এ দিন এই আন্তর্জাতিক সংস্থার ১৪ তম অধিবেশন শুরু হল শহরে৷ এই প্রথমবার সংস্থার অধিবেশন হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়৷ উদ্যোক্তা ক্যলকাটা রিসার্চ গ্রুপের কর্তা অধ্যাপক রণবীর সমাদ্দার বলেন, 'এর ফলে বোঝাই যাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অফ ফোর্সড মাইগ্রেশন এই অঞ্চলে জোর করে মানুষকে শরণার্থী বানানোর সমস্যাকে গুরুত্ব দিচ্ছে৷ সম্ভবত, দেশভাগের ফলে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই কলকাতা শহর৷ ১৯৭১-এর পরে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাংলাদেশ থেকে এখানে এসেছে আশ্রয়ের খোঁজে৷ কলকাতা তাই আক্ষরিক অর্থেই শরণার্থীদের শহর৷' দেশভাগ ছাড়াও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্যও যে বহু মানুষ রাতারাতি ভিটে-বাড়ি চ্যত হচ্ছে তাও উল্লেখ করেছেন রণবীরবাবু৷ আমাদের দেশে এখনও বহু পরিবার যে রাতারাতি শরণার্থী হয়ে পড়ছে, তার একমাত্র কারণ এই উন্নয়নমূলক প্রকল্প৷ যে কোনও প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য জমি দরকার৷ ফলে জমি-বাড়ি হারাচ্ছে মানুষ৷
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অফ ফোর্সড মাইগ্রেশনের প্রেসিডেন্ট ক্রিশ ডোলানের কথায়, দেশভাগের ফলেই কলকাতার জনসংখ্যা এত বেশি৷ এ দিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চে হাজির ছিলেন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দী, সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী প্রমুখ৷ চার দিনের এই অধিবেশন উপলক্ষে কলকাতায় এসেছেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা৷
মরিচঝাঁপির গণহত্যার বিচারের দাবি
ভারতভাগের জন্য আমরা দায়ী নই। পশ্চিমবঙ্গ কোনো রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রিদের পৈতৃক সম্পত্তি নয় -- তবে কেন আমরা বারবার উচ্ছেদ হচ্ছি? মরিচঝাঁপির উচ্ছেদ হওয়া মানুষেরা আবারও সোচ্চার হল। ৩১ জানুয়ারি মরিচঝাঁপি দিবস উদযাপন করল মরিচঝাঁপি সংগ্রাম সমিতি কলকাতার ভারতসভা হলে। ওই সমস্ত উদ্বাস্তু মানুষেরা পশ্চিমবাংলার বুকে অবর্ণনীয় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। যারা তাদের পুনর্বাসনের দাবিসহ দণ্ডকারণ্যে গিয়ে যারা পুনর্বাসন পান নি, তাদের পুনর্বাসন সহ মরিচঝাঁপিতে যাদের মত্যু হয়েছে, যারা পঙ্গু হয়ে রয়েছে সেই সমস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণ, হত্যাকারী ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবিতে এবং উদ্বাস্তুদের অনুপ্রবেশকারীর তকমা লাগিয়ে হয়রানি এবং উৎখাতের চক্রান্তের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগ্রাম গড়ে তুলবেন বলে জানান মরিচঝাঁপি সংগ্রাম সমিতি।
পূর্ব পাকিস্থান থেকে পিঁপড়ের সারির মতো আগত, শুধু বেঁচে থাকার আর্তি সম্বল করে উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছিল। এইসব ছিন্নমূল মানুষগুলোর বাসস্থান কোথায় হবে, দণ্ডকারণ্যে না আন্দামানে তা নিয়ে সরব হয়েছিল বামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতারা। পশ্চিমবঙ্গেই ওইসব বাঙ্গালিদের পুনর্বাসনে অসংখ্য উদ্বাস্তু কলোনি গড়ে উঠেছিল। শুধু কলকাতা বা শহরতলির আশপাশেই নয়, উত্তরবঙ্গের বহু জায়গাতেই স্থান হয়েছিল তাদের। তারপরেও স্থান সঙ্কুলান করা যায়নি। আন্দামান দ্বীপ কিছুতেই নয়, অতএব বহু পরিবারকে সরকার পাঠিয়েছিল দণ্ডকারণ্যে। কেন্দ্রীয় সরকার দণ্ডকারণ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হাতে দায় সঁপে দিয়েছিল এইসব নিম্নবর্গীয় বাঙ্গালি উদ্বাস্তুদের। ১৯৬৪ সালের পর থেকেই বেশ কিছু পরিবার দণ্ডকারণ্য ত্যাগ করে, সম্ভবত তারাই মরিচঝাঁপিতে প্রথম আগত উদ্বাস্তু মানুষ। ১৯৭৯ সালের ৩১ জানুয়ারি মরিচঝাঁপির অসহায় নিরন্ন অভুক্ত উদ্বাস্তুদের ওপর রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ গুলি চালিয়ে গণহত্যা ঘটায়। ওই দিনের সভার বক্তাদের কথায় বিবরণে সেদিনের ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও অত্যাচারের বর্ণনা শুনে উপস্থিত নাগরিক মানুষদের হাড় হিম হয়ে আসে। বক্তাদের মধ্যে কেউ কেউ মরিচঝাঁপির ঘটনাকে জালিয়ানওয়ালাবাগের থেকেও বেশি ভয়াবহ বলে মনে করেন। কারণ জালিয়ানওয়ালাবাগে জেনারেল ডায়ার পার্কের গেট বন্ধ করে গুলি চালিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা ঘটায়, এ ঘটনা ছিল তাৎক্ষণিক। মরিচঝাঁপিতে ১৯৭৯ সালের ২৬ থেকে ৩১ জানুয়ারি 'গরিবের স্বার্থরক্ষাকারী' জ্যোতি বসুর সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে, পানীয় জল ও খাবারের সরবরাহ বন্ধ করে দ্বীপে। কয়েকদিন পরেই মরিচঝাঁপির দিকে শুরু হয়ে যায় অনাহারে মৃত্যুর মিছিল। অনাহারের জ্বালায় অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে মানুষের মত্যু ঘটে। বেশ কিছু উদ্বাস্তু কুমীরমারির দিকে খাদ্য সংগ্রহ করতে গেলে সেখানেই উদ্বাস্তুদের গুলি করে মারা হয়। গুলিতে স্থানীয় আদিবাসী মহিলা মেনি মুন্ডার মৃত্যু হয়। অবশেষে ৩১ জানুয়ারি রাজ্য সরকার দেশভাগের বলি অসহায় উদ্বাস্তুদের ওপর গুলি চালিয়ে রক্তস্নান করে। পূর্বে ১৭ মে হাই কোর্টের আদেশ অগ্রাহ্য করেই খাদ্য পানীয় জল বন্ধ করা হয়েছিল। নৌকা ডুবিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হয়েছিল তারা। ঠিকানাহীন উদ্বাস্তুদের মৃতদেহগুলি গায়েব করা হয়েছিল বলেও অভিযোগ জানায় বক্তারা। এই ঘটনায় নিহতদের পরিবারগুলির আহত বিকলাঙ্গরা এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা আজও জীবিত। সেদিনের সেই মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে তারাই আজ গড়ে তুলেছে মরিচঝাঁপি সংগ্রাম সমিতি।
বক্তারা মরিচঝাঁপি গণহত্যার নায়ক তথাকথিত জননেতা জ্যোতি বসুকে কোনদিনও ক্ষমা করতে পারবেন না বলে জানান। ভারতসভা হলের সেদিনের সভায় মরিচঝাঁপির সংগ্রামী মানুষদের সংহতি জানাতে উপস্থিত ছিল সর্বস্তরের মানুষেরা।
বাংলা ভাগ : দায় কার
এবার আরেক টুকরো স্মৃতির কথা বলতে চাই। এই স্মৃতিটি অত্যন্ত মূল্যবান। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের স্থপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার সুগন্ধা কার্যালয়ে এক সন্ধ্যায় প্রায় ঘণ্টা তিনেক আলাপ হয়েছিল। অনেক প্রসঙ্গেই তিনি খোলামেলা অনেক কথা বলেছিলেন। তার সঙ্গে দেখা হতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মওলানা সাহেব (মওলানা ভাসানী) কী বলেন। আমার জবাব ছিল, আমার চেয়ে আপনিই তো ভালো জানেন। তিনি তো বলছেন বাংলাদেশ অসম্পূর্ণ। এখনও ১৪টি জেলা বাংলাদেশের বাইরে রয়ে গেছে। ওগুলো বাংলাদেশে এলেই বাংলাদেশ সম্পূর্ণ হবে। আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, এ ব্যাপারে আপনার মত কী। তিনি অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললেন, স্লোগানটা প্রিমেচিউর। আগে ওদের দিল্লি থেকে বের হয়ে আসতে দে। তারপর ভেবে দেখব ওদের নেয়া যায় কিনা। তার চিন্তা-ভাবনায় কোনো অস্বচ্ছতা ছিল না। বাঙালির ঐক্য তার কাছে বাংলাদেশের স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তা বিলীন করে ভারতের বাঙালিদের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া নয়। কোনো দূরভবিষ্যতে বাংলা ভাষাভাষীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রশ্ন উঠলে তার জন্য যে প্রাথমিক শর্তটি পূরণ করতে হবে, তা হলো যেসব বাংলা ভাষাভাষী দিল্লির কর্তৃত্বাধীন রয়েছে তাদের সেই কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হওয়া। অন্যথায় এই ঐক্যের কথা ভাবাই যায় না। যদি অন্য বাংলাভাষীরা দিল্লির কর্তৃত্বমুক্ত হয় তাহলেও শেখ মুজিবুর রহমান তাদের তাত্ক্ষণিকভাবে বরণ করে নেয়ার কথা ভাবেননি। তিনি বলেছিলেন, তারপর দেখব ওদের নেয়া যায় কি-না। বাংলাভাষীদের জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে আমাদের প্রাজ্ঞ নেতাদের মধ্যে চিন্তার পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট। কেন এই পার্থক্য তা নিয়ে খুব গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা হয় কিনা সন্দেহ আছে। মওলানা ভাসানী কী কারণে সেই ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে অসম্পূর্ণ বলেছিলেন, তা ভাসানী অনুসারীরা তার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল কি-না তা আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশের ৪০ বছর পূর্ণ হওয়ার ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে একথা উপলব্ধি করা কারোর জন্যই কঠিন নয় যে, বাংলাদেশের ওপর ভারতের আগ্রাসী থাবার ছোবল ক্রমাগতই বিষময় হয়ে উঠছে। মওলানা ভাসানী সেদিন এমন কথা উচ্চারণ করে প্রকারান্তরে যা বলতে চেয়েছেন তা হলো, ভারতের আগ্রাসী থাবার বিরুদ্ধে প্রয়োজনে প্রতিরোধাত্মক কৌশল হিসেবে সমগ্র বাংলাভাষীকে নিয়ে দিল্লির কর্তৃত্বমুক্ত বৃহত্তর বাংলা গঠনের স্লোগান উঠতে পারে। আমি অবশ্য ব্যক্তিগতগতভাবে এই সম্ভাবনা নাকচ করি। গণচীনের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এক সময় বলেছিলেন, পৃথিবীর তাবত্ বিভক্ত জাতি একদিন ঐক্যবদ্ধ হবে। তার সেই ভবিষ্যদ্বাণী ফলেছে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম এবং পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির একত্রীকরণের মধ্য দিয়ে। এখনও গণচীন ও তাইওয়ানের একত্রীকরণ এবং উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার একত্রীকরণ সম্ভব হয়নি। তবে রাজনৈতিক পর্যায়ে এসব একত্রীকরণের প্রয়াস আছে। কিন্তু বাংলাভাষীদের একত্রীকরণ আমার কাছে অলীক স্বপ্নমাত্র মনে হয়। এর কারণ বহুবিধ। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু ভদ্রলোকদের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য তীব্র গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তাদের বিক্ষুব্ধ হওয়ার মূল কারণ ছিল, পূর্ববঙ্গের হতদরিদ্র কৃষককুলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ হারানোর আশঙ্কা। সেদিন বাংলাদেশকে মায়ের অঙ্গচ্ছেদের সঙ্গে তুলনা করেছিল হিন্দু ভদ্রলোকরা। ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা দেয়া হয়। হিন্দু ভদ্রলোক নেতৃত্বের উদ্যোগে দিনটি 'শোক দিবস' হিসেবে পালন করা হয় এবং কলকাতায় ফেডারেল হলের শিলান্যাস করা হয়। এই ফেডারেল হলেই পরবর্তীকালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো। ১৬ অক্টোবরের সভা থেকে স্বদেশি আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় এবং বঙ্গভঙ্গবিরোধীরা 'বন্দেমাতরম'কে রণধ্বনি হিসেবে গ্রহণ করে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রধান নেতারা ছিলেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মতিলাল ঘোষ, আনন্দমোহন বসু, রমেশচন্দ্র দত্ত, বিপীনচন্দ্র পাল, অশ্বিনী কুমার দত্ত, অম্বিকাচরণ মজুমদার ও একে মিত্র। এই প্রসঙ্গে কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ লিখেছেন, 'উভয় বঙ্গের মুসলমানদের ভেতর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধ আন্দোলনে খুব অল্প সংখ্যক মুসলমান যোগ দিয়েছিলেন। তাদের ভেতর মিস্টার আবদুর রসুল (ব্যারিস্টার), আবদুল হালীম গজনবী (পরে স্যার আবদুল হালীম গজনবী), মৌলভী মনিরুজ্জামান ইসলাম আজাদী, মৌলভী কাজেম আলী (কাজেম আলী মাস্টার নামে খ্যাত ছিলেন), সৈয়দ ইসমাইল হোসাইন সিরাজী, বর্ধমানের মৌলভী আবুল কাশেম, মৌলভী মুজিবুর রহমান (দি মুসলমান নামক ইংরেজি সাপ্তাহিকের সম্পাদক), মৌলভী মুহম্মদ আকরম খাঁ (তখন ঢাকার 'আজাদ' পত্রিকার মালিক), পাটনার মিস্টার আলী ইমাম (পরে স্যার আলী ইমাম), তার ভ্রাতা মিস্টার হাসসান ইমাম, মিস্টার মুজহারুল হক ব্যারিস্টার (পরে পাটনার সাদাকত আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা), মৌলভী লিয়াকত হোসাইন, ডাক্তার আবদুল গফুর সিদ্দিকী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
আমি বঙ্গভঙ্গের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কোনো আন্দোলনেই যোগ দিইনি। তখন আমার যে বয়স ছিল তাতে কোনো এক পক্ষে যোগ দিলে আমার জন্য তা মোটেই বেমানান হতো না। আমার বয়সের ছেলেরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। তবে সাম্প্রদায়িক কোনো ব্যাপারে আমি একেবারেই যোগ দিইনি একথা বললে সত্যের অপলাপ করা হবে! বিশেষ মুসলিম দাবি-দাওয়ার সভা-সমিতিতে আমি যোগ দিয়েছি। আমি সে সময়ে ধার্মিক মুসলমান ছিলাম। দিনে পাঁচবার নামাজ না পড়লেও রমজানের পুরো মাস উপবাস করতাম।'
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তার 'আমার সোনার বাংলা' গানটি ৭ সেপ্টেম্বর ১৯০৫ (২২ ভাদ্র ১৩১২) সঞ্জিবনী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ৭ আগস্ট ১৯০৫ কলকাতা টাউন হলের সভায় এই গানটি বাউল সুরে গীত হয়েছিল। বর্তমানে এই গানটিই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গে ক্ষুব্ধ ও আবেগাপ্লুত হয়ে আরও অনেক গান ও প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তিনি লিখলেন, 'বাঙালির প্রাণ বাঙালির মন/বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন/এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।' এটিই ছিল বিখ্যাত 'রাখিসঙ্গীত'। তিনি আরও লিখলেন, 'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!/ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফেরে!/তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে\' জননীরূপী বাংলাদেশের এই অপরূপ ছবি আমাদের মনে স্বদেশপ্রীতির অনুভবকে জাগ্রত করে। এই গানটি স্বদেশপ্রেমের গান হিসেবে বাংলাদেশের নানা অনুষ্ঠানে দরদভরা কণ্ঠে গীত হয়। এই গানটিও রচিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে উজ্জীবিত করতে। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ লিখলেন—'ও আমার দেশের মাটি', 'সার্থক জন্ম আমার' ইত্যাদি। কিন্তু অচিরেই রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করলেন, বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে মুসলমানদের উত্সাহিত বোধ করার কোনো কারণ নেই। তিনি তার 'ব্যাধি ও প্রতিকার' প্রবন্ধে লিখলেন—"আজ আমাদের ইংরেজি পড়া শহরের লোক যখন নিরক্ষর গ্রামের লোকের কাছে গিয়ে বলে, 'আমরা উভয়েই ভাই'—তখন এই ভাই কথাটির মানে সে বেচারা কিছুই বুঝিতে পারে না। যাহাদিগকে আমরা 'চাষাবেটা' বলিয়া জানি, যাহাদের সুখদুঃখের মূল্য আমাদের কাছে অতি সামান্য, যাহাদের অবস্থা জানিতে হইলে আমাদিগকে গভর্নমেন্টের প্রকাশিত তথ্যতালিকা পড়িতে হয়, সুদিনে দুর্দিনে আমরা যাহাদের ছায়া মাড়াই না, আজ হঠাত্ ইংরেজের প্রতি স্পর্ধা প্রকাশ করিবার বেলায় তাহাদের নিকট ভাই সম্পর্কের পরিচয় দিয়া তাহাদিগকে চড়া দামে জিনিস কিনিতে ও গুর্খার গুঁতা খাইতে আহ্বান করিলে আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দেহ জন্মিবার কথা। সন্দেহ জন্মিয়াও ছিল। কোন বিখ্যাত 'স্বদেশী' প্রচারকের নিকট শুনিয়াছি যে পূর্ববঙ্গে মুসলমান শ্রোতারা তাঁহাদের বক্তৃতা শুনিয়া পরস্পর বলাবলি করিয়াছে যে, বাবুরা বোধ করি বিপদে ঠেকিয়াছে। ইহাতে তাহারা বিরক্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু চাষা ঠিক বুঝিয়াছিল। বাবুদের স্নেহভাষণের মধ্যে ঠিক সুরটা যে লাগে না তাহা তাহাদের বুঝিতে বিলম্ব হয় নাই। উদ্দেশ্য সাধনের উপলক্ষে প্রেমের সম্বন্ধ পাতাইতে গেলে ক্ষুদ্র ব্যক্তির কাছেও তাহা বিস্বাদ বোধ হয়—সে উদ্দেশ্য খুব বড় হইতে পারে, হউক তাহার নাম 'বয়কট' বা 'স্বরাজ' দেশের উন্নতি বা আর কিছু।" রবীন্দ্রনাথের মতো মানবতাবাদী কবিও বুঝতে পেরেছিলেন, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে কোথায় একটা বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই জন্যই মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনে একাত্ম হতে পারেনি।
পরবর্তীকালের অভিজ্ঞতা আরও করুণ। ১৯৪৬-৪৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম এবং শরত্ বসু স্বাধীন-সার্বভৌম যুক্তবাংলা গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। যুক্তবাংলার পরিকল্পনাটি ছিল অনেকটা দিবাস্বপ্নের মতো। গান্ধী এই পরিকল্পনার প্রতি শর্তসাপেক্ষ অনুমোদন দিয়েছিলেন। গান্ধী নিজেই স্বীকার করেছেন, কংগ্রেস কার্যকরী কমিটি তাকে শরত্ বসুর পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করায় ভর্ত্সনা করে। সুতরাং তিনি এর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারে বাধ্য হন। কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেল বাঙালি হিন্দুদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, 'Bengal cannot be isolated from the Indian Union. Talk of a Sovereign Republic of Independent Bengal is a trap to induce the unwary and the unwise to enter the parlour of the Muslim League. The Congress working committee is fully aware of the situation in Bengal, and you need not be afraid at all. Bengal has got to be partitioned, if the non Muslim population is to survive.' এ ব্যাপারে প্যাটেল ও জওহরলাল নেহরুর মধ্যে চিন্তার কোনো পার্থক্য ছিল না। কংগ্রেস নেতা জেবি কৃপালনি আশরাফউদ্দীন চৌধুরীকে লিখেছিলেন, 'All that the Congress seeks to do today is to rescue as many as possible from the threatened domination of the League and Pakistan. It wants to save as much territory for a free Indian Union as possible under the circumstances. It therefore insist upon the division of Bengal and Punjab... I do not see what else Congress can do under the circumstances.' হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিও প্রবলভাবে বাংলাভাগের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার ইচ্ছার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল বাংলার হিন্দু জনগোষ্ঠী। তারা অবিভক্ত স্বাধীন বাংলায় মুসলিম কর্তৃত্বে বাস করার চেয়ে বৃহত্ ভারতের একটি রাজ্যের নাগরিক হওয়াই শ্রেয় মনে করেছেন। বাংলা ভাগ তাই অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। ১৯০৫-এ যারা বাংলা ভাগকে মায়ের অঙ্গচ্ছেদের সঙ্গে তুলনা করেছিল, তারাই আবার ১৯৪৭-এ মায়ের অঙ্গচ্ছেদের পক্ষেই দাঁড়াল। আমরা সত্যকে কঠিন বলি। এটি তেমনি এক সত্য ছিল।
বিশ্ববাঙালি সম্মেলনে পঠিত এক প্রবন্ধে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, 'রাজনৈতিক নানা কারণে এবং ইতিহাসের ঘটনাক্রমে প্রাচীন বাংলাদেশ এখন বিভক্ত। কিন্তু বাঙালির একাত্মতার ভিত্তি প্রধানত রাজনৈতিক নয়। সাহিত্য, কাব্য, সঙ্গীত এবং চিন্তানির্ভর সভ্যতার ঐক্যের জোর রাজনীতি থেকে কম নয়। তারই সঙ্গে আছে আমাদের সমাজ চেতনার চিন্তামুখী আলোপ-আলোচনা। তার প্রভাব রাজনীতির ওপর পড়বে না, এমনটি নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু সেই নৈকট্যের ভিত্তি একমাত্র রাজনীতিতে নয়। বিশ্ববাঙালির সম্মেলন সেই একতাটিকে আরেকটু বড় করবে। যেমন করেছিল ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের উত্সব।' পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত আরেক অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের আলোচনায় বললেন, 'ভূমি ভাগ করা যায়, মাকে ভাগ করা যায় না।' অমর্ত্য সেনকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, বাংলা ভাষাভাষীদের ঐক্যের ভিত্তি কেন মূলত রাজনৈতিক নয়। হিন্দু ভদ্রলোকদের রাজনীতি এবং পরবর্তীকালে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার জেদাজেদির ফলেই তো বাংলা ভাগ হয়েছে। শুধু গান গেয়ে, সাহিত্য আলোচনা করে কিংবা উচ্চমার্গের তত্ত্বদর্শনের ব্যবচ্ছেদে লিপ্ত হয়ে এই ভাগ মুছবে না। এই ভাগকে পরম ও চরম বলে মনে করা হয় বলেই অভিন্ন নদীর পানি আটকে দেয়া হয়, সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশীদের হত্যা করা হয় এবং বাংলাদেশের প্রতি উপহাস করে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পণ্যসামগ্রী নেয়ার জন্য বছরে ১ লাখ টাকা করে দেয়া হচ্ছে। বিভেদের এই মৌলিক কারণগুলো দূর না করে শুধু উত্সব অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে কী কাজে আসবে?
লেখক : অর্থনীতিবিদ
mahbub.ullah@yahoo.com
অবগুণ্ঠন উন্মোচন : আসিফ আরসালান
১৯৪৭ সালের ৩রা জুন বৃটিশ কমন্স সভায় প্রাইম মিনিস্টার এবং লর্ডসভার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাঞ্জাব ও বাংলা বিভক্তির পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় বলা হয় যে, ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের যেসব প্রদেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে সেই সব এলাকা নিয়ে গঠিত হবে স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান। হিন্দু প্রধান প্রদেশগুলো নিয়ে গঠিত হবে ভারত। অবশ্য এর সাথে আবার ভৌগোলিক সংলগ্নতার একটি শর্তও জুড়ে দেয়া হয়। তখন পশ্চিমাঞ্চলে পাঞ্জাব এবং পূর্বাঞ্চলে বাংলা অবিভক্ত ছিলো। বাংলা এবং পাঞ্জাব উভয় প্রদেশেই ছিলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সুতরাং সমগ্র অবিভক্ত পাঞ্জাব এবং সমগ্র অবিভক্ত বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সেটি হয়নি। পাঞ্জাব ভাগ হয়ে হলো- পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব পাঞ্জাব এবং বাংলা ভাগ হয়ে হলো পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা। পাঞ্জাবের আলোচনা আজ এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। তাই আমরা বাংলা বিভক্তির মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি। সেদিন যদি বাংলা অবিভক্ত থাকতো তাহলে ১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশ পেলাম তার মধ্যে আজকের ভারতীয় বাংলা অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গেরও অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা ছিলো। কিন্তু সেটি হলো না। কেন হলো না? সেটি এখন অতীত দিনের কথা। সেই কথাটি নিয়ে জাবর কেটে লাভ নাই। কারণ পশ্চিম বাংলা তো আর বাংলাদেশে যোগদান করে বৃহত্তর বাংলা গঠন করবে না। কিন্তু তারপরেও এই কথাটি আর কেউ তোলেনি, তুলেছেন মান্যবর হাইকোর্ট। তুলেছেন সপ্তম সংশোধনী বাতিলের রায় দেয়ার সময়। রায়ে ৭০ বছর আগের ইতিহাসে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। তাই তখনকার ইতিহাসকে তার সঠিক অবস্থানে নিয়ে আসা জাতির দায়িত্ব। প্রাসঙ্গিকভাবে একটি কথা বলে নেয়া প্রয়োজন। এটি ৭০ বছর আগের ইতিহাস। সেই ইতিহাস যারা অবলোকন করেছেন তারা যদি ইতিহাসের সাক্ষী হতে চান, তাহলে তাদের সেই সময় অন্তত ৩০ বছর বয়সী হতে হবে। সুতরাং ওই সময় যার বয়স হয়েছিলো ৩০ বছর আজ তার বয়স হবে ১০০ বছর। ১০০ বছর বয়সী অর্থাৎ শতায়ু কোনো ব্যক্তি বেঁচে আছেন কিনা জানি না। আর বেঁচে থাকলেও ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার মতো অবস্থা তার নেই। তাই আমাদেরকে পুরাতন দলিলপত্রের ওপরেই নির্ভর করতে হবে।
\ দুই \
১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয় মুসলিম লীগ। এর আগে ভারতের কেন্দ্রীয় সংসদ অর্থাৎ জাতীয় পরিষদের নির্বাচন হয়। এখানে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ছিলো ৩০টি আসন। এই ৩০টি আসনেই জয়লাভ করে মুসলিম লীগ। তারা মুসলমানদের মোট ভোটের ৮৬ শতাংশ ভোট লাভ করেন। প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ছিলো ৪৯৫টি আসন। এখানে মুসলিম লীগ লাভ করে ৪২৩টি আসন। পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং সীমান্ত প্রদেশেও মুসলিম লীগ বিপুল বিজয় লাভ করে। ভারতবর্ষের অন্যান্য হিন্দু প্রধান প্রদেশে কংগ্রেস বিপুল বিজয় লাভ করে। এই দু'টি নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রধান নির্বাচনী ইস্যু ছিলো ভারতের স্বাধীনতা এবং ভারতকে অখন্ড রাখা। পক্ষান্তরে, মুসলিম লীগের প্রধান নির্বাচনী ইস্যু ছিলো মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা, যার নাম হবে পাকিস্তান। এই নির্বাচনের মাধ্যমে এই বিষয়টি শুধুমাত্র প্রমাণিত নয়, রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো যে, সারা ভারতে হিন্দুদের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন হলো কংগ্রেস এবং মুসলমানদের রাজনৈতিক সংগঠন হলো মুসলিম লীগ। মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা হলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। এই ঘটনা পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ১৯৭০ সালের কেন্দ্রীয় নির্বাচনের সাথে অনেকটা মিলে যায়। ওই নির্বাচনে প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তান পিপল্্স্ পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এবং জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো সেই দলের নেতা। পক্ষান্তরে, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক সংগঠন এবং জনাব শেখ মুজিবুর রহমান সেই রাজনৈতিক দলের অবিসংবাদিত নেতা।
১৯৪৬ সালের নির্বাচনটি ছিল ভারতের উত্তর পশ্চিম ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সপক্ষে জনগণের রায়। পূর্বাঞ্চলে বাংলা ছিলো অখন্ড। অখন্ড বাংলায় মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং মুসলিম লীগ নেতা জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। বিরোধী দলে বসে কংগ্রেস। প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন বাবু কিরণ শংকর রায়। সংসদের বাইরে প্রাদেশিক কংগ্রেসের নেতা ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর আপন ভাই শরৎ চন্দ্র বসু। অন্যদিকে শাসক দল মুসলিম লীগের প্রাদেশিক শাখা অর্থাৎ বেঙ্গল মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন জনাব আবুল হাশিম। সেই সময় অবিভক্ত বাংলায় মোট জনসংখ্যার ৫৫.২৯ শতাংশ ছিলেন মুসলমান। অবশিষ্ট ৪৪.৭১ শতাংশ ছিলেন হিন্দু। সুতরাং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জনাব সোহরাওয়ার্দী এবং মুসলিম লীগ নেতা জনাব আবুল হাশিম লাহোর প্রস্তাবের আলোকে স্বাধীন সার্বভৌম যুক্তবাংলা বা অখন্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন। তার এই আন্দোলনে তাকে সক্রিয় সমর্থন দান করেন কংগ্রেস নেতা শরৎ চন্দ্র বসু এবং সংসদের অভ্যন্তরে বিরোধী দলীয় নেতা বাবু কিরণ শংকর রায়। সোহরাওয়ার্দী তার স্বাধীন সার্বভৌম অখন্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য তার নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নার নিকট থেকে অনুমোদন চান। সমগ্র মুসলিম লীগের তরফ থেকে নেতা মিঃ জিন্নাহ তৎক্ষণাৎ স্বাচ্ছন্দ্যে স্বাধীন সার্বভৌম অবিভক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অনুমতি প্রদান করেন। মিঃ জিন্নার এই অনুমোদনের ফলে বাংলার মানুষের মাঝে এই মর্মে বিপুল আশাবাদের সঞ্চার হয় যে, ভারত বর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চলে হয়তো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।
\ তিন \
সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কংগ্রেসেরও অনুমোদনের প্রয়োজন ছিলো। সেই অনুযায়ী প্রাদেশিক অর্থাৎ বঙ্গীয় কংগ্রেসের তরফ থেকে দিল্লীতে কংগ্রেস হাই কমান্ডের কাছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সমর্থনদানের জন্য কংগ্রেস নেতা পন্ডিত নেহেরুকে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু জনগণের নেতা বলে পরিচিত কংগ্রেসের অবিসংবাদিত নেতা পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু কিরণ শংকরের কাছে যে পত্র দেন সেই পত্র প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলার মানুষের, বিশেষ করে জনাব সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের স্বপ্ন ভেঙ্গে চূরমার হয়ে যায়। ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ দিল্লী ও কলিকাতা থেকে যুগপৎ প্রকাশিত ইংরেজী দৈনিক 'স্টেটসম্যানে' ওই পত্রটির ফটোকপি ছাপা হয়। বাংলাদেশে একই বছরের ১১ আগস্ট অধুনালুপ্ত ইংরেজী দৈনিক 'বাংলাদেশ টাইমসে' ওই ফটোকপিটি পুনঃমুদ্রিত হয়। পন্ডিত নেহেরুর ওই পত্রটি নিম্নে হুবহু তুলে দেয়া হলো।
New Delhi
17.5.47
My dear Kiran,
We are gradually or rather rapidly approaching the state of final decision in regard to our immediate future and we should be quite clear in our minds as to what our attitude should be. I am certain that the various proposals put forward by Suhrawardy for a limited, independent Bengal plus joint electorates plus fifty-fifty are dangerous from the point of view of both Bengal and India. Those or similar proposals can only be accepted on the basis of union with India. On any other basis they will lead to infinite troubles and for greater difficulties in the way of future union with India. You will remember the talk we had at Maulana's place sometime back. I hold to that and I am more convinced than ever that we must stick to our guns. If there is no union of Bengal as a whole into India, then there must be a partition of Bengal, and Western Bengal must join the union : This will surely lead to East Bengal also joining the Union before long.
In the crucial days to come I hope, Congressmen in Bengal will hold fast together and stand for this position.
I am entirely opposed to the stand of Calcutta being a so-called free city.
Yours sincerely
Jawaharlal Nehru
চিঠির বাংলা অনুবাদ :
নয়াদিল্লী
১৭ই মে ১৯৪৭
প্রিয় কিরণ,
আমাদের আশু ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে আমরা ধীরে ধীরে, বরং বলা যায় দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছি।' এখন আমাদের মনে এ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার যে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে। আমি এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত যে, জনাব সোহরাওয়ার্দী যে সমস্ত প্রস্তাব ইতোমধ্যে উত্থাপন করেছেন সেগুলো ভারত এবং বাংলার ভবিষ্যতের জন্য খুবই বিপজ্জনক। জনাব সোহরাওয়ার্দী উত্থাপিত প্রস্তাবসমূহের মধ্যে রয়েছে স্বাধীন বাংলা, যুক্ত নির্বাচন এবং ৫০:৫০ অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বের সংখ্যা সাম্য। জনাব সোহরাওয়ার্দীর এসব প্রস্তাব গ্রহণ করা যেতে পারে যদি বাংলা ভারতের সাথে যোগ দেয়। ভারতের সাথে যোগ না দিয়ে অন্য যে কোন ভিত্তিতে এসব প্রস্তাব যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে বাংলা কর্তৃক ভবিষ্যতে ভারত ভুক্তির পথে আরো বড় ধরনের অসুবিধা এবং অনন্ত সমস্যার সৃষ্টি হবে। মওলানা সাহেবের বাসভবনে কিছু দিন আগে আপনার সাথে আমার যে কথা হয়েছিল সে সব কথা হয়তো আপনার মনে আছে। আমি এখনও আমার ওই মতের প্রতি অবিচল। এখন আগের চেয়েও আমার আরো বেশী করে বিশ্বাস হচ্ছে যে, আমাদের দাবির প্রতি আমাদের অনড় থাকতে হবে। যদি সমগ্র বাংলা-ভারতের সাথে যোগ না দেয় তাহলে বাংলাকে ভাগ করতেই হবে এবং পশ্চিমবঙ্গকে অবশ্যই ভারতে যোগ দিতে হবে। যদি এটা ঘটে অর্থাৎ বাংলা ভাগ হয় এবং পশ্চিম বাংলা ভারতে যোগ দেয় তাহলে আর বেশী দিন লাগবে না যেদিন পূর্ববঙ্গও ভারতে যোগ দেবে।
আমি আশা করি আগামী দিনের সংকট সন্ধিক্ষণের মুহূর্তগুলোতে বাংলার কংগ্রেস সদস্যরা আরো বেশী করে ঐক্যবদ্ধ হবেন এবং এই দাবির প্রতি অবিচল থাকবেন।
কলকাতাকে তথাকথিত ফ্রি সিটি বা মুক্ত নগরী করার দাবির আমি সম্পূর্ণ বিরোধী।
আপনার-
জওহরলাল নেহেরু।
যদি সেদিন সোহরাওয়ার্দী বর্ণিত বৃহত্তর বাংলা গঠিত হতো তাহলে আজকের বাংলাদেশও গঠিত হতো ওই অখন্ড বাংলা নিয়েই। কেন হল না? মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বনগাঁও, বশিরহাট, বারাসাত, পার্বত্য ত্রিপুরা, জলপাইগুঁড়ি, কুচবিহার, সিলেটের করিমগঞ্জ এবং আসামের কাছাড়, হাইলকান্দি ও ধুবড়ি ছাড়া পোকায় খাওয়া পূর্ব বাংলা আমরা পেলাম কেন? পেলাম এ জন্য যে, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নিজেদেরকে প্রথমে বাঙ্গালী হিসেবে গণ্য করেনি। প্রথম বিবেচনায় এনেছে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অর্থাৎ তারা হিন্দু। এবং সেই হিন্দুত্ব বিশাল ভারতের অবশিষ্টাংশের সাথে অধিকতর একাত্মতা বোধ করেছে। করেছে বলেই বাঙ্গালী হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে অর্থাৎ হিন্দু হওয়ার কারণে তারা বৃহত্তর বাংলায় শামিল হয়নি। বরং যশোর, দিনাজপুরসহ অনেক জেলাকে কর্তন করেছে। '৪৭ সালে খন্ডিত বাংলার একাংশ যোগ দিল পাকিস্তানে, অপর অংশ ভারতে।
\ চার\
পন্ডিত নেহেরুর এই পত্রের পর আর নতুন করে কিছু বলার থাকে না। কংগ্রেস হাইকমান্ডের এই নির্দেশ আসার পর সারা পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায় সভা সমিতি করে যুক্তবাংলার বিরুদ্ধে এবং বাংলাকে ভাগ করার পক্ষে অসংখ্য মিছিল করেন এবং কয়েকশত জনসভা করেন। আজকের এই লেখাটি বড় হয়ে যাচ্ছে বলে ওই সব তথ্য এখানে সন্নিবেশ করা সম্ভব হলো না। তবে শেষ করার আগে শুধু একটি কথা বলতে চাই। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলো যদি পূর্ববাংলা অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা হয়, তাহলে পশ্চিম দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ এবং নদীয়া বাংলাদেশে যুক্ত হলো না কেন? ব্রিটিশ সরকারের ৩রা জুনের ভারত বিভক্তি প্ল্যান অনুযায়ী অবিভক্ত ভারতের যেসব এলাকা নিয়ে সেদিনের পূর্ব বাংলা বা আজকের বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার কথা ছিল সেগুলো হলো- ১. চট্টগ্রাম, ২. বরিশাল, ৩. নোয়াখালী, ৪. ফরিদপুর, ৫. ঢাকা, ৬. পাবনা, ৭. বগুড়া, ৮. রাজশাহী, ৯. রংপুর, ১০. ময়মনসিংহ (টাঙ্গাইলসহ) ১১. দিনাজপুর (ভারতীয় দিনাজপুরসহ) ১২. মালদহ, ১৩. মুর্শিদাবাদ, ১৪. নদীয়া, ১৫. যশোর (বনগাঁওসহ), ১৬. কুমিল্লা (ত্রিপুরা জেলা), ১৭. সিলেট (করিমগঞ্জসহ), ১৮. আসামের কাছাড়, ধুবড়ী ও হাইলাকান্দি। কিন্তু আমরা বনগাঁ, বশিরহাট, বারাসাত, করিমগঞ্জ, কাছাড়, ধুবড়ী, হাইলাকান্দি প্রভৃতি মহকুমা/অঞ্চল পাইনি। কেন পাইনি? সেটি একটি লম্বা কাহিনী। আজ শুধু এটুকু বলা যায় যে, এগুলো ছিলো আমাদের ন্যায্য পাওনা। কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন, স্যার সিরিল র্যা ডক্লিফ এবং নেহেরু প্যাটেল চক্রের ষড়যন্ত্রে আমাদেরকে সেই সব এলাকা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
ওপরে যতোগুলো কথা বলা হলো তার সবগুলোর সপক্ষে আমাদের কাছে গবেষণালব্ধ ঐতিহাসিক দলিলপত্র রয়েছে। আজকের সংবাদপত্রে প্রকাশিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের একটি মন্তব্য দিয়ে শেষ করছি। তিনি বলেছেন, সরকারের সব কাজে উচ্চ আদালত নাক গলাবে কিনা সেটি তাদেরকে আরেকবার ভেবে দেখতে হবে। নীতিনির্ধারণী কাজ হলো সরকারের, উচ্চ আদালতের নয়। বাংলাদেশেও ইতিহাসের সঠিক উপস্থাপন এবং রাজনৈতিক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজটি হলো গবেষক, ইতিহাসবিদ এবং রাজনীতিবিদদের, উচ্চ আদালতের নয়।
http://www.dailysangram.com/news_details.php?news_id=39137
১৯৪৭ সালে কেন অখন্ড বাংলা স্বাধীন না হয়ে পূর্ব পাকিস্তান হল?
১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিলে লর্ড মাউন্টবেটেন নিশ্চিত হন, জিন্নাহ যুক্ত বাংলা পরিকল্পনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না। ওই তারিখে বাংলার গভর্নর বারোসের কাছে এক টেলিগ্রামে তিনি বলেনঃ 'এটা ভুলবেন না যে আমার প্ল্যানে পাকিস্তান অথবা হিন্দুস্তানের অংশ নয় এমন একটি যুক্ত অথচ স্বাধীন বাংলার পথ খোলা রেখেছে। জিন্নাহ এই প্ল্যানের কোনো বিরোধিতা করবে না।' ('টপ সিক্রেট', Mansergh, vol. X,পৃঃ ৪৭২ দ্রঃ) মে মাসে অনুষ্ঠিত ভাইসরয়'স মিটিংয়ে 'ভাইসরয় বলেন ... মি. জিন্নাহ পাকিস্তান থেকে পৃথক একটি স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা অনুমোদন করেন।' (মাউন্টবেটেন পেপারস, ১৯৪৭ সালের ১ মে, Mansergh, vol. X,পৃঃ ৫১২ দ্রঃ) এমনকি ১৯৪৭ সালের মে মাসের প্রথম দিকে একটি স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য জিন্নাহর সম্মতি সম্পর্কে সোহরাওয়ার্দী নিঃসংশয় ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৭ মে 'টপ সিক্রেট' মাউন্টবেটেন পেপারসে উল্লেখ রয়েছেঃ 'মি. সোহরাওয়ার্দী তাকে (গভর্নর বারোসকে) বলেন, মি. জিন্নাহ বলেছেন যে তিনি একটি স্বাধীন বাংলার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে রাজি হবেন।' Mansergh, vol. X,পৃঃ ৬৫৭ দ্রঃ)
এসব বিষয় পর্যালোচনা করে গ্রন্থকার স্ট্যানলি ওয়ালপার্ট মন্তব্য করেন, 'জিন্নাহ একটি স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠাকল্পে আগ্রহসহকারে স্বাগত জানানোর জন্য তৈরি ছিলেন। কিন্তু নেহরু ও প্যাটেল এই পরিকল্পনাকে কংগ্রেস এবং ভারতীয় স্বার্থের পরিপন্থী বলে অভিসম্পাত বলে মনে করেন এবং ভয় করেন যে মুসলিম প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি যুক্ত 'বাংলাদেশ' ভারতের চেয়ে পাকিস্তানের সাথে নিবিড়তর সম্পর্ক স্থাপন করবে।' (জিন্নাহ অব পাকিস্তান, পৃঃ ৩২০) শীলা সেন তার গ্রন্থে প্রায় একই ধরনের মত প্রকাশ করেনঃ 'জিন্নাহ এই [যুক্ত বাংলার] পরিকল্পনার বিরুদ্ধাচরণ করেননি। কিন্তু কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ প্রথম থেকেই এর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলেন।' 'প্যাটেল ও নেহরুর বিরোধিতা ছিল জেদে পূর্ণ।' (মুসলিম পলিটিকস ইন বেঙ্গল, পৃঃ ২৪৩) 'বাংলার কংগ্রেস নেতাদের কাছে লিখিত বেশ কিছু পত্রে প্যাটেল এই পরিকল্পনাকে নিন্দা করেন। (পৃঃ ১৩০)
জিন্নাহ জানতেন যে বাঙালি হিন্দুরা মন-প্রাণ দিয়ে যুক্ত বাংলার সমর্থন করে না। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে জিন্নাহ বলেন, 'দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার বেশির ভাগ হিন্দু বাংলার বিভক্তি চায়।' Mansergh, vol. X, পৃঃ ৮৫২ দ্রঃ) ১৯৪৭ সালে জিন্নাহ বাংলায় রেফারেনডাম করার প্রস্তাব করলে ব্রিটিশ কেবিনেট ২০ মে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। Mansergh, vol. X, পৃঃ ৯২১-৯২২ দ্রঃ) ১৯৪৭ সালের ২৮ মে লর্ড মাউন্টবেটন লন্ডনে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ কেবিনেট মিটিংকে অবহিত করেন, জিন্নাহ তাকে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, তার পক্ষে বাংলার বিভক্তি মেনে নেয়া সম্ভব হবে না। Mansergh, vol. X, পৃঃ ১০১৪)
পক্ষান্তরে হিন্দু মহাসভা যুক্ত বাংলা সম্পর্কে প্রথম থেকেই একটি নেতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করে। নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি যুক্ত বাংলা পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলেন এবং ভাইসরয় লর্ড মাউন্টবেটনের কাছে তিনি একটি তীব্র প্রতিবাদ পাঠান। ২ মে তারিখে লিখিত একটি চিঠিতে তিনি লেখেন, 'একটি স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা সম্বন্ধে কিছু এলোমেলো কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এর ভাবার্থ আমাদের কাছে একেবারেই বোধগম্য নয় এবং আমরা এর সমর্থন কোনোভাবেই করি না। আমরা হিন্দুদের কাছে এই পরিকল্পনা কোনো উপকারে আসবে না।
স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা প্রকৃতপক্ষে একটি পাকিস্তানের রূপ নেবে... আমরা কোনোভাবেই ভারতের অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই না।' (মাউন্টবেটেন পেপারস Mansergh, vol. X,পৃঃ ৫৫৭ দ্রঃ) সোহরাওয়ার্দী জানতেন, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ছাড়াও হিন্দু মহাসভা যুক্ত বাংলা পরিকল্পনার পরম বিপক্ষে ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ মে ভাইসরয়ের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ঝমড় ঊ. গমপংমললপ-এর কাছে এক পত্রে সোহরাওয়ার্দী লেখেন, 'পার্টিশানের ব্যাপারে হিন্দু মহাসভা হিন্দুদের ধ্যান-ধারণাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।' (Mansergh, vol. X, পৃঃ ৮৩০ দ্রঃ)
বাঙালি হিন্দুরা তাদের দৃষ্টিতে মনে করে, ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে একজন মুসলমান অভিষিক্ত হওয়ার পর বাংলায় রাজনৈতিক প্রাধান্য এরা চিরদিনের জন্য হারিয়েছে। বাংলার কংগ্রেস তাদের তরফ থেকে যুক্ত বাংলা সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা চালানোর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে ভার দেয়নি অথবা কোনো সংস্থা স্থাপনা করেনি। যুক্ত বাংলা পরিকল্পনা কার্যকর না হওয়ার কারণগুলোর বিশ্লেষণ করে শীলা সেন তার গ্রন্থে বলেন, 'সম্পূর্ণ স্বাধীন বাংলা পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার' প্রথম কারণটি হচ্ছে 'কংগ্রেস নেতাদের পুরোপুরি বিরোধিতা'। (পৃঃ ২৪৩)
যুক্ত বাংলা পরিকল্পনাকে পুরোপুরি অকেজো করে দেয়ার জন্য বাঙালি হিন্দুরা বাংলার বিভক্তি দাবি করে। বাংলার বিভক্তি সম্পর্কে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের মিটিংয়ের আগে বাংলার কংগ্রেস এবং বাংলার হিন্দু মহাসভা বাংলার বিভক্তি দাবি করে। ১৯৪৭ সালের এপ্রিলের প্রথমভাগে প্রাদেশিক হিন্দু কনফারেন্স ঘোষণা করেঃ 'বাংলার হিন্দুদেরকে একটি শক্তিশালী জাতীয় সরকারের অধীনে একটি পৃথক প্রদেশ গঠন করতে হবে।' (অমৃতবাজার পত্রিকা), ৫ এপ্রিল, ১৯৪৭) ১৩ মে সর্দার প্যাটেল বাঙালি হিন্দুদের একজন নেতা কে সি নিয়োগিকে চিঠিতে লেখেনঃ 'সম্পূর্ণ স্বাধীন বাংলার দাবি একটি ফাঁদ, যাতে এমন কি কিরণ শংকরও শরৎ বাবুর সাথে পড়ে যেতে পারেন... বাংলার হিন্দুদের বাঁচানোর একমাত্র পথ বাংলার পার্টিশনের দাবি অব্যাহত রাখা এবং অন্য কিছুতে কর্ণপাত না করা... অমুসলমানদের বাঁচাতে হলে বাংলাকে ভাগ করতেই হবে।' (শীলা সেন, পৃঃ ২৪৪) নেহরু মনে করেন, যুক্ত বাংলা বাস্তবায়িত হলে তার দ্বারা বাঙালি মুসলমানরা বেশি উপকৃত হবে। তার নেতৃত্বাধীনে ভারতীয় কংগ্রেস এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করলে যুক্ত বাংলার জন্য সোহরাওয়ার্দীর স্বপ্নের যবনিকাপাত ঘটে। বাংলার সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় বাঙালি মুসলমানরা কখনো বাংলার বিভক্তিকরণ চায়নি। পক্ষান্তরে বাংলাকে ভাগ করার দাবি সম্পর্কে বাঙালি হিন্দুদের মনোভাব অমৃতবাজার পত্রিকা (৫ এপ্রিল, ১৯৪৭ এভাবে প্রকাশ করেঃ 'এটা শুধু পার্টিশনের প্রশ্ন নয়, এটা হিন্দুদের জীবন মরণের প্রশ্ন।'
ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রায় শেষ পর্যন্ত বাংলাকে ভাগ করার প্রশ্নে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কোনো স্থির সিদ্ধান্ত নেয়নি। অবশেষে বাংলার বিভক্তি সম্পর্কে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ১৯৪৭ সালের ১৭ মে সিদ্ধান্ত নেয়, বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদকে দু'টি অংশে মিলিত হওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হবে। মুসলিম সংখ্যাগুরু অধ্যুষিত জেলাগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করবে একটি অংশ এবং অপরটি করবে বাংলার অবশিষ্ট জেলাগুলো। বাংলাকে ভাগ করা হবে, কি হবে না এই মর্মে পরিষদের দু'অংশের সদস্যদের পৃথকভাবে বসে ভোট দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়। যেকোনো অংশের অধিকাংশ সদস্য যদি বাংলা বিভক্তির পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়, সে ক্ষেত্রে বাংলা ভাগ হবে। (সংশোধিত খসড়া ঘোষণা, ১৭ মে, ১৯৪৭ সাল, Mansergh, vol. X,পৃঃ ৮৮৪ দ্রঃ) বাংলার পার্টিশনের প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য পরিষদের সদস্যরা দু'টি ভাগে মিলিত হন। উচ্চবর্ণের হিন্দু সদস্যরা পার্টিশনের পক্ষে ভোট দেন, পক্ষান্তরে মুসলিম সদস্যরা ও তফসিলি সম্প্রদায়ের অনেকে পার্টিশন বিপক্ষে ভোট দেন।
১৯৪৭ সালের ২০ জুন লর্ড মাউন্টবেটনের কাছে গভর্নর বারোস এক টেলিগ্রাম প্রেরণ করে বাংলার বিভক্তি সম্পর্কে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে অনুষ্ঠিত ভোটের ফলাফল জানিয়ে বলেনঃ 'অদ্য অপরাহ্নে পশ্চিম বঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্যদের পৃথক মিটিংয়ে [পার্টিশনের] পক্ষে ৫৮ ভোট এবং বিপক্ষে ২১ ভোটে সাব্যস্ত হয় যে [বঙ্গ] প্রদেশকে বিভক্ত করতে হবে... অদ্য অপরাহ্নে পূর্ব বঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্যদের পৃথক মিটিংয়ে [পার্টিশনের] বিপক্ষে ১০৬ ভোট এবং পক্ষে ৩৫ ভোটে সাব্যস্ত হয় যে [বঙ্গ] প্রদেশকে বিভক্ত না করা হয়।' Mansergh, vol. XI,পৃঃ ৫৩৬ দ্রঃ) এভাবে বাঙালি হিন্দুদের ভোটে বাংলা দু'টি অংশে বিভক্ত হয়। একটি অংশ অর্থাৎ পশ্চিম বঙ্গ ভারতের সাথে যুক্ত হয় এবং অপর অংশটি অর্থাৎ পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানে যোগদান করে। ফলে যুক্ত বাংলার বাস্তবায়ন ইতিহাসে পর্যবসিত হয় এবং এ ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দীর আপ্রাণ উদ্যম ও আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নেই থেকে যায়। সময়ের স্রোতে পূর্ব বঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তান ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয়।
লেখকঃ ব্যা রি স্টা র সা লা হ উ দদী ন আ হ ম দ
sahmen97@hotmail.com
লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারেলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অতিথি অধ্যাপক।
http://www.dailynayadiganta.com/2007/10/08/fullnews.asp?News_ID=46264&sec=4
|
লিখেছেন জাতীয়তাবাদী শাহেদ ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১১, বিকেল ০৫:০৪ |
|
ফিরে দেখা
১৯৪৭, ১৪ই অগস্ট, রাত বারোটা, পূর্ব বঙ্গ হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তান
প্রতি দিন হু হু করে বাড়তে লাগল বঙ্গের পশ্চিম পারের জনসংখ্যা। নতুন পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে মানুষ চলে আসতে লাগলেন 'দেশান্তরে'। লক্ষ করার বিষয়, পশ্চিম ও পূর্ব, দুই পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুরা কিন্তু একভাবে এলেন না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যাঁরা এলেন, এলেন মোটামুটি একসময়েই। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ কিন্তু আসতে লাগলেন ঢেউয়ে ঢেউয়ে, বছরে বছরে। '৪০ - '৫০-এর দশক ছাড়িয়ে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরেও, এমনকি আজও সঙ্গোপনে নিয়ত বহমান সেই শরণার্থী-ধারা।
সে সময়ই, ১৯৪৮-এ, University Institute Hall-এ এক ভাষণে পশ্চিমবঙ্গবাসীর উদ্দেশ্যে ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার উচ্চারণ করেছিলেন এই মোক্ষম সাবধানবাণী:"I warn West Bengal - do not spurn away such a rich racial element when seeking shelter at your doors. They alone can make you great if you utilise these human materials." এ দিকের সাবেক বাসিন্দাদের মনে তখন মিশ্র অনুভূত। 'ওদের' জন্য সহমর্মিতা, আর নিজেদের জন্য ভবিষ্যতের ভয়। কিন্তু বিপন্নতার তাড়নায় যেন এই শরণার্থী-বেশে-আসা প্রতিশ্রুতিময় মানবসম্পদকে পশ্চিমবঙ্গ কৃপার চোখে না দেখে, দূরে ঠেলে না দেয়: এই কথাটিই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যদুনাথ।
না, পশ্চিমবঙ্গ দূরে ঠেলে দেয়নি। ধৈর্য ও সমব্যথার সঙ্গে এই শরণার্থী স্রোতকে জায়গা করে দিয়েছিল। কাজটা ছিল কঠিন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নামমাত্র সাহায্যের বেশি কিছু করেনি। পুরো দায়টাই বহন করেছিল সদ্যোজাত, সদ্যোবিভক্ত, অনভিজ্ঞ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। কেন্দ্রের ব্যবহারে আঞ্চলিক বৈষম্যও ছিল বৈকি। পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের যে অর্থ ব্যয়িত হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীর জন্য তার এক দশমাংশও হল না। তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের ভাষায়, পশ্চিমবঙ্গে আগত উদ্বাস্তুদের জন্য কেন্দ্রের খরচ - 'মাথাপিছু দুই বছরে কুড়ি টাকার বেশি নয়।'
প্রসঙ্গত, এমনিতেও বিরাট অর্থনৈতিক সংকটে ছিল সে দিনের পশ্চিমবঙ্গ। পাট ছিল প্রধান কৃষিজাত পণ্য। দেশভাগের সঙ্গে পাট-উত্পাদক অঞলগুলি বেরিয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গের নাগাল থেকে, পড়ে রইল কেবল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, ধুঁকতে থাকা কলকারখানা।
এই সামগ্রিক চাপের মধ্যেও উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের বিপুল দায় যে সে দিনের রাজ্য প্রশাসন পালন করতে পেরেছিল, কেননা এতে বড় একটা ভূমিকা নিল - সমাজ। কত মানুষ যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এগিয়ে এলেন সাহায্য করতে। প্রায় একটা সামাজিক আন্দোলন বলা চলে। যে আন্দোলনের ইতিহাস কখনও লেখা হয়নি, হয়তো হবেও না। কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নানারকম বাঙ্গালি মিলেমিশে যে একটা নতুন সমাজ তৈরি করে তুলল, তাকে প্রতি দিন সাংস্কৃতিক ভাবে সম্পন্ন করে চলল ঘটি-বাঙাল, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, চিংড়ি-ইলিশ বিতর্ক; বেকার সমস্যা বৃদ্ধি; পাড়ার রকের আড্ডার ক্রমবিকাশ; বামপন্থি সাহিত্য সংস্কৃতি কৃষ্টি।
ঐতিহাসিক ভাবে, আর দুটি বড় ঘটনা ঘটল ক্রমে। ভারতের communist party পশ্চিমবঙ্গে যে দ্রুত শক্তিশালী হয়ে উঠল, তার পিছনে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল এই উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, উদ্বাস্তু colony-এর মানবিকীকরণের কাজ। সবচেয়ে বড় communist সমর্থক বাহিনী তৈরি হয়ে উঠতে লাগল এই নতুন আশ্রিত জনগোষ্ঠির মধ্যে থেকে।
দ্বিতীয়ত, উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে গেল মেয়েদের জীবনে ৷ তীব্র অনটন, আর্থিক দুর্দশা এবং পারিবারিক চাপের মুখে বড় দ্রুত ভেঙ্গে গেল অন্তঃপুরের অবরোধ। বাঙ্গালি মেয়েরা আগেও চাকরি করত, সমাজসেবায় যোগ দিত, কিন্তু সে ছিল হাতে গোনা। ১৯৪৭-এর পর, পরিবারের সব ক'জন সদস্যের কাজের খোঁজে না বেরিয়ে আর উপায় থাকল না। বাঙ্গালি মেয়েদের কাছে নারীশিক্ষা তখন আর পোশাকি বিলাশ নয়, পরিবারকে দাঁড় করানোর একান্ত মলিন বাস্তবে বেরিয়ে পড়ার সিঁড়ি।
পাওয়া, হারানো, এবং নতুন অর্জন: ১৯৪৭, পশ্চিমবঙ্গের জন্য রেখে গেল আলাদা তিনটি উত্তরাধিকার।
http://talking-bird.blogspot.in/2007_04_17_archive.html
সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ত্বের সংকট এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা
দেশের আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলো বিপদগ্রস্ত। এই বিপদ হলো আত্মপরিচয়ের বিপদ। এই সংকট সৃষ্টির পেছনে আছে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্তর্গত শক্তিশালী মেকানিজম।
রামু, টেকনাফ, পটিয়া, উখিয়ায় বৌদ্ধ মন্দির, বিহার ও বসতিতে হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের খবর এখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু এর আগেও আরো অন্তত তিনটি ঘটনা ঘটেছে যেগুলো পত্রপত্রিকায় কম প্রচার পেয়েছে। কিছুদিন আগেই দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে হিন্দুদের বসতি্ ও উপাসনালয়ের উপরে হামলা হয়েছে। এ-বছরের মার্চ মাসে সাতক্ষিরাতে হিন্দুদের ঘর-বাড়ি, মন্দিরে আক্রমন করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে হামলা হয়েছে। রাঙ্গামাটি এবং কক্সবাজারেও সহিংস হামলার ঘটনা ঘটেছে। ইতোমধ্যে, প্রথম আলোর (২২/০৯/২০১২) খবর মারফত আমরা জানতে পেরেছি যে ২০০১-২০১১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমেছে ৯ লক্ষ (জনসংখ্যা ৯.২% থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৮.৫%)
এই একই সময়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে 'আদিবাসী' বিষয়ে একটি বিতর্কিত পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। আর ২০১২ সালে আদিবাসী দিবস পালনেই রাষ্ট্রযন্ত্র বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। মাঠে নেমেছে প্রতিক্রিয়াশীল-রক্ষণশীল বাঙ্গালি প্রতিনিধিত্বকারী, যারা বাঙ্গালি জাত্যাভিমানকে আধিপত্যবাদী মনোভাবের মাধ্যমে প্রয়োগ করছে। এই বলয়ের মূল ভাবনা হলো- এই রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডে কোন 'আদিবাসী' নেই। পাহাড় আদিবাসীদের নয়, জুম আদিবাসীদের নয়। এসব জায়গায় বাঙ্গালিদের "সম-অধিকার" নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরণের মানসিকতা যারা পোষণ করছে তাদের কাছে '১৯৯৭ পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি' একটি অন্যায় দলিল। সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে এই গোষ্ঠীর লোকজন যেসব তথ্য-উপাত্ত হাজির করছে সেগুলো ভ্রান্তিপূর্ণ। ঐতিহাসিক ও নৃবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে না গিয়ে, সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের ধার না ধেরে, এই গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারীরা আক্রান্ত করছে আদিবাসী নাগরিকদের।
জাতিসংঘ, আইএলও কনভেশনশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র অনুযায়ী 'আদিবাসী'র যে সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে সেই অনুসারে কোনমতেই বাঙ্গালি জনগণ 'আদিবাসী' নয়। বাঙ্গালি হিসেবে আমরা কোনভাবেই 'আদিবাসী' পরিচয় ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারি না। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পক্ষে যদি তাদের জাতি সংস্কৃতিগত বৈশিষ্টকে, ভাষার চর্চাকে অটুট রাখা সম্ভবপর না হয়ে থাকে, তাহলে আমরাই এই পরিণতির জন্য দায়ী। কাপ্তাই প্রকল্প থেকে শুরু করে পাহাড়ে বাঙ্গালি বসতি গড়ে তুলে আমরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে আঘাত করেছি। প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে, বন কেড়ে, ধর্মান্তকরণের মাধ্যমে যুগ যুগের ঐতিহ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে আমরা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছি। রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে আধিপত্যবাদী বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর দুর্বৃত্ত চক্র নানা সময়ে আদিবাসীদের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর আজ কেড়ে নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে তাদের 'আদিবাসী' পরিচয়টি।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইন ২০১২ এবং সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী (২৩ এর 'ক' ধারা: "ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী") আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎকে হুমকীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বৈচিত্রের মধ্যে বসবাস আমাদের। অথচ আমাদের সংবিধান সবাইকে বাঙ্গালি বানাতে চায়! কি ভয়াবহ! বাঙ্গালি ভাষার স্বীকৃতি পায়নি বলে লড়াই করেছে। নিপীড়িত হয়েছে বলে স্বাধীনতার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। আর এই জাতিই আজ রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে অন্যান্য জাতিসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে পারেনি এই চল্লিশ বছরে!
আজ যখন আদিবাসী জনগোষ্ঠী ১৫ বছর বিলম্বিত পার্বত্য শান্তিচুক্তি, সংবিধানের মধ্যে জায়গা খুঁজছে, তখন সম-অধিকার আন্দোলনের নামে পার্বত্য অঞ্চলে চলছে স্বার্থান্বেষী মহলের কর্মকান্ড। যারা নিপীড়নবাদী মানসিকতা নিয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পরিচয় সংকট তৈরি করছে, সংখ্যায় তারা কম কিন্তু প্রভাবশালী। এরা তারাই, যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আদিবাসীদের জমি কেড়ে নিয়েছে। এরা তারাই যারা, বাঙ্গালি সেটলারদের পাহাড়ে জোরপূর্বক আধিপত্য স্থাপন করেছেন গর্বিত বোধ করে। এরা তারাই যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তিকে গত ১৫ বছর ধরেও বাস্তবায়িত করতে দেয় নাই। দেশে যখন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে, তখন আদিবাসী জনগণের প্রতি যে নির্মম অত্যাচার এবং মানবতাবিরোধী অপরাধকর্ম সংঘটিত হয়েছে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে না কেন?
পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী আর বাঙ্গালি জনগণের ঐক্য-সংহতি স্থাপন করা অতি জরুরি। আত্মপরিচয় কেড়ে নিয়ে আমরা সেই ঐক্য-সংহতি ধবংস হতে দিতে পারি না। আমরা দাবি করি বৈচিত্র-বৈভবে সবাই একসাথে বাঁচি। সকলের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত হোক। ১৫ বছরের পুরোনো পার্বত্য শান্তি চুক্তি (১৯৯৭) অবিলম্বে বাস্তবায়ন হোক। সকল জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা হোক।
লেখকবৃন্দ
১. সারা হোসেন, আইনজীবী, সুপ্রীম কোর্ট।
২. খুশী কবির, সমন্বয়কারী, নিজেরা করি।
৩. আমেনা মহসীন, শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।
৪. গীতিআরা নাসরীন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৫. নাঈম মোহায়মেন, সম্পাদক, 'চিটাগাং হিল ট্রাকস্ ইন দি ব্লাইন্ড স্পট অফ বাংলাদেশ ন্যাশনালিজম।
৬. মেসবাহ কামাল, মহাসচিব, আদিবাসী বিষয়ক জাতীয় কোয়ালিশন।
৭. মানস চৌধুরী, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
৮. মির্জা তাসলিমা, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
৯. সায়েমা খাতুন, সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১০. সাদাফ নুর-এ ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১১. সাঈদ ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১২. জোবাইদা নাসরীন, সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৩. মাহমুদুল সুমন, সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
১৪. স্বাধীন সেন, সহযোগী অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
১৫. নাসরীন খন্দকার লাবনী, সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
১৬. শিরিন লিরা, আইনজীবী।
১৭. জান্নাত-ই-ফেরদৌসী, সাধারন সম্পাদক, রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট কালেকটিভ (আরডিসি)।
১৮. হানা শামস্ আহমেদ, লেখক।
১৯. সঞ্জীব রায়, গণমাধ্যমকর্মী।
দেশভাগের সাম্প্রতিক ইতিহাস চর্চার আলোকে 'দ্যা মার্জিনাল মেন'
Posted by bangalnama on December 22, 2010
No comments:
Post a Comment