ড. কামাল উদ্দীন আহমদ
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমার বয়স ছিল ১৪ বছর। সকাল থেকেই জিন্দাবাহারের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সেদিন সকাল থেকেই খবর পাচ্ছিলাম আজ পাক বাহিনী মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। সকাল থেকে ঢাকার আকাশে তখন মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমানের মহড়া চলছিল। ইচ্ছা হচ্ছিল ছাদে দাঁড়িয়ে জোরে চিৎকার করে বলি 'জয় বাংলা'। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম বাসার পাশের গলি থেকে এক রাজাকার বাঁশি বাজাচ্ছে, চিৎকার করে বলছে নিচে নেমে যাওয়ার জন্য। হয়তবা বুঝতে পেরেছিল যে আমি জয় বাংলার লোক, বাইরে কার্ফু, কার্ফু পাসও নেই। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম দূর আকাশে অনেক হেলিকপ্টার সাপের মতো দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাচ্ছে। আঁচ করলাম নিশ্চয়ই এগুলো মিত্রবাহিনীর হেলিকপ্টার রেসকোর্সের দিকে যাচ্ছে।
গত কয়েকদিনের আকাশযুদ্ধ হওয়ার সময় প্রতিবেশী অবাঙালীদের আচরণে বেশ উৎফুল্লতা লক্ষ্য করলাম। পাপ্পু নামে আমার এক অবাঙালী পরিচিত লোক বলেই ফেলল ৭ম নৌবহর চলে এসেছে। এবার আর পাকিস্তানী সৈন্যদের কোন অসুবিধা হবে না। এই অবাঙালীদের এক বৃহৎ অংশ দেশ বিভাগের পর ভারত থেকে এসেছিল এবং এদের বেশিরভাগই ছিল ইসলামপুর/পাটুয়াটুলির ব্যবসায়ী।
সন্ধ্যা নাগাদ আকাশে গুলি ছোড়ার প্রতিযোগিতায় আশস্ত হলাম যে যুদ্ধ শেষ। ঢাকা এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে। রেডিওতে মেজর হায়দারের কণ্ঠের কথা মনে আছে। লুঙ্গি পরেই জয় বাংলা বলতে বলতে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। রাজাকার আলবদর বা পাকবাহিনী কারও কথাই মনে ছিল না। একজন দু'জন হতে হতে অন্ধকারে জিন্দাবাহারের গলিতে অনেককেই পাওয়া গেল। এর পর শুধু জয় বাংলা, পদ্ম-মেঘনা-যমুনা তোমার-আমার ঠিকানা, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব বলতে বলতে একেবারে বাবুবাজারের মোড়ে অনেকটা মিছিল সহকারে চলে এলাম। খনিকটা ক্লান্ত হয়ে পরে বাসায় ফিরে গেলাম। সারারাত আকাশে ছোড়া গোলাগুলির আওয়াজে ঘুমই হলো না। খুব ভোরে আব্বা আমাকে নিয়ে একেবারে তেজগাঁও এয়ারপোর্ট। একদল শিখ সেনাদের সঙ্গে দেখা হলো। এক অফিসার র্যাঙ্কের সৈনিকের সঙ্গে আলিঙ্গন করে আব্বা বললেন 'আপলোক হামলোককো বাঁচায়া'। প্রতি উত্তরে তিনি বললেন 'উনলোককো কুত্তা খারাহে'। বুঝে নিলাম কতটা ঘৃণা পাক বাহিনীর প্রতি ওদের ছিল। তেজগাঁও বিমানবন্দরের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম এখনই যদি বঙ্গবন্ধু চলে আসতে পারতেন। আমার মনে পড়ে এমনও কথা হয়েছিল যদি বঙ্গবন্ধুকে ওরা মুক্তি না দেয় তাহলে আমরা একজন অবাঙালী ও পাকিস্তানী সৈন্যকে আস্ত রাখব না।
বঙ্গবন্ধুর আগমনের জন্য আমাদের ২৪ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সত্যিই ফিরে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রতিবছরই বিজয় দিবস আসে। আমরা ৩২ নম্বরে যাই। তারপর যাই সভার স্মৃতিসৌধে। ৩২ নম্বরে গিয়েও তৃপ্ত হই না। সবই দেখি কিন্তু জাতির জনকের সমাধি দেখি না। এই সমাধি কি ঢাকায় স্থানান্তরিত করা যায় না? ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, ১৫ আগস্ট_ এ দিবসগুলো কেমন যেন অনাড়ম্বর হয় না। আমি একবারই টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলাম। আমার মতো এ রকম লক্ষ কোটি জনতা আছে। গত বছর টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার প্রাক্কালে বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। এ রকম দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। ইচ্ছা থাকলেও লাখো জনতা দূরত্ব, সময়ের কারণে যেতে পারেন না। এ প্রজন্মের বিরাট অংশ বঙ্গবন্ধুর সমাধি দর্শনে ব্যর্থ। এখন বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায় আছেন বলে যাতায়াতের সুবিধা বৃদ্ধির চিন্তা প্রশাসনের মাথায় আছে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এরাই আবার ভোল পাল্টে ফেলেন। তখন সেখানে না যাওয়ার জন্য নানা রকমের ফন্দিফিকির করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স হয়েছে। তারপরও বিশেষ দিনগুলোতে যাওয়ার তাগিদ নেই। এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। জাতির জনকের সমাধিতে ফুল দিতে পারলাম না? যে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেই সোহ্রাওয়ার্দীতেই বঙ্গবন্ধুর সমাধি স্থানানত্মরিত হোক। এটা এখন সময়ের দাবি। খাতকটা বঙ্গবন্ধুর পুরোপরিবারকে বনানীতে দাফন করল অথচ বঙ্গবন্ধুকে কেন টুঙ্গিপাড়া? এই প্রশ্নও নানাভাবে আসে। এর পেছনেও ঘাতকের কোন ষড়যন্ত্র, কোন হীন উদ্দেশ্য ছিল। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে তাদের জাতির জনকের সমাধিস্থল রাজধানীতেই। ১৯৮৮ সালের বন্যায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি পানিতে ডুবে গিয়েছিল। পত্রিকার সে ছবি দেখে কবি নির্মলেন্দু গুণ 'নেড়ীকুত্তার দেশে' নামে একটি কবিতাও লিখেছিলেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ ভেবে রেখেছিলেন যে তিনি ব্যাপারটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলবেন যে জাতির জনকের সমাধি সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের ঠিক মধ্যখানে প্রতিস্থাপন করা হোক। গুণদা সে কাজটি করতে পেরেছিলেন কি না জানি না। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আমরা আর কতদিন জিয়া-মোশতাক-নিজামী চক্রের দুরভিসন্ধিমূলক ওই নীলনকশা আর মান্য করে চলব? অনেক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করলে জানা যায় তারা কে কতবার টুঙ্গিপাড়া গিয়েছে। অনেকেই বলবেন আমি একবারই গিয়েছিলাম। পদ্মা সেতু হলেও জাতির জনকের সমাধির সঙ্গে দূরত্বটা থেকেই যাবে। এই দূরত্বের বিরোধিতা করেছেন অন্নদা শংকর রায়, কবি শামসুর রাহমানসহ অনেকে। দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছে। এ প্রজন্মের অনেকেই মুজিব আদর্শের অনুসারী। তবে সমাধিতে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন এই আদর্শকে আরও শাণিত করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
সরকার সংশ্লিষ্ট সবাই দেশপ্রেমিক নাগরিকদের বলছি চলুন না বঙ্গবন্ধুকে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে আসি। বাঙালী আমাকে মারবে না বঙ্গবন্ধুর এই প্রবল বিশ্বাস ছিল বাঙালীর ওপর। সেই বাঙালীর হাতেই মুজিব হত্যা হয়েছে। এই বাঙালী জাতির সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে তাঁর সমাধি সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে পুনর্স্থাপনের মাধ্যমে। লক্ষ কোটি জনতার ফুলেল শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে। ধর্মীয় দিক থেকেও এর কোন বাধা নেই। কারণ এই সেদিনও স্বাধীনতার ৪০ বছর পর বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল কাদিরকে চট্টগ্রাম থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজশাহীর কাদিরাবাদ সেনানিবাসে পুনরায় সমাধিস্থ করা হয়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে ফতোয়াবাজ ও পকিসত্মানী ভূতেরা নানারকম ষড়যন্ত্র করবে। ইন্ধন যোগাবে জামায়াত-বিএনপির মতো প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলার শক্তি এখন বাংলাদেশে আছে। এখন শুধু দরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার ইচ্ছা। ১৭ মার্চ ২৬ মার্চ ১৫ আগস্ট এবং ১৬ ডিসেম্বর বছরের এই চারটি দিনে বাংলাদেশের মানুষ প্রাণভরে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতেই চাইবে। টুঙ্গিপাড়া বহু দূরের পথ- ব্যয়বহুল এবং সময়ক্ষেপণ। এতে অনেক পয়সাকড়িও খরচ হয়। অনেক বিদেশী অতিথি এসে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে যেতে চান। তাদের বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে নিয়ে যেতে হয়। অনেকেই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। খোঁজেন কোথায় তাঁর সমাধি। ফুল দিতে চান। প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন না।
তুরস্কের জাতির জনক কামাল আতাতুর্কের কবরটি ইস্তাম্বুল থেকে আঙ্কারায় স্থানানত্মরিত করা হয়েছে। আমরাও কি পারি না? ঢাকায় তাঁর কবর স্থানান্তরিত হলে লক্ষ কোটি লোক তাঁর কবর জিয়ারতের সুযোগ পাবেন। বাংলাদেশের প্রতি মমত্ববোধ বৃদ্ধি পাবে। আমার বিশ্বাস কবরে প্রতিদিনই অগণিত মানুষের ঢল নামবে। ওই বজ্রকণ্ঠের স্মৃতি মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। কেননা তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী ও বাঙালীর নেতা। ওই গণরোষের ভয়েই তাঁর হত্যাকারীরা তাঁকে টুঙ্গিপাড়ায় নির্বাসন দিয়েছিল। সে কারণেই আমাদের ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ওই ইতিহাস বিকৃতকারী জামায়াত-বিএনপি চক্রকে আসত্মাকুঁড়ে আবারও নিক্ষেপ করেছে বাংলাদেশের জনগণ ২০০৮ সালে।
বঙ্গবন্ধুর কবর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে থাকলে অনেক অন্যায় কাজও তাঁর আদর্শের অনুসারীদের পক্ষে করা সম্ভব হবে না। বঙ্গবন্ধু যদি সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে সমাহিত হন তাহলে আমার বিশ্বাস তিনি কবরে থেকেও আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবেন। তিনি হয়ত কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় বলবেন না 'ওরা আমাকে ৪০ বছর ভাল করে দেখতে দেয়নি বসন্ত পলাশ/শহীদ মিনারের অগণিত পুষ্পার্পণ, এবং একুশের ছায়ানটের অনুষ্ঠান, বইমেলা'। আরও তিনি তৃপ্ত হবেন এই ভেবে যে তাঁর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর পাশেই তিনি সমাহিত। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু সমাধি অফিস আদালতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতাবান হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
ওই দূর মধ্যপ্রাচ্যের ইয়াহিয়ার বন্দীশালার দুর্বিষহ নিঃসঙ্গতা আর চিন্তায় শুকিয়ে যাওয়া দীর্ঘদেহের মানুষটি লাখ লাখ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে যখন বললেন 'আমি আবার আপনাদের কাছে এসেছি, লাখ লাখ ভাই মা আর বোন নিজেদের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। আমাকে মুক্ত করেছেন। আমার প্রতি ভালবাসার কোন পরিমাপ নেই। এর কোন প্রতিদান আমি দিতে পারি না।' তখন এমন কোন বাঙালী ছিল না যার নিজের চোখেও পানি জমেনি এবং আবেগে গলাটা রুদ্ধ হয়ে আসেনি। বঙ্গবন্ধুর কবর ঢাকায় মানে মৌলবাদীদের জন্য একধরনের সতর্কবার্তা। নয়াদিল্লীতে মহাত্মা গান্ধীর সমাধি এবং এর আশপাশের পরিবেশ যেমন ভারতবাসীর দেশপ্রেমকে গভীর থেকে গভীরতর করে আমরাও চাই ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি হবে ওই সব পরাজিত পাকিস্তানপন্থীদের প্রতি বিষোদগার। কারণ 'ঘাতকেরা সে কফিনটিকে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মতো পাচার করতে চেয়েছিল/বিস্মৃতির বিয়াবানে আর সে কফিন/ আলৌকিক প্রক্রিয়ায় একটি বিশাল/সন্তরনশীল নৌকা হয়ে ভাসমান সবখানে।' সেই নৌকাটি না হয় সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে চিরদিনের জন্য নোঙ্গর করম্নক। আশা করি ২০১২ সালের বিজয় দিবসে আমরা লক্ষ কোটি জনতা সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর কবরে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে পারব। প্রধানমন্ত্রী আমাদের আর্তনাদ শুনবেন কি?
লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ইংরেজী বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments:
Post a Comment