Twitter

Follow palashbiswaskl on Twitter

Memories of Another day

Memories of Another day
While my Parents Pulin babu and Basanti devi were living

Friday, November 23, 2012

যারা যুগে যুগে ছিল খাটো হয়ে, তারা দাঁড়াক একবার মাথা তুলে।

যারা যুগে যুগে ছিল খাটো হয়ে, তারা দাঁড়াক একবার মাথা তুলে।

পলাশ বিশ্বাস

উল্টো রথের বাজনা বাজে শুনতে পাও? শুনতে পাও,কেউ কোথাও? বাজনা বাজে উল্টো রথের নতুন পথের বাদ্যি, আদ্যিকালের রাজপথে আর রথ টানে কার সাধ্যি? চলতি সড়ক রয় পিছনে সামনে রথচক্রে নুন পথের দাগ কেটে যায় দিগন্ত ইস্তক রে! দর্গম পথ হয় সমতল রথের চাকার নিচে রথ চলে আজ সামনেটাকে উল্টে ফেলে' পিছে। উল্টো পথে রথের রশি টানছে কা'রা দেখতে পাও?

অস্পৃশ্যতা যে আমাদের একটি বিরাট সামাজিক ব্যাধি রবীন্দ্রনাথ তা বহুদিন থেকেই অনুভব করেছেন। অস্পৃশ্য বলে যে বিরাট জনসমাজকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, অবমাননার অতলে তলিয়ে রাখা হয়েছে, তাদেরকে যদি কাছে টেনে নেওয়া না যায়, ওপরে ওঠানো না যায় তাহলে সমাজ-ব্যবস'া একদিন না একদিন ভেঙ্গে পড়বেই।

 রবীন্দ্রনাথের ভিত্তি ছিল মৃত্তিকাবর্তী মানুষ। রবীন্দ্রনাথ জনগণমনের কবি। সুবিধাবাদী শাসকগোষ্ঠী রবীন্দ্রচেতনাকে সাধারণের মাঝে পৌঁছে দিতে ভয় পায় কারণ রবীন্দ্রনাথ ব্রাত্য মানুষের মাঝে অভয়মন্ত্র বাজার দীক্ষা দেন। তিনি বলেন, রবীন্দ্রচর্চা বিশ্বব্যাপী দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে কারণ তীব্রভাবে স্বাদেশিক হয়েও রবীন্দ্রনাথ বৈশ্বিক। ভবিষ্যতের বিশ্বমানুষ রবীন্দ্রনাথকে আরও নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করবেন কারণ তাঁর কাছে আছে বিশ্বসঙ্কটের সমাধানের সূত্র।

 রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববীক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য তার বিবর্তনমানতা। এই বিবর্তনের মূলে ছিল বৃহতের জন্য তাঁর শ্রেয়োসাধনার বোধ। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন বিশ্বমৈত্রীর মধ্য দিয়েই বিশ্বমুক্তি সম্ভব। তাঁর বিশ্ববোধের উৎস গভীর দার্শনিকতার বোধ। এই দর্শনে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানবমুখী ভাবনার যোগ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বজুড়ে সর্বজনীন মানব ঐক্য প্রত্যাশা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ব্যক্তির বিকাশকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন, কিন্তু মোটেও ব্যক্তিসর্বস্বতাকে নয়। বর্তমান আত্মকেন্দ্রিক ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের এ যুগান্তকারী চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা অনেক। আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সংলাপের মধ্য দিয়ে ইহজাগতিক বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্য তাঁর আকুলতা প্রকাশিত হয়েছে। 

তাঁর কবিতা, গান ও লেখায় সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষের কান্না অনুরণিত হয়৷ 

রবীন্দ্র সাহিত্য নূতন করে পড়ার প্রয়োজন আজ সব চাইতে বেশী।আমরা সেই ছোট বেলা থেকে যে রবীন্দ্র নাথকে প্রেম ও আধ্যাত্বের জীবন দর্শনে আলোকিত দেখতে অভ্যস্ত, সেই দৃষ্টিভন্গী পালটে সাধারন ব্রাত্য মানুষের পাশে দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথকে চেনার চেষ্টা করলে হয়ত পেলেও পেয়ে যেতে পারি সেই পথের সন্ধ্যান,যে পথে অচলায়ন ভান্গার বিপ্লব সুনিশ্চিত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন, উদ্ভিদজগৎ, প্রাণিজগৎ, চরাচর তথা সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তাল, লয় ও ছন্দের ঐক্যে চলছে, যাকে সমন্বিত সিম্ফোনি বলা যেতে পারে; হয়তো এ সিম্ফোনিই ছিল তার বিশ্বনিয়ন্তা। এ সিম্ফোনিটা বেসুরো হয়ে উঠলে বিশ্বচরাচরে যত বিপত্তি ঘটে। 

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জীবিত সন্তানদের মধ্যে ত্রয়োদশ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালে কোলকাতায়। পিরালির দায় নিয়ে যশোরের  ভদ্রাসন ছেড়েছিলেন বিশ্বকবির  আদি পুরুষগণ।  নানার বাড়ি এবং শ্বশুরবাড়ি খুলনায়।। ওরিয়েন্টাল সেমিনারীতে প্রাথমিক শিক্ষার্থে ভর্তি হলেও তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মুলত: গৃহ শিক্ষকদের তত্বাবধানে।।   কৈশোরে মাতৃহারা কবি বেড়ে উঠেছেন জোড়াসাকোর অভিজাত সাংস্কৃতিক পরিবেশে, ঊনিশ শতকের বাংলা রেনেসার মুক্ত হাওয়ায়, ধর্মীয় গোড়ামিমুক্ত উদারমনা ব্রাক্ষ্ম সমাজে। শাাজাদপুর,  শিলাইদহে পৈতৃক জমিদারী দেখাশোনা করতে এসে মাটি ও মানুষের সান্নিধ্যলাভ এবং তাদের জীবন ঘনিষ্ট হওয়া। প্রজাদের দু:খ কষ্ট লাঘবে ক্ষুদ্র ঋণ ভিত্তিক কো অপারেটিভ তথা  সমবায় ব্যাংক, দুগ্ধ খামার প্রতিষ্ঠা, কৃষকদের মধ্যে উন্নত কৃষি বীজ, উপকরনের প্রচলন, সাবান-ছাতা ইত্যাদি তৈরীর কুঠির শিল্প , মৎস্যজীবিদের জন্যে খাজনামুক্ত বিল-জলা প্রদান ইত্যাদি সমাজ চিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে এই মাটিতে। ছোট ছোট মানুষের অসামান্য জীবনবোধ, জীবন চর্চা এবং মানবিক আকুতি এখানেই চিত্রায়িত করেন ছোটগল্পের রবীন্দ্রনাথ।  নদীমাতৃক এই বাংলাদেশেই বিশ্বপরিভ্রাজক রবীন্দ্রনাথের কবিচিত্তের সোনার তরীতে অধিষ্ঠিত হন আপন দেবতা ।  ঋতুচক্রে এখানকার নদী-নিসর্গ এবং তাকে ঘিরে মুখর নির্জনতায় জীবনের কোলাহলে চিরন্তন জীবন জিজ্ঞাসা "আমি কোথায় পাব তারে" নুতন এক মাত্রা এমনকি এক কথায় উত্তর ও পেয়ে যায় বাউল রবীনদ্র উচ্চারনে- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি ।


ব দ রু দ্দী ন উ ম র লিখেছেনঃ

বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবাংলাতেও ২৫শে বৈশাখ ও ২২শে শ্রাবণ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের গল্প, গান, নাটক অবলম্বন করে অনেক প্রোগ্রাম হয়। নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্রামের কবি ও গীতিকার। সে তুলনায় তার নাটকের মধ্যে বিদ্রোহের উপাদান অনেক বেশি। এর পরিচয় তার জš§-মৃত্যুর অনুষ্ঠানে পাওয়া যায়; পাওয়া যায় ১ বৈশাখ ও বসন্তবরণ উৎসবের মধ্যেও। যেভাবে এসব অনুষ্ঠান পরিকল্পনা এবং উপস্থিত করা হয় তার থেকে মনে হয়, এর বাইরে রবীন্দ্রনাথের আর কিছু নেই। মানুষের সামাজিক জীবনের উন্নতির জন্য 'জাত বুর্জোয়া' হিসেবে লুণ্ঠনকারী বুর্জোয়াদের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের যে গভীর চিন্তা-ভাবনা ছিল, তার কোন পরিচয় এসব দিনের অনুষ্ঠানে পাওয়া যায় না। শিক্ষার ক্ষেত্রে, ইতিহাস চর্চা বিষয়ে, সমাজে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান বোঝা যায় না। উপরোক্ত সব দিবসে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, নাটক অবলম্বন করে নানা অনুষ্ঠান সত্ত্বেও মানুষ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় আড়ালেই থেকে যায়। কাজেই রবীন্দ্রনাথের গান, নাচ, নাটক নিয়ে যাদের গদগদ ভাবের শেষ নেই, তাদের ক'জন রবীন্দ্রনাথ থেকে কোন প্রকৃত শিক্ষা লাভ করে, তার ঠিক নেই। শুধু তাই নয়, দেখা যায় যে, জনগণের পকেট মেরে যারা বড়লোক হয় অথবা ভবিষ্যতে বড়লোক হওয়ার ভাবনায় মশগুল থাকে, তারাই এমন অনুষ্ঠানে জায়গা দখল করে বঙ্গ সংস্কৃতি চর্চায় এগিয়ে থাকে।
১৯১৯ সালে ইংরেজরা পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে শত শত মানুষকে গুলি করে হত্যার পর কংগ্রেসের নেতা মহাÍা নামে পরিচিত মোহন লাল করম চাঁদ গান্ধী তার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ না করে মৌন থাকলেও রবীন্দ্রনাথ তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তাকে দেয়া 'নাইট' খেতাব বর্জন করেছিলেন। সেই ফ্যাসিস্ট হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আরও নানাভাবে তিনি তার বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। এই বক্তব্যের মধ্যে যে রবীন্দ্রনাথের দেখা পাওয়া যায় সেই রবীন্দ্রনাথকেই পাওয়া যায় তার রাশিয়ার চিঠিতে।
রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়া গিয়েছিলেন। সেখানকার অবস্থা দেখে যে চিঠিপত্র তিনি লিখেছিলেন সেগুলোই তার রাশিয়ার চিঠি নামে পরিচিত। লক্ষ্য করার বিষয় যে, রবীন্দ্রনাথের অনেক চিঠিপত্র ও রচনা নিয়ে কথাবার্তা ও লেখালেখি হলেও তার রাশিয়ার চিঠির কথা শোনা যায় না বললেই চলে। এটা শুধু যে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধেই এক চক্রান্ত তাই নয়, এ চক্রান্ত রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধেও। কারণ এর দ্বারা রবীন্দ্র চরিত্রের এমন একটি দিককে আড়াল করা হয়, যার মধ্যে তার মহত্ত্বের পরিচয় সব থেকে বেশি উচ্চারিত।
রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ার চিঠিগুলোতে ১৯৩০ সালে অর্থাৎ বিপ্লবের মাত্র তের বছর পর সেখানকার অবস্থা দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি রাশিয়ার কিছু সমালোচনাও করেছিলেন, যা কিছুটা ছিল অনুষ্ঠানভিত্তিক এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে পশ্চিমা প্রচারণার দ্বারাই অনেকাংশে প্রভাবিত। তিনি তার তৃতীয় চিঠিতে নিজেই লিখেছিলেন, 'মস্কো থেকে যখন নিমন্ত্রণ এলো তখনও বলশেভিকদের সম্বন্ধে আমার মনে কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তাদের সম্বন্ধে ক্রমাগতই উল্টো উল্টো কথা শুনেছি। আমার মনে তাদের বিরুদ্ধে একটা খটকা ছিল। কেননা গোড়ায় ওদের সাধনা ছিল জবরদস্তির সাধনা।' এই 'জবরদস্তির সাধনা'র অর্থ হল বিপ্লবের সাধনা। রবীন্দ্রনাথ যে বিপ্লবপন্থী ছিলেন না তা বলাই বাহুল্য। যাই হোক, তার চিঠি সম্পর্কে কিছু আলোচনার আগে এটা বলা দরকার যে, সব কিছু দেখে তিনি যদি শুধু মুগ্ধ কথাবার্তা বলেই তার মূল্যায়ন শেষ করতেন, সেটা তার 'জাত বুর্জোয়া' চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতো না। তিনি যে সেটা করেননি, মুগ্ধ কথাবার্তার সঙ্গে কিছু সমালোচনাও করেছিলেন, এর মধ্যে তার সততার পরিচয় ছিল।
রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে তাদের অর্থনৈতিক নির্মাণ, মানবিকতা, সাম্যচিত্ত জাগিয়ে তোলার নানা শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যা কিছু লিখেছেন তার সব কিছু নিয়ে এখানে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবে তার জš§দিনে নানা উৎসবের আড়ম্বরে তার যে পরিচয় আড়ালে থেকে যায় সে পরিচয় কিছুটা উপস্থিত করার জন্য তার রাশিয়ার চিঠি থেকে কিছু উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিকই হবে।

২৫শে সেপ্টেম্বর লিখিত তৃতীয় চিঠিতে তিনি বলেছেন, "আপাতত রাশিয়ায় এসেছিÑ না এলে এ জšে§র তীর্থ দর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত।"
প্রথম চিঠিতে তিনি লিখেছেন, "আমাদের সকল সমস্যার সবচেয়ে বড় রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা। এতকাল সমাজের অধিকাংশ লোক শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিতÑ ভারতবর্ষ তো প্রায় সম্পূর্ণই বঞ্চিত। এখানে এই শিক্ষা যে কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যায় নয়, তার সম্পূর্ণতায়, তার প্রবলতায়। কোন মানুষই যাতে নিঃসহায় ও নিষ্কর্মা হয়ে না থাকে, এজন্য কী প্রচুর আয়োজন ও কী বিপুল উদ্যম। ওই শ্বেত রাশিয়ার জন্য নয়Ñ মধ্য এশিয়ার অর্ধসভ্য জাতের মধ্যেও এরা বন্যার মতো বেগে শিক্ষা বিস্তার করে চলেছে; সায়েন্সের শেষ ফলন পর্যন্ত যাতে তারা পায় এজন্য প্রয়াসের অন্ত নেই। এখানে থিয়েটারে ভালো ভালো অপেরা ও বড় নাটকের অভিনয়ে বিষম ভিড়, কিন্তু যারা দেখছে তারা কৃষি ও কর্মীদের দলের। কোথাও এদের আবাসন নেই। ইতিমধ্যে এদের যে দুই-একটা প্রতিষ্ঠান দেখলুম সর্বত্রই লক্ষ্য করেছি, এদের চিত্তের জাগরণ এবং আÍমর্যাদার আনন্দ।"
দুর্বলকে শক্তি দেয়ার যে সাধনা ও কর্মকাণ্ড সেখানে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "যদি কেউ বলে, দুর্বলের শক্তিকে উদবোধিত করার জন্যই তারা পণ করেছে, তাহলে আমরা কোন্ দুঃখে বলব যে, তোমাদের ছাড়া দাঁড়াতে নেই। তারা হয়তো ভুল করতে পারেÑ তাদের প্রতিপক্ষরাও যে ভুল করছে না তা নয়।"
দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা ও জনগণের জীবন নতুন ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে সামরিক খাতে অপব্যয় যে এদেরকে বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছিল, এ ব্যাপারে তিনি যেভাবে দৃষ্টি আর্কষণ করেছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। 'শত বুর্জোয়া' হয়েও যে তিনি এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এর মধ্যে যে শুধু তার গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় আছে তা-ই নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নে যে তাদের নির্মাণকাজ কি প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে করতে হয়েছিল তার উল্লেখ করে তিনি তাদের যে প্রশংসা করেছিলেন এটা তার শ্রেণীর লোকদের মধ্যে পূর্ণতাই বলতে হবে।
এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য হল, "মনে রেখো, এখানে যে বিপ্লবে জারের শাসন লয় পেলে যেটা ঘটেছে ১৯১৭ খিস্টাব্দে। অর্থাৎ তের বছর পার হল মাত্র। ইতিমধ্যে ঘরে-বাইরে এদের প্রচণ্ড বিরুদ্ধতার সঙ্গে লড়ে চলতে হয়েছে। এরা একা, অত্যন্ত ভাঙাচোরা একটা রাষ্ট্রব্যবস্থার বোঝা নিয়ে। পথ পূর্বতন দুঃশাসনের প্রভূত আবর্জনায় দুর্গম।ঃ অর্থসম্বল এদের সামান্য; বিদেশের মহাজনী গদিতে এদের ক্রেডিট নেই। দেশের মধ্যে কলকারখানা এদের যথেষ্ট পরিমাণে না থাকাতে অর্থ উৎপাদনে এরা শক্তিহীন। এই জন্য কোনোমতে পেটের ভাত বিক্রি করে চলেছে এদের উদ্যোগপর্ব। অথচ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সকলের চেয়ে যে অনুৎপাদক বিভাগ-সৈনিক বিভাগÑ তাকে সম্পূর্ণ সুদক্ষ রাখার অপব্যয় এদের পক্ষে অনিবার্য। কেননা আধুনিক মহাজনী যুগের সমস্ত রাষ্ট্রশক্তি এদের শত্র"পক্ষ এবং তারা সকলেই আপন আপন অস্ত্রশালা কানায় কানায় ভরে তুলেছে।"
রাশিয়া সম্পর্কে যেসব কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, তার কারণ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন "তোমার মতো ভদ্র মহিলাকে সাধারণ ভদ্রগোছের চিঠি না লিখে এ রকম চিঠি যে কেন লিখলুম তার কারণ চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে, দেশের দশা আমার মনের মধ্যে কি রকম তোলপাড় করছে। জালিয়ানওয়ালাবাগের উপদ্রব্যের পর একবার আমার মনে এই রকম অশান্তি জেগেছিল।"
মোট ১৩টি চিঠি এবং উপসংহারে তিনি রাশিয়া সম্পর্কে অনেক কিছু লিখেছিলেন, যা দারুণভাবে পাঠযোগ্য। রাশিয়া সফর তার চিত্তে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল সে বিষয়ে তার একটি উদ্ধৃতি দিয়েই এখানে শেষ করব। রাশিয়া থেকে ফেরত পথে বার্লিন পৌঁছে ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি এক চিঠিতে লেখেন, "বার্লিনে এসে একসঙ্গে তোমার দু'খানা চিঠি পাওয়া গেল। ঘন বর্ষার চিঠি, শান্তিনিকেতনের আকাশে শালবনের ওপরে মেঘের ছায়া এবং জলের ধারায় শ্রাবণ ঘনিয়ে উঠেছে, সেই ছবি মনে জাগলে আমার চিত্ত কি রকম উৎসুক হয়ে ওঠে, সে তোমাকে বলা বাহুল্য। কিন্তু এবারে রাশিয়া ঘুরে এসে সেই সৌন্দর্যের ছবি আমার মন থেকে মুছে গেছে। কেবলই ভাবছি, আমাদের দেশজোড়া চাষীদের দুঃখের কথা।"
বর্ষার কবি, বিশ্রামের কবি, রবীন্দ্রনাথের ভাবনার এই জগতের সঙ্গে কয়জনের পরিচয় আছে?

http://taiyabs.wordpress.com/2009/05/12/rabi-14/



'রথের রশিনামে রবীন্দ্রনাথের একটি নাটক আছে৷ 'রথবলতে এই নাচকে 'চলার ক্ষমতাবা চলচছত্তিু৷ নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ জানতেনসমাজকে সচল রাখার জন্য দরকার সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সক্রিয় সহযোগিতা৷ যদি সেই সহযোগিতায় খামতি দেখা যায়,সহযোগিতার মানসিকতায় ভাঁটা পড়েযদি মানুষের অসংকোচ সংস্পর্শ থেকে সমাজ বঞ্চিত হয়তবে সচল সমাজেরও চলার ক্ষমতা বা চলার শত্তিু ব্যাহত হয়৷ একই চিন্তার প্রতিফলন পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের 'বলাকা'-,–

''– যদি তুমি মুহূর্তের তরে

ক্লান্তি ভরে

দাঁড়াও থমকি

তখনই চমকি

উিচ্ছ্রয়া উঠিবে বিশ্ব পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুর পর্বত়ে,"

'রথের রশিনাটকটি তাই আজকের প্রেক্ষিতে ভীষণ প্রাসঙ্গিকপ্রয়োজন নাটকটির যথার্থ অনুধাবন৷ কয়েকদিন আগেও বাংলার মাটিতে যে সামাজিক অগ্রগতির রথ থমকে গিয়েছিল,তার কারণ এখন সর্বজনবিদিত৷ রথ টানবেন যাঁরাতাঁদের প্রতি অবহেলাই এই অবস্হার সৃষ্টি কর়েছিল৷ ফলেরথের যিনি দেবতাসেই 'সজীব গণতন্ত্রজেগে উঠলেন৷ এই 'দেবতা'প্রসঙ্গেই রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন, ''রথ ভাবে আমি দেবপথ ভাবে আমি! মূর্তি ভাবে আমি দেবহাসে অন্তর্মী৷সেই অন্তর্মী গণতন্ত্র সজাগ হতেই ঘটে গেল অভুতপূর্ব পট পরিবর্তন৷'রথের রশি'তে রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যায়,–

"ওদের দিকেই ঠাকুর পাশ ফিরলেন 

নইলে ছন্দ মেলে না৷ একদিকটা উচু হয়েছিল       অতিশয় বেশি,

ঠাকুর নীচে দাঁড়ালেন ছোটোর দিকে,

সেইখান থেকে মারলেন টানবড়োটাকে দিলেন       কাত করে৷

সমান করে নিলেন তাঁর আসনটা৷'


রথের রশি নাটকে সভ্যতার একটি দুর্দশার ছবি আছে। রথটি কালের, অর্থাৎ ইতিহাসের। পুঁজিবাদ তাকে অনড় করে দিয়েছে। কিন্তু রথটিকে তো এগোতে হবে। মানুষের সভ্যতা তো বর্তমানে এসে থেমে যেতে পারে না, তাকে ভবিষ্যতের দিকে চলতেই হবে। কীভাবে? সেই সমাধানের কথাও রয়েছে রথের রশি নাটকে।

রথের রশি   


প্রথম দৃশ্য


রথযাত্রার মেলায় মেয়েরা

 

প্রথমা

 

এবার কী হল, ভাই!

উঠেছি কোন্‌ ভোরে, তখন কাক ডাকে নি।

কঙ্কালিতলার দিঘিতে দুটো ডুব দিয়েই

ছুটে এলুম রথ দেখতে, বেলা হয়ে গেল;

রথের নেই দেখা। চাকার নেই শব্দ।

 

 

দ্বিতীয়া

 

চারি দিকে সব যেন থম্‌থমে হয়ে আছে,

ছম্‌ছম্‌ করছে গা।

 

 

তৃতীয়া

 

দোকানি পসারিরা চুপচাপ ব'সে,

কেনাবেচা বন্ধ। রাস্তার ধারে ধারে

লোক জটলা করে তাকিয়ে আছে

কখন্‌ আসবে রথ। যেন আশা ছেড়ে দিয়েছে।

 

 

প্রথমা

 

দেশের লোকের প্রথম যাত্রার দিন আজ;

বেরবেন ব্রাহ্মণঠাকুর শিষ্য নিয়ে,--

বেরবেন রাজা, পিছনে চলবে সৈন্যসামন্ত,--

পণ্ডিতমশায় বেরবেন, ছাত্ররা চলবে পুঁথিপত্র হাতে।

কোলের ছেলে নিয়ে মেয়েরা বেরবে,

ছেলেদের হবে প্রথম শুভযাত্রা--

কিন্তু কেন সব গেল হঠাৎ থেমে।

 

 

দ্বিতীয়া

 

ওই দেখ্‌, পুরুতঠাকুর বিড়্‌ বিড় করছে ওখানে।

মহাকালের পাণ্ডা বসে মাথায় হাত দিয়ে।

 

 

সন্ন্যাসীর প্রবেশ

 

সন্ন্যাসী

 

সর্বনাশ এল।

বাধবে যুদ্ধ, জ্বলবে আগুন, লাগবে মারী,

ধরণী হবে বন্ধ্যা, জল যাবে শুকিয়ে।

 

 

প্রথমা

 

এ কী অকল্যাণের কথা, ঠাকুর!

উৎসবে এসেছি মহাকালের মন্দিরে--

আজ রথযাত্রার দিন।

 

 

সন্ন্যাসী

 

দেখতে পাচ্ছ না-- আজ ধনীর আছে ধন,

তার মূল্য গেছে ফাঁক হয়ে গজভুক্ত কপিত্থের মতো।

ভরা ফসলের খেতে বাসা করেছে উপবাস।

যক্ষরাজ স্বয়ং তার ভাণ্ডারে বসেছে প্রায়োপবেশনে।

দেখতে পাচ্ছি না-- লক্ষ্ণীর ভাণ্ড আজ শতছিদ্র,

তাঁর প্রসাদধারা শুষে নিচ্ছে মরুভূমিতে--

ফলছে না কোনো ফল।

 

 

তৃতীয়া

 

হাঁ ঠাকুর, তাই তো দেখি।

 

 

সন্ন্যাসী

 

তোমরা কেবলই করেছ ঋণ,

কিছুই কর নি শোধ,

দেউলে করে দিয়েছ যুগের বিত্ত।

তাই নড়ে না আজ আর রথ--

ওই যে, পথের বুক জুড়ে পড়ে আছে তার অসাড় দড়িটা।

 

 

প্রথমা

 

তাই তো,বাপ রে, গা শিউরে ওঠে--

এ যে অজগর সাপ, খেয়ে খেয়ে মোটা হয়ে আর নড়ে না।

 

 

সন্ন্যাসী

 

ওই তো রথের দড়ি, যত চলে না ততই জড়ায়।

যখন চলে, দেয় মুক্তি।

 

 

দ্বিতীয়া

 

বুঝেছি আমাদের পুজো নেবেন ব'লে

হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন দড়ি-দেবতা।

পুজো পেলেই হবেন তুষ্ট।

 

 

প্রথমা

 

ও ভাই, পুজো তো আনি নি। ভুল হয়েছে।

 

 

তৃতীয়া

 

পুজোর কথা তো ছিল না--

ভেবেছিলেম রথের মেলায় কেবল বেচব কিনব,

বাজি দেখব জাদুকরের,

আর দেখব বাঁদর-নাচ।

চল্‌-না শিগগির, এখনো সময় আছে,

আনি গে পুজো।

 

 

[সকলের প্রস্থান

 

নাগরিকদের প্রবেশ

 

 

 

প্রথম নাগরিক

 

দেখ্‌ দেখ্‌ রে, রথের দড়িটা কেমন করে পড়ে আছে।

যুগযুগান্তরের দড়ি, দেশদেশান্তরের হাত পড়েছে ওই দড়িতে,

আজ অনড় হয়ে মাটি কামড়ে আছে

সর্বাঙ্গ কালো ক'রে।

 

 

দ্বিতীয় নাগরিক

 

ভয় লাগছে রে। সরে দাঁড়া, সরে দাঁড়া।

মনে হচ্ছে ওটা এখনি ধরবে ফণা, মারবে ছোবল।

 

 

তৃতীয় নাগরিক

 

একটু একটু নড়ছে যেন রে। আঁকুবাঁকু করছে বুঝি।

 

 

প্রথম নাগরিক

 

বলিস্‌ নে অমন কথা। মুখে আনতে নেই।

ও যদি আপনি নড়ে তা হলে কি আর রক্ষে আছে।

 

 

তৃতীয় নাগরিক

 

তা হলে ওর নাড়া খেয়ে সংসারের সব জোড়গুলো

বিজোড় হয়ে পড়বে। আমরা যদি না চালাই--

ও যদি আপনি চলে, তা হলে পড়ব যে চাকার তলায়।

 

 

প্রথম নাগরিক

 

ওই দেখ্‌ ভাই, পুরুতের গেছে মুখ শুকিয়ে,

কোণে বসে বসে পড়ছে মন্তর।

 

 

দ্বিতীয় নাগরিক

 

সেদিন নেই রে

যেদিন পুরুতের মন্তর-পড়া হাতের টানে চলত রথ।

ওরা ছিল কালের প্রথম বাহন।

 

 

তৃতীয় নাগরিক

 

তবু আজ ভোরবেলা দেখি ঠাকুর লেগেছেন টান দিতে--

কিন্তু একেবারেই উলটো দিকে, পিছনের পথে।

 

 

প্রথম নাগরিক

 

সেটাই তো ঠিক পথ, পবিত্র পথ, আদি পথ।

সেই পথ থেকে দূরে এসেই তো কালের মাথার ঠিক থাকছে না।

 

 

দ্বিতীয় নাগরিক

 

মস্ত পণ্ডিত হয়ে উঠলি দেখি। এত কথা শিখলি কোথা।

 

 

প্রথম নাগরিক

 

ওই পণ্ডিতেরই কাছে। তাঁরা বলেন--

মহাকালের নিজের নাড়ীর টান পিছনের দিকে,

পাঁচজনের দড়ির টানে অগত্যা চলেন সামনে।

নইলে তিনি পিছু হটতে হটতে একেবারে পৌছতেন

অনাদি কালের অতল গহ্বরে।

 

 

তৃতীয় নাগরিক

 

ওই রশিটার দিকে চাইতে ভয় করে।

ওটা যেন যুগান্তের নাড়ী--

সান্নিপাতিক জ্বরে আজ দব্‌দব্‌ করছে।

 

 

সন্ন্যাসীর প্রবেশ

 

সন্ন্যাসী

 

সর্বনাশ এল।

গুরুগুরু শব্দ মাটির নীচে।

ভূমিকম্পের জন্ম হচ্ছে।

গুহার মধ্য থেকে আগুন লক্‌লক্‌ মেলছে রসনা।

পূর্বে পশ্চিমে আকাশ হয়েছে রক্তবর্ণ।

প্রলয়দীপ্তির আঙটি পরেছে দিক্‌চক্রবাল।

 

 

[ প্রস্থান

 

 

 

প্রথম নাগরিক

 

দেশে পুণ্যাত্মা কেউ নেই কি আজ।

ধরুক-না এসে দড়িটা।

 

 

দ্বিতীয় নাগরিক

 

এক-একটি পুণ্যাত্মাকে খুঁজে বের করতেই

এক-এক যুগ যায় বয়ে--

ততক্ষণ পাপাত্মাদের হবে কী দশা।

 

 

তৃতীয় নাগরিক

 

পাপাত্মাদের কী হবে তা নিয়ে ভগবানের মাথাব্যাথা নেই।

 

 

দ্বিতীয় নাগরিক

 

সে কী কথা। সংসার তো পাপাত্মাদের নিয়েই।

তারা না থাকলে তো লোকনাথের রাজত্ব উজাড়।

পুণ্যাত্মা কালেভদ্রে দৈবাৎ আসে,

আমাদের ঠেলায় দৌড় মারে বনে জঙ্গলে গুহায়।

 

 

প্রথম নাগরিক

 

দড়িটার রঙ যেন এল নীল হয়ে।

সামলে কথা কোস।

 

 

মেয়েদের প্রবেশ

 

প্রথমা

 

বাজা ভাই, শাঁখ বাজা--

রথ না চললে কিছুই চলবে না।

চড়বে না হাঁড়ি, বুলবুলিতে খেয়ে যাবে ধান।

এরই মধ্যে আমার মেজো ছেলের গেছে চাকরি,

তার বউটা শুষছে জ্বরে। কপালে কী আছে জানি নে।

 

 

প্রথম নাগরিক

 

মেয়েমানুষ, তোমরা এখানে কী করতে।

কালের রথযাত্রায় কোনো হাত নেই তোমাদের।

কুটনো কোটো গে ঘরে।

 

 

দ্বিতীয়া

 

কেন, পুজো দিতে তো পারি।

আমরা না থাকলে পুরুতের পেট হত না এত মোটা।

গড় করি তোমায় দড়ি-নারায়ণ! প্রসন্ন হও।

এনেছি তোমার ভোগ। ওলো, ঢাল্‌ ঢাল্‌ ঘি,

ঢাল্‌ দুধ, গঙ্গাজলের ঘটি কোথায়,

ঢেলে দে-না জল। পঞ্চগব্য রাখ্‌ ওইখানে,

জ্বালা পঞ্চপ্রদীপ। বাবা দড়ি-নারায়ণ,

এই আমার মানত রইল, তুমি যখন নড়বে

মাথা মুড়িয়ে চুল দেব ফেলে।

 

 

তৃতীয়া

 

এক মাস ছেড়ে দেব ভাত, খাব শুধু রুটি।

বলো-না ভাই, সবাই মিলে-- জয় দড়ি-নারায়ণের জয়।

 

 

প্রথম নাগরিক

 

কোথাকার মূর্খ তোরা--

দে মহাকালনাথের জয়ধ্বনি।

 

 

প্রথমা

 

কোথায় তোমাদের মহাকালনাথ? দেখি নে তো চক্ষে।

দড়ি-প্রভুকে দেখছি প্রত্যক্ষ,--

হনুমানপ্রভুর লঙ্কা-পোড়ানো লেজখানার মতো--

কী মোটা, কী কালো, আহা দেখে চক্ষু সার্থক হল।

মরণকালে ওই দড়ি-ধোওয়া জল ছিটিয়ে দিয়ো আমার মাথায়।

 

 

দ্বিতীয়া

 

গালিয়ে নেব আমার হার, আমার বাজুবন্দ,

দড়ির ডগা দেব সোনা-বাঁধিয়ে।

 

 

তৃতীয়া

 

আহা, কী সুন্দর রূপ গো।

 

 

প্রথমা

 

যেন যমুনানদীর ধারা।

 

 

দ্বিতীয়া

 

যেন নাগকন্যার বেণী।

 

 

তৃতীয়া

 

যেন গণেশঠাকুরের শুঁড় চলেছে লম্বা হয়ে,

দেখে জল আসে চোখে।

 

 

সন্ন্যাসীর প্রবেশ

 

প্রথমা

 

দড়ি-ঠাকুরের পুজো এনেছি ঠাকুর!

কিন্তু পুরুত যে নড়েন না, মন্তর পড়বে কে।

 

 

সন্ন্যাসী

 

কী হবে মন্তরে।

কালের পথ হয়েছে দুর্গম।

কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু, কোথাও গভীর গর্ত।

করতে হবে সব সমান, তবে ঘুচবে বিপদ।

 

 

তৃতীয়া

 

বাবা, সাতজন্মে শুনি নি এমন কথা।

চিরদিনই তো উঁচুর মান রেখেছে নিচু মাথা হেঁট ক'রে।

উঁচু-নিচুর সাঁকোর উপর দিয়েই তো রথ চলে।

 

 

সন্ন্যাসী

 

দিনে দিনে গর্তগুলোর হাঁ উঠছে বেড়ে।

হয়েছে বাড়াবাড়ি, সাঁকো আর টিঁকছে না।

ভেঙে পড়ল ব'লে।

 

 

[ প্রস্থান

 

প্রথমা

 

চল্‌ ভাই, তবে পুজো দিই গে রাস্তা-ঠাকুরকে।

আর গর্ত-প্রভুকেও তো সিন্নি দিয়ে করতে হবে খুশি,

কী জানি ওঁরা শাপ দেন যদি। একটি-আধটি তো নন,

আছেন দু-হাত পাঁচ-হাত অন্তর।

নমো নমো দড়ি-ভগবান, রাগ কোরো না ঠাকুর,

ঘরে আছে ছেলেপুলে।

 

 

[ মেয়েদের প্রস্থান

 

সৈন্যদলের প্রবেশ

 

প্রথম সৈনিক

 

ওরে বাস্‌ রে। দড়িটা পড়ে আছে পথের মাঝখানে--

যেন একজটা ডাকিনীর জটা

 

 

দ্বিতীয় সৈনিক

 

মাথা দিল হেঁট করে।

স্বয়ং রাজা লাগালেন হাত, আমরাও ছিলুম পিছনে।

একটু ক্যাঁচ্‌কোঁচও করলে না চাকাটা।

 

 

তৃতীয় সৈনিক

 

ও যে আমাদের কাজ নয়, তাই।

ক্ষত্রিয় আমরা, শূদ্র নই, নই গোরু।

চিরদিন আমরা চড়েই এসেছি রথে।

চিরদিন রথ টানে ওই ওরা-- যাদের নাম করতে নেই।

 

 

প্রথম নাগরিক

 

শোনো ভাই, আমার কথা।

কালের অপমান করেছি আমরা, তাই ঘটেছে এ-সব অনাসৃষ্টি।

 

 

তৃতীয় সৈনিক

 

এ মানুষটা আবার বলে কী।

 

 

প্রথম নাগরিক

 

ত্রেতাযুগে শূদ্র নিতে গেল ব্রাহ্মণের মান--

চাইলে তপস্যা করতে, এত বড়ো আস্পর্ধা--

সেদিনও অকাল লাগল দেশে, অচল হল রথ।

দয়াময় রামচন্দ্রের হাতে কাটা গেল তার মাথা,

তবে তো হল আপদশান্তি।

 

 

দ্বিতীয় নাগরিক

 

সেই শূদ্ররা শাস্ত্র পড়ছেন আজকাল,

হাত থেকে কাড়তে গেলে বলেন, আমরা কি মানুষ নই।

 

 

তৃতীয় নাগরিক

 

মানুষ নই! বটে! কতই শুনব কালে কালে।

কোন্‌দিন বলবে, ঢুকব দেবালয়ে।

বলবে, ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়ের সঙ্গে নাইব এক ঘাটে।

 

 

প্রথম নাগরিক

 

এর পরেও রথ যে চলছে না, সে আমাদের প্রতি দয়া করে।

চললে চাকার তলায় গুঁড়িয়ে যেত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।

 

 

প্রথম সৈনিক

 

কাল লাঙল ধরবে ব্রাহ্মণ। সর্বনাশ!

 

 

দ্বিতীয় সৈনিক

 

চল্‌-না ওদের পাড়ায় গিয়ে প্রমাণ করে আসি--

ওরাই মানুষ না আমরা।

 

 

দ্বিতীয় নাগরিক

 

এ দিকে আবার কোন্‌ বুদ্ধিমান বলেছে রাজাকে--

কলিযুগে না চলে শাস্ত্র, না চলে শস্ত্র,

চলে কেবল স্বর্ণচক্র। তিনি ডাক দিয়েছেন শেঠজিকে।

 

 

প্রথম সৈনিক

 

রথ যদি চলে বেনের টানে

তবে গলায় অস্ত্র বেঁধে জলে দেব ডুব।

 

 

দ্বিতীয় সৈনিক

 

দাদা, রাগ কর মিছে, সময় হয়েছে বাঁকা।

এ যুগে পুষ্পধনুর ছিলেটাও

বেনের টানেই দেয় মিঠে সুরে টংকার।

তার তীরগুলোর ফলা বেনের ঘরে শানিয়ে না আনলে

ঠিক জায়গায় বাজে না বুকে।

 

 

তৃতীয় সৈনিক

 

তা সত্যি। এ কালের রাজত্বে রাজা থাকেন সামনে,

পিছনে থাকে বেনে। যাকে বলে অর্ধ-বেনে-রাজেশ্বর মূর্তি।

 

 

সন্ন্যাসীর প্রবেশ

 

প্রথম সৈনিক

 

এই-যে সন্ন্যাসী, রথ চলে না কেন আমাদের হাতে।

 

 

সন্ন্যাসী

 

তোমরা দড়িটাকে করেছ জর্জর।

যেখানে যত তীর ছুঁড়েছ, বিঁধেছে ওর গায়ে।

ভিতরে ভিতরে ফাঁক হয়ে গেছে, আলগা হয়েছে বাঁধনের জোর।

তোমরা কেবল ওর ক্ষত বাড়িয়েই চলবে,

বলের মাতলামিতে দুর্বল করবে কালকে।

সরে যাও, সরে যাও ওর পথ থেকে।

 

 

[ প্রস্থান

 

ধনপতির অনুচরবর্গের প্রবেশ

 

প্রথম ধনিক

 

এটা কী গো, এখনি হুঁচট খেয়ে পড়েছিলুম।

 

 

দ্বিতীয় ধনিক

 

ওটাই তো রথের দড়ি।

 

 

চতুর্থ ধনিক

 

বীভৎস হয়ে উঠেছে, যেন বাসুকি ম'রে উঠল ফুলে।

 

 

প্রথম সৈনিক

 

কে এরা সব।

 

 

দ্বিতীয় সৈনিক

 

আংটির হীরে থেকে আলোর উচ্চিংড়েগুলো

লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে চোখে।

 

 

প্রথম নাগরিক

 

ধনপতি শেঠির দল এরা।

 

 

প্রথম ধনিক

 

আমাদের শেঠজিকে ডেকেছেন রাজা।

সবাই আশা করছে, তাঁর হাতেই চলবে রথ।

 

 

দ্বিতীয় সৈনিক

 

সবাই বলতে বোঝায় কাকে বাপু?

আর তারা আশাই বা করে কিসের।

 

 

দ্বিতীয় ধনিক

 

তারা জানে, আজকাল চলছে যা-কিছু

সব ধনপতির হাতেই চলছে।

 

 

প্রথম সৈনিক

 

সত্যি নাকি! এখনি দেখিয়ে দিতে পারি, তলোয়ার চলে আমাদেরই হাতে।

 

 

তৃতীয় ধনিক

 

তোমাদের হাতখানাকে চালাচ্ছে কে।

প্রথম সৈনিক

চুপ, দুর্বিনীত!

 

 

দ্বিতীয় ধনিক

 

চুপ করব আমরা বটে।

আজ আমাদেরই আওয়াজ ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছে জলে স্থলে আকাশে।

 

 

প্রথম সৈনিক

 

মনে ভাবছ, আমাদের শতঘ্নী ভুলেছে তার বজ্রনাদ।

 

 

দ্বিতীয় ধনিক

 

ভুললে চলবে কেন। তাকে যে আমাদেরই হুকুম

ঘোষণা করতে হয় এক হাট থেকে আরেক হাটে সমুদ্রের ঘাটে ঘাটে।

 

 

প্রথম নাগরিক

 

ওদের সঙ্গে পারবে না তর্কে।

 

 

প্রথম সৈনিক

 

কী বলো, পারব না!

সবচেয়ে বড়ো তর্কটা ঝন্‌ঝন্‌ করছে খাপের মধ্যে।

 

 

প্রথম নাগরিক

 

তোমাদের তলোয়ারগুলোর কোনোটা খায় ওদের নিমক,

কোনোটা খেয়ে বসেছে ওদের ঘুষ।

 

 

প্রথম ধনিক

 

শুনলেম, নর্মদাতীরের বাবাজিকে আনা হয়েছিল

দড়িতে হাত লাগাবার জন্যে। জান খবর?

 

 

দ্বিতীয় ধনিক

 

জানি বৈকি।

রাজার চর পৌঁছল গুহায়,

তখন প্রভু আছেন চিত হয়ে বুকে দুই পা আটকে।

তুরী ভেরী দামামা জগঝম্পের চোটে ধ্যান যদি বা ভাঙল,

পা-দুখানা তখন আড়ষ্ট কাঠ।

 

 

নাগরিক

 

শ্রীচরণের দোষ কী দাদা!

পঁয়ষট্টি বছরের মধ্যে একবারও নাম করে নি চলাফেরার।

বাবাজি বলবেন কী।

 

 

দ্বিতীয় ধনিক

 

কথা কওয়ার বালাই নেই।

জিভটার চাঞ্চল্যে রাগ করে গোড়াতেই সেটা ফেলেছেন কেটে।

 

 

ধনিক

 

তার পরে?

 

 

দ্বিতীয় ধনিক

 

তার পরে দশ জোয়ানে মিলে আনলে তাঁকে রথতলায়।

দড়িতে যেমনি তাঁর হাত পড়া,

রথের চাকা বসে যেতে লাগল মাটির নীচে।

 

 

ধনিক

 

নিজের মনটা যেমন ডুবিয়েছেন রথটাকেও তেমনি তলিয়ে দেবার চেষ্টা।

দ্বিতীয় ধনিক

একদিন উপবাসেই মানুষের পা চায় না চলতে--

পঁয়ষট্টি বছরের উপবাসের ভার পড়ল চাকার 'পরে।

 

 

মন্ত্রী ও ধনপতির প্রবেশ

 

ধনপতি

 

ডাক পড়ল কেন মন্ত্রীমশায়?

 

 

মন্ত্রী

 

অনর্থপাত হলেই সর্বাগ্রে তোমাকে স্মরণ করি।

 

 

ধনপতি

 

অর্থপাতে যার প্রতিকার, আমার দ্বারা তাই সম্ভব।

 

 

মন্ত্রী

 

মহাকালের রথ চলছে না।

 

 

ধনপতি

 

এ পর্যন্ত আমরা কেবল চাকায় তেল দিয়েছি, রশিতে টান দিই নি।

 

 

মন্ত্রী

 

অন্য সব শক্তি আজ অর্থহীন,

তোমাদের অর্থবান হাতের পরীক্ষা হোক।

 

 

ধনপতি

 

চেষ্টা করা যাক।

দৈবক্রমে চেষ্টা যদি সফল হয়, অপরাধ নিয়ো না তবে।

 

 

দলের লোকের প্রতি

 

বলো সিদ্ধিরস্তু!

 

 

সকলে

 

সিদ্ধিরস্তু!

 

 

ধনপতি

 

লাগো তবে ভাগ্যবানেরা। টান দেও।

 

 

ধনিক

 

রশি তুলতেই পারি নে। বিষম ভারী।

 

 

ধনপতি

 

এসো কোষাধ্যক্ষ, ধরো তুমি কষে।

বলো সিদ্ধিরস্তু! টানো, সিদ্ধিরস্তু।

টানো, সিদ্ধিরস্তু!

 

 

দ্বিতীয় ধনিক

 

মন্ত্রীমশায়, রশিটা যেন আরো আড়ষ্ট হয়ে উঠল,

আর আমাদের হাতে হল যেন পক্ষাঘাত।

 

 

সকলে

 

দুয়ো দুয়ো!

 

 

সৈনিক

 

যাক, আমাদের মান রক্ষা হল।

 

 

পুরোহিত

 

আমাদের ধর্মরক্ষা হল।

 

 

সৈনিক

 

যদি থাকত সেকাল, আজ তোমার মাথা যেত কাটা।

 

 

ধনপতি

 

ওই সোজা কাজটাই জান তোমরা।

মাথা খাটাতে পার না, কাটতেই পার মাথা।

মন্ত্রীমশায়, ভাবছ কী।

 

 

মন্ত্রী

 

ভাবছি, সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল--

এখন উপায় কী।

 

 

ধনপতি

 

এবার উপায় বের করবেন স্বয়ং মহাকাল।

তাঁর নিজের ডাক যেখানে পৌঁছবে

সেখান থেকে বাহন আসবে ছুটে।

আজ যারা চোখে পড়ে না

কাল তারা দেখা দেবে সবচেয়ে বেশি।

ওহে খাতাঞ্চি, এই বেলা সামলাও গে খাতাপত্র--

কোষাধ্যক্ষ, সিন্ধুকগুলো বন্ধ করো শক্ত তালায়।

 

 

[ ধনপতি ও তার দলের প্রস্থান

 

 

 

মেয়েদের প্রবেশ

 

 

 

প্রথমা

 

হাঁ গা, রথ চলল না এখনো, দেশসুদ্ধ রইল উপোস করে!

কলিকালে ভক্তি নেই যে।

 

 

মন্ত্রী

 

তোমাদের ভক্তির অভাব কী বাছা,

দেখি না তার জোর কত।

 

 

প্রথমা

 

নমো নমো,

নমো নমো বাবা দড়ি-ঠাকুর, অন্ত পাই নে তোমার দয়ার।

নমো নমো!

 

 

দ্বিতীয়া

 

তিনকড়ির মা বললে সতেরো বছরের ব্রাহ্মণের মেয়ে,

ঠিকদুক্ষুর বেলা, বোম ভোলানাথ ব'লে

তালপুকুরে-- ঘাটের থেকে তিন হাতের মধ্যে--

এক ডুবে তিন গোছা পাট-শিয়ালা তুলে

ভিজে চুল দিয়ে বেঁধে দড়ি-প্রভুর কাছে পোড়ালে

প্রভুর টনক নড়বে। জোগাড় করেছি অনেক যত্নে,

সময়ও হয়েছে পোড়াবার।

আগে দড়ি-বাবার গায়ে সিঁদুর-চন্দন লাগা;

ভয় কিসের, ভক্তবৎসল তিনি--

মনে মনে শ্রীগুরুর নাম করে গায়ে হাত ঠেকালে

অপরাধ নেবেন না তিনি।

 

 

প্রথমা

 

তুই দে-না ভাই চন্দন লাগিয়ে, আমাকে বলিস কেন।

আমার দেওরপো পেট-রোগা,

কী জানি কিসের থেকে কী হয়।

 

 

তৃতীয়া

 

ওই তো ধোঁওয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে।

কিন্তু জাগলেন না তো।

দয়াময়!

জয় প্রভু, জয় দড়ি-দয়াল প্রভু, মুখ তুলে চাও।

তোমাকে দেব পরিয়ে পঁয়তাল্লিশ ভরির সোনার আংটি--

গড়াতে দিয়েছি বেণী স্যাকরার কাছে।

 

 

দ্বিতীয়া

 

তিন বছর থাকব দাসী হয়ে, ভোগ দেব তিন বেলা।

ওলো বিনি, পাখাটা এনেছিস তো বাতাস কর্‌-না--

দেখছিস্‌ নে রোদ্‌দুরে তেতে উঠেছে ওঁর মেঘবরন গা।

ঘটি করে গঙ্গাজলটা ঢেলে দে।

ওইখানকার কাদাটা দে তো, ভাই, আমার কপালে মাখিয়ে।

এই তো আমাদের খেঁদি এনেছে খিচুড়ি-ভোগ।

বেলা হয়ে গেল, আহা, কত কষ্ট পেলেন প্রভু!

জয় দড়ীশ্বর, জয় মহাদড়ীশ্বর, জয় দেবদেবদড়ীশ্বর,

গড় করি তোমায়, টলুক তোমার মন।

মাথা কুটছি তোমার পায়ে, টলুক তোমার মন।

পাখা কর্‌ লো; পাখা কর্‌, জোরে জোরে।

 

 

প্রথমা

 

কী হবে গো, কী হবে আমাদের--

দয়া হল না যে! আমার তিন ছেলে বিদেশে,

তারা ভালোয় ভালোয় ফিরলে হয়।

 

 

চরের প্রবেশ

 

মন্ত্রী

 

বাছারা, এখানে তোমাদের কাজ হল--

এখন ঘরে গিয়ে জপতপ ব্রতনিয়ম করো গে।

আমাদের কাজ আমরা করি।

 

 

প্রথমা

 

যাচ্ছি, কিন্তু দেখো মন্ত্রীবাবা,

ওই ধোঁওয়াটা যেন শেষ পর্যন্ত থাকে--

আর ওই বিল্বিপত্রটা যেন পড়ে না যায়।

 

 

[ মেয়েদের প্রস্থান

 

চর

 

মন্ত্রীমশায়, গোল বেধেছে শূদ্রপাড়ায়।

 

 

মন্ত্রী

 

কী হল।

 

 

চর

 

দলে দলে ওরা আসছে ছুটে-- বলছে, রথ চালাব আমরা।

 

 

সকলে

 

বলে কী! রশি ছুঁতেই পাবে না।

 

 

চর

 

ঠেকাবে কে তাদের। মারতে মারতে তলোয়ার যাবে ক্ষয়ে। মন্ত্রীমশায়, বসে পড়লে

যে।

 

 

মন্ত্রী

 

দল বেঁধে আসছে বলে ভয় করি নে-- ভয় হচ্ছে পারবে ওরা।

 

 

সৈনিক

 

বল কী মন্ত্রীমহারাজ, শিলা জলে ভাসবে?

 

 

মন্ত্রী

 

নীচের তলাটা হঠাৎ উপরের তলা হয়ে ওঠাকেই বলে প্রলয়,

বরাবর যা প্রচ্ছন্ন তাই প্রকাশ হবার সময়টাই যুগান্তর।

 

 

সৈনিক

 

আদেশ করুন কী করতে হবে, ভয় করি নে আমরা।

 

 

মন্ত্রী

 

ভয় করতেই হবে, তলোয়ারের বেড়া তুলে বন্যা ঠেকানো যায় না।

 

 

চর

 

এখন কী আদেশ বলুন।

 

 

মন্ত্রী

 

বাধা দিয়ো না ওদের।

বাধা পেলে শক্তি নিজেকে নিজে চিনতে পারে--

চিনতে পারলেই আর ঠেকানো যায় না।

 

 

চর

 

ওই-যে এসে পড়েছে ওরা।

 

 

মন্ত্রী

 

কিছু কোরো না তোমরা, থাকো স্থির হয়ে।

 

 

শূদ্রদলের প্রবেশ

 

দলপতি

 

মন্ত্রী

 

তোমরাই তো বাবার রথ চালিয়ে আসছ চিরদিন।

 

 

দলপতি

 

এতদিন আমরা পড়তেম রথের চাকার তলায়,

দ'লে গিয়ে ধুলোয় যেতুম চ্যাপটা হয়ে।

এবার সেই বলি তো নিল না বাবা।

 

 

মন্ত্রী

 

তাই তো দেখলেম।

সকাল থেকে চাকার সামনে ধুলোয় করলে লুটোপুটি--

ভয়ে উপরে তাকালে না, পাছে ঠাকুরের দিকে চোখ পড়ে--

তবু তো চাকার মধ্যে একটুও দেখা গেল না ক্ষুধার লক্ষণ।

 

 

পুরোহিত

 

একেই বলে অগ্নিমান্দ্য,

তেজ ক্ষয় হলেই ঘটে এই দশা।

 

 

দলপতি

 

এবার তিনি ডাক দিয়েছেন তাঁর রশি ধরতে।

 

 

পুরোহিত

 

রশি ধরতে! ভারি বুদ্ধি তোমাদের। জানলে কী করে।

 

 

দলপতি

 

কেমন করে জানা গেল সে তো কেউ জানে না।

ভোরবেলায় উঠেই সবাই বললে সবাইকে,

ডাক দিয়েছেন বাবা। কথাটা ছড়িয়ে গেল পাড়ায় পাড়ায়,

পেরিয়ে গেল মাঠ, পেরিয়ে গেল নদী,

পাহাড় ডিঙিয়ে গেল খবর--

ডাক দিয়েছেন বাবা।

 

 

সৈনিক

 

রক্ত দেবার জন্যে।

 

 

দলপতি

 

না, টান দেবার জন্যে।

 

 

পুরোহিত

 

বরাবর সংসার যারা চালায়, রথের রশি তাদেরই হাতে।

 

 

দলপতি

 

সংসার কি তোমরাই চালাও ঠাকুর?

 

 

পুরোহিত

 

স্পর্ধা দেখো একবার। কথার জবাব দিতে শিখেছে--

লাগল বলে ব্রহ্মশাপ।

 

 

দলপতি

 

মন্ত্রীমশায়, তোমরাই কি চালাও সংসার।

 

 

মন্ত্রী

 

সে কী কথা। সংসার বলতে তো তোমরাই।

নিজগুণেই চল, তাই রক্ষে।

চালাক লোকে বলে আমরাই চালাচ্ছি।

আমরা মান রাখি লোক ভুলিয়ে।

 

 

দলপতি

 

আমরাই তো জোগাই অন্ন, তাই তোমরা বাঁচ;

আমরাই বুনি বস্ত্র, তাতেই তোমাদের লজ্জারক্ষা।

 

 

সৈনিক

 

সর্বনাশ! এতদিন মাথা হেঁট করে বলে এসেছে ওরা,

তোমরাই আমাদের অন্নবস্ত্রের মালিক।

আজ ধরেছে উলটো বুলি, এ তো সহ্য হয় না।

 

 

মন্ত্রী

 

সৈনিকের প্রতি

 

চুপ করো।

সর্দার, মহাকালের বাহন তোমরাই,

তোমরা নারায়ণের গরুড়।

এখন তোমাদের কাজ সাধন করে যাও তোমরা।

তার পরে আসবে আমাদের কাজের পালা।

 

 

দলপতি

 

আয় রে ভাই, লাগাই টান, মরি আর বাঁচি।

 

 

মন্ত্রী

 

কিন্তু বাবা, সাবধানে রাস্তা বাঁচিয়ে চোলো।

বরাবর যে রাস্তায় রথ চলেছে যেয়ো সেই রাস্তা ধরে।

পোড়ো না যেন একেবারে আমাদের ঘাড়ের উপর।

 

 

দলপতি

 

কখ#না বড়ো রাস্তায় চলতে পাই নি, তাই রাস্তা চিনি নে।

রথে আছেন যিনি তিনিই সামলাবেন।

আয় ভাই, দেখছিস রথচূড়ায় কেতনটা উঠছে দুলে।

বাবার ইশারা। ভয় নেই আর, ভয় নেই। ওই চেয়ে দেখ্‌ রে ভাই

মরা নদীতে যেমন বান আসে

দড়ির মধ্যে তেমনি প্রাণ এসে পৌঁচেছে।

 

 

পুরোহিত

 

ছুঁলো, ছুঁলো দেখছি, ছুলো শেষে রশি ছুঁলো পাষণ্ডেরা।

 

 

মেয়েদের ছুটিয়া প্রবেশ

 

সকলে

 

ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, দোহাই বাবা--

ও গদাধর, ও বনমালী, এমন মহাপাপ কোরো না।

পৃথিবী যাবে যে রসাতলে।

আমাদের স্বামী ভাই বোন ছেলে

কাউকে পারব না বাঁচাতে।

চল্‌ রে চল্‌, দেখলেও পাপ আছে।

 

 

[ প্রস্থান

 

পুরোহিত

 

চোখ বোজো, চোখ বোজো তোমরা।

ভস্ম হয়ে যাবে ক্রুদ্ধ মহাকালের মূর্তি দেখলে।

 

 

সৈনিক

 

এ কি, এ কি, চাকার শব্দ নাকি--

না আকাশটা উঠল আর্তনাদ করে?

 

 

পুরোহিত

 

হতেই পারে না-- কিছুতেই হতে পারে না--

কোনো শাস্ত্রেই লেখে না।

 

 

নাগরিক

 

নড়েছে রে, নড়েছে, ওই তো চলেছে।

 

 

সৈনিক

 

কী ধুলোই উড়ল-- পৃথিবী নিশ্বাস ছাড়ছে।

অন্যায়, ঘোর অন্যায়! রথ শেষে চলল যে--

পাপ, মহাপাপ!

 

 

শূদ্রদল

 

জয় জয়, মহাকালনাথের জয়!

 

 

পুরোহিত

 

তাই তো, এও দেখতে হল চোখে!

 

 

সৈনিক

 

ঠাকুর, তুমিই হুকুম করো, ঠেকাব রথ-চলা।

বৃদ্ধ হয়েছেন মহাকাল, তাঁর বুদ্ধিভ্রংশ হল--

দেখলেম সেটা স্বচক্ষে।

 

 

পুরোহিত

 

সাহস হয় না হুকুম করতে।

অবশেষে জাত খোওয়াতেই বাবার যদি খেয়াল গেল

এবারকার মতো চুপ করে থাকো 'রঞ্জুলাল।

আসছে বারে ওঁকে হবেই প্রায়শ্চিত্ত করতে।

হবেই, হবেই, হবেই।

ওঁর দেহ শোধন করতে গঙ্গা যাবে শুকিয়ে।

 

 

সৈনিক

 

গঙ্গার দরকার হবে না।

ঘড়ার ঢাকনার মতো শূদ্রগুলোর মাথা দেব উড়িয়ে,

ঢালব ওদের রক্ত।

 

 

নাগরিক

 

মন্ত্রীমশায়, যাও কোথায়?

 

 

মন্ত্রী

 

যাব ওদের সঙ্গে রশি ধরতে।

 

 

সৈনিক

 

ছি ছি, ওদের হাতে হাত মেলাবে তুমি!

 

 

মন্ত্রী

 

ওরাই যে আজ পেয়েছে কালের প্রসাদ।

স্পষ্টই গেল দেখা, এ মায়া নয়, নয় স্বপ্ন।

এবার থেকে মান রাখতে হবে ওদের সঙ্গে সমান হয়ে।

 

 

সৈনিক

 

তাই বলে ওদেরই এক সারে রশি ধরা!

ঠেকাবই আমরা, রথ চলুক আর নাই চলুক।

 

 

মন্ত্রী

 

এবার দেখছি চাকার তলায় পড়বার পালা তোমাদেরই।

 

 

সৈনিক

 

সেও ভালো। অনেক কাল চণ্ডালের রক্ত শুষে চাকা আছে

অশুচি, এবার পাবে শুদ্ধ রক্ত। স্বাদ বদল করুক।

 

 

পুরোহিত

 

কী হল মন্ত্রী, এ কোন্‌ শনিগ্রহের ভেলকি?

রথটা যে এরই মধ্যে নেমে পড়েছে রাজপথে।

পৃথিবী তবু তো নেমে গেল না রসাতলে।

মাতাল রথ কোথায় পড়ে কোন্‌ পল্লীর ঘাড়ে, কে জানে।

 

 

সৈনিক

 

ওই দেখো, ধনপতির দল আর্তনাদ করে ডাকছে আমাদের।

রথটা একেবারে সোজা চলেছে ওদেরই ভাণ্ডারের মুখে।

যাই ওদের রক্ষা করতে।

 

 

মন্ত্রী

 

নিজেদের রক্ষার কথা ভাবো।

দেখছ না, ঝুঁকেছে তোমাদের অস্ত্রশালার দিকে।

 

 

সৈনিক

 

উপায়?

 

 

মন্ত্রী

 

ওদের সঙ্গে মিলে ধরো-সে রশি।

বাঁচবার দিকে ফিরিয়ে আনো রথটাকে--

দো-মনা করবার সময় নেই।

 

 

[ প্রস্থান

 

সৈনিক

 

কী করবে ঠাকুর, তুমি কী করবে।

 

 

পুরোহিত

 

বীরগণ, তোমরা কী করবে বলো আগে।

 

 

সৈনিক

 

কী করতে হবে বলো-না, ভাইসকল!

সবাই যে একেবারে চুপ করে গেছ!

রশি ধরব না লড়াই করব?

ঠাকুর, তুমি কী করবে বলোই-না।

 

 

পুরোহিত

 

কী জানি, রশি ধরব না শাস্ত্র আওড়াব।

 

 

সৈনিক

 

গেল, গেল সব। রথের এমন হাঁক শুনি নি কোনো পুরুষে।

 

 

দ্বিতীয় সৈনিক

 

চেয়ে দেখো-না, ওরাই কি টানছে রথ

না রথটা আপনিই চলেছে ওদের ঠেলে নিয়ে।

 

 

তৃতীয় সৈনিক

 

এতকাল রথটা চলত যেন স্বপ্নে--

আমরা দিতেম টান আর ও পিছে পিছে আসত দড়িবাঁধা গোরুর মতো।

আজ চলছে জেগে উঠে। বাপ রে, কী তেজ।

মানছে না আমাদের বাপদাদার পথ--

একটা কাঁচা পথে ছুটেছে বুনো মহিষের মতো।

পিঠের উপর চড়ে বসেছে যম।

 

 

দ্বিতীয় সৈনিক

 

ওই যে আসছে কবি, ওকে জিঞ্জাসা করি ব্যাপারটা কী।

 

 

পুরোহিত

 

পাগলের মতো কথা বলছ তোমরা।

আমরাই বুঝলেম না মানে, বুঝবে কবি?

ওরা তো বানিয়ে বানিয়ে বলে কথা-- শাস্ত্র জানে কী?

 

 

কবির প্রবেশ

 

দ্বিতীয় সৈনিক

 

এ কী উলটোপালটা ব্যাপার, কবি।

পুরুতের হাতে চলল না রথ, রাজার হাতে না--

মানে বুঝলে কিছু?

 

 

কবি

 

ওদের মাথা ছিল অত্যন্ত উঁচু,

মহাকালের রথের চুড়ার দিকেই ছিল ওদের দৃষ্টি--

নীচের দিকে নামল না চোখ,

রথের দড়িটাকেই করলে তুচ্ছ।

মানুষের সঙ্গে মানুষকে বাঁধে যে বাঁধন তাকে ওরা মানে নি।

রাগী বাঁধন আজ উন্মত্ত হয়ে ল্যাজ আছড়াচ্ছে--

দেবে ওদের হাড় গুঁড়িয়ে।

 

 

পুরোহিত

 

তোমার শূদ্রগুলোই কি এত বুদ্ধিমান--

ওরাই কি দড়ির নিয়ম মেনে চলতে পারবে।

 

 

কবি

 

পারবে না হয়তো।

একদিন ওরা ভাববে, রথী কেউ নেই, রথের সর্বময় কর্তা ওরাই।

দেখো, কাল থেকেই শুরু করবে চেঁচাতে--

জয় আমাদের হাল লাঙল চরকা তাঁতের।

তখন এঁরাই হবেন বলরামের চেলা--

হলধরের মাতলামিতে জগৎটা উঠবে টলমলিয়ে।

 

 

পুরোহিত

 

তখন যদি রথ আর-একবার অচল হয়

বোধ করি তোমার মতো কবিরই ডাক পড়বে--

তিনি ফুঁ দিয়ে ঘোরাবেন চাকা।

 

 

কবি

 

নিতান্ত ঠাট্টা নয় পুরুতঠাকুর!

রথযাত্রায় কবির ডাক পড়েছে বারে বারে,

কাজের লোকের ভিড় ঠেলে পারে নি সে পৌঁছতে।

 

 

পুরোহিত

 

রথ তারা চালাবে কিসের জোরে। বুঝিয়ে বলো।

 

 

কবি

 

গায়ের জোরে নয়, ছন্দের জোরে।

আমরা মানি ছন্দ, জানি একঝোঁকা হলেই তাল কাটে।

মরে মানুষ সেই অসুন্দরের হাতে

চাল-চলন যার এক পাশে বাঁকা;

কুম্ভকর্ণের মতো গড়ন যার বেমানান,

যার ভোজন কুৎসিত,

যার ওজন অপরিমিত।

আমরা মানি সুন্দরকে। তোমরা মানো কঠোরকে--

অস্ত্রের কঠোরকে, শাস্ত্রের কঠোরকে।

বাইরে ঠেলা-মারার উপর বিশ্বাস,

অন্তরের তালমানের উপর নয়।

 

 

সৈনিক

 

তুমি তো লম্বা উপদেশ দিয়ে চললে,

ও দিকে যে লাগল আগুন।

 

 

কবি

 

যুগাবসানে লাগেই তো আগুন।

যা ছাই হবার তাই ছাই হয়,

যা টিঁকে যায় তাই নিয়ে সৃষ্টি হয় নবযুগের।

 

 

সৈনিক

 

তুমি কী করবে কবি!

 

 

কবি

 

আমি তাল রেখে রেখে গান গাব।

 

 

সৈনিক

 

কী হবে তার ফল?

 

 

কবি

 

যারা টানছে রথ তারা পা ফেলবে তালে তালে।

পা যখন হয় বেতালা

তখন ক্ষুদে ক্ষুদে খালখন্দগুলো মারমূর্তি ধরে।

মাতালের কাছে রাজপথও হয়ে ওঠে বন্ধুর।

 

 

মেয়েদের প্রবেশ

 

প্রথমা

 

এ হল কী ঠাকুর!

তোমরা এতদিন আমাদের কী শিখিয়েছিলে!

দেবতা মানলে না পুজো, ভক্তি হল মিছে।

মানলে কিনা শুদ্দুরের টান, মেলেচ্ছের ছোঁওয়া!

ছি, ছি, কী ঘেন্না।

 

 

কবি

 

পুজো তোমরা দিলে কোথায়।

 

 

দ্বিতীয়া

 

এই তো এইখানেই।

ঘি ঢেলেছি, দুধ ঢেলেছি, ঢেলেছি গঙ্গাজল--

রাস্তা এখনো কাদা হয়ে আছে!

পাতায় ফুলে ওখানটা গেছে পিছল হয়ে।

 

 

কবি

 

পুজো পড়েছে ধুলোয়, ভক্তি করেছে মাটি।

রথের দড়ি কি পড়ে থাকে বাইরে।

সে থাকে মানুষে মানুষে বাঁধা, দেহে দেহে প্রাণে প্রাণে।

সেইখানে জমেছে অপরাধ, বাঁধন হয়েছে দুর্বল।

 

 

তৃতীয়া

 

আর ওরা-- যাদের নাম করতে নেই?

 

 

কবি

 

ওদের দিকেই ঠাকুর পাশ ফিরলেন--

নইলে ছন্দ মেলে না। এক দিকটা উঁচু হয়েছিল অতিশয় বেশি,

ঠাকুর নীচে দাঁড়ালেন ছোটোর দিকে,

সেইখান থেকে মারলেন টান, বড়োটাকে দিলেন কাত করে।

সমান করে নিলেন তাঁর আসনটা।

 

 

প্রথমা

 

তার পরে হবে কী।

 

 

কবি

 

তার পরে কোন্‌-এক যুগে কোন্‌-একদিন

আসবে উলটোরথের পালা।

তখন আবার নতুন যুগের উঁচুতে নিচুতে হবে বোঝাপড়া।

এই বেলা থেকে বাঁধনটাতে দাও মন--

রথের দড়িটাকে নাও বুকে তুলে, ধুলোয় ফেলো না;

রাস্তাটাকে ভক্তিরসে দিয়ো না কাদা করে।

আজকের মতো বলো সবাই মিলে--

যারা এতদিন মরে ছিল তারা উঠুক বেঁচে;

যারা যুগে যুগে ছিল খাটো হয়ে, তারা দাঁড়াক একবার মাথা তুলে।

 

 

সন্ন্যাসীর প্রবেশ

 

সন্ন্যাসী

 

জয়-- মহাকালনাথের জয়!

 

 

১৫ আষাঢ়, ১৩১৮  শিলাইদহ

রবীন্দ্রনাথ ও মানবতাবোধ
হাবিবুর রহমান স্বপন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে জাত-পাত ছিল না। যদিও তখন জাত-পাতের বিষয়টি ছিল প্রকট। শাহজাদপুরের কাছারিবাড়িতে ১৮৯১ সালে (যখন জাত-ধর্ম প্রবল) মুসলমান বাবুর্চি এনাত আলীর হাতের রান্না খেতেন। অতি দরিদ্র এনাত আলী ভাল রান্না করতেন। পতিসরে জমিদারবাড়িতে যে বাবুর্চি ছিলেন তিনিও ছিলেন মুসলমান। শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের ভৃত্য মোমিন মিঞা একদিন সকালে কাজে আসে বিলম্বে। ঘুম থেকে উঠে কবি দেখলেন পানি না থাকায় স্নান করা যাচ্ছে না। বেশ দেরিতে মোমিন মিঞা আসলে রবীন্দ্রনাথ রাগতস্বরে বললেন কোথায় ছিলি এতক্ষণ? শোকবিহ্বল কণ্ঠে মোমিন মিঞা উত্তর দেয়_ 'রাত দুপুরে আমার ৮ বছরের মেয়ে মারা গেছে।' এ কথা শুনে কবিমন বেদনায় গলে গেল। প্রভুচিত্তের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলো একটি চিরন্তন মানবমন। কবি ভাবলেন এক্ষেত্রে তো মোমিনের কোন দোষ নেই। ভৃত্য হলেও সে তো মানুষ, মানুষের মতো সুখ দুঃখবোধ তো তারও আছে। কবি তখনই মোমিন মিঞাকে ছুটি দিয়ে দিলেন। মোমিন মিঞার এই ঘটনা নিয়েই রবীন্দ্রনাথ 'চৈতালী' কাব্য গ্রন্থে 'কর্ম ' নামে কবিতা লেখেন।
শাহজাদপুরের নিকটবর্তী মাদলা গ্রামের গরিব মাঝি রামগতি খাজনা পরিশোধ না করতে পারায় তার জমি নিলামে ওঠে। রামগতি মাঝি একদিন শাহজাদপুর কাছারিবাড়িতে চিতল মাছ আনেন জমিদার বাবুকে উপহার দেয়ার জন্য। রবীন্দ্রনাথ মাছ খেয়ে খুশি হয়ে রামগতিকে ডাকলেন। রামগতি জমিদার বাবুর কাছে তার জমি নিলাম সংক্রান্ত বিষয়টি অবহিত করলে জমিদার রবীন্দ্রনাথ তার সাত বছরের খাজনা মাফ করে দেন। সঙ্গে তার মাছের দাম দুই টাকা পরিশোধ করে দেয়ার নির্দেশ দেন পেশকারকে।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী কবি। রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রধান ধর্ম-মানবধর্ম। বিশ্বের অনাদৃত, শোষিত- তথাকথিত নিম্ন শ্রেণীর সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর সমবেদনা ও সহানুভূতি ছিল যেমন গভীর তেমনি আন্তরিক। এজন্যেই তো তিনি বিশ্বকবি। যৌবনে শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসরে অবস্থানকালে জমিদারীর কাজকর্ম দেখাশোনার সময়েই তাঁর উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব রূপায়ণ দেখা যায় দুঃস্থ প্রজাদের কল্যাণে নানা পরিকল্পনা গ্রহণের মধ্যে। আদর্শ জমিদার রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন দরিদ্র কৃষকদের উন্নতি করতে হলে তাদেরকে মহাজনের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। সেজন্যে প্রয়োজন কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের। তাই তিনি নোবেল পুরস্কারের ১ লাখ ৮ হাজার টাকায় পতিসরে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া কৃষির প্রকৃত উন্নতি করতে হলে যে জমির প্রকৃত মালিকানা কৃষকদের দেয়া প্রয়োজন সে কথা অনুভব করে পরবর্তীকালে তিনি রাশিয়ার চিঠিতে লিখেছিলেন- 'চাষিকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে হবে, এই ছিল আমার অভিপ্রায়। এ সম্বন্ধে দুটো কথা সর্বদাই আমার মনে আন্দোলিত হয়েছে_ জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, সে চাষির ...।' তিনি আরও অনুভব করেছিলেন যে দরিদ্র কৃষকদের উন্নতি করতে হলে, দুঃখ দূর করতে হলে 'জনসাধারণের প্রতি দরদ-বোধ প্রয়োজন।' দুঃখীর দুঃখ দূরীকরণে রবীন্দ্রনাথের আনত্মরিক প্রচেষ্টার পরিচয় পাওয়া যায় শিলাইদহের কৃষকদের ডেকে সমবায়ভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথের এই মানবপ্রীতি তথা সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ও সমবেদনা ধীরে ধীরে যে পূর্ণতর রূপ লাভ করেছে তা তাঁর বিভিন্ন ধরনের রচনা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রত্যেক্ষ সংযোগের ফলে রবীন্দ্রনাথ আপন জমি থেকে বঞ্চিত কৃষকের মনোবেদনা কত গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন তা 'চিত্র' কাব্যের 'দুই বিঘা জমি' কবিতাটি পড়লেই বোঝা যায়। উপেনের প্রতি ভূ-স্বামীর অত্যাচারের চিত্র তাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে এবং নিঃস্ব উপেনের প্রতি কবির গভীর সমবেদনা প্রকাশিত হয়েছে।
গরিব প্রজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর সখ্য ছিল। ১৯৩৭ সালের ২৬ জুলাই কবি শেষ বারের মতো পতিসর আসেন। তখন সাম্প্রদায়িক দুর্দিন চলছিল। পতিসরের মুসলমানবহুল প্রজাদের পক্ষ থেকে কবিকে দেয়া হয় মুদ্রিত শ্রদ্ধাঞ্জলি। "প্রভুরুপে হেথা আস নাই তুমি দেব রূপে এসে দিলে দেখা, দেবতার দান অক্ষয় হউক হৃদিপটে থাক্ স্মৃতিরেখা।" একজন বৃদ্ধ মুসলমান কৃষক কবিকে বলেন, "আমরা তো হুজুর বুড়ো হয়েছি, আমরাও তো চলতি পথে, আপনিও চলতি পথে; বড়ই দুঃখ হয়, প্রজা-মনিবের এমন মধুর সম্বন্ধের ধারা বুঝি বন্ধ হয়ে যায়। ছেলেপিলেদের মতি-গতি বদলে যাচ্ছে, তারা আমাদের সব নাদান মনে করে। এমন জমিদারের জমিদারিতে বাস করবার সৌভাগ্যবোধ তাদের বুঝি হবে না।" রবীন্দ্রনাথ মৃতু্যর পূর্বে গরিব প্রজাদের এসব স্মৃতিচারণ করেন অশ্রম্নসজল চোখে।
পিতা যখন রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি কাজের দায়িত্ব দিয়ে পূর্ব বাংলায় পাঠালেন তিনি শিলাইদহ ও শাহজাদপুরে এসে দেখলেন প্রজাদের বসবার জন্য আসনের তারতম্য। প্রজারা কেউ বা বসেছেন চৌকিতে, কেউ বা পাটিতে আবার কেউ বা বসেছেন মাটিতে। এই বিষয়টি যুবক কবি জমিদার রবীন্দ্রনাথের ভাল লাগেনি। জমিদারদের রীতি-রেওয়াজকে তুচ্ছজ্ঞান করে, তিনি প্রজাদের সম্মানের কথা বিবেচনা করে সম আসনের ব্যবস্থা করেন। প্রজারা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে বিরক্ত হতেন এবং বাধা দিতেন। শাহজাদপুরের প্রধান কর্মচারী বিপিনচন্দ্রকে ডেকে বলেন, 'সবাই আমার প্রজা, আমার কাছে সবাই সমান, বেণী ম-ল, আলি নেওয়াজ খাঁ। হিন্দু ব্রাহ্মণ এরা ফরাসে বসবেন, আর মুসলমান বা নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা ভদ্রলোক হলেও, শিক্ষিত হলেও আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে! এর পর থেকে সকলকেই ফরাসে বসার ব্যবস্থা করা হয়। প্রথম জমিদারির দায়িত্ব পেয়েই রবীন্দ্রনাথ শাহজাদপুর এলাকার গরিব প্রজাদের ১ লাখ ৮ হাজার টাকা খাজনা মাফ করে দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি চিঠি থেকে প্রমাণ মেলে তিনি প্রজাদের কল্যাণে কাজ করেছেন। মানুষের দুঃখে তাঁর হৃদয় ব্যথিত হতো। তিনি লিখেছেন,'আমি জমিদারিকে কেবল নিজের লাভ-লোকসানের দিক হইতে দেখিতে পারি না। অনেকগুলি লোকের মঙ্গল আমাদের উপর নির্ভর করে ইহাদের প্রতি কর্তব্য পালনের দ্বারা ধর্মরক্ষা করিতে হইবে।' রবীন্দ্রনাথের উদারতার প্রমাণ মেলে তাঁর জামাতাকে লেখা চিঠি থেকে। 'মনে রেখো জমিদারদের টাকা চাষিদের টাকা এবং চাষিরাই তোমাদের শিক্ষার ব্যয় ভার নিজেরা আধপেটা খেয়ে না খেয়ে বহন করছে এদের এই ঋণ সম্পূর্ণ শোধ করবার দায় তোমাদের উপর রইল। নিজেদের সাংসারিক উন্নতির চেয়েও এইটাই তোমাদের প্রথম কর্তব্য হবে।'
অস্পৃশ্যতা যে আমাদের একটি বিরাট সামাজিক ব্যাধি রবীন্দ্রনাথ তা বহুদিন থেকেই অনুভব করেছেন। অস্পৃশ্য বলে যে বিরাট জনসমাজকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, অবমাননার অতলে তলিয়ে রাখা হয়েছে, তাদেরকে যদি কাছে টেনে নেয়া না যায়, ওপরে ওঠানো না যায় তাহলে সমাজব্যবস্থা একদিন না একদিন ভেঙ্গে পড়বেই। 'গীতাঞ্জলি'র ১০৮ সংখ্যক কবিতাতেই কবি তাঁর ক্ষোভ, হতাশা ও বেদনার কথা সুদৃঢ়ভাবে প্রকাশ করে বলেছেন_
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
মানুষের অধিকারে
বঞ্চিত করেছে যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমান হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
১৩১৭ সালের ২০ আষাঢ় (১৯১০ খ্রিস্টাব্দে) রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাটি লেখেন। তখনও ভারতবর্ষে অস্পৃশ্যতার বিরম্নদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কিন্তু গীতাঞ্জলি-গীতালি-গীতিমাল্য পর্বে কবির অরূপানুভূতি যতই গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে তাঁর মানবপ্রীতিও ততই ঘনিষ্ঠ ও সর্বাঙ্গীণ হয়ে উঠেছে। এই পর্বেই রচিত তাঁর 'অচলায়তন' (রচনা সমাপ্তিকাল ১৫ আষাঢ় ১৩১৮, প্রকাশ : প্রবাসী/আশ্বিন, ১৩১৮) নাটকে অস্পৃশ্যতা ও পুরনো কুসংস্কারের সহায়তাতেই দাদাঠাকুর বা গোঁসাই অচলায়তনের কুসংস্কারের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলেছেন। যাদের অচলায়তন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল অচলায়তনের 'গুর' (?) তাদের তো দূরে সরিয়ে রাখেনইনি পরন্তু তিনি তাদের একানত্ম আপনজনে পরিণত হয়েছেন। দাদাঠাকুর রবীন্দ্র-অঙ্কিত একজন শ্রেষ্ঠ সমাজ-বিপস্নবী।
'রথের রশি' নাটকটিতেও অস্পৃশ্যতার বিরম্নদ্ধে রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্ট ভাবনার পরিচয় মেলে। এখানেও তিনি দেখিয়েছেন যারা অবমানিত, লাঞ্ছিত তাদের স্পর্শেই মহাকালের অচল রথ চলছে। কবি নাটকটির মূল ভাবটি পরিস্ফুট করতে গিয়ে লিখেছিলেন- 'মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ বন্ধন দেশে দেশে যুগে-যুগে প্রসারিত, সেই বন্ধনই এই রথ টানবার রশি। সেই বন্ধনে অনেক গ্রন্থি পড়ে গিয়ে মানব-সম্বন্ধ অসত্য ও অসমান হয়ে গেছে, তাই চলছে না রথ। এই সম্বন্ধের অসত্য এতকাল যাদের বিশেষভাবে পীড়িত করেছে, অবমানিত করেছেন তাঁর রথের বাহনরূপে; তাদের অসম্মান ঘুচলে তবে সম্বন্ধের অসাম্য দূর হয়ে রথ সম্মুখের দিকে চলবে।'
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯১ সালের ১ ফেব্রম্নয়ারি শাহজাদপুর থেকে ভাতিজি ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে লিখেছিলেন, "প্রজারা যখন সসম্ভ্রম কাতরভাবে দরবার করে এবং আমলারা বিনীত করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন আমার মনে হয় এদের চেয়ে এমনি আমি কী মসত্ম লোক যে আমি একটু ইঙ্গিত করলেই এদের জীবন রক্ষা এবং আমি একটু বিমুখ হলেই এদের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। আমি যে চৌকিটার উপরে বসে বসে ভান করছি যেন এই সমসত্ম মানুষের থেকে আমি একটি স্বতন্ত্র সৃষ্টি, আমি এদের হর্তাকর্তা বিধাতা, এর চেয়ে অদ্ভুত আর কি হতে পারে! অনত্মরের মধ্যে আমিও যে এদেরই মতো দরিদ্র সুখ-দুঃখ কাতর মানুষ, পৃথিবীতে আমারও কত ছোট ছোট বিষয়ে দরবার, কত সামান্য কারণে মমর্ানত্মিক কান্না কত লোকের প্রসন্নতার উপরে জীবনের নির্ভর। এই সমসত্ম ছেলে পিলে-গোরু লাঙল, ঘর-কন্না ওয়ালা সরল হৃদয় চাষা-ভূষারা আমাকে কী ভুলই জানে! আমাকে এদের সমজাতি মানুষ বলেই জানে না।
অস্পৃশ্য নিম্ন শ্রেণীর মানুষের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সমবেদনা ও সহানুভূতি যে কত গভীর ছিল তা আরও নানা রচনা বিশেস্নষণ করেও দেখানো যেতে পারে। তবে মূল কথাটি হলো মানবতাবাদী কবি অনুভব করেছিলেন যে এক ভারত গড়ে তুলতে হলে সব জাতি ও সব ধর্মের মধ্যে সমন্বয় একানত্ম প্রয়োজন। বিভেদমূলক দৃষ্টিভঙ্গি দেশকে চরম দুরবস্থায় ঠেলে দেবে। তাই কেবল ব্রাহ্মহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্রের ব্যবধান দূর করলেই চলবে না_হিন্দু-মুসলমান-জৈন-খ্রীস্টান-বৌদ্ধ-প্রভৃতির মধ্যসত্ম ধর্মীয় ব্যবধানও দূর করতে হবে। 'সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরেই যে ভারতের পুণ্য অভিষেক সম্ভব_ এই ছিল তাঁর একানত্ম বিশ্বাস। আর তাঁর সেই দৃষ্টিভঙ্গি যে একজন সহৃদয় ও মহান মানবাতাবাদীর দৃষ্টিভঙ্গি সে কথা বলাই বাহুল্য।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক

অন্ত্যজ, রবীন্দ্রনাথ ও মানবতাবোধ
 হাবিবুর রহমান স্বপন
কোন জাতপাতের বিচার করতেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যদিও জাত-পাতের বিষয়টি সে-সময়ে প্রকট আকার ধারণ করেছিল। শাহজাদপুরের কাছারি বাড়িতে ১৮৯১ সালে (যখন জাত-ধর্ম প্রবল) মুসলমান বাবুর্চি এনাত আলীর হাতের রান্না খেতে হতো তাঁকে। অতি দরিদ্র এনাত আলী ভাল রান্না করতেন। শিলাইদহ এবং পতিসরে জমিদার বাড়িতে যে বাবুর্চি ছিলেন তারাও ছিলেন মুসলমান। শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের ভৃত্য মোমিন মিঞা একদিন সকালে কাজে আসে বিলম্বে। ঘুম থেকে উঠে কবি দেখলেন পানি না থাকায় স্নান করা যাচ্ছে না। বেশ দেরিতে মোমিন মিঞা এলে রবীন্দ্রনাথ রাগতঃস্বরে বললেন_ 'কোথায় ছিলি এতক্ষণ?' শোক বিহ্বল কণ্ঠে মোমিন মিঞা উত্তর দেয়, 'রাত দুপুরে আমার ৮ বছরের মেয়ে মারা গেছে।' এ কথা শুনে কবি মনোবেদনায় গলে গেলেন। প্রভুচিত্তের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো একটি চিরন্তন মানবমন। কবি ভাবলেন এক্ষেত্রে তো মোমিনের কোন দোষ নেই। ভৃত্য হলেও সে তো মানুষ, মানুষের মত সুখ দুঃখবোধ তো তারও আছে। কবি তখনই মোমিন মিঞাকে ছুটি দিয়ে দিলেন। মোমিন মিঞার এই ঘটনা নিয়েই রবীন্দ্রনাথ 'চৈতালী' কাব্যগ্রন্থে 'কর্ম' নামে কবিতা লেখেন।
শাহজাদপুরের নিকটবর্তী মাদলা গ্রামের গরিব মাঝি রামগতি খাজনা পরিশোধ না করতে পারায় তার জমি নিলামে ওঠে। রামগতি মাঝি একদিন শাহজাদপুর কাছারি বাড়িতে চিতল মাছ নিয়ে হাজির হয় জমিদার বাবুকে ঊপহার দেয়ার জন্য। রবীন্দ্রনাথ মাছ খেয়ে খুশি হয়ে রামগতিকে ডাকলেন। রামগতি জমিদার বাবুর কাছে তার জমি নিলাম সংক্রান্ত বিষয়টি অবহিত করলে জমিদার রবীন্দ্রনাথ তার সাত বছরের খাজনা মাফ করে দেন। সঙ্গে তার মাছের দাম দুই টাকা পরিশোধ করে দেয়ার নির্দেশ দেন পেশকারকে। 
শাহজাদপুরের 'হরকান্ত চক্রবর্তীর বাকি খাজনার নালিশের খরচা ও ড্যামেজ' মাফ করে দিয়েছিলেন এবং তোরাপ আলী ম-লের আবেদন মঞ্জুর করে লেখেন, 'জলি জমি যাহা ভোগ করিতেছে তাহা কায়েমি স্বরূপে দেওয়া যায়'। জমিদারি ছিল এজমালি অর্থাৎ অন্যান্য শরিকদের সাথে। তিনি ছিলেন সেটা পরিচালনার দায়িত্বে। তাই জমিদার কবি রবীন্দ্রনাথ (১৯১৭ খৃঃ) তাঁর মনের দুঃখের কথা প্রমথ চৌধুরীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, "আমার দুঃখ... প্রজাদের জন্য লোকসান করবার পূর্ণ অধিকার আমার হাতে নেই, তা হলে আমি শান্তি নিকেতন ছেড়ে আমি ওদের মধ্যে গিয়ে বসতুস্ত্তমনের সাধে বিষয় নষ্ট করতে করতে সুখে মরতুম।... ডাক্তার ও ডাক্তারখানায় আমাদের জমিদারীর এবং চতুপাশ্র্বের লোকের বিশেষ উপকার হয়েছে এই কথা যখন শুনতে পাই তখন সকল অভাবের দুঃখের উপর ঐ সুখটাই বড় হয়ে ওঠে।" ইংরেজ বন্ধু পীয়ার্সন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পতিসর এসে এক সপ্তাহ ছিলেন। তিনি লিখেছেন, 'রবীন্দ্রনাথকে তাঁর প্রজাদের সঙ্গে দেখা খুবই আনন্দের। ওরা তাকে গভীরভাবে ভালবাসে।'
পর পর কয়েক বছর বন্যা ও খরায় ভাল ফসল না হওয়ায় দুর্দশাগ্রস্ত প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের ব্যাপারে পতিসরের নায়েব শৈলেশচন্দ্র মজুমদারকে চাপ না দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বহু প্রজার খাজনা মাফ করে দিয়েছেন। কবি অমিয় চক্রবর্তীকে তিনি লিখেছিলেন, 'প্রজারা নিঃস্ব, শস্যের দাম অসম্ভব কমে গেছে, খাজনা প্রায় একেবারেই বন্ধ। নোবেল প্রাইজের সুদ বন্ধ'। উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কারের প্রাপ্ত সমস্ত টাকা দিয়ে পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন কৃষকের উন্নতির জন্য। এসময় যে ঋণ দেয়া হয়েছিল কৃষকদের, সেই ঋণ কৃষকরা শোধ করতে পারছেন না, তার কথাই তিনি উক্ত চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ পুত্র এবং জামাতাদের এসময় চিঠি লেখেন 'তোমরা দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজার অন্নগ্রাসের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ_ ফিরে এসে এই হতভাগ্যদের অন্নগ্রাস কিছু পরিমাণেও যদি বাড়িয়ে দিতে পার তাহলে মনে সান্ত্বনা পাব। মনে রেখো জমিদারের টাকা চাষীর টাকা এবং এই চাষীরাই তোমাদের শিক্ষার ব্যয়ভার নিজেরা আধপেটা খেয়ে এবং না খেয়ে বহন করছে। এদের ঋণ সম্পূর্ণ শোধ করবার দায় তোমাদের উপর রইল। নিজেদের সাংসারিক উন্নতির চেয়েও এইটেই তোমাদের প্রথম কর্তব্য হবে।' ছোট্ট এই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের সমাজচেতনা এবং মানবিকবোধের প্রকাশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথই বলতে পারেন এবং বলেছেন, 'জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, সে চাষীর।' তিনি বলেছিলেন, চাষীকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে হবে। যাতে জমিদার তাদের উপর অন্যায় অত্যাচার করার সুযোগ না পায়।' 
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী কবি। রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রধান ধর্ম_ মানবধর্ম। বিশ্বের অনাদৃত, শোষিত-তথাকথিত নিম্ন শ্রেণীর সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর সমবেদনা ও সহানুভূতি ছিল যেমন গভীর তেমনি আন্তরিক। এজন্যেই তো তিনি বিশ্ব কবি। যৌবনে শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসরে অবস্থানকালে জমিদারীর কাজকর্ম দেখাশোনার সময়েই তাঁর উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব রূপায়ণ দেখা যায় দুঃস্থ প্রজাদের কল্যাণে নানা পরিকল্পনা গ্রহণের মধ্যে। আদর্শ জমিদার রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন দরিদ্র কৃষকদের উন্নতি করতে হলে তাদেরকে মহাজনের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। সেজন্যে প্রয়োজন কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের। তাই তিনি নোবেল পুরস্কারের ১ লাখ ৮ হাজার টাকায় পতিসরে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া কৃষির প্রকৃত উন্নতি করতে হলে যে জমির প্রকৃত মালিকানা কৃষকদেরকে দেওয়া প্রয়োজন সেকথা অনুভব করে পরবর্তীকালে তিনি রাশিয়ার চিঠিতে লিখেছিলেন_ 'চাষীকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে হবে, এই ছিল আমার অভিপ্রায়। এ সম্বন্ধে দুটো কথা সর্বদাই আমার মনে আন্দোলিত হয়েছে_ জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, সে চাষীর ...।' তিনি আরও অনুভব করেছিলেন যে দরিদ্র কৃষকদের উন্নতি করতে হলে, দুঃখ দূর করতে হলে 'জনসাধারণের প্রতি দরদবোধ প্রয়োজন'। দুঃখীর দুঃখ দূরীকরণে রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক প্রচেষ্টার পরিচয় পাওয়া যায় শিলাইদহের কৃষকদের ডেকে সমবায় ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথের এই মানবপ্রীতি তথা সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ও সমবেদনা ধীরে ধীরে যে পূর্ণতর রূপ লাভ করেছে তা তাঁর বিভিন্ন ধরনের রচনা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগের ফলে রবীন্দ্রনাথ আপন জমি থেকে বঞ্চিত কৃষকের মনোবেদনা কত গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন তা 'দুইবিঘা জমি' কবিতাটি পড়লেই বোঝা যায়। উপেনের প্রতি ভূ-স্বামীর অত্যাচারের চিত্র তাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে এবং নিঃস্ব উপেনের প্রতি কবির গভীর সমবেদনা প্রকাশিত হয়েছে।
গরিব প্রজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর সখ্য ছিল। ১৯৩৭ সালের ২৬ জুলাই কবি শেষ বারের মত পতিসর আসেন। তখন সাম্প্রদায়িক দুর্দিন চলছিল। পতিসরের মুসলমান বহুল প্রজাদের পক্ষ থেকে কবিকে দেয়া হয় মুদ্রিত শ্রদ্ধাঞ্জলি। "প্রভুরূপে হেথা আস নাই তুমি দেব রূপে এসে দিলে দেখা, দেবতার দান অক্ষয় হউক হৃদিপটে থাক্ স্মৃতিরেখা।" একজন বৃদ্ধ মুসলমান কৃষক কবিকে বলেন, "আমরা তো হুজুর বুড়ো হয়েছি, আমরাও তো চলতি পথে, আপনিও চলতি পথে; বড়ই দুঃখ হয়, প্রজা-মনিবের এমন মধুর সম্বন্ধের ধারা বুঝি বন্ধ হয়ে যায়। ছেলে-পিলেদের মতি-গতি বদলে যাচ্ছে, তারা আমাদের সব নাদান মনে করে। এমন জমিদারের জমিদারিতে বাস করবার সৌভাগ্যবোধ তাদের বুঝি হবে না।" রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর পূর্বে গরিব প্রজাদের এসব স্মৃতিচারণ করেন অশ্রু সজল চোখে।
পিতা যখন রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি কাজের দায়িত্ব দিয়ে পূর্ব বাংলায় পাঠালেন তিনি শিলাইদহ ও শাহজাদপুরে এসে দেখলেন প্রজাদের বসবার জন্য আসনের তারতম্য। প্রজারা কেউ বা বসেছেন চৌকিতে কেউ বা পাটিতে আবার কেউ বা বসেছেন মাটিতে। এই বিষয়টি যুবক কবি জমিদার রবীন্দ্রনাথের ভাল লাগেনি। জমিদারদের রীতি-রেওয়াজকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, তিনি প্রজাদের সম্মানের কথা বিবেচনা করে সম আসনের ব্যবস্থা করেন। প্রজারা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে বিরক্ত হতেন এবং বাধা দিতেন। শাহজাদপুরের প্রধান কর্মচারী বিপিনচন্দ্রকে ডেকে বলেন, 'সবাই আমার প্রজা, আমার কাছে সবাই সমান, বেনী ম-ল, আলি নেওয়াজ খাঁ, হিন্দু ব্রাহ্মণ এরা ফরাসে বসবেন, আর মুসলমান বা নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা ভদ্রলোক হলেও, শিক্ষিত হলেও আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে!' এর পর থেকে সকলকেই ফরাসে বসার ব্যবস্থা করা হয়। প্রথম জমিদারির দায়িত্ব পেয়েই রবীন্দ্রনাথ শাহজাদপুর এলাকার গরিব প্রজাদের ১ লাখ ৮ হাজার টাকা খাজনা মাফ করে দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি চিঠি থেকে প্রমাণ মেলে তিনি প্রজাদের কল্যাণে কাজ করেছেন। মানুষের দুঃখে তাঁর হৃদয় ব্যথিত হতো। তিনি লিখেছেন, 'আমি জমিদারিকে কেবল নিজের লাভ-লোকসানের দিক হইতে দেখিতে পারি না। অনেকগুলি লোকের মঙ্গল আমাদের উপর নির্ভর করে ইহাদের প্রতি কর্তব্য পালনের দ্বারা ধর্মরক্ষা করিতে হইবে'। রবীন্দ্রনাথের উদারতার প্রমাণ মেলে তাঁর ছেলে ও জামাতাকে লেখা চিঠি থেকে। 'মনে রেখো জমিদারদের টাকা চাষীদের টাকা এবং চাষীরাই তোমাদের শিক্ষার ব্যয়ভার নিজেরা আধপেটা খেয়ে না খেয়ে বহন করছে এদের এই ঋণ সম্পূর্ণ শোধ করবার দায় তোমাদের উপর রইল। নিজেদের সাংসারিক উন্নতির চেয়েও এইটাই তোমাদের প্রথম কর্তব্য হবে।'
অস্পৃশ্যতা যে আমাদের একটি বিরাট সামাজিক ব্যাধি রবীন্দ্রনাথ তা বহুদিন থেকেই অনুভব করেছেন। অস্পৃশ্য বলে যে বিরাট জনসমাজকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, অবমাননার অতলে তলিয়ে রাখা হয়েছে, তাদেরকে যদি কাছে টেনে নেওয়া না যায়, ওপরে ওঠানো না যায় তাহলে সমাজ-ব্যবস্থা একদিন না একদিন ভেঙ্গে পড়বেই। 'গীতাঞ্জলি'র ১০৮ সংখ্যক কবিতাতেই কবি তাঁর ক্ষোভ, হতাশা ও বেদনার কথা সুদৃঢ়ভাবে প্রকাশ করে বলেছেন_ 
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
মানুষের অধিকারে
বঞ্চিত করেছে যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
১৩১৭ সালের ২০ আষাঢ় (১৯১০ খৃস্টাব্দে) রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাটি লেখেন। তখনো ভারতবর্ষে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কিন্তু গীতাঞ্জলি-গীতালি-গীতিমাল্য পর্বে কবির অরূপানুভূতি যতই গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে তাঁর মানবপ্রীতিও ততই ঘনিষ্ঠ ও সর্বাঙ্গীন হয়ে উঠেছে। এই পর্বেই রচিত তাঁর 'অচলায়তন' (রচনা সমাপ্তিকাল ১৫ আষাঢ় ১৩১৮, প্রকাশ : প্রবাসী/ আশ্বিন, ১৩১৮) নাটকে অস্পৃশ্যতা ও পুরোনো কুসংস্কারের সহায়তাতেই দাদাঠাকুর বা গোঁসাই অচলায়তনের কুসংস্কারের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলেছেন। যাদেরকে অচলায়তন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল অচলায়তনের 'গুরু' (?) তাদেরকে তো দূরে সরিয়ে রাখেনই-নি উপরন্তু তিনি তাদের একান্ত আপনজনে পরিণত হয়েছেন। দাদাঠাকুর রবীন্দ্র-অঙ্কিত একজন শ্রেষ্ঠ সমাজ-বিপ্লবী।
'পুনশ্চ' কাব্যের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের উদার মানবীয় ভাবের সার্থক প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে সে সময়ের অস্পৃশ্যতা সমস্যা অবলম্বনে রচিত "প্রথম পূজাও "শুচি" কবিতা দু'টিতে অস্পৃশ্যদের সম্বদ্ধে রবীন্দ্রনাথের মনোভাবের সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। ডাঃ ক্ষুদিরাম দাস 'প্রথম পূজা' কবিতাটি সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন_ 'কবি তাঁর গভীর সহানুভূতি ও সমাজ-অধ্যয়ন নিয়ে লক্ষ্য করেছেন আর্য শ্রেণীতে ব্রাহ্মহ্মণ-ক্ষত্রিয়াদি কীভাবে অনার্য ও নিম্নবর্ণের সংস্কৃতি আত্মসাৎ করে ঐ নিম্নবর্ণের মানুষদের নিষ্ঠুরভাবে বঞ্চিত করেছে তাদের নিজস্ব সম্পদ থেকে।' ত্রিলোকেশ্বরের যে মন্দিরে হাজার বছর আগে প্রতিষ্ঠা করেছিল কিরাত সম্প্রদায়ের লোকেরা, _ক্ষত্রিয়রা একদিন তাদেরকে পরাভূত করে তাদের দেবতাদের ওপরও আধিপত্য বিস্তার করে। ক্ষত্রিয়রা কিরাতদেরকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে_ মন্দিরের দেবতার দর্শন পায় না তারা_ 'কিরাত আজ অস্পৃশ্য, এ মন্দিরে তাদের প্রবেশপথ লুপ্ত।' কিন্তু যাদের দেবতা তদেরকে দেবতার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়াতে দেবতার রোষাগি্নতে ভেঙ্গে পড়ে মন্দির, দেবতার মূর্তিও বিদীর্ণ হয়ে যায়। কিরাতরা ছাড়া আর কারাও জানে না মন্দির আর মূর্তি গড়ার রহস্য। তাই রাজা নিরুপায় হয়ে ডাক দেন কিরাতদের সর্দার মাধবকে_ 
'তোমরা না হলে দেবালয় সংস্কার হয় না।'
দেবতাকে ছুঁলে পাপ হয় না, ক্ষতি হয় না দেবতার, _শুধু কিরাতের নগ্ন দৃষ্টি দিয়ে
দেখলে দেবতা অপবিত্র হয়ে যায়! তাই অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে কাজ করার পর অন্তর্যামীর
মূর্তি সম্পূর্ণ হলে মাধব তাঁকে না দেখে আর পারে না। _চোখের বাঁধন খুলে ফেলে_
একদৃষ্টে চেয়ে রইল দেবতার মুখে,
দু'চোখে বইল জলের ধারা।
আজ হাজার বছরের ক্ষুধিত দেখা দেবতার সঙ্গে ভক্তের।
কিন্তু ক্ষত্রিয় রাজা কি অস্পৃশ্য কিরাতদের এই স্পর্ধা সহ্য করতে পারেন। তাই_
রাজা প্রবেশ করলেন মন্দিরে।
তখন মাধবের মাথা নত বেদীমূলে।
রাজার তলোয়ারে মুহূর্তে ছিন্ন হল সেই মাথা।
দেবতার পায়ে এই প্রথম পূজা, এই শেষ প্রণাম।
'শুচি' কবিতাটিতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আচ-ালে কোল দানের আদর্শটিকে চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবগুরু রায় রামানন্দের আচরণের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এই কবিতাটির মূল ভাবটি 'প্রথম পূজার'ই অনুরূপ। অশুচি বলে যাদেরকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি তাদের মধ্যেও যে দেবতার স্পর্শ রয়েছে তা উচ্চবর্ণের মানুষেরা ভুলে যায়_ তাই অন্তর্যামী গুরুকে মনে করিয়ে দেন_ 
ঠাকুর বললেন, 'আমার বাস কি কেবল বৈকুণ্ঠে।
সেদিন আমার মন্দিরে যারা প্রবেশ পায়নি
আমার স্পর্শ যে তাদের সর্বাঙ্গে
আমারই পাদোদক নিয়ে
প্রাণ প্রবাহিণী বইছে তাদের শিরায়।
তাদের অপমান আমাকে বেজেছে,
আজ তোমার হাতের নৈবেদ্য অশুচি।
রামানন্দ বুঝতে পারলেন তাঁর ভুল। তাই রাত্রি অবসানের পূর্বেই তিনি মন্দির থেকে বের হয়ে অস্পৃশ্য জোলা কবীরের কাছে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। অস্পৃশ্য ইতর সাধারণ মানুষদের মধ্যে যে বিস্ময়কর আসাধারণত্ব বর্তমান। কবি যেন তারই স্বরূপ উদ্্ঘাটন করেছেন উলি্লখিত কবিতা দুটিতে। মাধব আর কবীর তাঁদের আন্তরিক ভক্তি ও নিষ্ঠার জন্য উচ্চবর্ণের ব্যক্তিদের চেয়ে অনেক মহনীয় রূপলাভ করেছেন।
'রথের রশি' নাটকটিতেও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্ট ভাবনার পরিচয় মেলে। এখানেও তিনি দেখিয়েছেন যারা অবমানিত, লাঞ্ছিত তাদের স্পর্শেই মহাকালের অচল রথ চলছে। কবি নাটকটির মূল ভাবটি পরিস্ফুট করতে গিয়ে লিখেছিলেন_ 'মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ বন্ধন দেশে দেশে যুগে-যুগে প্রসারিত, সেই বন্ধনই এই রথ টানবার রশি। সেই বন্ধনে অনেক গ্রন্থি পড়ে গিয়ে মানব-সম্বন্ধ অসত্য ও অসমান হয়ে গেছে, তাই চলছে না রথ। এই সম্বন্ধের অসত্য এতকাল যাদের বিশেষভাবে পীড়িত করেছে, অবমানিত করেছেন তাঁর রথের বাহনরূপে; তাদের অসম্মান ঘুচলে তবে সম্বন্ধের অসাম্য দূর হয়ে রথ সম্মুখের দিকে চলবে।'
পুরোহিত রাজা, বণিক কারও শক্তিতে যে রথ চলেনি শূদ্রের স্পর্শে সেই রথ চলেছে। এ যুগে শূদ্র-শক্তিই যে প্রধান শক্তি কবি বোধহয় এই নাটকটিতে সে ইঙ্গিতটিও দান করেছেন। মন্ত্রীর মুখ দিয়ে কবির উক্ত অভিপ্রায়টি এইভাবে প্রকশিত হয়েছে। _'রথযাত্রা আমাদের একটি পরীক্ষা। কাদের শক্তিতে সংসারটি সত্যিই চলছে, রথচক্র ঘোরার দ্বারা সেইটেই প্রমাণ হয়ে যাবে।' 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি শাহজাদপুর থেকে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে লিখেছিলেন, "প্রজারা যখন সসম্ভ্রম কাতরভাবে দরবার করে এবং আমলারা বিনীত করজোরে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন আমার মনে হয় এদের চেয়ে এমনি আমি কী মস্ত লোক যে আমি একটু ইঙ্গিত করলেই এদের জীবন রক্ষা এবং আমি একটু বিমুখ হলেই এদের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। আমি যে চৌকিটার উপরে বসে বসে ভান করছি যেন এই সমস্ত মানুষের থেকে আমি একটি স্বতন্ত্র সৃষ্টি, আমি এদের হর্তাকর্তা বিধাতা, এর চেয়ে অদ্ভুত আর কি হতে পারে! অন্তরের মধ্যে আমিও যে এদেরই মতো দরিদ্র সুখ-দুঃখ কাতর মানুষ, পৃথিবীতে আমারও কত ছোটো ছোটো বিষয়ে দরবার, কত সামান্য কারণে মর্মান্তিক কান্না কত লোকের প্রসন্নতার উপরে জীবনের নির্ভর। এই সমস্ত ছেলে পিলে-গোরু লাঙল, ঘরকন্নাওয়ালা সরল হৃদয় চাষা-ভূষারা আমাকে কী ভুলই জানে! আমাকে এদের সমজাতি মানুষ বলেই জানে না।
কবি এই চিঠিতেই লিখেছেন 'প্রেজটিজ' মানে হচ্ছে মানুষ সম্মন্ধে মানুষের ভুল বিশ্বাস! আমাকে এখানকার প্রজারা যদি ঠিক জানত, তা হলে আপনাদের একজন বলে চিনতে পারত, সেই ভয়ে সর্বদা মুখোষ প'রে থাকতে হয়। রবীন্দ্রনাথ মানুষ হিসাবে যে অতি সাধারণ ছিলেন এসব লেখা থেকেই তার প্রমাণ মেলে অস্পৃশ্য নিম্ন শ্রেণীর মানুষের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সমবেদনা ও সাহানুভূতি যে কত গভীর ছিল তা আরও নানা রচনা বিশ্লেষণ করেও দেখানো যেতে পারে। তবে মূল কথাটি হলো মানবতাবাদী কবি অনুভব করেছিলেন যে এক ভারত গড়ে তুলতে হলে সব জাতি ও সব ধর্মের মধ্যে সমন্বয় একান্ত প্রয়োজন। বিভেদমূলক দৃষ্টিভঙ্গি দেশকে চরম দূরবস্থায় ঠেলে দেবে। তাই কেবল ব্রাহ্মহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্রের ব্যবধান দূর করলেই চলবে না-হিন্দু-মুসলমান-জৈন-খ্রীস্টান-বৌদ্ধ-প্রভৃতির মধ্যস্থ ধর্মীয় ব্যবধানও দূর করতে হবে। 'সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীরেই যে ভারতের পুণ্য অভিষেক সম্ভব_ এই ছিল তাঁর একান্ত বিশ্বাস। আর তাঁর সেই দৃষ্টিভঙ্গি যে একজন সহৃদয় ও মহান মানবাতাবাদীর দৃষ্টিভঙ্গি সে কথা বলাই বাহুল্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: জীবন, সাহিত্য ও দর্শন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (বাংলা ২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ – ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮) (খ্রিস্টীয় ৭ মে, ১৮৬১ – ৭ অগস্ট, ১৯৪১) ছিলেন বাংলা তথা ভারতের বিশিষ্ট কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, সংগীতস্রষ্টা, নট ও নাট্যকার, চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তিনি বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। রবীন্দ্রনাথকে 'গুরুদেব', 'বিশ্বকবি' ও 'কবিগুরু' অভিধায় অভিহিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর মোট ৯৫টি ছোটগল্প এবং ১৯১৫টি গান যথাক্রমে 'গল্পগুচ্ছ' ও 'গীতবিতান' সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত এবং গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২টি খণ্ডে 'রবীন্দ্র রচনাবলী' নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য ১৯ খণ্ডে 'চিঠিপত্র' সংকলনে ও অন্য চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি প্রায় দু'হাজার ছবিও এঁকেছিলেন। তাঁর রচনা আজ বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে ও হচ্ছে।

ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার এক ধনাঢ্য সংস্কৃতিবান পিরালি ব্রাহ্মণ পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। বাল্যে প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণে তিনি অসম্মত হয়েছিলেন। তাই গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। মাত্র আট বছর বয়সে কাব্যরচনায় প্রবৃত্ত হন তিনি। ১৮৭৪ সালে 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'য় তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির নাম ছিল 'অভিলাষ'। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৮৭৮ সালে সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথম ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৮৯০ সাল থেকে তিনি পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে। এখানেই ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। ১৯০২ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয়। ১৯০৫ সালে জড়িয়ে পড়েন বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে। ১৯১৩ সালে 'গীতাঞ্জলি' কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথই এশিয়া মহাদেশের প্রথম নোবেলজয়ী সাহিত্যিক। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধি প্রদান করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীনিকেতন। এই সংস্থা গ্রামীণ সমাজের সার্বিক উন্নয়নের কাজে আত্মনিয়োগ করে। ১৯২৩ সালে শান্তিনিকেতনেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী বিদ্যালয়। দীর্ঘজীবনে বহুবার বিদেশভ্রমণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রচার করেছিলেন সৌভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বমানবতার বাণী। ১৯৪১ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য তাঁর ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। তাঁর গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। গ্রামীণ উন্নয়ন ও গ্রামীণ জনসমাজে শিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমে সার্বিক সমাজকল্যাণের তত্ত্ব প্রচার করতেন তিনি। পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের দর্শনে ঈশ্বর এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরের মূল নিহিত রয়েছে মানব সংসারের মধ্যেই। তিনি দেববিগ্রহের পরিবর্তে মানুষ অর্থাৎ কর্মী ঈশ্বরকে পূজার কথা বলতেন। সংগীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কীর্তি তাঁর গান। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত 'জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে' ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা' তাঁরই রচনা।

জীবন

*

উদয়দিগঙ্গনে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে। তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পত্নী সারদাসুন্দরী দেবীর চতুর্দশ সন্তান। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার শুধু ব্রাহ্ম আদিধর্ম মতবাদের প্রবক্তাই ছিল না, বরং সেযুগের কলকাতার শ্রেষ্ঠ ধনী ও সংস্কৃতিবান পরিবার হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু এহেন পরিবারের সন্তান হয়েও পিতামাতার সান্নিধ্য থেকে দূরে ভৃত্য ও অন্যান্য আত্মীয়দের শাসনে ছেলেবেলা কেটেছিল রবীন্দ্রনাথের। তাঁর নিজের ভাষায় সে ছিল 'ভৃত্যরাজক-তন্ত্র'। শৈশবে কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণহীন বিদ্যার আয়োজনে বিতৃষ্ণ হয়ে শেষ পর্যন্ত বালক রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেন। তখন বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। অতি শৈশবে একবার জোড়াসাঁকোর বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গঙ্গাতীরে পানিহাটির বাগানবাড়িতে সেই প্রথম মুক্ত প্রকৃতির সংস্পর্শে আসেন তিনি।

প্রথম দেশভ্রমণের সুযোগ অবশ্য পেয়েছিলেন ১১ বছর বয়সে। ১৮৭৩ সালে তাঁর উপনয়ন হয়। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশভ্রমণের নেশা তাঁকে বছরের অধিকাংশ সময়ই দেশান্তরী করে রাখত। উপনয়নের পর দেবেন্দ্রনাথ পুত্রকে নিয়ে দেশভ্রমণে বের হন। প্রথমে তাঁরা আসেন শান্তিনিকেতনে। এখানে বসেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম নাটক 'পৃথ্বীরাজ পরাজয়' রচনা করেন। এই নাটকটির পাণ্ডুলিপি তাঁর জীব্বদশাতেই হারিয়ে যায়। শান্তিনিকেতনে কিছুকাল কাটিয়ে চলে যান পাঞ্জাবের অমৃতসরে। এখানে থাকাকালীন স্বর্ণমন্দিরে শিখদের ভজন ও উপাসনা পদ্ধতি চাক্ষুষ করেন পিতাপুত্র। এরপর আসেন ডালহৌসির নিকট বক্রোটা পাহাড়ের চূড়ায়। জায়গাটি বর্তমানে হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে, সেই সময় অবশ্য পাঞ্জাবেরই অন্তর্গত ছিল। বক্রোটার বাংলোয় দেবেন্দ্রনাথ নিজে বালক রবীন্দ্রনাথকে কিছু কিছু পাঠ দিতে থাকেন। পিতার কাছে এই সময় রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের পাঠ নিতে থাকেন। পিতার অনুপ্রেরণায় উৎসাহিত হন মহামানবদের জীবনী, কালিদাসের ধ্রুপদি সংস্কৃত কাব্য-নাটক এবং উপনিষদ্ পাঠে। ফিরে এসে গৃহশিক্ষক জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছে পাঠগ্রহণকালে রবীন্দ্রনাথ শেকসপিয়রের 'ম্যাকবেথ' ও কালিদাসের 'কুমারসম্ভবম্' নাটকের কিয়দংশ অনুবাদ করেন।

১৮৭৪ সালে 'ভারতী' পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের 'অভিলাষ' কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৮৭৫ সালে বার্ষিক হিন্দুমেলা উৎসব উপলক্ষ্যে তিনি রচনা করেন 'হিন্দুমেলার উপহার'। কবিতাটি প্রকাশিত হয় 'অমৃতবাজার পত্রিকা'য়। এই বছরই মাতৃবিয়োগ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। ১৮৭৭ সালে 'ভারতী' পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। এগুলি হল 'মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা', ভানুসিং-ভণিতাযুক্ত রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক কবিতাগুচ্ছ (যা পরবর্তীকালে 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়) এবং 'ভিখারিণী' ও 'করুণা' নামে দুটি গল্প। উল্লেখ্য, 'ভিখারিণী' বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটোগল্প। ১৮৭৭ সালেই দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'অলীকবাবু' নাটকে নামভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে রঙ্গালয়ে আবির্ভাব ঘটে নট রবীন্দ্রনাথের। ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'কবিকাহিনী'। এটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থও বটে। এই বছরই বিলেত যাত্রার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সেকালের বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে অবস্থিত আমেদাবাদ শহরে যান রবীন্দ্রনাথ। সেখানে আনা তড়খড় নামে একটি মারাঠি মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই ব্যর্থ প্রণয়ের ছায়া পড়েছিল ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত তাঁর 'নলিনী' নাট্যকাব্যে।

যৌবননিকুঞ্জে

১৮৭৮ সালে সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গেলেন ইংল্যান্ডে। উদ্দেশ্য ছিল ব্যারিস্টার হওয়া। প্রথমে এলেন ব্রাইটনে। ভর্তি হলেন সেখানকার একটি পাবলিক স্কুলে। পরে ১৮৭৯ সালে ভর্তি হলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু হল আইনবিদ্যা পাঠ। কিন্তু সাহিত্যের আকর্ষণে সেই পাঠ খুব একটা এগোল না। এই সময় শেকসপিয়র ও অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের রচনা নিবিড়ভাবে অধ্যয়নের সুযোগ পেলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলেন 'রিলিজিও মেদিচি', 'কোরিওলেনাস' ও 'অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা'। নিজের ইংল্যান্ড বাসের অভিজ্ঞতার কথা 'ভারতী' পত্রিকায় পত্রাকারে পাঠাতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের টীকা সহকারে 'য়ুরোপযাত্রী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্রধারা' নামে প্রকাশিত হতে লাগল, সেই ভ্রমণবৃত্তান্ত। ১৮৮১ সালে 'য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র' নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিতও হল সেটি। 'য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র'ই রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যগ্রন্থ তথা চলিত ভাষায় লেখা প্রথম বই। দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটানোর পর ১৮৮০ সালে কোনো ডিগ্রি ছাড়াই দেশে ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে আনলেন পাশ্চাত্য সংগীতের সুর ও অপেরা নাট্যশৈলী সম্পর্কে কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার ফসল ১৮৮১ সালের 'বাল্মীকি-প্রতিভা'। ১৮৮২ সালে রমেশচন্দ্র দত্তের কন্যার বিবাহসভায় সদ্যপ্রকাশিত 'সন্ধ্যাসংগীত' কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতা পাঠ করলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই কবিতা শুনে নিজের গলার মালা খুলে রবীন্দ্রনাথের গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) ঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হল। বিবাহিত জীবনে ভবতারিণী হলেন মৃণালিনী দেবী (১৮৭৩–১৯০২ )।

১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথের বাল্য সহচরী তথা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। এই আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ জানা যায় না। তবে এই ঘটনা রবীন্দ্রনাথের মনে এক গভীর রেখাপাত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরী সম্পর্কের রসায়ন তাই পরবর্তীকালের গবেষকদের গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

১৮৮৪ সালেই রবীন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৮৮৬ সালে জন্ম হয় জ্যেষ্ঠ সন্তান মাধুরীলতার (১৮৮৬–১৯১৮)। ১৮৮৮ সালে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে চলে আসেন উত্তর ভারতের গাজিপুরে। 'মানসী' কাব্যগ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা তিনি এখানে বসেই লিখেছিলেন। এই বছর ২৭ নভেম্বর জন্ম হয় রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৮৮–১৯৬১)। ১৮৯০-৯১ সাল নাগাদ দেবেন্দ্রনাথের আদেশক্রমে নদিয়া, কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চলের জমিদারিগুলির তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। এই সময় দীর্ঘ কয়েক বছর সপরিবারে কলকাতা ও শিলাইদহে পর্যায়ক্রমে বসবাস করেন। ১৮৯১ সালে দ্বিতীয়া কন্যা রেণুকা (১৮৯১–১৯০৩), ১৮৯৪ সালে কনিষ্ঠা কন্যা মীরা (১৮৯৪–১৯৬৯) ও ১৮৯৬ সালে কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের (১৮৯৬–১৯০৭) জন্ম হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে রবীন্দ্রনাথের ন'টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলি হল: 'মানসী' (১৮৯০), 'সোনার তরী' (১৮৯৪), 'চিত্রা', 'চৈতালি' (১৮৯৬), 'কণিকা' (১৮৯৯), 'কথা', 'কাহিনী', 'কল্পনা' ও 'ক্ষণিকা' (১৯০০)। ১৮৯০ সালে পূর্ববঙ্গের সাজাদপুরে বসে তিনি লেখেন 'বিসর্জন' নাটকটি। ১৮৯২ সালে প্রকাশিত হয় নাট্যকাব্য 'চিত্রাঙ্গদা'। সেই সঙ্গে নিয়মিত গীতিচর্চাও করতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৯৪ সালে গ্রহণ করেন 'সাধনা' পত্রিকার সম্পাদনার ভার। এই পত্রিকাতেই সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কিছু গদ্যরচনা প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, 'গল্পগুচ্ছ' গল্পসংকলনের প্রথম ৮৪টি গল্পের অর্ধেকই এই সময়ের রচনা। এই গল্পগুলির রসদ তিনি সংগ্রহ করেছিলেন পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ হিন্দুসমাজ থেকে।

বিশ্ববীণারবে

১৯০১ সালে শিলাইদহ ছেড়ে পাকাপাকিভাবে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের উপকণ্ঠে শান্তিনিকেতনে চলে এলেন রবীন্দ্রনাথ। ইতিপূর্বে এখানে দেবেন্দ্রনাথ একটি আশ্রম ও ব্রহ্মমন্দির স্থাপন করেছিলেন। এই আশ্রম, ব্রহ্মমন্দির, আম্রকুঞ্জ ও একটি গ্রন্থাগার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চালু করলেন একটি পরীক্ষামূলক স্কুল। নাম দিলেন 'ব্রহ্ম বিদ্যালয়'। এরই মধ্যে একের পর এক নিকটজনের মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করে তুলল। ১৯০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী চলে গেলেন। ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর চলে গেলেন কন্যা রেণুকা। ১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি কবির পিতৃবিয়োগ হল। সবচেয়ে মর্মান্তিক মৃত্যুশোক এল ১৯০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে। এই মৃত্যুশোক থেকেই উৎসারিত হল তাঁর কাব্যধারার 'গীতাঞ্জলি' পর্যায়টি।

এসবের মধ্যেই ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে পড়লেন বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে। যৌবনে পূর্ববঙ্গের গ্রামজীবনকে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেওয়ার প্রত্যক্ষ অনুভূতি তাঁকে স্বদেশের প্রকৃত উন্নতির পথটি সম্পর্কে ভাবিয়ে তুলল। রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন, গ্রামীণ সমাজের সার্বিক উন্নতি ছাড়া দেশের উন্নতি অসম্ভব। ব্রহ্মবিদ্যালয়ের মাধ্যমে মুক্তশিক্ষার প্রচারের পাশাপাশি গ্রামোন্নয়নের জন্যও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন তিনি। ১৯০৬ সালে জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথকে আধুনিক কৃষি ও গোপালন বিদ্যা শিক্ষা এবং ১৯০৭ সালে কনিষ্ঠ জামাতা নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কৃষিবিজ্ঞান শিক্ষার জন্য পাঠালেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁদের শিক্ষার খরচ বহন করলেন নিজেই। এই সময়ে শান্তিনিকেতন আশ্রমে দেখা দিল তীব্র অর্থসংকট। স্ত্রীর গয়না, পুরীর বসতবাটী, বইয়ের স্বত্ব বিক্রি করে চলতে লাগল ব্যয়নির্বাহ।

ইতিমধ্যেই বাংলায় তো বটেই, বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল তাঁর কবিখ্যাতি। 'নৈবেদ্য' (১৯০১), 'খেয়া' (১৯০৬) ও 'গীতাঞ্জলি' (১৯১০) কাব্যগ্রন্থের নির্বাচিত কিছু কবিতার অনুবাদ পাশ্চাত্য সমাজে রবীন্দ্রনাথকে পরিচিত করে তুলল। এই অনুবাদগুলির সংকলন 'সংস অফারিংস' বা ইংরেজি 'গীতাঞ্জলি' (১৯১৩) প্রকাশিত হওয়ার পর সুইডিশ আকাদেমি তাঁকে ভূষিত করল সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দিয়ে। রবীন্দ্রনাথই ছিলেন প্রথম এশীয় নোবেলজয়ী সাহিত্যিক। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে 'স্যার' উপাধিতে ভূষিত করল। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এই উপাধি ত্যাগ করলেন রবীন্দ্রনাথ।

বিংশ শতাব্দীর বিশের দশক থেকে প্রত্যক্ষভাবে গ্রামোন্নয়নের কাজ শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২১ সালে স্থাপিত হল 'পল্লীসংগঠন কেন্দ্র'। রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন মার্কিন কৃষি-অর্থনীতিবিদ লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিনিকেতনের একাধিক শিক্ষক ও ছাত্র। সংস্থাটির উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতিসাধন, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগ নিবারণ, সমবায় প্রথায় ধর্মগোলা স্থাপন, চিকিৎসার সুব্যবস্থা এবং সাধারণ গ্রামবাসীদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি করা। ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ এই সংস্থার নাম পরিবর্তন করে রাখলেন 'শ্রীনিকেতন'। দেশ ও বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিশেষজ্ঞেরা শ্রীনিকেতনকে আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য প্রেরণ করতেন। শ্রীনিকেতন আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক কুপ্রথা ও কুসংস্কারগুলির বিরুদ্ধের সোচ্চার হতে শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ। ত্রিশের দশকের প্রথম ভাগ থেকে কবিতা-গান ও বক্তৃতার মাধ্যমে বর্ণাশ্রম প্রথা ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকেন।

দিনান্তবেলায়

রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ দশকটি (১৯৩২-১৯৪১) তাঁর সৃষ্টিকলার ইতিহাসে এক অত্যাশ্চর্য পর্যায়। এই পর্বে তাঁর সাকুল্যে ৫০টি বই প্রকাশিত হয়। সাহিত্যের নানা ধারায় নব নব সৃষ্টিপরীক্ষায় মেতে উঠেছিলেন সপ্ততিপর রবীন্দ্রনাথ। এই পরীক্ষানিরীক্ষার ফসল তাঁর গদ্যগীতিকা ও নৃত্যনাট্যগুলি। রবীন্দ্রনাথের এই সময়কার গদ্যকবিতাগুলি সংকলিত হয়েছে 'পুনশ্চ' (১৯৩২), 'শেষ সপ্তক' (১৯৩৫), 'শ্যামলী' ও 'পত্রপুট' (১৯৩৬) – এই চারটি সংকলনে। বাংলা নাট্যসাহিত্যের এক যুগান্তর তাঁর এই সময়কার নৃত্যনাট্যগুলি – 'নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা' (১৯৩৬; 'চিত্রাঙ্গদা' (১৮৯২) কাব্যনাট্যের নৃত্যাভিনয়-উপযোগী রূপ),'শ্যামা' (১৯৩৯) ও 'চণ্ডালিকা' (১৯৩৯)। জীবনের শেষ দশকে তিনি রচনা করে ফেলেছিলেন তিনটি ভিন্নধর্মী উপন্যাসও – 'দুই বোন' (১৯৩৩), 'মালঞ্চ' (১৯৩৪) ও 'চার অধ্যায়' (১৯৩৪)। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন 'বিশ্বপরিচয়'। এই গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিকতম সিদ্ধান্তগুলি সরল বাংলা গদ্যে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তাঁর কাব্যেও। 'সে' (১৯৩৭), 'তিন সঙ্গী' (১৯৪০) ও 'গল্পসল্প' (১৯৪১) গল্পসংকলন তিনটিতে তাঁর বিজ্ঞানী চরিত্র-কেন্দ্রিক একাধিক গল্প সংকলিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁর আঁকা অধিকাংশ ছবিও এই সময়েরই সৃষ্টি।

বিজ্ঞানচর্চা ও কুসংস্কারের বিরোধিতা জীবনের এই পর্যায়ে রবীন্দ্র-চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিহার প্রদেশে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে বহু লোকের মৃত্যু হয়। মহাত্মা গান্ধী এই ভূমিকম্পকে 'ঈশ্বরের রোষ' বলে চিহ্নিত করলে, এহেন অবৈজ্ঞানিক মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান রবীন্দ্রনাথ। পাশাপাশি বাংলার আর্থিক দুরবস্থা ও ভারতের রাজনৈতিক সমস্যাও এই সময়ে রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ চিন্তিত করে রেখেছিল।

জীবনের শেষ চারটি বছর রবীন্দ্রনাথের কেটেছিল ধারাবাহিক অসুস্থতার মধ্য দিয়ে। ১৯৩৭ সালে একবার তিনি গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেবার সেরে উঠলেও, ১৯৪০ সালের অসুস্থতার পর আর সেরে ওঠেননি। অসুখ-আরোগ্য-অসুখের লুকোচুরি খেলার মধ্যে লেখা তাঁর শেষ চারটি কাব্যগ্রন্থে মৃত্যুচেতনাকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথ সাজিয়ে তোলেন কিছু অসামান্য পংক্তি। ১৯৪০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সাম্মানিক ডি. লিট. প্রদান করে। মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত কবি সৃষ্টিশীল ছিলেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকোর পৈত্রিক বাসভবনেই তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে।

ভুবনবীণা

১৮৭৮ থেকে ১৯৩২। এই সময়পর্বের মধ্যে বারোটি বিশ্বভ্রমণ কর্মসূচি। আর তারই মাধ্যমে ৫টি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন রবীন্দ্রনাথ।

যৌবনে দু'বার ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন তিনি। প্রথম বার ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন ১৮৯০ সালে। কেন গিয়েছিলেন, তার কারণ ঠিক স্পষ্ট নয়। ১৯১২ সালে তৃতীয়বার ইংল্যান্ডে গেলেন ব্যক্তিগত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। এই সময়েই ইয়েটস প্রমুখ ইংরেজ কবি ও বিদ্বজ্জনেদের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি। 'গীতাঞ্জলি'র ইংরেজি অনুবাদ রবীন্দ্রনাথ পাঠ করে শোনালেন এই নতুন বন্ধুমহলে। সকলে মুগ্ধ। ইয়েটস স্বয়ং লিখে দিলেন বইটির ভূমিকা। এরপর ১৯১৩ সালে এই বইটির জন্যই রবীন্দ্রনাথ পেলেন সাহিত্যে নোবেল। উল্লেখ্য, এই তৃতীয় বিলেত সফরের সময়েই দীনবন্ধু সি এফ অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল।

১৯১৬-১৭ সালে প্রথমে জাপানে ও পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কতকগুলি বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতামালায় সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ সোচ্চার হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ উভয় দেশেই প্রত্যাখ্যাত হন রবীন্দ্রনাথ। তবে তাঁর এই বক্তৃতাগুলি সংকলিত হয়ে থাকে 'ন্যাশনালিজম্' (১৯১৭) সংকলনে।

১৯২০-২১ সাল নাগাদ আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ভ্রমণে যান রবীন্দ্রনাথ। এই সফরকালে পাশ্চাত্য দেশগুলিতে সংবর্ধিতও হন তিনি। ১৯২৪ সালে যান চীন সফরে। সেখান থেকে আবার যান জাপানে। এবারেও জাতীয়তাবাদ-বিরোধী বক্তৃতা দেন জাপানে।

১৯২৪ সালের শেষ দিকে পেরু সরকারের কাছ থেকে সেদেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ পান রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু পথে আর্জেন্টিনায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। পেরুর বদলে থেকে যান সেই দেশেই। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথেয়তায় কাটান তিনটি মাস। অসুস্থতার জন্য পেরু যাওয়া বাতিল হয়ে যায়।

১৯২৬ সালে বেনিতো মুসোলিনি রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানান ইতালিতে। প্রথমে মুসোলিনির আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু ক্রমে লোকমুখে মুসোলিনির স্বৈরাচার-অত্যাচারের কথা জানতে পেরে তাঁর সমালোচনায় মুখর হলেন তিনি। ফলত, উভয়ের উষ্ণ সম্পর্কে অচিরেই পড়ল ছেদ। গ্রিস, তুরস্ক ও মিশর ঘুরে রবীন্দ্রনাথ ফিরে এলেন ভারতে।

১৯২৭ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ চার সঙ্গীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চললেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভ্রমণে। দেখলেন বালি, জাভা, কুয়ালালামপুর, মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম ও সিঙ্গাপুর। ১৯৩০ সালে শেষ বার ইংল্যান্ড গেলেন অক্সফোর্ডে হিবার্ট বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। এরপর গেলেন ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৩২ সালে ইরাক ও পারস্য ভ্রমণ করলেন। ১৯৩৪ সালে গেলেন সিংহলে। এই ছিল তাঁর শেষ বিদেশ সফর।

একাধিক বইতে রবীন্দ্রনাথ লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাঁর বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এই বইগুলি হল: 'য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র' (১৮৮১), 'য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি' (১৮৯১, ১৮৯৩), 'জাপান-যাত্রী' (১৯১৯), 'যাত্রী' ('পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি' ও 'জাভা-যাত্রীর পত্র', ১৯২৯), 'রাশিয়ার চিঠি' (১৯৩১), 'পারস্যে' (১৯৩৬) ও 'পথের সঞ্চয়' (১৯৩৯)। সাক্ষাৎ করেছিলেন অরিঁ বের্গসঁ, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস, রোম্যাঁ রোলাঁ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে। জীবনের শেষপর্বে পারস্য, ইরাক ও সিংহল ভ্রমণের সময় জাতিগত ভেদবুদ্ধি ও জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তাঁর বিতৃষ্ণা তীব্রতর হয়েছিল মাত্র। আর জীবনব্যাপী বিশ্বভ্রমণের ফলে ভারত ও পাশ্চাত্যের মধ্যে আদানপ্রদানের পথটিই প্রশস্ত করেছিলেন কবি।

সাহিত্য

*

রসতীর্থ-পথের পথিক

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান পরিচয় তিনি কবি। মাত্র আট বছর বয়সে কবিতা রচনায় হাতেখড়ি হয় তাঁর। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তীর (১৮৩৫-১৮৯৪) অনুসারী কবি। তাঁর 'কবিকাহিনী' (১৮৭৮), 'বনফুল' (১৮৮০) ও 'ভগ্নহৃদয়' (১৮৮১) কাব্য তিনটিতে বিহারীলালের প্রভাব সুস্পষ্ট। 'সন্ধ্যাসংগীত' (১৮৮২) কাব্যগ্রন্থ থেকে প্রকাশিত হতে লাগল কবি রবীন্দ্রনাথের নিজের বাণী। এই পর্বের 'সন্ধ্যাসংগীত', 'প্রভাতসংগীত' (১৮৮৩), 'ছবি ও গান', 'কড়ি ও কোমল', 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' (১৮৮৪) কাব্যগ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু ছিল মানব হৃদয়ের বিষণ্ণতা, আনন্দ, মর্ত্যপ্রীতি ও মানবপ্রেম। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত 'মানসী' এবং তার পর প্রকাশিত 'সোনার তরী' (১৮৯৪), 'চিত্রা' (১৮৯৬), 'চৈতালি' (১৮৯৬), 'কল্পনা' (১৯০০) ও 'ক্ষণিকা' (১৯০০) কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কিত রোম্যান্টিক ভাবনা। ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রাধান্য লক্ষিত হয়। এই চিন্তা ধরা পড়েছে 'নৈবেদ্য' (১৯০১), 'খেয়া' (১৯০৬), 'গীতাঞ্জলি' (১৯১০), 'গীতিমাল্য' (১৯১৪) ও 'গীতালি' (১৯১৪) কাব্যগ্রন্থে। ১৯১৫ সালে বেজে উঠল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। আধ্যাত্মলোকের পরিবর্তে পুনরায় মর্ত্যলোকের দিকে তাকালেন কবি। এই নবদৃষ্টির ফসল 'বলাকা' (১৯১৬)। এরপর 'পলাতকা' (১৯১৮) কাব্যে গল্প-কবিতার আকারে তিনি নারীজীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলি তুলে ধরেন। এরপর 'পূরবী' (১৯২৫) ও 'মহুয়া' (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ আবার ফিরে এলেন প্রেমের আশ্রয়ে। জীবনের শেষ দশকে কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু নিয়ে কয়েকটি নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে প্রকাশিত হল 'পুনশ্চ' (১৯৩২), 'শেষ সপ্তক' (১৯৩৫), 'পত্রপুট' (১৯৩৬) ও 'শ্যামলী' (১৯৩৬) নামে চারটি গদ্যকাব্য। তারপর জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে 'রোগশয্যায়' (১৯৪০), 'আরোগ্য' (১৯৪১), 'জন্মদিনে '(১৯৪১) ও 'শেষ লেখা' (১৯৪১, মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত) কাব্যে মৃত্যু ও মর্ত্যপ্রীতিকে একটি নতুন আঙ্গিকে পরিস্ফুট করেছিলেন তিনি। শেষ কবিতা 'তোমার সৃষ্টির পথ' মৃত্যুর আট দিন আগে মৌখিকভাবে রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের কাব্যে প্রতিফলিত হয় প্রাচীন উপনিষদ্, মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলি, কবীরের দোঁহা, লালন ও অন্যান্য বাউল কবিদের মানবতাবাদী গীতিকবিতা ও রামপ্রসাদ সেনের শাক্ত সাহিত্যের মর্মবাণী। প্রাচীন সাহিত্যের দুরূহতা পরিহার করে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছিলেন কাব্য রচনার এক সহজ, সরল ও সরস আঙ্গিক। আবার বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক থেকে কিছু পরীক্ষামূলক লেখালেখির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা ও বাস্তবতাবোধের প্রাথমিক আবির্ভাব প্রসঙ্গে নিজ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছিলেন কবি। বহির্বিশ্বে তাঁর সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত কাব্যগ্রন্থটি হল গীতাঞ্জলি। এ বইটির জন্যই তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। নোবেল ফাউন্ডেশন তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটিকে বর্ণনা করেছিল একটি "গভীরভাবে সংবেদনশীল, উজ্জ্বল ও সুন্দর কাব্যগ্রন্থ" রূপে।

ছোটো ছোটো দুঃখকথা

বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটোগল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মূলত হিতবাদী, সাধনা, ভারতী, সবুজ পত্র প্রভৃতি মাসিক পত্রিকাগুলির চাহিদা মেটাতে তিনি তাঁর ছোটগল্পগুলি রচনা করেছিলেন। গল্পগুলি উচ্চ সাহিত্যমূল্য-সম্পন্ন। রবীন্দ্রনাথের জীবনের 'সাধনা' পর্বটি (১৮৯১–৯৫) ছিল সর্বাপেক্ষা সৃষ্টিশীল পর্যায়। তাঁর 'গল্পগুচ্ছ' গল্পসংকলনের প্রথম তিন খণ্ডের চুরাশিটি গল্পের অর্ধেকই রচিত হয় এই সময়কালের মধ্যে। গল্পগুচ্ছ সংকলনের অন্য গল্পগুলির অনেকগুলিই রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রজীবনের 'সবুজ পত্র' পর্বে (১৯১৪–১৭; প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকার নামানুসারে)। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল 'কঙ্কাল', 'নিশীথে', 'মণিহারা', 'ক্ষুধিত পাষাণ', 'স্ত্রীর পত্র', 'নষ্টনীড়', 'কাবুলিওয়ালা', 'হৈমন্তী', 'দেনাপাওনা', 'মুসলমানীর গল্প' ইত্যাদি। শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ 'লিপিকা', 'সে' ও 'তিনসঙ্গী' গল্পগ্রন্থে নতুন আঙ্গিকে গল্পরচনা করেছিলেন।

সমসাময়িক ঘটনাবলি, বাঙালি হিন্দু সমাজের নানা সমস্যা, আধুনিক ধ্যানধারণার খণ্ড খণ্ড ছবি উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের গল্পে। নানা শ্রেণির চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বৌদ্ধিক বিশ্লেষণই অনেক ক্ষেত্রে তাঁর গল্পের প্রধান বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটোগল্প চলচ্চিত্র, নাটক ও টেলিভিশন ধারাবাহিকের আকারে পুনঃসৃজিত হয়েছে। তাঁর গল্পের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রায়ণ সত্যজিৎ রায় পরিচালিত 'তিন কন্যা' ('মনিহারা', 'পোস্টমাস্টার' ও 'সমাপ্তি' অবলম্বনে) ও 'চারুলতা' ('নষ্টনীড়' অবলম্বনে), তপন সিংহ পরিচালিত 'অতিথি', 'কাবুলিওয়ালা' ও 'ক্ষুধিত পাষাণ'[১৩৯], পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত 'স্ত্রীর পত্র' ইত্যাদি।

রডোডেনড্রনগুচ্ছ

রবীন্দ্রনাথ উপন্যাস লিখেছেন মাত্র তেরোটি। এগুলি হল: 'বৌ-ঠাকুরাণীর হাট' (১৮৮৩), 'রাজর্ষি' (১৮৮৭), 'চোখের বালি' (১৯০৩), 'নৌকাডুবি' (১৯০৬), 'প্রজাপতির নির্বন্ধ' (১৯০৮), 'গোরা' (১৯১০), 'ঘরে বাইরে' (১৯১৬), 'চতুরঙ্গ' (১৯১৬), 'যোগাযোগ' (১৯২৯), 'শেষের কবিতা' (১৯২৯), 'দুই বোন' (১৯৩৩), 'মালঞ্চ' (১৯৩৪) ও 'চার অধ্যায়' (১৯৩৪)। বৌ-ঠাকুরাণীর হাট ও রাজর্ষি ঐতিহাসিক উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস রচনার প্রচেষ্টা। এরপর থেকে ছোটগল্পের মতো তাঁর উপন্যাসগুলিও মাসিকপত্রের চাহিদা অনুযায়ী নবপর্যায় বঙ্গদর্শন, প্রবাসী, সবুজ পত্র, বিচিত্রা প্রভৃতি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে।

'চোখের বালি' উপন্যাসে এক অকাল-বিধবার অবৈধ প্রণয়কে কেন্দ্র করে একাধিক চরিত্রের মানসিক দ্বন্দ্ব প্রধান বিষয় হিসেবে ফুটিয়ে তোলেন রবীন্দ্রনাথ। 'নৌকাডুবি'ও জটিল পারিবারিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে লেখা। কিন্তু এই উপন্যাসে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বদলে কাহিনির গতিশীলতাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। 'গোরা' রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এই উপন্যাসে ফুটে উঠেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ, সনাতন হিন্দু ও ব্রাহ্মসমাজের সংঘাত, ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলি। 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসের বিষয়বস্তু ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের জটিলতা। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের জটিলতা আরও সূক্ষ্মভাবে উঠে এসেছে তাঁর পরবর্তী 'যোগাযোগ' উপন্যাসেও। 'চতুরঙ্গ' উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের "ছোটগল্পধর্মী উপন্যাস"। 'শেষের কবিতা' প্রেমের উপন্যাস। এই উপন্যাসের চালিকাশক্তি একটি বিশেষভাবে উপস্থাপিত প্রেমতত্ত্ব। স্ত্রীর অসুস্থতার সুযোগে স্বামীর অন্য স্ত্রীলোকের প্রতি আসক্তি – এই বিষয়টিকে উপজীব্য করে রবীন্দ্রনাথ 'দুই বোন' ও 'মালঞ্চ' উপন্যাসদুটি লেখেন। এর মধ্যে প্রথম উপন্যাসটি মিলনান্তক ও দ্বিতীয়টি বিয়োগান্তক। রবীন্দ্রনাথের শেষ উপন্যাস 'চার অধ্যায়' সমসাময়িক বিপ্লবী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একটি বিয়োগান্তক প্রেমের উপন্যাস।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সত্যজিৎ রায়ের 'ঘরে বাইরে' ও ঋতুপর্ণ ঘোষের 'চোখের বালি'।

সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। এইসব প্রবন্ধে তিনি সমাজ, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, সাহিত্যতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, ছন্দ, সংগীত ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তামূলক প্রবন্ধগুলি 'সমাজ' (১৯০৮) সংকলনে সংকলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময়ে লেখা রাজনীতি-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি সংকলিত হয়েছে 'কালান্তর' (১৯৩৭) সংকলনে। রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও আধ্যাত্মিক অভিভাষণগুলি সংকলিত হয়েছে 'ধর্ম' (১৯০৯) ও 'শান্তিনিকেতন' (১৯০৯-১৬) অভিভাষণমালায়। রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি স্থান পেয়েছে 'ভারতবর্ষ' (১৯০৬), 'ইতিহাস' (১৯৫৫) ইত্যাদি গ্রন্থে। 'সাহিত্য' (১৯০৭), 'সাহিত্যের পথে' (১৯৩৬) ও 'সাহিত্যের স্বরূপ' (১৯৪৩) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদি ভারতীয় সাহিত্য ও আধুনিক সাহিত্যের সমালোচনা করেছেন যথাক্রমে 'প্রাচীন সাহিত্য' (১৯০৭) ও 'আধুনিক সাহিত্য' (১৯০৭) গ্রন্থদুটিতে। 'লোকসাহিত্য' (১৯০৭) প্রবন্ধমালায় তিনি আলোচনা করেছেন বাংলা লোকসাহিত্যের প্রকৃতি। ভাষাতত্ত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা লিপিবদ্ধ রয়েছে 'শব্দতত্ত্ব' (১৯০৯), 'বাংলা ভাষা পরিচয়' (১৯৩৮) ইত্যাদি গ্রন্থে। ছন্দ ও সংগীত নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন যথাক্রমে 'ছন্দ' (১৯৩৬) ও 'সংগীতচিন্তা' (১৯৬৬) গ্রন্থে। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা-সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার কথা প্রকাশ করেছেন 'শিক্ষা' (১৯০৮) প্রবন্ধমালায়। 'ন্যাশনালিজম' (ইংরেজি, ১৯১৭) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ উগ্র জাতীয়তাবাদের বিশ্লেষণ করে তার বিরোধিতা করেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দর্শন বিষয়ে যে বিখ্যাত বক্তৃতাগুলি দিয়েছিলেন সেগুলি 'রিলিজিয়ন অফ ম্যান' (ইংরেজি, ১৯৩০; বাংলা অনুবাদ 'মানুষের ধর্ম', ১৯৩৩) নামে সংকলিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা জন্মদিনের অভিভাষণ 'সভ্যতার সংকট' (১৯৪১) তাঁর সর্বশেষ প্রবন্ধগ্রন্থ। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ 'বিশ্বপরিচয়' (১৯৩৭) নামে একটি তথ্যমূলক প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। 'জীবনস্মৃতি' (১৯১২), 'ছেলেবেলা' (১৯৪০) ও 'আত্মপরিচয়' (১৯৪৩) তাঁর আত্মকথামূলক গ্রন্থ।

রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক পত্রসাহিত্য আজ পর্যন্ত উনিশটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া 'ছিন্নপত্র' ও 'ছিন্নপত্রাবলী' (ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে লেখা), 'ভানুসিংহের পত্রাবলী' (রানু অধিকারীকে (মুখোপাধ্যায়) লেখা) ও 'পথে ও পথের প্রান্তে' (নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লেখা) বই তিনটি রবীন্দ্রনাথের তিনটি উল্লেখযোগ্য পত্রসংকলন।

কেহ বলে ড্রামাটিক

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে ছিলেন নট ও নাট্যকার। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক নাট্যমঞ্চে মাত্র ষোলো বছর বয়সে অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'হঠাৎ নবাব' নাটকে (মলিয়ের লা বুর্জোয়া 'জাঁতিরোম' অবলম্বনে রচিত) ও পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরই 'অলীকবাবু' নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৮১ সালে তাঁর প্রথম গীতিনাট্য 'বাল্মীকি-প্রতিভা' মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকে তিনি ঋষি বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৮৮২ সালে রবীন্দ্রনাথ রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে 'কালমৃগয়া' নামে আরও একটি গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন।এই নাটক মঞ্চায়নের সময় তিনি অন্ধমুনির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।

গীতিনাট্য রচনার পর রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি কাব্যনাট্য রচনা করেন। শেকসপিয়রীয় পঞ্চাঙ্ক রীতিতে রচিত তাঁর 'রাজা ও রাণী' (১৮৮৯) ও 'বিসর্জন' (১৮৯০) বহুবার সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয় এবং তিনি নিজে এই নাটকগুলিতে অভিনয়ও করেন। ১৮৮৯ সালে 'রাজা ও রাণী' নাটকে বিক্রমদেবের ভূমিকায় অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ। 'বিসর্জন' নাটকটি দুটি ভিন্ন সময়ে মঞ্চায়িত করেছিলেন তিনি। ১৮৯০ সালের মঞ্চায়নের সময় যুবক রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ রঘুপতির ভূমিকায় এবং ১৯২৩ সালের মঞ্চায়নের সময় বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ যুবক জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। কাব্যনাট্য পর্বে রবীন্দ্রনাথের আরও দুটি উল্লেখযোগ্য নাটক হল চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২) ও মালিনী (১৮৯৬)।

কাব্যনাট্যের পর রবীন্দ্রনাথ প্রহসন রচনায় মনোনিবেশ করেন। এই পর্বে প্রকাশিত হয় 'গোড়ায় গলদ' (১৮৯২), 'বৈকুণ্ঠের খাতা' (১৮৯৭), 'হাস্যকৌতুক' (১৯০৭) ও 'ব্যঙ্গকৌতুক' (১৯০৭)। 'বৈকুণ্ঠের খাতা' নাটকে রবীন্দ্রনাথ কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৯২৬ সালে তিনি 'প্রজাপতির নির্বন্ধ' উপন্যাসটিকেও 'চিরকুমার সভা' নামে একটি প্রহসনমূলক নাটকের রূপ দেন।

১৯০৮ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ রূপক-সাংকেতিক তত্ত্বধর্মী নাট্যরচনা শুরু করেন। ইতিপূর্বে 'প্রকৃতির প্রতিশোধ' (১৮৮৪) নাটকে তিনি কিছুটা রূপক-সাংকেতিক আঙ্গিক ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ১৯০৮ সালের পর থেকে একের পর এক নাটক তিনি এই আঙ্গিকে লিখতে শুরু করেন। এই নাটকগুলি হল: 'শারদোৎসব' (১৯০৮), 'রাজা' (১৯১০), 'ডাকঘর' (১৯১২), 'অচলায়তন' (১৯১২), 'ফাল্গুনী' (১৯১৬), 'মুক্তধারা' (১৯২২), 'রক্তকরবী' (১৯২৬), 'তাসের দেশ' (১৯৩৩), 'কালের যাত্রা' (১৯৩২) ইত্যাদি। এই সময় রবীন্দ্রনাথ প্রধানত শান্তিনিকেতনে মঞ্চ তৈরি করে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অভিনয়ের দল গড়ে মঞ্চস্থ করতেন। কখনও কখনও কলকাতায় গিয়েও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করতেন তিনি। এই সব নাটকেও একাধিক চরিত্রে অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ১৯১১ সালে 'শারদোৎসব' নাটকে সন্ন্যাসী এবং 'রাজা' নাটকে রাজা ও ঠাকুরদাদার যুগ্ম ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৪ সালে 'অচলায়তন' নাটকে অদীনপুণ্যের ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৫ সালে 'ফাল্গুনী' নাটকে অন্ধ বাউলের ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৭ সালে 'ডাকঘর' নাটকে ঠাকুরদা, প্রহরী ও বাউলের ভূমিকায় অভিনয়। নাট্যরচনার পাশাপাশি এই পর্বে ছাত্রছাত্রীদের অভিনয়ের প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ পুরোন নাটকগুলি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ করে নতুন নামে প্রকাশ করেন। 'শারদোৎসব' নাটকটি হয় 'ঋণশোধ' (১৯২১), 'রাজা' হয় 'অরূপরতন' (১৯২০), 'অচলায়তন' হয় 'গুরু' (১৯১৮), 'গোড়ায় গলদ' হয় 'শেষরক্ষা' (১৯২৮), 'রাজা ও রাণী' হয় 'তপতী' (১৯২৯) এবং 'প্রায়শ্চিত্ত' হয় 'পরিত্রাণ' (১৯২৯)।

১৯২৬ সালে 'নটীর পূজা' নাটকে প্রথম অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে নাচ ও গানের প্রয়োগ ঘটান রবীন্দ্রনাথ। এই ধারাটিই তাঁর জীবনের শেষ পর্বে "নৃত্যনাট্য" নামে পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। নটীর পূজা নৃত্যনাট্যের পর রবীন্দ্রনাথ একে একে রচনা করেন 'শাপমোচন' (১৯৩১), 'তাসের দেশ' (১৯৩৩), 'নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা' (১৯৩৬), 'নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা' (১৯৩৮) ও 'শ্যামা' (১৯৩৯)। এগুলিও শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরাই প্রথম মঞ্চস্থ করেছিলেন।

মনের কথার টুকরো

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৫টি গান রচনা করেছিলেন। এই গানগুলি 'রবীন্দ্রসংগীত' নামে পরিচিত। ধ্রুপদি ভারতীয় সংগীত (হিন্দুস্তানি ও কর্ণাটকী শাস্ত্রীয় সংগীত), বাংলা লোকসংগীত ও ইউরোপীয় সংগীতের ধারা তিনটিকে আত্মস্থ করে তিনি একটি স্বকীয় সুরশৈলীর জন্ম দেন।রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু কবিতাকে গানে রূপান্তরিত করেছিলেন। রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ সুকুমার সেন রবীন্দ্রসংগীত রচনার ইতিহাসে চারটি পর্ব নির্দেশ করেছেন। প্রথম পর্বে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্ট গীতের অনুসরণে গান রচনা শুরু করেছিলেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৮৮৪-১৯০০) পল্লীগীতি ও কীর্তনের অনুসরণে রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব সুরে গান রচনা শুরু করেন। এই পর্বের রবীন্দ্রসংগীতে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট সংগীতস্রষ্টা মধুকান, রামনিধি গুপ্ত, শ্রীধর কথক প্রমুখের প্রভাবও সুস্পষ্ট। এই সময় থেকেই তিনি স্বরচিত কবিতায় সুর দিয়ে গান রচনাও শুরু করেছিলেন। ১৯০০ সালে শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করার পর থেকে রবীন্দ্রসংগীত রচনার তৃতীয় পর্বের সূচনা ঘটে। এই সময় রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের সুর ও ভাব তাঁর নিজের গানের অঙ্গীভূত করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথের গান রচনার চতুর্থ পর্বের সূচনা হয়।,কবির এই সময়কার গানের বৈশিষ্ট্য ছিল নতুন নতুন ঠাটের প্রয়োগ এবং বিচিত্র ও দুরূহ সুরসৃষ্টি। তাঁর রচিত সকল গান সংকলিত হয়েছে 'গীতবিতান' গ্রন্থে। এই গ্রন্থের 'পূজা', 'প্রেম', 'প্রকৃতি', 'স্বদেশ', 'আনুষ্ঠানিক' ও 'বিচিত্র' পর্যায়ে মোট দেড় হাজার গান সংকলিত হয়। পরে গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, নাটক, কাব্যগ্রন্থ ও অন্যান্য সংকলন গ্রন্থ থেকে বহু গান এই বইতে সংকলিত হয়েছিল। ইউরোপীয় অপেরার আদর্শে 'বাল্মীকি-প্রতিভা', 'কালমৃগয়া' গীতিনাট্য এবং 'চিত্রাঙ্গদা', 'চণ্ডালিকা', ও 'শ্যামা' সম্পূর্ণ গানের আকারে লেখা।

বিদ্রোহী পরমাণু

রবীন্দ্রনাথের সময় বাংলার শিক্ষিত পরিবারে নৃত্যের চর্চা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর পাঠক্রমে সংগীত ও চিত্রকলার সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যকেও অন্তর্ভুক্ত করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোকনৃত্য ও ধ্রুপদি নৃত্যশৈলীগুলির সংমিশ্রণে তিনি এক নতুন শৈলীর প্রবর্তন করেন। মূলত মণিপুরি রাসনৃত্য, গুজরাতি গড়বা নৃত্য, পাঞ্জাবি ভাঙড়া ও সিদ্ধা নৃত্যের রীতিগুলি মিশ্রিতভাবে গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে সিংহলের ক্যান্ডিনৃত্য এবং ইন্দোনেশিয়ার বালি ও জাভা অঞ্চলের লোকনৃত্যের কয়েকটি চলন ও ভঙ্গিমাকে মিশিয়েছেন তাতে। সমবেত নাচের ক্ষেত্রে সাঁওতালি গোষ্ঠীনৃত্যের একটি আদল পাওয়া যায়। তবে ভরতনট্যম বা কথাকলির কয়েকটি ভঙ্গিমা ছাড়া আর কিছুই তিনি গ্রহণ করেননি। এই শৈলীটি 'রবীন্দ্রনৃত্য' নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যগুলিতে গানের পাশাপাশি নাচও অপরিহার্য। বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী উদয় শংকর যে আধুনিক ভারতীয় নৃত্যধারার প্রবর্তন করেছিলেন, তার পিছনেও রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা ছিল।

চিত্ররেখাডোরে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন প্রায় সত্তর বছর বয়সে। চিত্রাঙ্কনে কোনো প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। প্রথমদিকে তিনি লেখার হিজিবিজি কাটাকুটিগুলিকে একটি চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এই প্রচেষ্টা থেকেই তাঁর ছবি আঁকার সূত্রপাত ঘটে। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ কালপরিধিতে অঙ্কিত তাঁর স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের ওপর, যার ১৫৭৪টি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ছবিতে রং ও রেখার সাহায্যে রবীন্দ্রনাথ সংকেতের ব্যবহার করতেন। রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য চিত্রকলার পুনরুত্থানে আগ্রহী হলেও, তাঁর নিজের ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে। মূলত কালি-কলমে আঁকা স্কেচ, জলরং ও দেশজ রঙের ব্যবহার করে তিনি ছবি আঁকতেন। তাঁর ছবিতে দেখা যায় মানুষের মুখের স্কেচ, অনির্ণেয় প্রাণীর আদল, নিসর্গদৃশ্য, ফুল, পাখি ইত্যাদি। তিনি নিজের প্রতিকৃতিও এঁকেছেন। নন্দনতাত্ত্বিক ও বর্ণ পরিকল্পনার দিক থেকে তাঁর চিত্রকলা বেশ অদ্ভুত ধরণেরই বলে মনে হয়। তবে তিনি একাধিক অঙ্কনশৈলী রপ্ত করেছিলেন। তন্মধ্যে, কয়েকটি শৈলী হল- নিউ আয়ারল্যান্ডের হস্তশিল্প, কানাডার (ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশ) পশ্চিম উপকূলের "হাইদা" খোদাইশিল্প ও ম্যাক্স পেকস্টাইনের কাঠখোদাই শিল্প।

দর্শন

*

বিশ্বমায়ের আঁচল

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক দর্শন অত্যন্ত জটিল। সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করলেও তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী নেতৃবর্গকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ গদর ষড়যন্ত্রের কথা শুধু জানতেনই না, বরং উক্ত ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন। আবার ১৯২৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে 'চরকা-সংস্কৃতি' বলে বিদ্রুপ করে রবীন্দ্রনাথ কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাঁর চোখে ছিল "আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলির রাজনৈতিক উপসর্গ"। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বৃহত্তর জনসাধারণের স্বনির্ভরতা ও বৌদ্ধিক উন্নতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। ভারতবাসীকে অন্ধ বিপ্লবের পন্থা ত্যাগ করে দৃঢ় ও প্রগতিশীল শিক্ষার পন্থাটিকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের মতাদর্শ অনেককেই বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯১৬ সালের শেষ দিকে সানফ্রান্সিসকোয় একটি হোটেলে অবস্থানকালে একদল চরমপন্থী বিপ্লবী রবীন্দ্রনাথকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ উপস্থিত হওয়ায় তাঁদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড বর্জন করেন। নাইটহুড প্রত্যাখ্যান-পত্রে লর্ড চেমসফোর্ডকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।" রবীন্দ্রনাথের 'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য' ও 'একলা চলো রে' রাজনৈতিক রচনা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। 'একলা চলো রে' গানটি গান্ধীজির বিশেষ প্রিয় ছিল। যদিও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। হিন্দু নিম্নবর্ণীয় জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজি ও আম্বেডকরের যে মতবিরোধের সূত্রপাত হয়, তা নিরসনেও রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গান্ধীজিও তাঁর অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।

যেমন করে গাইছে আকাশ

'তোতা-কাহিনী' গল্পে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয়ের মুখস্ত-সর্বস্ব শিক্ষাকে প্রতি তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। দেখিয়ে দেন, দেশের ছাত্রসমাজকে খাঁচাবদ্ধ পাখিটির মতো শুকনো বিদ্যা গিলিয়ে কীভাবে তাদের বৌদ্ধিক মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ১৯১৭ সালের ১১ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা বারবারা ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা সম্পর্কে প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তাভাবনা শুরু করেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমকে দেশ ও ভূগোলের গণ্ডীর বাইরে বের করে ভারত ও বিশ্বকে একসূত্রে বেঁধে একটি বিশ্ব শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাও এই সময়েই গ্রহণ করেছিলেন কবি। ১৯১৮ সালের ২২ অক্টোবর 'বিশ্বভারতী' নামাঙ্কিত তাঁর এই বিদ্যালয়ের শিলান্যাস করা হয়েছিল। এরপর ১৯২২ সালের ২২ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছিল এই বিদ্যালয়ের। বিশ্বভারতীতে কবি সনাতন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্রহ্মচর্য ও গুরুপ্রথার পুনর্প্রবর্তন করেছিলেন। এই বিদ্যালয়ের জন্য অর্থসংগ্রহ করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে প্রাপ্ত সম্পূর্ণ অর্থ তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন এই বিদ্যালয়ের পরিচালন খাতে। নিজেও শান্তিনিকেতনের অধ্যক্ষ ও শিক্ষক হিসেবেও অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতেন তিনি। সকালে ছাত্রদের ক্লাস নিতেন এবং বিকেল ও সন্ধ্যায় তাদের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করতেন। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে তিনি একাধিকবার ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণ করেন।

প্রাণের প্রদীপ

ধর্ম ও ঈশ্বরচেতনা রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনের কর্ম ও সাহিত্যের মধ্যেই নিহিত। তবে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা নন। তাঁর ধর্মও সমাজ-প্রচলিত মতবাদগুলির থেকে অনেকাংশে পৃথক। তাঁর ঈশ্বর কর্মী ঈশ্বর। তাঁর অবস্থান স্বর্গলোক নয়, মানবের সংসার। তাঁর মূর্তি নেই। মানুষের মধ্যেই তাঁর প্রকাশ, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তিনি "রূপসাগরের অরূপরতন"। তাঁর ধর্মও মানুষের ধর্ম। এই ধর্ম মানুষে-মানুষে ঐক্যবন্ধন করতে শেখায়। এই দর্শন সৌভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। রবীন্দ্রনাথ আজীবন ধর্মীয় উন্মাদনার বিরোধিতা করে এসেছেন। যে ধর্ম মানুষে-মানুষে ঘৃণার বীজ রোপণ করে, যে ধর্ম সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে সংঘাত-প্রতিঘাতের বাতাবরণ সৃষ্টি করে, যে ধর্ম আমাদের সামাজিক ঐক্যকে খণ্ডবিখণ্ড করে, রবীন্দ্রনাথ বরাবর সেই ধর্মের বিরোধিতা করে এসেছেন। তাঁর এই দর্শন এক অখণ্ড মানবতাবাদের নিদর্শন। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি মিশতে চেয়েছিলেন মানুষের মধ্যে। সারা জীবন গেয়েছিলেন মানুষের জয়গান, জীবনের জয়গান।

(বাংলা উইকিপিডিয়ায় আমার লেখা "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর" নিবন্ধটি সামান্য পরিবর্তন করে এখানে দেওয়া হয়েছে।)

http://bangabharati.wordpress.com/%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%A4-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7/%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%A5-%E0%A6%A0%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8-%E0%A6%B8-2/

রবীন্দ্রনাথ, এই সময়ে

রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষে এই সময়ের অভিজ্ঞতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাসঙ্গিকতা বুঝে নেওয়ার প্রয়াসে ১৮ ও ১৯ জুন প্রথম আলো ও ব্র্যাক ব্যাংকের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় সেমিনার 'রবীন্দ্রনাথ, এই সময়ে'। দুই দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন দেশের কবি-সাহিত্যিক-লেখক ও রবীন্দ্রভক্ত পাঠক। দুই দিনের জমাট সেই আসরের নানা দিক নিয়ে আমাদের এই মূল রচনা।

বিষয়: রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য
কাছে ফেরার তাগিদ
 কাজল রশীদ
১০০ বছর বা তারও আগে লেখা রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসের প্রয়োজন কি শুধুই একাডেমিক বা ঐতিহাসিক? প্রবন্ধকার ওয়াসি আহমেদ নিজে এ প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করেছেন। আলোচকত্রয় ও সভাপতিও বিচিত্র পথে একই সত্য অনুসন্ধান করেছেন। 'রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য বিষয়ে' প্রবন্ধকার বলেন: 'রবীন্দ্রনাথকে খণ্ডিত করে গল্প-উপন্যাসের রচয়িতা গণ্য করলেও তাঁর কথাসাহিত্যিক পরিচয়ের স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে তর্কের অবকাশ থাকে না। ১০০টির কাছাকাছি গল্পই লেখেননি, বাংলা সাহিত্যের এই উজ্জ্বল শাখাটির তিনিই জনক। উপন্যাস লিখেছেন এক ডজনের বেশি। শ্রেণী বিভাগের প্রয়োজনে কথাসাহিত্যকে আলাদা করলেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা-নাটকসহ বহুবিধ সৃজনী কর্মকাণ্ডের নির্যাসকে একটি অভিন্ন চিন্তাচেতনার ঐক্যে গাঁথা চলে। রবীন্দ্রনাথ কোনো ডকট্রাইনেয়ার দর্শনের প্রবক্তা ছিলেন না। মৌলিক চিন্তাভাবনাপ্রসূত কোনো নন্দনতাত্ত্বিক দর্শনও তিনি প্রতিষ্ঠিত করেননি। প্রয়োজনমতো নানা উৎস থেকে এর উপাদান সংগ্রহ করেছেন।'
ভাবনা, যৌক্তিকতা ও বিশ্লেষণের সমন্বয়ে কথাসাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে এভাবেই খুঁজে ফিরেছেন প্রবন্ধকার।
রবীন্দ্রনাথের সৃজনসম্ভারের সঙ্গে পূর্বাপর বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেছেন কখনো প্রত্যক্ষে, কখনো বা পরোক্ষে। হাজির করেছেন তাঁর সমসাময়িক, আগের কিংবা পরের লেখক-সাহিত্যিক, কবি-সমালোচক, তাত্ত্বিক ও সাহিত্যবোদ্ধাদের। আন্তর্জাতিকতার নিরিখে, দেশজ প্রেক্ষাপটে, সমাজ-রাষ্ট্র-ব্যক্তির আলোকেও প্রবন্ধকার রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের একটি স্বর্ণরেখা টেনেছেন। যে রেখা কখনো গন্তব্যে গেছে, কখনো যায়নি। তবে পরিব্রাজক সত্তাকে উন্মোচিত করেছেন। যার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের অপরূপ রূপ বিন্যস্ত হয়েছে।
প্রবন্ধকারের ভাষায়:
দার্শনিক বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক সাহিত্যকৃতিতে ঐক্যের সন্ধান মিললেও তাঁর গল্প ও উপন্যাসের জগৎ বিষয়ভাবনা ও প্রকারগত দিক থেকে একে অন্যের থেকে আলাদা।…গল্পগুচ্ছ-এ স্বল্প পরিসরে হলেও তিনি গল্পের ভেতর দিয়ে ভাবনাকে ছুঁয়েছেন, অন্যদিকে উপন্যাসে আইডিয়াকে দাঁড় করাতেই গল্পের কাঠামোর আশ্রয় নিয়েছেন, এমনকি চরিত্রেরও।
কথাসাহিত্যে তাঁর মানবতাবাদী শ্রেয়নীতিকে বলা যায় জীবনদেবতারই প্রতিরূপ।…এ প্রসঙ্গে ঘরে বাইরের দৃষ্টান্ত টানা যেতে পারে। উপন্যাসের ঢঙে এখানে রবীন্দ্রনাথ যা দাঁড় করিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে তা দেশ, জাতীয়তাবাদবিষয়ক থিসিস।…বিমলা-সন্দীপের রাজনৈতিক রোমান্সের সমাপ্তি ঘটাতে এবং নিখিলেশের থিসিসই যে শ্রেয়নীতি, তা প্রতিষ্ঠিত করতে সন্দীপকে কেবল শভিনিস্ট প্রমাণ করলে চলে না, তাকে হতে হয় লোভী, স্বার্থপর। কিন্তু মুশকিল হলো, সন্দীপ তো ব্যক্তিমাত্র, আর থিসিসের পটভূমি অগ্নিগর্ভ ভারতবর্ষ। তার পরও এক সন্দীপের উদাহরণেই শ্রেয়নীতি প্রতিষ্ঠা পায়। কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথকে কাছের মানুষ অভিহিত করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মহীবুল আজিজ বলেন: 'রবীন্দ্রনাথ কথাসাহিত্যে অনেক বেশি স্পষ্ট, কবিতার মতো রহস্যময়ী নন। তিনি সারা জীবন ছিলেন ঔপনিবেশিক লেখক, সে কারণে তাঁর ওপর একটা চাপ ছিল। সে চাপ তাঁর সমকালীন পশ্চিমা লেখকদের ছিল না। পূর্ববঙ্গবাস রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের জন্য আশীর্বাদ, পরম পাওয়া। গল্পগুচ্ছ-এর গল্পগুলোয় যার প্রমাণ ও বৈশিষ্ট্য প্রকৃষ্টরূপে বিদ্যমান।'
তাঁর মতে, হোমারের ইলিয়াড, ওডেসিকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনি বর্তমানের প্রাসঙ্গিকতায় রবীন্দ্রনাথের গোরাকেও অস্বীকার করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ জীবন-জগৎকে দেখার ক্ষেত্রে নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছেন। বিষয়, আঙ্গিক, ভাবনায়, বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। আধুনিক কালের লেখকেরাও তা অব্যাহত রেখেছেন তাঁকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে সম্যকভাবে বিচার করার কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী।
রবীন্দ্রনাথ শুধু পথ চলেননি, পথ তৈরিও করেছেন। নিজের তৈরি ভাষায় লিখেছেন। বিশ্বসাহিত্যের প্রতিভাধর লেখকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পার্থক্য এখানেই বলে উল্লেখ করেন প্রথম আলোর উপসম্পাদক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। প্রবন্ধকারের সঙ্গে সহমত প্রকাশ না করে তিনি বলেন: 'রবীন্দ্রনাথ সোনার তরীর 'বর্ষাযাপন' কবিতায় ছোটগল্প সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, তা মেনে ভালোই করেছেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের গল্প পড়তে শিখিয়েছেন। গল্পের অপূর্ব ভাষাভঙ্গির জন্যই তিনি প্রাসঙ্গিক ও বেঁচে থাকবেন।'
সভাপতি হাসান আজিজুল হক সহজ করে কঠিন কথাটি বলেছেন: 'রবীন্দ্রনাথ আকাশের মতো উদার, আবার পলায়নপর। তাঁকে নিয়ে শেষ কথাটি বলা অত সহজ নয়।'
তিনি বলেন, সাহিত্য ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তিযোগ্য কিছুই নেই।
সত্যেরও যেমন নির্ধারিত রূপ নেই, মিথ্যারও নেই। দুটোই নড়াচড়া করছে। আসল কথা হলো, নিজেদের রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে যাওয়া। অন্যের মূল্যায়নের প্রতি নির্ভর না করে নিজে অনুসন্ধান করা। তাঁকে পড়া। সেখান থেকেই নিজের মতো করে গ্রহণ বা বর্জন করা। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। আলোচনা করে তিনি বড় কি ছোট, প্রমাণ করে লাভ নেই। আমাদের ভেতরের সব দেয়াল ভেঙে তাঁর কাছে ফেরার মধ্যেই রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা অন্বেষণ সম্ভব।'

বিষয়: রবীন্দ্রনাথের কবিতা
নতুনের অপেক্ষায়
 পিয়াস মজিদ
রবীন্দ্রজন্মের ১৫০ বছর এবং প্রয়াণের ৭০ বছর পর সৈয়দ শামসুল হক রবীন্দ্রনাথের কবিতার দিকে নতুন দৃষ্টিতে তাকাতে চান। রবীন্দ্র-কবিতার বিষয়ভাগ নয়, বরং আঙ্গিকগত দিকই তাঁর আগ্রহের বস্তু। বিশেষত কবিজীবনের প্রথম থেকে শেষাবধি ছন্দের নানা নিরীক্ষা সৈয়দ হকের কাছে বিস্ময়-উদ্রেকী। 'রবীন্দ্রনাথ: তাঁর কবিতা, আমার কাছে' শীর্ষক প্রবন্ধে লেখকের বলার কথা এই যে মহৎ বক্তব্য পথে পড়ে থাকতে পাওয়া যায়। ইত্যাকার বক্তব্য উত্তরকালের কোনো সৃজনশীলের কাছে মহার্ঘ্য হতে পারে না। পূর্বজ কবির কাছ থেকে নেওয়ার যা থাকে তা হচ্ছে তার সৃষ্টির কারিগরি কাঠামো।
রবীন্দ্রনাথ সৈয়দ শামসুল হকের কাছে সোনার ঠাকুর নন; ভীষণভাবে একজন মানুষ কবি। তাই তিনি ফিরে তাকাতে চান তার বহুভঙ্গিম কবিজীবনের পানে। দেখেন রবীন্দ্রনাথেরও গেছে কবিতা-বন্ধ্যা সময়। দেখেন আবার এক দিনেও লিখেছেন স্মরণীয় একাধিক কবিতা। দেখেন কাটাকুটিময় কবিতার পাণ্ডুলিপি। অবিরাম শোধন-মার্জনের মধ্য দিয়ে তৈরি করছেন কবিতার কায়া। তখন অনুধাবন হয় যে কবিতা নেহায়েত ভাবের প্রসূন নয়, কবিতা কবির সচেতন নির্মাণ।
রবীন্দ্র-কবিতার কাছ থেকে এই শিক্ষা লাভ হয় আজকের কবির যে শব্দের পাশে শব্দ সংস্থাপনের ইন্দ্রজালবিদ্যা আয়ত্ত থাকতে হয় যেকোনো কবির। প্রবন্ধকার রবীন্দ্রনাথের কবিত্ব দৃষ্টিগোচরভাবে শনাক্ত করেন শব্দকে চিরকালের মতো নিজস্ব করে নেওয়ার প্রতিভাতে।
তবে রবীন্দ্র-কবিতার বিষয়ভাগে যে আধ্যাত্মিক জগতের বিস্তার তাকে সৈয়দ শামসুল হক নিজের জগৎ ভাবতে পারেন না। এ পথে সমসময়ের মানুষের মুক্তি বা স্ফূরণ সম্ভব কি না এ ব্যাপারে তিনি সংশয়াকীর্ণ। রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে এ কালের কবির সময় গেছে বদলে। জীবন ও সমাজে এসেছে বিপুল পরিবর্তন। তাই রবীন্দ্র-কবিতার সেই দার্শনিক নেপথ্য-চালক 'জীবনদেবতা' এখন তার কাছে পূজনীয় নয়। দুটি মহাযুদ্ধ, সহিংসতা ও সমর, মানুষের পতন ও মূল্যবোধের বিপর্যয় ইত্যাদি নেতিমূলক পরিস্থিতির দ্রষ্টা কবিকে রবীন্দ্রনাথের 'জীবনদেবতা'র শান্ত-সৌম্য বাণী সম্মোহিত করে না। বরং 'তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে/ হে ছলনাময়ী!' রবীন্দ্র জীবনের অন্ত্যপর্যায়ী এই উচ্চারণেই সৈয়দ হক খুঁজে পান সমসাময়িক স্বরভঙ্গি।
আলোচকদের একজন খোন্দকার আশরাফ হোসেন প্রবন্ধকার সৈয়দ শামসুল হকের মতের বিরোধিতা করে বলেন যে তিনি রবীন্দ্র-কবিতার আঙ্গিকে আকর্ষিত নন বরং বিষয়ভাগের প্রতিই তাঁর মনোযোগ। ইউরোপবাহিত মডার্নিজমের চোখে রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে দেখার ফলেই আমরা রবীন্দ্র-কবিতার স্বাদ-আস্বাদনে ব্যর্থ বলে মনে করেন তিনি। রবীন্দ্র-কবিতার ভূগোলব্যাপী আধ্যাত্মিকতার বিস্তার বলে সৈয়দ হক তাঁর ভেতর এই সময়ের কবির মুক্তি খুঁজে পান না কিন্তু খোন্দকার আশরাফ হোসেন আধ্যাত্মিকতাকেই একটি অচিকিৎস্য ব্যাপার বলে মনে করেন। টিএস এলিয়টের উদাহরণ দিয়ে আশরাফ বলেন যে তাঁর অধিকাংশ কবিতাই আধ্যাত্মিকতা-ভারাতুর কিন্তু এই সময়ের কবি বা পাঠকের কাছে তিনি মোটেও অগ্রহণীয় নন বরং দিনে দিনে এলিয়ট আরও বেশি পঠিত হচ্ছেন।
কবি নির্মলেন্দু গুণ রবীন্দ্রনাথকে দেখেন একজন পরিশ্রমী পূর্বজ কবি হিসেবে, রবীন্দ্রনাথের প্রভাব রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিদের ভেতর প্রত্যক্ষভাবে না হলেও অন্তঃশীলে গভীরভাবে প্রবহমান বলে তাঁর ধারণা।
অপর আলোচক বিশ্বজিৎ ঘোষ দৃঢ়ভাবে মনে করেন রবীন্দ্র-কবিতার বিষয়বস্তু এখনো প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। ফ্যাসিবাদী উন্মত্ততা, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন, পরিবেশবিরোধী তৎপরতার কালে 'আফ্রিকা', 'বৃক্ষবন্দনা'র মতো কবিতার কাছে বারবার যেতে হবে।
অধিবেশনের সভাপতি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, সাহিত্যের ধর্মই পরিবর্তনশীলতা। সুতরাং এই সময়ের কবির কাছে রবীন্দ্র-কবিতা যে নতুনভাবে মূল্যায়িত হবে তা-ই স্বাভাবিক, তবে কবি রবীন্দ্রনাথের মূল গুরুত্বের জায়গা হচ্ছে তাঁর কবিতাভাষা। কারণ তিনি কবিতার তৈরি-ভাষা পাননি। মেধা ও শ্রমের যুগল সম্মিলনে রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছেন নিজের এবং বাংলার কবিতার ভাষা।
সেমিনারে অংশগ্রহণকারীদের তর্ক-বিতর্ক, বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণে কোনো মীমাংসায় পৌঁছানো না গেলেও এই অভিন্ন উপলব্ধির কিনারে পৌঁছানো গেছে যে কবি রবীন্দ্রনাথ নতুন আবিষ্কারের অপেক্ষায়।

বিষয়: রবীন্দ্রনাথের গান
গানের ঝর্ণাতলায়
 আশীষ-উর-রহমান
'গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি/ তখন তারে চিনি আমি, তখন তারে জানি'—এ কথা তিনি নিজেই বলেছিলেন। আবার সেই ভুবন ছেড়ে যাওয়ার সময় শেষ সম্বল হিসেবে যা নিতে চেয়েছেন তাঁর বিপুল সৃজনসম্ভারের মধ্য থেকে তাও গানই। গানের প্রতিই যে তাঁর আস্থা ছিল গভীর সে কথা আরও নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর গান যে আমাদের গাইতেই হবে সে সম্পর্কেও নিঃসন্দেহ ছিলেন তিনি।
সেমিনারে প্রথম দিনের তৃতীয় অধিবেশনটি ছিল রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে। সভাপতি, প্রাবন্ধিক, আলোচক সবাই গানের জগতেরই মানুষ। তাঁরা যেমন রবীন্দ্রনাথের গানের বৈশিষ্ট্য, তাঁর অনন্যতা, তাঁর স্বাতন্ত্র্য এসব নিয়ে যুক্তিনিষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণ করেন, তেমনি তার সঙ্গে যোগ করেন গানের গায়কি কেমন হবে, হচ্ছে; কোথায় এ ক্ষেত্রে ভুলত্রুটিগুলো থেকে যাচ্ছে। রবীন্দ্রসংগীতচর্চার প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে বাধা-প্রতিবন্ধকতার বিষয়ও তাতে বাদ পড়েনি। উপরন্তু এসব তত্ত্ব-পদ্ধতিগত আলোচনার সঙ্গে তারা যোগ করেছিলেন নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। ফলে পুরো আলোচনাটি যেমন বহুমাত্রিকতা পেয়েছিল, তেমনি হয়ে উঠেছিল রসোত্তীর্ণ।
এ পর্বে সভাপতিত্ব করেন সংগীতজ্ঞ অধ্যাপক করুণাময় গোস্বামী। প্রথমেই আসা যাক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে। এটি উপস্থাপন করেছেন ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী। প্রবন্ধটি তিনি রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র সৃজনসম্ভারের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সেখানে গানের অবস্থানটি কোন পর্যায়ে, এবং বর্তমানে তার প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু সেই মূল্যায়ন করে। তিনি বলেন, 'এই সময়ে মানে কোন সময়ে? বর্তমান বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত বিশ্বমন্দার এই প্রেক্ষাপটে? যদি তাই ধরে নিই তা-ই, তাহলে কবির কথা ধার করে বলতে হয়: "হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিয়ত নিঠুর দ্বন্দ্ব"। এরই মধ্যে তাঁরই সৃষ্ট লেখনীতে সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া যায় এই পঙিক্তমালায় "বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি"।'
তিনি বলেন, ষড়ঋতুর রূপকল্প তাঁর গানের ভেতর দিয়ে যেমন অনুভব করা যায় তেমন আর কিছুতে পাওয়া যায় না। আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে তাঁর গান প্রেরণা জুগিয়েছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধ আন্দোলনে রচিত গানগুলো বিশ্লেষণ করলে লক্ষ করা যাবে, কালোয়াতি-ধ্রুপদী গানের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে উঠেও তিনি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও স্বদেশপ্রেমে জাতিকে উজ্জীবিত করতে বেছে নিয়েছিলেন স্বতোৎসারিত মাটি-মানুষের দেশজ লোকসুর। নিজেকে বাউল, ব্রাত্য বলতে দ্বিধাবোধ করেননি।
প্রবন্ধকার বলেন, জমিদারির দায়িত্বভার নিয়ে পূর্ববঙ্গে এসে তিনি ১৮৯০-১৯০১ পর্যন্ত প্রায় এক যুগ ধরে সাধারণ মানুষ ও লোকজ গানের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ লাভ করেন। এ সময় তিনি অবহেলিত লোকসংগীত, গ্রাম্য ছড়াগান সংগ্রহ করেছেন। বাউল লালনের গান সংগ্রহ করে মাসিক প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। লালনশিষ্য গগন হরকরার 'আমি কোথায় পাব তারে' গানের সুরে যে গানটি রচনা করেছিলেন, 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি', সেই গানটি এখন আমাদের জাতীয় সংগীত।
আলোচনা পর্বে শিল্পী সাদি মহম্মদ প্রাধান্য দেন রবীন্দ্রসংগীত চর্চার বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে সরকারি সংগীত মহাবিদ্যালয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, প্রধান সমস্যা হলো স্বরলিপি নিয়ে। আমরা অনেকেই স্বরলিপি বুঝতে চাই না। নবীন শিক্ষার্থীদের অনেকেই চর্চাটা শেষ পর্যন্ত অব্যাহত রাখে না। একটা পর্যায়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়। এ ছাড়া বড় ধরনের আরও একটি সমস্যা রয়েছে উচ্চারণ নিয়ে। অনেকেই হয়তো বেশ ভালো গাইছে, গলায় সুরও আছে চমৎকার, কিন্তু উচ্চারণের বেলায় তাঁর আঞ্চলিকতার ত্রুটিগুলো এড়াতে পারে না। এগুলো এড়ানো জরুরি।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ও শিল্পী লুভা নাহিদ চৌধুরী জোর দিয়েছেন নতুন প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তার ওপর। তিনি বলেন, 'আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁকে চেনাতে পারিনি। বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনা জাগাতে তিনিই ছিলেন আশ্রয়। গানের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের ছুঁয়ে গেছেন। এখন সময় বদলেছে। নতুন সময়ে তাঁর বোধ ও চেতনার আত্মীকরণের মধ্য দিয়েই তিনি প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন।'
শিল্পী অদিতি মহসীন বলেন, বাঙালির জীবনের নানা উপলক্ষ ও বোধকে তিনি গানটিতে স্পর্শ করেছেন। সুরের ক্ষেত্রে যেখানে যা ভালো মনে করেছেন তা আত্মস্থ করে নিজের মতো করে প্রয়োগ করেছেন।
অধ্যাপক করুণাময় গোস্বামী সভাপতির বক্তব্যে বলেন, ভাষা ও সংগীত মিলে গান তৈরি হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা এখনো পুরোনো হয়ে যায়নি। কিছু প্রেমের গানের ক্ষেত্রে, যেমন 'চরণ ধরিতে দিও গো আমারে', এমন করে আমরা এখন 'চরণ' শব্দ ব্যবহার করি না, তবে গানের অন্য ভাষা এখনো সমকালীন। কাজেই ভাষাগতভাবে তাঁর গান অনেক প্রাচীন বা দুর্বোধ্য হয়নি। সুরের ক্ষেত্রেও তিনি হিন্দুস্তানি রাগসংগীতের কড়াকড়ি থেকে বাংলা গানকে বের করে এনে আধুনিক করে তুলেছিলেন।
উপসংহারে তিনি বলেন, মানুষের ভাষা, দেশ-কাল আলাদা হলেও মানবিক অনুভূতি সব মানুষের প্রায় অভিন্ন। সেই মানবিক অনুভবের জায়গায় রবীন্দ্রনাথের গানের, তাঁর সুরের আবেদন থেকেই যাবে। সময় যত যাবে, তাঁর গানের শ্রোতাও তত বাড়তে থাকবে।

বিষয়: রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা
শেষ বয়সের প্রিয়া
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনের সৃজনসম্ভার মূলত তাঁর চিত্রকলা। আঁকাজোকার হাতেখড়ি অবশ্য হয়েছিল শৈশবেই। তবে কাব্য, সংগীত, সাহিত্যে যেভাবে আত্মনিবেদন করেছিলেন, আঁকাটা সে তুলনায় উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছিল। কাব্য-সংগীত প্রভৃতি রচনাকর্মে পঙিক্ত-চরণ বদলানোর প্রয়োজনে কাটাকুটি করতেন প্রায়ই। সেসব কাটাকুটি কখনো কখনো অভিনব সব নকশা বা আবয়বের আকৃতিও পেয়ে যেত।
পাণ্ডুলিপি দেখে বিষয়টি তাঁর সচেতন গোচরীভূত করেছিলেন তাঁর অনুরাগী আর্জেন্টাই বিদুষী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। পেরুযাত্রার পথে অসুস্থ অবস্থায় যখন তিনি আর্জেন্টিনায় ওকাম্পোর আতিথ্য গ্রহণ করনে তখন পূরবীর কবিতাগুলো লিখছিলেন তিনি। সেই পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি দেখে ওকাম্পোর মনে হয়েছিল, সেগুলোর ভেতরে শিল্পগুণ অন্তর্নিহিত আছে। কবিকে চিত্রকর হতে প্রণোদনা জুগিয়েছিলেন তিনি। এসবই আলোচিত হয় 'রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে' নামের সেমিনারের প্রথম দিনের শেষ অধিবেশনে।
অধিবেশনটি ছিল ভিন্ন স্বাদের। সভাপতি ছিলেন বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। শিল্পী আবুল মনসুর তাঁর নির্ধারিত প্রবন্ধটি না পড়ে তিনি প্রজেক্টরে রবীন্দ্রনাথের আঁকা এবং তাঁর সমকালে ভারত ও ইউরোপীয় বিভিন্ন শিল্পীর চিত্রকর্ম প্রদর্শন করে স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনা করেছেন। তুলে ধরেছেন রবীন্দ্র চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য।
প্রবন্ধকার বলেন, ধারণা করা হয় রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন ৬৭ বছর বয়সে। কবি নিজেই বলেছিলেন এটি তাঁর 'শেষ বয়সের প্রিয়া'। রবীন্দ্রচিত্রকলার দুটো পর্ব ছিল। একটি ১৯২৭-২৮, দ্বিতীয়টি ১৯৪০-৪১ সাল পর্যন্ত। প্রথম পর্বের কাজে ছিল পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি থেকে গড়ে ওঠা ছবি। এ পর্বের ছবি পরিকল্পনাবিহীনভাবে বেড়ে উঠেছে রূপ ও ছন্দ বিষয়ে সূক্ষ্ম সচেতনতা থেকে। এগুলো ঠিক পরিপূর্ণ চিত্র নয়। মূলত প্যাটার্ন বা সাদা ও কালোর বিন্যাস। এখানে তিনি রেখার ঘূর্ণন ও ছন্দময়তাকেই উদ্ভাসিত করার প্রয়াস পেয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পর্বের চিত্রমালা অনেকখানিই ভিন্নতর। এ পর্বের কাজে কাল্পনিক প্রাণীগুলো বদলে এসেছে নারীমুখের ডৌল ঘিরে ব্যাকুল রহস্যময়তা। আছে প্রকৃতিচিত্রও।
এরপর এসেছে তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি। নিজের ছবি এঁকেছেন রহস্যময়তার আবরণে। দৃষ্টিতে আছে বিষাদ বা বিপন্নতার ছাপ।
আলোচক শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের মতে, রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলার ব্যাপারে কোনো ঐতিহ্যের অনুসরণ করেননি। তিনি ছিলেন ঐতিহ্যছুট শিল্পী।
শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, তাঁর ছবির অল্পকিছু আমরা দেখেছি। বহু ছবি অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। কাজেই তাঁর চিত্রকলা নিয়ে চূড়ান্ত করে কিছু বলার সময় এখনো আসেনি।
শিল্পসমালোচক মইনুদ্দিন খালেদ বলেন, তিনি তাঁর কালের ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানের শিল্পীদের কাজ দেখেছেন। আমেরিকান ইন্ডিয়ান শিল্পীদের কাজ, ইন্দোনেশিয়ার শিল্পীদের প্রাচীন ঐতিহ্যগত কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এসবের প্রভাব-প্রচ্ছায়া তাঁর ওপরে প্রভাব ফেলতে পারে কি না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে তাঁর ছবিতে জীবনের সম্মুখীন হওয়ার ভীতি ও বিহ্বলতার প্রকাশ ঘটেছে।
সভাপতি কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ কাজ এখনও প্রকাশিত হয়নি। সব কাজ প্রকাশিত হলে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। হয়তো ভীবষ্যতে অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবেন। কারণ তাঁর এ দিকটিই এখন পর্যন্ত তেমন সুবিস্তৃতভাবে আলোচনায় আসেনি। পশ্চিমা বিশ্ব যখন জাপান ও চীন ছাড়া প্রাচ্যের কোনো শিল্পকে স্বীকৃতি দিত না, সেখানে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা প্রশংসিত হয়েছে। তিনি একটি নতুন শৈলী সৃষ্টি করেছিলেন। শিল্পসুষমা ও রং প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি বিস্ময়কর উৎকর্ষতায় এগিয়ে ছিলেন। তাঁর চিত্রকলা অমূল্য সম্পদ হয়েই থাকবে।

বিষয়: রবীন্দ্রনাথের নাটক
চির প্রাসঙ্গিকতায় ভাস্বর
 সুদীপ্ত শাহীন
রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক রচনার প্রাসঙ্গিকতা দেশ, কাল ও সমাজের মর্মমূলে প্রোথিত, যা কখনো ম্লান হওয়ার নয়। তাঁর রচনা চির নতুন ও চিরকালের, কারণ তিনি জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন 'আজকের চোখ' দিয়ে, যে চোখটি তৈরি হয়েছিল অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দর্শনের সমন্বিত অন্তর্দৃষ্টি থেকে; তাই তিনি সব সময়ই আজকের রবীন্দ্রনাথ। তাঁর নাট্য রচনায় এর ব্যত্যয় ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথ নাট্য রচনায় ছিলেন বৈচিত্র্য সন্ধানী এবং সেই কারণে তাঁর নাটকে পাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মনোলোকের সন্ধান। রবীন্দ্রনাথ এই সময়ের সেমিনারের নাটক বিষয়ের প্রবন্ধকার আতাউর রহমান এভাবেই মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ করেন রবীন্দ্র নাটকের।
তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের সমগ্র নাট্যসাহিত্যে পাই ধর্মীয় ভণ্ডামি, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও ক্ষুদ্রতার স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সোচ্চার উচ্চারণ। তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার, বিশ্বের অন্যতম সেরা নাট্যকারও। চির নতুন এবং চির প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্র নাটকের বিশ্ব পর্যটন বাস্তবতা ও সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে এই প্রবন্ধে। ব্যক্তি অভিজ্ঞতার নিরিখে তিনি নাটকগুলোর নানা মাত্রিক নির্যাস তুলে ধরেছেন।
প্রবন্ধকার শেষ রেখা টেনেছেন এভাবে—আমার বিশ্বাস, গীতাঞ্জলির 'দুঃখে যেন করিতে পারি জয়', তাঁর সমগ্র লেখনীসত্তার মূলমন্ত্র ছিল এবং তাঁর নাট্য রচনায় এই জীবনদর্শনের ব্যত্যয় ঘটেনি। … রবীন্দ্রনাথ সমগ্র বিশ্বের অন্যতম সেরা নাট্যকার, চির নতুন এবং চির প্রাসঙ্গিক।
রবীন্দ্রনাথের আকুলভক্ত নন, তবে পরিসীমা বোঝার চেষ্টা করেন বলে আলোচনার সূত্রপাত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ। তাঁর মতে, বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় রবীন্দ্রনাথ গৃহপালিত হয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথকে খুঁজতে গিয়ে তাঁকে সমালোচনা না করাই হবে সবচেয়ে বড় প্রবঞ্চনা। তিনি বলেন, নাটকের রবীন্দ্রনাথ দোদুল্যমানতায় আন্দোলিত। প্রথম দিকের নাটকে তিনি স্বদেশ ও সমাজ-সংলগ্ন হলেও পরবর্তী সময় সেই সংস্রব থেকে বেরিয়ে আসেন এবং রূপক-সাংকেতিক নাটক নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
রবীন্দ্রনাথ বাউলদের সঙ্গে ঈশ্বরকে খুঁজেছেন জীবন দেবতা রূপে উল্লেখ করে সৈয়দ জামিল আহমেদ স্পষ্ট করে বলেন, যে দেশে সেলফ সেন্সরশিপ হয়, সে দেশে রবীন্দ্র নাট্যচর্চা কিছুটা দুরূহ বৈকি।
রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ নাটককে বর্তমান সময়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক বলে দাবি করেন অভিনয়শিল্পী সারা যাকের। তাঁর নাটকে বিষয়ের অনেক বেশি পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বলে অভিমত দেন। তাসের দেশ, অচলায়তন, রক্তকরবী নাটকের বিষয়ও তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় রবীন্দ্র নাটক অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক বলে সহমত প্রকাশ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আফসার আহমেদ। তিনি বলেন, শুধু রাজনীতি চিন্তার কারণে নয়, মানুষের সর্বজনীনতায় ও জাতীয় সংকটে রবীন্দ্র নাটক পরম আশ্রয়স্থল।
সভাপতি অধ্যাপক অনুপম সেন বলেন, বহুমুখী প্রতিভা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের তুলনা শুধু ভিক্টোর হুগো ও গ্যেটে। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বলেছেন, যে জাতীয়তাবাদে কুফল আছে। তিনি বলেন, তাঁর নাটক সাংকেতিক বা রূপকধর্মী। এই নাটকের মৌলিকতা অতুলনীয়। বিশ্বসাহিত্যে এমন নাটক বিরল। তিনি একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী হয়েও আন্তর্জাতিকতাবাদী। বাঙালিত্বকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন। আবার সমাজের প্রত্যেক মানুষের মুক্তির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মুক্তি ঘটবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। নাটকে সেই বিশ্বাস পরস্ফুিট করে তুলেছেন। তিনি কেবল এই সময়েই প্রাসঙ্গিক নন, তিনি কালজয়ী। শেক্সপিয়র সম্পর্কে তলস্তয়ের তির্যক মন্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, যতই সমালোচনা হোক, রবীন্দ্র নাটক আজ শুধু নয়, শত বছর পরেও পঠিত হবে, মঞ্চস্থ হবে। কেননা, তা সময়কে ধারণ করেছে, তার দাবি মিটিয়েছে। এ কারণে দীর্ঘকাল ধরে রবীন্দ্রনাথ শুধু বাঙালিকে নয়, সারা বিশ্বকে আনন্দ দেবে।

বিষয়:রবীন্দ্র-বিবেচনায় মনুষ্যত্বের দায়
কালের রবীন্দ্রনাথ
 তৈমুর রেজা
অর্থনৈতিক শোষণ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ—এটা প্রসঙ্গ হিসেবে বিরাট। আকবর আলি খান সংক্ষেপে তাই ব্রিটিশ শাসন, জমিদারি ব্যবস্থা, বঞ্চিত মানুষ—এ রকম কয়েকটি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।
ব্রিটিশ শাসনের সাম্রাজ্যবাদী দিকটার প্রতি রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট ঘৃণা ছিল। তাঁর বহু লেখায় তা এসেছে। তবে মহাত্মা গান্ধী বা কার্ল মার্ক্স যেভাবে ব্রিটিশ শাসনকে দেখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠিক সেভাবে দেখেননি। তিনি মাঝামাঝি একটা দৃষ্টিভঙ্গি বেছে নিয়েছিলেন। গান্ধীর মত ছিল, পাশ্চাত্য সভ্যতা খারাপ জিনিস, তাই বর্জনীয়। আর মার্ক্সের মত ছিল, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ কলোনি আদতে 'আনকনশাস টুল অব হিস্টরি', এই শোষণের মধ্য দিয়েই সমাজ রূপান্তরিত হবে। গান্ধী সত্য হলে ভারতবর্ষ চরকায় সুতা কাটত। আর মার্ক্স সত্য হলে আমাদের সমাজ আমূল বদলে যেত। কিন্তু এ দুটির কোনোটিই ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথের কথাই ফলেছে: প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একটা সমন্বয় ঘটেছে।
জমিদারি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মত হলো, জমিদারি ছেড়ে দেওয়া উচিত, কিন্তু মুশকিল হলো, জমিদার চলে গেলে মহাজন ও রায়ত-খাদকদের প্রতিপত্তি বেড়ে যাবে। তাই আইন করে জমিদারি সমস্যার নিদান হবে না। ভেতর থেকে প্রাণসঞ্চার লাগবে। দারিদ্র্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মার্ক্সীয় বা ধ্রুপদি কোনো অর্থনৈতিক ঘরানার মতামতই গ্রহণ করেননি। তিনি মানব উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন: দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে, ক্ষমতায়ন করতে হবে। তাঁর মৃত্যুর ৫০ বছর পর এসব কথা আমরা শুনছি অমর্ত্য সেনদের মতো উন্নয়ন-অর্থনীতিকদের মুখে। রবীন্দ্রনাথ শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাস করতেন না। অর্থনৈতিক কাঠামো বদলালেই সমাজ রূপান্তর হবে, এমনটা তিনি ভাবেননি।
বর্ণবাদ বা জাতিভেদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মত ঠিক কালোত্তীর্ণ নয়। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের আগে জাতিভেদ যতটা ছিল, পরে তার থেকে বহু গুণে বেড়েছে। কালোর ওপর সাদার শ্রেষ্ঠত্ব তৈরি করে তারাই বর্ণবাদের পত্তন করে। রবীন্দ্রনাথ চিরকাল অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আপসহীন ছিলেন। তবে জাতিভেদের অন্যতর দিক, যেমন ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব, অসবর্ণ বিয়ে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে আহারাদি—এসব নিয়ে তাঁর প্রতিবাদ নেই। বর্ণাশ্রমকে 'মঙ্গল' ভেবেছেন। শূদ্র প্রসঙ্গে তাঁর ধারণা ছিল, 'যারা শূদ্র, শূদ্রত্বে তাদের অসন্তোষ নেই'। জাতিভেদ প্রসঙ্গে তাঁর চিন্তা আসলে দেবেন্দ্রনাথের চিন্তারই প্রতিধ্বনি।
নারীমুক্তির প্রশ্নে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি উদারভাবে 'পুরুষশাসিত সমাজের দুর্বলতা'র কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি বোধহয় নারীর সামাজিক অবস্থা নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন ছিলেন না, নারীহূদয় নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর মতে, আমাদের সমাজে স্ত্রীলোকেরা বেশ এক রকম সুখে আছে।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় নারীর অবস্থান কি এগিয়েছে? নারী-পুরুষের অনুপাত দেখলে এটা সহজে বোঝা যায়। জৈবিক নিয়মে নারীর সংখ্যা বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক, কম হলে বুঝতে হবে সমাজে বৈষম্য চলছে। অমর্ত্য সেন এসব হারিয়ে যাওয়া নারীকে বলেছেন 'মিসিং উইমেন'। ১৮৭২ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত বাংলায় ক্রমাগতভাবে নারীর অনুপাত কমে গেছে। এর প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ ও অপুষ্টির ফলে ঘটা মাতৃমৃত্যু। এগুলো নারীদের প্রকৃত সমস্যা। রবীন্দ্রনাথ এদিকে আকৃষ্ট হননি। নিজেও শিশুকে বিয়ে করেছেন, মেয়েদেরও শিশু অবস্থায় বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যে বাল্যবিবাহকে রোমান্টিক করেছেন। আমাদের মেয়েরা সবার খাওয়া শেষে যদি কিছু থাকে, তা-ই খায়। তিনি এর প্রশংসা করেছেন। কিন্তু এটাই আমাদের নারীর অপুষ্টির একটা বড় কারণ।
এসব সীমাবদ্ধতা তাঁর মধ্যে আছে। এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে সব ব্যাপারেই কালকে ছাড়িয়ে উঠবেন তিনি। এতে তাই আঁতকে ওঠার মতো কিছু নেই যে তিনি জাতিভেদ ও নারী প্রশ্নে 'সেকেলে' ছিলেন।
তাঁর লেখার প্রধান শক্তি দুটি: তিনি মানবতাবাদী ছিলেন এবং তিনি আদর্শবাদী ছিলেন না। আদর্শ বা মূল্যবোধের চেয়ে সব সময় তিনি মানুষকে ওপরে ঠাঁই দিয়েছেন। বিপ্লব তাঁর বাসনা ছিল না, কারণ বিপ্লবে সমস্যার নিরাময় ঘটে না বলেই তাঁর বিশ্বাস। তিনি চেয়েছেন বঞ্চিতের ক্ষমতায়ন, শিক্ষার প্রসার আর সচেতনতা।
সংক্ষেপে মোটামুটি এ রকমই দাঁড়াবে আকবর আলি খানের বক্তব্য। আলোচক হায়াৎ মামুদ বললেন, রবীন্দ্রনাথকে তো আর আমরা এভাবে বিচার করি না যে রবীন্দ্রনাথ সমাজসংস্কারক। তিনি নিজেও জানতেন, এ কাজ তাঁর নয়। তিনি যা সংস্কার করবেন তা হলো একটি দেশের, একটি জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সাহিত্য। মালেকা বেগমের মতে, রবীন্দ্রনাথ সমকালীন, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক ও উদার। তাঁকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে হবে। রবীন্দ্রনাথ যখন বঞ্চিতের কথা বলেন, তার মধ্যে আমরা নারীকে পাই। খালিকুজ্জামান ইলিয়াস আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত তর্কের প্রসঙ্গ ধরে আলোচনা করেন।
সভাপতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে জানালেন, গান্ধী ও মার্ক্স দুজনের থেকেই দূরে রবীন্দ্রনাথ। তবে গান্ধী থেকে যতটা দূরে, মার্ক্স থেকে অত দূরে ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ ধর্মের সঙ্গে শিল্প-সমাজ-রাষ্ট্রকে গুলিয়ে ফেলার পক্ষপাতী ছিলেন না।

বিষয়: রবীন্দ্রনাথের জাতি-ভাবনা
কবির নো-নেশন
বিনায়ক সেনের প্রবন্ধটি কয়েকটি অংশে বিভক্ত। প্রথম ভাগ—মোহ ও মোহভঙ্গ। এই ভাগের আলাপের বিষয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনে নেশনের ঘোর, যে কালপর্বে 'বাংলার বাইরের বিশ্বকে তিনি দেখছেন বাঙালির চোখ দিয়ে'। কিন্তু ১৯০৫ সালে হঠাৎ করেই রবীন্দ্রনাথ নিজেকে স্বদেশি আন্দোলন থেকে সরিয়ে নেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে চিঠিতে লেখেন, '…যতদিন আয়ু আছে, আমার এই প্রদীপটিকে জ্বালিয়া পথের ধারে বসিয়া থাকিব।'
দ্বিতীয় ভাগ—১৮৮৫-১৯০৯: নেশন-ভাবনার প্রথম পর্ব। এ পর্বে বিনায়ক সেন জানাচ্ছেন, একটি বিকল্প নেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু নেশনমাত্রই ব্যতিক্রমের ছদ্মাবরণে আসে, ক্রমে তার স্বভাব একই হয়ে দাঁড়ায়।
১৯১০ সালে গোরা উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মোহভঙ্গ ঘটে। তিনি নেশনের ওপর আস্থা হারান। নানা রকম সামাজিক বিভক্তি জারি থাকায় নেশন নির্মাণ সম্ভব নয়—এটাই ছিল তাঁর অনাস্থার মূল কারণ। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বহু দিন থেকে 'একটা পাপ চলিয়া আসিতেছে', আর শিক্ষিত-মূর্খের ফারাকটা এতদূর যে, আমরা 'এক দেশে থাকিলেও' এক দেশে নেই।
তৃতীয় ভাগ—১৯১০-১৯৪১: নেশন-ভাবনার দ্বিতীয় পর্ব। এই কাল-পর্বে রবীন্দ্রনাথ নেশন আইডিয়াকেই প্রশ্ন করলেন। ন্যাশনালিজমের তিনি নাম দিলেন 'জিওগ্রাফিক্যাল ডেমন'। গোড়ার দিকে তাঁর ধারণা ছিল, 'নেশন একটি মানস পদার্থ'। কিন্তু কিছুকাল পরেই তাঁর মতামত: নেশন হলো 'সেই অস্বাভাবিক অবস্থা' যা গোটা জনসাধারণকে 'যান্ত্রিক প্রয়োজনে' সংঘবদ্ধ করে।
ন্যাশনালিজম বিশেষ করে কেন ভারতবর্ষের বেলায় খাটবে না, সে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ: ইউরোপে শাসক-শোষিতের যে ভেদ ঘটেছিল, 'তা জাতিগত ভেদ নয়, শ্রেণীগত ভেদ'। অথচ ভারতবর্ষে ভেদ ঘটছে মূলত ধর্ম ও জাতির ছুতোয়। ভারতবর্ষে যখন স্বরাজ আন্দোলনের জোয়ার চলছে, তখন রবীন্দ্রনাথের মন পড়ে আছে সমাজের 'বিচিত্র ছলনাজালে'। তিনি নাছোড়বান্দার মতো বলছেন, আগে চাই আত্মশক্তি, তারপর স্বরাজ। রবীন্দ্রনাথের এই চরমপন্থা তখনকার রাজনীতিতে কলকে পায়নি। কিন্তু তাতে তিনি চঞ্চল হননি, তার কারণ বোধহয় রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন প্রবল ভেদের 'দুর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে নেশন গড়ার আন্দোলন… এসব ভেদবুদ্ধিকেই আরো বাড়িয়ে তুলবে।'
পরের ভাগ—অনাধুনিক না উত্তর-আধুনিক? এই অংশে রাবীন্দ্রিক-নেশন প্রসঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায় যে সমালোচনা দিয়েছেন, সেটা নিয়ে আলাপ তুলছেন সেন। পার্থের মোদ্দা কথা হলো, আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বা গণতন্ত্রের ধারণা রবীন্দ্রনাথের আমলে ছিল না, যন্ত্র বোঝার ধৈর্যও তাঁর ছিল না। এখনকার নেশন-স্টেট বুঝতে রবীন্দ্রনাথ ধরতাই হিসেবে তাই সেকেলে।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমন একদিকে রবীন্দ্রনাথের নেশন-ভাবনাকে 'বেহুদা' বলছেন, অন্যদিকে আবার কেউ কেউ তাঁকে ভাবছেন, 'উত্তর-আধুনিক'। ই পি থম্পসনের এ ব্যাপারে সাক্ষ্য আছে, আশিষ নন্দীও রবীন্দ্রনাথের নেশন বিরোধী সমালোচনায় খুঁজে পাচ্ছেন 'স্টেট বিরোধী এক মতাদর্শ যাতে স্বদেশপ্রেমের জায়গা আছে কিন্তু নেশনালিজমের নেই'। আর ইসাহ্ বার্লিন চোখে রবীন্দ্রনাথ 'দুঃসাধ্য মধ্যপন্থার' সাধনায় একাকী পথিক।
শেষ ভাগ—নো-নেশনের সমাজ। রবীন্দ্রনাথ কড়া ভাষায় নেশনের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু অতটা কড়া ছোপে 'নো-নেশনের' ছবি আঁকেননি। কিছু ছিটেফোঁটা চিন্তার খোঁজ মিলবে। ঐক্য রাখার প্রয়োজনে তিনি 'ভারতবর্ষে এক রাষ্ট্র শাসন না হয়ে যুক্তরাষ্ট্র শাসননীতির প্রবর্তন' হোক, এটা মেনে নিয়েছিলেন। নো-নেশনের সমাজের দৃষ্টান্ত তিনি খুঁজে পেয়েছেন ভারতবর্ষের বাইরে: চীন, জাপান, পারস্য ও তুরস্কে। তাঁর মতে, নো-নেশনের সমাজের একটা প্রধান অবলম্বন হবে সমগ্র জনসাধারণের উদ্ভাবনী শক্তি। আমলাতন্ত্রেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি।
যন্ত্র বোঝার ধৈর্য তাঁর ছিল না—এই অভিযোগ সর্বাংশে সত্য নয়। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় 'যৌথতার নতুন নির্মাণের' তিনি স্তুতি করেছেন বটে, আবার মানব চরিত্রের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার রীতিও তিনি ঠিক মনে করেননি।
বিনায়ক সেন সিদ্ধান্ত টানছেন, রবীন্দ্রনাথ 'এ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে এক ট্রাজিক চরিত্র'। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তা-ই বলতেন, তাঁর 'এই-বলার' সঙ্গে 'ঐ-বলা' সব সময় মেলেনি। কিন্তু তিনি দাঁড় বেয়েছেন স্রোতের বিপরীতে। ফলে সমকালীন চিন্তার স্রোত থেকে তিনি ছিটকে গেছেন। সে জন্যই জীবনের উপান্তে নিজেকে তিনি দেখেছেন ব্রাত্যহীনদের দলে।
আলোচকদের মধ্যে সলিমুল্লাহ খান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সম্পর্ক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। আর সভাপতি আনিসুজ্জামান তাঁর আলোচনায় সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথের জাতি-ভাবনার একটি রূপ নির্মাণ করেছেন।

বিষয়: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা
পথের দিশা
 জসীম মজুমদার
প্রথম আলো ও ব্র্যাক ব্যাংক আয়োজিত 'রবীন্দ্রনাথ, এই সময়ে' শীর্ষক দুই দিনের সেমিনারের সর্বশেষ অধিবেশনের বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সভাপতিত্বে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক আবুল মোমেন। আলোচক ছিলেন মোহিত উল আলম, গোলাম মোস্তফা ও দ্বিজেন শর্মা। প্রবন্ধকার জানান, ইংরেজ-প্রবর্তিত চলমান শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা নিয়ে বাঙালি সারস্বত সমাজে বরাবরই সমালোচনা ছিল। গত পঞ্চাশ বছরে তা জোরদার হয়ে শিক্ষায় নানা রকম সংস্কার ও নবায়ন চলছে বটে কিন্তু তাতেও আশানুরূপ উন্নতি যে হচ্ছে না সে বিষয়েও আমরা সবাই সজাগ। বরং ইদানীং উন্নত বিশ্বে এবং তার রেশ ধরে আমাদের এ অঞ্চলেও পেশা নয় 'জীবনের জন্য শিক্ষার' কথাবার্তাও কিছু কিছু শোনা যাচ্ছে। এই পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন আবার যেন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
অন্যের চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থায় যে আমরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারব না তা কিন্তু তখনই রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন এবং আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আধুনিক শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি বলে তা মাঝপথেই অনেকখানি হারিয়ে যায়।
আলোচক অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা যেমন বলছেন, রবীন্দ্রনাথ তখনো আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, আমাদের দেশে কিছু বৃত্তিজীবী তৈরি হবে, মানুষ তৈরি হবে না। রবীন্দ্রনাথ এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভেবেছিলেন যেটিতে শৃঙ্খল থাকবে না, মুক্তির আনন্দ থাকবে।
রবীন্দ্রনাথের আনন্দের ধারণাটিও বুঝতে হবে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য ও শিল্পের প্রেক্ষাপটে।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তায় শিক্ষক ও শিক্ষালয়ের পরিবেশ প্রধান দুটি বিষয়। ১৩৪৩ সনে তিনি শান্তিনিকেতনে স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে লিখেছেন, 'অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে আমার মনে এই কথাটি জেগে উঠেছিল, ছেলেদের মানুষ করে তোলবার জন্যে যে একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছে, যার নাম ইস্কুল, সেটার ভিতর দিয়ে মানবশিশুর শিক্ষার সম্পূর্ণতা হতেই পারে না।'
দ্বিজেন শর্মা বলছেন, পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থা কিন্তু নৃভিত্তিক এবং এই ক্ষেত্রে তারা সফল। আর আমরা যা করছি তা হচ্ছে পাশ্চাত্য শিক্ষা পদ্ধতিরই অবিকল সংস্করণ। আমরা যেমন এটা এখন উপলব্ধি করছি, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তখনই বলেছিলেন, আমাদের শিক্ষাকে আমাদের নিজেদের হাতে নিতে হবে। অর্থাৎ আমাদের উপযোগী করেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
মোহিত উল আলম এর উত্তরণে আবার আমাদের জানাচ্ছেন, আনন্দময় জীবনযাপন বা জীবন উদ্যাপনের মস্ত আকাঙ্ক্ষা মানুষের তা সার্থক হবে তার দুটি সামর্থ্যের ভিত্তিতে—আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রকাশ।
বিকাশ হলো ব্যক্তির প্রস্তুতির অংশ আর প্রকাশ হলো সেই প্রস্তুতির ফসল। একটি ঘটবে ভেতরে ভেতরে আর অন্যটি ফুটবে বাইরে। একদিকে অনুশীলন ও সাধনা, অন্যদিকে সক্রিয়তা ও সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মানুষের সব চর্চার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে—বিকশিত হওয়া, প্রকাশিত হওয়া।
আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রকাশের পথটি কীভাবে তৈরি হবে শিশুর জন্য তার জন্য রবীন্দ্র-সাহিত্য থেকেই কতগুলো উপায় বের করেছেন প্রবন্ধকার আবুল মোমেন— ১. শিশুর জন্য ঘরে ও স্কুলে অভয় মন্ত্রে অনুকূল সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; ২. তার আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার বোধে কোনো আঘাত দেওয়া যাবে না, তা সযত্নে রক্ষা করতে হবে; ৩. তার সুপ্ত সহজাত মৌলিক ক্ষমতার বিকাশে সহায়তা দিতে হবে, যেমন—তার সব ইন্দ্রিয়শক্তির এবং ভাষা, সুর ও দৃশ্যমানের রূপ ও রঙের বোধ; ৪. গাছপালা-নদী-জলাশয়-মাঠ-খেত-সমুদ্র-পর্বত, আকাশ-মহাজগৎ ইত্যাদি সম্পর্কে তাকে সচেতন ও সংবেদনশীল করে তুলতে হবে; ৫. পরিবার-প্রতিবেশ ছাড়াও সাধারণভাবে মানুষ সম্পর্কে তাকে আগ্রহী ও দায়িত্বশীল করে তুলতে হবে; ৬. তার সহজাত যুক্তি-বিবেচনা ও দায়বোধকে এবং বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতাকে ক্রমশ উন্নত ও পরিণত করে তুলতে হবে; ৭. তার জন্য সব কাজে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের এবং প্রশ্ন তোলার ও করার অবারিত সুযোগ দিতে হবে; ৮. সৃজনশীল ও প্রায়োগিক কলা চর্চায় তাকে উদ্বুদ্ধ ও সর্বোচ্চ সুযোগ দিতে হবে; ৯. স্বাজাত্যবোধ, মানবসভ্যতার উত্তরাধিকার ও বৈশ্বিক চেতনায় তাকে পুষ্ট করতে হবে; ১০. সমকালীন যেসব ইস্যু প্রকৃতি, মানুষ ও বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা ও উদ্বেগের কারণ সেগুলো সম্পর্কে সচেতন ও সংবেদনশীল হবে।
চাকরি বা অর্থ উপার্জন যদি শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হয় তবে তার চেয়ে ভয়ংকর আর কিছু নেই। দ্বিজেন শর্মা যেমন আশা প্রকাশ করেছেন, হয়তো কোনো মনীষী নতুন কোনো শিক্ষাব্যবস্থা আনবেন, যেটা হবে প্রকৃতিবান্ধব এবং শিক্ষাক্ষেত্র হবে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতামূলক।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আলোচনার ইতি টানেন এভাবে: রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ রেনেসাঁ-মানব। তিনি এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন যার মাধ্যমে এই রেনেসাঁ-মানব তৈরি হবে।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৪, ২০১১

ট্যাগস:,

http://banglalibrary.evergreenbangla.com/blog/1647

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি

 
কুলদা রায়

এমএমআর জালাল


প্রথম পর্ব

রবীন্দ্রনাথ জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি জমিদার পরিবারের সন্তান।

ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথকেও জমিদারগিরি করতে হয়েছিল। এখানে একটি তবে আছে? সেটা হল অধিকাংশ সময়কালটাই বাবার হয়ে–পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের হয়ে রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। এর জন্য তিনি নিয়মিত বেতন পেয়েছেন।

১৮৮৯ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩১ বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এস্টেটের বেতনভোগী হিসাবে জমিদারি দেখেছেন। এই জমিদারির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল সর্বমোট ৫০ বছর। তিনি প্রজাহিতৈষী জমিদার ছিলেন।

এই জমিদারগিরি নিয়েই একটি রবীন্দ্রবিরোধিতা দীর্ঘকাল থেকে নানা কায়দায় চলে আসছে। জমিদাররা যেহেতু শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধি–সুতরাং তারা কোনোভাবেই ব্যতিক্রমী হতে পারেন না– ভাল হতে পারেন না। তারা যে কোনো প্রকারেই হোক না কেন প্রজানিপীড়ন করে থাকেন। এইরকম একটি সাধারণ সমীকরণ থেকে বলা যেতে পারে, জমিদার রবীন্দ্রনাথও প্রজানিপীড়ক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালেই নানাধরনের বিরোধিতার সম্মুখিন হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে বিরোধিরা তাঁর সাহিত্য কর্ম নিয়ে বিরোধিতা করে জুঁত করতে পারেনি–তখন তারা চোখ বুজে গৎবাঁধা আওয়াজটি দিয়েছেন–বাবু রবীন্দ্রনাথ প্রজানিপীড়ন করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের এই প্রজানিপীড়ন বিষয়ে সম্প্রতি একটি ব্লগে নতুন করে অভিযোগ করা হয়েছে। সে কারণে এই সিরিজে অনুসন্ধান করে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে–'রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি' কেমন ছিল। বোঝার চেষ্টা করা হবে– প্রজানিপীড়নের অভিযোগটির ভাঁড়ার ঘরে কি আছে।

ঠাকুরদের জমিদারীর একটু খতিয়ান—

——————————————-

ডিহি শাহজাদপুর (সদর শাহজাদপুর), বিরাহিমপুর ( যার সদর কাছারি ছিল শিলাইদহে), কালিগ্রাম পরগণা (সদর পতিসর) এবং উড়িষ্যার পাণ্ডুয়া ও বালিয়া তালুক। এছাড়াও নূরনগর পরগণা, হুগলির মৌজা আয়মা হরিপুর, (মণ্ডলঘাট) পাবনার পত্তনী তালুক তরফ চাপড়ি, রংপুরের স্বরূপপুর, যশোরের মহম্মদশাহী ইত্যাদি এলাকাও। গবেষক অমিতাভ চৌধুরীর তথ্যমতে নদীয়া (কুষ্টিয়া)ও ঠাকুর এস্টেটের অধীনে ছিল। তবে প্রধানত বিরাহিমপুর, কালীগ্রাম, শাহজাদপুর ও ওড়িশার কটকের জমিদারি ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলের জমিদারি ঠাকুরদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। তার কারণ অবশ্য জানা যায় না।

কিভাবে জমিদারিটা ঠাকুর পরিবারে পেলেন–নীলমণি থেকে দ্বারকানাথ

—————————————————-

জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নীলমণি ঠাকুর ছিলেন ব্যবসায়ী। তার পুত্র রামলোচন ঠাকুর বিরাহিমপুর পরগনা (যার সদর কাছারি ছিল শিলাইদহে) জমিদারী কিনেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রখর বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি। জমিদারী কিনে পীরালী ঠাকুরদের মধ্যে তিনি কিছুটা আভিজাত্য অর্জন করেছিলেন।

রামলোচন ঠাকুর মৃত্যুর আগে তার দত্তকপুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুরকে ১৮০৭ সালে এ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে যান। তখন তাঁর বয়স মাত্র তের বছর। তার বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এ সম্পত্তি রামলোচন ঠাকুরের স্ত্রী অলকা দেবী ও দ্বারকানাথের বড় ভাই রাধানাথ দেখাশুনা করতেন। সে সময় শিলাইদহ এলাকাটির সুনাম ছিল না। প্রজারা 'দুর্বৃত্ত বলিয়া প্রসিদ্ধ' ছিল। এ জন্য জমিদারী পরিচালনার আইন-কানুন সুপ্রীম কোর্টের ব্যারিস্টার ফার্গুসনের কাছে ভাল করে জেনে নেন।

আইন বিশেষজ্ঞ হওয়ার কারণে ১৮১৮ সালে তিনি চব্বিশ পরগনার কালেক্টরের শেরেস্তাদার নিযুক্ত হন। ১৮২৮ সালে শুল্ক ও আফিং বোর্ডের দেওয়ান হন।

১৮৩০ সালে কালীগ্রাম পরগণা কিনেছিলেন। এ ছাড়া উড়িষ্যার পাণ্ডুয়া ও বালিয়া তালুক তাঁর ছিল। ১৮৩৩ সালে বিরাহিদপুরের কুমারখালি মৌজায় অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রেশমের কুঠিটি তিনি কিনে নিলেন। ১৮৩৪ সালে সাহাজাদপুর কেনেন।

সাজাদপুরের জমিদারিটি কিনেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, রানী ভবানীর নাটোরের জমিদারির নীলাম থেকে। দাম পড়েছিল ১৩ টাকা ১৩ আনা।

অথ জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাচার

———————————————

১৮৪৬ সালে দ্বারকানাথের মৃত্যুর পরে তাঁদের হাউসের দেনা এক কোটি টাকা, পাওনা সত্তর লক্ষ টাকা। ৩০ লক্ষ টাকার খবর নাই। ঠাকুর পরিবার গরীব হয়ে গিয়েছিল। সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী লিখেছেন—যাঁহার পিতার ডিনার তিনশত টাকার কমে হইত না, তিনি চারি আনা মূল্যের ডিনার খাইয়া তৃপ্ত হইতেন। সেসময় ১৮৫৫ সালে ঋণের দায়ে দেবেন্দ্রনাথ কারারুদ্ধ হওয়ার পথে। তিনি সংকল্প করলেন দেনা তিনি শোধ করবেন। দেউলিয়া ঘোষিত হবেন না। ছয়মাসের মধ্যেই অবস্থা সামলে ওঠেন। তাঁদের কোনো ব্যবসা বানিজ্য রইল না। শুধু জমিদারীটি টিকে ছিল। তিনি গরীব হওয়ার কারণে বিষয় সম্পত্তিতে মনোযোগী হলেন।

দ্বারকানাথ তাঁর উইলে তিন ছেলের মধ্যে বিষয় সম্পত্তি ভাগ করে দিলেও মৃত্যুর পরে জমিদারি এসে পড়েছে তার বড় ছেলে দেবেন্দ্রনাথের উপর। শিলাইদহে গিয়ে নিজেই জমিদারী পরিচালনা করা শুরু করলেন। গিরীন্দ্রনাথের ভাগে পড়েছিল শাহজাদপুর পরগণা।

দেবেন্দ্রনাথ তাঁর ছোটো দুই ভাই গিরীন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথের অংশের জমিদারি পরিচালনাও এক সঙ্গে করতেন। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করেন। দেবেন্দ্রনাথের পরামর্শে গিরীন্দ্রনাথ ব্যবসা দেখতেন। তিনি ভাল ব্যবসা বুঝতেন। দ্বারকানাথের অধিকাংশ ঋণই গিরীন্দ্রনাথের সুযোগ্য পরিচালনায় ব্যবসার আয় থেকে শোধ করা হয়। গিরীন্দ্রনাথ ১৮৫৪ সালে মারা যান।

দ্বারকানাথের ছোটো ছেলে নগেন্দ্রনাথ বিলাসী ছিলেন। তিনি সেই পারিবারিক ঋণগ্রস্থ অবস্থায়ও বিপুল পরিমাণ ঋণ করেন। এটা নিয়ে বড় ভাই দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে অভিমান করে ছোটো ভাই নগেন্দ্রনাথ কলকাতা ছেড়ে বহুদূরে চলে যান। দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। তার কোনো সন্তান ছিল না। তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। ফলে দ্বারকানাথের এই বিপুল জমিদারি দেবেন্দ্রনাথের একার উপরই পড়ে।

গিরীন্দ্রনাথের দুই ছেলে গণেন্দ্রনাথ ও গুণেন্দ্রনাথ অকালে মারা যান। গণেন্দ্রনাথের ব্যবসায়ী বুদ্ধি ছিল ক্ষুরধার। দেবেন্দ্রনাথ ব্যবসা বিষয়ে তার উপরে নির্ভর করতেন। তিনি মাত্র ২৮ বছর বয়সে কলেরা রোগে মারা যান। তাঁর কোনো সন্তান ছিল না। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে গিরীন্দ্রনাথের ছোটো ছেলে গুণেন্দ্রনাথও মারা যান। গুণেন্দ্রনাথের নাবালক তিন ছেলের গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের জমিদারী অংশও দেবেন্দ্রনাথকে পরিচালনা করতে হয়। তিনি তাঁদের প্রাপ্য টাকা মিটিয়ে দিতেন।

পরবর্তীকালে দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে সরাসরি জমিদারি পরিচালনা করা ছেড়ে দেন। ব্রাহ্ম ধর্ম পালন ও প্রচারে সময় ব্যয় করেন। দেবেন্দ্রনাথ জমিদরি ছেড়ে দিলে তাঁর প্রতিনিধি হয়ে এই জমিদারিগুলো বিভিন্ন সময়ে পরিচালনা করেছেন বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বড় জামাই সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথের বড় ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথ ও মেজো ছেলে অরুনেন্দ্রনাথ, সারদাপ্রসাদের ছেলে সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় এবং সর্বশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

তখন আয়ের উৎস দাঁড়িয়েছিল শুধুমাত্র প্রজাপ্রদত্ত খাজনা ও অন্যান্য আদায়। বাড়ির পুরুষরা প্রায় কেউই জমিদারী পরিচালনায় অংশ নেন না, কালে ভদ্রে মহালে যান। সেখান থেকে অর্থ আসে। তাঁরা ছিলেন জমিতে অনুপস্থিত জমিদার। পরিবারের সদস্যদের অনেকে সে সব অঞ্চল চোখে পর্যন্ত দেখেন নি। তাঁরা বিলাসী জীবন আর নানাপ্রকার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালবাসতেন। তবে দেবেন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে জমিদারী দেখতে গেছেন। সমীর সেনগুপ্ত লিখছেন—দেবেন্দ্রনাথের চরিত্রের মধ্যে দার্শনিকতা ও বৈষয়িকতার অদ্ভুত পরস্পরবিরোধী সহাবস্থান ছিল। সব কিছু থেকে দূরে থেকেও তিনি তাঁর জমিদারী, আদি ব্রাহ্মসমাজ ও পরিবারকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন।

রবীন্দ্রনাথের জমিদারির শুরুর আগে–

—————————————–

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ৭ ডিসেম্বর, ১৮৮৩ সালে বক্সার থেকে একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথকে লেখেন—এইক্ষণে তুমি জমীদারির কার্য্য পর্য্যবেক্ষণ করিবার জন্য প্রস্তুত হও; প্রথমে সদর কাছারিতে নিয়মিত রূপে বসিয়া সদর আমিনের নিকট হইতে জমাওয়াশিল বাকী ও জমাখরচ দেখিতে থাক এবং প্রতিদিনের আমদানি রপ্তানি পত্র সকল দেখিয়া তার সারমর্ম্ম নোট করিয়া রাখ। প্রতিসপ্তাহে আমাকে তাহার রিপোর্ট দিলে উপযুক্তমতে তোমাকে আমি উপদেশ দিব এবং তোমার কার্য্যে তৎপরতা ও বিচক্ষণতা আমার প্রতীতি হইলে আমি তোমাকে মফঃস্বলে থাকিয়া কার্য্যভার অর্পণ করিব। না জানিয়া শুনিয়া এবং কার্য্যের গতি বিশেষ অবগত না হইয়া কেবল মফঃস্বলে বসিয়া থাকিলে উপকার কিছুই হইবে না।

শুরুতে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ নিয়োগ করেছিলেন জমিদারী পরিদর্শক হিসাবে। সেটা ১৮৮৯ সালের ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ তখন সবেমাত্র বিয়ে করেছেন।

অই সময়ে রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভগ্নিপতি সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় ঠাকুর এস্টেটের ম্যানেজারের দ্বায়িত্ব পালন করতেন। তিনি ছিলেন ঘরজামাই। যে কোনো বৈষয়িক ব্যাপারে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবাস থেকে পত্র লিখে তাঁকেই নির্দেশ দিয়েছেন বলে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের বিবাহের রাত্রে ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর। আকস্মিকভাবে শিলাইদহে তাঁর মৃত্যু হয়। সংবাদটি এসে জোড়াসাঁকোয় পৌছায় পরের দিন। শোকের আঘাতে সমস্ত আনন্দঅনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।

সারদাপ্রসাদের মৃত্যু, কয়েকমাস পরে কাদম্বরী দেবী ও দেবেন্দ্রনাথের পুত্র হেমেন্দ্রনাথের দেহত্যাগ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জাহাজী ব্যবসা ইত্যাদিতে শৃঙ্খলায় জমিদারি ও আর্থিক বিলিব্যবস্থার ভার নির্দিষ্ট কারো উপরে দিতে ভরসা পাননি। এর আগে দেবেন্দ্রনাথের পঞ্চম ছেলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেখতেন। ১২৯১ (১৮৮৪) সাল থেকে জোড়াসাকোর হিসাবপত্র বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখতেন। তিনি এই কাজটি পছন্দ করতেন না। মাত্র দেড় মাস পরে তাই তাঁর পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

দ্বিপেন্দ্রনাথ ২৩ আগস্ট ১৮৮৪ তারিখ থেকে ঠাকুরপরিবারের জমিদারির হিসেবপত্র পরীক্ষা করার দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিপেন্দ্রনাথ পাঁচ বছর এই কাজ করেন। এরপর দেবেন্দ্রনাথের ছোটো ছেলে রবীন্দ্রনাথের উপর এই দায়িত্ব এসে বর্তায়। সে সময় রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য চর্চার ফাঁকে ফাঁকে কাছারিতে নিয়মিত বসে জমিদারির কাজকর্ম শিখতেন।

২ আষাঢ়, ১২৯৬ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন জোড়াসাকোর কাছারির হিসাবপত্র দেখার দায়িত্ব। ১০ অগ্রহায়ণ, ১৩৯৬ তারিখে পেয়েছিলেন জমিদারি পরিদর্শনে অধিকার (নভেম্বর, ১৮৯০)।. এতদিন অবসর মতো জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জমিদারি পরিদর্শন করেছিলেন। (১১ অগ্রহায়ণ, ১২৯৬ বঙ্গাব্দ, সোমবার) ২৫, ১৮৮৯ সালে নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী দেবী, একজন সহচরী, মেয়ে মাধুরীলতা (বেলা) ও পুত্র রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে শিলাইদহে যাত্রা করেন। তাঁদের সঙ্গে গেলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

জমিদারি কাজে কোলকাতায় নহে, শিলাইদহে --

——————————————————

রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে প্রথমবার গেছেন বাল্যকালে বাবা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বিতীয়বার ১৮৭৫ সালে দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে। তৃতীয়বার গেলেন জমিদারি পরিদর্শনের কাজে। সঙ্গে পরিবার।

তারা তখন শিলাইদহে একটি বোটে থাকা শুরু করলেন। রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে একটি পত্রে জানাচ্ছেন—শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকাণ্ড চর—ধূ ধূ করছে—কোথাও শেষ দেখা যায় না—পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কোলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। এই যে ছোটো নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে, এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতি রাতে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদ্য় হচ্ছে, জগৎ সংসারে এ যে কী একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।

২৮ নভেম্বর বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মৃণালিনী দেবী, বেলা, সহচরীসহ চরে বালিহাঁস দেখতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ জমিদারির কাজে ব্যস্ত। তিনি সঙ্গে আসেননি। বলেন্দ্রনাথরা চরে ফেরার পথ খুজে পাচ্ছেন না। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় দেখা যাচ্ছে, মৃণালিনী দেবী ভালই হাঁটতে পারছেন। কিন্তু সহচরী অমলা দাশ হাঁটতে পারছেন না। ভয়ে তার গা হিম হয়ে আসছে। মাটি ফুঁড়ে যে কোনো সময় ডাকাতদল বের হয়ে আসতে পারে। শেষে উঁচু জমিতে উঠতে একদল মেছোদের দেখা পেলেন। তারা ফেরার পথ দেখিয়ে দিয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে, সকালে মৌলভী সাহেব এক দঙ্গল প্রজা নিয়ে এসেছেন। তারা রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের অভাব অভিযোগ প্রার্থনা জানাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ শুনে তার প্রতিকার করছেন।

সে সময় বোট গ্রাম্য গাইয়েদের আগমণ ঘটত। তার মধ্যে দুজন মার্কামারা হয়ে গিয়েছিল। একজন বৈষ্ণব—সে কাঙাল ফিকিরচাঁদের গান গাইত, আরেকজন সুনা-উল্লাহ। এক-একদিনের পালায় দুআনা করে পয়সা বরাদ্দ ছিল। নিয়মিত বরাদ্দ ছাড়াও মৃণালিনী শাড়ি, সাংসারিক টুকিটাকি ওদেরকে দিতেন। বলেন্দ্রোনাথ এ সময় সুনা-ওল্লাহর মুখ থেকে শোনা ১২টি গান খাতায় লিখে রেখেছেন। এর মধ্যে ২ সংখ্যক গানের রচয়িতা গগণ মণ্ডল। তিনি গগণ হরকরা নামে পরিচিত। গানটির নাম আমি কোথায় পাব তারে। রবীন্দ্রনাথ সেগুলো শুনছেন। তাদের সঙ্গে আসরে বসছেন। পল্লীগানের সংকলন তৈরি হচ্ছে তার নির্দেশনায়।

পরিদর্শক থেকে আমমোক্তার জমিদার রবীন্দ্রনাথ

—————————————————–

রবীন্দ্রনাথের জমিদারী কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ১৮৯৬ সালে ৮ আগস্ট বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পক্ষে জমিদারি পরিচালনার জন্য পাওয়ার অব এটর্নি করে দেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত এই আমমোক্তারনামা দলিলে দেবেন্দ্রনাথ স্বাক্ষর করেন।Tagore Family Papers, Doc. No.68—এর উপরে লেখা আছে—Power of Attorney from Debendranath Tagore to Rabindranath Tagore on 8th August 1896 in the presence of Mohini Mohan Chatterjee, Solicitor, Cal./Presented between the hours 10 to 11 on on the 8th august 1896. এই দলিলের বলে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি-পরিচালনা করেছেন। তখনো বেতন পাচ্ছেন।

আমমোক্তারনামা নিয়ে বাবা দেবেন্দ্রনাথের পক্ষে কবি রবীন্দ্রনাথ জমিদারী পরিচালনা করেছেন। তারপর নিজে জমিদারির মালিকানা পেয়েছেন ১৯২০ সালের ৮ মে।।

এইভাবে কবি রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি শুরু হয়েছে।

পোস্টসূত্র :

————–

রবি ঠাকুর, রাহাজানি এবং রবীন্দ্র পূজারীবৃন্দ :ফরিদ আহমদ ও অভিজিৎ রায়–

গ্রন্থসূত্র :

———

১. রবিজীবনী–প্রশান্তকুমার পাল

২.রবিজীবনকথা–প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

৩. রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন — সমীর সেনগুপ্ত

৪. ছিন্নপত্র : রবীন্দ্রনাথ

৫. হাজার বছরের বাঙাল সংস্কৃতি গোলাম মুরশিদ

৬. জমিদার রবীন্দ্রনাথ : শিলাইদহ পর্ব : অমিতাভ চৌধুরী

৭. রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ

৮. স্মৃতিসম্পুট, রবীন্দ্রস্মৃতি; পুরাতনী–ইন্দিরা দেবী :

কুলদা রায় ও এমএমআর জালাল লিখিত রবীন্দ্রবিরোধিতার স্বরূপ সিরিজের লিংক

——————————————————————————————–

১. বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা ও রবীন্দ্রনাথ : 'গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি' থেকে 'বিশ্বপরিচয়'—

প্রথম পর্ব : লিংকদ্বিতীয় পর্ব: লিংকতৃতীয় পর্ব : লিংক

২. আমি কোথায় পাব তারে থেকে আমার সোনার বাংলা

৩. রবীন্দ্রবিরোধিতার স্বরূপ : পাকিস্তান পর্ব 

৪. রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন নাই : প্রথম পর্বদ্বিতীয় পর্ব

৫. এইখানে গান নিয়ে আলোচনা চলিতেছে : কুলদা রায়–

দ্বিতীয় পর্ব———————————————-

জমিদারির খোঁজে

—————-

কলিমখানের : জন্মসূত্র–জমিপুত্র–

বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষে ৩৮৯ পৃষ্ঠায় কলিম খান রবি চক্রবর্তী লিখেছেন : জমি–(জমিদার, জমী, জমীন, জমীনদান)

জমি শব্দটি এসেছে জম থেকে। জম অর্থ—গতিশীল যাহাতে।

জমি—পৃথিবী, ভূতল, মাটি, কৃষিক্ষেত্র, চাষের ভূঁই, কাপড়ের পিঠ (Surface) বা বুননি (Texture), চিত্রপটের তলদেশ (Ground)।

জমিদার—ভূস্বামী, রাজা। Land—অর্থে জমি এবং Landlord-অর্থে জমিদার শব্দটি প্রচলিত।

যতদূর বোঝা যায়, ভূতলের অংশ বা কৃষিক্ষেত্রের লেনদেন শুরু শুরু হওয়ার পরেই জমি ও জায়গা শব্দদুটির সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, দুটি শব্দের ভিতরেই 'ই' বা গতিশীলতা রয়েছে। জমি-তে ই-কার রয়েছে সরাসির, জায়গাতে ই রয়েছে 'য়'—এর ভিতরে। কিন্তু কলিম খানের  প্রশ্ন হল—জমিজায়গা গতি পায় কিভাবে?

তিনি বলছেন, জমিজায়গা হেঁটে-চলে বেড়ায় না। একবস্তা ধান কাউকে দিয়ে দেওয়ার মতো জমিজায়গা কাউকে হাতে তুলে দেওয়া যায় না, কেউ তা কাঁধে করে স্থানান্তরে নিয়ে যেতেও পারে না। অথচ একালের মানুষ মাত্রেই জানেন, জমিজায়গা দিয়ে দেওয়া যায়, দান করা যায়, বিক্রি করা যায় এবং অন্যে তা নিয়েও নিতে পারে। কী করে তা সম্ভব হয়?

কার্যত জমিদান, জমিক্রয় ইত্যাদি ব্যাপার মানবসভ্যতার একটা অদ্ভুত আবিষ্কার। বিষয়টিকে বুঝবার জন্য কলিম খান বলেন,  সর্বাগ্রে জানা চাই, ভূতলের কি কোনো অধিকারী বা মালিক হয়? হ্যা, হয়। ভূতল যাদের অস্তিত্বের ভিত্তি, তেমন সমস্ত জড় ও জীবই ভূতলের প্রতিটি বিন্দুর অধিকারী। জড় থেকে জীবের আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্রমান্বয়ে উচ্চতর উত্তরণের সমস্ত ধাপে পেরিয়ে এই ভূতল মানুষের সৃষ্টি করেছে। সেই কারণে এই পার্থিব জগৎ হল অস্তিত্বের মাতা, মানুষ হল তার শ্রেষ্ঠ সন্তান; তার সর্বাধিক আত্মনিয়ন্ত্রণক্ষম বুদ্ধিমান ছেলে; অন্যেরা তুলনায় কম আত্মনিয়ন্ত্রণক্ষম। যে নিজেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সে অন্যের সাহায্যে সাহায্য স্বভাবতই করতে পারে না। মানুষই একমাত্র পারে এই বিশ্বের সকল জীব ও জড়কে রক্ষা করে সবাইকে নিয়ে চলতে। ফলত, ভূতলকে কিভাবে ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে তার সিন্ধান্ত নেওয়ার অধিকার জন্মে যায়। ফলত, বিশ্বের সমস্ত মানুষ সমগ্র ভূতলের প্রতিটি বিন্দুর মালিক হয়ে যায়। আর, এই মালিকানার ধারণা চলে আদিম যুগ থেকে মহেঞ্জোদাড়োর যুগ পর্যন্ত। এই সময় পর্যন্ত ভূতল হাঁটা-চলা করতে পারেনি, গতিশীল হয়নি।

কিন্তু সুবিধাবাদিতার পাল্লায় পড়ে সেই মানুষ একদিন আত্মকলহে জড়িয়ে পড়ে। পরমাপ্রকৃতি তাকে সাধারণভাবে 'শিবতার' এবং প্রয়োজনে 'দক্ষতার' ব্যবহার করবার যোগ্যতা দিয়েছিল। নিজের নাবালকত্বের কারণে সে অপ্রয়োজনেও দক্ষতার ব্যবহার শুরু করে দেয়। এর অনিবার্য ফলস্বরূপ মানবসমাজে মৌলবিবাদের জন্ম হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় সম্প্রদায় ও সম্প্রদায় পরিচালক মহর্ষিদের বা জ্ঞানীমানুষদের। সেই সম্প্রদায় সৃষ্টির কালে আদি জ্ঞানীগণকে বা কশ্যপকে পৃথিবী দান করে দেওয়ার ঘটনাটি ঘটে যায়; আদিম যৌথসমাজের প্রতিটি মানুষ তাদের তিনটি অধিকার জ্ঞানীগণকে দান করে দেয়; যার তৃতীয়টি ছিল ভূতলের উপর প্রত্যেক মানূষের নিজ নিজ অধিকার। ভূতলের অংশ বা জমির হাঁটা-চলার সূত্রপাত হয়ে যায় সেই থেকে। এই অবস্থাতেই কেটে আরও হাজার বছর।

তারপর একদিন মহর্ষি (জ্ঞানী, ব্রাহ্মণ, মন্দির-চার্চ-মঠ-মন্দিরের অধিকারী) তাঁর অধিকারের ভূমির দেখভাল করার জন্য রাজা নিয়োগ করেন, অর্থাৎ রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। রাজা ও রাজার সাগরেদ রূপে সামন্তগণ জমির দেখভালের দায়িত্বও পেয়ে যান, কিন্তু তারা তো আর চাষ করেন না। অতএব তারা সে অধিকার দিয়ে দেন রায়তদের। এরপর এক রাজা আরেক রাজাকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসে, দেখভালের কাঁধবদল হতে থাকে; যদিও গোড়ায় থেকে যায় আদি জ্ঞানজীবী মন্দির-মঠ-চার্চ-মসজিদ এবং শেষ সীমায় থেকে যায় একই রায়ত। এর মাঝে জমির যে লেনদেন চলতে থাকে, তা কেবলমাত্র দেখভালের-চাষাবাদের অধিকারের লেনদেন।

মুগলদের জমিদারি বেত্তান্ত—

মুগল আমলে জমিদার বলতে প্রকৃত চাষির ঊর্ধ্বে সকল খাজনা গ্রাহককে বোঝানো হতো। প্রকৃত চাষি জমিদার নয়, কারণ সে কখনও তার জমি খাজনা বা ভাড়ায় অন্য কাউকে প্রদান করে না। জমিদাররা শুধু খাজনা আদায়ের স্বত্বাধিকারী, জমির স্বত্বাধিকারী নয়। পক্ষান্তরে, জমির মালিকদের বলা হতো রায়ত বা চাষি যাদের নামে জমাবন্দি বা রেন্ট-রোল তৈরি হতো। এই ধারণায় জমিদারগণ রাজস্বের চাষি ছিল মাত্র। এরা ছিল সরকার এবং হুজুরি(স্বতন্ত্র) তালুকদার ব্যতীত নিম্নস্তরের রাজস্ব চাষিদের মধ্যস্থ পক্ষ। হুজুরি তালুকদারগণ খালসায় (খাজাঞ্চি খানায়) সরাসরি রাজস্ব প্রদান করত।

জমিদার এই পদবি বা শব্দটি ভূঁইয়া বা ভূপতি নামে যে দেশীয় পারিভাষিক শব্দটি প্রচলিত আছে তার সরাসরি প্রতিশব্দ বলা যায়। এই ভূঁইয়া বা ভূপতিরা ছিল ভারতের প্রাক্‌-মুগল আমলের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারসূত্রে জমির মালিক। মুগলগণ তৎকালে প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থাকে তাদের আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের জন্য একটি নতুন ব্যবস্থায় রূপান্তর করে। অবশ্য চিরাচরিত ক্ষমতা ও উৎপাদনের উপায়গুলি তেমন বিশেষ পরিবর্তিত হয় নি।

টোডর মল্লর বন্দোবস্ত (১৫৮২) যা দূরবর্তী বাংলা সুবায় একদিন জমিদারি পদ্ধতির সূচনা করেছিল, তা ১৬৫৮ সন পর্যন্ত বজায় থাকে। এই সময়ে বাংলার সুবাহদার শাহ সুজার (১৬৫৭) রাজস্ব বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারি ব্যবস্থায় কিছুটা বল সঞ্চার হয়। এরপর ১৭২২ সনে সুবাহদার মুর্শিদ কুলির মালজমিনি (ভূমি রাজস্ব) পদ্ধতি প্রচলিত হয়। সরকারি রাজস্ব সর্বাধিক করা ও রাজস্বের নিয়মিত পরিশোধ নিশ্চিত করার জন্য মুর্শিদ কুলি বাংলা প্রদেশকে পূর্ববর্তী চৌত্রিশটি সরকারের পরিবর্তে তেরটি চাকলায় (প্রশাসনিক বিভাগ) ভাগ করেন। আর সেসঙ্গে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জমিদারদের চাকলাদারের এখতিয়ারাধীন করেন। এই চাকলাদারগণ মনোনীত হন বৃহৎ জমিদারবর্গ থেকে আর তারা জমির মালিক হিসেবে নয় অধস্তনদের তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। তাদের কাজ ছিল দক্ষতার সঙ্গে রাজস্বের আদায় ও সংগ্রহ নিশ্চিত করা। তবে প্রধান জমিদারগণকে রাজস্বের রাজকীয় অংশের জন্য খালসা বা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কাছে জবাবদিহি করার ফলে তাদের সনাতন ক্ষমতা ও মর্যাদাগত অবস্থান আরও বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও প্রতিভাবান জমিদারগণকে বিভিন্ন সরকারি পদে নিযুক্তির যে প্রস্তাব দেওয়া হয় তার ফলে রাজদরবারে তাদের অবস্থানগত মর্যাদা বৃদ্ধি ও সেসঙ্গে তাদের নিজ স্বার্থকে আরও এগিয়ে নেবার সম্ভাবনা অনেক দূর প্রসারিত হয়। রাজস্ব ব্যবস্থাপকের ভূমিকা থেকে জমিদারে রূপান্তরিত হওয়ার এই প্রক্রিয়াটি আঠারো শতকের মাঝামাঝি নাগাদ সম্পূর্ণ হয়।

সময়ের চিত্র : ফ্রম শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের শাহজাদা দারাশুকো থেকে—

কোটচাঁদপুর সরকার যশোহরের একটি মহাল। মোট পরিমাণ ফল ৮৩২০ বিঘা। আকবর বাদশার আমলে স্থির হয়েছিল—লড়াই-হামলার সময়—মহাল কোটচাঁদপুর আগ্রাকে দেবে ২০০ ঘোড়সওয়ার আর ১০১ জন পদাতী। .ঘোড়সওয়ার বা পদাতী দিতে না পারলেও মহান কোটচাঁদপুর শাহী খাজনা-খানায় পুরো মুল্য ধরে দিত—ফৌজদারের হাদ দিয়ে। কড়ায়-ক্রান্তিতে। আশরাফিতে—মোহরে।

লেখাটিতে একজন পথিককে দেখা যাচ্ছে। তিনি পায়ে হেঁটে আসছেন কোটচাঁদপুরের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় পথিক দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার পায়ের ফাঁক দিয়ে দুটি বনমোরগ ছুটে পালাল। দূরে বনশুয়োরের ঘোত ঘোত। পথিক এক একই বলে উঠলেন, আগে এখানে একটা গাঁ ছিল। এখন নেই। মুছে গেছে। বসতি মুছে যাওয়ার পরে এখানে বোধ হয় কোনওখানে মানুষজন মানত করতে আসে। তাদের মানত করা মুরগিগুলো এখন বনমোরগ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে বনজঙ্গল বেড়ে যাওয়ায় বনশুয়োর এসে জুটেছে।

পথিক জানেন, কোটচাঁদপুরে রাত জেগে থাকত। তাঁতীরা খটখট করত। নেই। শুন্য। ভিটেমাটি। জঙ্গল। গ্রামটি মুছে গিয়েছিল—মগদের লুটপাটের কারণে। পথিকের চার ভাইপোকে মগরা ধরে নিয়েছিল। আর নিয়ে গিয়েছিল বাড়ির কিশোরী মেয়েটিকে। এদেরকে দাস হিসেবে বেঁচে দেওয়া হয়েছে সেসময়ে। সে সময়ের শাসকবর্গ মগ দস্যুদের দমনের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রজারা বাঁচল কি মরল এটা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। তাদের লক্ষ্য ছিল প্রজাদের কাছ থকে খাজনা আদায় করা।

সে সময় মুর্শিদ কুলি খাঁ বলছিলেন, বাদশার পাওনা হল-বিঘা পিছু চার মণ গম, চার মণ যব, আড়াই মণ সরষে, সাড়ে তিনমন ছোলা বা মটর আর ছমন কলাই। কিন্তু জমিতে যদি পেঁয়াজ, লেবু, শাকসবজি ফলে—তাহলে নগদ তনখায় খাজনা দিতে হবে। এছাড়াও নীল, পান, তেতুল, গাজা, চুবড়া আলু, শাকালু, লাউ, কুমড়ো ফলানের নগদে খাজনা চাই। এসব হিসেব করার জন্য কানুনগোরা গ্রামে গ্রামে যায়। গরু মোষ রক্ষায় গোসেমারি খাজনা চালু কর হয়েছিল। ফলবান গাছের উপর খাজনা, সরদবক্তি, শান্তি রাখতে দারোখানা খাজনা, সরাফি, হাসিলবাজার—সব রকম খাজনার পাশাপাশি গাঁজা, কম্বল, তেল, কাঁচা চামড়ার উপরেও কর বসেছে প্রয়োজনে।

মুগল বনাম বণিক : দ্বৈতশাসন–

১৭৫৭ সালে সিরাজউদদৌলা ইংরেজ বণিকদের হাতে পরাজিত হওয়া পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা বিহার এবং ওড়িশার দেওয়ানী লাভ করে ১৭৬৫ সালে। এই সময় থেকে আরম্ভ করে কিছুকাল একই সঙ্গে চলতে থাকে নবাব এবং কোম্পানীর দ্বৈতশাসন।

ইরানী ভাগ্যান্বেষী রেজা খানকে নবাবের নায়েমে নাজিম করে শাসন ব্যবস্থা চালানো হয়। তাকে দেশীয় আইন-কানুন ও প্রথা অনুযায়ী দেশ শাসন করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়।  এই ব্যবস্থাটি ১৭৬৭ সন অবধি ভালভাবেই কার্যকর ছিল। ঐ বছরেই ক্লাইভ এদেশ থেকে চূড়ান্তভাবে বিদায় নেন। ক্লাইভের সমর্থনে রেজা খান দক্ষতার সাথেই কোম্পানির রাজ্য শাসনে সক্ষম হন। তবে পৃষ্ঠপোষক ক্লাইভ-এর নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের পর রেজা খানকে ফোর্ট উইলিয়ামের উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদের চরম বিরোধিতা মোকাবেলা করতে হয়। ফোর্ট উইলিয়ামের এসব কর্মকর্তা রাতারাতি ধনী হবার বাসনায় রেজা খানের প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাসে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন। তারা পর্যায়ক্রমে রেজা খানের হাত থেকে প্রশাসন নিজেদের হাতে তুলে নেন। তাদের এ হস্তক্ষেপের বিষয় প্রথম স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিভিন্ন জেলায় ইউরোপীয় তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগের মাধ্যমে। রেজা খান অভিযোগ করতে থাকেন যে এই নবনিযুক্ত কর্মকর্তারা পল্লী অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছেন। অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে কোম্পানি কর্মকর্তারা দেশের পল্লী জনপদগুলিতে লুটপাট চালাচ্ছে।

এর ফলে রাজস্বের দাবি রাতারাতি বেড়ে যায়। ১৭৬৪ সালে যেখানে ভূমি রাজস্ব ছিল মাত্র ৮১ লাখ টাকা, সেখানে পরের বছর তা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৪৮ লাখে। আর সাত বছর পরে ১৭৭৩ সালে এই রাজস্ব ধার্য হয় ৩ কোটি টাকা। এই অতিরিক্ত রাজস্বের দাবিতে বাংলার কৃষি ব্যবস্থা য় রীতিমত বিপর্যয় ঘটে। এ সময় একটি অসাধারণ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। দুর্ভিক্ষটির নাম ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। এই ছিয়াত্তর বাংলা সন ১১৭৬, ইংএরজি হিসেবে ১৭৭০ সালের প্রথম দিকে। এই দুর্ভিক্ষে চাষীদের অর্ধেকই মারা গিয়েছিল। আর মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগই প্রাণ হারান। অতিরিক্ত রাজস্বের দাবিতে জমিদাররা অত্যাচার শুরু করেন। তাতে অতিষ্ট হয়ে অধিকাংশ চাষী অন্যত্র পালিয়ে যান। বাংলার দুই-তৃতীয়াংশ ফসলি জমি লোকের অভাবে ঝোপ-জঙ্গলময় হয়ে ওঠে।

১৭৮১ সালের একটি পার্লামেন্টারি কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, একমাত্র রংপুরের উর্বর জমি ছেড়ে ৩০ হাজার পরিবার কোচবিচার চলে গিয়েছিল। এভাবে চাষীরা অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ায় এবং মারা যাওয়ায় জমিও হয়ে পড়েছিল অনাবাদি। ফলে রাজস্ব আদায়ে একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল।

কোম্পানির পরিচালক সভার নির্দেশের (২৮ই আগস্ট, ১৭৭১) আওতায় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল দেওয়ানি প্রশাসনের ক্ষেত্রে নিজেকেই সুবা বাংলার জন্য সর্বোচ্চ সরকার ঘোষণা করে। নায়েব দেওয়ান রেজা খানকে পদচ্যুত করে দুর্নীতি ও অনিয়মের দায়ে কারারুদ্ধ করা হয়।

তৃতীয় পর্ব————————————

বাকী রাখা খাজনা

মোটে ভাল কাজ না।

( –হীরক রাজার দেশ/ সত্যজিৎ রায়)

খাজনা আদারের কাছারি:

মুগল বাদশা জমির মালিক। তার কাছ থেকে কৃষক বা রায়তরা জমির সাময়িক মালিকানা নিয়ে চাষবাস করত। এর মধ্যে এই প্রজা বা রায়তদের কাছ থেকে জমির খাজনা আদায়ের জন্য মুগল বাদশা মধ্যবর্তী লোক হিসাবে জমিদার নিয়োগ দিতেন। জমিদার জমির মালিক ছিলেন না। খাজনা আদায়কারী মাত্র।  জমিদাররা খাজনা আদায়ের কাজটি ভালমতো করতে পারলে বাদশার তরফ থেকে খিলাত বা উপাধী জুটত। এই খিলাত দিয়ে ক্ষুদে জমিদারী থেকে বড়ো জমিদারি পেতে সুবিধা হত। চোর থেকে ডাকাত হতে কাজে লাগত। তবে কিভাবে—কোন প্রক্রিয়ায় সেই খাজনা আদায় করা হত—সেটা নির্মম কী ভয়ঙ্কর ছিল, তা বিবেচনা করার কোনো দরকার ছিল না বাদশার। এই তনখা পাওয়াটাই ছিল শাহীর জন্য আল্লার নেয়ামত।

তাহলে খাজনা—দেখি তোমার সাজনা:

জমিদাররা তিন ধরনের খাজনা আদায় করে বাদশার খালসা বা কোষাগারে জমা দিত।

এক. খাজনা মানে মাল :

আবাদি ফসলী জমি ও অফসলী জমি যেমন, ফলজ-বনজ গাছপালা, বনজঙ্গল, জলাভূমি ও পুকুর থেকে যে খাজনা আদায় করা হত, তার নাম ছিল মাল। (এখান থেকেই টাকা পয়সাকে মাল বলা হয়। বলা হয়—মাল-কড়ি কেমন কামাচ্ছেন ভাই?)

দুই. সেইর খাজনা :

নদীপথে যেসব নৌযান চলাচল করত, যেসব  হাঁট-বাজার বসত গ্রামে গঞ্জে তাদের কাছ থেকে সেইর খাজনাটি আদায় করা হত। এছাড়া যারা বিভিন্ন ধরনের কাজকারবার করত—সেইসব পেশাজীবী বা কর্মজীবীদের কাছ থেকে আদায় করা হত বেশ মোটা অঙ্কের খাজনা। এটার নামও ছিল সেইর খাজনা।

তিন. বাজে জমা খাজনা :

বিভিন্ন ধরনের জরিমানা, প্রতারণা ও বিয়েশাদি থেকে এই ধরনের জরিমানা আদায় করা হত।

খাজনা কি করে ধার্য হত:

এই খাজনা আদায়ের জন্য জমিজিরেতের  সঠিক জরিপ ছিল না। একটি সংক্ষিপ্ত হিসাব থেকে খাজনা ধার্য করা হত। একে বলা হত আসনাসাক। জমিদারের কাজ ছিল  বাদশাহী থেকে  ধার্যকৃতএই খাজনা আদায় করে দেওয়া।

ধার্যকৃত খাজনার টাকা বিভাজন করে জমিদাররা  প্রজাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতেন। তবে মুগল আমলে জমিদাররা প্রজারাদের বেশি খেপিয়ে তুলত না। বেশী ঝামেলা সৃষ্টি হলেই বাদশা জমিদার পাল্টে দিতেন। ফলে জমিদারী টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই প্রজাদের অনুগত রাখার দরকার হত।  জমিদাররা প্রজাদের খুশি রাখতে তাদের কিছু দাবীদাওয়া মেনে নিতেন। তাদের দেখভালের কিছু কাজ করতেন।

সকলপ্রকার জমিদারদের পুলিশ, বিচার ও সৈন্যসামন্তর দায়দায়িত্বও বহন করতে হত। জমিদারদের খাজনা আদায়ের জন্য পাইক বরকন্দাজ থাকত। এরা খাজনা আদায়ের কাজে সহযোগিতা করত। আবার স্থানীয় চুরি ডাকাতি দস্যুদের উৎপাত থামানোর কাজ করত। বড় জমিদারদের আওতায় থানা ছিল। সেখানে নিয়মিত পুলিশ থাকত। থানা অধিনে একাধিক চৌকি বা পাহারাস্থল ছিল। এদের কর্মীদের নাম ছিল চৌকিদার। থানার প্রধান ছিল ফৌজদার। ফৌজদাররা বাদশার লোক হলেও তারা জমিদারদের অধিনেই কাজ করত। এসবই ছিল খাজনা আদায়ের নানাবাহিনী।

মুগলদের নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিল না। যুদ্ধের জন্য, বিদ্রোহদমনের সময়, বা পররাজ্য দখলের কাজে বাদশাহীতে সৈন্যসামন্ত, ঘোড়া-হাতি এগুলোর যোগান দিতে হত জমিদারদের। এই উপলক্ষ‍্যে প্রজাদের ঘাড়ে বাড়তি কিছু খাজনা চাপিয়ে দেওয়া হত।

জমিদাররা ছোটোখাটো বিচারআচারও করতেন। তাদের ছিল জমিদারী আদালত। এই আদালতে যেসব বিচার সম্ভব হত না—তা পাঠিয়ে দেওয়া হত থানাদার বা কাজির কাছে। সাধারণত রায়ত বা প্রজাদের পক্ষে রায় যাওয়াটা ছিল দৈবদুর্ঘটনা। বাদশার স্বার্থ-জমিদারের স্বার্থরক্ষা করে যেটুকু বিচার করা সম্ভব—সেখানে তা-ই করা হত।

সে সময়ের লোকছড়ায় এই খাজনার ভয়াবহতা ধরা পড়েছে–

খোকা ঘুমোলো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে

ধান ফুরালো পান ফুরালো খাজনার উপায় কি?

আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল : পাঁচশালা বন্দোবস্ত

সে সময়ে কোম্পানী বেশ খারাপ অবস্থায় পড়ে যায়। তাদের আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এই সমস্যা মোকাবেলায় কোম্পানী তরফ থেকে ১৭৭২ সালে নিলামের মাধ্যমে জমিদারিগুলো পাঁচবছরের মেয়াদে ইজারা দেওয়া হয়। এই পাঁচসালা বন্দোবস্ত স্থির করার দায়িত্ব দেওয়া হয় গভর্নর ও কাউন্সিলের চার সদস্যের নেতৃত্বে এক সার্কিট কমিটিকে। এই কমিটির আরও দায়িত্ব ছিল ইজারাদারদের কাছ (চাষীদের) থেকে রাজস্ব আদায় করা। দেশীয় জেলা কর্মকর্তা তথা ফৌজদার, কানুনগো আর আমলাদের জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হলো ব্রিটিশ কালেক্টর বা রাজস্ব আদায়কর্তা। কানুনগোদের কাছে প্রজাদের জমিজিরতের—খাজনাপাতির হিসেবপত্র-দলিলদস্তাবেজ থাকত। তাদের বাতিল করার ফলে নতুন করে যে যে কোনো হারে খাজনা বসাতে কোনো অসুবিধে থাকল না।

ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। এরা 'জেলা কালেক্টর' হিসেবে অভিহিত হন। জেলা কালেক্টর জমিদারদের কাজনা আদায়েরকাজ তত্ত্বাবধান করত। কমিটি অব সার্কিট বন্দোবস্তের কাজ ১৭৭২ সালের মধ্যে শেষ করে।

নতুন ইজারাদার বা জমিদাররা চড়া হারে খাজনা আদায় করতে মনোযোগী হয়।  যারা চড়া দামে নিলামে এইসব ইজারা নিয়েছিলেন, তারা যে-পরিমাণ রাজস্ব আদায় করবেন বলে আশা করেছিলেন, অনেক ক্ষেত্রেই তা করতে পারেননি। ইজারাদাররা কোম্পানীকে নির্দিষ্ট অঙ্কের খাজনা আদায় করে দিতে পারেনি। তাদের জমিদারি নিলামে দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত স্থাবর অস্থাবর সকল সহায় সম্পত্তিও কেড়ে নেয়। এরপরও এই পুরনো জমিদারদের কয়েদখানায় ঢোকানো হয়। নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়।

পুরনো জমিদারদের কাছ থেকে নিলামে জমি কিনে নতুন জমিদার হয়ে বসে নবাবের চাকুরেরা, ব্যবসায়ীরা, সুদখোর মহাজনেরা– জমিদারদের দুর্নীতিবাজ নায়েব ধরনের আমলারা। ফলে তারা খাজনা আদায়ের বেলায় পুরনো জমিদারদের রেকর্ড ভেঙে ফেলে। প্রজাদের দুর্দশা আরও বেড়ে যায়। লোকজন জায়গা জমি পালাতে থাকে। সে সময়ে লোকসংখ্যার তুলনায় অনাবাদি জমির পরিমাণ বেড়ে বেড়ে যায়। বকেয়া খাজনার পরিমাণ বেড়ে যায়। আর তারাও কোম্পানীকে লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রাজস্ব দিতে না পারলে তাদের ভাগ্যেও পুরনো জমিদারদের মতো সব হারিয়ে কয়েদখানায় যেতে হত।

এই সমস্যা নিরসনকল্প কোম্পানী দশশালা বন্দোবস্ত করে।

দশশালা বন্দোবস্ত

জমি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারভিত্তিক জমিদারদের একটা সামাজিক স্বার্থ জড়িত ছিল যা অস্থায়ী ইজারাদারদের বেলায় ছিল না। তাই ধরে নেওয়া হয় যে, জমিদারদের তাদের পুরানো মর্যাদা ফিরিয়ে দিলে ও তালুকের সম্পদ অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য করা হলে একদিকে যেমন রাজস্ব আদায় সহজতর হবে অপরদিকে তা কৃষককুলকেও ইজারাদারের অত্যাচার থেকে রেহাই দেবে। কিন্তু পাঁচসালা বন্দোবস্তের শর্তাবলীর কারণে এক্ষেত্রে সরকারের হাত বাঁধা ছিল। ১৭৮৯-১৭৯০ সালে লর্ড কর্নওয়ালিন জমিদারদের সঙ্গে দশশালা বন্দোবস্ত করেন। এর ফলে জমিদার ও তালুকদাররাই  জমির প্রকৃত মালিক বলে বিবেচিত হন। তারা সরকারের কোনো অনুমতি ছাড়াই তাঁদের জমি দান বা বিক্রি করতে সক্ষম বা বন্ধক দিতে পারবেন। এমন কি উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টন করতে পারবেন। আর কোম্পানীকে ধার্যকৃত রাজস্ব দিতে না পারলে তাদের জমিদাইর নিলামে দেওয়া হত। কিন্তু পাঁচশালা বন্দোবস্তের মত তাদেরকে কয়েদ করা হত না।

রাজস্ব শাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে গোটা দেশকে অনেকগুলি জেলায় বিভক্ত করা হয়। জেলা কালেক্টরকে জেলার সর্বেসর্বা প্রশাসকে পরিণত করা হয়। কালেক্টরকে সকল নির্বাহী ও বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা প্রদান করা হয়। কেন্দ্রায়ন ও হস্তক্ষেপের প্রতীক রাজস্ব কমিটিকে বিলুপ্ত করে স্থাপন করা হয় রাজস্ব বোর্ড, যার দায়িত্ব হলো রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়াবলির সাধারণ বা সার্বিক নিয়ন্ত্রণ। জমিদারগণকে তাদের জমির ন্যায্য রাজস্ব নির্ধারণের জন্য এই কালেক্টরের মুখাপেক্ষী হতে হয়। রাজস্ব বোর্ডও রাষ্ট্রের রাজস্বের জন্য কালেক্টরের ওপর নির্ভরশীল হয়। ১৭৮৬ সনের সংস্কার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রকৃত প্রশাসনিক বুনিয়াদ রচনা করে। সরকার তখন থেকে আগেকার যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস ও দৃঢতার সঙ্গে জমিদারদের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য প্রস্তুত হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

দশশালা বন্দোবস্তের সাফল্যের কারণে ১৭৯৩ সালে একে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানীকে ধার্যকৃত রাজস্ব প্রদানের পরেও বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ জমিদারদের হাতে রয়ে যেত। তারা প্রজাদের দফায় দফায় খাজনা বাড়িয়ে দিত। তারা পরিত্যাক্ত সম্পত্তি, অনাবাদি জমি নতুন করে বন্দোবস্ত দিত প্রজাদের কাছে। নতুন খাজনা ধার্য করত। এভাবে তাদের আদায়কৃত অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। এটা কোম্পানী এবং জমিদারদের জন্য একটি সুবিধাজনক বন্দোবস্তে পরিণত হয়। আর প্রজারা নতুন শোষণের জাতাকলে পড়ে।

কেন এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

এ সময় কোম্পানীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাদের দরকার ছিল বিপুল অর্থ। তারা চেয়েছিল ভারতে তাদের ব্যবসাবানিজ্য বিনা মুলধনেই করবে। তারা প্রজাদের কাছ থেকে অর্থ লুটপাট করে সেই অর্থ দিয়েই ভারতে ব্যবসাবানিজ্য চালাবে। সোজা কথায় বিনা পূঁজিতে মুনাফা কামানোর ধান্ধা। কিন্তু  তাদের নিয়োগকৃত নাইবে নাজিম রেজাখানের দু:শাসন, দুর্ভিক্ষ, কোম্পানী লোকজনের উশঙ্খল আচরণ কোম্পানীর শেয়ার হোল্ডারদের কিছুটা হতাশ করেছিল। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বিপুল অর্থ কামাইয়ের ইচ্ছে ছিল তাদের। দুর্ভিক্ষের কারণে বাংলায় তখন এত জনসংখ্যা ছিল না। এই অল্প মানুষকে সহজে সুলভে শোষণ করে খাজনা আদায়ে জন্যই কোম্পানী জমিদারী প্রথায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছিল।

ইংরেজরা কুটির শিল্প, হস্ত শিল্পকে শেষ করে দিয়েছিল। তখন কেবল আয় বলতে জমির খাজনাই ছিল প্রধান। জমিদার পাল্টাতো কিন্তু শোষিত প্রজারা পাল্টাতো না। বাবার বকেয়া খাজনা ছেলের কাঁধে বর্তাতো। ছেলের বকেয়া তার ছেলের কাধেঁ পড়ত। এভাবে বংশপরম্পরায় বকেয়া খাজনা প্রদানের দায় বহন করে যেত।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মানে চিরস্থায়ী প্রজাশোষণ–

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়ার ফলে প্রজাদের অবস্থা আরও কাহিল হয়ে গেল। যো লোকটি জমি চাষ করছে, এতকাল জেনে এসেছে জমিটি তার—তার ইচ্ছেমত ফসল চাষ করছে, ছেলেপেলেদের জমি হস্তান্তর করতে পারছে, প্রয়োজনে বিক্রি করতে পারছে, জমি বন্দক দিয়ে ঋণ নিতে পারছে—এসবই এক খোঁচায় বন্ধ হয়ে গেল চিরস্থাযী বন্দোবস্তের কারণে। সবকিছু্রই মালিক হয়ে গেল জমিদার। জমিদার খাজনা আদায় ছাড়া আর কোনো বিনিয়োগই করছে না ফসলী জমিতে—না শ্রম, না পূঁজি—বিনা মূলধনেই কৃষককের ফসলের সিংহভাগই তারা নিয়ে যাচ্ছে। চাষী কোনো গাছপালা লাগাতে পারে না। কোনো  গাছপালা কাটারও ক্ষমতা তার নেই। যেখানে সে থাকে, সেখানে যেনতেন প্রকারে ঘর বেঁধে থাকবে—কোনো পাকা ঘর তুলতে চাষীরা পারবে না। জমাজুতোও পরতে পারবে না। মেয়ের বিয়েতে খাজনা দিতে হবে। বাপমা মারা গেলে তার শ্রাদ্ধশান্তিতে খাজনা ছাড়া করা যাবে না। চাষীর ছেলে হলেও জমিদারকে খাজনা দাও। এমনকি কোনো ঊৎসব-পার্বনও খাজনা ছাড়া প্রজারা করতে পারবে না।  রায়ত বা প্রজারা এক ধরনের শেকলেবন্দী শ্রমিক জীবনের অধিকারী হল পাঁচশালা বন্দোবস্তের মাধ্যমে।

এই শেকল আরও শক্ত হয়ে যেত মহাজনদের ফাঁদে পড়লে। সাধারণত দেশে তখন বন্যা-খরা-দুর্ভিক্ষ-মহামারী লেগেই থাকত। আর এই মেয়ের বিয়ে, বাপের শ্রাদ্ধ আর ছেলের জন্মের কারণে খাজনা দেওয়ার উপায় থাকত না। ফলে চাষীরা মহাজনদের কাছ থেকে চক্রবৃদ্ধি হার সুদে ঋণ নিতে হত। এই ঋণ কখনো ফেরত দেওয়া কখনো ফুরাতো না। বাপের ঋণ শুধতে হত ছেলেকে। ছেলের ঋণ নাতিকে। এইভাবে মহাজানের ঋণের শেকড় বংশপরম্পরায় বহন করতে হত। আবার চাষী যদি অক্ষরজ্ঞানহীন মুর্খ কিসিমের হত, তাহলে কায়দা করে একই ঋণের টাকা পয়সা দুই-তিনবারও আদায় করা হত।

এই মহাজনদের বড় বড় ব্যবসাপাতিও ছিল। তারা ফসল ওঠার সময়ে জমি থেকেই তাদের ঋণের টাকা আদায় করত। সেই সময়ে ফসলের বাজার মূল্য কম থাকত। ফলে মহাজনরা কম টাকায় বেশি ফসল পেয়ে যেত। চাষীরা আরও বেশি ঠকত। কখনো এই সুদের কারবারীরা হত বড় কৃষক। তাদের বলা হত জোতদার। তারা সব সময়ই হা করে থাকত ক্ষুদে কৃষকের জমিজিরতের গিলে খাওয়ার জন্য।

জমিদাররা খালসা বা রাজ কোষাগারে আদায়কৃত খাজনার ধার্যকৃত অংশ জমা দেওয়ার পরেও তাদের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ থেকে যেত। এই অর্থ সম্পদ দিয়ে তারা  এক ধরনের আয়েসী জীবন যাপন শুরু করে। তারা তাদের জমিদারিকে ছোটো ছোটো অংশ ভাগ করে  পত্তনিদার বা তালুকদারদের কাছে ইজারা দিতেন। এই পত্তনীদাররা বা তালুকদাররা আসলে জমিদারের আমলা। জমিদাররা তাদের উপর জমিদারির ভার দিয়ে কোলকাতায় বসবাস করত। তালুকদাররা তখন প্রজাদের লুটে পুটে খেত। আদায় করত ইচ্ছেমত খাজনা। দখল করত সহায় সম্পত্তি। প্রজারা এর প্রতিকার কারও কাছে পেত না। আসল জমিদারের কাছে প্রজারা পৌঁছুতেই পারত না। আর যদি কেউ আদালতে যেত—তাহলে সেখানে উকিল নামের কুমীরের খপ্পরে পড়ত। এই জমিদারীকাল ছিল প্রজাদের জন্য দোজখ।

চতুর্থ পর্ব——————————————–
প্যাগোডা ট্রি ওরফে টাকার গাছের কাহিনী

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে ইংলণ্ড থেকে যে সব ইংরেজরা ভারতে আসত তাদের অধিকাংশই ছিল দরিদ্র, ছিচকে, গুণ্ডা, মারকুটে ছিন্নমূল, আশিক্ষিত, অভদ্র। এদের অনেকের বাপদাদার ঠিক ঠিকানা ছিল না। এরা কলকাতায় এলে কিছুদিন ঘুরে বেড়াত ফ্যা ফ্যা করে। তারপর জুটে যেত কোম্পানীর চাকরী। বেতন বার্ষিক  মাত্র পাঁচ পাউন্ড। সবশেষে বার্ষিক চল্লিশ পাউন্ড।  এই বেতনে মেসের ভাড়াই হত না। এরা কোনোক্রমে সই করতে জানত, অথবা সামান্য লেখাপড়া—কিছু সহজ সরল অংক জানত। এরা লক্ষ লক্ষ পাউন্ডের মালিক হয়েছে  কয়েক বছরের মধ্যেই। এই ধনলাভের কাহিনী বাংলার মানুষকে লুটপাটেরই ইতিহাস। তারা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল। কলাগাছ থেকে বটগাছ। তারপর পুরো বন।  ১৭৫৭ সালে সিরাজউদ্দৌলার পতনের পরে বাংলাকে ইংরেজ বেনিয়ারা প্যাগোডা ট্রি বা টাকার গাছে পরিণত করেছিল।

এই ইংরেজরা বাংলাকে শোষণ করে ছিবড়ে করে ফেলে হয়েছিল নবাব। নবাব মানে খুব ধনশালী ব্যক্তি। এরা ভারতে প্রভুত অর্থ সংগ্রহ করে ইংলন্ডে ফরে যায়। বিত্তশালী জীবন যাপন করে।

সিরাজউদ্দৌলার পতনের পরে মীর জাফরের কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছিল বিপুল অঙ্কের টাকা পয়সা এইসব ভাগ্যবান ইংরেজরা। লর্ড ক্লাইভ ট্রেজারি লুট করেছিলেন। তিনি সেখান থেকে নিয়েছিলেন দেড় মিলিয়ন স্টারলিং মূল্যের নগদ টাকা, সোনা, রূপা, গহনাপাতি, এবং বহু মুল্যবান জিনিসপত্রাদি। মীর জাফরকে নবাব করা হলে তিনি ক্লাইভকে যা খুশি সম্পদ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। ক্লাইভ নিয়েছিলেন এক লক্ষ ষাট হাজার পাউন্ড। তিনি অর্ধ মিলিয়ন বিলিয়েছিলেন তার অধীনস্ত সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর মধ্যে। এরা কোম্পানীর বাহিনী।  আর যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানীর লোকদের প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছিল ২৪০০০ পাউন্ড।

মীর জাফর কর্তৃক পুরস্কারপ্রাপ্ত ভাগ্যবানদের তালিকা—

গভর্নর ড্রেক—৩১,৫০০ পাউন্ড, লর্ড ক্লাইভ—২,১১, ৫০০ পাউন্ড, মিঃ ওয়াটসন—১,১৭,০০০ পাউন্ড, কিল প্যাট্রিক—৬০,৭৫০ পাউন্ড, মিঃ ম্যানিংহাম—২৭,০০০ পাউন্ড, মিঃ বিচার—২৭,০০০ পাউন্ড, মিঃ বোডম—১১,৩৬৭ পাউন্ড, মিঃ ফ্রাঙ্কল্যান্ড—১১,৩৬৭ পাউন্ড, মিঃ ম্যাকেট—১১,৩৬৭ পাউন্ড, মিঃ আ্যামিয়েট—১১,৩৬৬ পাউন্ড, মিঃ পার্কেস—১১,৩৬৬ পাউন্ড, মিঃ ওয়ালশ—৫৬,২৫০ পাউন্ড, মিঃ স্ক্রাপটন—২২,৫০০ পাউন্ড, মিঃ ল্যাসংটন—৫৬২৫ পাউন্ড, মেজর গ্রান্ট—১১২৫০ পাউন্ড।

ইংরেজের বিজয় উপলক্ষ্যে কিছু বাঙালিবাবুও পুরস্কৃত হয়েছিলেন। একে পুরস্কার না বলে ক্ষতিপূরণ নাম দেওয়া হয়েছিলেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের পিতামহ নীলমণি ঠাকুর পেয়েছিলেন মীরজাফরের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের অর্থ হিসাবে—১৩,০০০ টাকা। সেই টাকা দিয়ে কোলকাতা গ্রামের পাথুরিয়াঘাটা পাড়ার জমি কিনে ভিটে তোলেন। সেখানে পরবর্তি সময়ে একঘর পাথুরিঘাটের জমিদারদের পত্তন হয়।

মীর জাফরকে সরিয়ে মীরকাশেমকে ১৭৬০ সালে পুতুল নবাব হিসেবে কোম্পানী বাংলার গদিতে বসায়। সে উপলক্ষ্যেও বিস্তর পুরস্কার জুটেছিল এই পরদেশী লুটেরাদের। পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকা—গভর্নর ভ্যানসিটার্ট—৫৮,৩৩৩ পাউন্ড, মিঃ হলওয়েল—৩০,৯৩৭ পাউন্ড, মিঃ সুমনার—২৮০০০ পাউন্ড, জেনারেল কাইলাইড—২২ম৯২৬ পাউন্ড, মিঃ ম্যাকগুইরি—২২,৯১৬ পাউন্ড, মিঃ স্মিথ—১৫, ৩৫৪ পাউন্ড, মিঃ ইয়র্ক—১৫, ৩৫৪ পাউন্ড।

১৯৬৪-৬৫ সালে মীরকাশেমকে সরিয়ে নরমপন্থী নিজামউদ্দৌলাকে গদিতে বসানে হলে আবারও পুরস্কার পায় মেজর মনরো—১৩০০০ পাউন্ড, তার অধীনস্ত সাহবরা পেল আরও ৩০০০ পাউন্ড করে পুরস্কার। আরও অনেকে পেয়েছে। দাগি মুদ্রারাক্ষস লর্ড ক্লাইভ পেয়েছিলেন—৫৮,৬৬৬ পাউন্ড।

মুর্শিদাবাদের নবাবদের কাছ থেকে এই পুরস্কার আদায়ের টাকাটা আসমান থেকে আসেনি। এই টাকাটা বাংলার  প্রজাদেরই টাকা। অভাবী ভুখা নাঙ্গা প্রজাদের কাছ থেকেই আদায় করা হয়েছিল।  তাদের রক্ত শোষণ করে অর্জন করেছিল জমিদার, তালুকদার, গাত্তিদাররা। তারা জমা দিয়েছিলেন রাজকোষে। সেখান থেকে ইংরেজরা নিয়েছে।

Prosperous Britis India নামে একটি বই লিখেছিলেন মিঃ ডিগবি। তিনি লিখেছেন—পলাশী এবং ওয়ার্টারলুর যুদ্ধের মধ্যবর্তি সময়ে ভারত থেকে ইংলন্ডে অন্তত ১০ কেটি পাউন্ড নগদ অর্থ চলে গিয়েছিল।  The Law of Civilization and Decay নামে আরেকটি বই লিখেছেন ব্রুকস এডামস। তিনি বলেছেন— শিল্পবিপ্লব কার্যত শুরু হয় ১৭৬০ সালে ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও সোনা-রূপা  ইংলন্ডে পৌঁছানোর পরে।

আর সে সময়ে বাংলায় দুর্ভিক্ষে মানুষ গরু-জরু বেঁচে দিচ্ছে। গাছের পাতা-ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। না খেতে পেয়ে তিনভাগের এক ভাগ মানুষ মারা যাচ্ছে। তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ খাজনা দেওয়ার ভয়ে পালিয়ে বনে জঙ্গলে পালিয়ে বাঘের পেটে যাচ্ছে। বাকীদের পিঠের চামড়া তুলে খাজনা আদায় করে এইসব ইংরেজ লুটেরাদের পকেটে ভরে দেওয়া হচ্ছে।

১৭৮২ সালে ইংলন্ডে পৌঁছে মেজর জন স্কট ওয়ারেন হেস্টংইসকে একটি চিঠিতে লিখছেন—আমাদের ব্যবসার হয়তো মন্দা দেখা দিয়েছে, কিন্তু আজকের মতো এমন বিপুল বৈভব বোধহয় এই রাজ্যে কখনো ছিল না। আমি ২০০ সোনার মোহর গলাতে দিয়েছিলাম একজনকে, তিনি জানালেন গত বারো বছর তিনি অন্তত দেড় টন সোনার মোহর এবং প্যাগোডা গলিয়ে 'বার' তেরি করে দিয়েছেন। তার মানে প্রতি বছর গড়ে ইংলন্ডে  মজুত হয়েছে ১৫০ হাজার পাউন্ড।

কেউ কেউ আবার সে সময় বাংলা থেকে ইংলন্ডে হীরেও নিয়ে যেত। হীরের আমদানি এত বেড়ে গিয়েছিল যে তখন ইউরোপের বাজারে হীরার দাম পড়ে গিয়েছিল। ওয়ারেন হেস্টিংসপত্নী কোনো পার্টিতে তিরিশ হাজার পাউন্ডের গহনা পরে যেতেন। এই টাকা বাংলার মানুষের টাকা।

১৭৬৯ সালে বাংলাকে কয়েকটি জেলায় ভাগ করা হয়। প্রত্যেক জেলায় একজন করে সুপারভাইজার নিয়োগ করা হয়। এই পদটিই ১৭৭২ সালে কালেক্টারে রূপান্তরিত করা হয়। এই জেলার কালেক্টারদের প্রধান কাজই ছিল দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়া। কেউ কেউ এরা সুদের ব্যবসা করতেন। কেই কেউ দুনম্বরী ব্যবসাবানিজ্য। জন বাথো নামে বর্ধমানের এক কালেক্টার দেশী একজন জমিদারকে লবণের ব্যবসা পাইয়ে দেন বার্ষিক আটাশ হাজার পাউন্ড ঘুষের বিনিময়ে। শ্রীহট্টের কালেক্টার কোম্পানীর কাছে হাতির ব্যবসা করে অনেক টাকা রোজগার করেছেন।

ক্লাইভ আঠার বছর বয়সে ভারতে এসেছিলেন। তিনি চাকরী পেয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে একজন রাইটার বা কেরানী হিসেবে। পরে প্রতিভাবলে  কোম্পানীর উচ্চপদে চলে যান। হয়েছিলেন গভর্নর জেনারেল। সিরাজউদ্দৌলাকে হারানোর পরে ১৭৬০ সালে ক্লাইভ যখন ইংলন্ডে ফিরে যান তখন সঙ্গে নিয়েছিলেন তিন লক্ষ পাউন্ড। ভারত থেকে তার জমি সম্পত্তির আয় থেকে বার্ষিক আয় ছিল ২৭০০০ পাউন্ড। সে সময়ে তার বার্ষিক আয় ছিল ৪০০০০ পাউন্ড।

এই ইংরেজরা তখন হয়েছিলেন নবাব। এইরকম একজন নবাবের নাম হল—মিঃ হিকি। উইলিয়াম ম্যাকিনটস হিকির দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে লিখেছেন– সকাল সাতটা নাগাদ দারোয়ান নবাববাহাদুরের গেট খুলে দিল। নিমেষে বারান্দাটি সলিসিটার, রাইটার, সরকার, পিওন, হরকরা, চোপদার, হুক-বরদার ইত্যাদিতে ভরে গেল। বেলা আটটায় হেড বেয়ারা এবং জমাদার প্রভুর শোয়ার ঘরে প্রবেশ করবে। একটি মহিলাকে তখন শয্যাত্যাগ করে একান্তে প্রাইভেট সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে দেখা যাবে,–অথবা বাড়ির অঙ্গন পরিত্যাগ। নবাব বাহাদুর খাট থেকে মাটিতে পা রাখামাত্র অপেক্ষমান ভৃত্যবহর তৎক্ষণাৎ ঘরে ঢুকে পড়বে। তারা আনত মাথায় পিঠ বাঁকিয়ে প্রত্যেকে তিনবার তাঁকে সেলাম জানাবে। ওদের হাতের একদিক তখন কপাল স্পর্শ করবে, উল্টো দিকটা থাকবে মেঝেতে। তিনি মাথা নেড়ে  অথবা দৃষ্টিদানে তাদের উপস্থিতিকে স্বীকৃতি জানাবেন।

পারসিভাল স্পিয়ার একটি বই লিখেছেন—The Nababs নামে। বইটিতে কয়েকজন মৃত  লুটেরা নবাব সাহেবের রেখে যাওয়া অস্থাবর সম্পত্তির বিববরণ আছে।  তার মধ্যে নিকোলাসের ঘরে পাওয়া যায় রাশি রাশি দামি আসবাব। বেশ কিছু ঘড়ি, আয়না, লণ্ঠন, রকমারি পালকি, বিপুল সংখ্যক বাসনপত্র, চা, কফি, পান, তামাকের বিবিধ সরঞ্জাম, বিভিন্ন মদের বোতল এবং আরও অনেক কিছু। তার মালসামানের জন্য ছিল পাঁচটি গুদাম। বারওয়েল নামের একজন নবাবের খাওয়ার সময় উপস্থিত থাকত প্রাতঃরাসের সময় তিরিশজন, মধ্যাহ্ণভোজের সময় পঞ্চাশজন এবং রাত্রির খাওয়ার সময়ে অগণিত। খেয়ে দেয়ে মধ্যরাত্র অবধি নাচের আসর হত। ভোর পর্যন্ত মদ্যপান।

হিকি নামে একজন নবাব ১৭৯৬ সালে গভর্নরের বাড়ির পাশেই পার্কের গা ঘেষে নদী পড়ে একটি প্রাসাদতুল্য বাংলো তৈরি করেছিলেন মাত্র ছয়মাসের মধ্যে। তার আর্কিটেক্ট আর মিস্ত্রিরা ছিল পশ্চিমি। কলকাতার চূঁচুড়ার এই বাংলোটি তিনি উপহার দিয়েছিলেন তার রক্ষিতা এক জমাদারনিকে। তার খরচ পড়েছিল চল্লিশ হাজার টাকা। হিকির বউ শার্লট যখন মারা গেল তখন হিকির জন্য কাজ করত তেষট্টিজন ভৃত্য।

এরকম রাশি রাশি নবাব তখন কোলকাতায় ছিলেন। তারা বাংলাকে লুটপাট করেছেন। এদের লুটপাটের অর্থের অন্যতম যোগানদাতা ছিলেন স্থানীয় বাবুশ্রেণী, জমিদার।

এই নবাবদের ইংলন্ডের সমাজে ভাল চোখে দেখ হত না।  তাদের মন্তব্য হল– এরা সবাই হয় দারোয়ান-তনয় অথবা দাসীপুত্র। হৃদয়হীন এই পাষণ্ডের দল প্রত্যেকই হাজার হাজার নেটিভের হত্যাকারী। হিন্দুস্থানে তাঁদের কেউ একশো নিরীহ মানুষ খুন করে এসেছেন—কেউ বা পঞ্চাশ হাজার। এদের দিকে তাকানোও পাপ।

তারা বাংলা থেকে লুটপাট করা অর্থ দিয়ে ইংলণ্ডে কাটিয়েছেন বিলাসবহুল জীবন। টাকা পয়সা দিয়ে ১৭৬০ থেকে ১৭৮৪ সালে এরকম ৩০জন নবাব পার্লামেন্টের আসন অলঙ্কৃত করেছেন। এদের সম্পর্কে একজন লিখেছেন—লজ্জার কথা সেদিন জনৈক নবাব এক ভদ্রসম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন। তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন একজন রূপোজীবিনীকে। অন্য একজন লিখেছেন—সাবধান, কোনও ভদ্রমহিলা যেন ভুলেও কখনও কোনও নবাবের সঙ্গে না নাচেন। তাদের নবাব তখন দাস-ব্যবসায়ী. ওয়েস্ট ইন্ডিজের খামার মালিকের চেয়েও ঘৃণ্য এক অসামাজিক জীব। তারা ভালো বাড়ি কেনে, ভালো খায়, যত খায় তার চেয়ে বেশি অপচয় করে, ছড়ায়। তারা ডুয়েল লড়ে, জুয়া খেলে,–মাত্রাহীন বিলাসে গা এলিয়ে দিয়ে ভদ্রসমাজকে ব্যঙ্গ করে। *

লেখাসূত্র : ১. রবি ঠাকুর, রাহাজানি এবং রবীন্দ্র পূজারীবৃন্দ: ফরিদ আহমদ ও অভিজিৎ রায় : http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=18247

গ্রন্থসূত্র :

১. ঐতিহাসিক অনৈতিহাসিক : শ্রীপান্থ

২. হাজার বছরের বাঙ্গালী : গোলাম মুরশিদ

৩. ভারত-সন্ধানে : জহরলাল নেহেরু

৪. The Nabobs : Percival Spear

৫. The Annals of Rural Bengal : W W Hunter

পঞ্চম পর্ব———————————————————

একটু ইংরেজদের গেড়ে বসার আদিকাণ্ড–

সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে মুগল সম্রাটের কাছ থেকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী বানিজ্যের উদ্দেশ্যে সুরাটে একটি কুঠি স্থাপনের অনুমতি লাভ করে। কয়েক বছর পরে তারা দক্ষিণ ভারতে একখণ্ড জমি কিনে মাদ্রাজ শহর পত্তন করে। ১৬৬২ সালে ইংলন্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস পোর্তুগালের কাছ থেকে বোম্বাই দ্বীপটি বিয়ের যৌতুক হিসেবে লাভ করেন। তিনি কোম্পানীর কাছে এই দ্বীপটি হস্তান্তরিত করেন। ১৬৯০ সালে কোলকাতা শহর জোব চার্নক নামে এক ইংরেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এইভাবে সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে ভারতের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ইংরেজ তারা আস্তানা গাড়ে। সমুদ্রের উপকূলে কয়েকটি ঘাঁটি বসায়। ক্রমে ক্রমে তারা দেশের প্রত্যন্ত প্রদেশে প্রবেশ করতে আরম্ভ করে। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পরে বিস্তির্ণ ভূখণ্ড ইংরেজদের দখলে আসে। কয়েক বছরের মধ্যে তারা বাংলা, বিহার ও উড়িশ্যা দখল করে বসে। এবং সমগ্র পূর্ব-উপকূলে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে।

এর চল্লিশ বছর পর, উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে তারা একবারে দিল্লীর তোরণদ্বারে হানা দেয়। ১৮১৮ সালে মারাঠাদের পরাজিত করে। ১৮৪৯ সালে শিখ-যুদ্ধের পর ইংরেজ সারা ভারতবর্ষে কায়েম হয়ে বসে।

মধ্যবিত্তের উত্থান

ইংরেজ শাসনে জমিদারদের প্রজাশোষণে লোকজন অনাহারে অত্যাচারে মারা গিয়েছে। অনেকে সব ছেড়ে ছুড়ে অন্য জমিদারের পরগণায় আশ্রয় নিয়েছে। আর যারা বনেজঙ্গলে পালিয়েছে তারা বাঘের আর কুমিরের পেটে গিয়েছে। অনেক নতুন নতুন জমিদার পুরনো জমিদারদের কাছ থেকে জমিদারী কিনে নতুন খাজনার হার ধার্য করেছে। এর মধ্যে অনেক প্রজা কখনো কখনো রুখেও দাড়িয়েছে।  ১৮৭৩ সালে পাবনাতে নাটরের জমিদারি ভেঙে  পাঁচজন ধনী লোক জমিদার কিনে যখন খাজনা বাড়াতে চেয়েছিল তখন প্রজাদের সঙ্গে জমিদারদের বড় ধরনের রায়ট হয়েছিল।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ২০ বছরের  মধ্যে রাজস্ব দিতে না পারার জন্য তিন ভাগের এক ভাগেরও বেশি পুরনো জমিদাররা জমিদারী খুইয়েছিলেন। এসব জমিদারি এসেছে নব্য ধনীদের মধ্যে। তখন ব্যবসার চেয়ে জমিদারদের সামাজিক মর্যাদা বেশি ছিল। কিন্তু এইসব জমিদাররা নিজেরা কখনো জমিদারি পরিচালনা করেননি। তারা অন্য লোকদের দিয়ে জমিদারি পরিচালনা করেছেন। তারা হয়েছেন অনুপস্থিত জমিদার।

হেস্টিংসের আমলে গোড়ার দিকে জমিদারের সংখ্যা মাত্র শ খানেক, সেখানে ১৮৭২-৭৩ সালে এই সংখ্যা দাড়ায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ২ শোতে। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজার জমিদারের সম্পত্তি ছিল মাথা পিছু ৫০০ একরেরও কম।

জমিদার এবং মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় প্রজাদের খাজনা দিতে হয়েছে বেশি। ১৭৭২ সালে রাজস্ব আদায় হয়েছিল তিন কোটি টাকা, কিন্তু একশো বছর পরে ১৮৭২ সালে জমিদার এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা রাজস্ব আদায় করতেন ১৭-১৮ কোটি টাকা।

বৃটিশ সরকারের  উদ্দেশ্যই ছিল ভারতে জমিদার, তালুকদার, জোদ্দার, ধনী কৃষক সৃষ্টি করে একটি অনুগত শ্রেণী সৃষ্টি করা। তাদের শোষণে যদি কখনো প্রজাবিদ্রোহ হয়, তাহলে এই অনুগত বাহিনীই প্রজাদের বিদ্রোহ থেকে তাদের বাঁচাবে। তাদের ব্যবসা-বানিজ্য-শোষণ কৌশল টিকে থাকবে।  এদের পাশাপাশি বিশেষভাবে রাজভক্ত বা অনুগত প্রজাদেরও তাদের  কোম্পানীতে, ব্যবসাবানিজ্যে, জমিদারী-সেরেস্তায় কিছু দায়িত্বজনক পদ দিয়ে জমিদারি পরিচালনার কাজ পাইয়ে দেয়। এভাবে কিছু ধনীক শ্রেণীও ইংরেজরা তৈরি করল।দেশে পরজীবী একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি হল ইংরেজ আমলে।

বেহাল কৃষি ব্যবস্থা

ইংরেজদের আগমণের আগে বাংলার শুধুমাত্র অর্থনীতি কৃষিনির্ভর ছিল না। দেশে শিল্পী দক্ষ কারিগরী পেশায় লোকের সংখ্যা ছিল প্রচুর। সে সময় মানুষের বড় ধরনের শিল্প না থাকলেও ঘরে ঘরে ক্ষুদ্র শিল্প-কুটির শিল্প ছিল। সেখানে কাজ করতে করতে বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষজন সেই কাজে খুব দক্ষতা অর্জন করেছিল। তারা পরিচিত হয়েছিল—তাঁতী বা জোলা, কামার, কুমোর, সুতোর ইত্যাদি নামে। চাষীরাও সে সময় চাষের অবসরে বা ফাঁকে ফাঁকে এইসব কুটির শিল্পে কাজ পেত এবং বাড়তি আয়ের সুযোগ ঘটত তাদের। ফলে দেশে মানুষের আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল না।

এই গ্রামবাংলার ঘরে উৎপাদিত মসলিন কাপড়ের খ্যাতি তখন শুধু দেশেই নয় সারা বিশ্বজোড়া। বিদেশীরা মসলিন কিনতে ভারতে আসত। বাংলা থেকে তা কিনে উচ্চদামে ইউরোপে বিক্রি করত। তারা খুঁজে বের করত কোথায় এই মসলিন উৎপাদিত হয়। শোনা যায় কলম্বাসও এই মসলিনের খোজেই ভারত আবিষ্কারের জন্য অভিযান চালিয়েছিলেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে আসার উদ্দেশ্যই ছিল ভারতের নানাপ্রকার শিল্পজাত দ্রব্য, শাল, মসলিনজাতীয় বস্ত্র ও নানাবিধ মসলা প্রভৃতি প্রাচ্য দেশ থেকে পাশ্চাত্যে চালান করা। সে সময়ে ইউরোপে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ছিল। বাংলায় যখন কোম্পানীর শাসন জেঁকে বসেছে—লুটপাটের টাকায় ইংলণ্ডে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছে তখন ইংলন্ডের একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা দাবী করে বসে ইংলন্ডের শিল্পবাজার প্রসারের জন্য ভারত থেকে পণ্য আমদানী বন্ধ করে দিতে হবে। বৃটিশ পার্লামেন্ট সে দাবী মেনে নেয়।

তখন ভারতের বহির্বানিজ্য সম্পূর্ণভাবে কোম্পানী নিয়ন্ত্রণে থাকায় ভারত থেকে পণ্য ইউরোপের অন্য দেশেও প্রবেশাধিকারের সুযোগ হারাল। ইংলণ্ডে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী ভারতে একচেটিয়াভাবে আসা শুরু করল। একই সঙ্গে বাংলা তথা ভারতের পণ্যের উপরে কোম্পানী চড়া কর বসিয়ে দিল। ফলে ইংলণ্ডের পণ্য কম দামে বাজারে পাওয়া যেতে লাগল। এইভাবে দেশী পণ্যের বাজার পড়ে গেল। দেশী পণ্য একই সঙ্গে দেশী ও বিদেশী বাজার হারাল। ফলে দেশের শিল্প খাতটি সমূলে ধ্বংস হয়ে গেল। জহর লাল নেহেরু বলেছেন—উনিশ শতকের ভারত ইতিহাস হল ধ্বংসপর্বের ইতিহাস–পুরাতন শিল্পাদি নিশ্চিহ্ণ করার ইতিহাস। জাহাজী কারবার কাজ, বস্ত্র শিল্প, ধাতব পদার্থের কাজ, কাঁচ তৈরির কাজ, কাগজ তৈরির কাজ—আরও অনেক শিল্প মৃত্যুমুখে পতিত হল।

ভারতের শিল্পোন্নতি যাতে না হয়, যাতে শিল্পের দিক থেকে তার অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ অবনতিলাভ করে—সেদিকেই ইংরেজদের লক্ষ্য ছিল বেশি। যন্ত্রপাতি ভারতে যাতে না আসতে পারে তার জন্য নিয়ম করা হল। বাজারে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করা হল যে বৃটিশ পণ্য না হলে যেন ভারতের না চলে। ইংলন্ড দ্রুত তার শিল্পোন্নতির দিকে এগিয়ে চলল, ভারত হয়ে গেল কৃষিনির্ভর দেশ। উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে শতকরা পঞ্চান্ন লোক এদেশে কৃষিদ্বরা জীবিকানির্বাহ করত। ইংরেজদের এই শিল্পধ্বংসের প্রত্যক্ষ প্রভাবে কৃষিজীবিীর সংক্যা বেড়ে দাড়িয়েছির শতকরা চুয়াত্তর জন।   এদেশ থেকে সস্তায় কাঁচা মাল ইংরন্ডের কারখানায় চলে গেল এবং বিলেতের কারখানাজাত শিল্পসম্ভার এই দেশের বাজারই চড়া মূল্য বিক্রি হতে লাগল। ইংরেজদের প্রধান কেন্দ্র বাংলা হওয়ায় বাংলার অবস্থাই সবচেয়ে করুণ হয়ে পড়ল।

ভারত-ইতাহাসের যুগ্ম লেখক এডওয়ার্ড টমসন ও জি.টি. গ্যারেট লিখেছেন, ইংরেজদের ঐশ্বর্য্যলিপ্সা একটা যেন রোগের মত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এ-বিষয়ে তারা কোর্টেস ও পিৎসারোর আমলের স্প্যানিশদের পর্যন্ত হার মানিয়েছিল। একেবারে নিঃশেষে শোষিত না হওয়া পর্যন্ত এই বাংলাদেশের আর শান্তি ছিল না।

ভূমিহীন ও বর্গাচাষীর বেত্তান্ত

ইংরেজরা বাংলার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই সুকৌশলে  বাংলার এই কুটির শিল্পকে পুরোপুরি ধ্বংশ করে দেয়। ফলে এই কুটির শিল্পে বিপুল সংখ্যক মানুষ বেকার হয়ে পড়ে।  লক্ষ লক্ষ শিল্পী ও কারিগররা আত্মহত্যা করে– মরে যায়। ১৮৩৪ সালে বড়লাট লর্ড বেন্টিংক তাঁর রিপোর্টে লিখেছেন—ব্যবসা বানিজ্যের ইতিহাসে এই রকম দুরাবস্থার তুলনা খুবই কম মেলে। সমগ্র ভারত ভূখণ্ড তাঁতি জোলা সম্প্রদায়ের অস্থি-কঙ্কালে পরিকীর্ণ হয়ে আছে।

এদের কাজ ছিল না, উপজীবিকা ছিল না, বহু বংশপরম্পরায় অর্জিত দক্ষতা বা  শিল্পকুশলতাও কাজের অভাবে নষ্ট হয়ে গেল। বেঁচে থাকার জন্য তারা তখন কৃষিকাজের দিকে ছুটে আসে। ফলে এরা জমির উপর বিরাট ভারস্বরূপ হয়ে দাঁড়াল। তারা পরিণত হয় ভূমিহীন ক্ষেতমজুরে। কেউ কেউ হল বর্গা চাষী। এদের জীবন ছিল মানবেতর। সভ্যজগতে যাকে খেয়ে পরে বেঁচে থাকা বলে তার বহু নিচের স্তরে লোকে কোনোমতে প্রাণধারণ করতে লাগল। এরা পরের জমিতে কাজ করে—হাড়ভাঙ্গা খাটুনি দিয়ে ফসল উৎপাদন করে। কিন্তু ফসলের উপরে তাদের অধিকার নেই। তাদের আয় খুবই কম। বর্গচাষীদেরকে  জমির মালিকরা ভয়ঙ্কর জটিল পদ্ধতিতে জমি ভাড়া দেওয়া শুরু করে। মালিকরা জমি ভাড়া দেওয়া ছাড়া জমিতে আর কোনো পূঁজি বিনিয়োগ না করেই বর্গাচাষীর কাছ থেকে ফসলের বড় ভাগ পায়।

ভূমিহীন ক্ষেতমজুর আর বর্গাচাষীরা হয়ে উঠে দাসশ্রমিকের মত। তার সঙ্গে মহাজনদের কবলে পড়ে এই দাসজীবনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠল। প্রজাদের জমির পরিমাণ দিন দিন কমে যেতে লাগল। এইভাবে হাত বদলানোয়  জমিগুলি দিন দিন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরোয় পরিণত হয়ে এক অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি করল। কৃষকরা  ঋণের ফাঁদে পড়ে মহাজনদের কাছে বেঁচে দিতে বাধ্য হল। ক্ষুদ্র কৃসকদের জমি গিলে নতুন নতুন ভূস্বামী সৃষ্ট হল। পরিচিত হল বাবুতে। ভূমিহীন শ্রমজীবীদের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ বেড়ে উঠল।

ক্ষুদ্র কৃষক-ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের জন্য তৎকালীন সরকারও কিছু করে নাই। পরবর্তিতে যখন রাজনীতিবিদদের উত্থান হল—তারাও তাদের জন্য  কিছু ভাবে নাই।

জমির আয় খুব লাভজনক ও সম্মানজনক বলে তখন শিক্ষিতবাবুরা এবং ব্যবসায়ীরা জমি কিনে ভাড়া দিতে শুরু করল। এইসব জমির মালিকরা  পরজীবী শ্রেণী সমাজে নতুন করে  শোষক হিসেবে আর্বিভূত হয়।

ষষ্ঠ পর্ব————————————————

বাবুরাম সাপুড়ে

কোথা যাস বাপুরে।।

নববাবুবিলাস  সম্বাদ

১৮৭২ সালে প্রথম যখন আদম শুমারী হয়। সেখানে দেখা যায়—সত্তরের মন্বন্তরের ক্ষতি পূরণ হতে প্রায় একশ বছর সময় লেগেছিল। দুই তৃতীয়াংশ লোকই হয় মরে গিয়েছিল—নয় পালিয়ে গিয়েছিল, ফলে প্রথম দিকে জমির পরিমাণ ছিল প্রচুর। কিন্তু চাষের লোক ছিল খুবই কম। যারা ছিল তারা জমিদারের শোষণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শস্যচাষে সাহস হারিয়ে ফেলেছিল। ইংরেজরা বাংলা দখল করার পরে দেশে অসংখ্য ক্ষুদে সামন্ত বা জমিদার এবং বরগা চাষীর সৃষ্টি হয়। এর আগে মধ্যবিত্ত বলে কোনো সম্প্রদায় ছিল না।

তখন দেশটি পুরোপুরি বৃটিশদের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। মাত্র ১০-১৫ জন বৃটিশ লক্ষ লক্ষ ভারতীয়ের উপর ছড়ি ঘোরাত। এই ছড়ি ঘোরানোর কাজটি করা হত স্থানীয় অনুগত শ্রেণীর লোকদের সহায়তায়। এই অনুগত বাহিনী সৃষ্টি করার জন্য ইংরেজরা ইংরেজি শিক্ষা চালু করে। বাঙ্গালী বাবুরাই ইংরেজি শিক্ষায় এগিয়ে আসে। তারা ইংরেজি শিখে সাহেবদের দোভাষী, মুনশি, দেওয়ান ইত্যাদি কাজে ভিড়ে যেত। তাদের এই ভিড়ে যাওয়াকে বলা হয় সাহেব ধরা। সাহেবরা চাকরী, দুর্নীতি, ব্যবস্যা-বানিজ্য, জমিদারি, নবাবীর নামে যেসব লুণ্ঠন করত এইসব বাঙ্গালী বাবুরা তাদের সহযোগী হিসাবে বেশ বড় অঙ্কের বেতন পেত—বখরা পেত। এভাবে দেশে তখন নতুন ধরনের শিক্ষিত ধনীক শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল। তারা এইসব টাকা পয়সা দিয়ে নানা ধরনের ব্যবসা-বানিজ্য করেছে। জমিদারীও কিনেছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার এক দশকের মধ্যেই কোলকাতায় থেকে নতুন ধরনের শোষক বাবু শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়েছে। এরাই পুরনো জমিদারদের হটিয়ে আরও হৃদয়হীন জমিদারে পরিণত হয়েছে।

এই শিক্ষিত বাবুরা একটু ইংরেজি শিখেই সাহেব ধরতে শিখত। বাবুরা কোলকাতায় বনবাস করত। কোলকাতা শুরুতে ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পন্য আমদান-রপ্তানীর কেন্দ্র। ইংরেজ শাসন কায়েম হওয়ার পরপরই কোলকাতাকে সারা ভারতের রাজধানী করা হয়। হয়ে ওঠে বৈদেশিক বানিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। ইংলল্ড থেকে তখন ভাগ্যান্বেষণে  ইংরেজরা কোলকাতায় আসত। এই ইংরেজরা  বাংলা ভাষা জানত না। এই মধ্যবিত্ত বাবুরা তাদেরকে জাহাজঘাটা থেকেই পাকড়াও করত। তারা সাহেবদের কেরানীর চাকরী করত। আবার কিছু কিছু বাঙালিরা ইংরেজী জানত না। কিন্তু দেখে দেখে কোম্পানীর দলিলপত্রাদি না বুঝেই হুবহু নকল করতে পারত। এদের নাম ছিল মুনশী। এরাই আবার প্রমোশন পেয়ে দেওয়ান হত। এরা নানা কায়দায় বেতনসহ নজরানা দস্তুরী আদায় করত ইংরেজদের কাছ থেকে। এভাবে তারা বেশ অর্থসম্পদের মালিক হয়ে গিয়েছিল। ব্যবসা বানিজ্য খুলেছিল। কেউ কেউ জমিদারও হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ জয়রাম ছিলেন ইংরেজদের এ ধরনের ঠিকাদার। হয়েছিলেন হুইলার সাহেবের দেওয়ান। রামমোহন রায়ও ছিলেন কোম্পানীর সেরেস্তাদার—পরে দেওয়ান।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আদি সহযোগীর অন্যতম ছিলেন শোভারাম বসাক। ১৭৮০ সালে তার মৃত্যু হয়। ইংরেজদের সঙ্গে ওঠাবসা করে তার সম্পত্তির পরিমাণ—কোলকাতার বগবাজার এলাকায় ৩৭টি বাড়ি, কৌরকাতার বিভিন্ন এলাকায় ৩টি বাগান ও পুকুর। মারা যাওয়ার পরে তার গুদামে ছিল নানা ধরনের বিপুল পরিমাণ কাপড়, ৫ মন রকমারি মশলা, ১৮ মন আফিং, এবং পরিমাণমত চন্দনকাঠ, তামা, সিসা, লবঙ্গ, ফিটকিরি ইত্যাদি। সিন্দুকে ছিল ৮৯১টি মুক্তা—এর মধ্যে ৬১টি আবার আকারে বেশ বড়, ৪১৩টি হিরা, ৩৫টি পদ্মরাগ মণি। তাছাড়া অনেক মোহর, সোনার ছড়া ইত্যাদি। সাহেবদেরও তিনি টাকা সুদে ধার দিতেন। তাদের কাছে তার পাওনা ছিল ৫ লক্ষ ২৭ হাজার ১১২ টাকা। দেশীয় লোকদের কাছে পাওনা ৫৩ হাজার ৮৩ টাকা। সুয়েজ, বোম্বাই এবং বসরার বণিকদের কাছে পাওনা টাকার পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৭৫১ টাকা। এ ছাড়াও মালদা, কাশিমবাজার, হরিয়াল, ক্সীরপাই ও ঘাটালে শোভারাম বসাকের নিজস্ব আড়ং ছিল।

লুণ্ঠনপর্বের শুরুতেই ইংরেজ কোম্পানী জাহাজে করে এদেশ থেকে মালপত্র ইংলন্ডে নিয়ে যেত। ফেরার পথে খালি জাহাজ নিয়ে আসার কিছু সমস্যা ছিল। ঝড়ের কবলে পড়লে জাহাজ ডুবির আশঙ্কা ছিল। সেকারণে তারা সে সময়ে খুবই সস্তা লবণ জাহাজ ভরে নিয়ে আসত। যাত্রা শেষে সে সব নুন সমুদ্রে ফেলে দিয়ে আবার জাহাজ খালি করত। ইংরেজদের ব্যবসাবুদ্ধি ছিল অতি প্রখর। তারা স্থানীয় কিছু অনুগত বাঙ্গালীকে ধরে এই লবণ বিক্রির ব্যবস্থা করে। তখন এদেশে লবণের কোনো ঘাটতি ছিল না। কিন্তু কোম্পানী বাজারে প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় লবণ বিক্রি থামিয়ে দিয়ে বিলেতি লবণ বিক্রির ব্যবস্থা করেছিল। সেই লবণের টাকায় অনেক বাঙ্গালী বিপুল অর্থসম্পত্তির মালিক হয়েছিল। তারা হয়েছিল দেওয়ান, উপদেওয়ান। কেউ কেউ হয়েছিলেন একদম নিঃস্ব থেকে উচ্চবিত্ত—মধ্যবিত্ত।

পদ্মলোচন নামে এক ভদ্রলোকবাবুর খবর জানতে পারা যায় হুতুম প্যাঁচার নকশায়। পদ্মলোচন খুব গরীব ঘরের সন্তান। গ্রাম থেকে কোলকাতায় এসে গৃহভৃত্যের কাজ নেয়। কিন্তু কায়দা করে টাকাপয়সা আয় করে একজন বড় মানুষে পরিণত হয়েছিলে। হুতুম প্যাচার নকশায় লেখা হয়েছে —

''ক্রমে পদ্মলোচন নানা উপায়ে বিলক্ষণ দশ টাকা উপার্জন কত্তে লাগলেন, অবস্থা উপযোগী একটি নতুন বাড়ি কিনলেন, সহরের বড় মানুষ হলে যে সকল জিনিসপত্র উপাদানের আবশ্যক, সভাস্থ আত্মীয় ও মোসাহেবরা সেই সকল জিনিস সংগ্রহ করে ভাণ্ডার ও উদর পূরণ করে ফেল্লেন, বাবু স্বয়ং পছন্দ করে (আপন চক্ষে সুবর্ণ বর্সে) একটি রাঁঢ়ও রাখলেন।''

আরেকজন বাবুর নাম জানা যায়—নাম বিশ্বনাথ মতিলাল। তিনি শেষ বয়সে এসে গান-বাজনা, হাফ-আখড়াই আর শখের যাত্রা নিয়ে খুব মেতেছিলেন। তার অগাধ সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছিলেন তার ছেলেপেলেদের মধ্যে। কোলকাতার তার এক ছেলের বউয়ের নামেই একটি বাজার বসিয়েছিলেন। সে বাজারটির নাম বউবাজার। এই বউবাজরটিতে সে সমযের বাবুদের মনোরঞ্জনের জন্য বারবণিতাদের সবচেয়ে পল্লী গড়ে উঠেছিল। এখানে এই বড় বড় বাবুরা ইংরেজদের সঙ্গে বাংলার লুটপাটের টাকা পয়সা দিয়ে, জমিদারী প্রজাশোষণের টাকা দিয়ে তাদের রক্ষিতা রাঢ়দের জন্য বাড়ি করে দিতেন। ভাগ্যান্বষণে অনেক মুসলমান ও পশ্চিমা বাঈজিরাও এখানে আসর বসাত। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল নিকি বাঈ। তাকে তার বাবু প্রতিমাসে সে সময়ে এক হাজার টাকা দিয়ে পুষতেন। পাইকার, ব্যাপারী আর ইজারাদারদের রাত্রিবাসের জন্য অনেক টোটেল গড়ে উঠেছিল। সেখানে রাতকাটানোর জন্য বারবণিতাদের সহজে পাওয়া যেত। তাদের জন্য তখন সৌখিন পোষাক আষাক আর গহনার দোকানপাটেরও রমরমা ছিল।

পূর্ব বাংলা থেকে আসতেন বাঙ্গাল জমিদার, তালুকদার আর ইজারাদাররা। তারা আসতেন বজরায় করে। তাদের পাণ্ডারা ধরে বারবণিতাদের কাছে নিয়ে যেত। আর কিছুদিন ফূর্তিফার্তা করে সর্বস্ব খুইয়ে দেশে ফিরে যেত। আবার প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে কোলকাতায় ফিরে আসত।

ঠিক সে সময়েই গ্রামের মানুষ না খেয়ে মরছে। সে সময়ে পথে ঘাটে, মন্দিরচত্বরে খ্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে অনেক মা তাদের শিশু সন্তানকে ফেলে রেখে পালিয়ে যেতেন। পালিয়ে গিয়ে এদের উঠতে হত এইসব বউবাজারের মত বারবণিতা পল্লীতে।

১৮২০ সালে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নববাবুবিলাস নামে একটি বই লেখেন। সেখানে বাবু বলতে তরুণ নব্যধনীদের কথা বুঝিয়েছেন। ইংরেজরা বাবু শব্দটিকে ইংরেজিজানা বাঙালি কেরানীকে বুঝত। তারা ১৭৮২ সালে এই বাবু শব্দটিকে দলিলপত্রাদিতে ব্যবহার করা শুরু করে। আর বাঙালিদের কাছে বাবু মানে মনিব।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যারা জমিদারি কিনে অথবা ব্যবসা বানিজ্য করে কৌলকাতায় নব্যধনী হয়েছিলেন–তারাই বাবু হিসেবে পরিচিত হতেন সে সময়ে। ১৮৫০ সালের দিকে বাবু বলতে সংবাদপত্রে জমিদার, ব্যবসায়অর সঙ্গে ধনী পরিবারের অলস তরুণদের বোঝানো হত। এরা ছিলেন আলালের ঘরের দুলাল। ১৮৬০ সালের দিকে বাবু শব্দটি আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। তখন চাকরীজীবীদের মধ্যে বড়বাবু, ছোটো বাবু ইত্যাদি শব্দ এসে যায়। এমনকি পরিবারের বড়ো ভাইকে বড় বাবু, মেজো ভাইকে মেজো বাবু ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হতে থাকে। বাবুদের গিন্নীদের বলা গত বিবি। ভাবানীচরণ এইসব বিবিদের নিয়ে নববিবিবিলাস নামে আরেকখানি বই লিখেছেন। মুসলমানদের মধ্যে বাবু শব্দটির বদলে সাহেব শব্দটিই বেছে নেওয়া হত।

এ ধরনের বাবু রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ির একটি উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ফেনি পার্কসের ভ্রমণকাহিনীতে। ভ্রমণকাহিনীর নাম Wanderings of a Pilgrim in search of Picturesque ।  তিনি ১৮২৩ সালে কলকাতায় রামোহনেরবাড়িতে নাচের আসরে যোগ দেন। তিনি লিখেছেন—

একদিন এক ধনিক সম্ভ্রান্ত বাঙালিবাবুর বাড়ি ভোজসভায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। বাবুর নাম রামমোহন রায়। বেশ বড় চৌহদ্দির মধ্যে তার বাড়ি; ভোজের দিন নানা বর্ণের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। চমৎকার আতসবাজির খেলাও হয়েছিল সেদিন। আলোয় আলোকিত হয়েছিল তার বাড়ি।

বাড়িতে বড় বড় ঘর এবং একাধিক ঘরে বাইজি ও নর্তকীদের নাচগান হচ্ছিল। বাইজিদের পরনে ছিল ঘাঘরা, সাদা ও রঙিন মসলিনের ফ্রিল দেওয়া, তার উপর সোনারূপার জরির কাজ করা। শাটিনের ঢিলে পায়জামা পা পর্যন্ত ঢাকা। দেখতে অপূর্ব সুন্দরী, পোষাকে ও আলোয় আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল। গায়েতে অলঙ্কার ছিল নানারকমের। …বাইজিদের একজনের নাম নিকি, শুনেছি সারা প্রাচ্যের বাইজিদের মধ্যে মহারানি সে, তার নাচগান শুনতে পাওয়া ভাগ্যের কথা।

ভদ্রলোক : ভদ্র হইলেও লোক বটে

উনিশ শতকের শেষদিক থেকে বিশ শতকের প্রথমদিকে বাবুদের মধ্যে থেকে ভদ্রলোক শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এরা কিছু দেশোদ্ধারের কাজকর্মে জড়িত থাকতেন। ইংরেজি শিক্ষার আলোকে  আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানে আলোকিত হয়ে বাঙালি মানসে এ সময়কালে একটি জাগরণের ফলে বাবু থেকে ভদ্রলোকে রূপান্তর  এসেছিল। তার কিছু পল ভাল হয়েছিল—কিছু খারাপ হয়েছিল।   ১৮৭২ সালে ভদ্রলোক অর্থটি ভদ্র যে  লোক হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন হুতুম প্যাঁচার নকশা বইয়ে।

বঙ্কিমচন্দ্র ঠাট্টা করে এই ইংরেজি জানা শিক্ষিত বাবুর একটি চিত্র এঁকেছেন—চসমা-অলঙ্কৃত, উদারচরিত্র, বহুভাষী। এরা নিজের ভাষাকে ঘৃণা করেন, পরের ভাষায় পারদর্শী। মাতৃভাষায় বাক্যালাপে অসমর্থ। এঁরা বিনা উদ্দেশ্য সঞ্চয় করেন, সঞ্চয়ের জন্য উপার্জন করেন, আপার্জনের জন্যে বিদ্যা শিক্ষা করেন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যে প্রশ্নপত্র চুরি করেন। এঁদের বল হস্তে এক গুণ, মুখে দশ গুণ এবং কার্যকালে এরা অদৃশ্য। এঁদের বুদ্ধি বাল্যে বইয়ের পাতায়, যৌবণে বোতলের মধ্যে, বার্ধক্যে গৃহিণীর আঁচলে। আরও মজা করে বঙ্কিম লিখেছেন—বাড়িয়ে এরা জল খান, বন্ধুগৃহে মদ খান, বেশ্যাগৃহে গালি খান এবং মুনিব সাহেবের কাছে গলাধাক্কা খান।

সোম প্রকাশ পত্রিকায় ১৮৬২ সালে একটি নিবন্ধে লেখা হয়—ভদ্রলোক, এ ব্যক্তি আপনার পরিবারকে খাইতে দয় না, বাটী যায় না, যেখানে পায় সেইখানে আহার ও শয়ন করে।

১৮৮৩ সালে সোমপ্রকাশ লেখে—কৃষিকার্য করা ভদ্রলোকের কর্ম নহে, তাহাতে লোকে চাষা বলিবে।

সপ্তম পর্ব——————————————–

বাংলায় বামুন  

আর্যরা ভারতে আসার অনেক পরে বাংলায় তাদের সংস্কৃতির স্পর্শ পায় অনেক পরে। রামায়ণ-মহাভারতের যুগে এই দেশকে আর্যরা খুব ভালো চোখে দেখেনি। বাংলা ছিল নিম্নবর্গের মানুষের জায়গা। দস্যুদের এলাকা। খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দীর বেশিরভাগ সময়েও এদেশে ব্রাহ্মণ্য আচার-অনুষ্ঠান অপেক্ষা বৌদ্ধ প্রভাবই অধিকতর পরিলক্ষিত হয়। সেই কারণেই তৎকালীন মহারজ আদিশুর কান্যকুব্জ বা কনৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণকে আনিয়েছিলেন। তারা বেদবিহিত পূজাঅর্চনা প্রচলন করেন। আধুনিক বাঙ্গালী ব্রাহ্মণদের আদিপুরুষ এই পঞ্চ ব্রাহ্মণ। তারা জাতপাতের বিভেদের প্রাচীর তুলে সমাজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। নিম্নবর্গের মানুষ শুধু রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নয়—ধর্মব্যবস্থায়ও নতুন নতুন নিপীড়নের শিকার হয়ে পড়ে।

বাংলায় ইসলাম 

পাশাপাশি   ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভারতে মুসলমানদের আক্রমণ ঘটে। তখন বাংলায় সমাজব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন ঘটে। কোথাও মুসলমান সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে কোথাওবা বা শাসক সম্প্রদায়ের ধর্মান্তকরণে  প্রদত্ত সুযোগসুবিধার ফলে বা রাজানুগ্রহ পাওয়ার আকাঙ্খায় বা জাতে উঠার আকাঙ্খায়ও অনেক উচ্চবর্গের হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। পাশাপাশি নিম্নবর্গের হিন্দুরা ইসলামের উদার নীতির কারণে আকৃষ্ট হয়। সে সময়ে দরবেশ-ফকিররাও ক্ষেতের আলে আলে নাচতে নাচতে—গাইতে গাইতে দিগন্তে পিঠ রেখে দেখা দিয়ে আসছেন। ঈশ্বরের কথা—আল্লার কথা তাঁদের গান হয়ে সন্ধ্যার শঙ্খ ঘণ্টার ধ্বনির সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে বাংলার আকাশে বাতাসে জনপদে মিশে গেছে। সাধারণ মানুষজন অনেকেই উদার ইসলাম গ্রহণ করেছে।

জাতের বামুন থেকে অজাতের পিরালী বামুন

ঘটনাটা পঞ্চদশ শতাব্দীর। তখন যশোর জেলার চেঙ্গুটিয়া পরগণায় এক ঘর জমিদার ছিল। তার পদবী ছিল গুড়। তবে খাতা পত্রে এই গুড়দের রায়চৌধুরী বলা হত। সেখানকার জমিদার দক্ষিণানাথ গুড় বা রায়চৌধুরীর চার ছেলে—কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেব। সে সময়ে স্থানীয় এক মোগল শাসক ছিলেন মামুদ তাহির বা পীর আলি। এই পীর আলীর কৌশলে বা প্রলোভনে পড়ে বা আকৃষ্ট হয়ে কামদেব এবং জয়দেব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তবে আরও একটি মত পাওয়া যায়– পীর আলী এই দুইভাইকে কৌশলে গোমাংস ভক্ষণ করান। এই ঘটনা জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেন পীর আলী। তখন তাদের মুসলমান হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।  তাদের ছোটো দুই ভাই রতিদেব ও শুকদেব মুসলমান হয়নি। কিন্তু তাদের ভাই মুসলমান হয়েছে শুধু এই কারণে হিন্দুসমাজ তাদেরকে সমাজচ্যুত করে। তাদের সঙ্গে সর্বপ্রকার সামাজিক সম্পর্ক বন্ধ হয়ে যায়। তাদের সঙ্গে কেউ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ছেলেমেয়ে বিয়ে দেওয়াও এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে। এদের নাম হয় পিরালী বামুন বা পিরালী থাক। জাতে ছোটো। অছ্যুৎ।

অথচ  মহাভারতে উল্লেখ আছে প্রাচীন সমাজে ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়াদি সকলেরই প্রচুর মাংসাহার করতেন। ভদ্রসমাজেও সুরাপান চলত। গোমাংসভোজন ও গোমেধ যজ্ঞের বহু উল্লেখ বেদে পাওয়া যায়। রাজশেখর বসু মহাভারতের ভূমিকায় আরও জানাচ্ছেন, সেকালে অস্পৃশ্যতা কম ছিল—দাসদাসীরাও অন্ন পরিবেশ করত। কিন্তু কালক্রমে ব্রাহ্মণতন্ত্র কঠিনভাবে সমাজে কায়েম হয়ে পড়লে হিন্দু সমাজের এই উদারনীতি অনেকাংশেই পরিত্যাক্ত হয়।

এই সমাজচ্যূতির ফলে স্বশ্রেণীর ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বিয়েশাদী বন্ধ হয়ে গেলে তারা ভিন্ন কৌশল করেন। তারা ছেলেমেয়েদের বিয়ের জন্য কৌশল ও প্রলোভনের জাল বিস্তার করেন। সাধারণত তারা টার্গেট করতেন গরীব ব্রাহ্মণদের। তাদেরকে টাকা পয়সা, জমিজিরেত ও ঘরজামাই করে মেয়ে গছাতেন। আর ছেলে বিয়ে দিলে মেয়ের বাপের বাড়ির লোড়ির লোকজনকে আর্থিকভাবে দাড় করানোর দায়িত্ব নিতেন।

ঘরজামাই থেকে জমিদারি 

এ সময়কালেই বর্ধমান জেলার কুশগ্রামে একঘর ব্রাহ্মণ পরিবার ছিল। তারা কুশগ্রামের নামঅনুসারে কুশারী পদবী ব্যবহার করতেন। তারা ছিলেন শ্রেষ্ঠ শ্রোত্রিয় শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। সে গ্রামের জগন্নাথ কুশারী পিঠাভোগ নামের এক স্থানের জমিদার ছিলেন। তাঁর জীবৎকাল ছিল ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে। তখন মোগল শাসন ছিল।

বর্ধমানের পিঠাভোগের জগন্নাথ কুশারীকেও এইরকম কোনো একটি কৌশলে পিলারী বামুন শুকদেব গুড় কায়দা করে তার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। ফলে জগন্নাথ কুশারীকে তার ভাইবেরাদার-আত্মীয়স্বজন পরিত্যাগ করে। সম্ভবত ছিন্নমূল হয়ে জগন্নাথ কুশারী যশোহরে শ্বশুরবাড়ি চলে আসেন। এবং ঘরজামাই হয়ে গেলেন। নরেন্দ্রপুরের উত্তরপশ্চিমকোণে উত্তরপাড়া গ্রামের সঙ্গে সংলগ্ন বারোপাড়া গ্রামে ঘর বাঁধেন। তিনিও পিরালী থাকের অন্তর্ভুক্ত অছ্যুৎ হয়ে গেলেন। শ্বশুর শুকদেব গুড় তাঁকে উত্তরপাড়া গ্রামটি দান করেন। এই গ্রামের আয় থেকেই তাঁর সংসার চলে। তাঁর চার ছেলে—প্রিয়ঙ্কর, পুরুষোত্তম,   জগন্নাথ কুশারীই রবীন্দ্রনাথদের ঠাকুরবংশের আদিপুরুষ।

আজব শহর কোলকেত্তা আগমন 

রবীন্দ্রনাথের উর্দ্ধতম নবম পুরুষ। তার জীবৎকাল ছিল সপ্তদশ শতাদ্বীর দ্বিতীয়ার্ধে। সে সময়ে জোব চার্নক কোলকাতা শহর পত্তন করছিল। তার ছেলে মহেশ বা মহেশ্বর যশোরের উত্তরপাড়া থেকে ভাগ্যান্বেষণে কোলকাতা আসেন। আরেকটি মত আছে মহেশ নয় তার ছেলে পঞ্চানন কুশারী জ্ঞাতী কলহে ভিটা ত্যাগ করে কোলকাতায় চলে যান। সময়টা প্রায় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ।

জোব চার্নক জোব চার্নকের কোলকাতা

জোব চার্নকের জন্ম ১৬৩০ সালে ইংলন্ডের ল্যাঙ্ক শায়ারে। ১৬৫৬ সালে এক ব্রিটিশ বানিজ্যিক সংস্থায় কাজ নিয়ে ভারতে আসনে। এর বছর খানেক পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাশিমবাজার কুঠিতে বার্ষিক কুড়ি পাউন্ড বেতনে এক কর্মি হিসাবে যোগ দেন। ১৬৮৬ সালে প্রতিভাবলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাংলার এজেন্ট নিযুক্ত হন। সে সময়ে সুবেদার শায়েস্তা খাঁর সঙ্গে ইংরেজদের বিবাদ বাড়ছিল। ঐ বছরের অক্টোবরে জোব চার্নক হুগলির মুগল সুবেদারের আড়তে গোলাগুলি চালিয়ে আগুণ লাগিয়ে দিলেন। ভারতের ইতিহাসে সেই প্রথম মুগলদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের অস্ত্র ধারণ।

জোব চার্নক মুগলদের ভয়ে তল্পতল্লা গুটিয়ে হুগলি ছেড়ে বালেশ্বরের দিকে যাত্রা করলেন। সে সময়ে হঠাৎ করে হুগলীর পূর্ব পাড়ে নির্জন এক গ্রাম তার চোখে পড়ল। ঘাঁটি গাড়লেন সেখানেই। গ্রামটির নাম সুতানটি। এই সুতানটি গ্রামে এর আগে আর কোনো ইংরেজের পা পড়েনি। সেখানে ছোটো একটা দুটো খড়ের চালা ঘর তৈরি করে বসবাসের উদ্যোগ নেন। কিন্তু মুগলদের বিরুদ্ধে আবার বিবাদে জড়িয়ে পড়ে সুতানটি ছেড়ে চলে যান।

ইংরেজদের সঙ্গে এই বিরোধের জেরে মুগলদের রাজকোষে অর্থ আসা বন্ধ হয়ে গেল। এবং শায়েস্তা খাঁ ব্যক্তিগতভাবেও কিছু ঘুষ পেতেন। সেটাও বন্ধ হয়ে গেল । ফলে শায়েস্তা খাঁ ইংরেজদের আবার সুতানটিতে ডেকে আনলেন। কিন্তু আবার গন্ডগোল হওয়ায় তিনি চট্টগ্রামে চলে যান। সেখানে সুবিধা করতে না পেরে মাদ্রাজে পলে যেতে হয়।

সে সমযে মুগল সম্রাট ছিলেন আওরঙ্গজেব। তিনি ইব্রাহিম খাঁকে পাঠালেন বাংলার সুবেদার করে। সম্রাটের আদেশে তিনি ইংরেজদের আবার আমন্ত্রণ জানালেন বাংলায় ব্যবসা করার জন্য। ১৬৯০ সালের ২৩ এপ্রিল আওরঙ্গজেব এক আদেশনামায় বার্ষিক তিন হাজার টাকা শুল্কের বিনিময়ে ইংরেজদের বাংলায় বাণিজ্য করবার অনুমতি দিলেন। ১৬৯০ সালের ২৪ জুলাই এক বৃষ্টিমুখর দিনে জলকাদা মাড়িয়ে জোব চার্নক এসে নামলেন সুতানটির ঘাটে।

সুতানটি সুতানটি থেকে কোলকাতা : আরেকটু পুরনো হিসাব 

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে লিখিত বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসাবিজয় কাব্যে এই অঞ্চলের একটি প্রামাণ্য ভৌগোলিক বিবরণী পাওয়া যায়। ব্যান্ডেল ও ত্রিবেণীরমধ্যবর্তী স্থানে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁ ছিল একটি বিরাট বন্দর। নদীর ভাটিতে একই পাড়ে বেতড় গ্রামটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানে পথিকেরা কেনাকাটা করত ও দেবী চণ্ডীর পূজা দিত। চিৎপুর ও কলিকাতা গ্রাম ছিল বেতরের নিকটবর্তী গ্রাম। সেই যুগে সুতানুটি ও গোবিন্দপুরের অস্তিত্ব ছিল না। ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বাংলায় পর্তুগিজদের যাতায়াত শুরু হয়।

এই যুগে পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম ও পশ্চিমবঙ্গের সপ্তগ্রাম বন্দরদুটি ছিল বাংলার দুটি প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। পর্তুগিজরা চট্টগ্রামকে বলত "Porto Grande" বা "মহা পোতাশ্রয়" ("Great Haven") ও সপ্তগ্রামকে বলত "Porto Piqueno" বা "ছোটো পোতাশ্রয়" ("Little Haven")। সেযুগে টালির নালা বা আদিগঙ্গা ছিল সমুদ্রে যাতায়াতের পথ। সমুদ্রগামী বড়ো বড়ো জাহাজগুলি এখন যেখানে গার্ডেনরিচ, সেই অঞ্চলে নোঙর ফেলত। কেবল মাত্র দেশি ছোটো নৌকাগুলিই হুগলি নদীর আরো উজানের দিকে চলাচল করত। সম্ভবত, সরস্বতী নদী ছিল এই সময়কার আরও একটি জলপথ। এই নদী ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে শুকিয়ে যেতে শুরু করে। ১৫৮০ সালে হুগলি-চুঁচুড়াতে পর্তুগিজরা একটি নতুন বন্দর স্থাপন করে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে সপ্তগ্রামের দেশীয় বণিকেরা নতুন একটি বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। তাঁদের অধিকাংশই হুগলিতে বসতি স্থাপন করলেন। কিন্তু চারটি বসাক পরিবার ও একটি শেঠ পরিবার বেতরের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে নদীর পূর্বতীরে গোবিন্দপুর গ্রামের পত্তন করেন। ডিহি কলিকাতা গ্রামের উত্তরাংশে বস্ত্রাদি ক্রয়বিক্রয়ের একটি কেন্দ্র গড়ে ওঠে। ১৫৯৬ সালে আকবরের প্রধানমন্ত্রী আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরিগ্রন্থে এই অঞ্চলটিকে সাতগাঁও পরগনার একটি জেলা হিসেবে উল্লেখ করেন। পর্তুগিজদের পর এই অঞ্চলে ওলন্দাজ ও ইংরেজ বণিকেরা পদার্পণ করে।

অবস্থানগত নিরাপত্তার কারণে জব চার্নক সুতানুটিকে বসতি স্থাপনের পক্ষে উপযুক্ত মনে করেছিলেন। সেই যুগে সুতানুটি পশ্চিমে হুগলি নদী এবং পূর্বে ও দক্ষিণে দুর্গম জলাভূমির দ্বারা বেষ্টিত ছিল। কেবলমাত্র উত্তর-পূর্ব অংশে প্রহরার প্রয়োজন হত।

সুতানুটি, ডিহি কলিকাতা ও গোবিন্দপুর ছিল মুঘল সম্রাটের খাসমহল অর্থাৎ সম্রাটের নিজস্ব জায়গির বা ভূসম্পত্তি। এই অঞ্চলের জমিদারির দায়িত্ব ছিল বড়িশারসাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উপর। ১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর জব চার্নকের উত্তরসূরি তথা জামাতা চার্লস আয়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের থেকে এই তিনটি গ্রামের জমিদারির অধিকার কিনে নেন। এরপরই কলকাতা মহানগর দ্রুত বিকাশ লাভ করে। ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিয়মিত এই অঞ্চলের রাজস্ব মুঘল সম্রাটকে দিয়ে এসেছিল

কোলকাতা শহরের প্রকৃত নগরায়ণ আরম্ভ হয় ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পর থেকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে বাংলার শাসন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় সমগ্র পূর্ব ভারতের প্রধান বানিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠে কোলকাতা। বাংলার তথা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষজন এখানে আসতে আরম্ভ করে জীবিকার তাগিদে। গ্রামগুলি মিলেমিশে ক্রমে রূপান্তরিত হয় কোলকাতা শহরে। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ মহেশ্বর বা পঞ্চানন কুশারী এভাবেই এখানে রুটি রুটির রোজগারে চলে এলেন। তখনো তারা ঠাকুর হননি।

অষ্টম পর্ব—————————————————————

কুশারী থেকে ঠাকুর : ঠাকুর থেকে টেগোর 

পঞ্চানন কুশারী ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় কোলকাতায় এলেন। সঙ্গে ছোটো ভাই শুকদেব।  বসতি স্থাপন করলেন কোলকাতা গ্রামের দক্ষিণে, গোবিন্দপুর আদিগঙ্গার ধারে। তখন এখানে জেলেদের বাস ছিল। অছ্যুত জেলেদের  মধ্যে দুভাই ব্রাহ্মণ এসে পড়ায় তারা বেশ খুশী হল। তাদের পূজাপার্বনের দুশ্চিন্তা কাটল।  তাদের বসবাসের বন্দোবস্ত করে দিল।  তাদের পূজাপার্বনের দায়িত্ব পালন করে দিতেন। দুভাই শিব পূজার জোগাড় যন্ত্র করে তাদের পুরুতঠাকুর হয়ে বসলেন।

এখানে তখন অনেক বিদেশী জাহাজ আসত। এইসব জাহাজে তারা নানাবিধ মালামাল সরবরাহ করা শুরু করলেন। এভাবে কিছু টাকা পয়সাও জমে গেল। পঞ্চানন ও শুকদেব গোবিন্দপুরে গঙ্গার ধারে কিছু জমি কিনে ফেললেন। বসতবাটি আর শিবমন্দির স্থাপন করলেন। জেলেদের দেখাদেখি সাহেবরাও এই দুইভাইকে ঠাকুর বলে ডাকা শুরু করল। তারা ঠাকুর বলতে পারত না। তারা বলত টেগোর। এই পঞ্চানন থেকেই কোলকাতার পাথুরীঘাটা, জোঁড়াসাঁকোতে পঞ্চানন ঠাকুরের বংশধারা এবং চোরাবাগানে শুকদেবের বংশাধারা ঠাকুর পরিবার হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।

 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে সংযোগ 

পঞ্চানন কুশারীর দুছেলে জয়রাম কুশারী ও রামসন্তোষ কুশারী কিছু কিছু ইংরেজী ও ফারসী শিখেছিলেন। ভাষার জোরে তারা সহজের বিদেশী বনিকদের নেক নজরে পড়ে গেলেন। এই দুই ভাষা জানার কারণে তারা অন্যদের চেয়ে বেশি মালামাল সরবরাহের কাজ পেতে লাগলেন। করিৎকর্মা পঞ্চাননকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মাস্টারের প্রধান সহকারী হিসাবে কাজ দিল।

ইংরেজদের অধীনে কোলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর আসার পরে ১৭৪২ সালে এই অঞ্চলে প্রথম জরীপ কাজ শুরু হয়। কোলকাতার কালেক্টর র‍্যালফ সেলডন পঞ্চানন ও শুকদেবকে আমিন হিসাবে নিয়োগ দেয়। এই কাজে দুভাই বেশ বিত্তশালী হয়ে ওঠেন। নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অধীনে ছিল কোলকাতার আশেপাশের জমি । তিনি দুভাইকে দিয়ে এই জমিগুলোর জরীপ করান। এইভাবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে তাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জয়রাম তার বাড়িতে রাধাকান্তর বিগ্রহ স্থাপন করেন। কৃষ্ণচন্দ্র খুশী হয়ে দেবসেবার জন্য ৩৩ বিঘা জমি জয়রামকে দান করেন।

বর্গী এলো দেশে 

সেসময়ে বাংলায় প্রতিবছরই মারাঠা বগীর্দের খুব হামলা হত। তারা ঘোড়ায় চড়ে আকস্মিকভাবে আসত। আক্রমণ করে সব লুটেপুটে কেটে পড়ত। নওয়াবের সেপাইরা তাদের ঘোড়ার পিছনে ছুটে ধরতে পারত না।  তাদের দমন করতে নবাবকে খুব ঝামেলা পোহাতে হত। মানুষের জন‍্য সেটা ছিল এক দুর্বিসহ অবস্থা। একটা ছড়া এই মারাঠা বর্গীদের অত্যাচার বিষয়ে মানুষের মুখে মুখে আজও ফেরে—

খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে।

ধান ফুরালো পান ফুরালো খাজনার উপায় কি?

আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি।

বর্গীদের হামলা আর নওয়াব-জমিদারদের খাজনা-প্রাকৃতিক দুর্যোগে পর্যুদস্ত মানুষের হাহকারের সামাজিক ইতিহাসটা এই ছড়ায় আছে।

গঙ্গা আর ভাগীরথী নদী একটা বাঁধা হিসাবে কাজ করত। এটা পাড়ি দিয়ে তাদের অনুপ্রবেশ করারটা অত সহজ ছিল না। তাই এই দিক দিয়ে তারা খুবই কম আসা যাওয়া করত। ১৭৫১ সালে নবাব ও মারাঠাদের একটি সন্ধি হয়। তারপর থেকে আর বাংলায় বর্গি আক্রমণ হয়নি। বর্গীদের স্থলপথের আক্রমণ ঠেকাতে কোলকাতার উত্তর দিকে নালা কাটা হয়।

বর্গিদের আক্রমণের সময়কালে নবাব খুব প্রতাপশালী ছিলেন। আর ইংরেজরা তখন তাদের ব্যবসা বানিজ্য সম্প্রসারণে ব্যস্ত। এদের হামলা রুখতে কোলকাতাকে রক্ষা করার জন্য চারিদিকে  মারাঠা ডিচ চ্যানেল বা নালা খনন করে ইংরেজরা। মূলত তাদের বানিজ্যের সম্পদাদি রক্ষা করার জন্যই  নবাবের অনুমতি নিয়ে মারাঠা ডিচ তৈরি করেছিল। কিন্তু বর্গীদের আক্রমণ আশঙ্কা থেমে গেল তখন অবশিষ্ট নালা আর খনন করা হয়নি। উত্তর কোলকাতার একমাত্র পথটিকে কেটে নালার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছিল। সরাসরি ঘোড়া নিয়ে কোলকাতায় ঢোকা যেত না। নালাটি পার হওয়ার দরকার হত। নালাটি সাত মাইল লম্বা করার পরিকল্পনা ছিল।  ছয় মাসে  মাত্র তিন মাইল কাটা হয়েছিল। এই নালা খননের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা এদেশীয় লোকদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছিল।

১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা যখন কোলকাতা আক্রমণ করেছিলেন, তার সঙ্গে ছিল ৩০, ০০০ সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র। অধিকাংশ সৈন্যই  এই নালাটি পার হয়ে কোলকাতায় প্রবেশ করেছিল। সেই যুদ্ধে সিরাজউদ্দোলা জয়লাভ করেছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পরে আবর্জনার ভরে উঠেছিল নালাটিটি। এটার কোনো দরকারই ছিল না।  ১৭৯৯ সালে এই মারাঠা নালাটি ভরে দেওয়া হয়। ওখানে সার্কুলার রোড তৈরী করা হয়।  এই মারাঠা পনালা খননের কাজটিতে জয়রাম কুশারী একজন ইন্সপেক্টর হিসাবে কাজ করেছিলেন। ধান সায়রে তিনি জমি কিনে রাতারাতি বসতবাড়ি স্থাপন করেন। ধানসায়রের বর্তমান কোলকাতার ধর্মতলা।

জয়রাম ঠাকুরের বড় ছেলে আনন্দীরাম খুব ভালো ইংরেজি শিখেছিলেন। বাঙালিদের মধ্যে সে সময়ে তার চেয়ে ভালো ইংরেজি আর কেউ জানতেন। তবে  বাবা জয়রামের কোনো অপ্রিয় কাজ করার ফলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। জয়রাম বেঁচে থাকতেই তিনি মারা যান।

নীলমণি ঠাকুর : জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির পত্তন

জয়রাম ঠাকুরের মেজো ছেলে নীলমণি ও সেজো ছেলে দর্পনারায়ণ ধানসায়রের জমি সম্পত্তি বেঁচে দেন। তাদের বাড়িটি ছিল ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের সময় মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলা যখন কোলকাতা আক্রমণ করে ফোর্ট ইউলিয়াম দুর্গে গোলা বর্ষণ করেন, তখন  নীলমণি ঠাকুরদের বাড়িও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তী নবাব মীর জাফরের কাছ থেকে ইংরেজরা তাদের নিজেদের জন্য এবং তাদের মিত্রদের জন্য ক্ষতিপুরণ আদায় করেন। জয়রাম ঠাকুরও সে সময় ১৩,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ পান। এই টাকার একটি অংশ দিয়ে কোলকাতা তিনি কোলকাতা গ্রামের পাথুরিয়া ঘাটা পাড়ায় জমি কিনে বসতবাড়ি নির্মাণ করেন। ইংরেজদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে জয়রাম ঠাকুর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শেয়ার বা কাগজও কিনেছিলেন। শেয়ার তাদের গৃহদেবতা শ্রীশ্রীরাধাকান্ত জিইয়ের নামে করেন। ১৭৬৫ সালে ইস্ট কোম্পানী বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে। তখন তারা জয়রাম ঠাকুরকে উড়িষ্যার কালেক্টরের দেওয়ান বা সেক্রেটারি নিযুক্ত করেন। এই কাজে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেন।

জয়রামের  তৃতীয় ছেলে দর্পনারায়ণ হুইলার কোম্পানীর দেওয়ানী লাভ করেন। সে সময়ে ইংরেজরা জাহাজ থেকে জলের মধ্য লবণ ফেলে দিত। পরে তুখোড় ব্যবসাবুদ্ধিসম্পন্ন ইংরেজরা সেই লবণ  ফেলে না দিয়ে স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে বিক্রি করত। এজন্য স্থানীয় লবণ শিল্পকে তারা ধ্বংস করে দেয়। এদেশীয়দের বাধ্য করে ইংরেজদের লবণ কিনতে। দর্পনারায়ণ  এই লবণের ব্যবসা শুরু করেন। এখান থেকে তিনি বিস্তর লাভ করতে থাকেন।  তিনি স্থানীয় লবণ বাজারের ইজারাদারী করেন। এ ছাড়াও জমিদারির পত্তনিদারি ও অন্যান্য ব্যবসা থেকে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদের মালিক হন। নীলমণি ঠাকুর উড়িষ্যা থেকে দেওয়ানী থেকে আয়কৃত টাকা দর্পনারায়ণের কাছে কোলকাতায় পাঠাতে থাকেন।

এই সময়কালে বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দ্বিতীয় বর্ষে করাল মূর্তি ধারণ করে। না খেতে পেয়ে, রোগে ভুগে বাংলায় তিনভাগের এক ভাগ মানুষ মারা যায়। একভাগ লোক পালিয়ে বনে জঙ্গলে চলে যায়। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ সমযকালেই বাংলায় রেকর্ড পরিমাণ খাজনা আদায় করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী রেজা খানের পরিচালনায়। এই ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডে স্থানীয় জমিদার তালুকদার, পত্তনীদাররা খাজনা আদায়ে মুল ভূমিকা পালন করে। পুরনো জমিদারদের চেয়ে ব্যবসা থেকে আসা নুতন জমিদাররা খাজনা আদায়ে বেশী দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হন। ফলে কোম্পানীর কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। পুরনো নরম আলস দুর্বল জমিদারদের অনেকেই খাজনার আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়ে জমিদারী হারায়। এইসব জমিদারীই এইসব নব্য ব্যবসায়ী ও জমিদাররা কোম্পানীর কাছ থেকে ইজারা নেন।  তারা বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হন। এরা সবাই ছিলেন অনুপস্থিত জমিদার। তারা নায়েব গোমস্তাদের মাধ্যমেই জমিদারী পরিচালনা করতেন।

নীলমণি ও দর্পনারায়ণের ছোটো ভাই গোবিন্দরাম নিঃসন্তান ছিলেন। ১৭৭১ সালে তার মৃত্যু হয়।  এই বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী ঠাকুর পরিবারে  নীলমণি ও দর্পনারায়ণের সঙ্গে গোবিন্দরামের বিধবা স্ত্রীর এই সময় গৃহবিবাদ শুরু হয়। বিধবা স্ত্রী রামপ্রিয়া দেবী ১৭৮২ সালে সুপ্রীয় কোর্টে মামলা করেন। এই মামলার ফলে সম্পত্তি তিনভাগে ভাগে হয়। রামপ্রিয়া রাধাবাজার ও জ্যাকসন ঘাটে দুটি বাড়ি পান। দর্পনারায়ণ পাথুরিয়া ঘাটের বাড়ি ও অপর গৃহদেবতা রাধাকান্ত জিউর সেবার ভার পান। তার বংশধারা পাথুরিয়া ঘাটের ঠাকুর বংশ নামে পরিচিত হন। আর নীলমণি তার নিজস্ব উপার্জিত বিপুল অর্থ, এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণসহ গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দন শিলার ভার নেন। জোড়া বাগানের বৈষ্ণব শেঠের কাছ থেকে লক্ষ্মীজনার্দন শিলার নামে মেছুয়াবাজার এলাকায় এক বিঘা জমি কেনেন। সেখানে আটচালা বেঁধে বসবাসকরতে শুরু করেন। মেছুয়া বাজারের নামই পরে জোড়াসাঁকো হয়। এইভাবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পত্তন করেন নীলমণি ঠাকুর ১৭৮৪ সালে। নীলমণি ঠাকুর ১৭৯১ সালে মারা যান।

নবম অধ্যায়———————————————————

ঠাকুরবাড়ির জমিদারি শুরু

নীলমণি ঠাকুরের বড় ছেলে রামলোচন ঠাকুর প্রখর বিষয়বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। তিনি বিরাহিমপুর পরগণা কিনে জোড়াসাঁকো পরিবারের আনুষ্ঠানিক জমিদারগিরির সূচনা করেন। বিরাহিমপুর পরগণার সদর কাঁছারি ছিল শিলাইদহে।  তিনি বিপুল বিষয়সম্পত্তি কিনে ঠাকুরপরিবারকে কোলকাতায় অভিজাত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এর আগে ঠাকুর পরিবারের পরিচয় ছিল– পিরালী ব্রাহ্মণ এবং ব্যবসায়ী বাবু। তারা পাত্তা পাওয়ার মতো কেউ ছিলেন না। সমাজে অছ্যুত।

জমিদারি করার সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক কিছু সৌখিন আভিজাত্য গড়ে তোলেন রামলোচন ঠাকুর। বিকেলে তিনি  হাওয়া খাওয়ার প্রচলন তিনি প্রচলন করেন। এছাড়া খেয়াল বা কালোয়াতি গান ও কবিয়াওয়ালাদের আসর জোঁড়াসাঁকোর বাড়িতে বসাতেন। সেসব অনুষ্ঠানে ইয়ারবন্ধুদের আমন্ত্রণ করা শুরু করেন। সেখানে বিস্তর খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হত। বিভিন্ন জেলায় তিনি জমিদারি কেনেন। কোলকাতা শহরে দশটি বাড়ি কিনেছিলেন।

রামলোচন ঠাকুর আর তাই ভাই রামমণি ঠাকুর দুজনে দুবোনকে বিয়ে করেন। রামলোচনের স্ত্রী অলকা দেবীর শিবসুন্দরী নামে একটি মেয়ে হলেও শৈশবেই তার মৃত্যু হয়। তাঁর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। রামমণির স্ত্রী মেনকার গর্ভে দুটি ছেলে ও দুটি মেয়ে হয়েছিল। ছেলে দুটির নাম রাধানাথ (১৭৯০-১৮৩০) ও দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬)।. মেয়ে দুটির নাম জাহ্ণবী ও রাসবিলাসী। সবার ছোটো দ্বারকানাথ। দ্বারকানাথের বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তার মা মেনকার মৃত্যু হয়। এরপর রামমণি ঠাকুর দুর্গামণি দেবীকে বিয়ে করেন। দুর্গামণির একটি ছেলে রমানাথ (১৮০০-১৮৭৭) এবং একটি মেয়ে দ্রবময়ীর জন্ম হয়।

ছোটো বোন মেনকার মৃত্যুর পরে দুধের শিশু দ্বারকানাথের লালন পালনের ভার তুলে নেন অলকা দেবী। তিনি তাকে স্তন্যপানও করান। সে সময় অলকাদেবীর পরামর্শে অপুত্রক রামলোচন দ্বারকানাথকে দত্তক নেন। এই দত্তক নেওয়াটা একই পরিবারের মধ্যে ঘটেছিল। দ্বারকানাথের বাবা-জ্যাঠা সহোদর দুভাই। মা-মাসি সহোদর দুবোন।

১৮০৭ সালে ডিসেম্বর মাসে রামলোচন উইল করে দ্বারকানাথকে তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে যান। উইলে লেখা হয়–

এখনও তুমি নাবালক একারণ এবং এই জমিদারি ওগায়রহ জে কিছু বিসয় তোমাকে দিলাম ইহার কর্ম্মকার্য্য জাবত আমি বর্ত্তমান থাকিব অর্থাৎ আমিই করিব আমার অবর্ত্তমানে জাবত তুমি বয়সপ্রাপ্ত না হও তাবৎ পরগণাদিগর এ সকল বিষয়রের কর্ম্মকার্য্য ও সহী দস্তখত বা বন্দবস্ত ও হুকুমহাকাম সকলি তোমার মাতা করিবেন তুমি প্রাপ্তবয়স হইলে জমিদারিদিগর আপন নামে হুজুর লেখাইয়া এবং আপন এক্তারে আনিয়া জমিদারির ও সংসারের কর্ম্মকার্য্য ও জমিদারির বন্দবস্ত ও খরচপত্র ওগায়রহ তোমার মাতার অনুমতি ও পরামর্শে তুমি করিবা এবং জাবৎ তোমার মাতা বর্ত্তমান থাকিবেন তাবৎ পরগণার মুনাফা ওগায়রহ জে কিছু  আমদানির তহবিল তোমার নিকট জেমন আমি রাখিতাম তুমিও সেইরূপ রাখিবা।

রামলোচন ঠাকুর এইভাবে নিজের স্ত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে তার স্বাভাবিক কর্ত্রিত্বশক্তির প্রতি সম্মানও দেখিয়েছেন।

এই উইল করার কয়েকদিন পরেই রামলোচর ঠাকুর ১৮০৭ সালের ১২ ডিসেম্বর মারা যান। দ্বারকানাথের বয়স তখন তের। তিনচার বছর সম্পত্তি দেখাশুনা করেন তার মা অলকা দেবী ও দ্বারকানাথের আপন বড় ভাই রাধানাথ। এর পরে দ্বারকানাথ নিজেই সব নিজেই পরিচালনা করতে শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স ১৬/১৭ বছর।

দ্বারকানাথ ঠাকুর—বাঙালি প্রিন্স বলিয়া ইংরেজরা আদর করিত

বাল্যকালে প্রথামতো কিছুদিন দ্বারকানাথ পাঠশালায় পড়াশুনা করেন। পরে মৌলবীর কাছে ফার্সি ও আরবী ভাষা শেখেন। সে সময়ে মুগলদের অনুসরণে ফার্সি ভাষা রাজভাষা হিসাবে প্রচলিত ছিল। ইংরেজরা প্রথমদিকে এদেশের শিক্ষা নিয়ে ভাবিত ছিল না। তখন কিছু ইংরেজ ইংরেজি শেখার স্কুল খুলেছিলেন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য। কিছু মিশনারীগণও কোম্পানীরকে পাশ কাটিয়ে স্কুল করেছিলেন। সে রকম একটি স্কুল খুলেছিলেন শেরবোর্ন সাহেব কোলকাতার চিৎপুরে। সেখানে দ্বারকানাথ ইংরেজি শেখেন। এছাড়াও পরে রামমোহন রায়ের বন্ধু উইলিয়াম অ্যাডাম, ডিজে গর্ডন, জেমস কলরড প্রমুখের কাছেও ইংরেজি ভাষার তালিম নেন। সেকালে ইংরেজি ভাষা শেখা ছাড়া বিত্তবৈভব অর্জন করা সম্ভব ছিল না। যারা ধনী হয়েছিলেন তারা সবাই-ইংরেজির শেখার গুণে ইংরেজদের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ধনী হয়েছিলেন। দ্বারকানাথও এই ঘরাণার উন্নত সংস্করণ। ইংরেজদের দেওয়ান রাজা রামমোহন রায় তাঁর পাইওনিয়ার। তারা দুজনেই ধনীদের প্রতিনিধি। গরীবপ্রজাদের নয়।

রামলোচন ঠাকুরের জমিদারি ছিল উড়িষ্যার কটকে ও পূর্ববঙ্গের বিরাহিমপুর মহলে। বছরে এই দুটি মহল থেকে তাঁর আয় হত তিরিশ হাজার টাকা। দ্বারকানাথ ১৬/১৭ বছরে জমিদারির দায়িত্ব নিয়েই সন্তুষ্ঠ ছিলেন না। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।  প্রতিভাবলে উপার্জনের নানা শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে দিয়ে কলাগাছ থেকে বটগাছ এবং বটগাছ থেকে তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর হয়েছিলেন। সেটা ইতিহাস। এই ইতিহাসের পেছনে কাজ করেছে তাঁর সহজে আয়ত্ত্বাধীন  ইংরেজিভাষা আর বহুমুখী উদ্যোগ।

একটি দলিলে জানা যায়, কুষ্টিয়ার বিরাহিমপুরের প্রজারা 'দুর্বত্ত বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিল'।. এই জটিলতাপূর্ণ জমিদারি পরিচালনা করতে গিয়ে দ্বারকানাথ আটঘাট বেঁধে জমিদারি আইনকানুনগুলো ভালোভাবে শিখে নিয়েছিলেন। এই বিষয়ে তিনি এত কুশলতা অর্জন করেছিলেন যে অন্যান্য জমিদারগণ তাঁকে জমিদারির নানা  সমস্যা নিরসনে ও  আইনকানুন বিষয়ে পরামর্শক নিয়োগ করতেন। পরে সুপ্রীম কোর্টের ব্যারিস্টার ফার্গুসনের নিকট থেকে তিনি আইন বিষয়ে গভীর পাঠ গ্রহণ করেন। এভাবে স্বাধীন আইন পরামর্শক হিসাবে তাঁর উপার্জন বেশ ভালো ছিল।

রাজা রামমোহন রায়ের বন্ধু উইলিয়াম অ্যাডাম ও ডিজে গর্ডন বিখ্যাত সওদাগরী প্রতিষ্ঠান ম্যাকিনটস এন্ড কোম্পানীর অংশীদার ছিলেন। তাদের সহায়তায় দ্বারকানাথ ম্যাকনটস কোম্পানীর গোমস্তা পদে যোগ দিয়ে রেশম ও নীল কিনতে তাদের সাহায্য করেন। এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি নিজেও রেশম ও নীল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন।

১৮১৮ সালে চব্বিশপরগণার কালেক্টর অফিসে সেরেস্তাদার পড়ে তাঁর চাকরী হয়। এই চাকরীটি আগে রাজা রামমোহন রায়ের সুপারিশে তিনি পান।  রামমোহন রায় নিজেও ইংরেজদের সেরেস্তাদার ছিলেন। দ্বারকানাথ আপন প্রতিভাবলে ১৮২২ সালে ২৪ পরগণা কালেক্টর ও নিমক মহলের অধ্যক্ষ প্লাইডেনের দেওয়ান নিযুক্ত হন। ১৮২৮ সালে শুল্ক ও আফিম বোর্ডের দেওয়ান পদে উন্নীত হন। ভালো আয় করা সত্ত্বেও তিনি ১৮৩৪ সালে কোম্পানীর চাকরী ছেড়ে দিয়ে নিজেই স্বাধীনভাবে ব্যবসা শুরু করেন।

১৮২৮ সালে ম্যাকিনটস কোম্পানীর ইংরেজ বন্ধুরা তাকে কোম্পানীর অংশীদার করে নেয়। এই কোম্পানীর কমার্শিয়াল ব্যাংকের ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। পরের বছর ১৮২৯ সালে১৬ লাখ টাকা মূলধন নিয়ে তিনি ইউনিয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যান্য ব্যবসা দেখার জন্য বাংকের কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ করেন তার ছোটো ভাই রমানাথকে। ১৮৩০ সালে তিনি কালীগ্রাম ও ১৮৩৪ সালে সাহাজাদপুরের জমিদারী কেনেন।

এই সময় উইলিয়াম কার নামে এক ইংরেজ বন্ধুর সঙ্গে কার-ঠাকুর কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেন। এই কোম্পানীর সাহায্যে দ্বারকানাথ চীন থেকে রেশম আমদানী করেন। এছাড়া বহুবিধ ব্যবসাবানিজ্যের মধ্যে অন্যতম হল—ক্যালকাটা স্টিম টাগ অ্যাসোসিয়েশন, দ ফ্লোটিং ব্রিজ প্রজেক্ট, দ বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যারহাউজ অ্যাসোসিয়েশন, দ ক্যালকাটা ডকিং কোম্পানী, দ বেঙ্গল সল্ট কোম্পানী, দ স্টিম ফেরি ব্রিজ কোম্পানী, দ বেঙ্গল টি অ্যাসোসিয়েশন, দ বেক্ষল কোল কোম্পানী, এবং ইন্ডিয়া জেনারেল নেভিগেশন কোম্পানী। রেললাইন বানিয়ে রেল কোম্পানীরও পত্তন করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু মৃত্যু তাঁকে থামিয়ে দেয়। কার এন্ড টেগর কোম্পানী বন্ধ হয়ে যায়। ইউনিয়ন ব্যাংকেরও পতন ঘটে।

১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ হারায়। তার কিছু সুবিধা ভোগ করেন দ্বারকানাথ। তার জমিদারি বিরাহিমপুরের কুমারখালি মৌজায় অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রেশম কুঠিটি কিনে নেন। স্থাপন করেন রামনগরে চিনির কারখানা, রানীগঞ্জে খনি থেকে কয়লা তোলার বেঙ্গল কোল কোম্পানী। আসামের চা প্রথম আমদানি করেন। এ ছাড়া কার এন্ড টেগোর কোম্পানীর প্রধান ব্যবসা নীলের চাষ ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের নীলের কুঠি ছিল। এই নীল ব্যবসাটিই ছিল সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত কারবার। তাদের অফিসকে লোকে নীলের বাজার বলে চিনত। এই ব্যবসা সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য তিনি ইংরেজদের নিয়োগ দিতেন। স্থানীয় বাঙ্গালীরা ইংরেজদের ভয় পেত। ফলে তাদের ব্যবসা চলেছে ইস্ট ইস্টিয়া কোম্পানীর স্টাইলেই। কোনো কোনো ব্যবসা-বানিজ্য আইনসংগত বা ন্যায়সংগত ছিল বলে মনে করেননি গবেষকগণ। তাঁদের কিছু সন্দেহ ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো এই কারণে দ্বারকানাথ সম্বন্ধীয় দলিলপত্রাদি পুড়িয়ে ফেলেন। তাই দ্বারকানাথের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহের সঠিক অনুসন্ধান করার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন জীবনীকার ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

জমিদারদের শক্তিকে সংহত করতে এবং তাদের সমস্যা সম্পর্কে সরকারকে সচেতন করার জন্য ১৮৩৮ সালে জমিদার-সভা বা ল্যান্ড-হোল্ডার্স এসোসিয়েশন স্থাপন করা হয়। তিনি এর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি প্রজাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কিছু করেছেন কিনা তেমন কোনো তথ্য জানা যায় না।

ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনীতে লিখেছেন, অনেকগুলি ঘটনা তাঁহার উপার্জনের সহায় হইয়াছিল। প্রথমত তিনি নিজে পৈতৃক জমিদারির অধিকারী ছিলেন, তাহা হইতে বাৎসরিক আয় ন্যূনাধিক ষাট হাজার টাকা আয় হত। সে সময়ে তাহার খরচ পরিবার হিসাবে ধরিলে বাৎসরিক দুই-তিন হাজারের অধিক হইবে না। আমরা তৎস্থানে দশ হাজার ধরিলেও বৎসরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা করিয়া সঞ্চিত হইবার অবসর ছিল। ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দ হইতে দেখি যে প্রতি দশ বছরে তাহার পাঁচ লক্ষ টাকা জমিত।

দ্বারকানাথ তখনকার দিনে ভারতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনীই শুধু নয়—প্রভুত সমাজিক সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করেন। নিজে ছিলেন বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান। তিনি নিজে প্রথম প্রথম মদ্য-মাংস খেতেন না। নিরামিষ খেতেন।

রামমোহন রায়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে দ্বারকানাথের পারিবারিক ধর্মাচরণে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। তিনি নিরামিষ ছেড়ে মাংস-পিঁয়াজ-মদ খাওয়া শুরু করেন। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন—শুনিয়াছি যে প্রথম প্রথম যখন দ্বারকানাথ ও রমানাথ রামমোহন রায়ের কথামত মাংসাহারে প্রবৃত্ত হইলেন, তখন উভয়েরই শরীর অসুস্থ হইয়া পড়িত এবং উভয়েই বমি করিয়া পরিত্রাণ পাইতেন। ক্রমে যখন অভ্যাস হইয়া পড়িল, তখন বাটির এক বহিঃপ্রান্তে মাংস রাঁধিবার বন্দোবস্ত হইল। রামমোহন রায় বড়ই মুসলমান প্রিয় ছিলেন। তাহারই অনুকরণে দ্বারকানাথও মুসলমান বাবুর্চি রাখিয়াছিলেন। ক্রমে দ্বারকানাথের সঙ্গে ইংরাজদেরও ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি হওয়াতে প্রকাশ্যেই তাহাদের সঙ্গে বসিয়া আহারাদি করিতেন। রামমোহন রায়ের অনুকরণে তিনিও অল্প পরিমাণে সেরি মদ্য পান করিতেন।

দ্বারকানাথে পত্নী দিগম্বরী দেবী খুবই ধর্মপরায়ণা ছিলেন। তিনি স্বামীর নিরামিষ বাদ দিয়ে মদ্য-মাংস খাওয়ার এই নবলদ্ধ আভ্যাসকে পছন্দ করেননি। তিনি  অনেক চেষ্টা করেছিলেন তাঁকে এই পথ থেকে ফেরাতে। কিন্তু তাঁর স্বামী ফেরেননি দেখে, রীতিমত ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের ডেকে মতামত চেয়েছিলেন ম্লেচ্ছ সংসর্গে পানভোজনে মত্ত স্বামীর সঙ্গে বসবাস করা ধর্মসংগত হবে কিনা। স্বামীসেবা অবশ্য কর্তব্য বলে রায় দিলেও তাঁকে স্বামীর সংগে এক সঙ্গে থাকতে তারা নিষেধ করেন। ফলে দিগম্বরী দেবী স্বামীর দেখভাল  করলেও সর্বপ্রকার সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন। শোনা যায়, যতবার দ্বারকানাথের সঙ্গে তিনি কথা বলতে বাধ্য হতেন—ততবারই তাঁকে সাতঘড়া গঙ্গাজলে স্নান করতে হত। এভাবে ঠাণ্ডা লেগে অসুস্থ হয়ে মারা যান দিগম্বরী দেবী।

স্ত্রীর আপত্তির ফলে দ্বারকানাথ বসতবাটির পরিবর্তে বেলগাছিয়ায় একটি বাগানবাড়ি কিনে বহুমূল্য আসবাবপত্রে সজ্জিত করে সেখানে তাঁর ভোজসভা ও নৃত্যগীত ইত্যাদির আয়োজন করতেন। এইসব আয়োজনে সে সমযে ইংরেজ সাহেবরা নিমন্ত্রণ পেলে কৃতার্থ বোধ করত।

সে সময়ের একটি সংবাদপত্রে কাগজে হেডলাইন প্রকাশিত হয়েছিল—

শ্রীযুত বা্বু দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যানে মহাভোজ ও তামাশা।–গত সোমবার রজনীতে শ্রীযুত বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর স্বীয় অত্যুত্তম উদ্যানে শ্রীলশ্রীযুত গবরনল জেনরল বাহাদুর ও অন্যান্য ন্যূনাধিক তিন শত সাহেব ও বিবি সাহেব লোককে মহাভোজন করাইয়া পরমসন্তোষক তামাসা দর্শাইলেন। বিশেষত: নৃত্যগীত, বাদ্য ও বহ্ণুৎসবজনক ও অত্যুৎকৃষ্ট বহুবিধ ভোজ্য সামগ্রী প্রস্তুত ছিল।…অনন্তর মহানাচ শুরু হইল।

কোলকাতায় সে সময় একটি গান জনপ্রিয় হয়েছিল—

বেলগাছিয়ার বাগানে হয়

ছুরি-কাটার ঝনঝনানি,

খানা খাওয়ার কত মজা

আমরা তার কি জানি?

জানে ঠাকুর কোম্পানি।।

একটা বর্ণনা পাওয়া যায় ফেনী পার্কসের বিবরণে, সময়টা ১৮২৩ সালে—দূর্গাপূজায় :

পূজা মণ্ডপের পাশের একটা ঘরে নানা রকমের উপাদেয় সব খাদ্যদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে সাজানো ছিল। সবই বাবুর ইউরোপীয় অতিথিদের জন্য বিদেশী পরিবেশক 'মেসার্স গান্টার অ্যান্ড হুপার' সরবরাহ করেছিলেন। খাদ্যের সঙ্গে বরফ এবং ফরাসি মদ্যও ছিল প্রচুর। মণ্ডপের অন্য দিকে বড় একটা হল ঘরে সুন্দরী সব পশ্চিমা বাইজিদের নাচগান  হচ্ছিল, এবং ইউরোপীয় ও এদেশী ভদ্রলোকেরা সোফায় হেলান দিয়ে চেয়ারে বসে সুরাসহযোগে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। হান্টার সাহেব লিখেছেন—এইসব নাচ দেখে দূর থেকে এ দেশের গ্রামের লোকেরা অবাক হত। তাদের এখানে যোগদানের কোনো সুযোগ ছিল না। দূর থেকে দেখা যেত কিছু হিছু দৃশ্য আর শোনা যেত বাদ্য আর গানের সুর।

জানা যায় মেম পটানোতেও দ্বারকানাথ খুব ওস্তাদ ছিলেন। অর্থ ও প্রতিপত্তির জোরে পছন্দের যে কোনও লেডিকে তিনি কাছে টানতে সমর্থ। বিখ্যাত অভিনেত্রী ইসথার লিচ-এর সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্বের কাহিনী সেকালে সবাই জানতেন। তিনি এবং তাঁর ষোড়শী কন্যাকে দ্বারকানাথ কেমন করে নিজের নাগালে রেখেছিলেন সেটাও ছিল সেকালের অন্যতম মুখরোচক কাহিনি। মিস হার্ব নামে এক লেডি দ্বারকানাথকে লিখেছেন,–'বিয়ে হয়ে যাওয়ার আগে একবার তোমার সঙ্গে বসে খেতে চাই'।. চিঠির শেষ বাক্যে লেখা আছে-'বিলিভ মি অলওয়েজ অ্যান্ড এভার টু বি ইওর সিনসিয়ার অ্যান্ড আই ডে সে নট ফারদার।…।. বিলেতে দ্বারকানাথ গেলে সেখানেও তিনি বিস্তর মেম সাহেবদের সঙ্গে খাতির জমিয়েছিলেন। তার অন্যতম বান্ধবী ছিলেন সুরসিকা ইংরেজ কবি এবং রূপসী ক্যারোলিন নর্টন। সবে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে তাঁর। শহরে তাঁর বিষয়ে নানা গুঞ্জন। দ্বারকানাথের জন্য তিনি আয়োজন করেছিলেন কবি ও সাহিত্যিকদের নিয়ে স্মরণীয় নৌ-পার্টির। সেই আসরে হাজির ছিলেন স্বয়ং চার্লস ডিকেন্স। ব্লেয়ার বি ক্লিং লিখছেন—দ্বারকানাথ এসব ব্যাপারে ঢাকাঢাকি পছন্দ করতেন না।সর্ববিষয়েই তিনি ইংরেজদের সঙ্গে ভারতিয়দের পার্টনারশিপ চাই। নারী বাদ যাবে কেন।

এসবই ছিল সাহেব ধরার কায়দা কৌশল। পয়সাকড়ি কামানোর নিত্যনতুন ফন্দি।

দশম পর্ব————————————————————

রামমোহন রায় : ঠাকুরদের বদলে দেওয়ার মানুষ

রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে  দ্বারকানাথের পরিচয় ঘটে ১৮১৫ সালে। এই পরিচয় ঠাকুরপরিবারের জন্য একটি বদলে যাওয়ার ঘটনা।

১৭৭২ সালে রামমোহন রায় হুগলীর এক গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা পারিবারিক প্রথাঅনুযায়ী ছেলেকে সংস্কৃত শিক্ষাটা খুব ভালো ভাবে দেন। তবে তিনি জানতেন—সংস্কৃত শিক্ষা পণ্ডিতের উপযুক্ত হতে পারে, কিন্তু জীবিকার জন্য সেটা লাভজনক নয়। জীবিকার জন্য তাকে পাঠানো হল পাটনায়। সেখানে ভালো করে আয়ত্ব করেছেন ফার্সি ও আরবী ভাষা। এদুটো ভাষা তখনকার রাজভাষা। এ দুটো ভাষা ছাড়া বিত্ত অর্জন অসম্ভব।

সে সময় সবে কোম্পানীর শাসন চলছে। দেশে জীবনবিনাশী সত্তরের মন্বন্তর শুরু হয়েছে। দেশে মানুষ মরে-ছেড়ে যাচ্ছে। সন্নাসী-ফকির বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। বাংলায় সংসারবিহীন হিন্দুকে  সন্নাসী বলে। আর সংসারবিহীন মুসলমানকে ফকির বলে। সুবা বাংলার  ভাগলপুর-পূর্ণিয়া থেকে শুরু করে রংপুর-বগুড়া পর্যন্ত এই  সন্নাসী-ফকিরদের আন্দোলন হয়। হেস্টিংস এদেরকে 'the gypsies of Hindustan', বঙ্কিমচন্দ্র ডাকাইত আর যামিনীমোহন গাঙ্গুলি Raiders বলেছেন। প্রাবন্ধিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত বলেছেন,  আকাশেবাতাসে তখন মন্বন্তরের হাহাকার, অন্যদিকে খাজনা আদায়কারীদের হুঙ্কার এবং সেই পরিস্থিতির মধ্যে থেকে উত্থিত হয়েছে  সন্নাসী-ফকিরদের ইংরেজ কোম্পানী ও বাহিনীর বিরুদ্ধে রণধ্বনি। সেই সময়টাতে দেবী সিংহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, চোয়াড় বিদ্রোহ, বাঁকুড়ার প্রজা বিদ্রোহ এবং সর্বোপরি  সন্নাসী-ফকির বিদ্রোহ ইত্যাদি একের পর এক ফেটে পড়েছিল। সুবে বাংলা তখন নরক।  সন্নাসী-ফকির বিদ্রোহের নেতার নাম মজনু শাহ। রামমোহন পরবর্তীতে যখন জন ডিগবির দেওয়ান হিসবে রংপুরে কাজ করেছেন—তখন তিনি প্রায়ই রংপুর থেকে তিন মাইল দূরে ফুলচৌকির রংমহলে আসতেন। মজনু শাহের অনুসারীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতেন।

সুফিবাদ

পাটনার পড়াশুনা করার সময়ে রামমোহন জীবিকার  ভাষা শিখতে গিয়ে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে গভীরভাবে জানার সুযোগ পান।  পরিচিতি হলেন সুফি সাধক ও যুক্তিবাদি মুতাজিলদের চিন্তাধারার সঙ্গে। সুফিরা মনে করেন, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে কোনো ফারাক নেই—তারা অভেদ। মানুষই সরাসরিভাবেই ব্যক্তিগতভাবে অদ্বৈতবাদের সাধনার মাধ্যমে স্রষ্টার সঙ্গে মিলিত হতে পারে। সুফিরা এই স্রষ্টাকে বললেন তওহীদ।

 

রক্ষণশীল মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, মানুষের কর্ম-অকর্ম, এমনকি প্রতিটি পদক্ষেপ, সমস্তই সৃষ্টিকর্তা বা আল্লাহর ইচ্ছায় সংগঠিত হয়। কি হবে না হবে, কে কি করবে না করবে—সবই পূর্ব নির্ধারিত। আল্লাহ সব ঠিক করে রেখেছেন। আল কোরআন চিরন্তন গ্রন্থ। কোনো মানুষ কর্তৃক রচিত হয়নি। এটা ঐশী গ্রন্থ। অভ্রান্ত।

মুতাজিলাবাদ–

মুতাজিলারা ছিলেন গ্রীক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত। তারা বললেন, মানুষের জন্য কুকর্ম বরাদ্দ করে সৃষ্টিকর্তা আবার তারই জন্য মানুষকে শাস্তি দিতে পারেন না। সৃষ্টিকর্তা স্বাধীন চিন্তা ও কর্মের অধিকার দিয়েছেন মানুষকে। নিজের স্বাধীনতাঅনুসারে ভালো কাজ বা মন্দ কাজ করার যে কোনোটাই সে বেছে নিতে পারে। সুতরাং মানুষের দোষগুণ বলে কোনো ব্যাপার থাকতে পারে না।   মুতাজিলারা বললেন, একমাত্র ঈশ্বরই চিরন্তন । তাকে কেউ সৃষ্টি করেনি। তিনিই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। সুফি ও মুতাজিলাদের চিন্তাধারাটা বে-শরা বা শাস্ত্রবহির্ভূত। রামমোহন দেখলেন, সুফিদের চিন্তার সঙ্গে ভারতীয় চিন্তার একটা মিল পাওয়া যায়।

রামমোহনের ধর্মঅভিযান–

রামমোহন ভারতীয় দর্শন, সুফিবাদ ও মুতাজিলদের চিন্তাধারা থেকে সিদ্ধান্তে এলেন, ঈশ্বর এক ও নিরাকার। তিনি সর্বত্র আছেন। ঈশ্বর এক বলে তাঁর সৃষ্টিও এক। মানুষ, স্রষ্টা ও মানবসমাজও এক। কোনো ভেদ নেই। মানুষ স্রষ্টার দেওয়ার অধিকার ভোগ করে। চিন্তায় ও কর্মে মানুষ স্বাধীন। মানুষ কোন কাজটি করবে তার জন্য ঈশ্বরের কাছে জবাবদিহিতা করার দরকার নেই। রামমোহনের এই চিন্তা লোকাচারবিরোধি। ফলে গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণ বাবা ছেলের উপর ক্ষেপে গেলেন। তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।

এরপর রামমোহন কিছুকাল দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ালেন। সে সময়ে বৌদ্ধ অধ্যূষিত হিমালয় অঞ্চল পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বৌদ্ধ ও তন্ত্র সাধনায় বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। এই দেশ ভ্রমণের সময়ে তিনি খুব গভীরভাবে খুব কাছ থেকে দেশের সাধারণ মানুষ ও তাঁদের জীবনযাত্র দেখার সুযোগ পান। তাঁর আত্মজীবনীমূলক পত্রে জানা যায়   ইংরেজ শাসিত দেশে জনসাধারণের দুর্দশা ও দুরবস্থা দেখে  সে সময় তিনি ইংরেজদের সম্বন্ধে প্রবল বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছিলেন তিনি।

এরপরে বারাণসীতে সংস্কৃত শিক্ষা করতে চলে যান। এখান থেকে সনাতন হিন্দু ধর্ম ও শাস্ত্রের আদি তথা মূল রূপ, উচ্চ ও শুদ্ধ সার জানার চেষ্টা করেন।

তিনি জীবনের এই পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেন একই সঙ্গে লক্ষ্মী সরস্বতীর সাধনা করবেন। তাঁর ভাবনাকে প্রকাশিত করতে গেলে রক্ষণশীলদের প্রবল বিরোধিতার সম্মুখিন হতে হবে। তাঁকে প্রতিরোধ করতে হলে আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হতে হবে। তিনি ১৮০৩ সালে মার্চ মাসে ফরিদপুরের কালেক্টর টমাস উডফোর্ডের অধীনে দেওয়ান পদে দুমাসের জন্য চাকরি নিলেন। প্রায় বছর খানেক পরে রামমোহন আবার মুর্শিদাবাদে উডফোর্ডের অধীনে কাজ করলেন। এরপর তিনি চাকরি নিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে কোম্পানীতে। ইংরেজদের সঙ্গে কাজ করতে করতে ইংরেজি ভাষাটা শিখে নিলেন খুব ভালোভাবে। ভাষার সঙ্গে ইউরোপীয় জ্ঞানবিদ্যা চিন্তাভাবনাও আয়ত্ত করে নিলেন।

বই লেখা–

তিনি প্রথম লিখলেন একটি পুস্তিকা। নাম তুহফৎ-উল-মুওয়াহিদদিন। অর্থ একেশ্বরবাদীদের প্রতি উপহার। বইটির ভূমিকা আরবিতে লিখেছেন। মূল লেখা ফার্সিতে।  নিজের পয়সায় প্রকাশ করে বিতরণ করলেন। দ্বিতীয় বই লিখলেন মনজারৎ-উল-আদিয়ান বা বিভিন্ন ধর্মের আলোচনা। বেদান্ত, লোকাচারসিদ্ধ হিন্দুধর্ম, বা-শরা বা শাস্ত্রীয় ইসলাম, সুফীবাদ বা বে-শরা ইসলাম, বৌদ্ধধর্ম ইত্যাদি সম্পর্কে একটি তুলনামুলক আলোচনা করেছেন এই বইতে। তিনি এ সময়ে খুঁজছেন ভারতে প্রচলিত ধর্মসমূহের সঙ্গে সারাবিশ্বের ধর্মেরসমূহের একটি যোগসূত্র।

১৮০৫ সালে তৃতীয়বার রামমোহন চাকরি নিলেন কোম্পানীতে। কর্মস্থল রাঁচিতে। জেলা আদালতের নিবন্ধক ও জেলা শাসকের সহকারী জন ডিগবির অধীনে কাজ করতে করতে প্রচুর  ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের বই-পত্র-পত্রিকা পড়ার সুযোগ পেলেন। ১৮১৫ সালে তিনি ভুটানে যান কোম্পানীর দূত হিসাবে। ডিগবি লিখেছেন, ফরাসি বিপ্লবের কাহিনী রামমোহনের বিশেষ প্রিয় ছিল এবং এই বিপ্লবের আদর্শ ও উদ্দেশ্য থেকে তিনি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।  

প্রথম যৌবন থেকেই তিনি তেজারতি বা সুদে টাকা ধার দেওয়ার  ব্যবসার শুরু করেন। তার এই ব্যবসায়ের পার্টনার ছিলেন অ্যান্ডরু র‍্যামজে, টমাস উডফোর্ড প্রমুখ।এই ইংরেজরা কোম্পানীতে  চাকরী করতেন। সে সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ছাড়া আর কেউ ব্যবসা বানিজ্য করতে পারবে না। রামমোহনের অংশীদারটি গোপনে এই তেজারতির কারবারটি করতেন। সুদের টাকা দিতেন মূলত ইংরেজ ব্যবসায়ীদেরকেই।  রামমোহন এই কারবারের সঙ্গে ধীরে ধীরে গোবিন্দপুর, রামেশ্বর, বীরলুক, শ্রীরামপুর ও কৃষ্ণনগর তালুকগুলি কেনেন। এই তালুক থেকে তাঁর বার্ষিক আয় ছিল এগার হাজার টাকা। এইভাবে জ্ঞানী রামমোহন সেকালে বিত্তবান হয়েছিলেন।  

১৮১২ সালের আগে থেকেই  রামমোহন  কোলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস না করলেও আন্তর্জাতিকভাবে তার ভাবনা বেশ সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল। ১৮১২ সালে স্পেনের প্রগতিশীল লোকেরা একটি বিকল্প সংবিধান প্রণয়ন করেন। সেটি তারা উৎসর্গ করেন রামমোহন রায়ের নামে। শুধু ইউরোপ নয় আমেরিকার ভাবুকরাও তার ভাবনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।

১৮১৪ সালে রামমোহন রায় রংপুর থেকে এসে কোলাকাতায় বসবাস করতে শুরু করেছেন। তখন তিনি আত্মীয়সভা স্থাপন করেছেন। আত্মীয় সভার বৈঠক বসত তাঁর মানিকতলার বাগান-বাড়িতে। পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুর, টাকীর কালীনাথ ঠাকুর ও বৈকুণ্ঠনাথ মুনশি, রাজেন্দ্রলাল মিত্রের পিতামহ বৃন্দাবন মিত্র, বিচারপতি অনুকূল মুখোপাধ্যায়ের পিতামহ বৈদ্যনাথ মুখেপাধ্যায়, ভূকৈলাসের কালীশঙ্কর ঘোষাল, তেলেনিপাড়ার অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসুর পিতা নন্দকিশোর বসু প্রমুখ আত্মীয়সভায় নিয়মিত যেতেন। জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথ সেখানে যেতে শুরু করেছেন। বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তাদের দুজনের মধ্যে। সেখানে ধর্ম, দেশের পরিস্থিতি, শিক্ষা ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হত।

বদলে দেওয়ার ভাবনা--

সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন—সে সময়ে রাজা রামমোহন রায় প্রচলিত দেশী ধর্মব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছেন। শুরু করলেন ধর্মসংস্কারের আন্দোলন। ইসলাম ও খ্রীস্টান ধর্মের প্রভাবে তিনি একেশ্বরবাদের প্রচারে নেমে পড়লেন। দ্বিতীয় কাজটি করলেন—সমাজসংস্কারণ আন্দোলন। সতীদাহ প্রথা নিবারণের জন্য আন্দোলন। তৃতীয় কাজটি করলেন, দেশীয় আইন-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে। মেয়েদের জন্য পৈত্রিক সম্পত্তিতে অংশ দাবী করলেন। অতঃপর তৎকালীন গভর্নর জেনারেলের কাছে তিনি দেশবাসীর জন্য দাবি করলেন প্রকৃত আধুনিক শিক্ষা এবং সেই সঙ্গে অই শিক্ষার সংজ্ঞা ও পাঠক্রমও তিনি দিয়ে দিলেন।

হিন্দু কলেজ : পরিবর্তনের সুতিকাগার–

১৮১৭ সালে ২০ জানুয়ারী কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কোম্পানী এই কলেজ প্রতিষ্ঠায় কোনো অর্থ বরাদ্দ করেনি। কোলকাতার ধনী বাবুরা অর্থ সাহায্য দিয়ে কলেজটি স্থাপন করেন। রামমোহন কলেজের উদ্যোক্তা হলেও তৎকালীন গোড়া হিন্দুরা তার ভাবনাকে পছন্দ করত না। তিনি থাকলে এই উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে আশঙ্কায়  তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়। নামে হিন্দু কলেজ হলেও সেখানে বাংলা ভাষার কোনো স্থান ছিল না। সেখানে পড়ানো হত ইংরেজি, ফার্সি, আরবি ইত্যাদি।  ছাত্ররা ইংরেজী ভাষা জানলেও বাংলাতে খুবই দুর্বল ছিলেন। জন ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনের প্রস্তাবে ১৮৫৩ সালে  সেখানে একজন  বাংলার অধ্যাপক নিয়োগ করা হয়। । হিন্দু কলেজের ছাত্ররা যুক্তিবাদ, উদারনৈতিকতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পাঠও নিয়েছিল তখন।

হিন্দু কলেজে মিশ্র পর্তুগীজ বংশোদ্ভুত শিক্ষক ডিরোজরিওর ছাত্ররা যুক্তির আলোকে ধর্মকে দেখার প্রয়াস পেয়েছিলেন। কোনো কিছুকেই আপ্তবাক্য হিসাবে গ্রহণ না করে প্রত্যেকটি বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা এবং বিচার-বিশ্লেষণ করে সত্যসিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আদর্শ তাঁর কাছ থেকে ছাত্ররা শিখেছিলেন। এই কলেজের ছাত্ররাই পরবর্তী সময়ে উনিশ শতকের রেনেসাঁ বা পূনর্জাগরণের নায়ক। হিন্দু কলেজ স্থাপিত হওয়ার পনেরো বছরের মধ্যেই এই ছাত্ররা তাঁদের পোষাক আশাক, খাবার অভ্যাস, বক্তব্য এবং জীবনযাত্রা দিয়ে রক্ষণশীলতার উপর প্রবরভাবে আক্রমণ চালিয়েছিলেন।  শুরুতে কেবল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের এই কলেজে প্রবেশাধিকার থাকলেও  ১৮৫৩ সালে হিন্দু কলেজটি সকল সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৮৫৫ সালে নাম পাল্টে প্রেসিডেন্সি রাখা হয়।

 হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পরের বছর ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুরে একটি মিশনারী কলেজ স্থাপিত হয়। ১৮২১ সালে নিজের সম্পাদিক সম্বাদ কৌমদী পত্রিকায় রামমোহন দেশের দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বিনা খরচে আধুনিক শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কোম্পানীর সরকারের কাছে আবেদন জানান। কোম্পানী এটা বাস্তবায়ন না করলে তিনি নিজেই ১৮২২ সালে আপন ব্যয়ে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্কুল নামে একটি ছোটো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। দ্বারকানাথ তাঁর ছেলে দেবেন্দ্রনাথকে এই স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। এই বিদ্যালয়ে আধুনিক শিক্ষার তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য তিনি সম্বাদ কৌমুদী পত্রিকায় প্রাথমিক বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা প্রকাশ করতে শুরু করেন।

সংবাদপত্রে স্বাধীনতা--

ইতিমধ্যে ১৮১৮ সালে রেগুলেশন নামে একটি বিধি প্রবর্তিত হয়েছিল। এই বিধির বলে সরকারি নীতির সমালোচনা বা বিরুদ্ধতার অপরাধে যে-কোনও ব্যক্তিকে—তা ইউরোপীয়ই হোন বা ভারতীয়ই হোন—কারণ দর্শাবার বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কারাগারে আটক করা যেত। রামমোহন এই বিধির বিরোধিতা করে কোম্পানীর সরকারকে চিঠি দিলেন। ১৮২৩ সালে প্রেস অর্ডিন্যান্স অ্যাক্ট নামে একটি আইন জারি করা হয়। তাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল—বিনা সরকারি অনুমোদনে সরকারি নীতি সংক্রান্ত কোনও সংবাদ বা আলোচনা সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশ করা যাবে না। এটা স্পষ্টতই ছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ। সে সময়ে তিনি লিখছেন—রাষ্ট্রশাসনের ব্যাপারে জনসাধারণের মতামত দেওয়ার এবং সমালোচনা করার অধিকার আছে। জনসাধারণের মতামত ও বিবেচনা অনুসারে শাসককে রাষ্ট্রশাসন করতে হবে। এবং তিনি আরও বললেন—অবস্থাবিশেষে জনসাধারণ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে। ১৮৩৫ সালে অই কালো আইন  উঠে যায়। দ্বারকানাথ ঠাকুর এই আইন বাতিলে রামমোহনের ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে জানপরাণ দিয়ে লড়েন। পাশাপাশি সতীদাহ প্রথা বাতিলের আন্দোলনেও   তিনি সব সময়ই রামমোহনের সহকারী হয়ে উঠেছিলেন।

ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণার সূত্রপাত–

রামমোহন জমিদারেরসঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমালোচনা করেছিলেন। তিনি এই প্রথা বাতিলের দাবী তুলেছিলেন। বলেছিলেন চিরম্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারকে নয়—দিতে হবে কৃষককে। তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণাটি এনেছিলেন। বলেছিলেন,  ব্যক্তিস্বাধীনতার শুরুতে আছে ক্ষুদ্রতম এককের যিনি কর্তা, তাকে সমালোচনা করার অধিকার থাকতে হবে। পরিবারের প্রধানকে সমালোচনা করবেন স্ত্রী, ছেলে মেয়ে সবাই। বৃহত্তর এককের কর্তা হলেন জমিদার। তাকে সমালোচনা করার অধিকার থাকবে প্রজাদের।  তিনি দাবী তুললেন নারীকে সম্পত্তির অধিকার দিতে হবে। কৃষককে জমির মালিকানা দিতে হবে। এই বস্তুগত অধিকার দিলেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। এই পরিবর্তন থেকেই আসবে ব্যক্তিস্বাধীনতা।

রাজনীতির উন্মেষ–

এর আগে এদেশের মানুষ জানতেন না দেশের শাসন ব্যবস্থায় প্রজারও একটি স্থান আছে—আধিকার আছে। কিভাবে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে সে বিষয়ে প্রজার মতামত থাকতে নেই। প্রজারা জানে রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার  রাজা-বাদশা-জমিদারদের। প্রজাদের ভালোমন্দ ভাবনা ভাববেন শুধু এই শাসক সম্প্রদায়। রাজনীতি নিয়ে শুধু সেই অতি ক্ষুদ্র গোষ্ঠির অন্তর্ভূক্তরাই মাথা ঘামাত যারা কোনো না কোনোভাবে শাসন-ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। প্রজারা রাজনীতি জানত না। সে সময়ে যে সব প্রজাবিদ্রোহ হয়েছিল সেখানে প্রজারা নিজেদের ক্ষমতায়নের কথা কখনো ভাবতে পারেনি।  তারা কেবল সচেতন ছিল ধর্ম সম্বন্ধে। আর ধর্ম সকলকালেই শাসিতদের পক্ষে থেকেছে।   সে সময়ে রামমোহন রায় লিখেছেন—রাজনৈতিক সুবিধা ও সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আধ্যাত্মিক ধর্মের সংস্কার দরকার। তিনি লিখেছেন, যাহা শিক্ষা দেয় যে, সমস্ত দৃশ্যমান বস্তুর কোনো যথার্থ অস্তিত্ব নাই, পিতা-ভ্রাতা প্রভৃতির কোনো প্রকৃত সত্তা নাই, সুতরাং তাহাদের মধ্যে কোনো পারস্পরিক স্নেহের সম্পর্ক নাই এবং সেইজন্য যত শীঘ্র পারি তাহাদের ও এই পৃথিবী ছাড়িয়া যাইতে পারিলেই মঙ্গল, সেই ধর্মের সঙ্গে কোনো যোগ থাকার কোনো দরকার নাই।

রাজা রামমোহনের এই ভাবনাগুলো তখন বঙ্গে বাংলার গণজাগরণের সূত্রপাত ঘটাচ্ছে। দ্বারকানাথ রামমোহনের প্রতিটি কাজের সঙ্গে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন। নিজেদের ব্যবসামনোবৃত্তিটার বদলে বুদ্ধিবৃত্তিক বিত্তের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। রামমোহন ধর্মীয় বাঁধা অমান্য করে বিলেতে গিয়েছিলেন। দ্বারকানাথও তাই।  

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তিকালে লিখেছেন একদা পিতৃদেবের নিকট শুনিয়াছিলাম যে, বাল্যকালে অনেক সময়ে রামমোহন রায় তাঁহাকে গাড়ি করিয়া স্কুলে লইয়া যাইতেন; তিনি রামমোহন রায়ের সম্মুখবর্তী আসনে বসিয়া সেই মহাপুরুষের মুখ হইতে মুগ্ধদৃষ্টি ফিরাইতে পারিতেন না, তাঁহার মুখচ্ছবিতে এমন একটি সুগভীর সুগম্ভীর সুমহৎ বিষাদচ্ছায়া সর্বদা বিরাজমান ছিল।

একাদশ পর্ব————————————————–

জমিদারীর সঙ্গে আসমানদারীর সূত্রপাত

রামমোহনের অনুরোধে দ্বারকানাথ ঠাকুর বড় ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। সেখানে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত পড়েছেন। হিন্দু কলেজে ১৮৩১ সালে ভর্তি হন। ৩/৪বছর পড়াশুনাও করেন। তাঁর ভর্তি হওয়ার পরে ২৫ এপ্রিল ১৮৩১  ডিরোজিও পদত্যাগ করে চলে গেছেন। তার ক্লাশ দেবেন্দ্রনাথের করা  হয়নি। কিন্তু তাঁর শিষ্য ছাত্রদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সেখানে সর্বতত্ত্বদীপিকা নামে একটি সভা স্থাপিত হয়। দেবেন্দ্রনাথ এর সম্পাদক হন। সভার নিয়ম করা হয়েছিল—বঙ্গভাষা ভিন্ন এ সভাতে কোনো কথোপকথন হইবেক না। সে-সময়ের হিন্দু কলেজের শিক্ষিত নব্য যুবকেরা  ইংরেজি শিক্ষায় মেতে দেশি ভাষা-সাহিত্য-ধর্ম-সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা শুরু করেছিলেন। সুতরাং দেবেন্দ্রনাথ সে ধারার বিরুদ্ধে বাংলা চর্চাকেই তাদের প্রধান লক্ষ্য হিসাবে নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলেন। রামমোহনের প্রভাবে এ সভায় ধর্মবিষয়ক আলোচনাও অন্যতম লক্ষ্য হয়েছিল। সেখানে একেশ্বরবাদ, হিন্দু, ইসলাম, খ্রীস্টান, বৌদ্ধসহ সকল ধর্ম নিয়েই আলোচনা হত। ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের সর্বশেষ বিষয়াদিও অন্তর্ভুক্ত থাকত।

১৮৩৪ সালে হিন্দু কলেজ থেকে ছাড়িয়ে এনে দ্বারকানাথ ছেলে দেবেন্দ্রনাথকে ইউনিয়ন ব্যাংকে শিক্ষানবিশ কোষাধ্যক্ষ্ হিসাবে নিযুক্ত করেন। এ সময় দ্বারকানাথ সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য নানাবিধ নৃত্য-গীত-ভোজসভার আয়োজন করতেন। দেবেন্দ্রনাথ এই পরিবেশে বিলাস ব্যাসনের স্রোতে ভেসে যান।

১৮৩৮ সালে তাঁর ঠাকুরমা মারা যাওয়ার পরে তাঁর মনে বিচিত্রভাবের উদয় হয়। তিনি রাতারাতি পাল্টে যান। গভীর তত্ত্বজ্ঞান জানার বাসনা জাগে। তিনি মহাভারত, ইউরোপীয় দর্শনশাস্ত্র প্রচুর পড়েন। ঈশোপনিষদের একটি শ্লোক পড়ে তার উপনিষদে ভক্তি জন্মে। শ্লোকটি–

ঈশা বাস্যমিদং সর্ব্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।

তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা, মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম।।

অর্থ : পরিবর্তনশীল এই জগতে সবকিছুরই পরিবর্তন হচ্ছে। তথাপি সবকিছু পরমেশ্বরের দ্বারা আবৃত।  ত্যাগ অনুশীলন কর এবং সর্বভূতের চৈতন্যস্বরূপ আত্মায় দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হও। অপরের ধনে লোভ করো না। তিনি যা দিয়েছেন তাকে ভোগ করতে হবে।।

বহুচেষ্টায় পণ্ডিতদের সাহায্য নিয়ে তিনি এই শ্লোকটির অর্থ বুঝলেন। এই তত্ত্বজ্ঞানের সন্ধানই তিনি করে ফিরছিলেন। তিনি রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে নিয়মিত উপনিষদ অধ্যায়ন করলেন। সমধর্মি বন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন তত্ত্ববোধিনী সভা। প্রথমে নিজের বাড়িতে—পরে সুকিয়া স্ট্রিটে একটি বাড়ি ভাড়া করে সভার কাজ করেন। তার পিতা গভীরভাবে ধর্মলোকের চেয়ে ব্যবসালোকে বিচরণ করাটাকেই পছন্দ করতেন। আগে ব্যবসা—তারপর ধর্ম। রামমোহনের কাজেকর্মে তিনি সহায়তা করতেন বটে—কিন্তু তার হিন্দুধর্মকে বিসর্জন দিয়ে নয়। তিনি প্রতিদিন শাস্ত্রমেনে চলতেন। পূজার্চনা করতেন। ইংলণ্ডে সকালে এই পূজায় ব্যস্ত থাকার সময়ে রানীর প্রতিনিধি এলেও তাকে বসিয়ে রাখতেন। পূজা শেষে শেষে তার সঙ্গে দেখা করতেন। এই পূজাটা ছিল তার ব্যবসার জন্য বৃদ্ধির জন্য আরাধনা।

কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠিক উল্টোপথ বেঁছে নিলেন। তিনি বেছে নিলেন জ্ঞানসাধনার ধর্মপথ। তিনি উপনিষদের লোকাচারকে প্রশ্ন করে বসলেন রামমোহনের মতো। মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু পিতাকে অসম্মান করতে চাইলেন না। পিতার প্রত্যক্ষ নজর এড়াতে তিনি রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে যন্ত্রালয়ে গিয়ে পড়েছেন। একারণেই তিনি নিজের বাড়ি ছেড়ে আলাদা বাড়িতে তত্ত্ববোধিনী সভা সরিয়ে নিয়েছেন। এখানে তিনি বিষয়বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন।

রামমোহন রায় ইংলন্ড চলে গেলে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর তত্ত্ববোধিনী সভা নিয়ে লুপ্তপ্রায় আত্মীয়সভায় যোগ দিলেন ১৮৪২ সালে। সভাতে ধর্মালোচনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তখন। এছাড়া তত্ত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মধর্মের প্রচারের কাজটাও করা শুরু করে তাঁর নেতৃত্বে।

এ সময় দ্বারকানাথ বিলেত চলে গেলেন। তখন দ্বারকানাথের জমিদারী আর ব্যবসাবানিজ্য সব কিছুর দ্বায়িত্ব পড়েছে দেবেন্দ্রনাথের উপর। কিন্তু এসবে বদলে তার উৎসাহ ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের কাজে। ১৮৪৩ সালে বছর খানেক ইংলন্ডে কাটিয়ে দ্বারকানাথ কোলকাতায় ফিরে এলেন। এসে দেখলেন দেবেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী সভা ও তার প্রতিষ্ঠাতা দেবেন্দ্রনাথ রীতিমত বিখ্যাত হয়ে গেছেন। এই বছর ২১ ডিসেম্বর ২০ জন সঙ্গীসহ আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দিক্ষা গ্রহণ করেন। জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ তারা দীক্ষাগ্রহণের পরপরই বিস্কুট ও সেরী এনে খান। এগুলো হিন্দুরা তখন খেত না। দেবেন্দ্রনাথ লিখেছেন—জাতিভেদ আমরা মানি না, উহা দেখাইবার জন্য ঐরূপ করা হয়। খানা খাওয়া ও মদ্যপান করা রীতির জের রামমোহনের সময় হইতে আমাদের সময় পর্যন্ত টানিয়াছিল।

দ্বারকানাথের জীবিতাকালে এইসব কাজকর্মের খরচাপাতি যোগাড় করার একটি কৌতুককর বর্ণনা দিয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর—

তখন পরগণা থেকে টাকা আসত কলসীতে করে। কলসীতে করে টাকা এলে পর সে টাকা তোড়া বাঁধা হত।… এখন এই যে আমার নিচের তলার সিঁড়ির কাছে যেখানে ঘড়িটা আছে, সেখানে মস্ত পাথরের টেবিলে সেই টাকা ভাগ করে তোঁড়া বাঁধা হত।…কর্তদাদামশায় তখন বাড়ির বড়ো ছেলে। মহা সৌখিন তিনি তখন।..এবাড়ি থেকে রোজ সকালে একবার করে দ্বারকানাথ ঠাকুরকে পেন্নাম করতে আসতেন—তখনকার দস্তুরই ছিল এই।…

কর্তামশায়কে তো বাপকে পেন্নাম করে ফিরে আসছেন। সেই ঘরে, যেখানে দেওয়ানজি ও আর কর্মচারীরা মিলে টাকার তোড়া ভাগ করছিলেন, সেখানে এসে হরকরাকে হুকুম দিলেন—হরকরা তো দুহাতে দুটো তোড়া নিয়ে চলল বাবুর পিছুর পিছু। দেওযানজিরা কী বলবেন—বাড়ির বড়ো ছেলে, চুপ করে তাকিয়ে দেখলেন। এখন হিসেব মেলাতে হবে—দ্বারকানাথ নিজেই সব হিসবে নিতেন তোঅ দুটো তোড়া কম। কী হল।

আজ্ঞে বড়োবাবু—

ও, আচ্ছা—

কিন্তু দ্বারকানাথ ছেলের এই ধর্মকাজে বিরক্ত হয়েছিলেন। ধারণা করেছিলেন তত্ত্বানুসন্ধানী ছেলে সম্পদ রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে। ফলে তিনি  একটি ট্রাস্টডীড করে পৈতিক ও স্বোপার্জিত কযেকটি জমিদারি তার অন্তর্ভুক্ত করে দেন। এটা এমন এক ব্যবস্থা করা হল—যাতে তার ব্যবসাবানিজ্যের পতন ঘটলেও এই সম্পত্তি রক্ষা পাবে। ট্রাস্টিবোর্ড তার রক্ষা করবে। এর ফলে দ্বারকানাথ অর্জিত বিত্তবৈভব শেষ হতে তাঁর মৃত্যুর পরে আরও তিন পুরুষ লেগেছিল।

দ্বিতীয়বার ইংলন্ডে যাওয়ার পর ১৮৪৬ সালের ২২ শে একটি পত্রে ছেলে দেবেন্দ্রনাথকে ভৎর্সনা করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার বাল্যকথায় এই পত্রটির বাংলাঅনুবাদ করেছেন–

আমার সকল বিষয়াসম্পত্তি নষ্ট হইয়া যায় নাই ইহাই আমার আশ্চর্য্য বোধ হয়। তুমি পাদ্রিদের সঙ্গে বাদ প্রতিবাদ করিতে ও সংবাদপত্রে লিখিতেই ব্যস্ত, গুরুতর বিষয় রক্ষা ও পরিদর্শন কার্য্যে তুমি স্বয়ং যথোচিত মনোনিবেশ না করিয়া তাহা তোমার প্রিয়পাত্র আমলাদের হস্তে ফেলিয়া রাখ। ভারতবর্ষের উত্তাপ ও আবহাওয়া সহ্য করিবার আমার শক্তি নাই, যদি থাকিত আমি অবিলম্বে লন্ডন পরিত্যাগ করিয়া তাহা নিজে পর্য্যবেক্ষণ করিতে যাইতাম।…

এইপত্র পেয়ে দেবেন্দ্রনাথ কিছুটা বিমর্ষ হয়েছিলেন। কিন্তু থামেননি। তিনি সে সমযই দেবেন্দ্রনাথ সপরিবারে নৌকা ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। এর ঠিক এক মাস পরে দ্বারকানাথ ইংলন্ডে মারা যান। বড় ছেলে হিসাবে শ্রাদ্ধ করার দ্বায়িত্ব দেবেন্দ্রনাথের।  তিনি বাবার শ্রাদ্ধ হিন্দু ধর্মানুসারে করলেন না। আনন্দচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ দ্বারা নিজ বিশ্বাস মত কয়েকটিমাত্র বৈদিক মন্ত্র পাঠ করিয়া স্বরচিত ব্রাহ্ম অনুষ্ঠানপদ্ধতিক্রমে এক গৃহে শ্রাদ্ধ করিলেন। সে স্থলে গঙ্গাজল তুলসী কুশ বা নারায়ণশিলা ছিল না। এ কারণে দেবেন্দ্রনাথকে বেশিরভাগ আত্মীয়স্বজন পরিত্যাগ করলেন। এটা ছিল একটা বড়ো বিদ্রোহ।

দ্বারকানাথের মৃত্যুর পরে ব্যবসা ও ব্যাঙ্কের পতন হয়ে ঠাকুর পরিবার গরীব হয়ে যায়। চাকরের ভিড় কমাইয়া দিলাম, গাড়ী ঘোড়া সব নিলামে দিলাম, খাওয়া পরা খুব পরিমিত করিলাম; ঘরে থাকিয়া সন্যাসী হইলাম। লিখেছেন দেবেন্দ্রনাথ। দ্বারকানাথ তিনশো টাকার ডিনার খেতেন—আর দেবেন্দ্রনাথ তখন চারিআনা মূল্যের ডিনার খাওয়া শুরু করলেন। তখন তাদের এককোটি টাকার মত দেনা। বিভিন্ন লোকের কাছে তাদের পাওনা ৭০ লাখ টাকা।  ভাইদের নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ  ছমাসের মধ্যে পরিস্থিতি সামলে ওঠেন।

এরপরেই আবার তিনি ভ্রমণে বের হলেন নৌকায় করে। বর্ধমান, আসাম, বর্মায় গেলেন। ১৮৪৮ সালেই তিনি উপনিষদ ও অন্যান্য শাস্ত্র থেকে ব্রাহ্মধর্ম গ্রন্থ সংকলন করেন। ব্রাহ্মসমা্জের বাড়িটির তেতলা তৈরি করেন। সে সময় ঠাকুর পরিবারের আর কোনো ব্যবসা বানিজ্য না থাকায় তারা পরিণত হন জমিদারি নির্ভর। ১৮৫০ সা্লে ঠাকুর বাড়ি থেকে জগধাত্রী পূজা উঠে যায়।

দেবেন্দ্রনাথ পূজা-পার্বণাদি বন্ধ করে ‌'মাঘ উতসব', 'নববর্ষ', 'দীক্ষা দিন'  ইত্যাদি উৎসব প্রবর্তন করেন।  ১৮৬৭ সালে তিনি বীরভূমের ভুবনডাঙ্গা নামে একটি বিশাল ভূখণ্ড ক্রয় করে আশ্রম স্থাপন করেন। এই আশ্রমই আজকের বিখ্যাত শান্তিনিকেতন। ১৮৮৮ সালের ৮ মার্চ তারিখে দেবেন্দ্রনাথ একটি ট্রাস্ট ডীড তৈরি করে শান্তিনিকেতনকে সর্বসাধারণের জন্য উৎসর্গ করেন। এবং নিজের জমিদারির কয়েকটি পরগনার (আনুমানিক ১৮৪৫২ টাকা মূল্যের) সম্পত্তি শান্তিনিকেতন আশ্রমের ব্যয় নির্বাহ করবার জন্য দান করেন। ডীডে ছিল, ''উক্ত সম্পত্তি চিরকাল কেবল নিরাকার একব্রহ্মের উপসনার জন্য ব্যবহৃত হইবে। …কোনো সম্প্রদায়বিশেষের অভিষ্ট দেবতা বা পশুপাখি মনুষ্যের মূর্তির বা চিত্রের বা কোনো চিহ্ণের পূজা হোমযজ্ঞাদি ঐ শান্তিনিকেতনে হইবে না। কোনো ধর্ম বা মনুষ্যের উপাস্য দেবতার কোনো প্রকার নিন্দা বা অবমাননা ঐ স্থানে হইবে না।'' এছাড়াও তিনি হিন্দু চ্যারিট্যাবল ইনস্টিটিউশনের বেথুন সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

দেবেন্দ্রনাথ কিছুদিন রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।  ১৮৫১সালের ৩১ অক্টোবর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন স্থাপিত হলে তিনি তার সম্পাদক নিযুক্ত হন। তিনি দরিদ্র গ্রামবাসীদের চৌকিদারি কর মওকুফের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং ভারতের স্বায়ত্তশাসনের দাবি সম্বলিত একটি পত্র ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রেরণ করেন। দেবেন্দ্রনাথ বিধবাবিবাহ প্রচলনে উৎসাহী ছিলেন, তবে বাল্য ও বহু বিবাহের বিরোধী ছিলেন। তবে নিজের পরিবারে বিধবা বিবাহের বিরোধিতা করেছেন। এটা ছিল তাঁর বৈপরীত্য। শিক্ষাবিস্তারেও তাঁর বিশেষ অবদান ছিল। খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব থেকে ভারতীয় যুবকদের রক্ষার জন্য ১৮৬৭ সালে রাধাকান্ত দেব তাঁকে 'জাতীয় ধর্মের পরিরক্ষক' ও ব্রাহ্ম সমাজ 'মহর্ষি' উপাধিতে ভূষিত করে।

পিতৃঋণ শোধ করার তাগিদেই দেবেন্দ্রনাথ বিষয়সম্পত্তির দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করেন। তিনি নিজেই জমিদারি দেখতে আরম্ভ করলেন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে। পরে ছেলেদের উপর দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু নিজের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছেন। এইক্ষেত্রে তিনি কোনো ছাড় দেননি।  তাঁর ধর্মবোধ, ন্যায়পরায়ণাতা, অপৌত্তলিক ধর্মে ও একমেবাদ্বিতীয়ম ঈশ্বরে বিশ্বাস ও নানা জনহিতকর কর্মে উৎসাহ ইত্যাদি বিষয় বহুবিখ্যাত। কিন্তু মরার আগে পর্যন্ত সকল দার্শনিকতার পাশপাশি বিষয়সম্পদাদিতে তাঁর প্রভুত্ব বজায় রেখেছেন।

অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার পরে তিনি  বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধির দিকে মনোযোগী প্রবলভাবে তিনি একেশ্বরবাদের প্রচারণায় প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন। তার জ্ঞান, অর্থ ও প্রতিপত্তি একক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। সমাজে বঙ্গের রেনেসাঁসের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসাবে শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পাশাপাশি নিজের পরিবারেও এর সুফলগুলো পরিপূর্ণভাবে বিকশারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেন উদারভাবে। তাঁর উত্তরসূরীরা পূর্বসূরীদের মতন ব্যবসাবানিজ্যের পথ থেকে সরে আসেন। জমিদারী থেকে আসমানদারীতে ঝুঁকে পড়েন।

তার উদ্যোগে ঠাকুর বাড়ি থেকে পত্রিকা বের হয়েছে , নাট্যমঞ্চ হয়েছে, সাহিত্য রচিত হয়েছে,  বিদ্বোৎসমাজের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ছে। ছেলেরা বিলেতে উচ্চ শিক্ষার জন্য যাচ্ছে।

দেবেন্দ্রনাথের সংস্কার কার্যক্রমের কারণে আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে পরিত্যাক্ত হয়েছেন। তারা তার সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসে ভোজন করতে অস্বীকার করেছেন। এই কারণেই দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পরিবারের জন্য সৃজনশীলতার পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমের নতুন স্বজন সন্ধান করেন। যার সুফল শুধু তার পরিবারেই নয়—আপামর বাংলায়ও ফলেছে। আসমানদারীর নতুন জমানা এসে গেছে।

দ্বাদশ পর্ব —————————————————————

আসমানদারীর নির্মাণপর্ব

গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর : সৌখিন মেজাজের বাবু

দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ ভাই গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮২০-১৮৫৪) বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। আবার আসমানদারীর পক্ষেও কাজ করেছেন। দাদার সঙ্গে তিনিও ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। সৌখিন যাত্রাদলের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বাবুবিলাস নামে একটি নাটকও লিখেছেন। ব্রাহ্ম হলেও তার পরিবারে দোল-দুর্গোৎসব অব্যাহত রেখেছেন। এ উপলক্ষ্যে বাড়িতে আয়োজন করতেন যাত্রা প্রভৃতি লৌকিক বিনোদনের ব্যবস্থা। বেশ বাবু চেহারা ছিল তার চরিত্রে।  রবীন্দ্রনাথ এই পালাগানের স্মৃতি চারণ করেছেন আমার ছেলেবেলা গ্রন্থে। গিরীন্দ্রনাথের নাতি অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন—

দাদামশায়ের সখ ছিল বোটে করে বেড়ানো। পিনিস তৈরি হয়ে এল—পিনিস কি জিনিস জান, বজরা আর পানসি, পিনিস হচ্চে বজরা আর পানসির বড়ো ভাই—ভিতরে সব সিল্কের গদি, সিল্কের পর্দা, চারদিকে আরামের চূড়ান্ত।

ফি রবিবারে শুনেছি—দাদামশায় ইয়ারবক্সি নিয়ে বের হতেন–সঙ্গে থাকত খাতা পেন্সিল, ছবি আঁকার সখ ছিল, দু-একজোড়া তাসও থাকত বন্ধুবান্ধবদের খেলার জন্য। পিনিসের উপরে থাকত একটা দামামা।। দাদামশায়ের পিনিস চলতে শুরু হলেও সেই দামামা দকড় দকড় করে পিটতে থাকত। তার উপরে হাতি মার্কা নিশেন উড়ছে পতপত করে। এই তার সখ, দামামা পিটিয়ে চলতেন পিনিসে।..তার সঙ্গে প্রায়ই থাকতেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। অনেক ফরমাইশী কবিতাই ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন সে সময়ে।…দাদামশায়ের যাত্রা করবার সখ, গান বাঁধবার সখ—নানা শাখা নিয়ে তিনি থাকতেন। তিনি বেশ একটা সৌখিনতা তৈরি করেছিলেন ঠাকুরবাড়িতে।

গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪১-১৮৬৯) : নাট্যশালা স্থাপন

গিরীন্দ্রনাথের ছেলে গণেন্দ্রনাথের ব্যবসায়ী বুদ্ধ ছিল ক্ষুরধার। দেবেন্দ্রনাথ তার উপরে ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে নির্ভর করতেন। তাছাড়া শিল্প-সাহিত্য—ইতিহাসচর্চা-নাট্যাভিনয় ইত্যাদি ব্যাপারেও তাঁর বিপুল আগ্রহ ছিল। ১৮৬৬ সালে ঠাকুরবাড়ির অভিনয়ের জন্য রামনারায়ণ তর্করত্ন নবনাটক প্রকাশ করেন। সেটা ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা মঞ্চস্থও করেন। ১৮৬৭ সালের ৬ জানুয়ারি দেবেন্দ্রনাথ একটি চিঠি লেখেন গুণেন্দ্রনাথকে। তখন দেবেন্দ্রনাথ জমিদারি কাজে কালিগ্রামে অবস্থান করছেন। তিনি লিখেছেন—

তোমাদের নাট্যশালার দ্বার উন্মুক্ত হইয়াছে—সমবেত বাদ্য দ্বারা অনেকের হৃদয় নৃত্য করিয়াছে—কবিত্বরসের আস্বাদনে অনেকে পরিতৃপ্তি লাভ করিতেছে। নির্দোষ আমোদ আমাদের দেশের যে একটি অভাব, তাহা এই প্রকারে ক্রমে ক্রমে দূরীভূত হইবে। পূর্বে আমাদের সহৃদয় মধ্যম ভায়ার উপরে ইহার জন্য আমার অনুরোধ ছিল। তুমি তাহা সম্পন্ন করিয়াছ। কিন্তু আমি তোমাকে স্নহপূর্বক সাবধান করিতেছি যে, এ প্রকার আমোদ যেন দোষে পরিণত না হয়।

দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয় ভাবের উদ্বোধন ঘটানোর উদ্দেশ্যে আয়োজিত  চৈত্র মেলা বা হিন্দুমেলার প্রধান উদ্যোক্তাদের মধ্য  দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি অন্যতম সংগঠক ছিলেন।  এই হিন্দুমেলায় তখনকার কৃষি-শিল্প-সংস্কৃতির একটি প্রদর্শনী ছিল। সেখানে গ্রাম থেকে কৃষিপণ্য-হস্তশিল্পজাত সামগ্রী প্রদর্শন করা হত। এই হিন্দুমেলায় মুসলমান গায়কগণও পালাগান করতে আসতেন। কোনো অর্থেই এই চৈত্রমেলা বা হিন্দুমেলা হিন্দুত্ববাদের জিনিস ছিল না।

ঠাকুরবাড়ির সাংগীতিক ঐতিহ্যের সঙ্গেও গুণেন্দ্রনাথের যোগ ছিল। হিন্দি গান ভেঙ্গে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনায় তিনিও প্রভুত উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। সে সময়ে ঠাকুরবাড়িতে বড়ো বড়ো ওস্তাদরা এসে গান শোনাতেন। নামকরা যাত্রাওয়ালারা এসে অভিনয় করতেন। মেয়েরাও দেখার সুযোগ পেতেন। কালিদাসের বিক্রমোর্বশী নাটকটি গুণেন্দ্রনাথ অনুবাদ করেন। ১৮৮৬ সালে এই নাটকটি প্রকাশিত হয়।

 বড়োবাবু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬) : অনেকের মধ্যে একা একজন

দ্বিজেন্দ্রনাথের অল্প বয়সের ঝোঁক ছিল কাব্য রচনা ও ছবি আঁকায়। ১৮৬০ সালে কুড়ি বছর বয়সে তিনি কালিদাসের মেঘদূতের পদ্যোনুবাদ করেন। এরপরই দর্শনের ত্ত্ত্বানুসন্ধানে তিনি মনোযোগী হয়ে পড়েন। তার স্মৃতি কথা থেকে সে সময়ে ঠাকুরবাড়ির একটি চেহারা পাওয়া যায়—

পূজার সময়ে আমাদের বাড়িতে যে উৎসব দেখিয়াছি, সে রকম উৎসব পরে আর কখনো দেখি নাই। বোধ হয় আমাদের প্রতিমা দেশের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হইত। পূজার অনেক আগে হইতেই আমাদের বাড়িতে দর্জি বসিয়া যাইত, জহুরীর আগমণ হইত। দর্জী ও জহুরী মিলিয়া বাড়ির সকলের পোষাক-পরিচ্ছদ অলঙ্কারাদি প্রস্তুত আরম্ভ করিত। গৃহ-প্রাঙ্গণে যে যাত্রা প্রভৃতির আযোজন হইত, তাহাতে যোগদান করিবার অধিকার আপামর সাধারণ সকলের ছিল। দরজা বন্ধ করিয়া পাহারা রাখিয়া, কাহাকেও প্রবেশ করিতে না দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত বলিয়া বিবেচিত হইত। ধনী গৃহস্থের বাড়ির পূজার আয়োজনে কেবল মাত্র সেই পরিবারের নিমন্ত্রিত নির্দিষ্ট সংখ্যক আত্মীয় বন্ধু বান্ধবের জন্য করা হইত না। প্রত্যেক গৃহস্থের পূজার উৎসব একটা বৃহৎ সামাজিক উৎসব ছিল। সমাজের ছোট-বড় সকলেই অবাধে সে উৎসবে মাতিয়া উঠিত। আমার পিতৃদেব ব্রাহ্মধর্মানুরাগ বশতঃ পূজার সময় বাড়ি থাকিতেন না। তিনি কিন্তু আগে হইতেই বিদেশ পর্যটনে বাহির হইতেন।

তাঁর সময়েই ঠাকুরবাড়িতে নাটক রচনা, অভিনয় ও আনন্দমুখর সঙ্গীত ধ্বনিত পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ তখন বেশ ছোটো। দূর থেকে এসবই দেখতে পেতেন।

সমীর সেনগুপ্ত লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের শিশুকালে তাদের বাড়িতে তিনটি ধারা দেখা যায়। প্রধান ধারাটি হল জনপ্রিয়, সঙ্গীত-নাটক-প্রমুখ কোলাহল মুখরিত যৌথ আনন্দোৎসবের ধারা। দ্বিতীয়টি হল—পাঠকক্ষে নির্জনে বসে জ্ঞানচর্চার ধারা। তৃতীয়টি হল বুদ্ধিনির্ভর, বিবর্তনকামী, জ্ঞানাশ্রয়ী ভক্তিবাদের ধারা। এই ভক্তিবাদের ধারাটি আদি ব্রাহ্মসমাজের নিরাকার ব্রহ্মোপসনার মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়েছিল দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্ব।

দ্বিজেন্দ্রনাথ এর মধ্যে থেকেও থাকেননি। একা বসে তত্ত্ব জ্ঞান, গণিতচর্চা আর ছড়া লিখে দিন কাটিয়েছেন। বাংলা শর্টহ্যান্ড লিখনপদ্ধতির প্রবর্তন করেন। রবীন্দ্রনাথ বড়োদাদা বিষয়ে লিখেছেন—গান গাইতে পারতেন না, বিলিতি বাঁশি বাজাতেন। সমাজের নির্দিষ্ট করে দেওয়া রীতিনীতি থেকে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে মূল্য দেওয়ার ধারণাটাও তাঁর মধ্যে প্রবলভাবে ছিল। সামাজিক অনুশাসনের প্রতিবাদ হিসাবে চিন্তাজগতে ব্যক্তিমানসের অভ্যুত্থান ঘটানো ছিল রেনেসাঁর মূল কথা।  দ্বিজেন্দ্রনাথ ব্যক্তিগতভাবে এই ধারারই অনুসারী ছিলেন।

১৮৭৫ সালে মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বিদ্বজ্জনসমাগম সভার প্রথম অধিবেশনটি বসিয়েছেন তিনি। তৎকালীন বাংলার বিদ্বজ্জনেরা ঠাকুরবাড়িতে ঘোরাফেরা করছেন। বিদ্বজ্জনসমাগম সভার উদ্দেশ্য ছিল—সাহিত্যসেবীদের মধ্যে  পরস্পর আলাপ-পরিচয় ও তাঁহাদের মধ্যে সদ্ভাব বাড়ানো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন—এই উপলক্ষে অনেক রচনা ও কবিতাদিও পঠিত হইত, গীতবাদ্যের আয়োজন থাকিত, নাট্যাভিনয়ও প্রদর্শিত হইত এবং সর্ব্বশেষে সকলের একত্র প্রীতিভোজনের মধ্যে দিয়ে এই সাহিত্য-মহোৎসবের পরিসমাপ্তি হইত। বছরে একবার এই সভার অধিবেশন হত। দ্বিতীয় অধিবেশনে বালক  রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির খেদ নামে একটি কবিতা পড়েছিলেন। তখন ভারতী নামে একটি পত্রিকা বের হয়েছে দ্বিজেন্দ্রনাথের সম্পাদনায়। রচনা করছেন বেশ কিছু ব্রাহ্মসঙ্গীতও। ১৯২১ সালে তিরি গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থক হয়ে উঠেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারেননি। এখানে দাদার সঙ্গে তাঁর ভাবনার পথটি আলাদা হয়ে গেছে।

পশুপাখির প্রতি দ্বিজেন্দ্রনাথের ছিল বড়ো ভাব।  সুধাকান্ত চৌধুরী লিখেছেন—

দূর থেকে তাকিয়ে দেখলাম দক্ষিণের বারান্দায় বড়োবাবু তাঁর চেয়ারে বসে আছেন, তাঁর সামনে একটি টেবিল পাতা। সেই টেবিলের উপরে ছিল দুই একটি ছোটো ছোটো প্লেট। দূরের থেকে দেখতে পাইনি সেই প্লেটগুলিতে কী আছে। তবে দেখলাম অই টেবিলের উপরে তিন-চার রকমের পাখি ঠোকর দিয়ে প্লেট থেকে কি সব খাচ্ছে। দেখলাম একটা গাছের থেকে দুটো কাঠবিড়ালী দৌঁড়ে গিয়ে বড়ো বাবুর চেয়ার বেয়ে টেবিলের উপরে লাফ দিয়ে উঠছে। তাদের বড়োবাবু বিস্কুটের মতো কী একটা পদার্থ ভেঙে ভেঙে দিচ্ছেন। তারা পেছনের দুই পায়ে বসে সামনের দু-পা দিয়ে ধরে যেন ছোটো ছোটো হাত দিয়ে ধরে সেই খাবার খাচ্ছে। পাখিগুলোও কী সব খাচ্ছে—এরা হল সকালবেলায় বড়োবাবুর প্রাতরাশের সময়ের মজলিশের সভ্যবৃন্দ।

তিনি বাংলা গানের প্রথম স্বরলিপি তৈরী করেন। এটাকে পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পূর্ণরূপ দেন। তিনি সাঁতাশটি বই লিখেছেন। আত্মজীবনীতে দ্বিজেন্দ্রনাথ লিখেছেন—

আমি অনেক লিখিয়াছি; এই লেখাপড়া ছাড়া আমি আর জীবনের বড়ো একটা কিছুই করিতে পারিতে পারিলাম না। কখনো আমি বিষয়কর্ম ভালো করিয়া বুঝিতে পারিতাম না—বাবা ইদানিং আমাকে কোনও বিষয়কর্মে থাকিতে দিতেন না। দ্বিজেন্দ্রনাথ জমিদারী দেখেছিলেন মাত্র মাসখানেক। এর মধ্যে আবার তিনি সাহজাদপুরেও গিয়েছিলেন। সেখানে নিজের উদ্যোগে প্রজাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সুখ দুঃখের খোজ খবর নিয়েছেন। তাদের খাজনা মউকূপের প্রস্তাব করছেন। এ ঘটনায় আমলারা বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছিল। আর তখন তখুনি তাকে বাদ দিয়ে তার ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথকে জমিদারী দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। দ্বিপেন্দ্রনাথ পাঁচ বছর জমিদারি পরিচালনা করেন। এর পরে রবীন্দ্রনাথ জরিদারি পারিচালনার ভার পান।

 সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর : বিলেতি হাওয়া

সেকালে জোঁড়া সাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ছিল একান্নবর্তী পরিবার। পাঁচ ও ছ নম্বর বাড়ি মিলিয়ে বিশাল বাড়ি। সত্যন্দ্রনাথের বাল্যকালে বাড়িটা ভাগ হয়ে যায়। ভাগ হওয়া  আগে থেকেই হিন্দুত্বের সঙ্গে ব্রাহ্মধর্মের বিরোধ জেগে উঠেছে দেবেন্দ্রনাথের মতো তাঁর ছেলেমেয়েদের মধ্যেও। নয় বছর বয়সের একটি স্মৃতি বলছেন দেবেন্দ্রনাথের মেজো ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। 'এক সময়ে আমাদের বাড়ি সরস্বতী পূজা হত। মনে আছে একবার সরস্বতী পূজার অর্চনায় গিয়েছি—শেষে ফিরে আসবার সময় আমার হাতে যে দক্ষিণার টাকা ছিল তাই দেবীর পায়ের উপরে সজোরে নিক্ষেপ করে দে ছুট। তাতে দেবীর মুকুট ভেঙে পড়ল।

ছেলেবেলার বর্ণনা দিয়েছেন—ছেলেবেলায় আমাদের ব্যায়ামচর্চার অভাব ছিল না। ভোরে উঠে জোড়াসাঁকো থেকে গড়ের মাঠ বরাহনগর প্রভৃতি দূর দূর পাল্লা পদব্রজে বেড়িয়ে আসতুম।..তা ছাড়া ঘোড়ায় চড়া, সাঁতার দেওয়া এসব ছিল।…হীরা সিং বলে একজন পালোয়ানের কাছে আমরা কুস্তি শিখতাম।রবীন্দ্রনাথকেও কুস্তি শিখিয়েছিলেন এই হীরা সিং। সংস্কৃত শেখাতে আসতেন বাণেশ্বর বিদ্যালংকার। এর মধ্যে আরবী সাহিত্যেও বেশ বুৎপত্তি লাভ করেছেন।

১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। তার সঙ্গে আরও পাশ করেছিলেন  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য। প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়ার সময় ব্রাহ্মধর্মের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। তার সহপাঠী ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন। দেবেন্দ্রনাথ কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে পরিচিত হন সত্যেন্দ্রনাথের মাধ্যমে। কেশবচন্দ্র সেনকে তার বাড়ির লোকেরা হিন্দু লোকাচার না মানার জন্য অত্যাচার করছিল। এ কারণে তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কেশব চন্দ্রের প্রভাবে সমাজ এক নতুন মূর্তি গ্রহণ করেছিল। সত্যন্দ্রনাথও সেই কর্মকাণ্ডে মেতে উঠেছিলেন। এ সময়ই দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজের বেদি থেকে হৃদয়ভেদী প্রার্থনা আর উপদেশ দিচ্ছেন। আর ঠাকুরবাড়ির সবাই গান লিখছেন। গানে সুর দিচ্ছেন ব্রাহ্মসমাজের সভাগায়ক বিষ্ণু চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রথম সঙ্গীত গুরু। তিনি ৬০০ ব্রাহ্মসঙ্গীতের সুর করেছিলেন। গানের সারল্যের আদর্শটি  রবীন্দ্রনাথ বিষ্ণু চর্কবর্তীর কাছ থেকেই শিখেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ যে বছর জন্মেছিলেন সে বছরই তাঁর বড়ো দিদি সুকুমারীর বিয়ে হয়েছে হিন্দুপদ্ধতির বদলে ব্রাহ্মধর্মানুসারে। এটা ছিল তৎকালীন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে বড়ো ধরনের বিদ্রোহ। ঠাকুর পরিবার আবার একঘরে হয়েছিল এ কারণে।  ব্রাহ্মমত ধীরে ধীরে তাত্ত্বিক রূপ থেকে আনুষ্ঠানিক ধর্মমতের চেহারা পেয়েছে।  পৌত্তিলকতার বিরুদ্ধেওতাদের বিদ্রোহ সমাজে জায়গা করে নিচ্ছে।

সত্যেন্দ্রনাথ তাঁদের বাড়ির ছোটো ছোটো ভাই বউদের ঘোমটা খুলে দিতেন। নারী স্বাধীনতার জন্য মেতে উঠেছেন। বাবার মতানুসারে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে বিয়ে করেন ১৮৫৯ সালে।  তিনি বিলেতে স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাবা দেবেন্দ্রনাথ সে অনুমতি দেননি। ১৮৬৩ সালে ইংলণ্ড থেকে আইসিএস পাশ করেন। তাঁর পোস্টিং হল আমেদাবাদে অ্যাসিস্টেন্ট কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট পদে বোম্বাই প্রদেশ। তাঁর প্রভাবে তারপর থেকেই ঠাকুরবাড়িতে বিলেতের ছোয়া লাগল। বোম্বাই প্রদেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে তারা সর্বভারতীয় ভাবনার উন্মেষ ঘটতে শুরু করেছিল। দেবেন্দ্রনাথ অন্তঃপুরের রক্ষণশীলতার প্রাচীর বিন্দুমাত্র ফাঁটল ঘটাতে রাজি ছিলেন না। তাঁর প্রচেষ্টা ছিল শুধুমাত্র ধর্মসংস্কারের প্রতি। কিন্তু বাড়ির মধ্যে সেই রক্ষণশীলতার প্রাচীর ভেঙে দিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ও তার স্ত্রী জ্ঞানদান্দিনী দেবী। ভেঙে দিয়েছিলেন তারা পর্দাপ্রথা ।

কিছুদিন পরে সত্যেন্দ্রনাথ স্ত্রীকে পুরনো নিয়ম ভেঙে বাড়ির বাইরে বের করে নিয়ে গেলেন বোম্বাইতে। তিনি লিখেছেন, 'জাহাজে করে যেতে হবে। বাবামহাশয় তাতে কোনো কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। এখন কথা হচ্ছে ঘাটে উঠা যায় কী করে? গাড়ি করে তো যাওয়া চাই। আমি প্রস্তাব করলুম বাড়ি থেকেই গাড়িতে ওঠা যাক। কিন্তু বাবামহাশয় সম্মত হলেন না। বললেন মেয়েদের পালকি করে যাবার যে নিয়ম আছে তাই রক্ষা হোক।' অসূর্যম্পশ্যা কুলবধূ কর্মচারীদের চোখের সমানে দিয়ে বাহির বাড়ির দেউড়ি ডিঙিয়ে গাড়িতে উঠবেন, এ তাঁর কিছুতেই মনঃপুত হল না। সুতরাং গাড়িতে নয়—সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রীকে গাড়িতে নয় পালকীতে করে জাহাজঘাটায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

…তখন অন্তঃপুরে অবরোধপ্রথা পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান। তখনো মেয়েদের একই প্রাঙ্গণের এ বাড়ি হইতে ও বাড়ি যাইতে হইলে ঘেরাটোপ মোড়া পালকীর সঙ্গে প্রহরী ছোটে, তখনো নিতান্ত অনুনয় বিনয়ে মা গঙ্গাস্নানে যাইবার অনুমতি পাইলে বেহারারা পালকী সুদ্ধ তাঁহাকে জলে চুবাইয়া আনে।

সত্যেন্দ্রনাথের ছেলে সুরেন্দ্রনাথের জন্ম হয় ১৮৭২ সালে। মেয়ে ইন্দিরা দেবীর জন্ম হয় এক বছর পরে। তখন তাঁদের ধাত্রীমা রাখা হয়েছিল এক মুসলমান মহিলাকে। ইন্দিরা দেবী লিখেছেন—'আমি তো মুসলমানীর দুধ পর্যন্ত খেয়েছি'।. অথচ মুসলমানের খাদ্যের ঘ্রাণ নাকে আসায় ঠাকুর পরিবারের পূর্বপুরুষের জাত গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথের কাছে বারবার গেছেন তাঁর কর্মস্থলে। পারিবারিক বিষয়াদিতে পরামর্শ নিয়েছেন।  মেজোবৌঠানের সঙ্গে তাঁর মধুর সম্পর্ক হয়েছে। তারা তাঁকে বিলেতেও নিয়ে গেছেন। বিলেতি কেতা শেখার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী বালিকা বধু বলে সন্তানসহ মৃণালিনী দেবীকে জ্ঞানদানন্দিনী তার হেফাজতে রেখেছেন।

জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায়  বালক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই পত্রিকার প্রদান লেখক। তিনি ফটোগ্রাফীর চর্চাও করতেন। তিনিই প্রথম সাড়ির নিচে পায়জামা পরা, সায়া পরা, জামা পরা ও বম্বে ধরনের সাড়ি পরা ঠাকুর পরিবারে প্রচলন করেন। তারপর বাংলায় এই পদ্ধতি প্রচলিত হয়। তারাই বঙ্গে বাঙ্গালীদের মধ্যে জন্মদিন পালন প্রথার চালু করেন। বেশ কিছু বইও লেখেন তিনি।

চাকরি শুরুর দুবছর পরে সত্যেন্দ্রনাথ বিচার বিভাগে চলে যান। ৩৩ বছর চাকরী করে অবসর নেন ১৮৯৭ সালে। তখন ছিলেন সাতারা জেলার ডিস্ট্রিক্ট অ্যান্ড সেসন জজ। অবসর নিয়ে কোলকাতায় বসবাস শুরু করলেন জোড়াসাঁকোর বাইরে আলাদা বাসা নিয়ে। তাঁদের বাড়িতে কলকাতার ধনী অভিজাত সমাজের অনেকেই আগমন করতেন। বিশেষ করে তরুণদের আগমন ছিল চোখে পড়ার মত। তাঁর রূপসী ও বিদূষী কন্যা ইন্দিরা দেবী এইসব সভায় উপস্থিত থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের খুব স্নেহের  কলকাতায় এসেই সত্যেন্দ্রনাথ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত হন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি জড়িয়ে পড়েন। তিনি নিজে জমিদারী দেখেন নি কখনো। তার ছেলে সুরেন্দ্রনাথ জমিদারীর কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে ১৯০৫ সালে। তার অবিবেচনার কারণে জমিদারিতে প্রচুর দেনা হয়ে যায়। ফলে ঋণ করতে হয়েছিল।

সত্যেন্দ্রনাথ নয়টি বাংলা ও তিনটি ইংরেজি গ্রন্থ রচনা করেন। সেসবের মধ্যে সুশীলা ও বীরসিংহ নাটক (১৮৬৭), বোম্বাই চিত্র (১৮৮৮), নবরত্নমালা, স্ত্রী স্বাধীনতা, বৌদ্ধধর্ম (১৯০১), আমার বাল্যকথা ও বোম্বাই প্রয়াস (১৯১৫), ভারতবর্ষীয় ইংরেজ (১৯০৮) ইত্যাদি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। এছাড়াও তার কৃত তিলকের ভগবদ্গীতাভাষ্য, (কালিদাস) এর মেঘদূত এবং তুকারামের অভঙ্গের অনুবাদ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি বেশকিছু ব্রহ্মসঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গানও রচনা করেন এবং কিছুকাল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

১৯২৩ সালের ৯ জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়।

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ত্রয়োদশ পর্ব

কুলদা রায়

এমএমআর জালাল

নতুন দাদার বোনা বীজ

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম ছেলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন রবীন্দ্রনাথের নতুন দাদা। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকতেন। স্কুল অব আর্টে ভর্তিও হয়েছিলেন। জোড়াসাঁকো বাড়ির নাট্যাশালা প্রতিষ্ঠিত করে সেখানে অভিনয় করেন। মেজোদাদা সত্যেন্দ্রনাথের কর্মস্থলে গিয়ে ফরাসী ভাষা শিখেছেন। সেতার বাজনাতে তাঁর দক্ষতা এসেছে। চৈত্রমেলার জন্য গান লিখেছেন। ১৮৬৯ সালে ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।

১৮৬৮ সালে বিয়ে করেছেন বাবার নির্বাচিত পাত্রী কাদম্বরী দেবীকে। তখন তার নিজের বয়স ১৯ বছর ২ মাস। আর কাদম্বরীর নয় বছর। রবীন্দ্রনাথের সাত বছর ২ মাস। কাদম্বরী লেখাপড়া জানতেন না। তাঁকে উপযুক্ত পড়াশুনা করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ঠাকুর পরিবারের দস্তুর মতো। সে সময়ে রবীন্দ্রনাথদের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। জোড়াসাঁকোর ভেতরে চাকরদের কাছে বেড়ে উঠেছেন। ভেতরবাড়িটা দূরের। সেখানে যাওয়ার সুযোগ নেই। একারণে জোড়াসাঁকোর সীমানার মধ্যে থেকে বাইরের আর ভেতরের যা কিছুই তখন দেখতে পেতেন—তার সবই ছবির মত করে তাঁর কৌতুহলী চোখ পড়ে নিত। রাত নটার পরে তাদের পড়া শেষ হত। ভিতর বাড়ি যাওয়ার সময় পার হতেন খড়খড়ি দেওয়া লম্বা বারান্দা। দেখতে পেতেন জ্যোৎস্নার অস্পষ্ট আলোয় দাসীরা পাশাপাশি পা মেলে বসে আছে। উরুর উপর প্রদীপের সলতে পাকাতে পাকাতে মৃদুস্বরে নিজেদের দেশের গল্প করছে। তারপর বালকদের খাওয়া দাওয়া শেষ হত। তখন শঙ্করী কিংবা প্যারি কিংবা তিনকড়ি দাসী এসে রূপকথার গল্প বলত। শুয়ে শুয়ে কানে শুনতে পেতেন রূপকথা—আর দেয়ালের চুন খসা রেখার মধ্যে সেইসব রূপের গল্পগুলো দেখতে পেতেন। এইভাবে সাতবছরের রবিবালকের ঘুম নেমে আসত।

এর মধ্যে ২ বছরের বড়ো কাদম্বরী এসে গেছেন নতুন বৌঠান হয়ে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—তখন অন্তপুরের রহস্য আরও ঘনীভূত হইয়া উঠিল। যিনি বাহির হইতে আসিয়াছেন অথচ যিনি ঘরেরই, যাহাকে কিছুই জানিনা অথচ যিনি আপনার, তাহার সঙ্গে ভাব করিয়া লইতে ভারী ইচ্ছা করিত।

ভাব করার চেষ্টা করলেও দিদি স্বর্ণকুমারীর তাড়া খেয়ে ফিরে বাইরেই আসতে হত। সেখানে শুধু কাদম্বরীই নয়—তার আলমারীর কাঁচের ও চিনামাটির দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী দূর থেকে দেখে দেখে আঁশ মেটাতো হত। তবে ধীরে ধীরে এই সীমা ঘুচে গেছে। নতুন বৌঠানের সঙ্গে বালকদের ভাব হয়ে গেছে।

কাদম্বরী বড় হয়ে উঠছেন। আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে স্ত্রী স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন। তিনি লিখেছেন তাঁর জীবন স্মৃতিতে—স্ত্রী স্বাধীনতার শেষে আমি এত বড় পক্ষপাতি হইয়া পড়িলাম যে গঙ্গার ধারের কোনো বাগানবাড়িতে সস্ত্রীক অবস্থানকালে আমি আমার নিজের স্ত্রীকে নিজেই অশ্বারোহন পর্যন্ত শিখাইয়াছিলাম। তাহার পর জোড়াসাঁকো বাড়িতে আসিয়া দুইটি আরব ঘোড়ায় দুইজন পাশাপাশি চড়িয়া বাড়ি হইতে গড়ের মাঠ পর্যন্ত বেড়াইতে যাইতাম। ময়দানে পৌঁছাইয়া দুইজনে সবেগে ঘোড়া ছুটাইতাম। প্রতিবাসীরা স্তম্ভিত হইয়া গালে হাত দিত।

এর ঠিক দশ বছর আগে তার মেজোদাদা সত্যেন্দ্রনাথকে বাড়ি থেকে স্ত্রীকে গাড়িতে করে জাহাজ ঘাটায় যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। দশ বছরের ব্যবধানে দেবেন্দ্রনাথের জীবনকালেই তাঁর আরেকপুত্র স্ত্রীকে নিয়ে ঘোড়া দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছেন।

ততদিনে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাড়ির প্রধান পুরুষ হয়ে উঠেছেন। নাটকের জন্য আর্কেস্ট্রা তলি করছেন, গান করছেন, গান বাঁধছেন, সেতার শিখছেন, ফরাসী ভাষা শিখছেন, জোঁড়াসাকোর বাড়িতে নাট্যশালা তৈরি করেছেন, সেখানে বাড়ির বউদেরও অভিনয়ে নামাচ্ছেন, ব্রাহ্মসমাজের সভায় বক্তৃতা করছেন, কোলকাতায় বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। সেই সঙ্গে পাটের ব্যবসা– নীলের ব্যবসাও করছেন। হয়েছেন বহুকাজের কাজী। দ্বিজেন্দ্রনাথ দর্শন, গণিত আর ছড়া লেখা নিয়ে ব্যস্ত, সত্যদাদা সিভিল সার্ভিসে মগ্ন। হেমেন্দ্রদাদা ব্যায়াম আর ছেলেমেয়েদের বিচিত্রবিদ্যায় সময় কাটাচ্ছেন। এরা কেউই জমিদারীর কাজে আগ্রহী নন।

১৮৭৩ সালে দাদা সোমেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন হয়। সাড়ে তেরো বছরের বৌঠান কাদম্বরী তখন খুদে দেওরদের জন্য হবিষ্যান্ন রেঁধে দিয়েছেন। তাতে পড়ত গাওয়া ঘি। ঐ তিনদিন তার স্বাদে, গন্ধে যুক্ত করে রেখেছিল লোভী ছেলেদের। তাদের মধ্যে এ সময় অন্তরঙ্গ সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। ১৮৭৫ সালে রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেছেন ম্যাকবেথ। সেটা পড়ে শোনাতে গেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। এই নাটকে একটি চরিত্রের নাম হেকেটি। সেই থেকে বৌঠানকে নাম দিয়েছেন হেকেটি।

এই ১৮৭৫ সালে দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সারদাদেবীর মৃত্যু হলে ছোটো ছোটো দেবরদের দেখে রাখার কাজটি নিয়েছেন। তখন তাঁর বয়স ১৬।. আর রবীন্দ্রনাথের ১৪।

মা মারা গেলে এই বিরাট বাড়িটির দ্বায়িত্ব নিয়েছেন বড়ো দিদি সুকুমারী দিদি। সঙ্গে ছিলেন শরৎকুমারী, বর্ণকুমারী—এই দুই দিদি। আর ছিলেন বাড়ির অন্যান্য বউ—সর্বসুন্দরী, নীপময়ী, প্রফুল্লময়ী। কাদম্বরী নিঃসন্তান। স্বর্ণকুমারীর দুমাসের মেয়ে ঊর্মিলাকে নিজের কোলে তুলে নিয়েছেন এই বালকদের পাশাপাশি। তাকে খাওয়ান। স্নান করান। ঘুম পাড়ান। তিনি ঊর্মিলার মা হয়ে উঠেছেন। ঊর্মিলার বয়স যখন মাত্র পাঁচ। তখন কাদম্বরীদের তিনতলার ছাদের ঘর থেকে নমে আসা ঘোরানো সিঁড়ি থেকে একা একা নামতে গিয়ে এই ছোটো মেয়েটি পা ফসকে পড়ে গেল। মাথায় আঘাত পেয়ে মারা গেল। কেউ কেউ দোষ দিল কাদম্বরীর। প্রচণ্ড আঘাত পেলেন তিনি। বিষণ্নরোগে আক্রান্ত হলেন। এ সময় তাঁর স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রও সংসারে সময় দিতে পারছেন না। নানাকাজে বাইর বাইরে থাকেন। তখন কাদম্বরীর বয়স ২১।. দুবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলেন। প্রথমবারে ফিরে এলেন। দ্বিতীয়বারে কাদম্বরী চলে গেলেন। সেদিন ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল।

সারদা দেবী মারা গেলে দেবেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তাঁর তেতলার ছাদের ঘরটি পেয়েছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। স্বামীস্ত্রী দুজনে টবে ফুলের বাগান বসিয়েছেন। সেখানে আসর জমে ওঠেছে সাহিত্য ও সঙ্গীতের। এখানে কবিতা পড়তে আসতেন সেকালের বিখ্যাত কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। সে কবিতা শুনে রবিরও ই্চ্ছে জাগে বিহারীলালের মত কবিতা লিখতে। বৌঠান তাকে উৎসাহও দেন। রবি লেখেন। বৌঠান শোনেন। আর উৎসাহ দেন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—তিনি (জ্যোতিরিন্দ্র) আমাকে খুব একটা বড়ো রকমের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তাহার সংশ্রবে আমার ভিতরকার সংকোচ ঘুচিয়া গিয়াছিল। এইরূপ স্বাধীনতা আমাকে আর কেহ দিতে সাহস করিত না—সেজন্য হয়তো কেহ কেহ তাহাকে নিন্দাও করিয়াছে। কিন্তু প্রখর গ্রীষ্মের বর্ষার যেমন প্রয়োজন, আমার পক্ষে আশৈশব বাঁধানিষেধের পরে এই স্বাধীনতার তেমনি অত্যাবশ্যক ছিল। জ্যোতিদাদাই সম্পুর্ণ নিঃসংকোচে সমস্ত ভালোমন্দর মধ্য দিয়া আমাকে আত্মোপলদ্ধির ক্ষেত্রে ছাড়িয়া দিয়াছেন এবং তখন হইতেই আমার আপনি শক্তি নিজের কাঁটা ও নিজের ফুল বিকাশ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে পারিয়াছে।

সে সময়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সরোজিনী নাটকটি লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই নাটকের জন্য 'জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ' পরিণত গানটি লিখে দেন। জ্যোতিদাদা তাকে প্রমোশন দিয়ে এরপর থেকেই তার সমশ্রেণীতের তুলে নিয়েছিলেন। ১৮৭৭ সালে ভারতী পত্রিকা বের করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। এই পত্রিকার কারণে রবির কাছে জীবন অর্থময় হয়ে উঠেছে। তখন তাঁর বয়স ১৬।

রবীন্দ্রনাথ দেখছেন এই সময় নতুনদাদা এই প্রথম গানের সুর তৈরি করছেন। সুর তৈরি করা যে খুব সহজ বিষয়—সেটা দাদাকে দেখে শিখেও নিচ্ছেন। নতুনদাদা তার পিয়ানোতে নতুন নতুন সুর করছেন। আর সুরে শান্ত ভঙ্গিতে অনায়াসে কথা বসিয়ে গান রচনা করে ফেলছেন বালক রবি।

দেবেন্দ্রনাথ এই কর্মোদ্যোগী জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে জমিদারি দেখার দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে একতলায় অবস্থিত কাছারির অফিসে হিসাবপত্তর দেখছেন। সঙ্গে গুণেন্দ্রনাথ। দুপুরের খাবার খেয়ে গুণেন্দ্রনাথ দেবেন্দ্রনাথের বাড়ির একতলায় জমিদারির কাজ করতে করতে কাছারিকে দুই ভাই ক্লাবের মতোই করে নিয়েছেন। কাজের সঙ্গে হাস্যালাপের বড়োবেশি বিচ্ছেদ ছিল না। মাঝে মাঝে একটা কৌচে হেলান দিয়ে বসলে ছুটি-ছাটায় বালক রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোলের কাছে এসে বসতেন। গুণেন্দ্রনাথ প্রায়ই তাঁকে ভারত বর্ষের ইতিহাসের গল্প বলতেন। এই বয়সকালেই তিনি চুরি করে দীনবন্ধু মিত্রের জামাই বারিক প্রহসন বইটি পড়ে ফেলছেন।

জমিদারীর হিসাব দেখার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্র জমিদারি মহালে চলে গেছেন। মাঝে মধ্যে গেছেন শিলাইদহে। সেখানে খুঁজে বের করেছেন লালন ফকিরকে। তার গান শুনতে শুনতে স্কেচ করে নিচ্ছেন। আর নিজে লিখছেন ঐতিহাসিক নাটক পুরুবিক্রম। সেটা ১৮৭২ সালের ঘটনা।

১৮৭৪ সালে সারদাচরণ মিত্র ও অক্ষয় সরকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে প্রাচীনকাব্য সংগ্রহ কয়েক খণ্ডে। নতুনদাদা সেগুলো কিনছেন। আর রবি পড়ে মনের মধ্যে গেঁথে নিচ্ছেন বৈষ্ণব কবিতার ভাব ও ভাষা। নতুনদাদা এই ছোটোভাইটিকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলছেন। রবীন্দ্রনাথে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার বীজটিকে তিনি পরিকল্পিতভাবে বুনে দিচ্ছেন। জল দিচ্ছেন। আলো দিচ্ছেন। হাওয়া দিচ্ছেন। আর রবীন্দ্রনাথও এই বীজকে আপনার প্রাণের ভেতরে অঙ্কুরিত করে নিচ্ছেন। ভ্রুণমূলটি বেরুচ্ছে। বীজপত্রটি মেলছে মাটির ভেদ করে। কাণ্ড জেগে উঠেছে। শাখা প্রশাখা ছড়িয়েছে। পাতা ধরেছে। ফুল ও ফলে বিরাট মহীরূহে পরিণত হয়েছে। জমিদার বাড়ির ছেলেটি জমিদারীর বদলে আসমানদারীর খাতায় নাম লিখে ফেলেছেন। তিনি প্রকৃতি দেখেন। মানুষ দেখেন। মানুষের ভেতরে সহজ মানুষটিকে খুব সহজেই খুঁজে নিতে পারেন।

তার আগেই জ্যোতিরিন্দ্র নীলের ব্যবসা কিছু অর্থ করেছিলেন। সেটা দিয়ে তিনি জাহাজ কিনলেন। নাম দিয়েছিলেন নিজের নাটকের নামে—সরোজিনি। খুলনা বরিশাল রুটে এই জাহাজটি বৃটিশ জাহাজ কোম্পানীর সঙ্গে ব্যবসায়ে পাল্লা দিতে যাত্রীদের জন্য টিকিট ফ্রি করে দিলেন। ফ্রি টিকিটের সঙ্গে মাগনা খাওয়া দেওয়া হত যাত্রীদের। ফলে জাহাজ ব্যবসাটি মার খায়। বিপুল অঙ্কে ঋণী হয়ে পড়েন। কাদম্বরীর মৃত্যুর পরে আর তিনি বিয়ে করেননি। ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন সব কিছু থেকে।

১৮৯৮ সালে তিনি সত্যেন্দ্রনাথের বির্জিতলার বাড়িতে খুলেছেন পারিবারিক খাতা। এই খাতাটি একটি অনন্য বস্তু। খাতাটি রাখা থাকত সিঁড়ির কোণে। এখানে পরিবারের যো কোনো সমস্যই যে কোনো বিষয় নিয়ে মন্তব্য লিখতে পারতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে লিখে খাতাটির উদ্বোধন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথও পরবর্তি তিন বছর অনেক বিচ্ছিন্ন ভাবনাচিন্তা এখানে লিখে রেখেছেন। সবাই দেখেছেন পড়েছেন। মন্তব্য করেছেন। আর পরে তিনি এই ভাবনাগুলিকে আশ্রয় করে স্থায়ী পরিণত লেখা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথকে শিলাইদহে নিয়ে গিয়েছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয করিয়ে দিয়েছিলেন বাংলা প্রকৃতির সঙ্গে।

জ্যোতিরিন্দ্র ৪৬ টি বই লিখেছেন। অসাধারণ স্কেচ করেছেন। বিখ্যাত চিত্রকর রোদেন স্টাইন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের এই স্কেচ দেখে মন্তব্য করেছেন-

তিনি পেশাদার চিত্রকর নন।…তার অঙ্কিত মুখগুলিতে যে রেখা ও অবয়বের সংবেদনশীলতা দেখা তা ব্স্মিয়কর। আর আমার মনে হয়েছে, ছবিগুলি আঁকা হয়েছে নিরতিশয় স্বাভাবিকতার সঙ্গে। পাশ্চাত্য রীতিঅনুসরণ করবার অতিমাত্রিক প্রবণতা তাঁর মধ্যে নেই। আবার মুঘল ধারা অনুসরণ করবার সচেতন ঝোঁকও তার মধ্যে লক্ষ করা যায় না। এই প্রসঙ্গে তাঁর আঁকা ভারতীয় মহিলাদের ছবিগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার চিত্রশৈলী সরল ও বিনয়পূর্ণ। কিন্তু প্রত্যেকটি ড্রয়িং দেখে অনুভব করা যায় যে তাঁর মডেলের অন্তর্লীন অবয়বের সুকুমারত্ব এবং চরিত্রের বিশেষত্ব ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টায় তিনি নিবিষ্ট হয়ে গেছেন।

আমরা অভ্যস্থ হয়ে গেছি জমকালো পোষাক পরা মহারাজাদের ছবিই কেবল দেখতে, বা ভ্রমণকাহিনীগুলির মধ্যে অদ্ভুত ধরনের মানুষের ছবি দেখতে। এইসব সংস্কৃতিবান, রুচিবান, ভদ্র ভারতীয় নারী আর পুরুষের সম্পর্কে কমই জানি আমরা। তাই এই সোজাসুজি আঁকা ছবিগুলি দেখা আমাদের কাছে এক অত্যন্ত আনন্দজনক অভিজ্ঞতা।

রবীন্দ্রনাথকেও পরবর্তিকালে ছবি আঁকতে দেখা যায়। তিনিও নতুন দাদার পথে এঁকেছেন সাধারণ মানুষ আর প্রকৃতির ছবি। এইখানে এসে বোঝা যায় দাদার হাত ধরে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ছোটো ছেলেটি তার ভেতরে বংশধারায় পাওয়া জমিদারী মুখোশটি ছুড়ে ফেলে মানুষের মুখটিকে স্থাপন করে নিয়েছেন। তিনি অন্যমানুষ। তিনি দ্বারকানাথের মত ব্যবসাদার নন। দেবেনাথের মত ধর্মমার্গী নন। তার পেশা আসমানদারী। তাঁর শেকড়টি মাটিতে, মানুষে, প্রাণে—বিশ্বের মহাপ্রাণে।

ছবি পরিচিতি.

১. নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২. কাদম্বরী দেবী, ৩. জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, সত্যন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাদম্বরী ঠাকুর। ৪. লালন শাহ।

দ্বাদশ পর্ব http://www.facebook.com/porimanob?sk=notes

কাদম্বরী আলেখ্য : http://www.youtube.com/watch?v=mxpE-ZAJKsI&feature=related

——————————————————————-

চতুর্দশ পর্ব

কুলদা রায়

এমএমআর জালাল

রবীন্দ্রনাথের জন্মের কাল

ঠাকুরবাড়ির আঙিনার আলো

ইংরেজদের শাসনের একশো বছর পূর্তি হয় ১৮৫৭ সালে। এ বছরই সিপাহী বিদ্রোহ ঘটে। ইংলন্ডের মহারানী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাত থেকে শাসনভার নিয়েছেন। ১৮৫৮ সাল থেকে পরিবর্তনের কাল শুরু হয়েছে।

এর পঞ্চাশ বছর আগে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নামে কিন্তু কলেজ হলেও সুনিয়ন্ত্রিণ ছিল ইংরেজদের হাতে। কলেজটি ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ১৮৫৭ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। বিধবা বিবাহ পাশ হয়েছে ১৮৫৬ সালে।

দেবেন্দ্রনাথের তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মসমাজে রূপান্তরিত হয়ে ধর্মআন্দোলনে পরিণত হয়েছে। কেশবচন্দ্র সেন মশাই এই আন্দোলনকে নবপ্রাণ দিচ্ছেন।

বাংলা সাহিত্য জগতে বিরাট পরিবর্তন হচ্ছে। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্য লিখতে শুরু করেছেন। প্যারীচাঁদ মিত্র আলালের ঘরের দুলাল লিখে বাবুদের ফুঁটো করে দিয়েছেন। নাটক লিখছেন রামনারায়ণ তর্কালঙ্কার—দীনবন্ধু মিত্র—মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

উনবিংশ শতাব্দির প্রথমার্থে ইংরেজদের সাহচর্যে ও ইংরেজীসাহিত্যর হাত ধরে বাংলার স্রোতহীন জীবনে এক আলোড়ন এসেছিল। দিয়েছিল ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী। উনবিংশ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধে নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে দেশীয় ভাবধারা মিলিত হয়ে এক বিমিশ্র সংস্কৃতির উদ্ভব হয়। উনিশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ বছর বিদেশী চিন্তাভূমির কর্ষণযন্ত্র দিয়ে বাঙালির মানসভূমি বিদেশী সাহিত্যের ভাবরসে কর্ষিত হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে এসে সেই কর্ষিত ভূমিতেই বীজ বপন করে রাজনীতি শিক্ষা সমাজ ধর্ম ও সাহিত্য সর্বক্ষেত্রেই বাংলা তখন ফসল ফলানো শুরু করেছে। বাংলা তখন এক নতুন সভ্যতার দরোজায় পৌঁছে গেছে।

গোটা উনিশ শতক ধরেই কোলকাতার ঠাকুর পরিবার ব্যবসা বানিজ্য ও ইংরেজদের চাকরির বদৌলতে সমাজে সম্পদ, সামাজিক সম্মান ও প্রতিপত্তির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। দ্বারকানাথের সময়ে গেছে তা চূড়ান্ত সীমায়। দেবেন্দ্রনাথের সময় থেকে সেসব হারিয়ে কেবল জমিদারিনির্ভর এক উচ্চবিত্ত পরিবার হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল।

এই আর্থিক অবনতির সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির পূজা অর্চনার অনুষ্ঠান ধর্মকর্মও বদলে গেছে। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় সব ধরনের পৌত্তলিকতা বর্জন করেন। ঠাকুরবাড়ির বিখ্যাত দুর্গাপূজা উঠে যায়। দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধ পুরোপুরি হিন্দুধর্মঅনুসারে না করায় দেবেন্দ্রনাথকে আত্মীয়স্বজন ত্যাগ করেন। এইসব কারণে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বদলে ঠাকুর পরিবার বেছে নেন কিছু অসাম্প্রদায়িক আচার অনুষ্ঠান—মাঘোৎসব, বর্ষশেষ, নববর্ষ ইত্যাদি। এই অনুষ্ঠানগুলোতে যোগ দেন অনাত্মীয়– অন্যপথের লোকজন।

সে সময় ধনী পরিবারে বাংলাভাষার বদলে ইংরেজি ভাষাই আদরণীয় ছিল।  ঠাকুর পরিবারে ইংরেজি ভাষার বদলে বাংলা ভাষায় কথা বার্তা বলা, চিঠিপত্র লে ও লেখাপড়াও বাংলাভাষায় প্রচলন হয়। এই বাংলাভাষা ঠাকুরবাড়ির ভাষা নামে পরিচিত হয়েছিল। তারা বেশভূষা, আদবকায়দা ও চালচলেনও স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছিল। এইভাবে তারা অর্থবিত্তের বদলে সাংস্কৃতিক অভিজাত্য অর্জন করেছিল।

ঠাকুরপরিবারের দ্বারকানাথ ইউরোপে গিয়েছিলেন। তার ছেলে দেবেন্দ্রনাথ নিজে না গেলেও তার ছেলে-আত্মীয়স্বজনরা লেখাপড়ার উদ্দেশ্য ইংলন্ড যাওয়া শুরু করেছেন। ইউরোপীয় শিল্প সাহিত্য দর্শন তারা আত্মস্থ করলেও দেবেন্দ্রনাথের উপনিষদের মাধ্যমে গভীরভাবে প্রাচীনভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। চৈত্রমেলা বা হিন্দুমেলার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার লোকসস্কৃতির সঙ্গেও তাদের পরিচয় ঘটেছে। ঠাকুরবাড়িতে যাত্রা পালাগান বাউলগানের আসর বসেছে। আবার বিষ্ণ চক্রবর্তী নিধুবাবু রূপচাঁদপক্ষীদের ছড়া কালোয়াতি  আখড়াই গানের প্রবেশ ঘটেছে।

ঠাকুরবাড়িতে আশ্রিত দরিদ্র আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে, বাড়ির চাকর মহলের মাধ্যমে রূপকথা লোককথা পাঁচালিগানেরও অবাধ প্রবাহ ছিল। এই সকলের মেলবন্ধনে ঠাকুরবাড়িতে পুরনোর সঙ্গে নতুনের সহযাত্রা ঘটেছে। বৈচিত্র্যের সঙ্গে বিরোধ নয়– ঐক্যের জয়ধ্বনী ঘোষিত হয়েছে। ফলে শুধু শিল্প সংস্কৃতির মত মানসপরিবর্তন নয়—ব্যবসা জমিদারীর ক্ষেত্রেও তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই পরিবর্তনের পালা শুরু হয়েছে। ফলে দেখা যায়—দ্বারকানাথের পরবর্তি প্রজন্ম আর ব্যবসায়ে সিদ্ধি লাভ করতে পারেন নি। নতুন করে জমিদারী-বিত্তবেসাত বাড়াতে পারেননি। কিন্তু মানবচিত্তবিদ্যায় তাঁদের পূর্বপুরুষকে টপকে গেছেন।

শেকসপীয়র ওয়ালস্কট প্রভৃতি ইংরেজ লেখকদের পাশাপাশি ঠাকুর পরিবার ফরাসী কাব্যসাহিত্যের দিকেও হাত বাড়িয়েছেন। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তা ও সৃষ্টির সঙ্গে তারা পরিচিত হয়ে আত্মস্থ করেছেন। স্বদেশী সাহিত্যকে নব নব ভাবসম্পদে ও সৌন্দর্য পূর্ণ বিকশিত করেছেন। ঠাকুরবাড়িতে নিয়মিত এসেছেন সেসময়কার প্রখ্যাত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগেই ঠাকুরবাড়ির পরিবেশে সাহিত্যরসের সৃজনশীল ধারা পূর্ণমহিমায় প্রবাহমান ছিল।

রামমোহনের সময় থেকেই ব্রাহ্মধর্মসমাজে উপসনার অঙ্গ হিসাবে সঙ্গীতকে গ্রহণ করা হয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ কৃষ্ণ ও বিষ্ণু চক্রবর্তী নামে দুজন বেতনভোগী গায়ক ব্রাহ্মসমাজের গান গাইতেন এবং গানের সুর দিতেন। রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, দ্বেজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, গণেন্দ্রনাথ অনেক হিন্দি গান গান ভেঙ্গে বাংলায় ব্রাহ্মসঙ্গীত রচনা করেছেন। একা বিষ্ণু চক্রবর্তী ৬০০ গানের সুর দিয়েছেন। ঠাকুরবাড়িতে যদু ভট্ট গান শেখাতেন। দ্বারকানাথ নিজেও ইউরোপীয় সঙ্গীত শিখেছিলেন। সঙ্গীতের এই ধারা পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত হয়েছে। এবাবে দেখা যায় ঠাকুরবাড়িতে বিশুদ্ধ সঙ্গীতের একটি পরিবেশ গড়ে উঠেছিল।

চিত্রবিদ্যারও বাড়িতে স্বাভাবিক ও সহজ চর্চা ছিল। গুণেন্দ্রনাথ, গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রখ্যাত শিল্পী ছিলেন। তাদের ধারাবাহিকতায় গগনেন্দ্রনাথের পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ভারতের শ্রেষ্ঠ শিল্পী ছিলেন। এছাড়াও হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও সহজাত শিল্পপ্রতিভা ছিল। এরা সবাই মিলে বাংলার শিল্পচর্চার ধারাটাই পাল্টে দিয়েছিলেন।

ঠাকুরবাড়ির ঘরগেরস্থালি

পিরালী ব্রাহ্মণ হওয়ায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে অভিজাত বা কুলীন ব্রাহ্মণেরা বিবাহসম্পর্ক করত না। ফলে তাঁদের নিজস্ব পিরালী ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যেই বিয়েসাদি হত। খুলনা-যশোর এলাকায় পিরারী থাক থাকায় এখান থেকে গরীব ঘর থেকে পাত্রী আনা হত। ফলে বিয়ের পরে এই গরীব আত্মীয়স্বজনদের আশ্রয় হত ঠাকুরবাড়িতে। তাদের ভরণপোষণেরও দ্বায়িত্ব নেওয়া হত। দেওয়া হত চাকরীবাকরী। ঠাকুর বাড়ির সেরেস্তায়  বা অন্যত্র কাজকর্ম করত। এরকম কজনের নামও পাওয়া যাচ্ছে। জ্যোতি, গুপি, পচা ও পুঁটে। জ্যোতি বাজার করত। গুপি দুধ দোহাত। পচা ও পুঁটে পাই ফরমাস খাটত। ছেলেদের সঙ্গে খোসগল্প করত। তাদের বউয়েরাও মাঝে মাঝে এসে থাকত। আবার দেশগাঁয়েও যেত বিষয়সম্পত্তি দেখার জন্য।

ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার জন্য যেসব পাত্র যোগাড় করা হত পেঁয়াজ খাওয়া ব্রাহ্ম শ্বশুরের কারণে তাদের জাত যেত। ফলে তাদেরকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করে ঘরজামাই করে রাখা হত। এভাবে ঠাকুরবাড়িতে এই আশ্রিত লোকজনেরা শাখাপ্রশাখা মিলে রীতিমত একটি কলোনীতে রূপান্তরিত করে ফেলেছিল।

ঠাকুরবাড়ি ছিল একান্নবর্তী পরিবার। ধান আসত জমিদারী থেকে। গোলাবাড়িতে মজুত হত। ঢেঁকিশালে ভানা হত। রান্না হত এজমালি মাইনে করা ঠাকুরের হাতে। রান্নার মধ্যে ডাল, সবজি, মাছ, মাংস অন্তর্ভুক্ত ছিল। রবীন্দ্রনাথের নদিদি স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলাদেবী স্মৃতিচারণ করেছেন—

আমি যখন প্রায় পাঁচ বছর বয়সে (১৮৭৭ সাল) জন্মপুরীতে ফিরে এসে তার হাওয়ায় মানুষ হতে লাগলাম, তখন সে পুরী জমজম গমগম করছে। প্রতি মহলে মহলে ঘরে ঘরে লোক। কর্তাদাদা মহাশয়ের (দেবেন্দ্রনাথ) ছেলে মেয়ে, জামাই-বউ, নাতি-নাতনি, দাসদাসীতে বাড়ি ভরা। সে বাড়ির রান্নাঘরে দশ-বারজন বামুন ঠাকুর ভোর থেকে রান্না চড়ায়। সে প্রকাণ্ড রান্নাঘরের দুপাশে ভাগ করা মেঝেতে পরিস্কার কাপড় পেতে ঢালা হয়। সে ভাত স্তুপাকার হয়ে প্রায় কড়িকাঠ স্পর্শ করে। তারই পরিমাণে ব্যঞ্জনাদি প্রস্তুত করে দিনে সেই ভাতব্যঞ্জন ও রাত্রে লুচিতরকারি—লোক গুণে গুণে পাথরের থালাবাটিতে  সাজিয়ে মহলে মহলে ঘরে ঘরে দিয়ে আসে বামুনেরা।

…ঘরে ঘরে বামুনেরা যে খাবার দিয়ে যেত সেটা হল সরকারি রান্নাঘরের যোগান, এর উপরে ছিল প্রতি মহলে তোলা উনুনে গিন্নিদের নিজের নিজের রুচি ও স্বামীর ফরমান অনুযায়ী বেসরকারি বিশিষ্ট রান্না আলাদা করে হত।' তখন দিনে ১৩০ লিটার দুধ আসত।  তখন টাকায় ছসের করে দুধ। সামনে এসে দুইয়ে দিয়ে যেত গয়লারা। সে দুধে পুরো বন্যা বয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার।

রবীন্দ্রনাথের জন্মকালে কোলকাতা–

জোড়াসাঁকোর বাড়িটি ছিল কোলকাতার চিৎপুর রোডে। এটা ছিল আধা শহুরে আধা গ্রাম্য। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-তখন শহর এবং পল্লী অল্পবয়সের ভাইভগিনীর মতো অনেকটা এরকম চেহারা লইয়া প্রকাশ পাইত।

তখন চিৎপুর রাস্তায় মেঘ কল্লে কাদা হয়। ধুলো উড়িয়ে স্যাকড়া ড়াড়ি চলে। ঘোড়ার গাড়ির চালায় হাড়জিরজিরে ঘোড়া। তার পিঠে চাবুক পড়ে। বাসগাড়ি-রেলগাড়ি কখনো আসে নি।

তখন কোলকাতার লোকজন খুব ঢিলেঢালা। কাজের চাপ খুব বেশী ছিল না। কেরানী বাবুরা তামাক খেয়ে পান চিবুতে চিবুতে আফিসে যেতেন। পালকী বা ভাড়াগাড়ি তাদের নিয়ে যেত। টাকাওয়ালা বাবুদের জন্য ছিল তকমা আঁকা গাড়ি। বক্সে পাগড়ীপরা কোচম্যান। পিছনে দুজন সহিস। তারা পথচারী দেখলেই হেঁইয়ো হেঁইয়ো বলে পিলে চমকে দিত। মেয়েদের ঘরের দরোজা দরজা বন্ধ। বাইরের দরোজাও বন্ধ। গাড়িতে চড়া ছিল লজ্জার। আর কেউ যদি মেয়েদের পা, মোজা বা সেমিজ দেখে ফেললে লজ্জার শেষ নেই। তবু বাবুদের মেয়েরা পালকীতে চেপে কখনো কখনো বাইরে যেত। পালকীর চারিদেকে মোটা কাপড় দিয়ে ঘেরা থাকত। পালকীর ভেতরটা অন্ধকার। গুমোট। তাকে কেউ দেখতে পেত না। সেও কাউকে দেখত পেত না। এই পালকীটাকে চলমান গোরস্থানের মত দেখতে ছিল। এদের পাশে পাশে পাহারাদার হিসাবে দেওয়ানজীরা চলত। তাদের মোটা গোঁফ। মাথায় পাগড়ী। হাতে পিতলে বাঁধানো লাঠি। এই পাহারাদাররা ব্যাংকে বাবুদের সঙ্গে যেত। কুটুমবাড়িতে মেয়েদের পৌঁছে দিত। আর পূজাপার্বনের দিনে বাড়ির গিন্নিকে গঙ্গাতে পালকীশুদ্ধ চুবিয়ে আনত। এটা তাদের গঙ্গা স্নান। আর ছিল কোলকাতায় এখানে ওখানে বিস্তর শুড়িখানা। মেদো মাতালদের হৈহুল্লা। ঠাকুরবাড়ির পাশেই ছিল কোলকাতার সবচেয়ে বড় বেশ্যাপাড়া।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি–

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির ফটক পেরিয়ে দুটি বাড়ি ছিল একই প্রাঙ্গনে। একটির নাম আদিবাড়ি বা আদি ভদ্রাসন বাড়ি। অন্যটি বৈঠকখানা বাড়ি। প্রথমটি দোতলা। আর দ্বিতীয়টি তেতলা। অনেকগুলো ঘর, অনেকগুলো মহল আর অনেকখানি বাগান জুড়ে এই দুই বাড়ি মিলিয়ে এক বাড়ি।

বাড়ির ঈশানকোণে বিশাল এক তেঁতুল গাছ। সেই তেঁতুল গাছের ছায়ায় ছিল ছিরু মেথরদের ঘর। বাহির-বাড়িতে দোতলায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে চাকরদের মহল। এ ঘরে বালক রবীন্দ্রনাথদের দিন কাটত। পুকুরের ধারে তারা গয়লানির গোয়াল ঘর।

দেবেন্দ্রনাথ বৈঠকখানার বাড়িটি গিরীন্দ্রনাথদের ছেড়ে দিয়ে আদি ভদ্রাসন বাড়িটিতে চলে আসেন। পরে এই বাড়িটিকে তেতলা করা হয়।

ঠাকুরবাড়ির অন্ধকার

আর ভেতরবাড়িতে একতলায় আলোবাতাসহীন ছোটো ছোটো ঘরগুলিতে গ্রাম থেকে আগত আত্মীয় স্বজনদের বাস। রবীন্দ্রনাথ নারী শিক্ষা নামে এক বক্তৃতায় লিখেছেন—

ছেলেবেলা থেকে আমাদের বাড়িতে দেখেছি কত নিঃসহায় অনাথা স্থান পেয়েছে। প্রকাণ্ড বাড়িটি তাদের বসবাসে একেবারে পায়রার খোপের মত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অধিবাসিনীদের অবস্থা ছিল তখন অতি শোচনীয় ছিল। তাদের অশিক্ষিত মন আত্মাবমাননাতে পূর্ণ হয়ে থাকত। তারা কোথাও আত্মমর্যাদা অনুভব করতে পারেনি। তখনকার দিনে দেশের অন্যান্য মেয়েদের মত তারা অভ্যস্ত অজ্ঞানতা ও অন্ধকারের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিল। তারা পরস্পরে ঈর্ষা করেছে, নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির দ্বারা যতরকম কুচিন্তার প্রশ্রয় দিয়েছে। মানুষের জগতে তাদের স্থান কত তলায়, তা বোধ করবার শক্তি তাদের ছিল না। এর ফলে হয়েছিল বাড়িময় অশান্তি, পরস্পরের লাগালাগি ও কলহ বিবাদ।

ওদের সামনে জীবনের সকল পথই রুদ্ধ, সংকীর্ণ অস্বাস্থ্যকর আশ্রয়ে পরের অনুগ্রহের জুয়াখেলায় তাদের রাত্রিদিন কলুষিত।

এই আলোঅন্ধকারের ভেতর থেকে রবীন্দ্রনাথ এসেছেন। শিখেছেন রবীন্দ্রগিরি।

পঞ্চদশ পর্ব-————————

রবীন্দ্রনাথের প্রথম ভ্রমণ : শিলাইদহ

পনের বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে যান। বাবার সঙ্গে আসা। এর আগে তিনি হিমালয়ে ঘুরে এসেছেন। বালককে দেবেন্দ্রনাথ জ্যোতির্বিদ্যা, প্রকৃতিপাঠ, ধর্মতত্ত্ব, দায়িত্বজ্ঞানসহ নানাবিষয় শেখাচ্ছেন। বছর দুই আগে যখন হিমালয়ে গিয়েছিলেন–পথে কিছুদিন বোলপুরে শান্তি নিকেতনে থেকেছিলেন। তখন পর্যন্ত ধানগাছই তিনি দেখেননি। শান্তিনিকেতনেও সে সময় মাঠ ফাঁকা ছিল। ধান কাটা হয়ে গেছে সারা।

তারিখটা ১৮৭৫ সালের ৬ ডিসেম্বর। সোমবার। শিলাইদহের উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছেন বোটে করে। গঙ্গা নদীতে বোট চলেছে। সেখানে বাবার বুক সেলফে খুঁজে পেয়েছেন কবি জয়দেবের গীত গোবিন্দ বইটি।

বাবা-ছেলে ঠিক কোন তারিখে শিলাইদহে পৌঁছেছিলেন ঠিক জানা যায় না।  ক্যাশবইতে লেখা আছে, কোলকাতা থেকে ৮ ডিসেম্বর দেবেন্দ্রনাথের কাছে ডাক পাঠানো হয়েছে। ডাকে ছোটোবাবুর জন্য শিলাইদহে পাঠানো হয়েছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটক সরোজিনী। সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। এই নাটকে রবি জ্বল জ্বল চিতা নামে একটি গান লিখে দিয়েছিলেন। নাটকটি সাড়া ফেলেছে। সঙ্গে চিঠি। লিখেছেন কাদম্বরী বৌঠান। পরে এ যাত্রায় আরও তিনটি চিঠি বৌঠান পাঠিয়েছেন। দেবেন্দ্রনাথ একটু কৌতুহলী হয়ে জেনে নিয়েছিলেন পত্রলেখিকার নামটা। এইটুকু।

শিলাইদহ ভ্রমণের একটি সংবাদ বিবরণী তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেখান থেকে  জানা যাচ্ছে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ নানাবিধ ধর্মসভায় যোগদান করছেন।

গত ৮ঠা পৌষ শনিবার প্রধান আচার্য মহাশয় জলপথে ভ্রমণ করিতে করিতে রামপুর বোয়ালিয়ায় উপস্থিত হয়েন। তাঁহার আগমণে এখানকার ব্রাহ্মমণ্ডলী মহা ঊৎসাহিত হইয়া, গত ৫ ই পৌষ (১৯ ডিসেম্বর, ১৮৭৫) প্রাতঃকালে অত্রত্য ব্রাহ্মসমাজে উপসনা কার্য্য সম্পাদন করেন। উপসনাসমাজে প্রায় তিনশতেরও অধিক ভদ্রলোকের সমাগম হয়।…শ্রীযুক্ত প্রধান আচার্য্য মহাশয় বেদী গ্রহণ করেন। …স্বাধ্যায়ের পরে প্রধান আচার্য্যের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুমর্ধর স্বরে একটি মনোহর ব্রাহ্মসঙ্গীত করেন। (তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, মাঘ সংখ্যা)।

সেবারে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে বোটে ছিলেন না। ছিলেন কুঠি বাড়িতে। কুঠি মানে নীলকুঠি। এই কুঠিটি কিনেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর নীলকর সাহেবদের কাছ থেকে।

শিলাইদহ : দহের শেলী সাহেব থেকে কোথায় পাব তারে 

শিলাইদহ কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার একটি গ্রাম। এটা পূর্বে নদিয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরগণারটির নাম বিরাহিমপুর। নদীয় কালেক্টরের ৩৪৩০ নং তৌজি। দ্বারকানাথের বাবা রামলোচন ঠাকুর এই জমিদারিটি কিনেছিলেন। শিলাইদহের উত্তরে পদ্মা এবং পশ্চিম দিকে গড়াই নদী। এই দুটি নদী গ্রামটিকে আধখানা চাঁদের মতো ঘিরে আছে।

গ্রামটির নাম আগে শিলাইদহ ছিল না। ছিল খোরশেদপুর। তিনটি মৌজা নিয়ে গ্রামটি গঠিত। খোরশেদপুর, কশবা ও হামিরহাট। এই তিনটি মৌজাকে একত্র করে শেলী সাহেবের নামে নাম দেওয়া হয় শিলাইদহ। পদ্মা ও গোরাই নদীর সংযোগস্থল একটি দহের আকার নিয়েছে। দহ অর্থ নদী বা জলাশয়ের অতলস্পর্শ ও ঘূর্ণিময় অংশ।

শেলী একজন নীলকর সাহেব। কুঠি স্থাপনের আগে থেকেই এখানে সাহেব বাস করতেন। শেলী ও তার স্ত্রীর কবরও ছিল পুরনো কুঠি বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ কবর দুটি দেখেছিলেন। খোরশেদপুরে খোরশেদ ফকির বাস করতেন। তার নামে একটি দরগাও রয়েছে। এই ফকিরের নামে একটি কিংবদন্তী আছে।

রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে থেকেছেন তখন উচ্চ বর্ণের হিন্দু প্রজাদের সংখ্যাও কম ছিল না। গ্রামের মাঝখানে একটি মন্দির ছিল—গোপীনাথদেবের মন্দির। রাজা সীতারাম এই মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন। রানী ভবানী শিলাইদহ গ্রামটির অধিকার নিলে দেবসেবায় ব্রহ্মত্র জমি দান করেছিলেন। এই জমির আয় দিয়ে এই মন্দিরের ব্যয়নির্বাহ করা হত। গোপীনাথ মন্দির প্রাঙ্গণে একটি রথ ছিল। কাঠের তৈরী। বেশ কারুকার্য্যখচিত। এই রথের কারণে এই জায়গাটি রথতলা নামে পরিচিত। ছেলেবেলা—লেখায় রবীন্দ্রনাথ রথতলার মাঠের নাম করেছেন।

পদ্মা ও গড়াই নদীর সংযোগস্থলে বুনাপাড়া। এখানেই কুঠিরহাট ও শিলাইদহ খেয়াঘাট। অনেক বড়ো বাগানের মধ্যে কুঠিবাড়িটি। তিনতলা। নীচের তলায় জমিদারি কাছারি অফিস। উপরতলায় জমিদারবাবুদের বাসস্থান। ১২৯০ বঙ্গাব্দে পদ্মানদীর ভাঙনে কুঠিবাড়িটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তার মালামাল নিয়ে নদী থেকে কিছু দূরে নতুন কুঠিবাড়ি নির্মিত হয়।

রবীন্দ্রনাথ শিলাদহে এই ভ্রমণকালে কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ হাতে নিয়েছেন। বইটি ফোর্ট উইলিয়াম থেকে প্রকাশিত। বাংলা অক্ষরে ছাপা। রবীন্দ্রনাথ বহুবার গীতগোবিন্দ পড়েছেন। এর আগে সংস্কৃত ঋজুপাঠ, কুমারসম্ভব ও শকুন্তলা পড়েছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় লেখা হলেও বাংলায় প্রেমগীতি সাহিত্য গীতগোবিন্দ থেকেই শুরু। রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজের প্রধান আচার্য্য। ব্রাহ্মরা রাধাকৃষ্ণ বিষয়ে কোনো ধর্মীয় ভক্তি পুষত না। কিন্তু সকল বিদ্যা পড়ায় কোনো বাঁধা নিষেধ ছিল না। বিদ্যাপতির পদাবলী, গীতগোবিন্দর আদিরসাত্মক বর্ণনাসমৃদ্ধ প্রেমরহস্য কিশোর কবি রবীন্দ্রনাথের চিত্তকে আবিল করেছিল।  তিনি লিখেছেন—জয়দেব যাহা বলিতে চাহিয়াছেন তাহা কিছুই বুঝি নাই। কিন্তু ছন্দে ও কথায় মিলিয়া আমার মনের মধ্যে   যে জিনিসটি গাঁথা হইয়াছিল তাহা আমার পক্ষে সামান্য নহে। জয়দেব সম্পূর্ণ না বুঝলেও কাব্যের সৌন্দর্যে তার মন ভরে উঠেছিল। এ কারণে তিনি একটি খাতায় গীতগোবিন্দ পুরোটাই লিখে নিয়েছিলেন।

পিতৃস্মৃতি'তে লিখেছেন—আমার মনে আছে, নিভৃতনিকুঞ্জগুহং গতয়া নিশি রহসী নিরীয় বসন্তং—এই লাইনটি আমার মনে ভারি একটি সৌন্দর্যের উদ্রেক করিত—ছন্দের ঝংকারের মুখে নিভৃতনিকুঞ্জগুহং এই একটিমাত্র কথাই আমার পক্ষে প্রচুর ছিল। গদ্যরীতিতে সেই বইখানি ছাপানো ছিল বলিয়া জয়দেবের বিচিত্র ছন্দকে নিজের চেষ্টায় আবিষ্কার করিয়া লইতে হইত—সেটাই আমার বড়ো আনন্দের কাজ ছিল।

পরে তিনি এই বৈষ্ণব পদাবলীর ভাষা আয়ত্ব করেছিলেন। লিখেছিলেন ভানুসিংহের পদাবলী। পরের বছর লিখেছিলেন—

গহন কুসুম-কুঞ্জ মাঝে

মৃদুল মধুর বংশি বাজে…

এ সময় আরও পড়েছেন নতুন বৌঠানের চিঠি। তার উত্তরও পাঠিয়েছেন। সরোজিনী নাটকটি আবার পড়েছেন।  এইবার মাত্র কয়েকদিনই ছিলেন। কোলকাতায় ফিরে গেছেন ২২ ডিসেম্বর। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন রামসর্ব্বস্ব ভট্টাচার্য। এ বাবদ খরচ হয়েছে ২০ টাকা।

প্রবলপ্রতাপান্বিত মহর্ষির বাবার সামনে ভালো করে পল্লীর রূপের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা এবারে ঘটতে পারেনি। সব সময়ই বাবাগিরির একটা শেকল তাকে পাখা মেলতে দেয়নি। তবে তাঁর তৃষ্ণা জন্মেছে। ভেতর ঘরে পল্লীর জন্য হাতছানি বেড়ে ওঠেছে।

২৩ ডিসেম্বর ভারতসম্রাজ্ঞী রানী ভিক্টোরিয়ার বড় ছেলে প্রিন্স অব ওয়েলস সেরাসিস নামে রাজকীয় জাহাজে করে কোলকাতায় আগমণ করেছেন। সে উপলক্ষ্যে নগরীর সৌধগুলি ও রাজপথগুলি বিচিত্র আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। নড়েচড়ে উঠছে কোলকাতা। সে সময়ই শিলাইদহে কেরোসিনের অভাবে টেমির আলো নিভে যায় সন্ধ্যার পর পরই। জোনাকি জ্বলে। শুক্লপক্ষে চাঁদ ওঠে। তারার আলো জাগে। এই পর্যন্ত। শিয়ালের হুক্কাহুয়া জাগে। দূরে কোথাও মাঝে মাঝে বাঘের আওয়াজ শোনা যায়।

রবীন্দ্রনাথ যখন তার বাবার সঙ্গে শিলাইদহে গিয়েছেন—তখন তার বয়স চৌদ্দ পনের। সদ্য কিশোর। স্কুল পালানো স্বভাবের কারণে সবাই বিরক্ত। ছকে বাঁধা লেখাপড়া তিনি করতে চান না। স্কুলে অনুপস্থিত থাকছেন। পড়া করছেন না। এজন্য অসুস্থতার ভানও করতে হচ্ছে। পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন না। দাদারা বড় ক্লাশে উঠে যাচ্ছেন। তিনি সেই এক ক্লাশেই থেকে যাচ্ছেন। শিক্ষকরা তাকে নানা ধরনের সাহিত্য পড়ানোর চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে ম্যাকবেথ, কালিদাসের শকুন্তলা, কুমারসম্ভব—তার মনে ধরেছে। পড়ছেন। কিছু কিছু তর্জমাও করছেন নিজ থেকে। প্রখ্যাত সঙ্গীতবিশারাদ যদুভট্টাচার্য ঠাকুরবাড়িতে গান শেখানোর দাযিত্ব নিয়েছেন। তিনি ধ্রুপদ, বিশেষত খাণ্ডারবাণী ধ্রুপদে বিশেষ দক্ষ ছিলেন। তানসেনবংশীয় বীনকার কাশেম আলী খাঁর কাছে তিনি সেতার শিক্ষা করেছিলেন। সুরবাহার ও পাখোয়াজেও তাঁর দক্ষতা ছিল। তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন এ বছর। তবে যদু ভট্ট যখনই তাঁকে শেকলে বাঁধতে চেয়ছেন-তখনই তিনি ফুড়ুৎ। তবে যা শিখেছেন নিজের মতো করেই শিখেছেন।

এ বছরের মার্চ মাসের ২৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মাকে হারিয়েছেন। তাঁকে দেখার দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী। জুন মাসে বেনে পুকুরে ন-দিদি স্বর্ণকুমারীর জন্য বাবা দেবেন্দ্রনাথ একটি বাড়ি কিনে দিয়েছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সরোজিনী নাটকটি কোলকাতায় থিয়েটারে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সেকালের নামী অভিনেত্রী নটি বিনোদিনী। রবীন্দ্রনাথের লেখা গান জ্বল জ্বল চিতা এ নাটকের প্রধান আকর্ষণ।

এ সময় পর্যন্ত ভারতে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। বঙ্গে ভূম্যধিকারী সভা নামে জমিদারদের একটা সংগঠন ছিল। তার মাধ্যমে কেবল জমিদারদের স্বার্থ দেখা হত। বৃটিশ শাসকদের সঙ্গে জমিদারদের সমস্যা নিয়ে কথা বলত। মুসলমান জমিদাররা এই সংগঠনটিকে তাদের যথার্থ প্রতিনিধি বলে স্বীকার করতে পারেননি। তারা ১৮৬৫ সালে মোহামেডান এসোসিয়েশন অব ক্যালকাটা নামে আলাদা একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সে সময়ে ইংরেজী শিক্ষার প্রসারের ফলে সরকারী ও বেসরকারী নানা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চাকুরীজীবীদের মধ্যে দিয়ে একটি মধ্যবিত্ত সম্পদ্রায় গড়ে উঠেছিল। তারা প্রথম দিকে ধর্ম ও সমাজসেবামূলক বিভিন্ন আন্দোলন নিয়ে মেতে উঠেছিল। কিন্তু সকল শ্রেণী পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্বমূলক কোনো রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না। অথচ রাজনৈতিক সচেতনতা মধ্যবিত্তদের মধ্যে গড়ে উঠছিল।

১৮৭৫ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ইন্ডিয়া লীগ নামে একটি সভা গড়ে ওঠে। এটা পরের বছরে ইন্ডিয়া এসোসিয়েশন গঠন করে। ঠিক দশ বছর পরে গঠিত হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন। ছাত্রদের মধ্যে গঠিত হয় স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন। ঠাকুরবাড়ির কিছু তরুণ এই সভার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসব কিন্তু হচ্ছে কোলকাতায়। আর কোলকাতা থেকে প্রথম বারের মত অজপাড়াগাঁ শিলাইদহে গিয়ে দেখতে পেলেন—নদী আর মানুষ নিঃসঙ্গে নির্জনে বয়ে চলেছে। তাঁর দেখা তার চেনা নাগরিক মানুষের সঙ্গে–প্রকৃতির সঙ্গে–জীবনের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।

এটা অন্যজীবন।

ছবি পরিচিতি.

১. খুব ছেলেবেলায় ঘোড়ার পিঠে রবি।

২. জ্যোতিরিন্দ্রনাথের করা স্কেচ থেকে গগণেন্দ্রনাথের রবি স্কেচ।

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ষোড়শ পর্ব

শিলাইদহে দ্বিতীয় ভ্রমণ : দাদার সঙ্গে বাঘ শিকার

দেবেন্দ্রনাথ হিমালয়ে যাবেন। জমিদারী দেখার দ্বায়িত্ব দিয়ে গেলেন পঞ্চম ছেলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উপর। বলে গেলেন-কোলকাতায় বসে জমিদারী দেখা চলবে না। যেতে হবে সোজা শিলাইদহে। সে সময়ে জমিদারিতে বেশ কিছু গোলমাল চলছিল। বিশেষ করে জমিদারীতে প্রজাসাধারণের কাগজপত্রাদি সুরক্ষিত ছিল না। জমিদারদের অনুপস্থিতিতে নায়েব আমলারা এটা নিয়ে প্রজাদের হয়রানী করত। প্রজাদের নিপীড়নের খবর সে সময়ে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় প্রকাশিতও হয়েছিল। এ কারণে কাঙ্গাল হরিনাথের বাড়িতে জমিদারের পাইক পেয়ারারা চড়াও হয়েছিল। খবর পেয়ে হরিনাথের বন্ধু লালন ফকির এসে লড়াই করে পাইক পেয়াদাদের ভাগিয়ে দিয়েছিল। সুতরাং দেবেন্দ্রনাথ জমিদারী নায়েব আমলাদের হাতে রাখাটা ভালো মনে করেননি।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চলেছেন শিলাইদহে ১৮৭৬ সালের ফাল্গুনে। । সঙ্গে নিয়েছেন ছোটো ভাই রবিকে। বাবার সঙ্গে আড়াই মাস আগে শিলাইদহ থেকে ঘুরে গেছেন। বাবার বিশাল ব্যক্তিত্বের ছায়ার গ্রাম দেখে আশ মেটেনি। এবার দাদার অবাধ স্নেহের অধিকারে তিনি চলেছেন শিলাইদহে।

তারা উঠেছেন শিলাইদহের কুঠি বাড়িতে। ক্যাশ বহির হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ সময় দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার জন্য পাঁচহাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। সুদ দিতে হবে বার্ষিক ছয় টাকা হারে। বাবার কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হল কেন? কারণ ঠাকুর বাড়ির সব এজমালি সম্পত্তি দেবেন্দ্রনাথের হাতেই ছিল। ছেলেমেয়েরা আত্মীয়স্বজনরা এখান থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেতেন। আর জ্যোতিরিন্দ্ররনাথ, রবীন্দ্রনাথসহ যারা ঠাকুরবাড়ির এস্টেটে চাকরী করতেন তারা নিয়মিত বেতন পেতেন। ঋণ নিয়ে কেউ কেউ স্বাধীন ব্যবসা করেছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই ঋণের টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন পাটের ব্যবসা।

সে সময়ে বয়সের পার্থক্য থাকলেও জ্যোতিদাদার সঙ্গে রবির সম্পর্কটা বন্ধুর মত। রবি লেখাপড়ায় মোটেই মনোযোগী নয়। কবি হয়ে উঠেছেন। নানা বিষয়ে নিজের মতো করে পড়ালেখা করছেন। মনটা তার আকাশে চরে বেড়ানো পাখির মত মুক্ত। কোএথাও বাঁধা পড়তে চায় না। তাকে দেওয়া দরকার স্নেহ আর অবাধ স্বাধীনতার অধিকার। তাঁকে রূপে ভোলানো যাবে না। ভালোবাসায় ভোলানো সম্ভব। এই কারণে প্রতিভাবান ছোটো ভাইটিকে নতুন দাদা শিলাইদহের নির্জন প্রকৃতির কাছে নিয়ে এলেন। তাঁকে দিতে চাচ্ছেন বাংলার প্রকৃতিপাঠ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—তিনি নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, এই থেকে এই বাইরে চলাচল এ একটা চলতি ক্লাশের মতো। সেখান থেকে তিনি খোরাক পান আপনা হতেই । তার কিছুকাল পরে জীবনটা যখন আরও উপরের ক্লাসে উঠেছিল তিনি মানুষ হচ্ছিলেন এই শিলাইদহে ।

ছেলেবেলা গ্রন্থে লিখেছেন—পুরনো নীলকুঠি তখনো খাড়া ছিল। পদ্মা ছিল দূরে। নীচের তলায় কাছারি, উপরের তলায় আমাদের থাকবার জায়গা। সামনে খুব মস্ত একটা ছাদ। ছাদের বাইরে বড় বড়ো ঝাউগাছ, এরা একদিন নীলকর সাহেবের ব্যবসার সঙ্গে বেড়ে উঠেছিল। লিখেছেন,  আজ কুঠিয়াল সাহেবের দরবার একেবারে থম থম করছে । কোথায় নীলকুঠির যমের দূত সেই দেওয়ান , কোথায় লাঠি-কাঁধে কোমর-বাঁধা পেয়াদার দল , কোথায় লম্বা-টেবিল-পাতা খানার ঘর যেখানে ঘোড়ায় চড়ে সদর থেকে সাহেবরা এসে রাতকে দিন করে দিত — ভোজের সঙ্গে চলত জুড়ি-নৃত্যের ঘূর্ণিপাক , রক্তে ফুটতে থাকত শ্যাম্পেনের নেশা , হতভাগা রায়তদের দোহাই-পাড়া কান্না উপরওয়ালাদের কানে পৌঁছত না , সদর জেলখানা পর্যন্ত তাদের শাসনের পথ লম্বা হয়ে চলত । সেদিনকার আর যা-কিছু সব মিথ্যে হয়ে গেছে , কেবল সত্য হয়ে আছে দুই সাহেবের দুটি গোর। লম্বা লম্বা ঝাউগাছগুলি দোলাদুলি করে বাতাসে, আর সেদিনকার রায়তদের নাতি-নাতনিরা কখনো কখনো দুপুররাত্রে দেখতে পায় সাহেবের ভূত বেড়াচ্ছে কুঠিবাড়ির পোড়ো বাগানে ।

বাবার সঙ্গে প্রথমবার শিলাইদহে এলেও বিখ্যাত বাবার কারণে শিলাইদহের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা গড়ে উঠতে পারে সে সময়ে। জ্যোতিদাদার ডাকে দ্বিতীয়বার এসে শিলাইদহকে গভীর করে দেখার অবসর পেলেন। জীবনে এই প্রথমবার একলা থাকা মন নিতে পেরেছেন। বেছে নিয়েছেন উপরের তলায় ছোটো একটি কোণের ঘর। এই ঘরে ছুটির আনন্দ আছে। এই আনন্দটা তাঁর কাছে দীঘির কালো জলের মত অথৈ। এই কোণের ঘর থেকে দেখতে পাচ্ছেন—বউ-কথা-কও ডাকছে তো ডাকছেই। উড়ো ভাবনা ভাবছি তো ভাবছিই। এর মধ্যে তিনি মালতী পুঁথিতে লিখছেন আমের বোলের মত পদ্য।

কবিতা লেখার পাশাপাশি রবি ঘোড়ার চড়ে বেড়াতে লাগলেন। জ্যোতিদাদা নিজেও ঘোড়ায় চড়া পছন্দ করতেন। রবি চড়তেন টাট্টু ঘোড়া। ঘোড়ায় চড়ে সোজা চলে যেতেন রথতলার বড়ো মাঠটিতে। …সেই এবড়ো থেবড়ো মাঠে পড়ি-পড়ি করতে করতে ঘোড়া ছুটিয়ে আনতুম। আমি পড়ব, তার মনে এই জোর ছিল বলেই আমি পড়িনি। পরে তিনি বড়ো ঘোড়ায়ও চড়েছেন। তবে সেটা সুখের হয়নি।

দুভাই মাঝে মাঝে বাঘ শিকারে বেরিয়েছেন। বিশ্বনাথ নামে এক অসীম-সাহসী শিকারীর কাছে গল্প শুনে শুনে শিকারে প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। শিলাইদহের জঙ্গলে তখন মাঝে মাঝে বাঘ পড়ত। জ্যোতিদাদার সঙ্গে তিনি অন্তত দুবার বাঘ শিকারে গিয়েছিলেন। ভালো বন্দুক চালাতে জানতেন জ্যোতিদাদা।

ছেলেবেলায় লিখেছেন—

বাঘ-শিকারের ইচ্ছা ছিল তাঁর (জ্যোতিদাদার) মনে । বিশ্বনাথ শিকারী একদিন খবর দিল, শিলাইদহের জঙ্গলে বাঘ এসেছে । তখনি বন্দুক বাগিয়ে তিনি তৈরি হলেন । আশ্চর্যের কথা এই, আমাকেও নিলেন সঙ্গে । একটা মুশকিল কিছু ঘটতে পারে, এ যেন তাঁর ভাবনার মধ্যেই ছিল না।

ওস্তাদ শিকারী ছিল বটে বিশ্বনাথ । সে জানত , মাচানের উপর থেকে শিকার করাটা মরদের কাজ নয় । বাঘকে সামনে ডাক দিয়ে লাগাত গুলি । একবারও ফসকায় নি তার ।

ঘন জঙ্গল। সেরকম জঙ্গলের ছায়াতে আলোতে বাঘ চোখেই পড়তে চায় না। একটা মোটা বাঁশগাছের গায়ে কঞ্চি কেটে কেটে মইয়ের মতো বানানো হয়েছে। জ্যোতিদাদা উঠলেন বন্দুক হাতে । আমার পায়ে জুতোও নেই, বাঘটাতাড়া করলে তাকে যে জুতোপেটা করব তার উপায় ছিল না। বিশ্বনাথ ইশারা করলে। জ্যোতিদাদা অনেকক্ষণ দেখতেই পান না। তাকিয়ে তাকিয়ে শেষকালে ঝোপের মধ্যে বাঘের গায়ের একটা দাগ তাঁর চশমাপরা চোখে পড়ল। মারলেন গুলি। দৈবাৎ লাগল সেটা তার শিরদাঁড়ায় । সে আর উঠতে পারল না । কাঠকুটো যা সামনে পায় কামড়ে ধরে লেজ আছড়ে ভীষণ গর্জাতে লাগল । ভেবে দেখলে মনে সন্দেহ লাগে । অতক্ষণ ধরে বাঘটা মরবার জন্যে সবুর করে ছিল, সেটা ওদের মেজাজে নেই বলেই জানি । তাকে আগের রাত্রে তার খাবার সঙ্গে ফিকির করে আফিম লাগায় নি তো! এত ঘুম কেন ।

আরও একবার বাঘ এসেছিল শিলাইদহের জঙ্গলে। আমরা দুই ভাই যাত্রা করলুম তার খোঁজে, হাতির পিঠে চড়ে । আখের খেত থেকে পট পট করে আখ উপড়িয়ে চিবতে চিবতে পিঠে ভূমিকম্প লাগিয়ে চলল হাতি ভারিক্কি চালে । সামনে এসে পড়ল বন । হাঁটু দিয়ে চেপে, শুঁড় দিয়ে টেনে গাছগুলোকে পেড়ে ফেলতে লাগল মাটিতে । তার আগেই বিশ্বনাথের ভাই চামরুর কাছে গল্প শুনেছিলুম, সর্বনেশে ব্যাপার হয় বাঘ যখন লাফ দিয়ে হাতির পিঠে চড়ে থাবা বসিয়ে ধরে । তখন হাতি গাঁ গাঁ শব্দে ছুটতে থাকে বনজঙ্গলের ভিতর দিয়ে, পিঠে যারা থাকে গুঁড়ির ধাক্কায় তাদের হাত পা মাথার হিসেব পাওয়া যায় না। সেদিন হাতির উপর চড়ে বসে শেষ পর্যন্ত মনের মধ্যে ছিল ঐ হাড়গোড়-ভাঙার ছবিটা । ভয় করাটা চেপে রাখলুম লজ্জায় । বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে চাইতে লাগলুম এ দিকে, ও দিকে । যেন বাঘটাকে একবার দেখতে পেলে হয় । ঢুকে পড়ল হাতি ঘন জঙ্গলের মধ্যে । এক জায়গায় এসে

থমকে দাঁড়াল । মাহুত তাকে চেতিয়ে তোলবার চেষ্টাও করল না । দুই শিকারী প্রাণীর মধ্যে বাঘের ' পরেই তার বিশ্বাস ছিল বেশি । জ্যোতিদাদা বাঘটাকে ঘায়েল করে মরিয়া করে তুলবেন , নিশ্চয় এটাই ছিল তার সবচেয়ে ভাবনার কথা । হঠাৎ বাঘটা ঝোপের ভিতর থেকে দিল এক লাফ । যেন মেঘের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ল একটা বজ্রওয়ালা ঝড়ের ঝাপটা । আমাদের বিড়াল কুকুর শেয়াল দেখা নজর — এ যে ঘাড়েগর্দানে একটা একরাশ মুরদ , অথচ তার ভার নেই যেন । খোলা মাঠের ভিতর দিয়ে দুপুরবেলার রৌদ্রে চলল সে দৌড়ে । কী সুন্দর সহজ চলনের বেগ । মাঠে ফসল ছিল না । ছুটন্ত বাঘকে ভরপুর করে দেখবার জায়গা এই বটে — সেই রৌদ্রঢালা হলদে রঙের প্রকাণ্ড মাঠ ।

এক মালি তার ঘরে ফুল দিয়ে যেত। সুন্দর করে সাজিয়ে রাখত। রবির হঠাৎ ইচ্ছে হল, এই ফুল দিয়ে কবিতা লিখবেন। ঠিক ফুল দিয়ে নয়। ফুলের রঙ দিয়ে। ফুলের পাপড়ি টিপে টিপে রস বের করে লিখতে চেষ্টা করলেন। সেটা অনেক ঝামেলা মনে হর। তিনি ছিদ্রযুক্ত কাঠের বাটির উপর হামানদিস্তার নোড়া দড়িতে-বাঁধা চাকার সাহায্যে ঘুরিয়ে বৃহদাকারে ফুলের রস উৎপাদকারী একটি যন্ত্র তৈরি করতে পরিকল্পনা করলেন ।  দাদাকে বলতেই মিস্ত্রী  তৈরি করে দিল  ফুলের পাপড়ি থেকে রস বের করার যন্ত্র। কিন্তু তাতে কালি পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল পাপড়ির কাদা। তা দিয়ে লেখা যায় না। জ্যোতিদাদা দেখলেন, ফুলের রস আর কলের চাপের ছন্দ মিলল না। তবু কিশোর মুখের উপর হেসে উঠলেন না। তার ইচ্ছেকে সম্মান করলেন।

স্কুলের ছাত্র হিসেবে রবির ব্যর্থতা সাইকে হতাশ করেছিল। সবাই ধরেই নিয়েছিল রবির কিছু হবে না। তিনি নিজেও হারিয়েছিলেন আত্মবিশ্বাস। কিন্তু জ্যোতিদাদা তার স্বাধীন ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে, নানা কাজে প্রবৃত্ত করে তাঁর হারানো আত্মবিশ্বাসকেই ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছেন। শিলাইদহ এই আত্মআবিষ্কারের আর আত্মবিকাশের উর্বর ক্ষেত্র।  

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : সপ্তদশ পর্ব

জমিদারিতে প্রথম চাকরী

রবীন্দ্রনাথের বিয়ের আগেই দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে জমিদারির কাজ পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হতে চিঠি দিয়েছিলেন। এই সময়কালে দেবেন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। জ্যোতিদাদা জমিদারী ভালোই দেখাশুনা করতেন। মূল ম্যানেজার হিসাবে কাজ করতেন তাঁদের বড়  ভগ্নিপতি সারদাপ্রসাদ। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের দিনেই তাঁর মৃত্যুর সংবাদ এসেছিল। এর কয়েকমাস পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী আত্মহত্যা করেন।  তৃতীয় ভাই হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরও অকালে মৃত্যুবরণ করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জাহাজের ব্যবসা মার খায়। তখন থেকেই তিনি বিষয়ে মনোযোগ হারান। জমিদারি দেখা ছেড়ে দেন। দেবেন্দ্রনাথ এরপর বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথকে শিলাইদহে পাঠান পরিদর্শনের ভার দিয়ে। কাজটি তাঁর ভালো না লাগায় তাঁর ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথ এই দ্বায়িত্ব পালন করেন। বড় নাতি হিসেবে তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথের খুব আদরের। জমিদারী এলাকায় তিনি যাননি। তাঁর নায়েব-গোমস্তারা প্রজাদের সঙ্গে বেশ ঝামেলাও তৈরি করেন। তখন দেবেন্দ্রনাথ ছোটো ছেলে রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি পরিচালনার কাজে পরিদর্শক হিসাবে নিয়োগ করেন।

২ অঘ্রাণ (নভেম্বর ১৮৮৯)  রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে রওনা করেন। সঙ্গে স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, বড় মেয়ে বেলা ও ছেলে রথীন্দ্রনাথ। সঙ্গে একজন সহচরী।  ভাইপো বলেন্দ্রনাথও তাঁদের সঙ্গে আছেন। শিলাইদহে তখন তারা কুঠিবাড়িতে নয়—বোটে আশ্রয় নিয়েছেন। বোট আসলে বজরা।  বজরাটির নাম ছিল 'হাউজ বোট পদ্মা'। .তার এ রকম আরও তিনটি নৌকা ছিল। নাম 'লালডিঙ্গি','চপলা' ও 'চঞ্চলা'।. তবে তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল 'হাউজ বোট পদ্মা'।  এ সময় ভাগ্নি ইন্দিরা দেবীকে প্রায়ই  চিঠি লিখেছেন। সেসব চিঠিতে পূর্ববঙ্গ ভ্রমণের বিবরণ দিয়েছেন। পূর্ববঙ্গের সহজ সরল অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতির মতই চলিত ভাষায় তাঁর লেখা এই চিঠিগুলো ছিন্নপত্র নামে সংকলন করেন ইন্দিরা দেবী।

ছিন্নপত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—

শিলাইদহের অপরপারে একটা চরে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকাণ্ড চর—ধূ ধূ করছে—কোথাও শেষ দেখা যায় না—মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায়—আবার অনেক সময়ে বালিকে চর বলে ভ্রম হয়—গ্রাম নেই—লোক নেই—তরু নেই, তৃণ নেই—বৈচিত্রের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ফাটল-ধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায় শুকনো সাদা বালি, পূর্ব দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখলে দেখা যায় উপরে অনন্ত নীলিমা আর নীচে অনন্ত পাণ্ডুরতা, আকাশ শূন্য এবং ধরণীও শূণ্য, নীচে দরিদ্র শুষ্ক কঠিন শূন্যতা আর উপরে অশরীরি উদার শূন্যতা।…সন্ধ্যার সময়ই আমরা বেড়াতে বেরোই এবং সেই ছবিটিই মনে অঙ্কিত হয়ে আছে। পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকরে ভুলে যেতে হয়।…সন্ধ্যেবেলা এই বৃহৎ চরের মধ্যে ছাড়া পেয়ে অনুচর-সমেত ছেলেরা একদিকে যায়, বলু একদিকে যায়, আমি একদিকে যাই। দুটি রমণী আর এক দিকে যায়।

এই প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথের কাছে বৃহৎ নিস্তব্ধ নিভৃত পাঠাশালা হয়ে উঠেছে। এদিন একটি কাণ্ড ঘটেছিল। কবির স্ত্রী মৃণালিনী সহচরীসহ বেড়াতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। গফুর, প্রসন্ন, বোটের মাঝিমাল্লারা তাদের খুঁজে বের করেছিল। রবীন্দ্রনাথ দুশ্চিন্তায় কখনো মনে করেছিলেন তারা চোরাবালিতে পড়েছে, কখনো আশঙ্কা করেছেন বলেন্দ্রনাথ জন্মরোগ মূর্ছায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। আবার ভয়ও পাচ্ছেন—বন্যজন্তু তাঁদের হয়তো আক্রমণ করেছে। গোটা সময়টাই মস্ত একটা বিভীষিকার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কেটেছে। সে সময় চরে আরাম কেদারায় বসে এনিম্যাল ম্যাগনিটিজম নামে একটি বই পড়ছিলেন। এদের চিন্তায় পড়াটা আর সেদিন আগাতে পারেনি বলেও জানিয়েছেন ইন্দিরাকে।

রবীন্দ্রনাথ তখন নানা কাজে ব্যস্ত। তাদের বোটে গ্রাম্য গাইয়েরা গান গাইতে আসত। একজন বৈষ্ণব কাঙাল ফিকির চাঁদ ফকিরের গান শুনিয়ে যেত। আর একজন মুসলমন গায়ক শুনাউল্লা আসতেন। শিলাইদহের গগণ হরকরার গাণও তারা শুনেছেন। বলেন্দ্রনাথ এই গানগুলো একটি খাতায় লিখে নিয়েছেন। এইবার রবীন্দ্রনাথও তার পরিবারের সদস্যগণ বাউল ও অন্যান্য লোকসঙ্গীত সংগ্রহ করেন। ভারতী পত্রিকায় সেগুলো প্রকাশও করা হয়েছে। এইবারে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে কতদিন ছিলেন তা বিশেষ জানা যায় না। তিনি কোলকাতায় সপরিবারে ফিরে আসেন। তখন পৌষ মাস।

জানুয়ারীতে শাহজাদপুরে তিনি আসেন। ছিলেন ফ্রেব্রুয়ারী পর্যন্ত। তখন পৌষ ফাগুনের পালা। পাবনা জেলার ইউসুফশাহী পরগণাতে এইবারই তিনি একলা এসেছেন। প্রথমবারে এসেছিলেন বাবার সঙ্গে। দ্বিতীয়বার জ্যোতিদাদার সঙ্গে। তৃতীয়বার সপরিবারে। এইবার একা একা বাংলা দেখবেন।

একা এসে তাঁর ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের জন্য মন কেমন করছে। স্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন—বেলি খোকার জন্যে এক একটা মনটা ভারি অস্থির বোধ হয়। বেলিকে আমার নাম করে দুটো 'অড খেতে দিয়ো। আমি না থাকলে সে বেচারা ত নানা রকম জিনিষ খেতে পায় না। খোকাকেও কোন রকম করে মনে করিয়ে দিয়ো'।

চিঠিতে আরও জানা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন একদল উকিল আর স্কুলের শিক্ষক। একজন ইস্কুল ইন্সপেক্টরও আছেন। স্কুলে তাঁর বই চালাবার কথাবার্তাও হয়েছে তাদের সঙ্গে। সঙ্গে একখানা রাজর্ষি বই ছিল। সেটি স্কুল ইন্সপেক্টরের হাতে দিয়েছেন। পরে স্কুলগুলোতে ২৫টি বই বিক্রি হয়েছে। এ বাবদ পাওয়া গেছে ২৫ টাকা।

উকিল আর মাস্টারবাবুরা এসেছিলেন শাহজাদপুরের সুনীতিসঞ্চারিনী সভায় সভাপতিত্ব করার অনুরোধ করতে। ২০ জানুয়ারী রবীন্দ্রনাথ এ স্কুলটি পরিদর্শনে যান। তিনি ঘুরে ঘুরে সব ক্লাসরুমগুলো দেখেছেন। ছাত্ররা যাতে ভয় না পায়, সেজন্য তাদেরকে তিনি কোনো প্রশ্ন করেননি। তারা যাতে সহজসরল মুডে থাকে সে ব্যাপারটি খেয়াল রেখে ক্লাশরুমগুলোতে গিয়েছেন। কিন্তু তারা যথেষ্ট ঘাবড়ে গিয়েছিল। বোধহয় ঘাবড়ে যাওয়ার পিছনে হেড মাস্টার সাহেবের কিছু অবদান ছিল বলে কবির মনে হয়েছিল। এই ঘটনাটি বেশ কৌতুক ভরে চিঠিতে লিখেছেন ইন্দিরা দেবীকে কালিগ্রাম থেকে। তারিখ নেই চিঠিতে। শুধু সন লেখা ১৮৯১–

কাল যখন কাছারি করছি, গুটি গুটি পাঁচ ছয় ছেলে হঠাৎ অত্যন্ত সংযতভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়ালে—কোনো প্রশ্ন করতে না করতে একেবারে বিশুদ্ধ বঙ্গভাষায় আরম্ভ করে দিল, 'পিতঃ, অভাগ্য সন্তানগণের সৌভাগ্যবশতঃ জগদীশ্বরের কৃপায় প্রভুর পুনর্বার এতদ্দেশে শুভাগমণ হইয়াছে'।. এমনি করে আধ-ঘণ্টা-কাল বক্তৃতা করে গেল, মাঝে মাঝে বক্তৃতা ভুলে যাচ্ছিল, আবার আকাশের দিকে চেয়ে সংশোধন করে নিচ্ছিল। বিষয়টা হচ্ছে তাদের স্কুলে টুল এবং বেঞ্চির অপ্রতুল হয়েছে—সেই কাষ্ঠাসন-অভাবে 'আমরাই বা কোথায় উপবেশন করি, আমার পূজনীয় শিক্ষক মহাশয় উপস্থিত হইলে তাহাকেই বা কোথায় আসন দান করা যায়? ছোট্ট ছেলের মুখে হঠাৎ এই অনর্গল বক্তৃতা শুনে আমার এমনি হাসি পাচ্ছিল। বিশেষত এই জমিদারী কাছারিতে, যেখানে অশিক্ষিত চাষারা নিতান্ত গ্রাম্য-ভাষায় আপনাদের যথার্থ দারিদ্রদুঃখ জানায়—যেখানে অতিবৃষ্টি দুর্ভিক্ষ গোরু বাছুর হাল লাঙ্গল বিক্রি করেও উদরান্নের অনটনের কথা শোনা যাচ্ছে, যেখানে 'অহরহ' শব্দের পরিবর্তে 'রহরহ', অতিক্রমের স্থলে অতিক্রয় ব্যবহার, সেখানে টুল-বেঞ্চির অভাবে সংস্কৃত বক্তৃতা কানে এমনি অদ্ভুত শোনায়। অন্যান্য আমলা এবং প্রভুরা এই ছোকরার ভাষার প্রতি এতাদৃশ দখল দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল—তারা মনে মনে আক্ষেপ করছিল, 'বাপ-মারা আমাদের যত্ন করে লেখাপড়া শেখায়নি, নইলে আমরাও জমিদারের সামনে দাঁড়িয়ে এইরকম শুদ্ধ ভাষায় নিবেদন করতে পারতুম। আমি শুনতে পেলুম একজন আরেকজনকে ঠেলে ঈষৎ বিদ্বেষের ভাবে বলছে, 'একে কে শিখায় দিয়েছে?' আমি তার বক্তৃতা শেষ না হতেই তাকে থামিয়ে বললুম, 'আহা, তোমাদের টুল-বেঞ্চির বন্দোবস্ত করে দেব।' তাতেও সে দমল না। সে যেখানে বক্তৃতা ভঙ্গ করেছিল সেইখান থেকে আবার আরম্ভ করলে—যদিও তার আবশ্যক ছিল না, কিন্তু শেষ কথাটি পর্যন্ত চুকিয়ে প্রণাম করে বাড়ি ফিরে গেল।

জানুয়ারী ২৩, ১৮৯১।. রবীন্দ্রনাথ পতিসর ত্যাগ করে নদীপথে শাহজাদপুরে গিয়েছেন। সেখান থেকে প্রমথ চৌধুরী জানাচ্ছেন, দিন দশেক সেখানে থাকবেন। এজন্য শাহজাদপুরের বেড়াতে আসার জন্য তাঁকে নিমন্ত্রণ করছেন। তিনি একা একা এই জমিদারী পরিচালনা করতে করতে—জমিজমা ও বাকি-বকেয়া কাজ করতে করতে হাপিয়ে উঠেছেন। তিনি গোটা চারেক বই এনেছেন। ইউরোপের ডাইরী লিখছেন। ২৭ জানুয়ারী মেজো মেয়ে রেণুকার জন্ম হয়েছে কোলকাতায়।

১ ফেব্রুয়ারী ইন্দিরা একটি চিঠিতে জানাচ্ছেন—তিনি ডাইরীটা লিখছিলেন, তার নায়েব এসে কাছারিতে নিয়ে গেলেন। লেখা বাদ দিতে হল। সে সময় জমিদারীই ছিল একমাত্র উপার্জনের উপায়। সুতরাং ভালোভাবে পরিচালনা না করে উপায় নেই। তাই একাজে তিনি কখনো অবহেলা করতেন না।

কিন্তু জমিদারী সম্মান বজায় রাখার জন্য যে-সব আড়ম্বরের আয়োজন ছিল সেগুলো তিনি মনে প্রাণে অপছন্দ করতেন। ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে লিখছেন, প্রজারা যখন সসম্ভ্রম কাতরভাবে দরবার করে, এবং আমলারা বিনীত করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন আমার মনে হয় তাদের চেয়ে এমনি আমি কি মস্ত লোক যে আমি একটু ইঙ্গিত করলেই এদের জীবনযাত্রা এবং আমি একটু বিমুখ হলেই এদের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। …অন্তরের মধ্যে আমিও যে এদেরই মতো দরিদ্র সুখদুঃখকাতর মানুষ, পৃথিবীতে আমারও কত ছোটো ছোটো বিষয়ে দরবার, কত সামান্য কারণে মর্মান্তিক কান্না, কত লোকের প্রসন্নতার উপরে জীবনের নির্ভর। …Prstige মানে হচ্ছে মানুষ সম্বন্ধে মানুষের ভুল বিশ্বাস, আমাকে এখানকার প্রজারা যদি ঠিক জানত, তাহলে আপনাদের একজন বলে চিনতে পারত, সেই ভয়ে সর্বদা মুখোষ পরে থাকতে হয়।

এই সময়ে তিনি জমিদারিতে চাকরী করতেন। তিনি মালিক নন। ইচ্ছে করলেও জমিদারী  প্রথার বিরুদ্ধে যাওয়ার উপায় ছিল না তাঁর। তাঁর বাবার জমিদারীর কঠোর বিধিবিধান মাথার উপরে ছিল। ছিল প্রথার কঠোর বন্ধন। কিন্তু যখণ তিনি আরও পরে নিজেই জমিদারীর অধিকারী হয়েছিলেন—তখন এগুলো উঠিয়ে দিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : অষ্টাদশ পর্ব

কালেক্টরের সাহেব

১৮৯১ সালের জানুয়ারীতে শাহাজাদপুরে এক তরুণ ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট এসেছিলেন। তার নাম এফ.ও বেল। স্ত্রী মৃণালিনীকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ  এ খবরটি জানাচ্ছেন। চিঠির স্বরটি একটা মজার। একটু খেদও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন—আমাদের সাহেব আসবেন পর্শুদিন। সেদিন আমার কি শুভদিন! আমার কী আনন্দ! আমার সাহেব আসবে, আবার আমার মেমও আসবে। হয়ত আমার ঘরে এসে খানা খেয়ে যাবে—নয়ত বলবে—বাবু, আমার সময় নেই! আমার কত ভাগ্যি! প্রার্থনা করি, যেন তার সময় না থাকে।

রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনায় কিছু কাজ হয়েছিল। সেই পর্শুদিন সাহেব আসেননি। প্রথামোতাবেক জমিদারের দায়িত্বপালনরত রবীন্দ্রনাথকে পরের সপ্তাহে সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হল। সেদিন ২৫ জানুয়ারী, ১৮৯০।. দুপুর বেলা পাগড়ীও পরতে হয়েছে মাথায়। পালকী চড়ে তিনি যাচ্ছেন সাহেবের তাবুর দিকে। মেজো দাদা সত্যেন্দ্রনাথের মেয়ে প্রিয় ইন্দিরাকে ঘটনাটি লিখছেন, সাহেব তাবুর বারান্দায় বসে বিচার করছেন, দক্ষিণ পার্শ্বে পুলিশের চর। বিচারপ্রার্থীর দল মাঠে ঘাটে গাছতলায় পড়ে অপেক্ষা করে আছে—একেবারে তার নাকের সামনে পালকী নাবালে, সাহেব খাতির করে চৌকিকে বসালেন। ছোকরা—হেন, গোঁফের রেখা উঠেছে, চুল খুব কটা, মাঝে মাঝে একটু একটু কালো চুলের তালি দেওয়া, হঠাৎ মনে হয় বুড়ো মানুষ, অথচ মুখ নিতান্ত কাঁচা।

সাহেবকে রবীন্দ্রনাথ খেতে নিমন্ত্রণ করলেন। কিন্তু সাহেব তখন শুয়োর তাড়াতে ব্যস্ততা দেখাল। সোজা বলে দিল—সে যেতে পারবে না।

সেদিন কুঠিবাড়িতে ফেরার পরে মেঘ কালো করে এলো। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। দমকা বাতাস বইতে শুরু করেছে। সঙ্গে বৃষ্টি। সাহেব ভিজছে মাঠের মধ্যে সরকারী তাবুতে। কবি বুঝলেন– সাহেব সেখানে বিপদে আছেন। সাহেবের কাছে লোক পাঠালেন। তাকে কুঠিবাড়িতে চলে আসতে বললেন।

কুঠিবাড়ির ঘরবাড়ির অবস্থা খুব সুবিধার ছিল না।  সাহেবের জন্য নীচতলায় একটি ঘর রেডি করা হল। সে ঘরে দুটো বাঁশের ঝোলার উপর তাকিয়া গদি, ময়লা লেপ টাঙানো—চাকরদের গুল টিকে তামাক, তাদেরই দুটো কাঠের সিন্দুক,…তাদেরই মলিন লেপ, ওয়াড়হীন তৈলাক্ত বালিশ ও মসীবর্ণ মাদুর, এক টুকরো ছেড়া চট ও তার উপরে বিচিত্রজাতীয় মলিনতা—কতকগুলো প্যাকবাক্সের মধ্যে নানাবিধ জিনিসের ভগ্নাবশেষ—যথা মর্চেপড়া কাৎলির ঢাকনি, তলাহীন ভাঙা লোহার উনুন, অত্যন্ত ময়লা শামাদান, দুটো অকর্মন্য ফিল্টার, Meat Safe, একটা সুপ-প্লেটে খানিকটা পাৎলা গুড়, ধুলো পড়ে পড়ে সেটা গাঢ় হয়ে এসেছে, গোটাকতক ময়লা কালীবর্ণ ভিজে ঝাড়ন,–কোনে বাসনধোবার গামলা, গফুর মিয়ার একটা ময়লা কোর্তা এবং পুরনো মকমলের Skull Cap—জলের দাগ– তেলের দাগ—দুধের দাগ—কালো দাগ—Brown দাগ—সাদা দাগ—এবং নানা মিশ্রিত দাগ বিশিষ্ট আয়নাহীন একটা পোকাকাটা Dressing Table—তার পায়া-কটা ভাঙা, আয়নাটা অন্যত্র দেয়ালে ঠেসান-দেওয়া, তার খোপের মধ্যে ধুলো, খড়কে, ন্যাপকিন, পুরনো তালা, ভাঙা গেলাসের তলা এবং সোডা ওয়াটারের বোতলের তার, কতকগুলো খাটের খুরো ভাঙা। ইত্যাদি।

লোকজনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজেও লেগে গেলেন ঘরটি পরিস্কার করতে। ভাঙা চুপড়িগুলো এবং ছেড়া চটটা বহুদিন সঞ্চিত ধুলোসমেত নিজের হাতে টেনে ফেললেন। আরসুলা উড়ে বেড়াল। বাইরে বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাস।  এর মধ্যে সাহেব এসে পড়ছে। তাড়াতাড়ি চুল দাড়ি সমস্ত ঝেড়ে ফেলে ভদ্রলোক হয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। পুরো দস্তুর জমিদার। সাহেবের সঙ্গে ঈষৎ হেসে হাত নাড়ানাড়ি করে গল্প করতে লাগলেন।

রবীন্দ্রনাথ এর আগেই বিলেতে মেজো দাদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে থেকে এসেছেন। এই কচি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে  গিয়ে বেশ অস্বস্তি বোধ করলেও সাহেবের সঙ্গে জমিদারের এই সম্পর্কটাকে প্রজারা বেশ সমীহর চোখেই দেখেছে। সাহেবকে এই অবসরে তার জমিদারী এলাকার প্রজাদের নানা সমস্যা বিষয়েও অবহিত করেছেন।

এ সময়কালে শাহাজাদপুরে থাকাকালে রবীন্দ্রনাথ বিসর্জন নাটকটি লিখছেন। শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, তাঁরা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে নাটক করার কথা ভাবছিলেন। রজর্ষি উপন্যাসের প্রথম খণ্ড থেকে কাহিনী নিয়ে নাটকটি রচনা করার চেষ্টা করছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। তিনি লিখেছেন—এমন সময় রবি কাকা (শাহজাদপুর থেকে) কী একটা কাজে ফিরে এসেছেন। তিনি বললেন, দেখি কী হচ্ছে! খাতাটা নিয়ে এলেন, দেখে বললেন, না, এ চলবে না—আমি নিয়ে যাচ্ছি খাতাটা, শিলাইদহে বসে লিখে আনব, তোমরা এখন কিছু কোরো না, এর কিছুদিন বাদেই রবিকাকা শিলাইদহে গেলেন। আট-দশ দিন বাদে ফিরে এলেন, বিসর্জন নাটক তৈরী। এর আসল কাহিনীটি ছিল-প্রেমের অহিংসা পূজার সঙ্গে হিংস্র শক্তির বিরোধ।

একটি প্রেমের বিয়ে

ডঃ মযহারুল ইসলাম দেশ পাত্রিকায় (২৫ চৈত্র, ১৩৮৯) 'শাহজাদপুরে জমিদার রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাফল্য' নামে একটি প্রবন্ধে লিখেছেন একটি ঘটনা।

মযহারুল ইসলামের পিতামহ ছিলেন নবীপুরের মুসলমান পরিবারের আকুল সরকার। তিনি সম্ভ্রান্ত হিন্দু বাউল ভদ্রের মেয়ে মৃণাল-মৃদুল লতাকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। এ বিয়েতে বাউল ভদ্র খেপে যান। তখন মুড়াপাড়ার জমিদার ছিলেন ব্যানার্জী পরিবার।  তিনি জমিদারের কাছে নালিশ করেন—তার মেয়েকে জোর করে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করে বিয়ে করেছে আকুল সরকার। জমিদার ও তার ম্যানেজার রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায় আকুল সরকারকে শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা করেন। আকুল সরকারও তাদেরকে বাঁধা দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এ নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধার উপক্রম হয়। রবীন্দ্রনাথ শাহজাদপুরে এসে এ ঘটনাটি শুনে ম্যাজিস্ট্রেট বেলকে জানান। বেল ব্যবস্থা নিলেন।  দুজনের চেষ্টায়  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতি প্রশমিত হল। করেন।

পকেট বুক : মজুমদার পুঁথি

১৮৮৯ সালে ১৫ জুন মাসে বর্ষার শুরুতে রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর সেরেস্তায় জমিদারির হিসাবপত্র দেখার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এ দায়িত্বের অঙ্গ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ একটি পকেট বুক নিয়েছিলেন। এটা একটা ছোটো খাতা। এই খাতায় রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে খাজনা ও মুনাফার হিসাব ও কর্মচারীরদের নাম ও বেতনের তালিকা লেখা হয়েছিল। সহজে ও তাৎক্ষণিকভাবে সেরেস্তার তদারকির কাজে এই খাতাটির ব্যবহার করতেন। তিনি যখন শিলাইদহে জমিদারী পরিদর্শনের কাজ শুরু করেন তখন থেকেই খাতাটি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে থাকত।

পকেট বুকটির দুটি পৃষ্ঠায় ছিল কজন প্রজার তথ্য– যজ্ঞেশ্বর, শুকচাঁদ, হরিচাঁদ, মধুসা, বসন্ত বিশ্বাস প্রমুখ। এই প্রজাদের মধ্যে টাকা পয়সার বিবাদ সম্পর্কে কিছু নোটও নিয়েছিলেন তিনি। একটি পৃষ্ঠায় লেখা আছে—Memo–/ শ্রাবণ মাসের আরম্ভ হইতে ডাক্তার মৈত্রকে বার্ষিক ৭৫ টাকায় নিযুক্ত করা হইয়াছে। ৪ মাস অন্তর পঁচিশ করিয়া দেওয়া যাইবে। এ খাতায় সোনার তরী, শৈশব সন্ধ্যা, বিম্ববতী, রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে, বৈষ্ণব কবিতা, যেতে নাহি দেব, পুরস্কার প্রভৃতি– সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের অনেকগুলি কবিতার প্রাথমিক খসড়া তিনি লিখেছেন। তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত স্মরণ কাব্যগ্রন্থের ১৯টি কবিতাসহ আরও কিছু লেখার খসড়া এই খাতায় পাওয়া যায়।

চারি দিক হতে আজি

অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি

সেই বিশ্ব-মর্মভেদী করুণ ক্রন্দন

মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে ; শিশুর মতন

বিশ্বের অবোধ বাণী । চিরকাল ধরে

যাহা পায় তাই সে হারায় , তবু তো রে

শিথিল হল না মুষ্টি , তবু অবিরত

সেই চারি বৎসরের কন্যাটির মতো

অক্ষুণ্ন প্রেমের গর্বে কহিছে সে ডাকি

' যেতে নাহি দিব ' ।

শান্তি নিকেতনের আশ্রম-বিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুবোধচন্দ্র মজুমদার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্র গুছিয়ে রাখতেন। তাঁর কাছেই পাওয়া যায় পকেট বুকটির সন্ধান। এই পকেট বুকটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৪২৬।. সব সময় একটি পেন্সিল খাতার ভিতরে গোঁজা থাকত। খুব পারসোনাল ছিল বলে জমিদারীর হিসাব থেকে শব্দতত্ত্ব—যখন যা মনে আসত কবি তা লিখে রাখতেন। জমিদারের হিসাবপত্র লেখা হত খাগের কলমে। কলমের কালি ছিল সেরেস্তার। অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও সাহিত্যের খসড়া লিখেছিলেন পেন্সিলে। এই খাতাটি থেকে অনুলিপি করে নিতেন সুবোধচন্দ্র মজুমদার। এই কারণে নোট বুকটির নাম হয়েছির মজুমদার পুঁথি। এর মলাটে লেখা আছে—R.N. Tagore/ Pocket Book/ 1889। রবীন্দ্রভবনে নোট বুকটির প্রতিটি পৃষ্ঠার মাইক্রো ফিল্ম ও ফটোকপি আছে বলে।

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ঊনবিংশ পর্ব

মাটি মা 

১৮৯০ সালে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ ২ মাস ১১ দিন ইউরোপ ভ্রমণ করেন। ১৮৯১ সালের ১৩ জানুয়ারী তিনি কালীগ্রামের সদর কাছারি পাতিসর রওনা করেন। বোটে করে পতিসরে পৌঁছাতে ৩ দিন লেগেছিল। তখন বড় মেয়ে বেলার বয়স মাত্র ৪ বছর ৩ মাস। বেলা এর মধ্যেই একটি চিঠি লিখে পাঠিয়েছে পতিসরে। চিঠিটি পড়ে বাবা রবীন্দ্রনাথ আকুল হয়ে উঠেছেন। স্ত্রী মৃণালিনীকে লিখেছেন—আমার মিষ্টি বেলুরাণুর চিঠি পেয়ে তখনি বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমার জন্য তার আবার মন কেমন করে—তার ঐ একটুখানি মন, তার আবার কী হবে? …কাল রাত্তিরে আমি খোকাকে স্বপ্ন দেখেছি—তাকে যেন আমি কোলে নিয়ে চটকাচ্ছি। বেশ লাগছে।' রবিজীবনীকার প্রশান্ত পাল একটি মন্তব্য করেছেন—পিতৃস্নেহ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিমূলক রচনায় খুব বেশি প্রকাশ পায়নি। সেই মনটি ধরা পড়েছে এই ধরনের কিছু কিছু পত্রে।

পতিসর পৌছানোর ৫ দিন পরে তিনি চিঠি লিখছেন ইন্দিরাকে—আমার বোট কাছারির কাছ থেকে অনেক দূরে একটি নিরিবিলি জায়গায় বেঁধেছি। এ দেশে গোলগাল কোথাও নেই। ইচ্ছে করলেও পাওয়া যায় না। কেবল হয়তো অন্যান্য বিবিধ জিনিসের সঙ্গে হাটে পাওয়া যেতে পারে। আমি তখন যেখানে এসেছি এ জায়গায় অধিকন্তু মানুষের মুখ দেখা যায় না। চারিদিকে কেবল মাঠ ধূ ধূ করছে—মাঠে শস্য কেটে নিয়ে গেছে, কেবল কাটা ধানের গোড়াগুলিতে সমস্ত মাঠ আচ্ছন্ন। সমস্ত দিনের পর সূর্যাস্তের সময় এই মাঠে কাল একবার বেড়াতে বেরিয়েছিলুম। সূর্য্য ক্রমেই রক্তবর্ণ হয়ে একেবারে পৃথিবীর শেষ রেখার অন্তরালে অন্তর্হিত হয়ে গেল। চারি দিক কী যে সুন্দর হয়ে উঠল সে আর কী বলব।

শুধু এই প্রকৃতিকে দেখছেন না নিবিড়ভাবে—এসময় গভীরভাবে রবীন্দ্রনাথ পর্যবেক্ষণ করছেন মানুষকে—সাধারণ মানুষকে। প্রকৃতি ও মানুষের ধারণার বাঁক বদল ঘটছে।  সবে কালিগ্রামে এসেছেন তিনি। বোটে ভোরবেলা কুড়েমিতে ধরেছে। শুয়ে আছেন জানালার পাশে। তাঁকে তাড়া দেবার কেউ নেউ। এদিন প্রজারাও কেউ আসেনি। কাজের ভিড়ভাট্টাও কম।

তিনি  ইন্দিরাকে লিখেছেন—

জলের মাঝে মাঝে যে লম্বা ঘাস এবং জলজ উদ্ভিদ জন্মেছে, জেলেরা জাল ফেলতে না এলে সেগুলো সমস্ত দিনের মধ্যে একটু নাড়া পায়না। পাঁচটা-ছটা বড়ো বড়ো নৌকা সারি সারি বাঁধা আছে, তার মধ্যে একটার ছাতের উপর একজন মাঝি আপাদমস্তক কাপড় মুড়ে রোদ্দুরে নিদ্রা দিচ্ছে—আর-একটার উপর একজন বসে বসে দড়ি পাকাচ্ছে। এবং রোদ পোহাচ্ছে। দাঁড়ের কাছে একজন আধ-বৃদ্ধ লোক অনাবৃত গাত্রে বসে অকারণে আমাদের বোটের দিকে চেয়ে আছে। ডাঙার উপরে নানান রকমের লোক অত্যন্ত মৃদুমন্দ অলস চালে কেন যে আসছে, কেন যে যাচ্ছে, কেন যে বুকের মধ্যে নিজের হাঁটু দুটোকে আলিঙ্গন করে ধরে উবু হয়ে বসে আছে, কেন যে অবাক হয়ে বিশেষ কোনো কিছুর দিকে না তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার কোনো অর্থ পাওয়া যায় না।

পতিসর, ৭ মাঘ, ১২৯৮ বঙ্গাব্দ (১৮৯১) 

এদিন বোট রয়েছে ছোটো নদীর ঈষৎ বাঁকে। দুই উঁচু পাড়ের মধ্যে কোনটুকুতে। এখানে দূর থেকে বোটটিকে দেখা যায় না। বেশ চুপ করে থাকা যায়। কোন কোন—নৌকাওয়ালারা উত্তর দিক থেকে গুণ টেনে টেনে আসে, হঠাৎ একটা বাঁক ফিরেই এই জনহীন ঘাটের ধারে অকারণে একটা মস্ত বোট বাঁধা দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়।–'হা গা, কাদের বজরা গা?' 'জমিদার বাবুর।' 'এখানে কেন?' কাছারির সামনে কেন বাঁধ নি?' হাওয়া খেতে এসেছেন?' হাওয়া খেতে নয়—তিনি এসেছেন হাওয়ার চেয়েও কঠিন জিনিসের জন্য। কি জিনিস? এ প্রশ্নের জবাব তার স্বভাবে আছে।

তিনি লিখেছেন ইন্দিরাকে—

অনেক দূরে দূরে একটা-একটা ছোটো ছোটো গ্রাম আসছে। গুটিকতক খোড়ো ঘর। কতকগুলি চাল শূন্য মাটির দেয়াল, একটা দুটো খড়ের স্তুপ, কুলগাছ আমগাছ বটগাছ এবং বাঁশের ঝাড়, গোটা-তিনেক ছাগল চরছে, গোটা কতক উলঙ্গ ছেলেমেয়ে; নদী পর্যন্ত গড়ানো কাঁচা ঘাট, সেখানে কেউ কাপড় কাচছে, কেউ নাইছে, কেউ বাসন মাজছে; কোনো কোরো লজ্জাশীলা বধু দুই আঙুলে ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করে ধরে কলসী কাঁখে জমিদার বাবুকে সকৌতুকে নিরীক্ষণ করছে। তার হাঁটুর কাছে আঁচল ধরে একটি সদ্যস্নাত তৈলচিক্কন বিবস্ত্র শিশুও একদৃষ্টে বর্তমান পত্রলেখক সম্বন্ধে কৌতুহল নিবৃত্তি করছে—তীরে কতগুলো নৌকো বাঁধা এবং একটা পরিত্যাক্ত প্রাচীন জেলেডিঙি অর্ধনিমগ্ন অবস্থায় পুনরুদ্ধারের প্রতীক্ষায় আছে। …এখানকার দুপুরবেলার মতো এমন নির্জনতা নিস্তবদ্ধতা আর কোথাও নাই।

১৮ নং পত্র সেই কঠিন জিনিসটিকে আরেকটু বিষদ করে বলেছেন। তিনি কেবল রূপ নয়-অরূপেরও সন্ধান পাচ্ছেন এই পূর্ববঙ্গে। আনন্দ নয়—বেদনার ধনও তার প্রাণ হরণ করছে। তিনি ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছেন। অন্য এক রবীন্দ্রনাথকে পেয়ে যাচ্ছি আমরা। তিনি লিখেছেন—

ঐ-যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালোবাসি—ওর গাছপালা নদী মাঠ কোলাহল নিস্তদ্ভতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দুহাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে-সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি এমন-কি কোনো স্বর্গ থেকে পেতুম? স্বর্গ আর কী দিত জানি নে. কিন্তু এমন কোমলতা দুর্বলতাময়, এমন সকরুণ আশঙ্কা-ভরা, অপরিণত এই মানুষগুলোর মতো এমন আপনার ধন কোথা থেকে দিত? আমাদের এই মাটির মা, আমাদের এই আপনাদের পৃথিবী, এর সোনার শস্যক্ষেত্র এর স্নেহ-শালিনী নদীগুলির ধারে, এর সুখদুঃখময় ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে এই-সমস্ত দরিদ্র মর্ত হৃদয়ের অশ্রুর ধনগুলিকে কোলে করে এনে দিয়েছে। আমরা হতভাগ্যরা তাদের রাখতে পারিনে, বাঁচাতে পারিনে, নানা অদৃশ্য প্রবল শক্তি এসে বুকের কাছ থেকে তাঁদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায়।  কিন্তু বেচারা পৃথিবীর যতদূর সাধ্য তা সে করেছে।

এইখানে এসে সেই কঠিন জিনিসের একটি তালিকাও পাওয়া যাচ্ছে। ১. কোমলতা দুর্বলতা-ময়, এমন সকরুণ আশঙ্কা-ভরা, অপরিণত মানুষগুলি, ২. এই মাট মা, ৩. মানুষদের আপনাদের পৃথিবী, ৪. সোনার শস্যক্ষেত্র, ৫. স্নেহশালিনী নদীগুলি, ৬. দরিদ্র মর্ত হৃদয়ের অশ্রুর ধন। এই ধনগুলি কবির কাছে স্বর্গের চেয়েও বড় কিছু।

তিনি লিখেছেন—

আমি এই পৃথিবীকে ভারী ভালোবাসি। এর মুখে ভারী একটি সুদূরব্যাপী বিষাদ লেগে আছে—যেন এর মনে মনে আছে, আমি দেবতার মেয়ে, কিন্তু দেবতার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ভালোবাসি, কিন্তু রক্ষা করতে পারি নে। আরম্ভ করি, সম্পূর্ণ করতে পারি নে। জন্ম দেই, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারি নে। এই জন্যে স্বর্গের উপর আড়ি করে আমি আমার দরিদ্র মায়ের ঘর আরো বেশি ভালোবাসি—এত অসহায়, অসমর্থ, অসম্পূর্ণ,  ভালোবাসার সহস্র আশঙ্কায় চিন্তাকাতর বলেই।

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : বিংশ পর্ব

নদী, আপন বেগে—বদলের সুর

কালিগ্রামের নদীটি মুমূর্ষু নাড়ির মত অতি ক্ষীণ। এই নদী পথে রবীন্দ্রনাথ  যাত্রা করেছেন শাহাজাদপুরের দিকে। তারিখ ১২ মাঘ। বোট চলছে সকাল থেকে সন্ধ্যা সাতটা-আটটা পর্যন্ত। কবি বিশ্রামে আছেন বোটের মধ্যে। তাঁর নিজের কোনো গতি নেই। এদিন পড়তেও ইচ্ছে  করছে না কিছু। লিখতেও না। কোনো কাজ করতে মন জাগছে না। চুপ করে বসে আছেন। কিন্তু দিব্যি টের পাচ্ছেন বাইরে একটি গতি বয়ে যাচ্ছে। সেটা অশান্ত। তার কোনো ক্লান্তি নেই। তিনি নিজের ভিতরে এরকম একটি প্রাণবন্ত গতি অনুভব করছেন।

শাহাজাদপুরে আসার পথে একটু বড়ো নদীতে বোট ঢুকে পড়েছে। সেখানে জল এবং ডাঙা দুটি অল্প বয়েসী ভাইবোনের মত। এর পরে পাড় আর নেই। থৈ থৈ জল।

তারপর খানিকটা সবুজ ঘাস—পৃথিবীর স্বচ্ছ জল। চারিদিকে জেলেদের বাঁশ পোতা—জেলেদের মাছ নেবার জন্য চিল উড়ছে। পাঁকের উপরে নিরীহ বক –নানারকমের জলচর পাখি—জলে ভাসা শ্যাওলা, পাকের মধ্যে অযোনীসম্ভুত ধানগাছ, কোথাও স্থির জল—সেখানে মশার ভন ভন। এখানে কবির বোট থেমে যায়। ঘুম নামে।

পরদিন ভোরে বোটটি আবার চলছে। বারো তের হাতে ছোটো খালের মধ্যে দিয়ে চলেছে। বিল থেকে সড় সড় করে জল নেমে আসছে প্রবল বেগে। জলের স্রোত বিদ্যুৎ বেগে বোটটিকে টেনে নিয়ে চায়। মাঝিরা লগি হাতে সামলাতে চেষ্টা করছে। সামলাতে না পারলে ডাঙার উপরে বোটটিকে আছড়ে ফেলতে পারে।

দিনটি মেঘলা। মাঝে মাঝে বৃষ্টি পড়ছে। শীতে সবাই কাঁছে। বেলা দুটোয় রোদ উঠেছে। এ সময় তাদের বোটটি ঢুকছে সেই নদীর দিকে—যার দুই ধার খুব উঁচু। সেখানে গাছপালা। লোকালয়। শান্তিময়। সুন্দর। নিভৃত।

ছিন্নপত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—আমাদের বাংলাদেশের একটি অপরিচিত অন্তঃপুরবাসিনী নদী। কেবল স্নেহ এবং কোমলতা এবং মাধুর্য পরিপূর্ণ। চাঞ্চল্য নেই। অথচ অবসরও নেই। গ্রামে যে মেয়েরা ঘাটে জল নিতে আসে এবং জলের ধারে বসে বসে অতি যত্নে গামছা দিয়ে আপনার শরীরখানি মেজে তুলতে চায়–তাদের সঙ্গে এর যেন প্রতিদিনের মনের কথা এবং ঘরকন্যার গল্প চলে।

সন্ধ্যাবেলায়  বোটটি বাঁকের মুখে নিরালায় রাখা হয়েছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, জলে একটিও নৌকো নেই। বহুদূরে গ্রামগুলি ঘুমিয়ে আছে। কেবল ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে। আর কোনো শব্দ নেই। আছে নিস্তব্দতার গভীর অনুবাদ।

কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ ভ্রমণ করে এসেছিলেন। বাংলার এই রূপের সঙ্গে একটা তুলনা করতে পেরেছেন তিনি সেই য়ুরোপের সঙ্গে। ভারত বর্ষের যেমন বাঁধাহীন পরিস্কার আকাশ, বহুদূর বিস্তৃত সমতল ভূমি আছে—এমন যুরোপের কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। এই জন্যে আমাদের জাতি যেন বৃহৎ পৃথিবীর সেই অসীম ঔদাস্য আবিষ্কার করতে পেরেছে। এই জন্যে আমাদের পূরবীতে কিংবা টোড়িতে সমস্ত বিশাল জগতের হাহাধ্বনি যেন ব্যক্ত করছে, কারও ঘরের কথা নয়। পৃথিবীর একটা অংশ আছে যেটা কর্মপটু, স্নেহশীল, সীমাবদ্ধ, তার ভাটা আমাদের মনে প্রভাব বিস্তার করবার অবসর পায়নি। পৃথিবীর যে ভাবটা নির্জন, বিরল অসীম, সেই আমাদের উদাসীন করে দিয়েছে। তাই সেতারে যখন ভৈরবীর মিড় টানে আমাদের ভারতবর্ষীয় হৃদয়ে একটা টান পড়ে।

এই পৃথিবীর ভাবটা কিন্তু তার বেড়ে ওঠা কোলকাতার নয়। কোলকাতা তাঁর কাছে—সেই বাঁশতলার গলি, জোড়াসাঁকোর মোড়, সেই ছেকরা গাড়ির আস্তাবল, সেই ধূলো, সেই ঘড় ঘড়—হুড় মুড়—হৈ হৈ, সেই মাছি-ভন ভন ময়রার দোকান, সেই ঘোরতর হিজি বিজি হ-য-র-ল-ব। সেখানে তিন হাজার গির্জের চূড়ো, কলের চিমনি, জাহাজের মাস্তুল নীল আকাশে যেন গুতো মারতে উঠেছে। কোলকাতা তার সমস্ত লোষ্ট্রকাষ্ঠ দিয়ে প্রকৃতিকে গঙ্গা পার করেছে—তার উপর আবার এক পাঁচিল-দেওয়া নিমতলার ঘাট, মানুষের মরেও সুখ নেই।

সুখের ভাবটা পাচ্ছেন বাংলায়। তিনি যেখানে বোটে করে ঘুরছেন ছোটো বড়ো বিভিন্ন নদীতে। দেখতে পাচ্ছেন বিস্তীর্ণ মাঠ, মুক্ত আকাশ, আশেপাশের গ্রাম, সাধারণ ,মানুষের শান্ত নিস্তরঙ্গ সরল জীবনযাত্রা। তার হৃদয়ে ধরা পড়েছে—হাসি-কান্না-সুখ-দুঃখ ভরা বিভিন্ন চরিত্র। তার হৃদয়ে জারিত হয়ে এই সুর মুখর হয়েছে তার ছোটো গল্প। পরবর্তীতে এই সুরেই বদলে যাচ্ছে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবনা। তাঁর লেখা-পত্তর। তাঁর ভুবনজোড়া জগৎখানি। সেটা বাংলার মুখ।

ছোটো গল্পের শুরু

ইন্দিরাকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ দুটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তারিখটি উল্লেখ নেই। ছিন্নপত্রে লেখা আছে ফেব্রুয়ারি ১৮৯১। .স্থান শাহাজাদপুর।

ঘটনার চরিত্র বেদে-পুলিশ ও একটি দরিদ্র শিশু। তিনি বসে আছেন জানালার পাশে—বোটে। খালের ওপারে দেখতে পাচ্ছেন একদল বেদেকে। তারা বাখারির উপর দরমা ও কাপড় টানিয়ে আশ্রয় বানিয়েছে। মাঘ মাসের শীতকাল। বেলার আট-নটার সময়  তারা দরমার চালের উপর রোদে দিয়েছে রাতে শোবার কাঁথা ও ছেড়া নেকড়াগুলো। কাছাকাছি তাদের শুয়োরপাল গুটি শুটি হয়ে রোদ পোয়াচ্ছে। এই বেদেদের জীবন ভাসমান। তাদের কোথাও বাড়ি-ঘর নেই। কোনো জমিদারকে খাজনা দেওয়া লাগে না। একদল শুয়োর, গোটা দুয়েক কুকুর ও কতকগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়।

রবীন্দ্রনাথ জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন, পুরুষটি রান্না চড়িয়েছে। বসে বসে বাঁশ চিরে চিরে ধামা চাঙারি কুলো তৈরি করছে। আর কালো বউটি আয়না নিয়ে ভেজা গামছা দিয়ে মুখ মুছে নিয়েছে। তারপর পুরুষটির সঙ্গে কাজ করছে। কেউ বসে নেই। মাঝে মাঝে এক মেয়ে আরেক মেয়ের উঁকুন বাঁছছে। ঘরকন্নার গল্প জুড়ছে।

এই বেদেদের সম্পর্কে পুলিশের  ধারণা সন্দেহজনক। সেদিন এক পুলিশ এসে ঐ বেদে পুরুষটিকে লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গালমন্দ করছে। শুনে মেয়েটি বাখারি ছোলা বাদ দিয়ে পুলিশকে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গালমন্দের জবাব দিচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, দেখতে দেখতে দারোগার তেজ প্রায় বারো-আনা পরিমাণ কমে গেল—অত্যন্ত মৃদুভাবে দু-একটা কথা বলবার চেষ্টা করলে—কিন্তু একটুও অবসরও পেলে না। যেভাবে এসেছিল সে ভাব অনেকটা পরিবর্তন করে ধীর ধীরে চলে যেতে হল। অনেকটা দূরে গিয়ে চেঁচিয়ে বললে, 'আমি এই বলে গেলাম—তোমাদের এখান হৎকে যাবার লাগবে'।

রবীন্দ্রনাথ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, পুলিশের হুমকীকে বেদেরা থোড়াই কেয়ার করল।

এদিনই তিনি জানালা দিয়ে দেখতে পেয়েছেন, এক মেয়ে তার উলঙ্গ শীর্ণ শিশুটিকে মাঘ মাসের ঠাণ্ডা জলের মধ্যে স্নান করাচ্ছে। ছেলেটা শীতে কাঁপছে। ভয়ানক ভাবে কাশছে। মেয়েটা ছেলেটার গালে চড় কশিয়েছে। 'ছেলেটা বেঁকে পড়ে পড়ে হাঁটুর উপর হাত দিয়ে ফুল ফুলে কাঁদতে লাগল, কাশিতে তার কান্না বেধে যাচ্ছিল।

এই ঘটনাটিকে কোমল কবির কাছে পৈশাচিক মনে হয়েছে। অসহায় শিশুটির কান্না তাকে বিচলিত করেছে।

৪ ঠা ফেব্রুয়ারি ১৮৯১ তারিখে প্রমথনাথ চৌধুরীকে একটি চিঠিতে জানাচ্ছেন, শাহাজাদপুরে সেদিন সকালে প্রাতঃভ্রমণ করার সময় ডান কাঁধে বাতের ব্যাথা অনুভব করছেন। মাথা ও হাত নাড়াতে পারছেন না।

৯ ফেব্রুয়ারি তিনি শাহজাদপুর ছেড়ে শিলাইদহে চলে এসেছেন। শিলাইদহে বোটে এসে তাঁর ভালো লাগছে। কাঁধের ব্যাথা দূর হয়ে গেছে। ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে পোস্ট মাস্টারের কথা বলেছেন।

পোস্ট মাস্টার 

সন্ধ্যার সময় শাহাজাদপুরের পোস্ট মাস্টার কবির সঙ্গে এক-একদিন দেখা করতে আসেন। তাঁর সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন। বিষয় চিঠির যাতায়াত।

পোস্টাফিসটি কুঠিবাড়ির একতলাতেই। ফলে চিঠি আসা মাত্রই চিঠি পাওয়া যায়। কথক হিসাবে পোস্ট মাস্টার ভালোই। কবির ভালোই লাগে এই নির্জনে তার বলা গল্পগুলো। তিনি অসম্ভব কথা বেশ গম্ভীরভাবে বলতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, কাল বলছিলেন, এ দেশের লোকের গঙ্গার উপর এমনি ভক্তি যে, তাদের কোনো আত্মীয় মরে গেলে তার হাড় গুড়ো করে রেখে দেয়। কোনো কালে গঙ্গার জল খেয়েছে এমন লোকের যদি সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তাহলে তাকে পানের সঙ্গে সেই হাড়-গুড়ো খাইয়ে দেয়, আর মনে করে তার আত্মীয়ের একটা অংশের গঙ্গা লাভ হল। আমি হাসতে হাসতে বললুম, 'এটা বোধ হয় গল্প?'।. তিনি খুব গম্ভীর ভাবে চিন্তা করে স্বীকার করলেন, 'তা হতে পারে।'

এই পোস্ট মাস্টারকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন পরে তাঁর সেই বিখ্যাত পোস্ট মাস্টার গল্পটি। গল্পটির শেষ স্তবকে বলেছেন সেই হৃদয় কাঁপানো বাক্য–এই পৃথিবীকে কে কাহার। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছোট গল্পের বিষয়বস্তু বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, পোস্ট মাস্টারটি বজরায় এসে বসে থাকতো। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে। ছিদামদের দেখেছি—আমাদের কাছারিতে। ওই যারা কাছে এসেছে তাদের কতকটা দেখেছি– কতকটা বানিয়ে নিয়েছি।

বাংলার নদীতীরবর্তী এইসব মানুষের চরিত্র ক্ষণে ক্ষণে যতটুকু গোচরে এসেছিল তার চেয়ে অনেকখানি প্রবেশ করেছিল তাঁর মনের অন্দর মহলে আপন বিচিত্র রূপ নিয়ে। এই দেখা না দেখার মেশা জগৎই গল্পগুচ্ছের মধ্যে দিয়ে প্রাণ পেয়েছিল। তিনি যখন স্থায়ীভাবে  শান্তি নিকেতনে চলে গিয়েছিলেন তখন কিন্তু এই ছোটো গল্প রচনার ধারাটি অক্ষুণ্ন থাকে নি। তিনি দুঃখ করে স্বীকার করেছিলেন পরবর্তীকালে—গল্প রচনার সে ধারা অব্যাহত থাকতো, যদি কর্তব্যের টানে তাকে চলে না আসতে হতো বীরভূমের শুষ্কপ্রান্তরের ক্ষেত্রে। এই গল্পগুলো সাধনা ও হিতবাদী পত্রিকার তাগিদে লেখা হয়েছে। এটা হয়েছে পূর্ববঙ্গের মাটি ও মানুষের কারণে।

এর পরের চিঠিতে ইন্দিরাকে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ সেই অসম্ভব কথার মতই—

কাছারির পরপারের নির্জন চরে বোট লাগিয়ে বেশ আরাম বোধ হচ্ছে। দিনটা এবং চারিদিকটা এমনি সুন্দর ঠেকেছে সে আর কী বলব। অনেক দিন পরে আবার এই বড়ো পৃথিবীর সঙ্গে যেন দেখা-সাক্ষাৎ হল। সেও বললে, 'এই-যে।' আমিও বললুম, 'এই-যে'। .তার পরে দুজনে বসে আছি—আর কোনো কথাবার্তা নেই, জল ছল ছল করছে এবং তার উপরে রোদ্দুর চিকচিক করছে, বালির চর ধূ ধূ করছে, তার উপরে ছোট বনঝাউ উঠেছে। জলের শব্দ, দুপুর-বেলাকার নিস্তদ্ধতার ঝাঁ ঝাঁ এবং ঝাউঝোপ থেকে দুটো-একটা পাখির চিক চিক শব্দ, সবসুদ্ধ মিলে খুব একটা স্বপ্নাবিষ্ট ভাব। খুব লিখে যেতে ইচ্ছে করছে—কিন্তু আর কিছু নিয়ে নয়, এই জলের শব্দ এবং রোদ্দুরের দিন, এই বালির চর। মনে হচ্ছে রোজই ঘুরে ফিরে এই কথাই লিখতে হবে—কেননা, একই নেশা, আমি বারবার এই এক কথা নিয়েই বকি—

বড়ো বড়ো নদী কাটিয়ে আমাদের বোটটা একটা ছোটো নদীর মুখে প্রবেশ করছে। দুই ধারে মেয়েরা স্নান করছে, কাপড় কাঁচছে এবং ভিজে কাপড়ে এক-মাথা ঘোমটা টেনে জলের কলসী নিয়ে ডান হাত দুলিয়ে ঘরে চলেছে—ছেলেরা কাদা মেখে জল ছুড়ে মাতামাতি করছে এবং একটা ছেলে বিনা সুরে গান গাচ্ছে ' একবার দাদা বলে ডাকরে লক্ষ্মণ।' উঁচু পাড়ের উপর দিয়ে অদূরবর্তী গ্রামের খড়ের চাল এবং বাঁশবনের ডগা দেখা যাচ্ছে। …পৃথিবীর সকালবেলাকার কাজকর্ম খানিকক্ষণের জন্যে বন্ধ হয়ে আছে।

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : একবিংশ পর্ব

ছোটো গল্পের হদিস

১৮৯১ সালের ৩০ মে একটি নতুন সাপ্তাহিক পত্রিকা হিতবাদী প্রকাশিত হয়েছিল। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য সম্পাদক। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য সম্পাদক। মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায় রাজনৈতিক সম্পাদক নিযুক্ত হন। হিতবাদী নামটি রবীন্দ্রনাথের বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া। তিনি পত্রিকার উদ্দেশ্যও লিখে দেন—হিতং মনোহারি চ দুলর্ভং বচঃ। পত্রিকার প্রতি সংখ্যায় একটি করে গল্প প্রকাশিত করার নীতি নেওয়া হয়েছিল। পত্রিকাটিতে লেখকদের স্মানী দেওয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলি গল্প লেখেন হিতবাদীতে।

এর আগে ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ভিখারিনী ও ঘাটের কথা এবং নবজীবনের রাজপথের কথা প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো ঠিক গল্প নয়। গল্পের আভাষ মাত্র। রবিজীবনীকার প্রশান্ত পাল জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের সূচনা সূচনা হিতবাদীতেই—পরে তা সাধনা পত্রিকায় পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। বস্তুত সুখদুঃখবিরহমিলনপূর্ণ মানবজীবনের সঙ্গে যে অন্তরঙ্গ পরিচয় ছোটো গল্পের প্রাণ, সেই বাস্ত অভিজ্ঞতার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন শিলাইদহ-শাহাজাদপুর-পতিসরে জমিদারী-পরিদর্শনের সময়। তাই মাঝে মাঝে রোমাঞ্চের উর্দ্ধলোকে প্রয়াণ করলেও রবীন্দ্রনাথের এই পর্বের ছোট গল্পের প্রধান বিষয় মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবন।

'দেনাপাওনা', 'পোস্টমাস্টার', 'গিন্নি', 'রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা', 'ব্যবধান', 'তারাপ্রসন্নের কীর্তি' ও 'খাতা' গল্পগুলি হিতবাদীতে প্রকাশিত হয়। পদ্মিনীমোহন নিয়োগীকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, সাধনা বাহির হইবার পুর্বেই হিতবাদী কাগজের জন্ম হয়। সেই পত্রে আমি প্রতি সপ্তাহেই ছোট গল্প সমালোচনা ও সাহিত্যপ্রবন্ধ লিখিতাম। আমার ছোটো গল্প লেখার সূচনা ঐখানেই। ছয় সপ্তাহকাল লিখিয়াছিলাম।

হিতবাদীতে সাতটি গল্প প্রকাশিত হওয়ার পরে সম্পাদক কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য রবীন্দ্রনাথকে বলেন, গল্পগুলো সাধারণের পক্ষে গুরুপাক হচ্ছে। লঘুপাকের গল্প লেখা আবশ্যক। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়ে হিতবাদীতে লেখা ছেড়ে দেন। সম্পাদকের মতকে তিনি সঙ্গত মনে করেন নি। এরপরে ঠাকুরবাড়ি থেকে সাধনা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তিনি সেখানে ছোট গল্প লেখেন।

১৮৯১ সালের জুন মাসে আষাঢ়ের বৃষ্টির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ শাহাজাদপুরে চলে যান। পাল তুলে তার বোট চলেছে যমুনা নদীর মধ্য দিয়ে। নদীটি প্রকাণ্ড। তীব্র স্রোতে পাড়  ভাঙছে—নদী ভাঙছে। আর বাতাসের হুহু ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু তাদের বোটটি ছাড়া আর কোনো নৌকা দেখা যাচ্ছে না যমুনায়। সন্ধ্যাসন্ধি বড় নদী থেকে যমুনার ছোটো একটা শাখা নদীতে প্রবেশ করেছে। একটা  চরে বোটটি বাঁধা হয়েছে। চরটি বড়। ধূ ধূ বালি। কিন্তু কোনো জনমানুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যপারে সবুজ শস্যক্ষেত। আর দূরে একটি গ্রাম। ইন্দিরাকে চিঠিতে লিখেছেন—এই নদীর উপরে, মাঠের উপরে, গ্রামের উপরে সন্ধ্যেটা কী চমৎকার, কী প্রকাণ্ড, কী অগাধ সে কেবল স্তব্ধ হয়ে অনুভব করা যায়। কিন্তু ব্যক্ত করতে গেলেই চঞ্চল হয়ে উঠতে হয়। ক্রমে যখন অন্ধকারে সমস্ত অস্পষ্ট হয়ে এল, কেবল জলের রেখা এবং তটের রেখায় একটা প্রভেদ দেখা যাচ্ছিল, এবং গাছপালা কুটির সমস্ত একাকার হয়ে একটা ঝাপসা জগৎ চোখের সামনে বিস্তৃত পড়ে ছিল তখন ঠিক মনে হচ্ছিল এ-সমস্ত যেন  ছেলেবেলার রূপকথার অপরূপ জগৎ।

এই জগতে রবীন্দ্রনাথের নিজেকে মনে হয়েছে একজন রাজপুত্র—তার জন্য ঘুমিয়ে আছে একজন রাজকন্যা। এই ভাবনা নিয়েই তিনি লিখেছেন শৈশব সন্ধ্যা কবিতাটি।

১১ জুন একটি ঝড়ের বিবরণ দিয়েছেন। বোটের মধ্যে থেকে খোলা জানালায় মুখ রেখে প্রকৃতির এই রুদ্ররূপ দেখছেন। নিজের মনকে রুদ্রের তালে দোলাচ্ছেন।

পরদিন তিনি সন্ধ্যায় তিনি নৌকায় উঠেছেন। চাঁদ উঠেছে—অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। ছেটো নদীর মধ্যে ঢুকে পড়েছে বোটটি। এই স্থানটি তাঁর কাছে পরীস্থানের মত মনে হচ্ছে। একটা ধানক্ষেতে বোটটি নোঙ্গর করা হয়েছে। 'কাছি ফেল', নোঙ্গর ফেল' এ কর' সে কর' করতে করতে ঝড় এলো, মাঝি থেকে থেকে বলতে লাগল ভয় কোরো না ভাই, আল্লার নাম করো—আল্লা মালেক। থেকে থেকে সকলে আল্লা আল্লা করতে লাগল।

এই ঝড় বাদলটা একটা মস্ত তামাশার মত মনে হয়েছে। তিনি লিখেছেন, আমরা কিনা প্রকৃতির নাতি সম্পর্ক, তাই তিনি মধ্যে মধ্যে একটু-আধটু তামাশা করে থাকেন। জীবনটা একটা গম্ভীর বিদ্রুপ, এর মজাটা বোঝা একটু শক্ত—কারণ, যাকে নিয়ে মজা করা হয়, মজার রসটা সে গ্রহণ করতে পারে না।

এরপর ছিন্নপত্রে আরেকটি শান্ত জ্যোৎস্নার কথা বলছেন। অন্যত্র তাঁর দেখা জ্যোৎস্নার সঙ্গে এর একটা পার্থক্য পাওয়া যাচ্ছে। 'সেখানে জ্যোৎস্না ছাড়াও অন্য পাঁচটা বস্তু আছে—কিন্তু এখানে নিস্তব্ধ রাত্রি ছাড়া আর কিছু নাই।  একলা বসে এই জ্যোৎস্নার অনন্ত শান্তি ও সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু এই দেখাটাকে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। তাই তিনি বোটের জানালায় মাথা রেখে আছেন। বাতাস তার চুলে স্নেহস্পর্শ্ব দিচ্ছে। শুনতে পাচ্ছেন জলের ছল ছল শব্দ। জ্যোৎস্না ঝিকমিক করছে। এই জলে নয়ন আপনি ভেসে যায়। অনেক সময় মনের আন্তরিক অভিমান, একটু স্নেহের স্বর শুনলেই অমনি স্নেহজলে ফেটে পড়ে।

এরপরের চিঠিতে দিয়েছেন একটি দুপুরের বর্ণনা। এই দুপুর বেলাটি তাঁর বেশ লাগে। রৌদ্রে চারিদিক বেশ নিঃঝুম হয়ে থাকে—মনটা ভারী উড়ু উড়ু করে, বই পড়ার ইচ্ছে করে না।

এই শান্ত প্রকৃতির মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন খেয়া ঘাটের দৃশ্য। সেটা নিঃঝুম নয়। একটু গতিশীল। বটগাছের তলায় নানাবিধ লোক জড়ো হয়ে নৌকার জন্য অপেক্ষার  করছে। নৌকা আসা মাত্রই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ছে।…ওপারে হাট, তাই খেয়া নৌকায় এত ভীড়। কেউবা ঘাসের বোঝা, কেউবা একটা চুপড়ি, কেউবা একটা বস্তা কাঁধে করে হাঁটে যাচ্ছে এবং হাঁট থেকে ফিরে আসছে, ছোটো নদীটি এবং দুই পারের ছোটো গ্রামের মধ্যে নিস্তব্ধ দুপুর বেলায় একটুখানি কাজকর্ম, মনুষ্যজীবনের জন্যে এই একটুখানি স্রোত অতি ধীরে ধীরে চলছে। সব কিছু বিষাদের ছায়া বোধ হয়। তারমধ্যে সংসারের সুখদুঃখ, আনন্দ-বেদনা—ক্ষণস্থায়ী। নিস্ফল কাতরতা-পুর্ণ তুচ্ছ মনে হয়।

পরের চিঠিতে তিনি একটি বিকেল বেলার কথা লিখেছেন। বিকেলে বেলাটি নির্জন নয়—একটি গ্রামের ঘাট। সেখানে অনেকগুলো ছেলে খেলা করছে। তিনি জানালা দেখতে পাচ্ছেন। দৃশ্যটি তাঁর ভালো লাগছে। কিন্তু বোটের মাঝিমাল্লা আর লোকজন ছেলেগুলোর এই খেলাধূলা জমিদারের সামনে বেয়াদবী হিসেবে গণ্য করে থাকে। চাষারা গরুকে জল খাওয়াতে এলে পাইক পেয়াদারা লাঠি নিয়ে তাড়া করে। এটা কবির অপছন্দ। তিনি পাইক পেয়াদাদের থামিয়ে দেন।

শাহাজাদপুরের কুঠি বাড়ির দোতলায় বসে এমনই এক দুপুরবেলায় রবীন্দ্রনাথ পোস্টমাস্টার গল্পটি লিখেছিলেন। এইখানকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ ও প্রকৃতির নিরবিচ্ছিন্ন পাঠ—তার মধ্যে একটি বর্ণনাধর্মী গল্পভাষা তৈরি করেছিল।  এ কারণে তার গল্পে ঘটনার ঘনঘটা কম, মানুষের সুখ দুঃখ একটি বৃহৎ পরিসরে স্থান পায়। নিচু স্বরে বিলম্বিত লয়ে খেলা করতে থাকে।

এই বিকেল বেলার ঘাটে এসে রবীন্দ্রনাথ ছুটি গল্পটি পেয়ে গেছেন। ছিন্নপত্রে লিখেছেন—ডাঙার উপর একটা মস্ত নৌকার মাস্তুল পড়ে ছিল—গোটা কতক বিবস্ত্র ক্ষুদে ছেলে মিলে অনেক বিবেচনার পর ঠাওরালে যে, যদি যথোচিৎ কলরব-সহকারে সেইটেকে ঠেলে ঠেলে গড়ানো যেতে পারে তাহলে খুব একটা নতুন এবং আমোদজনক খেলার সৃষ্টি হয়।…এর মধ্যে একটি ছোটো মেয়ে এসে বসেছে মাস্তুলের উপর। তাতে ছেলেদের খেলা পণ্ড হওয়ার জোগাড়। বয়োজ্যেষ্ঠ ছেলেটি একপাশে সরে যেতে অনুরোধ করেছে। মেয়েটি সরে না যাওয়ায় মাস্তুলটিকে মেয়েটিসহ গড়িয়ে ফেলে দিল। এই বয়োজ্যেষ্ঠ ছেলেটিই ছুটি গল্পের ফটিক। মেয়েটির বদলে গল্পে এনেছেন ফটিকের ছোটো ভাইয়ের চরিত্র। বাস্তবে ঘটনাটি গড়িয়ে ফেলা পর্যন্ত। গল্পটি যখন লিখেছেন তখন ঘটনার গায়ে একটি নতুন আখ্যান জুড়ে দিয়েছেন। ফটিক শহরে যাচ্ছে। শহরে মামার বাসায় থাকছে। একসময়ে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। বাস্তবতা আর কল্পনার মিশেলে ফটিক গল্পটি বাংলাভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প।

আরও দুটি চিঠি পাওয়া যাচ্ছে এই সময়কালে। প্রথমটিতে তিনি একটি স্বপ্নের বিবরণ দিচ্ছেন। শাহজাদপুরের নির্জন বিজন পল্লীতে থেকে কোলকাতার ভিড়ভাট্টা পুর্ণ জীবনের আখ্যান যেন এই স্বপ্নটি। সমস্ত কোলকাতা শহরটি যেন মহা একটা ভীষণ অথচ আশ্চর্য ভাবের দ্বরা আচ্ছন্ন হয়ে আছে—বাড়িঘর সমস্তই একটা  কুয়াশার ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে—এবং তার ভিতরে তুমুল কী একটা কাণ্ড চলছে।

সেন্ট জেভিয়ার কলেজটা একটু একটু বড়ো হয়ে যাচ্ছে। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বদখত, মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের লোকজন এসে পড়েছে। মেয়েগুলো মাথায় কী একটা গুড়ো দিয়ে লম্বা হতে চেষ্টা করছে। এজন্যে বাড়িটা বেঁকে চুরে বিশ্রী হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দেখা যায়, আধখানা মানুষ দেয়ালের মধ্যে গাঁথা রয়েছে, আধখানা বেরিয়ে আছে। বেশ শয়তানী কাণ্ড মনে হচ্ছে। পুরোটা একটা পরাবাস্তব গল্প।

গ্রন্থসূত্র : ——— ১. রবিজীবনী–প্রশান্তকুমার পাল ২.রবিজীবনকথা–প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ৩. রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন — সমীর সেনগুপ্ত ৪. ছিন্নপত্র : রবীন্দ্রনাথ ৫. হাজার বছরের বাঙাল সংস্কৃতি গোলাম মুরশিদ ৬. জমিদার রবীন্দ্রনাথ : শিলাইদহ পর্ব : অমিতাভ চৌধুরী ৭. রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, ৮. আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ : আবু সয়ীদ আইয়ুব, ৯. রবীন্দ্র কাব্যালোচলায় রবীন্দ্রনাথ : ডঃ সুখেন্দুসুন্দর গঙ্গোপাধ্যায়, ১১. ব্রাত্য লোকায়ত লালন  : সুধীর চক্রবর্তী।

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : দ্বাবিংশ পর্ব

চিত্রগদ্য : গদ্যচিত্র

৪ জুলাই. শাহাজাদপুর. ১৮৯১

কবির ঘাটে একটি নৌকা থেমেছে। অনেকগুলো জনপদবধু নৌকার কাছে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে আছে কচি ছেলে, ঘোমটাপরা বউ এবং পাকা চুলের বুড়ি। একটি মেয়ে ডাঙায় দাঁড়িয়ে রৌদ্রে চুল এলিয়ে দশাঙ্গুলি দিয়ে জটা ছাড়াচ্ছে। আর নৌকার অন্য একটি রমণীর সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে ঘরকণ্যার আলাপ করছে। তাদের টুকরো টুকরো আলাপ –'মায়্যা' অন্য ছাওয়াল নাই, কারে কী কয় কারে কী হয়—আপন পর জ্ঞান নেই। গোপাল সার জামাই ভালো হয়নি। এজন্য তাদের গ্রামের মেয়েটি তার ঘর করে না। এইসব।

নৌকার কাছে চুল-ছাঁটা, গোলগাল-হাতে-বালা-পরা, উজ্জ্বল-সরল-মুখশ্রীর মেয়েকে স্বামীর বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। আগত বউ ঝিরা কাঁদছে। তার বোনটিও নিঃশব্দে মায়ের কোলে কেঁদে কেঁদে বড় বোনকে বিদায় জানাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রে লিখেছেন, সকাল বেলাকার রৌদ্র এবং নদীতীর এবং সমস্ত এমন গভীর বিষাদে পূর্ণ বোধ হতে লাগল। সকাল বেলাকার একটা অত্যন্ত হতাশ্বাস করুণ রাগিণীর মত। মনে হল, সমস্ত পৃথিবীটা এমন সুন্দর অথচ এমন বেদনায় পরিপূর্ণ। …বিদায়কালে এই নৌকো করে নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়ার মধ্যে যেন আরও একটু বেশি করুণা মতো। অনেকটা যেন মৃত্যুর মতো—তীর থেকে প্রবাহে ভেসে যাওয়া—যারা দাঁড়িয়ে থাকে তারা আবার চোখ মুছে ফিরে যায়, যে ভেসে গেল সে অদৃশ্য হয়ে গেল। এই গভীর বেদনাটুকু, যারা রইল এবং গেল উভয়েই ভুলে যাবে, হয় তো ততক্ষণে অনেকটা লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। বেদনাটুকু ক্ষণিক এবং বিস্মৃতিটাই চিরস্থায়ী। কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে এই বেদনাটুকুই বাস্তবিক সত্য, বিস্মৃতি সত্য নয়। এক-একটা বিচ্ছেদ এবং এক-একটা মৃত্যুর সময় মানুষ সহসা জানতে পারে এই ব্যথাটা কী ভয়ঙ্কর সত্য।

ন্যায় দর্শনের সেই সাপ এবং লাঠি দেখার মত কখনো সাপ সত্যি—কখনো লাঠি সত্যি মনে হয়। কোনটা যে সত্যি—নির্ধারণ করা কঠিন। দুটোই ভ্রমাত্মক। আবার দুটোই সত্যি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বাস্তবিক, আমাদের দেশের করুণ রাগিণী ছাড়া সমস্ত মানুষের পক্ষে, চিরকালের মানুষের পক্ষ, আর কোনো গান সম্ভবে না। এইখানে এসে আমাদের স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়।

এই আধা ছেলে আধা বালিকা মেয়েটির কাহিনীই বছর দুই পরে রবীন্দ্রনাথ সমাপ্তি গল্প লিখেছেন। সেখানে মেয়েটির নাম মৃন্ময়ী।

'মৃন্ময়ী দেখিতে শ্যামবর্ণ। ছোটো কোঁকড়া চুল পিঠ পর্যন্ত পড়িয়াছে। ঠিক যেন বালকের মতো মুখের ভাব। মস্ত মস্ত দুটি কালো চক্ষুতে না আছে লজ্জা, না আছে ভয়, না আছে হাবভাবলীলার লেশমাত্র। শরীর দীর্ঘ পরিপুষ্ট সুস্থ সবল, কিন্তু তাহার বয়স অধিক কি অল্প সে প্রশ্ন কাহারও মনে উদয় হয় না; যদি হইত, তবে এখনও অবিবাহিত আছে বলিয়া লোকে তাহার পিতামাতাকে নিন্দা করিত। গ্রামে বিদেশী জমিদারের নৌকা কালক্রমে যেদিন ঘাটে আসিয়া লাগে সেদিন গ্রামের লোকেরা সম্ভ্রমে শশব্যস্ত হইয়া উঠে, ঘাটের মেয়েদের মুখ-রঙ্গভূমিতে অকস্মাৎ নাসাগ্রভাগ পর্যন্ত যবনিকাপতন হয়, কিন্তু মৃন্ময়ী কোথা হইতে একটা উলঙ্গ শিশুকে কোলে লইয়া কোঁকড়া চুলগুলি পিঠে দোলাইয়া ছুটিয়া ঘাটে আসিয়া উপস্থিত। যে দেশে ব্যাধ নাই, বিপদ নাই, সেই দেশের হরিণশিশুর মতো নির্ভীক কৌতূহলে দাঁড়াইয়া চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে থাকে, অবশেষে আপন দলের বালকসঙ্গীদের নিকট ফিরিয়া গিয়া এই নবাগত প্রাণীর আচারব্যবহার সম্বন্ধে বিস্তর বাহুল্য বর্ণনা করে।'

অপূর্ব বিএ পাশ করে কোলকাতা দেশে এসে এই মৃন্ময়ীকে দেখেছে নদীর ঘাটে। তাকে বিয়ে করেছে। মেয়েটির তখনো রমণী হয়ে ওঠে নি। তার মনে পড়ে থাকে অবাধ মুক্ত প্রান্তরে। সঙ্গীসাথীদের কাছে। শ্বাশুড়ী মনে করেন মেয়েটি লক্ষ্মী ছাড়া। কিন্তু অপূর্ব লক্ষ্মীময়ী হয়ে উঠবে একদিন।

'শাশুড়ী মৃন্ময়ীর বিদ্রোহী ভাবের সমস্ত লক্ষণ দেখিয়া তাহাকে ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া রাখিয়া দিল। সে নূতন পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির মতো প্রথম অনেকক্ষণ ঘরের মধ্যে ধড়ফড় করিয়া বেড়াইতে লাগিল। অবশেষে কোথাও পালাইবার কোনো পথ না দেখিয়া নিষ্ফল ক্রোধে বিছানার চাদরখানা দাঁত দিয়া ছিঁড়িয়া কুটিকুটি করিয়া ফেলিল, এবং মাটির উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া মনে মনে বাবাকে ডাকিতে ডাকিতে কাঁদিতে লাগিল।

এমন সময় ধীরে ধীরে কে তাহার পাশে আসিয়া বসিল। সস্নেহে তাহার ধূলিলুণ্ঠিত চুলগুলি কপোলের উপর হইতে তুলিয়া দিবার চেষ্টা করিল। মৃন্ময়ী সবলে মাথা নাড়িয়া তাহার হাত সরাইয়া দিল। অপূর্ব কানের কাছে মুখ নত করিয়া মৃদুস্বরে কহিল, "আমি লুকিয়ে দরজা খুলে দিয়েছি। এস আমরা খিড়কির বাগানে পালিয়ে যাই।" মৃন্ময়ী প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া সতেজে সরোদনে কহিল, "না।" অপূর্ব তাহার চিবুক ধরিয়া মুখ তুলিয়া দিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, "একবার দেখো কে এসেছে।"

অপূর্ব কোলকাতায় ফিরে যায়। তখন মৃন্ময়ী মায়ে কাছে চলে গেছে। কিন্তু নতুন জীবন তাকে সেই পূরনো জীবনের অনেকটাই বদলে দিয়েছে খোলস পাল্টানোর মত। এই বদলে যাওয়ার গল্পটিই সমাপ্তি।

স্ত্রী মৃণালিনীকে ২০ জুন ১৮৯১ লিখেছেন, আমার প্রবাস ঠিক একমাস হল। আমি দেখেছি যদি কাজের ভিড় থাকে তা হলে আমি কোন মতে একমাসকাল কাটিয়ে দিতে পারি। তার পর থেকে বাড়ির দিকে মন টানতে থাকে।

এ সময়কালে ঠাকুর বাড়ির ক্যাশবহির হিসাব থেকে জানা যায়—ঠাকুর বাড়িতে ব্যয় সংকোচনের প্রয়োজন হয়েছে। সবাই পূর্বে যে পরিমাণ মাসোহারা পেতেন—তা অর্ধেক হয়ে গেছে। শুধু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মাসোহারাটা পাল্টে নি। তিনি পেতেন ৩৮০ টাকা। রবীন্দ্রনাথ ৩০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায় নেমে গেলেন। তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী ৩০ টাকা। রবীন্দ্রনাথের বেতন থেকে ৩৩ টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে।  রবিজীবনীকার প্রশান্ত পালের অনুমান—রবীন্দ্রনাথ বিলেত যাওয়ার জন্য ৫-৬ হাজার টাকা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন। সে টাকা মাসোহারা থেকে কেটে নেওয়া হচ্ছে।

১৮৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পুরোটাই রবীন্দ্রনাথ থেকেছেন উড়িষ্যার কটকে। সেখানে জমিদারী পরিচালনা করছেন। কিন্তু তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। সেই ভ্রমণের পথটি ছিল কষ্টকর। তিনি লিখেছেন—বাতাস অবাধে হু হু করে বয়ে আসছে, নারকেল গাছের পাতা ঝরঝর করে কাঁপছে। দুচার জন চাষা মাঠের মধ্যে এক জায়গায় জটলা করে ধানের ছোটো ছোটো চারা উপড়ে নিয়ে আঁটি করা বাঁধছে। শুধু এইটুকু।

আবার শিলাইদহে যাত্রা করেছেন রবীন্দ্রনাথ সেপ্টেম্বরের শেষ দিনটিতে। ১৮৯১ সালের ১ অক্টোবর ইন্দিরা দেবীকে লিখেছেন—বেলায় উঠে দেখলুম চমৎকার রোদ্দুর উঠেছে এবং শরতের পরিপূর্ণ নদীর জল তল-তল থৈ-থৈ করছে। নদীর জল এবং তীর প্রায় সমতল, ধানের ক্ষেত সুন্দর সবুজ এবং গ্রামের গাছপালাগুলি বর্ষাবসানে সতেজ এবং নিবিড় হয়ে উঠেছে।…দুপুর বেলা খুব এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। তার পরে বিকেলে পদ্মার ধারে আমাদের নারকেল বনের মধ্যে সূর্যাস্ত হল। আমি নদীর ধারে উঠে আস্তে আস্তে বেড়াচ্ছিলুম। আমাদের সামনের দিকে দূরে আম-বাগানে সন্ধ্যার ছায়া পড়ে আসছে এবং আমার ফেরবার মুখে নারকেল গাছগুলির পিছনে আকাশ সোনায় সোনালী হয়ে উঠেছে। পৃথিবী যে কী আশ্চর্য সুন্দরী এবং কী প্রশস্ত প্রাণে এবং গভীরভাবে পরিপূর্ণ তা এইখানে না এলে মনে পড়ে না। কী শান্তি, কী স্নেহ, কী মহত্ব, কী অসীম করুণাপূর্ণ বিষাদ, আমি তার মধ্যে অবগাহন করে অসীম মানসালোকে একলা বসে থাকি।

এই চিঠিপত্রে রবীন্দ্রনাথ এক মৌলবীর প্রসঙ্গে লিখেছেন—মৌলবী বক বক করে তার ধ্যান ভঙ্গে করে দেন।  ধ্যান ভঙ্গ হলে তিনি ব্যাথিত হন।

শিলাইদহে এই মৌলবী সর্বদাই সঙ্গে সঙ্গে  থাকেন। প্রমথ চৌধুরীকে ১৮৯১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি চিঠিতে লিখেছেন—সাজাদপুরে বাত যেমন আমার কাঁধে চেপেছিল, এখানে মৌলবী তার চেয়ে কম নয়। শচীন্দ্রনাথ অধিকারী লিখেছেন, শোনা যায়, তিনি (মৌলবী) নাকি স্থানীয় মুসলমান নন, তিনি ছিলেন পাঞ্জাবি; আরবি ও পারসি সাহিত্যে সুপণ্ডিত, বড় বড় পারসিক কবিদের বানী ও কবিতা প্রায়ই আওড়াতেন; সাধারণত উর্দু বা হিন্দিতেই কথা কইতেন। তিনি খুব সুপুরুষ ছিলেন, আমীর-ওমরাহদের মত দাঁড়িগোফ-সমেত তার সোগৌর দেহকান্তি দেখে সকলেই মুগ্ধ হত। …মৌলবী সাহেব নিজের দর্শনধারী রূপ, আদব-কায়দা আর আরবি-পারসির পাণ্ডিত্যের জোরেই রবীন্দ্রনাথের খুব পরিচিত হয়ে পড়লেন। প্রায়ই নানা বিষয় নিয়ে রবিবাবুর কাছে আসতেন, খুব মিশতেন—স্থানীয় উন্নতিকর নানা আলোচনায় যোগ দিতেন এবং সব বিষয়েই বেশ উদারতার পরিচয় দিতেন।

তবে মৌলবীর সার্বক্ষণিক বকবকানী মাঝেমধ্যে কবির নির্জনতার ব্যাঘাত ঘটাত। ইন্দিরা দেবীকে লিখছেন—মৌলবী এবং আমলাগুলো গিয়ে, কাছারির পরপারের নির্জন চরে বোট লাগিয়ে বেশ আরাম বোধ হচ্ছে।

এখানে নীরবতা, নির্জনতা, নদীর কলধ্বনির প্রত্যেক তরললকারের জন্য তার যে-পিপাসা ধ্বনিত হয়েছে, মুখের বকবকানি আর সাধারণ ব্যবহৃত তথা নিজের কবিতার ভাষার অস্মপূর্ণতা সম্পর্কে মাঝে মাঝে তাঁর সূক্ষ ক্ষোভ ঝরে পড়েছে। সে কারণে তাকে নির্মাণ করে নিতে হয়েছে এই পারিপাশ্বিকের উপযোগী একটি ভাষা। সে ভাষার মধ্যে ছবি আঁকা হয়। তিনি যেন ঠিক করে নিয়েছেন, তার দেখা পুরো ছবি এঁকে তুলতে হবে। কিছুই যেন বাদ না পড়ে। এই প্রকৃতি যেমন চিরকালের, মানুষ যেমন চিরকালের ছাড়া অন্যকালের হতেই পারে না—সেই চিরকালের মহাসঙ্গীত-রূপময় ছবিটিকে তুলে ধরার জন্য এই সৃষ্ট ভাষাটি তাই হয়ে ওঠে স্বভাবতই চিরকালীন—ধ্রুপদী। এটা চিত্রগদ্য। প্রতিটি শব্দের বাইরে ভাব। ভেতরে ছবি।

এর মধ্যে যেমন ডিটেল আছে, তেমনি আছে আবহ বা অ্যাটমসফিয়ার। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক বর্ণনায় একেক সময়ে যে-আন্দাজ অনুপুঙ্খকুশলতা দৃষ্টিগোচর হয়েছে শিলাইদহে, শাহাজাদপুরে, পাতিসরে পূর্ববাংলায়  সে ধরনের ডিটেলের কাজ শেষ জীবনে যখন ছবি আঁকতে শুরু করেন—সেইসব ছবিতেই এই ধারা চলে এসেছে।

১৮৯১ সালে অক্টোবরে আরও চারটি চিঠি লিখেছেন ইন্দিরাকে। তখন পূজার ছুটিতে প্রবাস থেকে ফিরছে লোকজন। বছর খানেক পরে তারা পোটলা পুটলি আর বাক্স-ধামা ভরে বাড়ির জন্য উপহার সামগ্রী নিয়ে আসছে। একটি নৌকা ভিড়েছে। একজন বাবু তখনই পুরনো কাপড় পাল্টে নিয়েছেন। পরেছেন একটি কোঁচানো ধুতি, জামার উপরে দিয়েছেন শাদা রেশনের চায়না কোট। একখানি পাকানো চাদর বহু যত্নে কাঁধের উপরে রেখেছেন। ছাতা ঘাড়ের করে ঘরের দিকে রওনা হলেন।

এটা একটা সুখের দৃশ্য। দৃশ্যটিকে সুখতর লাগছে পারিপার্শ্বিক কারণে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ধানের ক্ষেত থর থর করে কাঁপছে, আকাশে শাদা শাদা মেঘের স্তুপ, তারই উপর আম এবং নারিকেল গাছের মাথা উঠেছে—নারিকেলের পাতা বাতাসে ঝুর ঝুর করছে, চরে দুটো একটা কাশ ফুটে ওঠার উপক্রম করছে—সব-শুদ্ধ বেশ একটা সুখের ছবি।

কিন্তু এর পরেই এই বড়ো পরিসরের মধ্যে চূড়ান্তভাবে বিষাদকেই দেখতে পেয়েছেন। সব কিছু অসীম করুণাপূর্ণ বিষাদময়। এই লোকনিলয় শস্যক্ষেত থেকে ঐ নির্জন নক্ষত্রলোক পর্যন্ত একটা স্তম্ভিত হৃদয়বাঁশিতে আকাশ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে; তিনি তার মধ্যে অবগাহন করে অসীম মানসালোকে একলা বসে থাকেন।

এদিন সে বাবুটির ঘরে ফেরার মনের ভাব, ঘরের লোকদের মিলনের আগ্রহ এবং শরৎকালের আকাশ, পৃথিবী, সবকিছু একীভুত করে তুলেছিল। সবই সেই সুখের। দীর্ঘদিনের প্রবাসজীবনের বেদনা এই সুখের উপস্থিতিতে ধুয়ে মুছে গেছে। তখন জেলে ডিঙি বেয়ে যে মাঝিটি বেসুরো গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে—তাও মধুর। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে তিনি লিখেছেন, উপবাস করে, আকাশের দিকে তাকিয়ে, অনিদ্র থেকে, সর্বদা মনে মনে বিতর্ক করে, পৃথিবীকে এবং মনুষ্যহৃদয়কে কথায় কথায় বঞ্চিত করে স্বেচ্ছারচিত দুর্ভিক্ষে এই দুর্লভ জীবনকে ত্যাগ করতে চান না। পৃথিবী যে সৃষ্টি কর্তার একটি ফাঁকি এবং শয়তানের একটা তাল মনে করে একে বিশ্বাস করে, ভালোবেসে, ভালোবাসা পেয়ে, মানুষের মতো বেঁকে এবং মানুষের মতো মরে গেলেই যথেষ্ট। এইখানে এসে রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত টানছেন—দেবতার মতো হাওয়া হয়ে থাকার চেষ্টা করা আমার কাজ নয়।

পরের চিঠিতে এক ভজিয়া আর তার মায়ের কাহিনী বলছেন। মৌলবী এসে কবিকে বলছেন, কলকাতায় ভজিয়া আয়ছে। ভজিয়া আর তার মা কুঠিবাড়িতে কাজ করে। আর দুজনে প্রায়ই ঝগড়া করে। একদিন মায়ে ঝিয়ে হাতাহাতি হয়ে গেছে।  মা কিছু আহত হয়েছে। সেই ভয়ে ভজিয়া পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু থাকতে পারেনি। ভজিয়া এসে জমিদারবাবুর পা জড়িয়ে ধরেছে। তিনি ঘটনার কিছুই জানেন না। তবু কবিকে মা-মেয়ের মিলন ঘটাতে একটা জমিদারী অভিনয় করতে হয়েছে সকলের অনুরোধে। যেন তিনি সব জানেন। যেনে বিচার করতে বসেছেন।  এই ঘটনাটির একটা নাম দিয়েছেন তিনি—ভজিয়াপাত।

ভজিয়াপাতের পরের চিঠিতে জানা যাচ্ছে– কোলকাতার সঙ্গে পূর্ববঙ্গের একটা গভীর পার্থক্য স্পষ্টভাবে তিনি বুঝতে পারছেন। শিলাইদহ থেকে লিখছেন—এখানে মানুষ কম এবং পৃথিবীটাই বেশী। চারিদিকে এমন সব জিনিস দেখা যায় যা আজ তৈরি করে কাল মেরামত করে পরশুদিন বিক্রি করে ফেলবার নয়, যা মানুষের জন্মমৃত্যু ক্রিয়াকলাপের মধ্যে চিরদিন অটল দাঁড়িয়ে আছে, প্রতিদিন সমানভাবে যাতায়াত করছে এবং চিরকাল অবিশ্রান্তভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। পাড়া গাঁয়ে এলে  মানুষকে স্বতন্ত্রমানুষ ভাবে দেখা যায় না।

তাদের মধ্যে অখণ্ডমানুষকে দেখতে পাচ্ছেন। সমগ্রকে অনুভব করতে পারছেন। এ চিঠির শুরুতেই কিন্তু সোজা সাপ্টাভাবে বলে দিয়েছেন—কোলকাতার মানুষ খণ্ড খণ্ড—স্বতন্ত্র মানুষ। তারা শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। নিজের মহত্বেও প্লুত। সেটা ক্ষুদ্র—অতি ক্ষুদ্র। সেখানে পৃথিবীটাই নেই। আছে খণ্ডমানুষের হিজিবিজি।

এই বছরের শেষ চিঠিতে এই অখণ্ড ধারণাকে অন্য একটি ছবির আকারে লিখেছেন—

নদীতে একটি রেখামাত্র ছিল না, ও-ই সেই চরের পরপারে যেখানে পদ্মার জলের শেষ প্রান্ত দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে  এ পর্যন্ত একটি প্রশস্ত জ্যোৎস্নারেখা ঝিকঝিক করছে; একটি লোক নেই, একটি নৌকো নেই, ও পারের নতুন চরে একটি গাছ নেই, একটি তৃণ নেই—মনে হয়, যেন একটি উজাড় পৃথিবীর উপরে একটি উদাসীন চাঁদের উদয় হচ্ছে, জনশূন্য জগতের মাঝখান দিয়ে একটি লক্ষ্যহীন নদী বয়ে চলেছে, মস্ত একটা পুরাতন গল্প এই পরিত্যাক্ত পৃথিবীর উপরে শেষ হয়ে গেছে, আজ সেই রাজা রাজকন্যা পাত্র মিত্র স্বর্ণপুরী কিছুই নেই, কেবল সেই গল্পের তেপান্তরের মাঠ এবং সাত সমুদ্র তেরো নদী ম্লান জ্যোৎস্নায় ধূ ধূ করছে।

এই ভাবটিকে তিনি বলেছেন অনির্বচনীয়। অনির্বচনীয় শব্দটি রবীন্দ্রনাথে নানাভাবে বহুস্থানে বহুভাবে কথিত হয়।

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ত্রয়োবিংশ পর্ব

প্রজানিপীড়ণ খণ্ড  : এক

অধ্যাপক আহম্মদ শরীফ ১৯৮৫ সালে 'রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন' প্রবন্ধের জন্য  গবেষক অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরীকে কাঙাল হরিনাথের 'গ্রামবার্তা' এবং ঠাকুর জমিদারদের সম্পর্কে জানতে চেয়ে একটি চিঠি লেখেন।

আবুল আহসান চৌধুরীর বাড়ি কুষ্টিয়া। তার পিতার নাম ফজুলল বারী চৌধুরী। মামা বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনের অন্যতম নায়ক কাজী মোতাহার হোসেন। রবীন্দ্রনাথ, লালন ও কাঙাল হরিনাথ মজুমদার বিষয়ে আবুল আহসান চৌধুরীর গবেষণা উচ্চমানের। তিনি সমাজমনস্ক ও ঐতিহ্যানুসন্ধানী। তাঁর চর্চার বিষয় উনিশ শতকের সমাজ ও সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব, সাময়িকপত্র, আধুনিক সাহিত্য ও আঞ্চলিক ইতিহাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। তাঁর পিএইচডির অন্যতম তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন প্রফেসর আহম্মদ শরীফ।

কাঙাল হরিনাথের গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকাটি কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হত। কাঙাল হরিনাথ গ্রামেই থাকতেন। সুতরাং তিনি গ্রামের পরিস্থিতি শুনে নয়—দেখেই লিখতেন। মিছে কথা লেখার লোক তিনি নন। কাঙাল হরিনাথ তার পত্রিকায় সে সময় জমিদার-প্রজার সংবাদ লিখেছেন। জমিদারদের নিপীড়নের খবর নির্ভয়ে প্রকাশ করেছেন।  আহম্মদ শরীফ এই প্রজানিপীড়ন বিষয়ে খোজ নিতে বলেছিলেন তার ছাত্র আবুল আহসান চৌধুরীকে। এজন্য জমিদার তার বিরুদ্ধে লাঠিয়াল পাঠিয়েছিলেন পিটিয়ে তক্তা খোলার জন্য।

ঠাকুর পরিবাররা সে সময় সাজাহাদপুরের জমিদার ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে প্রজানিপীড়নের অভিযোগ।  আহম্মদ শরীফ তাঁর ছাত্র আবুল আহসান চৌধুরীকে  এই অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য তথ্যপ্রমাণাদি প্রেরণের নির্দেশনা দিয়ে চিঠিটি লিখেছেন। প্রবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করা হয়েছে। সুতরাং ঠাকুর-পরিবারের বিরুদ্ধে প্রজাপিড়ীনের অভিযোগের তদন্তের কথা বললেও আসল লক্ষ্য জমিদার রবীন্দ্রনাথ। এজন্য প্রফেসর শরীফ বলে দিচ্ছেন কাঙাল হরিনাথের নামটি আর তার গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামের পত্রিকাটার কথা। তিনি বলছেন—এই গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় ঠাকুরপরিবারের প্রজানিপীড়নের খবর ছাপা হয়েছিল।

অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী প্রফেসর আহম্মদ শরীফকে যে উত্তরটি লেখেন-সেটি একটি ইতিহাস। ইতিহাস এই কারণে যে এই চিঠিটি দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রাবন্ধিক চিঠিটি ব্যবহার করেছেন। চিঠিটি পুরোপুরি আহম্মদ শরীফের  রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন প্রবন্ধে প্রকাশিত হয়। এইসব প্রাবন্ধিকদের উদ্দেশ্য চিঠিটি দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করা যে, রবীন্দ্রনাথ অত্যান্ত প্রজাপীড়ক জমিদার ছিলেন। মজার ঘটনা হল কেউ কিন্তু প্রফেসর শরীফের চিঠিটি তুলে দিচ্ছেন না। তাদের আগ্রহের বিষয় আবুল আহসান চৌধুরীর উত্তরসম্বলিত চিঠিটি।  আবুল আহসান চৌধুরী চিঠিটি লিখেছিলেন ৭. ৯. ৮৫ তারিখে। চিঠির অংশ—

''শ্রদ্ধাভাজনেষু স্যার, সালাম জানবেন। অসুস্থতার জন্যে আপনার চিঠির জবাব দিতে কয়েকদিন দেরী হলো। অনুগ্রহ করে মাফ্‌ করবেন আমাকে। ঠাকুর জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ কাঙাল হরিনাথের 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা'র কোন্‌ বর্ষ কোন্‌ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তা আমার সঠিক জানা নেই। আমাদের কাছে 'গ্রামবার্তা'র যে ফাইল আছে, তাতে এই সংবাদ নেই। প্রজাপীড়নের এই সংবাদ-সূত্রটি পাওয়া যায় কাঙাল-শিষ্য ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র একটি প্রবন্ধে। কাঙালের মৃত্যুর পর অক্ষয়কুমারের এই প্রবন্ধটি সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত 'সাহিত্য' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধে মৈত্রেয়বাবু কাঙাল হরিনাথের সংবাদপত্র পরিচালনায় সততা ও সাহসের পরিচয় প্রসঙ্গে প্রজাপীড়নের সংবাদ 'গ্রামবার্তা'য় প্রকাশের উল্লেখ করেন। ঠাকুর-জমিদারদের অত্যাচার সম্পর্কে হরিনাথ নিজে অক্ষয়কুমারকে যে পত্র লেখেন, তিনি এই প্রবন্ধে তা উদ্ধৃত করে দেন।''

অধ্যাপক আহম্মদ শরীফের প্রবন্ধ, চিঠি এবং প্রফেসর আবুল আহসান চৌধুরীর উত্তরসম্বলিত চিঠি থেকে কয়েকটি অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে। তার তালিকাটি এরকম—

১. জমিদার ঠাকুর-পরিবার প্রজানিপীড়ণে অভ্যস্থ ছিল।

২. জমিদার রবীন্দ্রনাথও প্রজানিপীড়ন করেছেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ  মুসলমান প্রজাদের নিপীড়ণ করেছেন। প্রজা-নির্যাতনের দলিলপত্র নষ্ট করে ফেলেছেন। ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন নিপীড়িতদের। খাজনা পরিশোধে অপারগ মুসলমান প্রজার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবার, এমনকি মুসলমান প্রজাদের শিক্ষা দেবার জন্য নমঃশূদ্র প্রজা এনে মুসলমানদের এলাকায় বসতি স্থাপনের সামপ্রদায়িক বুদ্ধিও রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন।

৩. প্রজাদের দুঃখ দুর্দশার চিত্র তিনি দেখলেও সেগুলি তার সাহিত্য রচনা করেন নি।  প্রজাহিতৈষী কোনো কাজই করেন নি।

৪. মুসলমান প্রজাদের কলাটা-মূলাটা-মাখনটা খেয়েছেন। কিন্তু তাদেরকে তাঁর সাহিত্যে স্থান দেন নি।

অভিযোগগুলি মারাত্মক। এই অভিযোগগুলি অনুসন্ধান করার চেষ্টা করা হবে এই খণ্ডে।

তাহলে প্রজানিপীড়নের ঘটনাটি অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে।

প্রজাবিদ্রোহ থেকে প্রজানিপীড়নের 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে  জমিদাররা সরকারের কাছ থেকে জমিদারীর পাট্টা নিয়ে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন। তারা সরকারকে নির্ধারিত হারে কর প্রদান করতেন। অবশিষ্ট অংশ তারা রেখে দিতেন। সে সময় অমৃত বাজার পত্রিকায় ১৮৬৮ সালের ২৩ জুলাই সংখ্যায় লেখা হয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দবস্তের ফলে জমিদারদিগের জমিদারি রক্ষণাবেক্ষণের যত্ন হয়, প্রজার উপর অত্যাচার কমিয়া যায় ও গবর্নমেন্টের আয় এক প্রকার নিশ্চিত হইয়া দাঁড়ায়। এ বন্দোবস্তটি ১৭৯৩ সালে শেষ হইয়া যায়। তাহার পরে কত গবর্নর আসিয়াছেন ও গিয়াছেন কত ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে কিন্তু এ বন্দবস্তটি যেমন তেমনি রহিয়া গিয়াছে। এরূপ বন্দবস্তে প্রজাদিগের ক্ষতি জমিদারদিগের লাভ।

অমৃতবাজার পত্রিকাটি কোলকাতা থেকে নয়– যশোরের একটি গ্রাম থেকে প্রকাশিত হত।  ১৮৬৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অমৃতবাজার পত্রিকায় সেকালের জমিদারী পরিস্থিতি নিয়ে লেখা হয়েছে—

ভূমির যত মূল্য বাড়িতেছে, জমিদারদিগের ধন সম্পত্তি তত বাড়িতেছে। …প্রজারা অন্নকষ্ট পাইতেছে, প্রজারা রোগে প্রপীড়িত, প্রজাদিগের বিদ্যাভাসের প্রয়োজন, এ সমূহের নিমিত্ত অর্থ দরকার…জমিদারগণ একটু মনোযোগ করিলে এ সমুদায় অভাব অনায়াশে পূরণ হইতে পারে।

অমৃতবাজার পত্রিকায় ঐ খবরটিতে বলা হয়েছে, অনেক জমিদার মদ্য, বেশ্যা, অনর্থক মকর্দ্দমা ও ঘৃণাস্কর বাবুগিরির নিমিত্ত বিপুল অর্থ ব্যয় করে থাকে।  যে অর্থ খাজনা আকারে প্রজাদের কাছ থেকে তারা আদায় করছে-তাতে জড়িয়ে রয়েছে করুণ ইতিহাস, তাতে প্রজাদের জীবনের অমঙ্গলই ডেকে আনছে, সেই অনর্থের মূল অর্থ জমিদারগণকে আমোদ বিলাসে প্রিয় করে তুলেছে। এমন কি বংশপরম্পরায় যে জমিদারী চলে আসছে, সেই জমিদারের বড় ছেলে যদিচ জমিদারী পরিচালনার কাজ গ্রহণ করে তো পরিবারের অন্য ছেলেরা কোন কাজ করেন না, বৃথা আমোদে সময় অতিবাহিত করেন।

অমৃতবাজারে লেখা হয়েছে, অদ্য ৭৬ বছরের কথা হইল, গবর্নমেন্ট দেখিলেন যে বৎসর বৎসর ক্রমেই রাজস্ব কমিতেছে, তখন নিরুপায় হইয়া জমিদারগণকে বললেন, 'তোমাদের বৎসর বৎসর এত টাকা দিতে হইবে, ইহাতে তোমরা কিছু লাভ করিতে পার সে তোমাদিগের, আমরা আর ইহার বেশী কখন লইব না। প্রজারা টাকা না দেয় মারো, ধরো, কাটো, আমাদের কিছু আপত্তি নাই, আমাদের টাকা পাইলেই হল। ইহাতেও না পারো, যাহাতে তোমাদের সুবিধা হয় এইরূপ সমুদয় আইন করিতেছি।…তখন গবর্নমেন্ট লাভ প্রত্যাশায় জমিদারগণকে প্রজাদিগের উপর লেলাইয়া দিলেন।

অমৃতবাজার পত্রিকায় ১৮৬৯ সালের ২৬ আগস্ট লিখেছে, জমিদারেরা প্রজার নিকট থেকে অনেক বেশী খাজানা লইয়া থাকেন। তাহারা যাহা গবর্নমেন্টকে দেন, অনেক স্থানে তাহারা প্রজার নিকট থেকে তাহার বিশ গুণ খাজানা লইয়া থাকেন। প্রজার যত লোকসান যায়, ইহা সমুদায় বাদ দিলে, ভুমির উৎপন্ন হইতে প্রজারা যাহা পায়, জমিদারেরা তাহার অর্দ্ধেক লইয়া থাকেন। মনু ছয় ভাগের এক ভাগ লইবার বিধি দেন। আকবার অতি কঠোর রূপে কর লইতেন, কিন্তু তবু তিন ভাগের একভাগ লইতেন।

তাহলে প্রজার সঙ্গে জমিদারের সম্পর্ক কর বা খাজনা আদায়ের। জমিদাররা এই খাজনা আদায়ের দায়িত্বটি পেয়েছেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বদৌলতে। ৭৬ বছর আগেকার করা  চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার সময় কয়েকটি বড় ধরনের অমীমাংসিত ঝামেলা ছিল।

১) জমিদাররা প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার দায়িত্বে ছিল। তবে তারা কী পরিমাণ খাজনা আদায় করতে পারবে—তা নির্দিষ্ট করা ছিল না।

২) খাজনা আদায়ের বেলায় কী ধরনের ক্ষমতা জমিদাররা প্রয়োগ করার অধিকারী  তা নির্দিষ্ট করা ছিল না।

৩)  কোন পরিস্থিতিতে একজন প্রজাকে জমিদাররা জমি থেকে উৎখাত করতে পারবে সে বিষয়েও কোনো নির্দেশনা ছিল না। শুধু বলা ছিল, তুমি জমিদার, তোমার জমিদারি এলাকার জন্য এই বছরে এই পরিমাণ খাজনা আদায় করে সরকারের কাছারিতে জমা দাও। না পারলে তোমাকে পত্রপাঠ বিদায় করা হবে। অর্থাৎ ইংরেজদের খাজনা পাওয়াটাই একমাত্র এবং প্রথম ও শেষ কথা। ‌যারা খাজনা দিতে পারবে না তাদের জন্য দৈহিক শাস্তি এ জেলখানার ব্যবস্থা ছিল। সুতরাং জমিদাররা এই সুযোগেরই সদব্যবহার করেছে।

১৭৯৩ সালে কোম্পানী এই কর্তৃত্বটা তুলে দেয়। জমিদাররা তখন অভিযোগ করে যে, এর ফলে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ক্ষমতা না থাআয় প্রজারা তাদের থোড়াই কেয়ার করছে। খাজনা দিচ্ছে না। ফলে খাজনা আদায় করতে প্রজাদের সঙ্গে তাদের রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে।

১৭৯৫ সালে কুখ্যাত Vii লেগুলেশন জারি করে। এই রেগুলেশনঅনুসারে কোর্টের আদেশ ছাড়াই কোনো জমিদার তার নিজস্ব ক্ষমতাবলে প্রজাদের উপর শারিরীক শক্তি প্রযোগ করার ক্ষমা রাখে। ১৮১২ সালের রেগুলেশন অনুসারে জমিদাররা প্রজাদের সম্পত্তি থেকে উৎখাত করারও ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ পেয়েছিল আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে। আইনটি এভাবেই ইংরেজরা দুর্বলভাবে তৈরি করে রেখেছিল।

এর মধ্যে আবার মধ্যসত্বাভোগী বা বরগা জমিদারী প্রথারও জন্ম হয়। এটা একটা নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে। খাজনা আদায়ের জন্য জমিদাররা তাদের জমি পত্তনীদার নামে একটি মধ্যসত্তাভোগীকে বর্গা দিয়ে কোলকাতায় আরাম আয়েশে জীবনযাপন করত। এই পত্তনীদাররা আবার আরেকটি দরপত্তনীদারদের কাছে বরগাপ্রাপ্ত জমি আবার বরগা দিয়ে দিত। ফলে খাজনা আদায়ের কাজটি প্রকৃত জমিদারদের হাত থেকে শাখা প্রশাখাবাহিনীর হাতে চলে যেত। দেখা যেত এই মধ্যসত্তাভোগীরা ঐ জমিদারেরই নায়েব গোমস্তা গ্রুপই।  এটা ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৮১৯ সালে এই মধ্যসত্তাভোগীদেরকে আইনগতভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় ইংরেজ সরকারদের পক্ষ থেকে। এদেরই নাম দেওয়া হয় পত্তনিদার।

তবে সত্তরের মন্বন্তরে ফলে এবং প্রজাশোষণের ফলেপালিয়ে যাওয়া প্রজার সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে বাংলায়। এবং আবাদী জমির পরিমাণও বেড়ে যায় জঙ্গল কেটে। ফলে খাজনা আদায়ের পরিমাণও বেড়ে যায়। তখন জমিদাররা আগের মতো আর নির্দয় ব্যবহার না করে অনেক সহিষ্ণু ববহার করে। এবং কৃষি উন্নয়নে তারা কিছু সহযোগিতাও করতে থাকে কৃষকদেরকে।

প্রজাবিদ্রোহের  ঘটনা

উনিশ শতকে জমিদারদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রজাবিদ্রোহ ঘটেছিল ১৮৭২ থেকে ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত। ঘটনাস্থল ছিল পাবনা-সিরাজগঞ্জ। সেকালে এর নাম ছিল ইউসুফশাহী পরগণা। বর্তমানে এ এলাকাটি বৃহত্তর পাবনার সিরাজগঞ্জ জেলাধীন। এই পরগণার কিছু অংশ দ্বারকানাথ ঠাকুর কিনেছিলেন নাটোর রাজ জমিদাররের নিকট থেকে। দাম মাত্র মাত্র ১৩ টাকা। ১৮৩০ সালে তিনি কালীগ্রাম পরগণা কিনলেন, ১৮৩৪ সালে সাহাজাদপুর। সে সময়ে অনেক ব্যবসায়ী ব্যক্তি নানা কায়দায় ধনসম্পদ অর্জন করেছিলেন। তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুযোগে ইস্টি ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছ থেকে জমিদারী কেনেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর উদ্দেশ্য ছিল রাজস্ব আদায়। সে জন্য জমিদারদের নির্দিষ্ট অঙ্কের একটি রাজস্ব ধার্য করে দিত। যারা এই পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে দিতে ব্যর্থ হত, তাদের জমিদারী নিলাম করে অন্য আরেকজনের কাছে বিক্রি হয়ে যেত। সুতরাং নব্য জমিদারগণ এই ধার্যকৃত রাজস্ব বা খাজনা আদায় করে নিজের জমিদারী রক্ষা এবং নিজেদের বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করার উদ্দেশ্যে নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করত।

১৮৫৮ সালে X রেগুলেশন অনুসারে জমিদাররা তিনটি কারণে খাজনা বাড়াতে পারত।

১) কাছাকাছি কোনো জমিদারি পরগণায় কোনো জমির খাজনা যদি বেশি হয়ে থাকে এবং ঐ ধরনের জমির খাজনা যদি অন্য জমিদারের পরগণায় কম হয়ে থাকে—তাহলে  ঐ জমিদারও সেই জমির খাজনা বাড়াতে পারেন।

২) যদি পন্যসামগ্রীর বাজারমুল্য বেড়ে যায়।

৩) যদি জমিদার মনে করে থাকেন যে, প্রজারা তাদের প্রকৃত জমির চেয়ে কম জমি দেখিয়ে খাজনা কম দিচ্ছে।

সেকালে  বাংলায় সেচ ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় প্রায়ই বন্যা হত। ফলে ফসল নষ্ট হত। কখনো নীরব কখনো সরব দুর্ভিক্ষ লেগেই থাকত। ইংরেজরা সেগুলো কখনোই বিবেচনায় নেয়নি। তারা জমিদারের উপর বার্ষিক নির্ধারণ করে দিত। আবার জমিদাররাও পত্তনীদারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে খাজনা আদায়ের ভার তাদের উপর ছেড়ে দিত। পত্তনীদাররাও এভাবে দরপত্তনিদারদের হাতে খাজনা আদায়ের কাজ দিত। প্রজাদের ফসলের বা আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনা করার কোনো সুযোগই তাদের ছিল না। পুরো পদ্ধতিটাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় চিনে জোঁকের মত রক্ত চোষা।  আর সুদখোর মহাজনদের কারণেও তারা সর্বশান্ত হচ্ছিল।

সূত্র.

উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্র : মুনতাসীর মামুন

রবিজীবনী : প্রশান্তকুমার পাল

ব্রাত্য লোকায়ত লালন : সুধীর চক্রবর্তী

জমিদার রবীন্দ্রনাথ : শিলাইদহ পর্ব : অমিতাভ চৌধুরী

সাক্ষাৎকার–প্রফেসর আবুল আহসান চৌধুরী : শাশ্বতিকী, রবীন্দ্রসংখ্যা. সম্পাদক : মোজাফ্ফর হোসেন

রবীন্দ্রমানস ও সাহিত্যে পূর্ববঙ্গের প্রভাব : গোলাম মুরশিদ

Pabna Peasant Uprising : Nurul Hossain Choudhury

রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন' : প্রফেসর আহম্মদ শরীফ

রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ : ফরহাদ মজহার

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : চতুর্বিংশ পর্ব

প্রজানিপীড়ণ খণ্ড  : দুই

১৮৬৯ সালের ১৬ নভেম্বর অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছে, দরিদ্র প্রজাদিগের সুসার সংগতি হওয়ার একটী প্রধান কণ্টক মহাজনেরা। অজ্ঞ, অবিবেচক, অপব্যয়ী ও দরিদ্র প্রজারা ধার পাইলে আর শুদের দিকে তাকায় না। মহাজনেরা তাহাই বুঝিয়া ইচ্ছামত শুদ নিরূপণ করে। এ বৎসরের টাকা আগত বৎসরে যদি না দিতে পারে, তবে মহাজনরা সমুদায় টাকার আর একখানা খত লয়। এক্ষণে শুদের শুদ চলিল। এইরূপে তার ধার পুত্রের পরিশোধ ও পিতার টাকা পুত্রে আদায় করে।

১৮৬৯ সালের ১ জুলাই অমৃতবাজারে লেখা হয়েছে,  মহাজনরা যেরূপ অর্থগৃধ্নু ও কঠিন হৃদয়, তা প্রসিদ্ধই আছে। কৃষক মাত্রেরই প্রায় প্রতি বৎসর মহাজনের আশ্রয় লইতে হয়, কারণ তাহাদের কাহারও মূলধন নাই। যে একবার মহাজনের নিকট ঋণে আবদ্ধ হইয়াছে, সে আর তাহা পুরুষ পুরুষানুক্রমেও শোধ দিতে পারে না। শুদে শুদ, তার শুদ এইরূপে অনন্তকাল পর্যন্ত শুদ চলিতে থাকে। কর্জ্জ কখনো কখনো টাকা পাওয়া যায়, কখনো কখনো শস্যে পাওয়া যায়। টাকা লওয়া হইলে সুদের স্থিরতা নাই। কৃষকের গরজ বুঝিয়া কেহ এক আনা কেহ দুই আনা, কেহ চারি আনা পর্যন্ত সুদ লইয়া থাকেন। ধান্য কি অন্য শস্য দ্বারা যে কর্জ্জ দেওয়া হয়, তাহাকে বাড়ী বলে। কৃষকের ঘরের ধান ফুরাইলে মহাজনের নিকট হইতে ধান লয় এবং নূতন ধান হইলে উহা প্রত্যার্পন করে। মহাজনেরা সুদের স্বরূপ যত খুচি ধান দেন, তাহার দেড়া এবং কখনও দুন লইয়া থাকেন। যদি খাতক ধান দিতে না পারে তবে উহার মূল্য স্থির করিয়া যত টাকা হয়, তত টাকার খত লিখিয়া লন। কৃষকের মহাজনের টাকা শোধ করিবার একমাত্র উপায় শস্য বিক্রয় করিয়া।

যেবার দৈবদুর্য্যোগে শস্য না জন্মে, সেবার কৃষকের দুরাবস্থার আর শেষ থাকে না। এদিকে জমিদারের উদর পূর্ণ করিতে হইবে, ওদিকে মহাজনকে ঠাণ্ডা করিতে হইবে, আবার নিজের উদর পূর্ণ করিতে হইবে, এই হতভাগাদিগের পরিবার কম নয়। এতদ্ভিন্ন আরো খরচ আছে। নাপিতকে বার্ষিক দিতে হইবে, ধোপা, কামার, ছুতোর ইহাদের সকলকেই কিছু কিছু করিয়া দিতে হইবে। এইরূপে কৃষকগণের ব্যয় আয় অপেক্ষা ঢের বেশী হইয়া পড়ে। সাধারণতঃ কৃষকদিগের গরুই সর্ব্বাপেক্ষা মূল্যবান বস্তু। মহাজন, যখন দেখিলেন, অন্য উপায়ে কর্জ্জের টাকা আদায় হইল না, তখন ঐ গরু বিক্রয় করিয়া লন, কিন্তু দুর্ভাগা কৃষকের যে কি অবস্থা হইল, তাহার প্রতি একবার দৃকপাতও করেন না।

১৮৬৯ সালের ২৬ অক্টোবর অমৃত বাজার পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়–সেকালে বাংলায় শতকরা ৯০—৯৪ ভাগই জমিতেই ধান চাষ হত। এর মধ্যে বিল জলি ধানই প্রধান। ফাল্গুন মাসে ধানের বীজ বুনে দেওয়া হত। আর পাকত আষাঢ় মাসে। এটা আউশ ধান। আমন কাটা হত হেমন্তে। ভরা বর্ষায় এই ধানের বাড়বাড়তি। অমৃত বাজার লিখেছে, ইহাতে অপর্যাপ্ত ধান্য জন্মে ও এরূপ জমিতে দৈবাৎ দুই এক বছর ব্যতীত আর কোনো ফসল হয় না। কিছু কিছু বোরো ধানও চাষ হত। বোরো ধান শীতকালের ধান। এই সব জমিতে আউশ বা আমন হত না। এটা সাধারণ জোয়ারের জলের উপর নির্ভর করে চাষ হত। সেকালে কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থা ছিল না। বৃষ্টি বা বর্ষার জলের উপর নির্ভর করে চাষ হত। যদি কখনো বপনের আগে বৃষ্টি না হত বা জো না আসত বা বপনের পরপরই তীব্র বৃষ্টি হত তাহলে চারা ধান নষ্ট হয়ে যেত। আবার শীষ বের হওয়ার সময় বৃষ্টিপাত না হলে ধান চিটা হয়ে যেত।

অমৃতবাজার লিখেছিল, অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশে কৃষি কার্য্যের সুপ্রণালী নাই। কূপ কি খাল হইতে জল উঠাইয়া ভূমি সাঞ্চন করার রীতি আমাদের নাই। ভূমি হইতে বাহির করিয়া দিবার উপায়ও আমাদের চাষারা জানে না। সুতরাং দৈবের উপর তাহাদের সম্পূর্ণ নির্ভর করিতে হয়। যদি অধিক বৃষ্টি হইল, শষ্য ডুবিয়া গেল, অনাবৃষ্টি হইলে ফসল পুড়িয়া গেল। এক্ষণে প্রায় প্রতি বছরই এই রূপ ঘটিতেছে। ইহাতে শুদ্ধ চাষা নয়, দেশীয় সমস্ত লোকদিগের অবস্থা দিন ২ কষ্টজনক হইয়া উঠিতেছে। আবার আজ কয়েক বৎসর এদেশে সংক্রামক জ্বর প্রভৃতি পীড়া প্রবেশ করিয়া অনেকগুলো চাসাকে একেবারে অকর্ম্মণ্য করিয়া ফেলিয়াছে, বিস্তর লোক প্রাণও হারাইয়াছে। ইহাতে কৃষি কার্য্যের অনেক ব্যাঘাত হইয়াছে। মাঝে ২ প্রবল ঝটিকা হওয়াতে ইহাদের দুর্দশার আর একটি কারণ বাড়িয়াছে। চাসারা দিন আনে, দিন খায়। নিয়মিত খরচের উপর এক টাকা ব্যয় হইলে তাহার এক বৎসরের মধ্যে তাহা পরিশোধ করিয়া উঠিতে পারে না। একখানি যৎসামান্য কুটির প্রস্তুত করিতে হইলেও অন্যূন  দশটি টাকার কম খরচ হয় না।

অমৃতবাজারের এই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৯ সালে ১ জুলাই। তখন বর্ষাকাল। নিবন্ধটিতে লেখা হয়েছে, এই পাঁচ বছরের মধ্যে পর পর কয়েকটি ঝড় কর্তৃক তাহারা গৃহশূন্য হইল। কে জানে পুনঃ পুনঃ গৃহ সংস্কার করিতে গিয়া কতজন চিরঋণ পাশে আবদ্ধ হইল।

ঐ নিবন্ধে লেখা হয়েছে, আমাদের কৃসকের ন্যায় ঘোর পরিশ্রমী জাতি পৃথিবীর মধ্যে দৃষ্ট হইবে না, আবার ইহাদের দৈন্যও বুঝি জগতে নাই। (সকালে) উঠিয়া দেখ কৃষক ভূমি কর্ষণ করিতে আরম্ভ করিয়াছে, দুই প্রহরের সময় যাইয়া দেখ ভূমি কর্ষণ করিতেছে, সন্ধ্যার সময় যাইয়া দেখ ভূমি কর্ষণ করিতেছে—তাহার আহার বিহার বিশ্রাম সকলেই ঐ মাঠের ভিতর। বৎসরের অধিকাংশই ইহারা এই রূপে অতিবাহিত করে। কি গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড রৌদ্র কি বর্ষাকালে মুসলধার বৃষ্টি কি শীতকালের তীক্ষ্ণ শীতল বায়ূ, সকল অবস্থায় ইহারা ক্ষেত্রের কার্য্যে প্রবর্ত্ত রহিয়াছে।

কৃষক মাত্রেই প্রায় অন্ন ও বস্ত্রহীন, গৃহহীন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। অধিকাংশেরই পর্ণ কুটিরে বাস করিতে হয়, সকলের ঘরে আবার আবশ্যকীয় খড়ও নাই। পরিধেয় বস্ত্র একখানি ভিন্ন দুখানি কাহার ভাগ্যে জুটিয়া ওঠে না। প্রায় কৃষক মাত্রের অর্দ্বশনে কি অনশনে দিন পাত করিতে হয়, অধিক কি ভোজনপাত্র ও জলপাত্র পর্যন্ত নাই। এই হৃদয়বিদারক অবস্থায় ১২ ঘণ্টা পর্য্যন্ত ভুতানন্দী পরিশ্রম! আমাদের শুনিলে আতঙ্ক হয়, কিন্তু এই হতভাগাদের প্রতিদিন এইরূপে কাটাইতে হয়।

চাষের জন্য গরুগুলো ছিল হাড় জিরজিরে। অমৃত বাজার পত্রিকা জানাচ্ছে, বসন্ত রোগে গোরুর সংখ্যা ক্রমেই কমিতেছে। আবার অবশিষ্ট যাহা রহিতেছে, তাহারা নিতান্ত দুর্বল। গোরুর দুর্বলতার একটা কারণ অনাহার, ঘাসের চাস আমাদের দেশে নাই। আর ছিল ফসলের ক্ষেতে গোছাগাদির উৎপাত। এই নিমিত্ত বৎসর বৎসর কতক্ষতি হয়, তাহা বলিয়া উঠা যায় না। বোধহয় যত শস্য মনুষ্যে আহার করে, গো ছাগাদিতে তত নষ্ট করে।

ফসলের রোগপোকার আক্রমণ হলে তেমন কোনো ব্যবস্থাপনা নেওয়ার সুযোগ ছিল না। ১৮১৮ সালে ভারতে ধানের ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ ঘটেছিল বলে জানা যায়। এ রোগ তখন বাংলায়ও আক্রমণ করেছিল। ব্লাস্ট ছত্রাকঘটিত রোগ। এই ছত্রাক জীবাণু ধান গাছের যে কোন অবস্থায় আক্রমণ করতে পারে। এ রোগে প্রথমে পত্র ফলকে অতি ছোট ডিম্বাকৃতি দাগ পড়ে। এ দাগের মাঝামাঝি অংশ প্রশস্ত হয় এবং দু'প্রান্ত সরু থাকে যাতে দাগটাকে মনে হয় অনেকটা চোখের মত। বড় দাগগুলোর (০-১.৫  ০.৩-০.৫ সেন্টিমিটার) কেন্দ্র ভাগ ধূসর বর্ণের হয়। আক্রমণ প্রবণ ধানের পাতা মরে যেতে পারে। এ রোগে সে বছর কোথাও কোথাও ২০ ভাগ, কোথাও কোথাও ৮০ ভাগ ধান ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

ধানের আরেকটি মারাত্মক রোগ ব্লাস্ট। ধানগাছে ব্লাস্ট রোগ কান্ডের গিঁটেও আক্রমণ করতে পারে। গিঁট পঁচে গিয়ে কালচে হয় এবং সহজেই ভেঙ্গে যায়।ছড়া বা শিষের গোড়া আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত অংশ কালচে হয়ে ভেঙ্গে যেতে পারে যাকে শীষ ব্লাস্ট বলে।  বাতাসের আর্দ্রতা এ রোগের প্রকোপ বাড়ায়। এ ছাড়া রাতে ঠাণ্ডা, দিনে গরম ও সকালে শিশির পড়া এ রোগের প্রকোপ বাড়ায়। মাঠে এ রোগের আক্রমণ ব্যাপক হলে পুড়ে বসে যাওয়ার মত হয়।

খোলাপোড়া রোগে প্রাথমিক অবস্থায় পানির উপরিভাগে খোলের উপর পানি ভেজা হালকা সবুজ রঙের দাগ পড়ে। ডিম্বাকৃতি বা বর্তুলাকার এ সব দাগ প্রায় ১ সেন্টিমিটার লম্বা হয় এবং বড় হয়ে দাগগুলো ২-৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হতে পারে। কয়েকটি দাগ পরে একত্রে মিশে যায়। প্রত্যেকটি দাগের সীমারেখা এবং রঙের বৈচিত্র্য একটা আক্রান্ত এলাকার বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তোলে। তখন আক্রান্ত খোলটার উপর ছোপ ছোপ দাগ মনে হয়। অনুকুল এবং আর্দ্র পরিবেশে আক্রান্ত কাণ্ডের নিকটবর্তী পাতাগুলোও আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণতঃ ফুল হওয়া থেকে ধান পাকা পর্যন্ত রোগের লক্ষণ স্পষ্ট দেখা যায়। আক্রান্ত জমি মাঝে মাঝে পুড়ে বসে যাওয়ার মত মনে হয় । রোগের প্রকোপ বেশি হলে ধান চিটা হয়ে যায়।

ধানে কৃমিজনিত রোগ উফরা রোগের আক্রমণ বাংলায় সবসময়ই কম বেশি ছিল।  এখানে বিশেষ করে জলী আমন ধানে এ রোগের আক্রমণ হয়েছে বেশি। পানি ও মাটি দ্বারা পরিবাহিত এ কৃমি গাছের উপরের অংশ আক্রমণ করে। এ কৃমি ধান গাছের পাতায় কচি অংশের রস শুষে খায়, ফলে প্রথমত পাতার গোড়ায় সাদা ছিটা-ফোটা দাগের মত দেখায়। সাদা দাগ ক্রমে বাদামী রঙের হয় এবং পরে এ দাগ বেড়ে সম্পূর্ণ পাতাটাই শুকিয়ে ফেলে।  অধিকাংশ ছড়াই মোচড় খেয়ে যায় ও ধান চিটা হয়। কোন কোন ছড়া মোটেই বের হয় না। এ রোগের জীবাণু জল স্রোতের সাথে এক জমি থেকে অন্য জমিতে যায়।

ধানের ভাইরাস জনিত রোগ টুংরো রোগের আক্রমণেও নানা সময়ে ফসল বিপর্যস্ত হয়েছে। সমস্যা হল ফসলে রোগ বিষয়ে তখন কৃষকদের তেমন কোনো ধারণাই ছিল না। এবং রোগ দমনে কি ধরনের ব্যবস্থানা নিতে হবে সে বিষয়টিও ছিল অজানা। ইংলন্ডে সে সময এগ্রিকালচার বোর্ড ছিল—ভারতে কিছুই ছিল না। কৃষিগবেষণা গড়ে ওঠে নি। ফসলের রোগ বিষয়ে কারো সম্যক ধারণা না থাকায় সে বিষয়ে তথ্যও তেমন পাওয়া যায় না সে সময়কার পত্র-পত্রিকায় বা লেখালেখিতে।

পোকামাকড় সম্পর্কে কৃষকদের ধারণা মোটামুটি ছিল। ধানের মাজরা পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা, বাদামী গাছ ফড়িংয়ের আক্রমণে অনেক ফসল নষ্ট হত। তখন পোকামাকড় দমনের জন্য কোনো কীটনাশক ছিল। যখন তীব্রভাবে শিষকাটা লেদা পোকা ধানের সদ্য বের হওয়া শীষগুলো কেটে ফেলত বা মাজরা পোকা শিষের গোড়াটি কেটে দিত অথবা মাজরা পোকার আক্রমণে ধান চিটা হয়ে যেত তখন কৃষকগণ অসহায় হয়ে পড়ত। সরকারী বা বেসরকারী কোনো উদ্যোগই নেওয়া হত না। এর সঙ্গে ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যা ছিল নিত্য বছরের সঙ্গী। মাঝে মাঝে খরায় অজন্মা হত।  ফলে দেশে অবধারিতভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত।

অমৃত বাজার পত্রিকার ১৮৭০ সালের ২৮ জুলাই তারিখের রিপোর্টে জানা যায়, পূর্ব্বে কৃষকেরা জমি ৪/৫ বছর পতিত রাখিয়া তাহা আবাদ করিত সুতরাং শস্য প্রচুর হইত কিন্তু এক্ষণ দেশের জনসংখ্যা ও কৃষিকার্য্যের বৃদ্ধির দ্বারা ভূমি আর পতিত থাকে না সুতরাং ভূমির উৎপন্ন ক্রমে হ্রাস পাইতেছে। ভুমি ক্রমাগত কর্ষণ করিলে উহার উর্ব্বরা শক্তি ক্রমে লোপ পায়। এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ কথা, সুতরাং যে ভূমিতে ৫০ বছর পূর্বে ৫ মন ধান্য উৎপন্ন হইত তাহাতে এখন সম্ভবতঃ এক মনও উৎপন্ন হয় না।

ধান ছাড়া অবশিষ্ট জমিতে আখ, পাট, তামাক,কিছু গম,সরিষা, তিল, তিসি, মুগ, মুসুর, খেসারী, সবজি, আলু, পিয়াজ, রসুন, আদা হলুদ, রসুন, মরিচের আবাদ হত। তবে এইসব ফসলেরর আওতায় জমির পরিমাণ ছিল কম।

অমৃত বাজার পত্রিকা একটি নিবন্ধে ১৮৭০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এদেশের কৃষকদের অবস্থা সম্পর্কে লিখেছে, ইহারা (কৃষক) মদ্য পান করে না, ইহারা মাংসাশী নহে, ইহাদের পরণ পরিচ্ছেদের ব্যয় একরূপ নাই বলিলেও হয়, উহাদের আমোদ তা হল দেব মধ্যে জারির গীত, আবার কৃষিকার্য়্যের নিমিত্ত অতি সামান্য ব্যয় পড়ে, ইহাতে বহু মুল্যবান বলিবদ্ধের প্রয়োজন করে না, অনেক ভূমিতে জল সিঞ্চন কি সারের প্রয়োজন করে না, ভূমি স্বাভাবিক উর্ব্বরা বলিয়া অল্প পরিশ্রমে অল্প কর্ষণে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হয়, অথচ এমন দীন দুঃখী প্রজা পৃথিবীর কোথাও নাই। ইংলন্ডে যাহার ১০/১৫ বিঘা ভূমির আবাদ আছে। সে একজন 'গৃহস্থ', এবং এদেশে চাষা মাত্রেরই এরূপ আবাদ আছে, অথচ ইহারা বৎসর মাস এক সন্ধ্যা আহার কি উপবাস করে।

পঞ্চবিংশ পর্ব

প্রজানিপীড়ণ খণ্ড  : তিন

১৮৬৮ সালের অমৃত বাজার পত্রিকা থেকে সে সময়ের পুলিশি ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু চিত্র পাওয়া যায়। সে সময়ে পূর্ব বঙ্গে প্রতিটি জেলায় গড়ে ৮০০-১০০০ জন পুলিশ নিযুক্ত ছিল। মফস্বলে পুলিশের দুর্দান্ত প্রতাপ—তা মফস্বলবাসীরা বিলক্ষণ জানেন। রিপোর্টে লেখা হয়েছে, একজন কনস্টাবল গ্রামকে গ্রাম অস্থির করিয়া তুলিয়াছে। এরূপে তাহারা কত স্থানে কত সময়ে তাদের পোষাক পরিয়া প্রজার নিকট হইতে বলপূর্বক অর্থ লয়, তাহার সংখা হিসাব করিয়া ওঠা যায় না। এরূপ অত্যাচার করিলে তাহাদের ধরিবার সম্ভাবনাও নাই। পালে মিশিয়া গেলে আর চিনিবার উপায় নাই। রিপোর্টটিতে পুলিশ কর্তৃক ডাকাতি করার  ঘটনার উল্লেখ আছে।

এই রিপোর্টটি প্রকাশের ছয়মাস পরে ১৮৮৯ সালের ২৫ মার্চ পত্রিকাটি লিখেছে, বৎসর বৎসর পুলিশ ধনাগার হইতে অল্প টাকা শোষণ করিতেছে না।…পুলিশের সম্মুখে চুরি হইতেছে., ঘটনাস্থলে চোর ধৃত হওয়া দূরে থাকুক, ৫ বৎসর দিনরাত্রি পরিশ্রম করিয়াও তাহার কিছু অনুসন্ধান হয় না। পুলিশের উর্দ্ধতন কর্তা চোর ধরিতে না পারিয়া উল্টো অভিযোগ করিয়াছে—আদৌ চুরি হইতেছে না, লোখে মিছামিছি চুরির এজাহার দিতেছে।

…অত্যাচার করিয়া করিয়া পুলিশ লোকের নিকট এরূপ ঘৃণা ও আশঙ্কার পাত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, ইচ্ছাপূর্বক কেহ উহাকে দোষানুসন্ধানে সাহায্য করে না।

আবার পুলিশ পর্যন্ত যাইয়া যদি তাহারা অব্যাহতি পায়, তবু একষ্ট অনেকে লইতে পারে। কিন্তু তাহার পর আবার সাক্ষী শ্রেণীভুক্ত হইয়া মাজিস্ট্রেট, হয়ত দাওরা পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। একে হলপ পড়িয়া সাক্ষ্য দেওয়া এদেশীয়দের সংস্কার বিরুদ্ধ তাহাতে আবার হাকিমের বিশেষত সিবিলিয়ান সাহেবেরা, তাহাদের প্রতি অভদ্র ব্যবহার করেন, তাহাতে নিতান্ত বাধ্য না হইলে আর কেহ সাক্ষ্য দিতে সম্মত হয়েন না।…অনেক সময় আবার অনেক সিবিলিয়ান মনপুত কথা না বলিলে সাক্ষীদিগকে হাজতে পাঠান। না বুঝিতে পারিয়া সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ভুল কহিয়া ফেলিলে তাহাদিগকে কঠিন পরিশ্রমের সহিত ফাটক ভোগ করিতে হয়।

পুলিশ ছাড়াও চৌকিদারী প্রথা গ্রামে বলবৎ ছিল বঙ্গদেশে। আঠার শতকে শুরুর দিকে বিখ্যাত ডাকাতরা গ্রামে চৌকিদারীর কাজ করত। তারা গ্রামে চুরি-ডাকাতির থেকে লোক্জনের সম্পত্তি রক্ষা করত। এক একজন ডাকাত দুইশত গ্রামের চৌকিদারী করার ভার নিত। তার অনুগত বাহিনীর সদস্যদেরকে বিভিন্ন গ্রামের দায়িত্বে  দিত। এটা সত্ত্বেও কোনো গ্রামে যদি চুরি হত, তাহলে তারা চোর ধরত। চোর ধরতে না পারলে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিকে তারা ক্ষতিপূরণ প্রদান করত। এইজন্য ডাকাতদেরকে গ্রামবাসীরা উপযুক্ত কর দিত। প্রতি ডাকাত সর্দারদের অধীনে ৪০০-৫০০ ডাকাত সদস্য কাজ করত। তারা কখনো এই ব্যবসাটি গোপন করত না। সবাই তাদেরকে ডাকাত এবং চৌকিদার হিসাবে চিনতে। তারা নিজেরা তাদের এক্তিয়ার বহির্ভুক্ত এলাকায় কখনোই ডাকাতি করত না। অন্য এলাকায় করত।

বৃটিশ এসে এই ডাকাতদের অনেককেই আটক করেছিল। এদের কারো কারো প্রাণদণ্ড হয়েছিল—কারো যাবজ্জীবন হয়েছিল। একারণে ডাকাত দল আকারে ছোটো হয়ে গিয়েছিল। আগে যেখানে দুই-তিনশত গ্রামের দায়িত্ব নিত একজন ডাকাত সর্দর তার বড় ডাকাত বাহিনী থাকার কারণে, কিন্তু দলটির আকার ছোট হয়ে যাওয়ার কারণে এবং প্রকাশ্যে চলাফেরার অসুবিধার কারণে তারা একটি বা দুটি গ্রামের দায়িত্ব নেওয়ার মত সাহস করত। তারা রাতে পাহারা দিত। যদি এরপরও চুরি হত—তাহলে চোরের খোঁজ খবর করে দিত। এভাবে গ্রামের লোকজন এইসব ডাকাতদের উপর সন্তুষ্ট ছিল। তাদের উপর নির্ভর করা যেত। তাদের কাজটাই ছিল প্রজাদের জন্য কাজ করা করা। সরকার নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যাথা ছিল না।   বৃটিশদের তৎপরতার কারণে ডাকাতদের এই বিকল্পটি পেশাটি নষ্ট হয়ে যায় এবং তারা দুর্বল হয়ে পড়ায় আবার ডাকাতি-চুরি-ছ্যাচড়ামীর মত পেশায় জড়িয়ে পড়ে গোপনে গোপনে।

নির্ভরযোগ্য স্থানিয় প্রজাব্যবস্থাপনার চৌকিদারী ব্যবস্থা ধ্বংস করে বৃটিশরা গ্রামে গ্রামে চৌকিদারী প্রথা সৃষ্টি করছে। কোনো কোনো এলাকায় কোনো দুষ্কর্ম সংঘটিত হলে সরকারকে জানানোই হল চৌকিদারের মূল দায়িত্ব। ১৮৬৫ সালে সরকার থেকে একটি সার্কুলার জারি করে চৌকিদারদের কাজ সম্পর্কে জানানো হয়—চৌকিদাররা নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে সরকারকে খবর জানাবে–

১. যদি ডাকাতরা জোটবদ্ধ হয়।

২. গ্রামে চোরে থলিদার থাকে।

৩. ডাকাতি,খুন, ঘর জ্বালানি, চুরি প্রভৃতি হয়।

৪. যদি সহমরণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে– জমিদারের তদন্তে সংবাদকে খবর দেওয়াই হল চৌকিদারদের কাজ।

এ ছাড়া আরও কিছু নিত্য নৈমিত্তিক দায়িত্ব ছিল চৌকিদারদের—

১. থানায় কয়েকদিন পর পর হাজিরা দেওয়া।

২. ডাকাতি, চুরি, খুন করতে উদ্যত ব্যক্তিকে ও ফেরারী গ্রেফতারে সাহায্য করা।

৩. ডাকাতসহ যে কোনো বদমাস গ্রামে প্রবেশ অনুপ্রবেশ করলে সরকারকে জানানো।

৪. গ্রামে খুন, ডাকাতি, চুরি, দাঙ্গা ইত্যাদি হলে সরকারকে অবহিত করা।

চৌকিদাররা প্রজাদের  কোনো কাজ করে না—তারা সরকারের কাজ করে। অথচ তাদেরকে বেতন দেয় প্রজা। অমৃতবাজার পত্রিকায় অভিযোগ করে বলা হয়—চৌকিদার পুলিশের ভৃত্য—প্রজাসাধারণের নয়। পুলিশ যা যা বলে তারা তাই তাই করে। পুলিশ যখন গ্রামে প্রবেশ করে—তখন চৌকিদার-পুলিশকে দেখে মনে হয় শৃগাল যেমন ব্যাঘ্রের পাছে পাছে থাকে সেই রকম চৌকিদাররাও পুলিশের সঙ্গে থেকে প্রজাদের নানা কায়দায় দোহন করে থাকে। প্রজাদের কাছ থেকে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে—বা ফাটকে পুরে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পুলিশ টাকা পয়সা আদায় করে, সে কাজে চৌকিদাররা পুলিশদের সহযোগিতা করে সেই ঘুষের টাকার একটা ভাগ পায়। পুলিশকে সন্তুষ্ট রাখাই চৌকিদারের কাজ। তারা গ্রামে পাহারা দেয় না।

১৮৬৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল—বাঙ্গালার জেলে আর কয়েদী ধরে না। কয়েদীর সংখ্যা ক্রমে বাড়িতেছে। কিন্তু অপরাধের সংখ্যা কমিতেছে না। চোরের এবার বড় প্রাদুর্ভাব। এই রিপোর্ট থেকে আরও জানা যাচ্ছে, ডাকাতি কমেছে। তার কারণ অন্য। অমৃতবাজার এরপর ছোট্ট একটা প্রশ্ন করেছে—দণ্ড দ্বারা কোন্ অপরাধ কমিতেছে, তাহা আমরা জানিতে ইচ্ছা করি। ইংরেজ শাসনের ল এন্ড অর্ডার, আমলা, মাজিস্ট্রেট, পুলিশ এবং চৌকিদারী  বঙ্গদেশের অপরাধ কমাতে পারে নি। আগে ছিল দেশীয়য় শোষক—এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, শুধু বড় নয়,  বিদেশী বৃহৎ শোষক।

তখন আমলারা বেতন অল্প বেতন পেত। নিয়মিত ঘুষ নেওয়াটাই ছিল তাদের অন্যতম দ্বায়িত্ব। একজনকে জেলে আটকালে –তার জায়গায় পদায়নপ্রাপ্ত অন্য আমলা এসে আরও ঘুষ নেয়। ফাঁসি দিয়েও ব্যাভিচার কমছে না—খুন থামছে না। দুষ্ট লোকের জন্য আমলারা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে দিতে সদাসর্বদা প্রস্তুত। পয়সা দিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের ধার না ধারে আমলারা যে কোনো কাজই করে দিচ্ছে। এ সবই ছিল জমিদার,ব্যবসায়ী, প্রতারক ধনীদের জন্য আদর্শ শাসনকাঠামো।

১৮৬৯ সালে ১০ জুন অমৃত বাজার পত্রিকা লিখেছে, হাকিম, মুন্সেফ, ডেপুটি কালেক্টররা অসাধু আচরণে অভ্যস্থ। সবর্ত্র ঘুষের কারবার। দেশী কর্মচারীরা নেয় একশত টাকা ঘুষ—বিদেশী কর্মচারীরা চারশত টাকার নিচে খুশী নয়।

কতকগুলি জমিদারের পুরনাখাতা অনুসন্ধান করিলে দেখা যাইবে, দশ হাজার, বিশ হাজার, মাজিস্ট্রেট কি জজের কিত্রিম নাম দিয়া বকশিস বলিয়া লেখা আছে। অধিক দিনের কথা নয়, প্রায়. দশ বৎসর হইল একজন সিবিলিয়ান জজ এক লক্ষ টাকা পাইয়া গুরুতর মকদ্দমার ন্যায় বিক্রি করেন। তিনি এখন উচ্চ বিচারপতি।

অমৃতবাজারের অই রিপোর্টটিতে ফরেস্টারদের দূর্নীতিরও তথ্য আছে। অভিযোগ করেছে, টাকা পেলে ইউরোপীয় ডাক্তার মিথ্যা সার্টিফিকেট প্রদান করে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখা হয়েছে ১৮৬৯ সালের ১ জুলাই সংখ্যার অমৃতবাজারে, আট দশ বৎসর যাবৎ বঙ্গদেশ সংক্রামক জ্বরের আক্রমণে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। এক গ্রাম সুস্থ হলেও অন্য গ্রামের মানুসজন অসুস্থ হয়ে ধুকছে। এইরূপ মেলেরিয়া বঙ্গদেশের প্রায় সর্বত্রই বিচরণ করছে। পল্লীগ্রামেই এই রোগের বিশেষ প্রাদুর্ভাব। শহারাঞ্চলে কম। কারণ শহরের সাহেবদের দৃষ্টি রয়েছে। সেখানে নেটিভরা নয়—সাহেবরাও বাস করে।

পল্লীগ্রামের পথঘাট পুকুর অপরিস্কার। এগুলো নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। আগে লোকজন ধর্ম্মবুদ্ধিতে পথঘাট পরিস্কার রাখতেন। নূতন পুকুর খনন করতেন। পুরনো পুকুর সংস্কার হত। বর্তমানে পুকুর জলাশয়ের জল নির্মল নয়। পানের অযোগ্য—দুর্গন্ধযুক্ত। জীবানুদুষ্ট। বর্ষাকালে ঐ সব পুকুর ডোবার জল উপচে পড়ে। রাস্তাঘাট ডুবে যায়–প্যাক কাদায় চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে।

পুকুরের পাড় গ্রামের লোকজনের বিষ্টাত্যাগের স্থান। মলিন আবর্জনা, পচাঘাস, লতা, পাতা, ঝাড়, জঙ্গল পথঘাট-জলাশয় পূর্ণ। মশা-মাছি ঘিন ঘিন করে। সবকিছুই অস্বাস্থ্য কর। বর্ষাকাল পল্লীগ্রাম বসবাসের উপযুক্ত নয়। বর্ষার শেষে পীড়ার উৎপত্তি এবং শীত ঋতুর শেষ পর্যন্ত এই রোগ প্রবল  হয়ে থাকে। গ্রামে কোনো মিউনিসিপালিটি না থাকায় এইসব জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি দেখার কেউ নেই। উপার্জনের ন্যূনতা হেতু সেখানে ডাক্তার গমন করেন না। অনেক অসমাপ্ত কম্পাউন্ডার বা অসমাপ্ত পাথ অর্থাৎ দুই এক বৎসর বা দুই এক মাস মেডিকেল কলেজে হাজিরা দিয়েছেন এমন ব্যক্তিরা পল্লীগ্রামের চিকিৎসা করেন। ফলে প্রকৃত চিকিৎসা সুবিধা থেকে পল্লীবাসীরা আঞ্চিত।

এর মধ্যে চলছে ইংরেজ শাসন এবং জমিদারের খাজনা আদায়ের কাছারি। এই সময়ের এইসব পল্লীচিত্র পাওয়া যাচ্ছে তৎকালীন সংবাদপত্রের পাতায়। ইংরেজরা খাজনা দাবী করত জমিদারদের কাছে—জমিদাররা প্রজাদের ঘাড়ে ধরে অস্থিমজ্জাসহ আদায় করে ছাড়ত। দেখা যেত প্রজার শরীরের শীর্ণ হচ্ছে—খাজনা বাড়ছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে প্রবলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক।

এইরকম পরিস্থিতির মধ্যে ১৮৭১ সালের দিকে পাবনা সিরাজগঞ্জ এলাকার জমিদাররা খাজনা বেআইনীভাবে বাড়িয়ে দিলে প্রজারা খাজনা দেওয়া বন্ধ করেছিল। খাজনা জমা দিচ্ছিল কোর্টের কাছে। তারা দাবী করেছিল, জমিদাররা বেআইনীভাবে জমির খাজনা বাড়িয়েছে। জমিদার পক্ষ ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে কোর্টের কাছে বলে যে, তারা (জমিদাররা) মোটেই খাজনা বাড়ায়নি। যে হারে এ বছর প্রজাদের কাছে খাজনা দাবী করেছে গত ১০ বছর ধরে এই হারেই খাজনা আদায় করে আসছে।   ১৮৭২ সালের এপ্রিল মাসে শাহাজাদপুরের মুন্সেফ জমিদারদের পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু ডিসেম্বর  মাসে রাজশাহীর সিবিল কোর্ট প্রজাদেরদের পক্ষে রায় দেয়। কোর্ট বিশ্বাস করে যে প্রজাদের অভিযোগ সত্য—জমিদারদের খাজনাসংক্রান্ত কাগজপত্র ভুয়া। এভাবে জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রজাদের একটা নৈতিক জয় ঘটে।

আরেকটি ঘটনাও ঘটেছিল পাবনা সিরাজগঞ্জ এলাকায় এই সময়। এ এলাকায় পাট একটি অর্থকরী ফসল হিসাবে চাষ হতে থাকে। পাটের দরও ভালো পাওয়া যাওয়া শুরু করেছিল। এর ফলে পাটের ব্যবসার মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে একটি গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। এরা খাজনা আদায়কারী জমিদারদের বিরুদ্ধে একটি পাল্টা শক্তি হিসাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ১৮৭৩ সালে পাটের বাজার দর হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ায় কৃষকরা এবং এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী একটা দুরাবস্তার মধ্যে পড়ে যায়। জমিদাররারা এই অর্থনৈতিক দুরাবস্থাকে আমলে নিতে পারে নাই। সে সময়ে আমলে নেওয়ার অবস্থাও তাদের ছিল না। তাদের ঘাড়ে জমিদারি বাঁচানোর জন্য এবং তাদের বিলাসী জীবনের জন্য যে কোনো প্রকারেই খাজনা আদায় করাটাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। ফলে এই এলাকায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। একটি দুর্ভিক্ষঅবস্থার সৃষ্টি হয়। কিন্তু সিরাজগঞ্জ এলাকার কিছু জমিদার খাজনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে এই এলাকায় প্রজারা বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। তারা একটি প্রজা লীগও গঠন করে।

তখন ঐ এলাকার জমিদার ছিলেন ঠাকুর পরিবারের দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। রবীন্দ্রনাথের সবেমাত্র উপনয়ন হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ ধর্মকাজে কোলকাতায় থাকেন না। বা জমিদারী এলাকায় যান না। গেলেও কদাচিৎ। জমিদারীর ভার নায়েব-গোমস্তা আর ইংরেজ কর্মচারীর উপর। তিনি ভ্রমণে ব্যস্ত থাকেন। প্রায়ই হিমালয়ে যান। জমিদারীর প্রজাবিষয়ে এক ধরনের স্বাভাবিক ঔদ্যাসীন্য ছিল।

এই ১৮৭৩ সালে বালক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ প্রথমে শান্তিনিকেতনে গেলেন ১০ ফেব্রুয়ারি। সেখান থেকে মার্চের শুরুতে হিমালয়ের উদ্দেশ্য রওনা হলেন। চার মাস কাটিয়ে (১৮৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি ১০-মে ২৩) কোলকাতায় ফিরে এলেন। দেবেন্দ্রনাথকে জমিদারী এলাকায় দেখা গেল না। দেখা গেলেও তা ছিল ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ।

এই সময়েই কোর্টের রায় অমান্য করে জমিদাররা খাজনা আদায়ের জন্য প্রজাদের উপর জোর জবরদস্তি চালিয়ে যেতে থাকে। ফলে  ১৮৭৩ সালের মে মাসে পাবনা প্রজা লীগ  টিকে থাকার লক্ষ্য জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ গোটা পাবনা জেলায়ই ছড়িয়ে পড়ে। এই কৃষক নেতদের প্রধান নেতার নাম ঈশানচন্দ্র রায়। সবার কাছে তিনি ঈশান রাজা নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তার দুজন প্রধান অনুসারীর নাম খুদী মোল্লা এবং শম্ভুনাথ পাল।

এই বিদ্রোহীরা পাবনা-সিরাজগঞ্জ পরগণাকে জমিদারমুক্ত স্বাধীন এলাকা ঘোষণা করে। তারা একটা স্থানীয় প্রশাসনিক কাঠামোও প্রণয়ন করে। এমনকি তারা বিদ্রোহী সেনাবাহিনীও গঠন করে জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা শুরু করে। প্রশাসনিক বিভিন্ন বিভাগ বা শাখায় তাদের অনুগত লোকজনদের নিয়োগ দেয়। কিছু কিছু অনুগত প্রজা বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর দায়িত্বে ছিল এবং তারা জেলার বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব পেয়েছিল। প্রথম দিকে পাবনা আন্দোলনটি আইনসম্মত ও অহিংস ছিল। কিন্তু ধীর ধীরে যখন বিদ্রোহী প্রজালীগের শক্তি বেড়ে গেল তখন তারা আর অহংস থাকতে পারে নি। তারা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল।

এই প্রজা লীগের কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের শান্তি ভঙ্গ করা শুরু করেছিল তখন বৃটিশ সরকার শান্তি রক্ষার্থে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিল। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল ইংরেজদের পক্ষে ৪ জুলাই ১৮৭৩ একটি অধ্যাদেশ জারি করে সকল প্রকার অশান্তি দূরীকরণের ঘোষণা দেন। তিনি জমিদারদের নির্যাতনের পরিবর্তে আইনের পথে যাওয়ার পরামর্শ দেন।  আর এই সময় এই আন্দোলন থামানোর জন্য প্রচুর পুলিশ পাঠানো হয় পাবনা-সিরাজগঞ্জ এলাকায়। ফলে ঐ এলাকায় স্বাভাবিক পরিস্থিতি নষ্ট হয় এবং ১৮৭৩-১৮৭৪ সালে একটি দুর্ভিক্ষ ঘটে। মিস ফ্লোরেন্স নামে এক ইংরেজ মহিলা তখন দুর্ভিক্ষের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখান যে বাংলার দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী অনুন্নত সেচব্যবস্থা। পাশাপাশি তাদের দারিদ্র, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা খাজনাআদায়কারী বা জমিদার এবং সুদখোর মহাজনের কর্মকাণ্ডই এই দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছে।

ষড়বিংশ পর্ব

প্রজানিপীড়ণ খণ্ড  : চার

ডঃ আহম্মেদ শরিফ লিখেছেন, ঠাকুর-পরিবার প্রজানীপিড়ন করেছেন। আবুল আহসান চৌধুরী ডঃ শরীফকে চিঠিতে উত্তর দিয়েছিলেন, সেখানে ঠাকুর-পরিবারের প্রজানীপিড়নের স্বপক্ষে কিছু কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, এ রকম কিছু তথ্য পাওয়া যায়। বলেছিলেন  সেটা ১৯৮৫ সালের লেখা চিঠি। আর ২০১১ সালে আবুল আহসান চৌধুরী বলেছেন শাশ্বতিকী পত্রিকায়—

পূর্ববঙ্গের জমিদারির দেখভাল দ্বারকানাথ ঠাকুর নিজেও একসময় করেছেন- সে একেবারে গোড়ার দিকের কথা। তাঁর হাতেই এসব জমিদারি-সম্পত্তি কেনা। পরে দেবেন্দ্রনাথ নিজে দেখাশুনা করেছেন এবং তাঁর বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরও এ অঞ্চলের– বিশেষ করে সাজাদপুরের জমিদারি দেখাশুনা করেছেন। অন্য ছেলেদের মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা ভালো যোগাযোগ ছিল শিলাইদহ অঞ্চলের সঙ্গে। দ্বিজেন্দ্রনাথ পাবনার প্রজা-বিদ্রোহের সময় খুব ভালো ভূমিকা পালন করেন নি, এটা ১৮৭৩ দিকের কথা, সিরাজগঞ্জের সাজাদপুর অঞ্চলে যে কৃষক-বিদ্রোহ হয়েছিল তা দমনের জন্যে ঠাকুর-জমিদারেরা যথেষ্ট জবর-জুলুম ও নানা কূট-কৌশলও খাটিয়েছিলেন। আলাভোলা দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রজাপীড়নে যে কতো দড় হতে পারেন — কাঙাল হরিনাথের অপ্রকাশিত ডায়েরি ও  গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার পাতায় তার নমুনা আছে।

দ্বারকানাথ ব্যবসা করেছেন। জমিদারী কিনেছেন। এবং জমিদারী পরিচালনা করেছেন বৃটিশকর্মচারীদের মাধ্যমে। নিজে জমিদারি পরিচালনা করেন নি। তার সময়ে প্রজানীপিড়ন হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। দেবেন্দ্রনাথ যখন ঠাকুর-পরিবারের হাল ধরেন তখন তো জমিদারীই একমাত্র পারিবারিক আয়ের উৎস। সুতরাং যে কোনোভাবেই হোক না কেন জমিদারীটা টিকিয়ে রাখা তার দরকার ছিল। আবার তার বিশাল পরিবারের জন্য এবং ব্রাহ্মধর্মপ্রচারসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জন্যও অর্থ প্রয়োজন ছিল। তিনি নিজেও জমিদারী এলাকায় গিয়েছেন। সেটা খুবই কম। আবার সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যও যতটা না জমিদারী তার চেয়ে বেশী ছিল ব্রাহ্মধর্মসভার উপাসনা সভায় যোগদান। বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথও দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গেই এরকম একটা সফরে প্রথমবারের মত শিলাইদহে গিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের জমিদারী নায়েব-গোমোস্তারা পরিচালনা করতেন। পরে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার পুত্র, জামাই এবং নাতিদের উপর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে জমিদারী এলাকায় গিয়ে জমিদারী দেখেছেন। প্রজাদের সঙ্গেও তার ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে অন্যরা জমিদারী সরাসরি দেখেন নি। নায়েব-গোমস্তা এবং  ইংরেজ সাহেবদের উপরই খাজনা আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। কোলকাতার সেরেস্তায় বসে হিসাবপত্র দেখেছেন।

দেবেন্দ্রনাথের সময়ে বৃটিশ নীলকর কেনী সাহেব শিলাইদহের জমিদারীর খাজনা আদায়ের ইজারা নিতে চেয়েছিল। কেনী সাহেব ছিল দুর্ধর্ষ রকমের পীড়ক নীলকর। প্রজারা দেবেন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিল—কেনীকে ইজারা না দিতে। দেবেন্দ্রনাথ প্রজাদের অনুরোধ শুনেছিলেন। কিন্তু তার নিজের ধর্মপ্রচারকর্মে এত বেশী মগ্ন ছিলেন যে নিজে জমিদারিতে কি হল না হল, বা নায়েব-আমলারা জমিদারীতে কি করল না করল তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চান নি বা পারেন নি। তিনি পুত্র, জামাই এবং নাতিদের উপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তারা জমিদারী এলাকায় গেলে হয়তো আমলানির্ভরতা কমানো সম্ভব হত। সবাই সেটা করেন নি। ফলে প্রজানীপিড়নের ছিদ্র সব সময়ই কিছু না কিছু থেকে গিয়েছিল।

দেবেন্দ্রনাথের সময়ের একটা ঘটনার কথা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রে ইন্দিরা দেবীকে।

তারিখ : ২১ আগস্ট, ১৮৯৩ খ্রীস্টাব্দ।

'আজ একজন এসে বলেছিল, সে বছর ভালো ধান হয় নি বলে চুঁচড়োয় বুড়ো বাপের কাছে এনছাপ নিতে গিয়েছিলুম, তা সে বললে, আমি তোদের কিছু ছেড়ে দিচ্ছি, তোরাও আমাকে কিছু খেতে দিস। তার কাছে দরবার করতে গিয়েছিলুম বলে সেই মনোবাদে এখানকার আমিন আমাকে ফেরেবি মকদ্দমা করে তিন মাস জেল খাটিয়েছিল। আমি তখন তোমার মাটিকে সেলাম করে ভিন এলাকায় চলে গিয়েছিলুম।'

প্রজা কথিত এই বুড়ো বাপ হলেন রবীন্দ্রনাথের বাবা  দেবেন্দ্রনাথ।

১৮৭৫ সালের মার্চ মাসে দেবেন্দ্রনাথের পত্নী সারদা দেবীর মৃত্যুর হলে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে দেবেন্দ্রনাথ বেশিদিন থাকেন নি। তিনি বহুকাল কাটিয়েছেন চুঁচড়াতে। ১৮৯৮ সালের নভেম্বর মাসে তিনি কোলকাতায় ফিরে আসেন।

পশ্চিমবঙ্গের হুগরী জেলার একটি ছোটো শহর হল চুচড়া। হুগলী শহরটি ছিল পর্তুগিজদের অধিকারে এবং চুঁচুড়া ছিল ওলন্দাজদের দখলে। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী দুই-ই দখল করে ও পরে ১৮৬৫ সালে এই দুই প্রশাসনিক অঞ্চলকে একত্রিত করা হয়। বাড়ি ও ব্রাহ্ম সমাজের কর্তারা আবশ্যক মতো চুঁচড়ায় যেতেন নানা কাজে তাঁর আদেশ ও উপদেশ নিতে।

এই বুড়ো প্রজা লোকটি দেবেন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছিলেন কালীগ্রাম থেকে হুগলীর চুঁচড়ায়। গিয়েছিলেন খাজনা মাপ করার দাবী নিয়ে। সে বছর ফসল ভালো হয় নি বলে খাজনা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। কাছারির নায়েব-গোমস্তারা তাদের কাছে খাজনা চেয়েছে। ফসল হওয়া—না হওয়াটা নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা নেই। তাদের মাথা হল—খাজনা দেও। দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে মহাজনের কাছে যাও। না হলে পাইক পেয়াদা দিয়ে পিটিয়ে ঢিঁট করা হবে। এইতো আমলা শ্রেণীর চরিত্র। তারা মাপ করেন না। সব কিছু গাপ করেন।

এই তথ্য থেকে ধারণা করা যায়—সে সময় জমিদার দেবেন্দ্রনাথ জমিদারী এলাকায় ছিলেন না। ছিলেন চুঁচুড়াতে। প্রজারা তার কাছে যেতেও পারত। দাবী করতে পারত। প্রজা আর দেবেন্দ্রনাথের সংলাপ থেকে বোঝা যাচ্ছে প্রজা একা যায় নি চুঁচড়াতে। সঙ্গে আরও প্রজা ছিল। তাদের সবার দাবী নিয়েই তারা জমিদারের সঙ্গে কথা বলেছে। জমিদার তাদের কথা বিশ্বাস করেছেন। মেনে নিয়ে কিছু খাজনা মাপও করে দিয়েছেন। দেবেন্দ্রনাথ বলেছেন,  তোরাও কিছু দিস। কিছু দিয়ে যেন জমিদারকেও বাঁচিয়ে রাখে। তাহলে দেখা যাচ্ছে জমিদার দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তার প্রজাদের সম্পর্ক মন্দ নয়। একটা সমঝোতার মধ্যে আছে। উভয়ে উভয়ের জন্য ভাবে। সমস্যা বোঝো। পাশে দাড়ায়।   আবার  এবং প্রজারা জমিদারের এই সিদ্ধান্তে খুশী হয়েই কালীগঞ্জে ফিরে এসেছে।

তবে এই খানেই ঘটনাটি শেষ নয়। আরওকিছু অংশ আছে। প্রজারা জমিদারের কাছ থেকে খাজনা মাপ পেয়ে কাছারিতে গেছে সেই খাজনা দিতে। আর নায়েব-গোমস্তা-আমিনরা তাদের এড়িয়ে সরাসরি জমিদারের কাছে যাওয়ার অপরাধে তাদেরকে জেলে পুরেছে প্রতারণা মামলায়। জেল খেটেছে তিন মাস। তাহলে ঘটনা কি বলে? বলে প্রজা নিপীড়িত হয়েছে দেবেন্দ্রনাথের জমিদারীতে। সেটা করেছে তার কাছারির আমলারা। জমিদার দেবেন্দ্রনাথ যদি কালিগ্রামে থাকতেন, তাহলে আমলারা এই প্রজানীপিড়ন করার সাহস পেত না। তিনি এ বিহীত করতে পারতেন। প্রজারাও তার কাছে নালিশ জানাতে পারত।

প্রজাটি মনে কষ্ট পেয়েছে। মনে কষ্ট পেয়ে আবার দেবেন্দ্রনাথের কাছে ছুটে যায় নি নালিশ জানাতে। চলে গেছে দেবেন্দ্রনাথের জমিদারী এলাকা ছেড়ে অন্য পার্শ্ববর্তী জমিদারের এলাকায়।

পাশের জমিদারের কাছ থেকে কিছু জমি নিয়ে চাষ করতে শুরু করেছে। জমিতে ফসলও হয়েছে। সে সময়ে প্রজাটি দেখতে পেল দেবেন্দ্রনাথের জমিদারী এলাকার কিছু জমিদারীর জমিসম্পত্তি অন্যায়ভাবে দখল করে রেখেছে এই জমিদার। তা হয়তো দেবেন্দ্রবাবুর কাছারির নায়েব বাবুরা জানে না। এই খবরটি প্রজা দেবেন্দ্রবাবুর কাছারিতে এসে জানিয়ে গেছে। তখন তারা জমিগুলো উদ্ধার করে নিয়েছে। এই অপরাধে সেই জমিদার প্রজাটির ধানসহ জমিজমা সব কেড়ে নিয়েছেন। প্রথম ঘটনাটির ক্ষেত্রে নিপীড়ক জমিদার নয়—দেবেন্দ্রনাথের আমলা। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে নিপীড়ক জমিদার।

প্রজাটি কেন ফসল হারানোর মত বিপজ্জনক কাজ করল? কেন দেবেন্দ্রনাথের কাছারিতে পাশের দখলদার জমিদারের জমি দখলের ঘটনাটি বলতে এসেছিল? এর উত্তর আছে ছিন্নপত্রের ঐ চিঠিতে—বুড়ো বলছেন রবীন্দ্রনাথকে—

'আমি যার মাটিতে বুড়োকাল পর্যন্ত মানুষ হয়েছি তার হিতের কথা আমি বলতে পাব না? এই বলে সে চোখ থেকে দুই-এক ফোঁটা জল মুছে ফেললে।'

যে সময়ে প্রজাটির মুখ থেকে এই ঘটনাটি শুনেছিলেন, তখন ফ্রান্সের আর্টিস্টদের কিছু খবরাদি পড়ছিলেন পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ। তিনি তখন বলেছিলেন, কোথায় প্যারিসের আর্টিস্টদের উন্মত্ততা আর কোথায় আমার কালীগ্রামের সরল চাসী প্রজাদের দুঃখদৈন্যনিবেদন। আমার কাছে এই সমস্ত দুঃখপীড়িত অটল-বিশ্বাস-পরায়ণ অনুরক্ত প্রজাদের মুখে বড়ো একটি কোমল মাধুর্য আছে। বাস্তবিক এরা যেন আমার একটি দেশজোড়া বৃহৎ পরিবারের লোক। এই-সমস্ত নিঃসহায় নিরুপায় নিতান্তনির্ভর সরল চাষাভূষোদের আপনার লোক মনে করিয়া একটি সুখ আছে।

তাহলে রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথের জমিদারীমেজাজটা বাস্তবিকই নির্মম মনে হয় না এই সব ঘটনা থেকে। তিনি নিজেও লিখেছেন তার আত্মজীবনীতে জমিদারী এলাকা ভ্রমণের কথা। কিন্তু সেখানে বেশীর ভাগই উল্লেখ করেছেন বাহ্মধর্মের কথা, তার আধ্যাত্ম্য দর্শনের বয়ান। জমিদারী বিষয় সম্পত্তি নিয়ে তার তেমন মাথা ব্যাথা ছিল না। তবে তিনি যে উদাসীন ছিলেন তা কিন্তু নয়। বিষয়সম্পত্তির ক্ষেত্রে তিনি সকলের চেয়ে সজাগ ছিলেন। ১৮৫৩ সালে লেখা তাঁর একটা চিঠিতে দেখা যাচ্ছে তিনি শিলাইদহ ইত্যাদি স্থানে নিজে গিয়ে জমিদারী পরিচালনা করছেন। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন জমিদার দেবেন্দ্রনাথ বিষয়ে—

..তিনি (দেবেন্দ্রনাথ) তখন নিজে পড়িতে পারিতেন না। গত মাসের ও গত বৎসরের সঙ্গে তুলনা করিয়া সমস্ত আয়ব্যয়ের বিবরণ তাঁহার সম্মুখে ধরিতে হইত। প্রথমমত মোটা অঙ্কগুলো তিনি শুনিয়া লইতেন এবং মনে মনে তাহার যোগবিয়োগ করিয়া লইতেন। মনের মধ্যে যদি কোনো অসংগতি অনুভব করিতেন তবে ছোটো ছোটো অঙ্কগুলো শুনাইয়া যাইতে হইত। কোনো কোনো দিন এমন ঘটিয়াছে, হিসাবে যেখানে কোনো দুর্বলতা থাকিত সেখানে তাঁহার বিরক্তি বাঁচাইবার জন্য চাপিয়া গিয়াছি, কিন্তু কখনো তাহা চাপা থাকে নাই। হিসাবের মোট চেহারা তিনি চিত্তপটে আঁকিয়া লইতেন। যেখানে ছিদ্র পড়িত সেখানেই তিনি ধরিতে পারিতেন। এই কারণে মাসের ওই  দুটা দিন বিশেষ উদ্বেগের দিন ছিল।..

এ বিষয়ে সমীর সেনগুপ্ত মন্তব্য করেছেন, দেবেন্দ্রনাথের চরিত্রে দার্শনিকতা ও বৈষয়িকতার অদ্ভুত পরস্পরবিরোদী সহাবস্থান দেখা যায়। তাঁর ধর্মবোধ, ন্যায়পরায়ণতা, অপৌত্তলিক ধর্মে ও একমেবোদ্বিতীয়ম ঈশ্বরে বিশ্বাস, নানা জনহিতকর কর্মে উৎসাহ ইত্যাদি বিষয়ে বহুবিখ্যাত, কিন্তু তাঁর চরিত্রের বৈষয়িক ও প্রভুত্বপ্রিয় দিকগুলি ত পরিচিত নয়। সব কিছু থেকে দূরে থেকেও তাঁ জমিদারী, আদি ব্রাহ্মসমাজ ও পরিবারকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। তাঁর শাসনকালেই তাঁর জমিদারীতে প্রজাপীড়নের সংবাদ হরিনাথ মজুমদারের (১৮৩৩-১৮৯৬) গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় প্রকাশিত হয়।

তাহলে গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় দেবেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে প্রজানিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নয়। বাবা দেবেন্দ্রনাথ যদি প্রজানীপিড়ন করেও থাকেন, তাহলে অপরাধটা দেবেন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের নয়। তাহলে বাবার অপরাধে ছেলে অপরাধী হবে কেন?

প্রফেসর আবুল আহসান চৌধুরী আরেকটি তথ্য জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথের পূর্ববঙ্গের জমিদারির দেখভাল দ্বারকানাথ ঠাকুর নিজেও এক সময় করেছেন—সে একেবারে গোড়ার দিকের কথা। তাঁর হাতেই এসব জমিদারি-সম্পত্তি কেনা। পরে দেবেন্দ্রনাথ নিজে দেখাশুনা করেছেন এবং বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরও  এ অঞ্চলের—বিশেষ করে সাজাদপুরের জমিদারি দেখাশুনা করেছেন। …দ্বিজেন্দ্রনাথ পাবনার প্রজা-বিদ্রোহের সময় খুব ভালো ভূমিকা পালন করেন নি, এটা ১৮৭৩ দিকের কথা, সিরাজগগঞ্জের সাজাদপুর অঞ্চলে যে কৃষক-বিদ্রোহ হয়েছিল তা দমনের জন্যে ঠাকুর-জমিদারেরা যথেষ্ট জবর-জুলুম ও নানা কূটকৌশলও খাটিয়েছিলেন। আলাভোলা দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রজাপীড়নে যে কতো দড় হতে পারেন—কাঙাল হরিনাথের অপ্রকাশিত ডায়েরি ও গ্রামবার্তা প্রকাশিকার পাতায় তার নমুণা ছড়িয়ে আছে।

কিন্তু তথ্য বলে অন্য কথা। বলে, দ্বিজেন্দ্রনাথ পুরোপুরি তাত্ত্বিক জগতের মানুষ ছিলেন, কোনো কিছু গড়ে তোলার কি পরিচালনা করার গুণাবলি বা উৎসাহ তাঁর চরিত্রে ছিল না। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের চরিত্র ভালো করেই বুঝতেন, জমিদারি পরিচালনা করার তাঁর উপরে তাই অর্পন করেন নি। তার চেয়ে অচলিত ছন্দে বাংলায় ছড়া লেখা তাঁর কাছে অনেক  কাঙ্ক্ষণীয় ছিল।

তবু দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে  ১২৯১ (১৮৮৪) সালে জোড়াসাকোর হিসাবপত্র বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখার দায়িত্ব দেন। তিনি এই কাজটি পছন্দ করতেন না। মাত্র দেড় মাস পরে তাই তাঁর পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার মানে দ্বিজেন্দ্রনাথ মাত্র দেড় মাস জমিদারি পরিচালনা করেছিলেন। দ্বিপেন্দ্রনাথ ২৩ আগস্ট ১৮৮৪ তারিখ থেকে ঠাকুরপরিবারের জমিদারির হিসেবপত্র পরীক্ষা করার দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিপেন্দ্রনাথ পাঁচ বছর এই কাজ করেন। ১৮৭৩ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথ জমিদারি পরিচালনা করতে গেছেন শিলাইদহে—এরকম তথ্য পাওয়া যায় না। তিনি গিয়েছেন ১৮৮৪ সালে।

দ্বিজেন্দ্রনাথ জমিদারী দেখেছিলেন মাত্র মাসখানেক। এর মধ্যে আবার তিনি সাহজাদপুরেও গিয়েছিলেন। সেখানে নিজের উদ্যোগে প্রজাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সুখ দুঃখের খোজ খবর নিয়েছেন। তাদের খাজনা মউকূপের প্রস্তাব করছেন। এ ঘটনায় আমলারা বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছিল। আর তখন তখুনি তাকে বাদ দিয়ে তার ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথকে জমিদারী দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রনাথ ১৮৮৪ সালের জুন মাসে প্রথম সপ্তাহে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ছেড়ে দিয়েছিলেন ২২ আগস্ট।  দ্বিপেন্দ্রনাথ পাঁচ বছর জমিদারি পরিচালনা করেন। এর পরে রবীন্দ্রনাথ জরিদারি পারিচালনার ভার পান।

এ ঘটনাটির একটি ছোটো বিবরণী লিখেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন বড়বাবু নামে প্রবন্ধে—একবার বাম্পার-ক্রপ হলে পর সুযোগ বুঝে পিতা মহর্ষিদেব তাঁকে খাজনা তুলতে গ্রামাঞ্চলে পাঠান। গ্রামের দুরাবস্থা দেখে তিনি তার করলেন, সেন্ড ফিফটি থাউজেন্ড। (তাঁর গ্রামোন্নয়ন করার বোধ হয় বাসনা হয়েছিল!)।. উত্তর গেল, কাম ব্যাক!'

দ্বিপেন্দ্রনাথ দেবেন্দ্রনাথের বড়ো আদরের নাতি ছিলেন। তিনি কোলকাতায় থেকেই জমিদারি পরিচালনা করতেন। শিলাইদহে যাওয়ার প্রয়োজন করেন নি। দেবেন্দ্রনাথও এই নাতিটিকে যাওযার জন্য পীড়াপীড়ি করেন নি। সে রকম তথ্য পাওয়া যায় না। সুতরাং দ্বিপেন্দ্রনাথের জমিদারী পরিচালনার কালটি পুরোপুরি আমলানির্ভর জমিদারী কাল। সুতরাং না্য়েব-গোমস্তারা যা বলবে, সেটাই সহি।

দ্বিজেন্দ্রনাথের  আলাভোলা রূপটির আরও কিছু নমুণা পাওয়া যায় সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায়– লোকমুখে শুনেছি সকলের অজান্তে এক ভিখিরি এসে তাঁর (দ্বিজেন্দ্রনাথ) কাছে ভিক্ষা চাইলে তিনি বললেন, 'আমার কাছে তো এখন কিছু নেই। তুমি এই শালখানা নিয়ে যাও।'  প্রাচীন যুগের দামী কাশ্মিরী শাল। হয়তো বা দ্বারকানাথের আমলের। কারণ তাঁর শালে শখ ছিল। ভিখিরি প্রথমটায় নাকি নিতে চায় নি। শেষটায় যখন বড়বাবুর চাকর দেখে বাবুর উরুর উপর শালখানা নেই, সে নাতি দিনেন্দ্রনাথে খবর দেয়। তিনি বোলপুরে লোক পাঠিয়ে শালখানা 'কিনিয়ে' ফেরত আনান। ভিখিরি নাকি খুশী হয়েই 'বিক্রি' করে; কারণ এর রকম দামী শাল সবাই চোরাই বলেই সন্দেহ করতো। কথিত আছে, পরের দিন যখন সেই শালই তাঁর উরুর উপর রাখা হয় তখন তিনি সেটাই লক্ষ্যই করলেন না, যে এটা আবার এল কি করে!

সুতরাং এই আলাভোলা লোকটি কি করে প্রজানীপিড়নের কাজটি করাবেন? লাঠিয়াল ভাড়া করে এবং পাঞ্জাবী গুন্ডা ভাড়া করে প্রজাদের ঢিট করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তাদের ঘর-জ্বালিয়ে দিয়েছেন, কাঙাল হরিনাথকে শিক্ষা দেবার জন্য লাঠিয়াল পাঠিয়েছেন—এটা ঠিক মেলে না। তথ্য বলছে, দ্বিজেন্দ্রনাথ এই কাজ করেন নি। তিনি উল্টো প্রজাদের ঘরে ঘরে ঘুরেছেন। তাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখেছেন। বাবাকে তাদের দুর্দশা মোচনের জন্য টাকা পাঠাতে তার করছেন। এবং আমলারা জমিদারকে বলে কয়ে তাকে কোলকাতায় ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।

আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন, কাঙাল হরিনাথের ডা্য়েরিতে এবং গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় দ্বিজেন্দ্রনাথের এই প্রজানীপিড়নের সংবাদ ছাপা হয়েছিল। কাঙাল হরিনাথের ডায়েরিটি ছাপা হল না কেন এতদিন? বাঁধা কোথায় ছিল? গ্রামবার্তার প্রকাশিকার মূল খবরটিও কোথাও পাওয়া যায় না।

আসলে সে সময় প্রজানীপিড়নের ঘটনাটাটি ঘটেছে ঠিকই। তবে সেটার জন্য কোনো ভাবেই দ্বিজেন্দ্রনাথকে দায়ী নন। কাজটি করেছিল না্য়েব-গোমস্তারা। দুর্নামটি রটেছে দ্বিজেন্দ্রনাথের নামে।

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : সপ্তবিংশ পর্ব


প্রজানিপীড়ণ খণ্ড 
 : পাঁচ

 কাঙাল হরিনাথ ওরফে হরিনাথ মজুমদার : খুঁজে দেখা

————————————————————————

কাঙাল হরিনাথ মজুমদার জন্মেছিলেন ১৮৩৩ সালে কুষ্টিয়ার এক গণ্ডগ্রামে।। এর ঠিক ২৮ বছর পরে কোলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরপরিবারে রবীন্দ্রনাথ।

অল্প বয়সেই হরিনাথ বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন। স্থানীয় ইংরেজি স্কুলে তাঁর পড়ালেখা শুরু। তবে অনাথ হয়ে পড়ায় আর্থিক দুর্গতিতে বেশিদূর এগোতে পারেননি। নিজের চেষ্টায় শিক্ষিত হয়েছেন। খুলেছেন স্কুল। শিক্ষকতাও করেছেন।  নিজ গ্রামে তিনি বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় একটি ভার্নাকুলার স্কুল খুলেছিলেন ১৮৫৫ সালে। সেখানেই অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। পরের বছর তিনি কুমারখালীতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৮ সালে এই বালিকা বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এ দেশে নারীদের শিক্ষার প্রসারেও হরিনাথের ভূমিকা পথিকৃতের।

পারিবারিক দৈন্যের কারণে বালক বয়সে কুমারখালী বাজারের এক কাপড়ের দোকানে কাঙাল হরিনাথ কাজ নিতে বাধ্য হন দৈনিক দুই পয়সা বেতনে। এরপর ৫১টি কুঠির হেড অফিস কুমারখালীর নীলকুঠিতে শিক্ষানবিস হিসেবে যোগ দেন। তবে নীলকুঠিতে নীলকরদের অত্যাচার দেখে সে চাকরী ছেড়ে দিয়েছিলেন।

স্থানীয় জমিদার ও ইংরেজদের প্রজাপীড়ন ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছিল হরিনাথকে। ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় এসব নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। সেই তার সাংবাদিকতার শুরু। পরে ১৮৬৩ সালে নিজেই প্রকাশ করেন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা নামের মাসিক পত্রিকা। পরে এটি পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। গ্রামবার্ত্তা প্রথমে প্রকাশিত হতো কলকাতার গীরিশ বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে। বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে,১৮৬৪ সালে কুমারখালীতে স্থাপিত হয় মথুরনাথ যন্ত্র। বিখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রের পিতা হরিনাথের বন্ধু মথুরনাথ মৈত্র এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি মুদ্রণযন্ত্রটি হরিনাথকে দান করেন। ১৮৭৩ সাল থেকে এই যন্ত্রেই গ্রামবার্তা প্রকাশিত হতে থাকে। ২৫ বছর ধরে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল। মেশিনের মাঝখানে এ যন্ত্রটির উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদনের তারিখ লেখা রয়েছে। লন্ডনের ১০ ফিন্সবারি স্ট্রিটের ক্লাইমার ডিক্সন অ্যান্ড কোম্পানি থেকে কলম্বিয়ান প্রেস মডেলের ১৭০৬ নম্বর এ মুদ্রণযন্ত্রটি তৈরি করা হয় ১৮৬৭ সালে। প্রয়াত এডওয়ার্ড বিভান এ যন্ত্রটি পেটেন্ট করেন। অমৃতবাজার পত্রিকার বাংলা ১২৮০ সালের ১৭ শ্রাবণ সংখ্যায় কুমারখালীতে কাগজ ছাপা কল বসার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সে খবর লোকমুখে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অসংখ্য লোক তাই দেখতে আসে কেমন করে কাগজের গায়ে অত ছোট লেখা হয়। ৩০-৩৫ মণ ওজনের ডাবল ক্রাউন সাইজের বিশাল মেশিন। দেখতে একটি দানবের মতো। এ মেশিনে কাগজ ছাপাতে তিনজন লোক লাগত। মেশিন চলাকালে দেখা যেত মেশিনের মাথার ওপর ডানা প্রসারিত ঈগল পাখিটা উড়ে গিয়ে আবার যথাস্থানে ফিরে আসছে।

গ্রামবার্তা পত্রিকায় হরিনাথ সাহিত্য, দর্শন বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশের পাশাপাশি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী প্রকাশ করেন। একটা পর্যায়ে জমিদারেরা তার ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন। তখন লালন সাঁই অনুসারীদের নিয়ে হরিনাথের বাড়িতে এসে পাহারা দিয়ে তাকে রক্ষা করেন। পাশাপাশি লালনকেও প্রকাশের দায়িত্ব তিনিই নিয়েছিলেন।

কাঙাল হরিনাথ ও লালন সাঁইয়ের জন্ম একই অঞ্চলে। হরিনাথ জন্মেছিলেন অধুনা কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালিতে। লালনের জন্ম এই কুমারখালিরই অন্তর্গত গড়াই নদীর অপর পারে ভাঁড়ারা গ্রামে। হরিনাথের সাহিত্যচর্চা, সাংবাদিকতা ও অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ড কুমারখালিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিল। লালন ফকিরের সাধনপীঠও ছিল এই কুমারখালির নিকটবর্তী ছেঁউড়িয়া গ্রামে।

লালন ও হরিনাথ দুজনেই ছিলেন দরিদ্র। কিন্তু এর মধ্যে থেকেই দুজনেই মহৎজীবনের সন্ধান করেছেন। দুজনেই পার্থিব আকাঙ্খামুক্ত ছিলেন। দুজনেই মনাবমিলনপ্রয়াসী লোকায়ত পথের মরমী পথিক ছিলেন। এই অন্তর্গত মিলের কারণেই দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।

লালন মাঝে মধ্যে কাঙাল কুটিরে কুমারখালিতে আসতেন। অপরদিকে কাঙ্গালও ছেউড়িয়ার লালনের আখড়ায় যেতেন। দুজনেই গানের ভূবনে মেতে উঠতেন।

কাঙাল-শিষ্য জলধর সেন (১৮৬০-১৯৩৯)  কাঙাল জীবনীতে লিখেছেন—

সে দিন প্রাতঃকালে লালন ফকির নামক একজন ফকির কাঙালের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন। লালন ফকির কুমারখালির অদূরবর্তী কালীগঙ্গার তীরে বাস করিতেন। তাঁহার অনেক শিষ্য ছিল। লালন সেদিন কাঙালের কুটিরে গেয়েছিলেন—

আমি একদিনও না দেখিলাম তারে;

আমার ঘরের কাছে আরসী-নগর,

তাতে এক পড়সী বসত করে।

লালনের অনুপ্রেরণায় আইনজীবী, ঐতিহাসিক ও পুরাতত্ত্ববিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১—১৯৩০) একটি বাউলের দল গঠনের চিন্তা করেন। কাঙাল হরিনাথের নির্দেশে তাঁর শিষ্যদল ফিকিরচাঁদের দল গঠন করে। তারা ফিকিরচাঁদ ভনিতা যোগ করে গান লেখেন—ভাব মন দিবানিশি, অবিনাশি, সত্য-পথের সেই ভাবনা। কাঙালও গান লেখা শুরু করেন। তাঁর লেখা প্রথম গান–

আমি কোরব এ রাখালি কতকাল

পালের ছটা গরু ছুটে, কোরছে আমায় হাল-বেহাল।

কাঙাল তাঁর দিনলিপিতে লিখেছেন—

শ্রীমান অক্ষয় ও শ্রীমান প্রফুল্লের গানগুলির মধ্যে আমি যে মাধুর্য্য পাইলাম, তাহাতে স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম, এইভাবে সত্য, জ্ঞান ও প্রেমতত্ত্বে প্রচার করিলে, পৃথিবীর কিঞ্চিৎ সেবা হইতে পারে। এতএব কতিপয় গান রচনার দ্বারা তাহার স্রোত সত্য, জ্ঞান ও প্রেমসাধনার উপায়স্বরূপ পরমার্থ-পথে ফিরাইয়া আনিলাম এবং ফিকিরচাঁদের আগে কাঙ্গাল নাম দিয়া দলের নাম 'কাঙ্গাল-ফিকিরচাঁদ' রাখিয়া তদানুসারেই গীতাবলীর নাম করিলাম।

কাঙালের ডায়েরী থেকে জানা যায়, অল্প দিনের মধ্যেই ফিকিরচাঁদের গান নিম্নশ্রেণীর লোকের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। উচ্চশ্রেণীর মধ্যেও তাঁর আদর হয়েছিল। মাঠের চাষা, ঘাটের নেয়ে, পথের মুটে,, বাজারের দোকানদার এবং তাহার উপর শ্রেণীর সকলে কাঙ্গাল ফিকিরচাঁদের গান শুনতে লাগলেন। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সামান্য বীজ থেকে প্রকাণ্ড বৃক্ষে পরিণত হয়েছিল।

কাঙাল হরিনাথের শিষ্যদের অন্যতম ছিলেন মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১), জলধর সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, তন্ত্রাচার্য বিদ্যার্ণব (১৮৬০-১৯১৩) প্রমুখ।

গবেষক অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী মন্তব্য করেছেন,  লালনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নিরন্তর চর্চা ও অনুশীলনে কাঙ্গাল হরিনাথের গান উত্তরকালে হৃদয়গ্রাহী, সরস ও মার্জিত হয়ে উঠেছিল। লালনের গানের ভাব-ভাষা-ভাবনার একটা প্রভাবও পড়েছিল হরিনাথের গানে। কাঙ্গাল হরিনাথের একটি গান বিখ্যাত সকল মানুষের কণ্ঠে গীত হয়েছে—

ওহে দিন তো গেল সন্ধ্যা হল, পার কর আমারে।

তুমি পারের কর্তা, শুনে বার্তা, ডাকছি হে তোমারে।।

(ওহে দীন দয়াময়)

আমি আগে এসে ঘাটে এসে রইলাম বসে

(ও হে আমার কি পার করবে না হে, অধম বলে)

যারা পাছে এল, আগে গেল, আমি রইলাম পড়ে।।

এই গানটি সত্যজিৎ রায়ের পথে পাঁচালী চলচ্চিত্রে গীত হয়েছিল। সেখানে গীতিকার হিসাবে কাঙ্গাল হরিনাথের নামটি ব্যবহার করা হয় নি।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মনের মানুষ বইতে লিখেছেন,

একদিন একটা অন্যরকম ঘটনা ঘটল।

সেদিনও লালন তার কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে হরিনাথের বাড়ির সামনের প্রাঙ্গনে বসে অন্যদের কথা শুনছে। হরিনাথ এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছে জমিদারদের বিরুদ্ধে। এমন সময় এক ব্যক্তি হন্তদন্ত হয়ে এসে হরিনাথের কানের কাছে কী যেন বলল।

একটুক্ষণ শোনার পর হরিনাথ উত্তেজিতভাবে বলল, তাই নাকি, চলো, সবাই যাই।

উঠে দাঁড়িয়ে সে লালনকে বলল, চলো বন্ধু, তুমিও চলো।

লালন জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?

হরিনাথ বলল, নদীর ধারে। বেশী সময় নেই, চলো, যেতে যেতে তোমায় সব বলব।

ঘটনাটি এই—কুমারখালির মানুষের নানারকম অভাব-অভিযোগ রয়েছে। ইস্কুল-মাদ্রাসা মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যায়। রোগের চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত নেই। বন্যায় ভোরাই নদীর পাড় ভাঙছে। নীলকর সাহেবদের অত্যাচার তো লেগেই আছে। কিন্তু জমিদারের নায়ে এর কোনও প্রতিকার করে না, পুলিশ এসব অভিযোগে কান দেয় না। সর্বত্র অরাজকতা।একমাত্র জেলার হাকিমের কাছে সব কিছু জানালে কিছু ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু হাকিম সাহেবের কাছে তো পৌঁছানই যায় না। খবর আছে, আজই হাকিমসাহেব তার নামের কলের জাহাজে এই ভোরাই নদী দিয়ে যাবেন। তখন সাহেবের কাছে অনেকে মিলে গিয়ে অভাব-অবিযোগের জানাবার এক সূবর্ণ উপস্থিত হয়েছে।

প্রায় হাজার খানেক মানুষ সমবেত হয়েছে ভোরাই নদীর তীরে। হরিনাথের সঙ্গে লালনের দলবলও সেখানে এসে দাঁড়াল।

হাকিমসাহেবের স্টিমারটির কিন্তু সেখানে থামল না। পাড়ের লোকদের উপেক্ষা করে নদী দিয়ে সোজা চলে যেতে লাগল। তখন লালন ফকির দলবল নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সঙ্গে সমবেত হাজারখানেক পল্লীবাসী। তারা সাঁতরে স্টিমারটি ঘিরে ফেলেছিল।  সাহেবের স্টিমারটি থামিয়ে দিয়েছিল। সাহেব শুনেছিল প্রজাদের অভাব-অভিযোগ। সে সময়টা ছিল দেবেন্দ্রনাথের জমিদারকাল।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। লালনের কাছে খবর এসেছিল, জমিদারের লোকজন হরিনাথের বাড়িতে লেঠেল পাঠিয়েছে। সঙ্গে আছে পাঞ্জাবী গুণ্ডা। কারণ হরিনাথের গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় জমিদারের বিরুদ্ধে প্রজানীপিড়নের সংবাদ ছাপা হচ্ছে।

লালন তার শিষ্যদলকে নিয়ে কুমারখালিতে হরিনাথের বাড়িতে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন কাঙালের উঠোনে নায়েব শ্রেণীর এক লোক বসে আছে। তারা তখনো হরিনাথের ঘরে আগুন দেয় নি। হরিনাথ বাড়িতে ছিল ন।

সেখানে শীতল নামে একজন লালন শিষ্য বলেছিল, অন্য এক জমিদার আমার বাড়ি পুড়ায়ে দিয়েছিল। পেয়াদারা আমার ভগিনীরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ঋণ শোধ করতে পারি নি তাই জমিদার জুতা মেরেছিল আমার দুই গালে।

লালন সেদিন জমিদারের বাহিনীকে লড়াই করেই হটিয়ে দিয়েছিলেন। সুনীল লিখেছেন, পরে লালনকে জমিদারের কুটি বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে লালনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, জমিদারের ছেলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। জ্যোতিরিন্দ্র তখন নবীন যুবক। দীর্ঘকায়, অত্যন্ত রূপবান। দেবেন্দ্রনাথের পরিবর্তে তার পুত্রদের কেউ  যে তখন জমিদারি পরিদর্শনের ভার নিয়েছে, তা এ অঞ্চলে কেউ সেভাবে জানত না। জ্যোতিরিন্দ্র লালনের মুখে সেদিন প্রজানিপীড়নের কথা শুনেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছিলেন, জমিদারেরা থাকেন সব কলকাতায়, দূরের জমিদারিতে নায়েব-কর্মচারীরা যে কী করছে, তার খবরও রাখেন না। তাঁরা টাকা পেলেই খুশি। কীভাবে সেই টাকা আদায় হচ্ছে—সেটা জানার চেষ্টা করছেন না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তার বাবা দেবেন্দ্রনাথ জমিদারী পাওয়ার পরে নিয়মিত জমিদারী এলাকায় পরিদর্শনে আসতেন। কিন্তু পরে তিনি ঈশ্বরের সাধনায় মগ্ন থেকেছেন। জমিদারীর কিছু দেখেন না, কলকাতায়ও থাকেন না। মাঝে মাঝেই চলে যান সিমলে পাহাড়ে কিংবা গঙ্গায় বোটে থাকেন। জমিদারির ভার দিয়েছেন ছেলেদের উপর। তার বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ কবি ও দার্শনিক মানুষ, বিষয়কর্মে একদমই মন নেই। পরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ খুবই উচ্চশিক্ষিত, সরকারী চাকরি করেন—জমিদারীতে আগ্রহ নেই। থাকেন বোম্বাই নগরীতে। আর তিনি নিজে গানবাজনা, ছবি, থিয়েটার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। জমিদারির ভবিষ্যৎ নেই জেনেও এ বিষয়ে মন লাগিয়ে কাজ করতে পারেন না। ব্যবসা করার চেষ্টা করছেন।  ফলে তাদের জমিদারিটা নায়েব-কর্মচারীদের কব্জায় পড়েছে।

লালনকে ফকিরের আখড়া সংশ্লিষ্ট এলাকাকে জ্যোতিরিন্দ্র নিষ্কর পাট্টা করে দিয়েছিলেন সেবার। হরিনাথের বাড়িতে আর লাঠিয়াল যায় নি।

সুনীলের লেখাটা উপন্যাস। ইতিহাস নয়। সুতরাং তার এই বিবরণকে পুরোপুরি সত্য ধরার সুযোগটা কম। তবে সুনীল সে সময়ের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা, আবুল আহসান চৌধুরীর কাঙাল হরিনাথ : গ্রামীন মণীষার প্রতিকৃতি, লালন স্মারক গ্রন্থ, সমাজ সমকাল ও লালন সাঁই, শক্তিনাথ ঝাঁর ফকির লালন সাঁই : দেশকাল ও শিল্প,  ধনঞ্জয় ঘোষাল সম্পাদিত হরিনাথ মজুমদার ও বাঙালি সমাজ, ইত্যাদি আকর গ্রন্থ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে উপন্যাসটি লিখেছেন। সুতরাং তার লেখা উপন্যাস হলেও অনেকটাই ইতিহাসের তথ্য মেলে।

আবুল আহসান চৌধুরীর গবেষণা থেকে জানা যায় যে. কাঙাল হরিনাথের গান ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করেছিল। কাঙাল নিজে একসময়ে ব্রাহ্মসমাজে গান গেয়েছেন, ঢাকায় গান গেয়ে মাতিয়েছেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, যিনি একসময় ব্রাহ্মধম্যের প্রচারক ছিলেন, তিনি হরিনাথের গান খুব পছন্দ করতেন। ব্রাহ্মসঙ্গীতের যেসব বই বেরিয়েছিল ব্রাহ্মসমাজের তরফ থেকে বা বাইরে থেকে তাতেও দেখা যায় কাঙাল হরিনাথের গান দুচারটে আছে। ব্রাহ্মধর্ম দেবেন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচারিত হত। রবীন্দ্রনাথ নিজেও  ব্রাহ্মসমাজের দীর্ঘকালীন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

হরিনাথের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৮টি। তার প্রণীত উপন্যাসের নাম বিজয়-বসন্ত। এটা সংস্কৃত 'কথা' জাতীয় উপাখ্যান ধরনের লেখা হয়েছিল। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এই উপন্যাস ১৮৫৯ খ্রীস্টাব্দে। ১২৬০, ১৮৬৫ এবং ১৮৬৯ সালে বইটির আরও কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কাঙাল হরিনাথের এই বিজয়-বসন্ত উপন্যাসটি কোনো কোনো বিদ্যালয়ে পাঠ্য-তালিকাভুক্ত ছিল। এছাড়াও সাধারণ পাঠকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন এগার বছর তখন তিনি কাঙাল হরিনাথের এই বইটি প্রথম পড়েছিলেন।

বিজয়-বসন্তের ভূমিকা প্রথমবারের বিজ্ঞাপন হিসাবে  কাঙাল হরিনাথ লিখেছিলেন,  …এক্ষণে কামিনীকুমার, রসিকরঞ্জন, চাহারদরবেশ, বাহারদানেশ প্রভৃতি যে সমুদয় রূপক-ইতিহাস প্রচারিত আছে, সে সমুদয়ই অশ্লীল ভাব ও রসে পরিপূর্ণ। তৎপাঠে উপকার না হইয়া বরং সর্বতোভাবে অনর্থের উৎপত্তি হয়। এই সমুদয় অবলোকনে বালকদিগের রূপক-পাঠের নিমিত্তে কতিপয় বন্ধুর অনুরোধে আমি বিজয়-বসন্ত নামক এই গ্রন্থ প্রণয়নে প্রবৃত্ত হই। ইহা কোন পুস্তক হইতে অনুবাদিত নহে, সমুদয় বিষয়ই মনঃকল্পিত। ইহার আদ্যন্ত কেবল করুণরসাশ্রিত এবং নীতিগর্ভ বিষয়ে পরিপূর্ণ। ১৩০৮ বঙ্গাব্দে (ইংরেজী ১৯০১) বসুমতি প্রতিষ্ঠান থেকে জলধর সেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত 'হরিনাথ গ্রন্থাবলীতে' বিজয়-বসন্ত' অর্ন্তভুক্ত হয়।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এইসব পাঠ্য-তালিকার বইগুলির বেশীর ভাগই বাড়ির মেয়েরা সংগ্রহ করতেন। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী লিখেছেন—'মনে আছে, বাড়ীতে মালিনী বই বিক্রি করিতে আসিলে মেয়েমহল সেদিন কি রকম সরগরম হইয়া উঠিত। সে বটতলার যত কিছু নতুন বই, কাব্য, উপন্যাস, আষাঢ়ে গল্প আনিয়া দিদিদের লাইব্রেরীর কলেবর বৃদ্ধি করিয়া যাইত। বড় হইয়া সে-কালের বইগুলি যথেষ্ট নাড়াচাড়া করিয়াছি—মানভঞ্জন, প্রভাস-মিলন, দূতী সংবাদ, কোকিল দূতি, রুক্মিনীহরণ, পারিজাতহরণ, গীতগোবিন্দ, প্রহ্লাদচরিত, রতিবিলাপ, বস্ত্রহরণ, আন্নদামঙ্গল, আরব্যোপন্যাস, চাহারদরবেশ, হাতেম তাই, গোলেবকায়েলী, লায়লামজনু, বাসবদত্তা, কামিনীকুমার ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ কাঙাল হরিনাথের রচিত বিজয়-বসন্তের কথা কয়েকটি জায়গায় উল্লেখ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ যখন ১৮৮৯ সালের ২৫ নভেম্বর জমিদারি পরিদর্শনের ভার পেয়ে শিলাইদহে গিয়েছিলেন তখন সঙ্গে ছিলেন শিশুকন্যা, শিশুপুত্র, স্ত্রী মৃণালিনী, স্ত্রীর এক সহচরী এবং রবীন্দ্রনাথের দাদা বীরেশ্বরের ছেলে প্রিয় বলেন্দ্রনাথ। তখন  তারা নদীর উপরে বোটে থাকতেন। সে সময় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় তাদের বোটে গ্রাম্য গাইয়েরা এসে গান শুনিয়ে যেত। বলেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ফিকিরচাঁদের দলের গান খুব মাতিয়ে ছিল। তখন কাঙাল হরিনাথ ফিকিরচাঁদের দলের সঙ্গে আসতেন কিনা জানা যায় না। তবে ফিকিরচাঁদের দলটি তার শিষ্যদেরই গড়া। তারাই গান শোনাতে আসতেন। সেইসব গানের একটা সংকলন করেছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে।

কাঙাল হরিনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল কিনা জানা যায় না। কাঙালের গ্রামবার্তা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৩ সালে। ১৮৮৮ সালে পত্রিকাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ঠাকুরবাড়িতে গ্রামবার্তা প্রকাশিতা রাখা হত। দেবেন্দ্রনাথও পড়ে থাকবেন হয়তো। রবীন্দ্রনাথ যে সময়কালে শিলাইদহে জমিদারি পরিদর্শন বা জমিদারী পরিচালনা করতে এসেছেন তার বাবার আদেশে—সে সময়ে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকাটি প্রকাশ হত না। আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং যে পত্রিকাটি লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, সেখানে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে প্রজানীপিড়নের অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার অভিযোগ প্রকাশিত হওয়ার কোনো সুযোগ না থাকার কথা নয়।

রবীন্দ্রনাথ কাঙাল হরিনাথের লেখার ব্যাপারে কিছুটা উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। নায়েবকে পাঠিয়ে তিনি ধারে কাঙাল হরিনাথের কিছু বই কুমারখালির মথুরানাথ মুদ্রাযন্ত্র থেকে আনিয়েছিলেন। ঐ প্রেসের ১৩০০ সালে পত্রনকলের খাতায় একটা চিঠি আছে ঠাকুর-এস্টেটের নায়েবকে লেখা, কাঙাল হরিনাথের বড় ছেলে সতীশচন্দ্র মজুমদার বইয়ের দাম চেয়ে এই তাগাদা পত্র লেখেন, তাতে উল্লেখ ছিল কি কি বই কতো দাম ইত্যাদি। এ থেকে বোঝা যায় কাঙাল হরিনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা না হলেও তাঁর লেখালেখির ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ উদাসীন ছিলেন না।

মুনতাসীর মামুন উনিশ শতকের বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্রে গ্রন্থের দশম খণ্ডে লিখেছেন—১৮৫৭ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিসাব অনুযায়ী বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সংবাদ-সাময়িকপত্রের সংখ্যা মোট ৯০৫টি। এর মধ্যে পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৮০টি। কিন্তু, এছাড়াও খোঁজ পাওয়া গেছে আরো ৯৭টি সংবাদ সাময়িকপত্রের। ফলে উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত সংবাদ সাময়িকপত্রের সংখ্যা মোট ২৭৭টি বলে ধরে নিতে পারি। সে সময় ছিল বাংলাদেশ বনে জঙ্গলে ঢাকা, এবং বহির্বিশ্বে কেন, বাংলাদেশেরই অনেক অঞ্চলের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না। সুতরাং সে সময়ে সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশ হওয়াটাই ছিল অভাবনীয় ঘটনা।

কুষ্টিয়ার কুমারখালি থেকে হরিনাথ বের করতেন গ্রামবার্তা প্রকাশিকা—যশোরের এক গ্রাম থেকে শিশিরকুমার ঘোষ বের করতেন অমৃতবাজার পত্রিকা। হরিনাথ মজুমদার লিখেছিলেন, 'দেশীয় জমিদারগণ পূর্বের ন্যায় অত্যাচার করেন না একথা আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু মফস্বলে এখনও যে প্রকার অত্যাচার লক্ষিত হয়, তাহা অল্প নহে।' কোনও কোনও প্রদেশের প্রজারা যে মধ্যে মধ্যে জমিদারের অবাধ্য হইয়া ওঠে, সেই দোষ প্রজার নহে।' (জুলাই, ১৮৭২ খ্রীস্টাব্দ, গ্রামবার্তা প্রকাশিকা)।. তবে, একই সঙ্গে জমিদারি ব্যবস্থার উপর যেন কারো হামলা না আসে সে ব্যাপারেও সে সময়কার পত্রিকার সম্পাদকগণ সচেতন ছিলেন। মধ্যশ্রেণীর প্রতিনিধ হিসাবে বিদ্যমান ব্যবস্থার সমর্থনে হরিনাথ লিখেছিলেন, জমিদারি প্রজাদিগের পিতামাতা স্বরূপ ও সহায় সম্পদ (জুলাই, ১৮৬৯ খ্রীস্টাব্দ)।. শিশিরকুমার লিখেছিলেন, অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমরা প্রাণপণে জমিদারদিগের পক্ষ সমর্থন করিয়া থাকি। পাশাপাশি এও লিখেছেন অমৃতবাজার পত্রিকায়, অধিকাংশ জমিদারই প্রজার উপর নিপীড়ন করেন ও তাহাদের সর্বস্ব শোষণ করিয়া লন। এর কারণ  হিসাবে মুনতাসীর মামুনের মন্তব্য হল—পাশ্চাত্যের মানবতাবাতী ধারা ও ভারতীয় অভিভাবকবাদ ভাবধারার মিশ্রণে , উনিশ শতকে শিক্ষিত বাঙালির মনে যে ধারার সৃষ্টি হয়েছিল, সম্পাদকরা তার বাইরে ছিলেন না। এর অর্থ, প্রজার উপর জমিদারের অত্যাচার মেনে নিতে তার বিবেকে বাধে, তিনি তাই প্রজার পক্ষে লেখেন, কিন্তু অন্তিমে জমিদারের সঙ্গে প্রজার সংঘাত বাঁধলে, ঔপনিবেশিক কাঠামোর জমিদারের সঙ্গে তার আঁতাত সৃষ্টি হয়। আর প্রজা হয়ে ওঠে নিয়তিবাদি, যার শাসকের কাছে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। কারণ সে সময়কার সংবাদপত্রের সম্পাদকদের মতো প্রজাও জানে, নীলকরদের চেয়ে জমিদার অপেক্ষাকৃত ভালো। জমিদাররা ইংরেজদেরই সৃষ্টি। তাদের নির্দেশেই তারা চলে।  নীলকররা যখন প্রজাদের সকল কিছু হরণ করতে নিয়ে যায়, তখন দেশীয় জমিদাররাই নীলকরদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষায় এগিয়ে আসে। দেবেন্দ্রনাথও এসেছিলেন। তিনি নীলকর কেনী সাহেবকে তার জমিদারি  ইজারা দেন নি প্রজাদের অনুরোধ।

অষ্টাবিংশ পর্ব

প্রজানীপিড়ন খণ্ড : ছয়

১৮৯১ সালে শিলাইদহে কুঠিবাড়িতে পূণ্যাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। পূণ্যাহ অনুষ্ঠানে জমিদার বা তার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে প্রজারা খাজনা দেয়। সেদিন তারা সাধ্যমত ধোপদুরস্ত পোষাকে জমিদারের সামনে আসে। তাদেরকে মিষ্টি মুখ করানো হয়। কখনো কখনো ভোজেরও আয়েজন করা হয়।

সেদিন প্রজারা এসেছে ভোরবেলা কুঠিবাড়িতে। পূণ্যাহর আয়োজন সমাপ্ত। বন্দুকের আওয়াজ রোশনচৌকি হুলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনিতে কাছারি মুখরিত। রবীন্দ্রনাথ তখন বাবুমশাই। ধূতি পাঞ্জাবী চাদর পরে তিনি কাছারিতে নেমে এলেন। প্রথামত পূণ্যাহর শুরুতে ব্রাহ্মসমাজের আচার্য্যের প্রার্থনা—পরে হিন্দুমতে পূজা। পুরোহিত বাবুমশাইয়ের কপালে এঁকে দিলেন চন্দনের তিলক। তখন তিনি নতুন কাপড় চাদর দই মাছ ও দক্ষিণা দান করবেন পুরোহিত এবং পরেই প্রজাদের করদান পর্ব শুরু হবে।

অমিতাভ চৌধুরী 'জমিদার রবীন্দ্রনাথ : শিলাইদহ পর্বে' লিখেছেন,  দ্বারকানাথের আমল থেকে সম্ভ্রম ও জাতবর্ণ অনুযায়ী পূণ্যাহ অনুষ্ঠানে থাকে বিভিন্ন ধরনের আসনের বন্দ্যোবস্ত। হিন্দুরা চাদর-ঢাকা সতরঞ্জির উপর এক ধারে, তার মধ্যে ব্রাহ্মণের স্থান আলাদা। মুসলমান প্রজাদের জন্য চাদর ছাড়া সতরঞ্জির উপর-অন্যধারে। সদর ও অন্য কাছারির কর্মচারীরা নিজ নিজ পদমর্যাদাঅনুসারের বসেন পৃথক পৃথক স্থানে। আর জমিদার বাবুমশাইয়ের জন্য ভেলভেট মোড়া সিংহাসন। এখানে বৈষম্যপূর্ণ জাতপাতের চূড়ান্ত ব্যবস্থা করা হয়।

বাবুমশাই রবীন্দ্রনাথ এই বৈষম্যপূর্ণ আসন ব্যবস্থা মানলেন না। তিনি নায়েব মশাইকে বললেন, পূণ্যাহ জমিদার ও প্রজার মিলন অনুষ্ঠান। সুতরাং এই শুভ দিনে সকলের আসনেও মিলন থাকতে হবে। তিনি নায়েবকে বললেন, সব আসন তুলে দিন। হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল সবার জন্য একই ধরনের আসনের ব্যবস্থা করুন।

নায়েব মশাই এ প্রথার দাস। তিনি নতুন বাবুমশাইকে বললেন, আনুষ্ঠানিক দরবারের প্রাচীন রীতিটি বদলানোর অধিকার কারো নেই। রবীন্দ্রনাথ আরো স্পষ্ট করে তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন , আমি বলছি তুলে দিতে হবে। এ রাজ-দরবার নয়, মিলনানুষ্ঠান।

সদর নায়েবের সেই একই জবাব, অসম্ভব। এ নিয়ম ভাঙা চলবে না।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জানেন এ প্রাচীন প্রথা বদলে যাওয়ার ইতিহাস আছে ঠাকুর পরিবাবেই। দ্বারকানাথের সময়ে ব্রাহ্মধর্মই ছিল না এখানে। দ্বারকানাথ ছিলেন আচারসর্বস্ব হিন্দু। সুতরাং তার সময়ে পূণ্যাহর দিনে ব্রাহ্মসমাজের আচার্য্যের প্রার্থনা বিষয়টি  ছিল না। সেটা দেবেন্দ্রনাথ জমিদারী নেওয়ার পরে পুরনো প্রথার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। তিনি প্রথার বদল করেছিলেন।  রবীন্দ্রনাথ হাসলেন। প্রথার মধ্যেই প্রথা ভাঙার বিষয় আছে। সেটা তিনি জানেন।

উপস্থিত সকলে স্তম্ভিত, বিস্মিত। নতুন বাবুমশায়ের আচরণে কারো মুখে কথা নেই। সদর নায়েব মশাই রবীন্দ্রনাথকে বললেন, সিংহাসনে বসুন।

রবীন্দ্রনাথ জানিয়ে দিলেন, আসনের জাতিভেদ দূর না করলে তিনি কিছুতেই বসবেন না। সাধারণ দরিদ্র প্রজার অপমান তিনি সহ্য করবেন না।

নায়েব বলল, আপনাকে প্রথার বাইরে যাওয়া যাবে না।

তিনি নায়েব মশায়কে ক্রুদ্ধ কণ্ঠ বললেন, প্রথা আমি বুঝি না। সবার একাসনে বসতে হবে। জমিদার হিসাবে এই আমার প্রথম হুকুম।

নায়েব তখন ঘোষণা করলেন, প্রথার পরিবর্তন ঘটালে তারা একযোগে পদত্যাগ করবেন। রবীন্দ্রনাথ অবিচলিত। তিনি উপস্থিত প্রজামণ্ডলীকে উদ্দেশ্য বললেন, এই মিলন উৎসবে পরস্পরে ভেদ সৃষ্টি করে মধুর সম্পর্ক নষ্ট করে দেওয়া চলবে না। প্রিয় প্রজারা, তোমরা সব পৃথক পৃথক আসন, পৃথক ব্যবস্থা—সব সরিয়ে দিয়ে একসঙ্গে বসো। আমিও বসব। আমি তোমাদেরই লোক।

অপমানিত নায়েব-গোমস্তার দল পদত্যাগ করলেন। তারা সবিস্ময়ে দূরে দাঁড়িয়ে দেখলেন, রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে হিন্দু-মুসলমান প্রজারা প্রকাণ্ড হল ঘরের সব চাদর সব চেয়ার নিজেরাই সরিয়ে দিয়ে ঢালা হল ফরাসের উপর বসে পড়ল। মাঝখানে বসলেন রবীন্দ্রনাথ।

তার পর তিনি প্রজাদের ডেকে বললেন, যাও, সদর নায়েব আর আমলাদেরদের ডেকে আনো। সবাই একসঙ্গে বসে পুণ্যাহ উৎসব করি। রবীন্দ্রনাথ আমলাদের অনুরোধ করলেন পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে। উৎসব শুরু হল। দলে দলে আরো লোক কাছারিবাড়িতে এসে এসে ভেঙে পড়ল। এবং সেদিন থেকে ঠাকুর এস্টেটের পুণ্যাহ সভায় শ্রেণীভেদেরদের ব্যবস্থা উঠে গিয়েছিল।

এই ব্যবস্থা পরবর্তীকালেও রবীন্দ্রনাথ চালু রেখেছিলেন।

এই ঘটনাটি ফলে তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। প্রথমত, প্রজাদের মনে রবীন্দ্রনাথ জমিদারীর প্রচলিত প্রভুত্বমার্কা ভাবমূর্তিটি ভেঙে ফেলতে সক্ষম হলেন। তিনি তাদের লোক হয়ে উঠলেন। দরিদ্র প্রজারা বুঝতে পারল, তাদের দুঃখের দিন ঘোচার লগ্ন উপস্থিত হয়েছে।

আমলারা বুঝতে পারল তাদের দুঃসময় শুরু হয়েছে। তাদের চোখ দিয়ে জমাদারকে সব কিছু দেখতে হবে এই ব্যবস্থার বদল এসেছে—এই নতুন জমিদার নিজের চোখে দেখেন। শুধু দেখেন না,  অসঙ্গত বিষয় বদলে দেওয়ার জন্য নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কঠিন করে।  ফলে আমলাদের ভেতরে রবীন্দ্রবিরোধিতার বীজ রোপিত হল।

আর রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন, তার সামনে কঠিন পরীক্ষা।  সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরো সংকল্পবদ্ধ হলেন, আরো স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, এখানে তাঁকে কি করতে হবে, কিভাবে  অগ্রসর হতে হবে এবং প্রতিপদে বাধা আসবে কোন পক্ষ থেকে।

১৮৯৬ সালে অমৃত বাজার পত্রিকার একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, নড়াইলের জমিদার আমলাদের এই দৌরাত্ম্য সহ্য করতেন না। তারা যদি প্রজাদের উপর পীড়ন করত—সে অভিযোগ শোনা মাত্র জমিদার তাদেরকে চাকরীচ্যূত করতেন। এই জমিদার কিন্তু রায় বাহাদুর বা খানবাহাদুর কোন পদকই পান নি বৃটিশ রাজের কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথ সেটা করেন নি। তিনি সবার ভেতর থেকে বদলে দেওয়ার ধারণাটি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে সদর কাছারিতে কাজ করতে এসেই সেরাস্তার কাগজ পত্রের নানা ঝামেলা দেখতে পাচ্ছিলেন। এই কাগজপত্রে গোলমালের সূত্র ধরেই তাদেরকে নিপীড়নের সুযোগ নিত নায়েব-গোমস্তারা।  এই নিপীড়নের জন্য প্রজা-অসন্তোষের সৃষ্টি হত। রবীন্দ্রনাথের আগে দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, গণেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গুনেন্দ্রনাথ, দ্বিপেন্দ্রনাথ পার্যায়ক্রমে জমিদারী পরিচালনা করলেও তাঁরা কিন্তু কেউই এই কাগজপত্রের শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করেন নি। সবাই আমলাদের ব্যবস্থাই মেনে নিয়েছেন। আমলার উপর ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত থেকেছেন। আমলাদের চোখ দিয়েই সব কিছু দেখতে অভ্যস্ত হয়েছেন।  রবীন্দ্রনাথ গোড়ায় এসে এই গলদটি দুর করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করে দুই মাস প্রচেষ্টায় সেই কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন। ১৮৯১ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখে শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি জানান–

আমাদের বিরাহিমপুরের সেরেস্তা সবচেয়ে বিশৃঙ্খল—আমি আজ মাস দু'এর অধিককাল এটাকে আয়ত্ত করার চেষ্টায় আছি। এখনো পেরে উঠলুম না। এককালে এই পরগণা নীলকরদের ইজারাধীন ছিল। সেই সময়ে তারা অনাদরে কাগজপত্র সমস্ত নষ্ট করে বসে আছে। সেই অবধি এ পর্যন্ত গোলমাল চলেই আসছে।

'শ্রীনিকেতনের ইতিহাস ও আদর্শ' নামে এক কথিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, আমি শহরের মানুষ, শহরে আমার জন্ম। আমার পূর্বপুরুষরা কলকাতার আদিম বাসিন্দা। পল্লীগ্রামের কোনো স্পর্শ আমি প্রথম-বয়সে পাই নি। এইজন্য যখন প্রথম আমাকে জমিদারির কাজে নিযুক্ত হতে হল তখন মনে দ্বিধা উপস্থিত হয়েছিল, হয়তো আমি এ কাজ পারব না, হয়তো আমার কর্তব্য আমার কাছে অপ্রিয় হতে পারে। জমিদারির কাজকর্ম, হিসাবপত্র, খাজনা-আদায়, জমা-ওয়াশীল—এতে কোনোকালেই অভ্যস্ত ছিলুম না; তাই অজ্ঞতার বিভিষিকা আমার মনকে আচ্ছন্ন করেছিল। সে অঙ্ক ও সংখ্যার বাঁধনে জড়িয়ে পড়েও প্রকৃতিস্থ থাকতে পারব এ কথা ভাবতে পারি নি।

কিন্তু কাজের মধ্যে যখন প্রবেশ করলুম, কাজ তখন আমাকে পেয়ে বসল। আমার স্বভাব এই যে, যখন কোনো দায় গ্রহণ করি তার মধ্যে নিজেকে নিমগ্ন করে দিই, প্রাণপণে কর্তব্য সম্পন্ন করি, ফাঁকি দিতে পারি নে। এক সময় আমাকে মাস্টারি করতে হয়েছিল, তখন সেই কাজ সমস্ত মন দিয়ে করেছি, তাতে নিমগ্ন হয়েছি এবং তার মধ্যে আনন্দ পেয়েছি। যখন আমি জমিদারির কাজে প্রবৃত্ত তখন তার জটিলতা ভেদ করে রহস্য উদ্ঘাটন করতে চেষ্টা করেছি।। আমি চিন্তা করে যে-সকল রাস্তা বানিয়েছিলুম তাতে আমি খ্যাতি লাভ করেছিলুম। এমন-কি, পার্শ্ববর্তী জমিদারেরা আমার কাছে তাঁদের কর্মচারী পাঠিয়ে দিতেন কী প্রণালীতে আমি কাজ করি তাই জানবার জন্য।

আমি কোনোদিন পুরনো বিধি মেনে চলি নি। এতে আমার পুরাতন কর্মচারীরা বিপদে পড়ল। তারা জমিদারীর কাগজপত্র এমনভাবে রাখত যা আমার পক্ষে দুর্গম। তারা আমাকে যা বুঝিয় দিত তাই বুঝতে হবে, এই তাদের মতলব। তাদের প্রণালী বদলে দিলে কাজের ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, এই ছিল তাদের ভয়। তারা আমাকে বলত যে, যখন মামলা হবে তখন আদালতে নতুন কাগজপত্র গ্রহণ করবে না, সন্দেহের চোখে দেখবে। কিন্তু যেখানে কোনো বাঁধা সেখানে আমার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, বাঁধা আমি মানতে চাই নে। আমি আদ্যোপান্ত পরিবর্তন করেছিলুম, তাতে ফলও হয়েছিল ভালো।

আরেকটা কাজ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জমিদারের সঙ্গে প্রজার দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের জন্য তাঁর দরোজা খুলে দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন ঐ কথিকায়—প্রজারা আমাকে দর্শন করতে আসত, তাদের জন্য সর্বদাই আমার দ্বার ছিল অবারিত—সন্ধ্যা হোক, রাত্রি হোক, তাদের কোনো মানা ছিল না। এক-এক সময সমস্তদিন তাদের দরবার নিয়ে দিন কেটে গেছে, খাবার সময় কখন অতীত হয়ে যেত টের পেতেম না। আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে এ কাজ করেছি। যে ব্যক্তি বালককাল  থেকে ঘরের কোণে কাটিয়েছে, তার কাছে গ্রামের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কিন্তু কাজের দুরূহতা আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে, উৎসাহিত করেছে, নূতন পথনির্মাণের আনন্দ আমি লাভ করেছি।

কেন এই কাজগুলো তিনি করেছেন তার একটি বিবরণী দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রে—

তারিখ ১০ মে, ১৮৯৩, শিলাইদহ

আমার এই দরিদ্র চাষীগুলোকে দেখলে আমার ভারী মায়া করে। এরা যেন বিধাতার শিশু সন্তানের মতো নিরুপায়। তিনি তাদের মুখে নিজের হাতে কিছু তুলে না দিলে এদের আর গতি নেই। পৃথিবীর স্তন যখন শুকিয়ে যায় তখন এরা কেবল কাঁদতে জানে—কোনোমতে একটুখানি ক্ষুধা ভাঙলেই আবার সমস্ত ভুলে যায়। সোসিয়ালিস্টরা যে সমস্ত পৃথিবীময় ধন বিভাগ করে সেটা সম্ভব কি অসম্ভব ঠিক জানি নে—যদি একেবারেই অসম্ভব হয় তা হলে বিধির বিধান বড়ো নিষ্ঠুর, মানুষ ভারি হতভাগ্য। কেননা, পৃথিবীতে যদি দুঃখ থাকে তো থাক, কিন্তু তার মধ্যে এতটুকু ছিদ্র একটু সম্ভাবনা রেখে দেওয়া উচিৎ যাতে সেই দুঃখ মোচনের জন্য মানুষের উন্নত অংশ অবিশ্রাম চেষ্টা করতে পারে। একটা আশা পোষণ করতে পারে। যারা বলে কোনোকালেই পৃথিবীর সকল মানুষকে জীবনধারনের কতকগুলি মূল আবশ্যক জিনিসও বণ্টন করে দেওয়া নিতান্ত অসম্ভব অমূলক কল্পনাপ্রসূত, কখনোই সকল মানুষ খেতে-পরতে পারে না, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ চিরকালই অর্ধাশনে কাটাবেই, এর কোনো পথ নেই—তারা ভারি কঠিন কথা বলে। কিন্তু এ-সমস্ত সামাজিক সমস্যা এমন কঠিন, বিধাতা আমাদের এমনি একটি ক্ষুদ্র জীর্ণ বস্ত্রখণ্ড দিয়েছে, পৃথিবীর একদিকে ঢাকতে গিয়ে আর-এক দিক বেরিয়ে পড়ে—দারিদ্র্য দূর করতে গেলে ধন চলে যায়, এবং ধন গেলে সমাজের  কত যে শ্রীসৌন্দর্য উন্নতির কারণ চলে যায় তার আর সীমা থাকে না।

শ্রীনিকেতনের কথিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, যতদিন পল্লীগ্রামে ছিলেম ততদিন তাকে তন্ন তন্ন করে জানবার চেষ্টা আমার মনে ছিল। কাজের উপলক্ষ এক গ্রাম থেকে আর-এক দূর গ্রামে যেতে হয়েছে, শিলাইদা থেকে পতিসর, নদী-নালা-বিলের মধ্য দিয়ে—তখন গ্রামের বিচিত্র দৃশ্য দেখেছি। পল্লীবাসীদের দিনকৃত্য, তাদের জীবনযাত্রার বিচিত্র চিত্র দেখে প্রাণ ঔৎসৃক্যে ভরে উঠত। আমি নগরে পালিত, এসে পড়লুম পল্লীশ্রীর কোলে, মনের আনন্দে কৌতুহল মিটিয়ে দেখতে লাগলুম। ক্রমে এই পল্লীর দুঃখদৈন্য আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল, তার জন্যে কিছু করব এই আকাঙ্ক্ষায় আমার মন ছটফট করে উঠেছিল। তখন আমি যে জমিদারি-ব্যবসায় করি, নিজের আয়-ব্যয নিয়ে ব্যস্ত, কেবল বনিক-বৃত্তি করে দিন কাটাই, এটা নিতান্তই লজ্জার বিষয় মনে হয়েছিল। তার পর থেকে চেষ্টা করতুম—কী করলে এদের মনে উদ্বোধন হয়, আপনাদের দায়িত্ব এরা আপনি নিতে পারে। আমরা যদি বাইরে থেকে সাহায্য করি তাতে এদের অনিষ্টই হবে। কী করলে এদের মধ্যে জীবনসঞ্চার হবে, এই প্রশ্নই তখন আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। একেই রবীন্দ্রনাথ আত্মশক্তির উদ্বোধন বলেছেন।

এর মধ্যে নিজের অবস্থান সম্পর্কেও তার মিথ্যা মোহ ছিল না। ছিল না মানুষ সম্পর্কে ভুল ধারণা। তিনি লিখেছেন আত্মসমালোচনার ঢংএ—

…অন্তরের মধ্যে আমিও যে এদেরই মতো দরিদ্র সুখদুঃখ কাতর মানুষ, পৃথিবীতে আমারও কত ছোট ছিট বিষয়ে দরবার, কত সমান্য কারণে মর্মান্তিক কান্না, কত লোকের প্রসন্নতার উপরে জীবনের নির্ভর। এই সমস্ত ছেলেপিলে-গোরুলাঙ্গল-ঘরকন্না-ওয়ালা সরল হৃদয় চাষাভূষোরা আমাকে কী ভুলই না জানে।! আমাকে এদের সমজাতি মানুষ বলেই জানে না। …আমাকে এখানকার প্রজারা যদি ঠিক জানত, তাহলে আপনাদের একজন বলে চিনতে পারত।

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ঊনত্রিংশ পর্ব

মুসলমান খণ্ড–১

—————–

১৯৩১ সালে ৬ সেপ্টেম্বর হেমন্তবালা দেবীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ একটি ঘটনা উল্লেখ করেছিলেন।

…একদিন আমার একজন মুসলমান প্রজা অকারণে আমাকে এক টাকা সেলামী দিয়েছিল। আমি বললুম, আমি তো কিছু দাবী করি নি। সে বললে, আমি না দিলে তুই খাবি কি। কথাটা সত্য। মুসলমান প্রজার অন্ন এতকাল ভোগ করেছি। তাদের অন্তরের সঙ্গে ভালবাসি, তারা ভালবাসার যোগ্য।

এ চিঠিতে তিনটি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ১. মুসলমান প্রজাদের অন্ন তিনি ভোগ করেছেন—এটা রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করেছেন অকুণ্ঠ চিত্তে। ২. মুসলমান প্রজারা তাকে ভালোবাসে। ৩. রবীন্দ্রনাথ মুসলমান প্রজাদের অন্তরের সঙ্গে ভালোবাসেন। এ ভালোবাসার কারণ তার এই মুসলমান প্রজারা ভালোবাসার যোগ্য।

পূর্ববঙ্গে আসার আগে মুসলমানদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গভীর পরিচয় ছিল না।  ছেলেবেলায় হিন্দুমেলায় মুসলমান বয়াতির গান শুনেছেন।  রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,  তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ ফারসি কবি হাফিজের অনুরাগী ছিলেন। ছেলেবেলায় বাবার কাছে হাফিজের কবিতার শুনতেন। দেবেন্দ্রনাথ ফারসি ভাষা জানতেন। তিনি মূল ফারসিতে আবৃত্তি করতেন। সঙ্গে সেগুলোর বাংলা অনুবাদ শোনাতেন। সে কবিতার মাধূর্য বালকের হৃদয়ে প্রবেশ করেছিল। তিনি বলেছেন, কবিতা পারসিক হলেও তার বানী সব মানুষের। ১৯৩২ সালে ইরানে গিয়েছিলেন কবি। হাফিজের সমাধির পাশে সমবেত কবিদের বলেছিলেন, এই ফারসি সুধা তার বাবাকে জীবনান্তকাল পর্যন্ত সান্ত্বনা দিয়েছে।

এ সূত্রেই ঠাকুর পরিবারে উদার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পড়েছেন ফারসী, আরবী, তুর্কী সাহিত্য। জেনেছেন ইসলামী দর্শন, ইতাহাস, ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে। তিনি জেনেছেন—ঈশ্বর এক। তার মধ্যে কোনো ভেদ নেই। তিনি সকল বর্ণের। সকল জাতির। এবং জীবনের একটা পর্যায়ে এসে তিনি অনুভব করেন—পূর্ববঙ্গে নতুন করে পাওয়া প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবনের বিশালতা তার ভাবজগতে পরিবর্তন এনেছে—তার ধর্মচিন্তা, রাজনৈতিক ভাবনা, দর্শন তত্ত্ব, সাহিত্যবোধ, জীবনবোধ পাল্টে গেছে। তার ভেতরের মানুষটার পুরনো বাবুপরিবারের পুরনো খোলসটা ১৮৯১ সালে শিলাইদহে যাওয়ার পরে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়েছে। তিনি ভেবেছেন শুধু ভাবজগতের এই খোলস বদলের সঙ্গে তার বহিরাঙ্গের পোষাকটিরও বদল হওয়া দরকার।  পোষাকটি হিন্দুরও নয়—মুসলমানেরও নয়। খ্রীস্টান বা বৌদ্ধেরও নয়। বাউলদের আদলে করা হয়েছিল এই আলখেল্লা নামের পোষাকটি। করেছিলেন প্রিয় ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পোষাকটি আর পাল্টান নি– সারা জীবন ধরে পরেছেন।

একটি ঘটনা জানা যাচ্ছে ১৯১১ সালের নভেম্বরের। শান্তি নিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ে একজন মুসলমান ভদ্রলোক তাঁর পুত্রকে ভর্তি করার প্রস্তাব দেন। রবীন্দ্রনাথ সে সময়ে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রবন্ধে হিন্দু ও মুসলমানকে সমীপবর্তি করার যে পরামর্শ দিচ্ছিলেন তাকেই বাস্তব রূপ দেবার এই সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে তিনি ঐকান্তিক আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি মুসলমান ছেলেটিকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করে নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। সে সময় বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথ ছিলেন শান্তিনিকেতনের অন্যতম ট্রাস্টি। তার কাছ থেকে বাঁধা আসার আশঙ্কা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ২৬ অক্টোবর কলকাতা থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষক নেপালচন্দ্রকে একটি চিঠি লিখে তাঁকে ভর্তি করে নেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু নেপালচন্দ্রের নিকট থেকে  অনুকুল উত্তর পান নি। সে সময়কার ছাত্র-শিক্ষক ও দিপেন্দ্রনাথনাথ ছেলেটিকে ভর্তি না করার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। তখন রবীন্দ্রনাথ নেপালচন্দ্রকে ২ নভেম্বর ১৯১১ সালে আরেকটি  চিঠি লেখেন—

মুসলমান ছাত্রটির সঙ্গে একজন চাকর দিতে তাহার পিতা রাজী। অতএব এমন কি অসুবিধা, ছাত্রদের মধ্যে এবং অধ্যাপকদের মধ্যেও যাহাদের আপত্তি নাই তাঁহারা তাহার সঙ্গে খাইবেন। শুধু তাই নয়—সেই সকল ছাত্রের সঙ্গেই ঐ বালকটিকে রাখিলে সে নিজেকে নিতান্ত যুথভ্রষ্ট বলিয়া অনুভব করিবে না। একটি ছেলে  লইয়া পরীক্ষা সুরু করা ভাল অনেকগুলি ছাত্র লইয়া তখন যদি পরিবর্ত্তন আবশ্যক হয়, সহজ হইবে না। আপাতত শাল বাগানের দুই ঘরে নগেন আইচের তত্ত্বাবধানে আরো গুটি কয়েক ছাত্রের সঙ্গে একত্র রাখিলে কেন অসুবিধা হইবে বুঝিতে পারিতেছি না। আপনারা মুসলমান রুটিওয়ালা পর্য্যন্ত চালাইয়া দিতে চান, ছাত্র কি অপরাধ করিল? এক সঙ্গে হিন্দু মুসলমান কি এক শ্রেণীতে পড়িতে বা একই ক্ষেত্রে খেলা করিতে পারে না?…প্রাচীন তপোবনে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খাইত, আধুনিক তপোবনে যদি হিন্দু মুসলমানে একত্রে জল না খায় তবে আমাদের সমস্ত তপস্যাই মিথ্যা। আবার একবার বিবেচনা করিবেন ও চেষ্টা করিবেন যে আপনাদের আশ্রমদ্বারের আসিয়াছে তাহাকে ফিরাইয়া দিবেন না—যিনি সর্ব্বজনের একমাত্র ভগবান তাহার নাম করিয়া প্রসন্ন মনে নিশ্চিন্ত চিত্তে এই বালককে গ্রহণ করুন; আপাতত যদিবা কিছু অসুবিধা ঘটে সমস্ত কাটিয়া গিয়া মঙ্গল হইবে।

রবীন্দ্রনাথের এই চেষ্টা সত্ত্বেও শান্তি নিকেতনে বালকটিকে সে সময়ে ভর্তি করানো সম্ভব হয় নি। কিন্তু দশ বছর পরে বিদ্যালয়ের বিশ্বভারতী পর্বে সৈয়দ মুজতবা আলী প্রথম মুসলিম ছাত্র হিসাবে ভর্তি হন।

১৮৯১ সালের লোক গণনার প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, নদীর শতকরা ৫৮ জন অধিবাসী ছিলেন মুসলমান। ৪২ জন হিন্দু। এর মধ্যে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে মুসলামানদের সংখ্যা তুলানামূলকভাবে বেশি ছিল। কৃষ্ণনগর ও রাণাঘাটে হিন্দুদের সংখ্যা বেশি ছিল। বর্ণভেদে নদীয়া জেলার হিন্দুদের সংখ্যার অনুপাতটি ছিল নিম্নরূপ—

কামার- ৮%, সদগোপ—৮%, কৈবর্ত—৬%, চামার—২.৭%, গোয়ালা—৫%, বাগদী—২%, তেলি—১.৫%, মালো—২.৩%, কুমোর—১%।. মোট—৩৫.৫০%

ব্রাহ্মণ—৩%, কায়স্থ—২%। .মোট—৫%।

এই শতকরা ৪২ জন হিন্দুর মধ্যে মাত্র ৫ জন ছিলেন ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ। ওরা ছিলেন তথাকথিত ভদ্রলোক। এরাই ছিলেন জমিদার, তালুকদার, আমলা, ব্যবসা-বানিজ্যের অধিকর্তা। এদের মধ্যে কায়স্থ শ্রেণীরাই ছিলেন ব্যবসায়ী। ঐ এলাকার যে মহাজন-সুদের কারবারী শোষণ শ্রেণী ছিল এই কায়স্থ বা সাহা শ্রেণীর অন্তর্গত। হিন্দুদের মধ্যে ৭.৬% ছিল শিক্ষিত। এই শিক্ষিত হিন্দুদের সিংহভাগই উচ্চবর্ণের। ব্রাহ্মণ—২৭.৫ জন। কায়স্থ—১৬.৪ জন এবং বৈদ্য ৩২ জন।

মুসলমানদের সিংহভাগই ছল দরিদ্র। শিক্ষার হারও ছিল মাত্র ১.৬ জন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে ৯০ শতাংশেরও বেশি অধিবাসী ছির দরিদ্র, অশিক্ষিত—নিম্নবর্ণজ, বৃত্তির দিক থেকেও নিম্নশ্রেণীর ও নিম্নবিত্তের। এরাই মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।

স্বল্প সংখ্যক শিক্ষিত ব্যক্তি ব্যতীত বিপুল জনতা তাদের কৌলিক বৃত্তিক উপর নির্ভরশীল। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে এই মানুষদের প্রায় সকলেই জমি থেকে তাদের জীবিকা উপার্জন করতেন। স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এ কথা সত্যি যে—এদের আয় ছিল অতি নগন্য।

শিলাইদহের অধিকাংশ চরের অধিবাসী ছিল মুসলমান। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—তারা খাজনা দিতে চাইত না। ফলে জমিদারের নায়েব-গোমস্তা-আমিনদের সঙ্গে তাদের ঝামেলা লেগেই থাকত। লাঠিয়ালরা এসে লাঠির ঘায়ে তাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের চেষ্টা করত। আবার মুসলমান প্রজারা তাদের রুখে দাড়াত। পাল্টা আঘাত করতে ভয় পেত না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন জমিদারীর দায়িত্ব নিয়ে এই এলাকায় এলেন—তিনি সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করলেন। তাদের কাছে গেলেন। তাদের বশ করলেন—লাঠির আঘাত দিয়ে নয়—ভালোবাসা দিয়ে, মমতা দিয়ে, সহানুভূতি দিয়ে। ন্যায়-নীতি ও মানবিকতা বোধ দিয়ে। তিনি আস্থা অর্জন করেছিলেন সকল শ্রেণীর বর্ণের ধর্মের সম্প্রদায়ের মানুষের। শিলাইদহের চরের বিদ্রোহী প্রজাদের সর্দার ইসমাইল মোল্লা রবীন্দ্রনাথের শালিসী খুশী মনে মেনে নিয়েছেন। মুসলমান প্রধান কালিগ্রামের সব প্রজা জমিদারের সঙ্গে তাদের মধ্যেকার স্বার্থ ভাগ করে নিয়েছে। এর আগে এই কাজটি ঠাকুর-এস্টেটের কোনো ম্যানেজার করতে পারেন নি। কখনো কখনো তারা সমস্যারটির সমাধান না করে জিঁইয়ে রেখেছেন।

ছিন্নপত্রের একটি চিঠিতে দেখা যাচ্ছে ইন্দিরাকে তিনি লিখেছেন –একদিন তিনি পতিসরের মাঠে গিয়েছেন। সেদিন একজন অতিশয় দরিদ্র প্রজা তাঁর পায়ের ধূলো নিতে এসেছে। প্রজাটি অসুস্থ। অসুস্থতা নিরাময়ের জন্য তিন ধরে উপবাস করছে। তার ধারনা—এই অন্যরকম জমিদারের পায়ের ধূলো নিলে তার অসুখ সেরে যাবে। এটা তার গভীর বিশ্বাস। অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন– রবীন্দ্রনাথ কালিগ্রামের  মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে কফিলুদ্দিন বা জালালুদ্দিন শেখের সঙ্গে ধান ফসলের পোকামাকড় মারার কৌশল নিয়ে আলাপ করছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

পূর্ববঙ্গে জমিদারী পরিচালনা করার সময়ে তিনি অধিকাংশ সময়ই নদীর উপরে বজরা বোটে থাকতে পছন্দ করতেন। তার বজরার প্রধান মাঝির নাম ছিল মেছের আলি। আর মুসলমান বাবুর্চির রান্না তিনি খেতেন। বাবুর্চির নাম ছিল গফুর। কুঠিবাড়ির বাবুর্চির নাম ছিল মোমিন মিঞা। মোমিন মিঞার নাম  তিনি নাটকেও লিখেছেন।

আবুল আহসান চৌধুরী ডঃ আহমদ শরীফকে ১৮৯৫ সালে চিঠিতে লিখেছিলেন, চরের মুসলমান প্রজাদের উচ্ছেদ করে সেখানে নমশুদ্র প্রজা বসানোর পরিকল্পনাটা রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকেই বের হয়েছিল। তিনি এই হীনপরিকল্পনাটির কোনো প্রমাণ সেখানে দেন নি। বা তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেন নি।  কিন্তু ২০১১ সালে সেই আবুল আহসান চৌধুরীই সেই পুরণো চিঠিটির হীনপরিকল্পনাটিকে  নাকচ করেছেন। তিনি বিস্তারিত প্রমাণ, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ  লিখেছেন—মুসলমান প্রজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়-গভীর-আত্মিক।..তিনি এদেরকে এতটাই  বশ করেছিলেন যে,  যখন শিলাইদহের জমিদারী রবীন্দ্রনাথের হাতছাড়া হয়ে গেছে, নতুন মালিক তাঁর ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর—রবীন্দ্রনাথকে আসতে হলো চরের অধিবাসী মুসলমান প্রজারা আবার বিদ্রোহী হয়েছে বলে।

১৯২০ সালে ঠাকুর এস্টেটের জমিদারী ভাগ হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাতের ভাগে পড়ে কালিগ্রাম জমিদারী। শিলা্ইদহ-সাহাজাদপুরের বিরাহিমপুর পরগণার জমিদারী অংশটি পড়ে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগে। ফলে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় শিলাইদহ ও পদ্মা আর তাঁর নিজের রইল না। সুরেন্দ্রনাথও জমিদারী পরিচালনা করতে আসেন নি। তিনি নায়েব-গোমস্তাদের হাতে জমিদারী ছেড়ে দেন। ফলে প্রজা অসন্তোষ দেখা দেয়। আরও পরে সুরেন্দ্রনাথ সে জমিদারী রক্ষা করতে পারেন নি। সুরেন্দ্রনাথ ভাগ্যকুলের কুণ্ডু পরিবারের কাছে এই সম্পত্তি বেঁচে দেন।

রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালে শেষবারের মতন এলেন এই চরের প্রজাদের মনের-মতের পরিবর্তন ঘটানোর জন্যে। তাদের যে অসন্তোষ, তারা যে জমিদারকে মানতে চাচ্ছে না বা সুরেন ঠাকুরের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক যে খুব ভালো হয়ে উঠছে না, সেটা মেটানোর জন্যে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন।

২৩ মার্চ ১৯২২ তারিখে রাত্রের ট্রেনে করে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আ্যান্ডরুজকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে রওনা হন। ২৪ মার্চ শিলাইদহে পৌঁছান।  প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন– শিলাইদহে এসে তার ভালো লাগছে। এদিন তিনি রচনা করলেন পূর্বাচলের পানে তাকাই গানটি। মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে গানটি পাঠিয়ে তিনি লিখেছেন—পুরনো শিলাইদহে এসে মনটা কেমন ঢিলে হয়ে গেচে। কর্তব্য জগতের বিপুল যে-একটা ভারাকর্ষণ ছিল সেটা ফস করে আমার চারদিক থেকে খসে পড়েছে। গুরুতর দ্বায়িত্ব বলে যে সমস্ত পদার্থকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতুম হঠাৎ তাদের কথা মনে করে হাসি পাচ্ছে। এটা তার শিলাইদহে শেষ আগমন। তিনি ২৫ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত চারটি গান লেখেন। আসা-যাওয়ার পথের ধারে, কার যেন এই মনের বেদন, নিদ্রাহারা রাতের এ গান, এক ফাগুনের গান সে আমার।

শিলাইদহকে তিনি মন থেকে ভালো বেসেছিলেন। এটা তাঁর হাত থেকে চলে যাওয়ায় বেদনা পেয়েছিলেন। ৫ এপ্রিল ১৯২২ তারিখে রাণু অধিকারীকে একটি চিঠি লেখেন শিলাইদহ থেকে–

আগে পদ্মা কাছে ছিল—একন নদী বহু দূরে সরে গেছে—আমার তেতলা ঘরের জানলা দিয়ে তার একটুখানি আভাস যেন আন্দাজ করে বুঝতে পারি। অথচ একদিন এই নদীর সঙ্গে আমার কত ভাব ছিল—শিলাইদহে যখনই আসতুম তখন দিনরাত্তির ঐ নদীর সঙ্গেই আমার আলাপ চলত।  রাত্রে আমার স্বপ্নের সঙ্গে ঐ নদীর কলধ্বনি মিশে যেত আর নদীর কলস্বরে আমার জাগরণের প্রথম অভ্যর্থনা শুনতে পেতাম। তার পরে কত বৎসর বোলপুরের মাঠে মাঠে কাটল, কতবার সমুদ্রের এপারে ওপারে পাড়ি দিলুম—এখন এসে দেখি সে নদী যেন আমাকে চেনে না; ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে যতদূর দৃষ্টি চলে তাকিয়ে দেখি, মাঝখানে কত মাঠ, কত গ্রামের আড়াল,–সবশেষে উত্তর দিগন্তে আকাশের নীলাঞ্চলের একটি নীলতর পাড়ের মত একটি বনরেখা দেখা যায়, সেই নীল রেখাটির কাছে ঐ যে একটি ঝাপসা বাষ্পলেখাটির মত দেখতে পাচ্ছি ঐ আমার পদ্মা, আজ সে আমার কাছে অনুমানের বিষয় হয়ে রয়েছে। এই ত মানুষের জীবন, ক্রমেই কাছের জিনিস দূরে চলে যায়, জানা জিনিষ ঝাপসা হয়ে আসে, আর যে স্রোত বন্যার মত প্রাণমনকে প্লাবিত করেচে, সেই স্রোত একদিন অশ্রুবাষ্পের একটি রেখার মত জীবনের একান্তে অবশিষ্ট থাকে।

এখানে দুসপ্তাহ ছিলেন। সঙ্গী সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সিএফ এন্ডরুজ। ২১ শে চৈত্র গ্রামবাসীরা কবি ও এন্ডরুজ সাহেবকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা জানান। এই সভায় একাধিক মানপত্র দেওয়া হয়। এদিনই শিলাইদহ অঞ্চলের মুসলমান মহিলাদের পক্ষ থেকে কবিকে একটি নকশি কাঁথা উপহার দেওয়া হয়। এটি বর্তমানে রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। শিলাইদহ জমিদারীর প্রজারের পক্ষ মানপত্রটি রচনা করেছিলেন জেহের আলী বিশ্বাস বলে চর কলারোয়া গ্রামের একজন মুসলমান প্রজা।  তিনি লেখেন—আজ আমাদের কী আনন্দে দিন…সমস্ত প্রকৃতি যেন আজ শরবেণুরবে গাইছে—ধন্য হয়েছি মোরা তব আগমনে।

তাঁরা রবীন্দ্রনাথের কাছে কিছু উপদেশ প্রার্থনা করেছিলেন। আর কিছু নয়।

জেহের আলী বিশ্বাস রচিত বিরাট এই মানপত্রের শেষ দিকে বলা হয়—

সমুদ্রমন্থন করিয়া একদিন দেবতারা অমৃত তুলিযা অমর হইয়াছেন। আমরাও আজ আপনার জ্ঞানরূপ সমুদ্র ছেঁচিয়া তার মাঝখান থেকে অমৃতবাণী তুলিয়া মর্মে মর্মে গাঁথিয়া জীবনের কর্তব্যপথে অগ্রসর হব। কিন্তু শত পরিতাপের বিষয়, আমরা বিদ্যাহীন বুদ্ধিহীন; সে অমৃত তুলিতে আমাদের উপযুক্ত আসবাবের অভাব। তবে আজ আপনার ন্যায় একজন নায়কের শুভাগমনে যে আনন্দটুকু পেয়েছি, আর যতটুকু সাধ্য সাজাইয়া গুছাইয়া এই ক্ষুদ্র ঝুলিটি পূর্ণ করিয়া এই সোনার হাটের মধ্যে আনিয়া দিলাম, আপনার সুধামুখের সুধাবর্ষণ প্রার্থনা করিতেছে:

১. গৃহস্থেরা সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া মাঠে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে; তবু তাহাদিগকে দুমুঠো ভাতের জন্য পরের দ্বারস্থ হইতে হয়। কিরূপে তাদের এই দুরাবস্থা দূর হইতে পারে এই সভায় তাহার সৎ উপদেশ প্রার্থনা করে।

২. দেশ হইতে হাজার হাজার মন শস্য সস্তা দরে বিদেশে চলিয়া যাচ্ছে, আর বিদেশ থেকে যা আসছে তা তাহাদিগকে আতিরিক্ত মূল্যে কিনিতে হচ্ছে। তার প্রতিকারের উপায় কি, এ সভায় তাহার সৎ উপদেশ প্রার্থনা করে।

৩. বর্তমানে দেশের যেরূপ অবস্থা হইয়াছে, তাহাতে প্রত্যেকের কি কি করা কর্তব্য এ সভায় তাহার সৎ উপদেশ প্রার্থনা করে।

৪. দেশে গরীবের ছেলে উপযুক্ত লেখাপড়া শিখে সহায় অভাবে জীবনে উন্নতির দিকে যাইতে পারে না জন্য ক্রমে ক্রমে অকর্মণ্য হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কি করা কর্তব্য এ সভায় তাহার সৎ উপদেশ প্রার্থনা করে।

অতএব প্রার্থনা, অধীনগণের এই ক্ষুদ্র এ আকিঞ্চন গ্রহণ করিলে জীবনে ধন্য হইব। নিবেদন ইতি। ১৩২৮। ২১ চৈত্র।

'জগৎপূজ্য কবিসম্রাট শ্রীল শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহোদয়ের শ্রীচরণ কমলেষু' নামে খোরসেদপুরের অধিবাসিবৃন্দ মানপত্রে লেখেন—

…আবার এসেছে ফিরে এ পল্লীর আনন্দ দুলাল

দশদিক আকুলিয়া পত্র পুষ্পে সেজে ওঠ কদম্ব তমাল।

শাখে শাখে ডাকে পাখি দাঁড়াইলা পল্লী আজি উৎসব সজ্জায়

কবীন্দ্রের চরণের তলে, অর্ঘ্য করে নতমুখী সেবিকার প্রায়।।…

১৯৩৭ সালে পতিসরের প্রজাদের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ সে বছরের পূন্যাহে (১০ শ্রাবণ ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ)পতিসরে আসেন। সেখান থেকে কালীগ্রামে। এখানে কবি বারো বছর পরে এলেন। তখন থাকতেন বোটে। কবির আগমণ উপলক্ষে রসুনচৌকি আর দিশি বাদ্যভাণ্ডের ধ্বনিতে সরগরম হয়ে উঠল গ্রামগুলি। পরের দিন সংবর্ধনা জানাবার বিপুল আয়োজন করেছেন গ্রামবাসীরা। স্থানীয় পতিসর হাইস্কুলে বসেছে অভিনন্দন সভা। পুষ্পমাল্যে বরণ করা হল কবিকে। স্থানীয় জনসাধারণের অনেকেই বক্তৃতা করলেন। কবিও সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন—''সংসার থেকে বিদায় নেবার আগে, তোমাদের দেখে যাবো—আমার সেই আকাঙ্ক্ষা আজ পূর্ণ হল। তোমরা এগিয়ে চলো,–জনসাধারণের জন্যে সবার আগে চাই শিক্ষা—'এডুকেশন ফার্স্ট', সবাইকে শিক্ষা দিয়ে বাঁচাও, মানুষ করো।'' অনেক বৃদ্ধপ্রজা, যুবকেরাও ভাবাবেগে কেঁদে ফেললেন, কবির কণ্ঠও যেন রুদ্ধ।

বড়ো আকারের অভিনন্দন সভাটি অনুষ্ঠিত হল কাছারি প্রাঙ্গণে। জনৈক মুসলমান প্রজা অভিনন্দন পাঠ করলেন—

মহামান্য দেশবরেণ্য দেবতুল্য জমিদার শ্রীযুক্ত কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহোদয়ের পরগণায় শুভাগমন উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি—

প্রভো, প্রভুরূপে হেথা আস নাই তুমি দেবরূপে এসে দিলে দেখা।

দেবতার দান অক্ষয় হউক, হৃদিপটে থাক স্মৃতিকথা।।

কালীগ্রাম পরগণার প্রজাবৃন্দের পক্ষে—

মোঃ কফিলদ্দিন আকন্দ রাতোয়ান।

পতিসর, সদর কাছারী, রাজশাহী, ১২ শ্রাবণ, ১৩৪৪।

পতিসরের একটি ঘটনা বলেছেন অন্নদা শঙ্কর রায়। তখন তিনি রাজশাহীর ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। রবীন্দ্রনাথ পতিসরে এলে তার সঙ্গে অন্নদা শঙ্কর রায় দেখা করতে গেছেন। সেখানে একজন বৃদ্ধ মুসলমান প্রজা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার কাছে মন্তব্য করেছেন যে—আমাদের ধর্মের মহামানবকে আমরা দেখিনি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে দেখলে তেমনই মনে হয়।

সে সময়কার একটি ছবি শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর বইতে আছে যে চরের প্রজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কথা বলছেন চরের ভেতর দাঁড়িয়ে। মুসলমান প্রজাদের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্কটাই নির্দেশ করে এ ছবিটি।

১৮৯১ সালে জমিদারি পরিচালনা করতে এসে রবীন্দ্রনাথ মহাজনী প্রথার সর্বনাশা রূপটি দেখেছিলেন। সে সময়ের মহাজনদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের সাহা পরিবারের লোকজন। তিনি সে সময় ঘোষণা করেছিলেন—সাহাদের হাত থেকে শেখদের রক্ষা করাই আমার প্রথম কর্তব্য। তার জমিদারী এলাকার অধিকাংশ প্রজাই ছিল দরিদ্র এবং মুসলমান। শেখ বলতে এই দরিদ্র প্রজাদেরই বুঝিয়েছিলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ যেসব পল্লীউন্নয়ন কর্মকাণ্ড গ্রহণ করেছিলেন—যেমন কৃষি ব্যাংক খুলে দরিদ্রপ্রজাদের ঋণ প্রদান, মণ্ডলী প্রথার মাধ্যমে সমবায় প্রথায় চাষ পদ্ধতি প্রচলন, তাঁত-রেশমের প্রশিক্ষণ স্কুল খোলা, উন্নত কৃষি প্রদ্ধতির প্রচলন, হাসপাতাল স্থাপন ইত্যাদি–  সেগুলো সরাসরি আঘাত করেছিল কায়েমী স্বার্থের রক্ষক হিন্দু গোমস্তা, আমলা, মাহজন এবং জোতদারদের দূর্গে। ফলে শিলাইদহ এলাকায় তিনি সব সময় এদের দ্বারা প্রবল বিরোধিতার সম্মুখিন হয়েছিলেন। তারা নানাভাবে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচার করেছিল। তারা রবীন্দ্রনাথের জেদ আর কল্যাণব্রতের সামনে বিপন্ন বোধ করেছিলেন। ঠাকুর-এস্টেটের অধিকাংশ প্রজাই ছিলেন মুসলমান। তারা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সব ধরনের কল্যাণকর্মে সর্বাধিক উপকৃত হয়েছিল। এ কারণেই তারা তাকে ভালোবাসত। তাকে ভক্তি করত। কায়েমী স্বার্থবাদীরা সে সময় প্রচার করেছিল, রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম বলে মুসলমানদের প্রতি তার এত প্রীতি।

জমিদারী পরিচালনার কাজে এসে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ট সম্পর্ক পরিচয় ওঠে এই নিম্নবর্গের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে। পল্লীর সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন হয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ইংরেজ রাজত্বে এই সমাজ ও অর্থনীতি উভয়েরই পরিবর্তন ঘটেছিল। নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার অভিঘাতে পুরনো সমাজকাঠামোর অবক্ষয় তাকে বিস্মিত করেছিল। তিনি লক্ষ করেছিলেন—নতুন ব্যবস্থায় ভারতবর্ষীয় এককালীন স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজ স্টেটের কাছে মর্মান্তিকভাবে আত্মবিলোপ করতে বাধ্য হচ্ছে। এবং দেখেছিলেন—পল্লীতে এই দরিদ্য মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনটাই বড়। সাম্প্রদায়িক ভেদরেখার ছিদ্র ধনীদের মধ্যেই গোপনে গোপনে আছে। সেখানে বাইরে থেকে রোগজীবাণু সংক্রমণ ঘটলেও ঘটতে পারে। দরিদ্র মানুষের কোনো দায় নেই।

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ত্রিংশ পর্ব

মুসলমান খণ্ড—২

——————

হযরত মোহাম্মদের জন্মদিন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ বাণী পাঠিয়েছিলেন স্যার আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দিকে। ১৯৩৪ সালের ২৫ জুন অই বাণীটি হযরত মোহম্মদের জন্মদিনে আকাশবাণীতে প্রচারিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—

ইসলাম পৃথিবীর মহত্তম ধর্মের মধ্যে একটি। এই কারণে উহার অনুবর্তিগণের দায়িত্ব অসীম, যেহেতু আপন জীবনে এই ধর্মের মহত্ত্ব সম্বন্ধে তাহাদিগকে সাক্ষ্য দিতে হইবে। ভারতে যে-সকল বিভিন্ন ধর্মসমাজ আছে তাহাদের পরস্পরের প্রতি সভ্য জাতিযোগ্য মনোভাব যদি উদ্ভাবিত করিতে হয় তবে কেবলমাত্র রাষ্ট্রীক স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা ইহা সম্ভবপর হইবে না। তবে আমাদিগকে নির্ভর করিতে হইবে সেই অনুপ্রেরণার প্রতি, যাহা ঈশ্বরের প্রিয় পাত্র ও মানবের বন্ধু সত্যদূতদিগের অমর জীবন হইতে চির উৎসারিত। অদ্যকার এই পূর্ণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে মস্লেম ভ্রাতাদের সহিত একযোগে ইসলামের মহাঋষির উদ্দেশ্য আমার ভক্তি-উপহার অর্পন করিয়া ঊৎপীড়িত ভারতবর্ষের জন্য তাঁহার আশীর্বাদ ও সাত্ত্বনা কামনা করি।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রজীবনীর ৩য় খণ্ড জানিয়েছেন, বানীটির ইংরেজী পাঠও আছে। ইংরেজী পাঠটি রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছিলেন। বাংলা পাঠে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মোহাম্মদকে মহাঋষি হিসাবে অভিহিত করেছিলেন কবি। কিন্তু ইংরেজী পাঠে তিনি মহাঋষি শব্দটির অনুবাদ করেছিলেন—Grand Propfet of Islam.

১৯৩৩ সালের ২৬ নভেম্বর নবী দিবস উপলক্ষে একটি বাণী পাঠান রবীন্দ্রনাথ বোম্বের আনজুমানে আহমদিয়ার সম্পাদককে—

Message to the Secretary, Anjuman Ahmadiya, Bombay, on Prophet Day—

Islam is one of the greatest religious od the world and the responsibility is immense upon its followers who must in their lives bear testimony to the greatness of their faith. Our one hope of mutual reconciliation between different communities inhabiting India, of bringing about a truly civilized attitude of mind towards each other in this unfortunate country depends not merely on the realization of an intelligent self-interest but on the eternal source of inspiration that comes from the beloved of God and  lovers of men. I take advantage of this auspicious occasion today when I may join my moslem brothers in offering my homage of adoration to the grand prophet of Islam and invoke his blessings for India which is in dire need of success and solace.

Rabindranath Tagore

26.11.1933.

দিল্লীর জামে মসজিদ থেকে প্রকাশিত The Peshwa পত্রিকার নবী সংখ্যার জন্য ১৯৩৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথের একটি বাণী পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ গ্রন্থে ভূঁইয়া ইকবাল সেই বানীটি শান্তি নিকেতনের রবীন্দ্রভবনের অভিলেখাগার থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছেন।

Message for the Prophet Number of The Peshwa, Jama Masjid, Delhi.

I take this opportunity to offer my veneration to the Holy Prophet Mohammad, one of the greatest personalities born in the world, who has brought a new and latent force of life into human history, a vigorous ideal of purity in religion, and I earnestly pray that those who follow his path will justify their Noble faith in their life and the sublime teaching of their master by serving the cause of civilization in building the history of the modern India, helping to maintain peace and mutual goodwill in the field of our national life.

Rabindranath Tagore.

Santiniketon 27the February 1936.

প্রথম বাণীটিতে রবীন্দ্রনাথ ইসলামের প্রবর্তকের নাম সরাসরি বলেন নি। তিনি তার স্বভাবসুলভ ভাষায় মহাঋষি বলেছেন। দ্বিতীয় বাণীটি প্রথম বাণীটিরই অনুবাদ। সেখানে ইসলামের মহাঋষি শব্দের বদলে প্রোফেট বা নবী শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তৃতীয় বাণীটিতে সুস্পষ্টভাবে পবিত্র নবী মোহাম্মদ হিসাবে অভিহিত করেছেন।

শান্তিনিকেতন প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ তিনজন ধর্মপ্রবতর্কের নাম করেছেন। নামের তালিকা দেখলে বোঝা যায়—তিনি বয়স হিসাবে সিনিয়রিটি নির্ধারিত করেছেন। শুরুতে গৌতম বুদ্ধ, দ্বিতীয়টিতে যীশু এবং সবশেষে হযরত মহম্মদকে আলোচনায় এনেছেন। তিনি তিনজনের মধ্যেই মানুষত্বের সংগ্রামে তাঁদের আত্মনিবেদনকে সভ্যতার বড় অবদান হিসাবে দেখেছেন। লিখেছেন—

নিজের রচিত জটিল জাল ছেদন করে চিরন্তন আকাশ চিরন্তন আলোকের অধিকার আবার ফিরে পাবার জন্য মানুষকে চিরকালই এইরকম মহাপুরুষদের মুখ তাকাতে হয়েছে। কেউ বা ধর্মের ক্ষেত্রে, কেউ বা জ্ঞানের ক্ষেত্রে, কেউ বা কর্মের ক্ষেত্রে এই কাজে প্রবৃত্ত হয়েছেন। যা চিরদিনের জিনিষ তাকে তাঁরা ক্ষণিকের আবরণ থেকে মুক্ত করবার জন্যে পৃথিবীতে আসেন। বিশেষ স্থানে গিয়ে বিশেষ মন্ত্র পড়ে বিশেষ অনুষ্ঠান করে মুক্তি লাভ করা যায় এই বিশ্বাসের অরণ্যে যখন মানুষ পথ হারিয়েছিল, তখন বুদ্ধদেব এই অত্যন্ত সহজ কথাটি আবিষ্কার ও প্রচার করবার জন্যে এসেছিলেন যে, স্বার্থত্যাগ করে, সর্বভূতে দয়া বিস্তার করে, অন্তর থেকে বাসনাকে ক্ষয় করে ফেললে তবেই মুক্তি হয়। কোনো স্থানে গেলে বা জলে স্নান করলে, বা অগ্নিতে আহুতি দিলে বা মন্ত্র উচ্চারণ করলে হয় না। এই কথাটি শুনতে নিতান্তই সরল, কিন্তু এই কথাটির জন্যে একটি রাজপুত্রকে রাজ্যত্যাগ করে বনে বনে পথে পথে ফিরতে হয়েছে– মানুষের হাতে এটি এতই কঠিন হয়ে উঠেছিল। য়িহুদিদের মধ্যে ফ্যারিসি সম্প্রদায়ের অনুশাসনে যখন বাহ্য নিয়মপালনই ধর্ম বলে গণ্য হয়ে উঠেছিল, যখন তারা নিজের গন্ডির বাইরে অন্য জাতি, অন্য ধর্মপনথীদের ঘৃণা করে তাদের সঙ্গে একত্রে আহার বিহার বন্ধ করাকেই ঈশ্বরের বিশেষ অভিপ্রায় বলে স্থির করেছিল, যখন য়িহুদির ধর্মানুষ্ঠান য়িহুদি জাতিরই নিজস্ব স্বতন্ত্র সামগ্রী হয়ে উঠেছিল, তখন যিশু এই অত্যন্ত সহজ কথাটি বলবার জন্যই এসেছিলেন যে, ধর্ম অন্তরের সামগ্রী, ভগবান অন্তরের ধন, পাপপুণ্য বাহিরের কৃত্রিম বিধি-নিষেধের অনুগত নয়, সকল মানুষই ঈশ্বরের সন্তান, মানুষের প্রতি ঘৃণাহীন প্রেম ও পরমেশ্বরের প্রতি বিশ্বাসপূর্ণ ভক্তির দ্বারাই ধর্মসাধনা হয়; বাহ্যিকতা মৃত্যুর নিদান, অন্তরের সার পদার্থেই প্রাণ পাওয়া যায়। কথাটি এতই অত্যন্ত সরল যে শোনবামাত্রই সকলকেই বলতে হয় যে, হাঁ। কিন্তু, তবুও এই কথাটিকেই সকল দেশেই মানুষ এতই কঠিন করে তুলেছে যে, এর জন্যে যিশুকে মরু-প্রান্তরে গিয়ে তপস্যা করতে এবং ক্রুসের উপরে অপমানিত মৃত্যুদন্ডকে গ্রহণ করতে হয়েছে।

মহম্মদকেও সেই কাজ করতে হয়েছিল। মানুষের ধর্মবুদ্ধি খন্ড খন্ড হয়ে বাহিরে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাকে অন্তরের দিকে, অখন্ডের দিকে, অনন্তের দিকে নিয়ে গিয়েছেন। সহজে পারেন নি, এর জন্য সমস্ত জীবন তাঁকে মৃত্যুসংকুল দুর্গম পথ মাড়িয়ে চলতে হয়েছে, চারিদিকে শত্রুতা ঝড়ের সমুদ্রের মতো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে তাঁকে নিরন্তর আক্রমণ করেছে। মানুষের পক্ষে যা যথার্থ স্বাভাবিক, যা সরল সত্য, তাকেই স্পষ্ট অনুভব করতে ও উদ্ধার করতে, মানুষের মধ্যে যাঁরা সর্বোচ্চশক্তিসম্পন্ন তাঁদেরই প্রয়োজন হয়।

মানুষের ধর্মরাজ্যে যে তিনজন মহাপুরুষ সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিরোহণ করেছেন এবং ধর্মকে দেশগত জাতিগত লোকাচারগত সংকীর্ণ সীমা থেকে মুক্ত করে দিয়ে তাকে সূর্যের আলোকের মতো, মেঘের বারিবর্ষণের মতো, সর্বদেশ ও সর্বকালের মানবের জন্য বাধাহীন আকাশে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, তাঁদের নাম করেছি। ধর্মের প্রকৃতি যে বিশ্বজনীন, তাকে যে কোনো বিশেষ দেশের প্রচলিতমূর্তি বা আচার বা শাস্ত্র কৃত্রিম বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখতে পারে না, এই কথাটি তাঁরা সর্বমানবের ইতিহাসের মধ্যে নিজের জীবন দিয়ে লিখে দিয়ে গেছেন। দেশে দেশে কালে কালে সত্যের দুর্গম পথে কারা যে ঈশ্বরের আদেশে আমাদের পথ দেখাবার জন্যে নিজের জীবন-প্রদীপকে জ্বালিয়ে তুলেছেন সে আজ আমরা আর ভুল করতে পারব না, তাঁদের আদর্শ থেকেই স্পষ্ট বুঝতে পারব। সে-প্রদীপটি কারও বা ছোটো হতে পারে কারও বা বড়ো হতে পারে, সেই প্রদীপের আলো কারও বা দিগ্‌দিগন্তরে ছড়িয়ে পড়ে, কারও বা নিকটের পথিকদেরই পদক্ষেপের সহায়তা করে, কিন্তু সেই শিখাটিকে আর চেনা শক্ত নয়।

মূর্তি বা আচার বা শাস্ত্র কৃত্রিম বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখতে পারে না, এই কথাটি তাঁরা সর্বমানবের ইতিহাসের মধ্যে নিজের জীবন দিয়ে লিখে দিয়ে গেছেন। দেশে দেশে কালে কালে সত্যের দুর্গম পথে কারা যে ঈশ্বরের আদেশে আমাদের পথ দেখাবার জন্যে নিজের জীবন-প্রদীপকে জ্বালিয়ে তুলেছেন সে আজ আমরা আর ভুল করতে পারব না, তাঁদের আদর্শ থেকেই স্পষ্ট বুঝতে পারব। সে-প্রদীপটি কারও বা ছোটো হতে পারে কারও বা বড়ো হতে পারে, সেই প্রদীপের আলো কারও বা দিগ্‌দিগন্তরে ছড়িয়ে পড়ে, কারও বা নিকটের পথিকদেরই পদক্ষেপের সহায়তা করে, কিন্তু সেই শিখাটিকে আর চেনা শক্ত নয়।

পূর্ববঙ্গে যে বছর এসেছিলেন জমিদারী পরিচালনা করতে সেই ১৮৯১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ অর্ধশতকে মুসলমান সমাজ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ সম্যক ধারণা পান এবং তাঁর ভাবনা প্রকাশ করেছেন অকাতরে। শুরু করেছিলেন ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা সাধনায় মুসলমান মহিলা নামে প্রবন্ধ লিখে। পরিচয় পত্রিকায় কালান্তর পর্যন্ত নানা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের সম্পর্কে ৩০টিরও  বেশী প্রবন্ধ লিখেছেন। এই প্রবন্ধের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর গভীর বিশ্লেষণী অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি কিছু বানিয়ে লেখেন নি। পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলমানদের জীবনকে কাছ থেকে দেখেই তিনি লিখেছেন। এখানেই তাঁর লেখাটার শক্তি।

১৯৪০ সালে রবীন্দ্রনাথ তখন বুড়ো হয়ে গেছেন। নানা রোগে শোকে জীর্ণশীর্ণ। নিজের হাতে লিখতেও পারেন না। হাত কাঁপে। তখন ১২ ভাদ্র সিরাজগঞ্জ থেকে আবুল মনসুর এলাহী বক্স এসেছিলেন শান্তি নিকেতনে। তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এলাহী বক্স সিরাজগঞ্জে সেবক সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেবক নামে এই মাসিক পত্রিকা বের করেছিলেন। তাকে রবীন্দ্রনাথ অটোগ্রাফ দিয়ে লিখেছেন—

যে করে ধর্মের নামে

বিদ্বেষ সঞ্চিত

ঈশ্বরকে অর্ঘ্য হতে

সে করে বঞ্চিত।।

মৌলানা জিয়াউদ্দিন বিশ্বভারতীর ছাত্র ছিলেন। পরে বিশ্বভারতীর ইসলামি সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বাড়ি অসৃতসর, পাঞ্জাব। তিনি সদ-বন্দ-ই টেগোর নামে ১০০টি রবীন্দ্রকবিতা ও গানের ফারসীতে ও কলম-ই টেগোর নামে কবিতার উর্দু তরজমা করেন। বই দুটিই বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৫ সালে। ১৯২২ সালে ২৪ জুলাই শান্তি নিকেতনে সুফি ধর্ম বিষয়ে মৌলনা জিয়াউদ্দিন প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯২৩ সালে ১৬ মার্চ শান্তি নিকেতনে জিয়াউদ্দিন কোরআন থেকে তেলওয়াত করেন এবং ইংরেজীতে তার অনুবাদ পাঠ করেন।

মৌলানা জিয়াউদ্দিন শান্তি নিকেতনের বিভিন্ন কাজকর্মে জড়িত ছিলেন। তিনি বিশ্বভারতীতে ইসলামী সংস্কৃতি বিভাগকে একটি শক্ত ভিত্তির উপরদাঁড় করিয়েছিলেন। তিনি আকস্মিকভাবে মৃত্যুমরণ করেন ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে। কবি গভীর ভাবে শোকাহত হন। রবীন্দ্রনাথ ৮ জুলাই মৌলানা জিয়াউদ্দিন নামে ৪৮ লাইনের একটি কবিতা লেখেন। শান্তি নিকেতনে সে সময় একটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ মৌলানা স্মরণে একটি দীর্ঘ ভাষণও দেন। মিসেস জিয়াউদ্দিনকে ৬ জুলাই টেলিগ্রামে শোকবার্তা পাঠান –

Ziauddin's passing  away is a terrible blow to me personally and Santiniketon. Rabindranath Tagore.

6.7.38.

ভাষণে রবীন্দ্রনাথ লেখেন—

আজকের দিনে একটা কোনো অনুষ্ঠানের সাহায্যে জিয়াউদ্দিনের অকস্মাৎ মৃত্যুতে আশ্রমবাসীদের কাছে বেদনা প্রকাশ করব, এ কথা ভাবতেও আমার কুণ্ঠাবোধ হচ্ছে। যে অনুভূতি নিয়ে আমরা একত্র হয়েছি তার মূলকথা কেবল কর্তব্যপালন নয়, এ অনুভূতি আরো অনেক গভীর।

জিয়াউদ্দিনের মৃত্যুতে যে স্থান শূন্য হল তা পূরণ করা সহজ হবে না, কারণ তিনি সত্য ছিলেন। অনেকেই তো সংসারের পথে যাত্রা করে, কিন্তু মৃত্যুর পরে চিহ্ন রেখে যায় এমন লোক খুব কমই মেলে। অধিকাংশ লোক লঘুভাবে ভেসে যায় হাল্কা মেঘের মতো। জিয়াউদ্দিন সম্বন্ধে সে কথা বলা চলে না; আমাদের হৃদয়ের মধ্যে তিনি যে স্থান পেয়েছেন তা নিশ্চিহ্ন হয়ে একদিন একেবারে বিলীন হয়ে যাবে। এ কথা ভাবতে পারি নে। কারণ তাঁর সত্তা ছিল সত্যের উপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। আশ্রম থেকে বাইরে গিয়েছিলেন তিনি ছুটিতে, তাঁর এই ছুটিই যে শেষ ছুটি হবে অদৃষ্টের এই নিষ্ঠুর লীলা মন মেনে নিতে চায় না। তিনি আজ পৃথিবীতে নেই সত্য, কিন্তু তাঁর সত্তা ওতপ্রোতভাবে আশ্রমের সব-কিছুর সঙ্গে মিশে রইল।

তিনি প্রথম আশ্রমে এসেছিলেন বালক বয়সে ছাত্র হিসাবে, তখন হয়তো তিনি ঠিক তেমন করে মিশতে পারেন নি এই আশ্রমিক জীবনের সঙ্গে, যেমন পরিপূর্ণ ভাবে মিশেছিলেন পরবর্তী কালে। কেবল যে আশ্রমের সঙ্গে তাঁর হৃদয় ও কর্মপ্রচেষ্টার সম্পূর্ণ যোগ হয়েছিল তা নয়, তাঁর সমস্ত শক্তি এখানকার আবহাওয়ায় পরিণতি লাভ করেছিল। সকলের তা হয় না। যাঁরা পরিণতির বীজ নিয়ে আসেন তাঁরাই কেবল আলো থেকে হাওয়া থেকে পরিপক্বতা আহরণ করতে পারেন। এই আশ্রমের যা সত্য যা শ্রেষ্ঠ সেটুকু জিয়াউদ্দিন এমনি করেই পেয়েছিলেন। এই শ্রেষ্ঠতা হল মানবিকতার, আর এই সত্য হল আপনাকে সকলের মধ্যে প্রসারিত করে দেবার শক্তি। ধর্মের দিক থেকে এবং কর্মের দিকে অনেকের সঙ্গেই হয়তো তাঁর মূলগত প্রভেদ ছিল, কিন্তু হৃদয়ের বিচ্ছেদ ছিল না। তাঁর চলে যাওয়ায় বিশ্বভারতীর কর্মক্ষেত্রে যে বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল, সেটা পূরণ করা যাবে না। আশ্রমের মানবিকতার ক্ষেত্রে তাঁর জায়গায় একটা শূন্যতা চিরকালের জন্যে রয়ে গেল। তাঁর অকৃত্রিম অন্তরঙ্গতা, তাঁর মতো তেমনি করে কাছে আসা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না, সংকোচ এসে পরিপূর্ণ সংযোগকে বাধা দেয়। কর্মের ক্ষেত্রে যিনি কর্মী, হৃদয়ের দিক থেকে যিনি ছিলেন বন্ধু, আজ তাঁরই অভাবে আশ্রমের দিক থেকে ও ব্যক্তিগতভাবে আমরা এক জন পরম সুহৃদকে হারালাম।

মৌলানা জিয়াউদ্দিন/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কখনো কখনো কোনো অবসরে

নিকটে দাঁড়াতে এসে;

"এই যে' বলেই তাকাতেম মুখে,

"বোসো' বলিতাম হেসে।

দু-চারটে হত সামান্য কথা,

ঘরের প্রশ্ন কিছু,

গভীর হৃদয় নীরবে রহিত

হাসিতামাশার পিছু।

কত সে গভীর প্রেম সুনিবিড়,

অকথিত কত বাণী,

চিরকাল-তরে গিয়েছ যখন

আজিকে সে কথা জানি।

প্রতি দিবসের তুচ্ছ খেয়ালে

সামান্য যাওয়া-আসা,

সেটুকু হারালে কতখানি যায়

খুঁজে নাহি পাই ভাষা।

তব জীবনের বহু সাধনার

যে পণ্যভারে ভরি

মধ্যদিনের বাতাসে ভাসালে

তোমার নবীন তরী,

যেমনি তা হোক মনে

জানি তার এতটা মূল্য নাই

যার বিনিময়ে পাবে

তব স্মৃতি আপন নিত্য ঠাঁই–

সেই কথা স্মরি বার বার

আজ লাগে ধিক্‌কার প্রাণে–

অজানা জনের পরম মূল্য

নাই কি গো কোনোখানে।

এ অবহেলার বেদনা বোঝাতে

কোথা হতে খুঁজে আনি

ছুরির আঘাত যেমন সহজ

তেমন সহজ বাণী।

কারো কবিত্ব, কারো বীরত্ব,

কারো অর্থের খ্যাতি–

কেহ-বা প্রজার সুহৃদ্‌ সহায়,

কেহ-বা রাজার জ্ঞাতি–

তুমি আপনার বন্ধুজনেরে

মাধুর্যে দিতে সাড়া,

ফুরাতে ফুরাতে রবে তবু তাহা

সকল খ্যাতির বাড়া।

ভরা আষাঢ়ের যে মালতীগুলি

আনন্দমহিমায় আপনার দান

নিঃশেষ করি ধুলায় মিলায়ে যায়–

আকাশে আকাশে বাতাসে

তাহারা আমাদের চারি পাশে

তোমার বিরহ ছড়ায়ে চলেছে

সৌরভনিশ্বাসে।

শান্তিনিকেতন, ৮ জুলাই, ১৯৩৮

১৯২১ সালে ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বভারতীর সম্মিলনী সভায় সৈয়দ মুজতবা আলী ঈদ উৎসব নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন। সভায় রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করেন। নসিরুল্লাহ এ বৎসর শান্তিনিকেতনে কিছুকাল উর্দু শেখান।১৯২৩ সালে সৈয়দ মুজতবা আলীর সভাপতিত্বে বিশ্বভারতীর সম্মিলনী সভায় রামচন্দ্র নামে এক প্রাবন্ধিক The little I know of Islam পাঠ করেন।

১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনের কাজী আব্দুল ওদুদ শান্তি নিকেতনে নিজাম বক্তৃতা করেন।  কাজী আব্দুর ওদুদ ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যাপক। ১৯৩৫ সালে ২৬-২৮ মার্চ তিনদিন তিনি শান্তি নিকেতনে তিনটি বক্তৃতা দেন। তিনটির বিষয়—মুসলমানের পরিচয়, হৃদয়ের জাগরণ এবং ব্যর্থতার প্রতিকার।  তখন রবীন্দ্রনাথ খুবই অসুস্থ। তবুও তিনি সভায় উপস্থিত থেকে তাঁর বক্তব্য পুরোটাই শোনেন। কাজী আব্দুল ওদুদের সঙ্গে ছিলেন কবি আব্দুল কাদির ও কাজী মোতাহার হোসেন। তিনটি প্রবন্ধের সমন্বয়ে ১৯৩৬ সালের ৪ ফ্রেব্রুয়ারী কবি কাজী আব্দুল ওদুদের হিন্দু-মুসলমান বিরোধ বইটির ভূমিকা লিখে দেন। বইটি বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত হয়।

মুসলমান খণ্ড—৩

রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনের ইতিহাস ও আদর্শ ভাষণে লিখেছেন, আমি সেখানে (পল্লীগ্রামে) থাকতে একদিন পাশের গ্রামে আগুন লাগল। গ্রামের লোকেরা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল, কিছু করতে পারে না। তখন পাশের গ্রামের মুসলমানেরা এসে তাদের আগুন নেবাল। কোথাও জল নেই, তাদের ঘরের চাল ভেঙে আগুন নিবারণ করতে হল।

নিজের ভালো তারা বোঝে না, ঘরভাঙার জন্য আমার লোকেরা তাদের মারধর করেছিল। মেরে ধরে এদের উপকার করতে হয়। অগ্নিকাণ্ড শেষ হয়ে গেলে তারা আমার কাছে এসে বললে, 'ভাগ্যিস বাবুরা আমাদের ঘর ভাঙলে, তাই বাঁচতে পেরেছি।' তখন তারা খুব খুশি, বাবুরা মারধর করাতে তাদের উপকার হয়েছে তা তারা মেনে নিল, যদিও আমি সেটাতে লজ্জা পেয়েছি।

রবীন্দ্রনাথ এদের জন্য একটি ক্লাব করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ঘর তোলা হয়েছে। সেখানে রাখা হয়েছে খবরের কাগজ। সেখানে গানবাজনার আয়োজনের ব্যবস্থাও হল। সেখানে মাস্টারও রেখে দিলেন। হিন্দুপ্রধান এলাকায় সেই ক্লাবঘরটি কেউ ব্যবহার করল না। স্কুলঘরে ছাত্র জুটল না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, তখন পাশের গ্রাম থেকে  মুসলমানেরা আমার কাছে এসে বলল, ওরা যখন ইস্কুল নিচ্ছে না তখন আমাদের একজন পণ্ডিত দিন, আমরা তাকে রাখব, তার বেতন দেব, তাকে খেতে দেব।

রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন মুসলমানদের গ্রামে সেই ইস্কুল ঘরটি টিকে গিয়েছিল। তারা আদরের সঙ্গে সেটাকে বাস্তবায়ন করেছে। মুসলমানদের মধ্যেই আত্মশক্তির পরিচয় পেয়েছিলেন। এই আত্মশক্তির উদ্বোধনের কথাই তিনি সারা জীবন ধরে বলে গেছেন।

কবি গোলাম মোস্তফা বঙ্গীয় সাহিত্য পত্রিকায় ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ নামে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন,  কবি-সম্রাট রবীন্দ্রনাথ তাঁহার গীতিকবিতায় যে ভাব ও আদর্শ ব্যক্ত করিয়াছেন তাহার সহিত ইসলামের চমত্কার সৌসাদৃশ্য আছে৷ তাঁহার ভাব ও ধারণাকে যে কোন মুসলমান অনায়াসে গ্রহণ, অন্তর দিয়া গ্রহণ করিতে পারে৷… শুধু বাংলা ভাষায় কেন, জগতের কোন অমুসলমান কবির হাত দিয়া এমন লিখা বাহির হয় নাই৷' ('ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ', বঙ্গীয় মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকা, শ্রাবণ ১৩২৯)৷ কবি রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধটি পড়েছিলেন। তিনি বঙ্গীয়-মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ভোলার কবি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হককে একটি চিঠি লিখেছিলেন। বলেছিলেন—মুসলমানদের প্রতি আমার মনে কিছুমাত্র বিরাগ বা অশ্রদ্ধা নাই বলিয়াই আমার লেখার কোথাও তাহা প্রকাশ পায় নাই।

যোগাযোগ উপন্যাসে লিখেছেন সেই প্রজাদের প্রসঙ্গে–

এ দিকে চাটুজ্যেদের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন। দলে দলে প্রজারা মিলে নিজেরাই আয়োজন করেছে। হিন্দুদের মুসলমানদের স্বতন্ত্র জায়গা। মুসলমান প্রজার সংখ্যাই বেশি— রাত না পোয়াতেই তারা নিজেরাই রান্না চড়িয়েছে। আহারের উপকরণ যত না হোক, ঘন ঘন চাটুজ্যেদের জয়ধ্বনি উঠছে তার চতুর্গুণ। স্বয়ং নবগোপালবাবু বেলা প্রায় পাঁচটা পর্যন্ত অভুক্ত অবস্থায় বসে থেকে সকলকে খাওয়ালেন। তার পরে হল কাঙালিবিদায়। মাতব্বর প্রজারা নিজেরাই দানবিতরণের ব্যবস্থা করলে। কলধ্বনিতে জয়ধ্বনিতে বাতাসে চলল সমুদ্রমন্থন।

গোরা উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন শিলাইদহের নদীর উপরে—বোটে বসে। সেখানে একটি উপ আখ্যান আছে। গৌরাঙ্গ ওরফে গোরা একটি গ্রামে গিয়েছে। সঙ্গে রমাপতি নামে এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। গ্রামটি নদীর চরে—মুসলিম পাড়া। সেখানে মাত্র একঘর হিন্দু পাওয়া গেল। তারা নিম্নশ্রেনীর হিন্দু জাতের—নাপিত। তারা একটি মুসলমান বালককে পুত্রজ্ঞানে প্রতিপালন করছে।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন–

উভয়ে চলিতে চলিতে এক জায়গায় নদীর চরে এক মুসলমান-পাড়ায় আসিয়া উপস্থিত হইল। আতিথ্যগ্রহণের প্রত্যাশায় খুঁজিতে খুঁজিতে সমস্ত গ্রামের মধ্যে কেবল একটি ঘর মাত্র হিন্দু নাপিতের সন্ধান পাওয়া গেল। দুই ব্রাহ্মণ তাহারই ঘরে আশ্রয় লইতে গিয়া দেখিল, বৃদ্ধ নাপিত ও তাহার স্ত্রী একটি মুসলমানের ছেলেকে পালন করিতেছে। রমাপতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, সে তো ব্যাকুল হইয়া উঠিল। গোরা নাপিতকে তাহার অনাচারের জন্য ভ‍র্‌ৎসনা করাতে সে কহিল, "ঠাকুর, আমরা বলি হরি, ওরা বলে আল্লা, কোনো তফাত নেই।"

তখন রৌদ্র প্রখর হইয়াছে— বিস্তীর্ণ বালুচর, নদী  বহুদূর। রমাপতি পিপাসায় ক্লিষ্ট হইয়া কহিল, "হিন্দুর পানীয় জল পাই কোথায়?"

নাপিতের ঘরে একটা কাঁচা কূপ আছে— কিন্তু ভ্রষ্টাচারের সে কূপ হইতে রমাপতি জল খাইতে না পারিয়া মুখ বিমর্ষ করিয়া বসিয়া রহিল।

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, "এ ছেলের কি মা-বাপ নেই?"

নাপিত কহিল, "দু'ই আছে, কিন্তু না থাকারই মতো।"

গোরা কহিল, "সে কী রকম?"

নাপিত যে ইতিহাসটা বলিল, তাহার মর্ম এই—

যে জমিদারিতে ইহারা বাস করিতেছে তাহা নীলকর সাহেবদের ইজারা। চরে নীলের জমি লইয়া প্রজাদের সহিত নীলকুঠির বিরোধের অন্ত নাই। অন্য সমস্ত প্রজা বশ মানিয়াছে, কেবল এই চর-ঘোষপুরের প্রজাদিগকে সাহেবরা শাসন করিয়া বাধ্য করিতে পারে নাই। এখানকার প্রজারা সমস্তই মুসলমান এবং ইহাদের প্রধান ফরুসর্দার কাহাকেও ভয় করে না। নীলকুঠির উৎপাত উপলক্ষে দুই বার পুলিসকে ঠেঙাইয়া সে জেল খাটিয়া আসিয়াছে; তাহার এমন অবস্থা হইয়াছে যে, তাহার ঘরে ভাত নাই বলিলেই হয়, কিন্তু সে কিছুতেই দমিতে জানে না। এবারে নদীর কাঁচি চরে চাষ দিয়া এ গ্রামের লোকেরা কিছু বোরো ধান পাইয়াছিল— আজ মাসখানেক হইল নীলকুঠির ম্যানেজার সাহেব স্বয়ং আসিয়া লাঠিয়ালসহ প্রজার ধান লুঠ করে। সেই উৎপাতের সময় ফরুসর্দার সাহেবের ডান হাতে এমন এক লাঠি বসাইয়াছিল যে ডাক্তারখানায় লইয়া গিয়া তাহার সেই হাত কাটিয়া ফেলিতে হইয়াছিল। এত বড়ো দুঃসাহসিক ব্যাপার এ অঞ্চলে আর কখনো হয় নাই। ইহার পর হইতে পুলিসের উৎপাত পাড়ায় পাড়ায় যেন আগুনের মতো লাগিয়াছে— প্রজাদের কাহারও ঘরে কিছু রাখিল না, ঘরের মেয়েদের ইজ্জত আর থাকে না। ফরুসর্দার এবং বিস্তর লোককে হাজতে রাখিয়াছে, গ্রামের বহুতর লোক পলাতক হইয়াছে। ফরুর পরিবার আজ নিরন্ন, এমন-কি, তাহার পরনের একখানি মাত্র কাপড়ের এমন দশা হইয়াছে যে, ঘর হইতে সে বাহির হইতে পারিত না; তাহার একমাত্র বালক পুত্র তমিজ, নাপিতের স্ত্রীকে গ্রামসম্পর্কে মাসি বলিয়া ডাকিত; সে খাইতে পায় না দেখিয়া নাপিতের স্ত্রী তাহাকে নিজের বাড়িতে আনিয়া পালন করিতেছে। নীলকুঠির একটা কাছারি ক্রোশ-দেড়েক তফাতে, দারোগা এখনো তাহার দলবল লইয়া সেখানে আছে, তদন্ত উপলক্ষে গ্রামে যে কখন আসে এবং কী করে তাহার ঠিকানা নাই। গতকল্য নাপিতের প্রতিবেশী বৃদ্ধ নাজিমের ঘরে পুলিসের আবির্ভাব হইয়াছিল। নাজিমের এক যুবক শ্যালক, ভিন্ন এলেকা হইতে তাহার ভগিনীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিল— দারোগা নিতান্তই বিনা কারণে 'বেটা তো জোয়ান কম নয়, দেখেছ বেটার বুকের ছাতি' বলিয়া হাতের লাঠিটা দিয়া তাহাকে এমন একটা খোঁচা মারিল যে তাহার দাঁত ভাঙিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল, তাহার ভগিনী এই অত্যাচার দেখিয়া ছুটিয়া আসিতেই সেই বৃদ্ধাকে এক ধাক্কা মারিয়া ফেলিয়া দিল। পূর্বে পুলিস এ পাড়ায় এমনতরো উপদ্রব করিতে সাহস করিত না, কিন্তু এখন পাড়ার বলিষ্ঠ যুবাপুরুষমাত্রই হয় গ্রেফতার নয় পলাতক হইয়াছে। সেই পলাতকদিগকে সন্ধানের উপলক্ষ করিয়াই পুলিস গ্রামকে এখনো শাসন করিতেছে। কবে এ গ্রহ কাটিয়া যাইবে তাহা কিছুই বলা যায় না।

গোরা তো উঠিতে চায় না, ও দিকে রমাপতির প্রাণ বাহির হইতেছে। সে নাপিতের মুখের ইতিবৃত্ত শেষ না হইতেই জিজ্ঞাসা করিল, "হিন্দুর পাড়া কত দূরে আছে?"

নাপিত কহিল, "ক্রোশ-দেড়েক দূরে যে নীলকুঠির কাছারি, তার তহসিলদার ব্রাহ্মণ, নাম মাধব চাটুজ্জে।"

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, "স্বভাবটা?"

নাপিত কহিল, "যমদূত বললেই হয়। এত বড়ো নির্দয় অথচ কৌশলী লোক আর দেখা যায় না। এই যে কদিন দারোগাকে ঘরে পুষছে তার সমস্ত খরচা আমাদেরই কাছ থেকে আদায় করবে— তাতে কিছু মুনফাও থাকবে।"

রমাপতি কহিল, "গৌরবাবু, চলুন আর তো পারা যায় না।" বিশেষত নাপিত-বউ যখন মুসলমান ছেলেটিকে তাহাদের প্রাঙ্গণের কুয়াটার কাছে দাঁড় করাইয়া ঘটিতে করিয়া জল তুলিয়া স্নান করাইয়া দিতে লাগিল তখন তাহার মনে অত্যন্ত রাগ হইতে লাগিল এবং এ বাড়িতে বসিয়া থাকিতে তাহার প্রবৃত্তিই হইল না।

গোরা যাইবার সময় নাপিতকে জিজ্ঞাসা করিল, "এই উৎপাতের মধ্যে তুমি যে এ পাড়ায় এখনো টিঁকে আছ? আর কোথাও তোমার আত্মীয় কেউ নেই?"

নাপিত কহিল, "অনেক দিন আছি, এদের উপর আমার মায়া পড়ে গেছে। আমি হিন্দু নাপিত, আমার জোতজমা বিশেষ কিছু নেই বলে কুঠির লোক আমার গায়ে হাত দেয় না। আজ এ পাড়ার পুরুষ বলতে আর বড়ো কেউ নেই, আমি যদি যাই তা হলে মেয়েগুলো ভয়েই মারা যাবে।"

গোরা কহিল, "আচ্ছা, খাওয়া-দাওয়া করে আবার আমি আসব।"

দারুণ ক্ষুধাতৃষ্ণার সময় এই নীলকুঠির উৎপাতের সুদীর্ঘ বিবরণে রমাপতি গ্রামের লোকের উপরেই চটিয়া গেল। বেটারা প্রবলের বিরুদ্ধে মাথা তুলিতে চায় ইহা গোঁয়ার মুসলমানের স্পর্ধা ও নির্বুদ্ধিতার চরম বলিয়া তাহার কাছে মনে হইল। যথোচিত শাসনের দ্বারা ইহাদের এই ঔদ্ধত্য চূর্ণ হইলেই যে ভালো হয় ইহাতে তাহার সন্দেহ ছিল না। এই প্রকারের লক্ষ্মীছাড়া বেটাদের প্রতি পুলিসের উৎপাত ঘটিয়াই থাকে এবং ঘটিতেই বাধ্য এবং ইহারাই সেজন্য প্রধানত দায়ী এইরূপ তাহার ধারণা। মনিবের সঙ্গে মিটমাট করিয়া লইলেই তো হয়, ফেসাদ বাধাইতে যায় কেন, তেজ এখন রহিল কোথায়? বস্তুত রমাপতির অন্তরের সহানুভূতি নীলকুঠির সাহেবের প্রতিই ছিল।

মধ্যাহ্নরৌদ্রে উত্তপ্ত বালুর উপর দিয়া চলিতে চলিতে গোরা সমস্ত পথ একটি কথাও বলিল না। অবশেষে গাছপালার ভিতর হইতে কাছারিবাড়ির চালা যখন কিছুদূর হইতে দেখা গেল তখন হঠাৎ গোরা আসিয়া কহিল, "রমাপতি, তুমি খেতে যাও, আমি সেই নাপিতের বাড়ি চললুম।"

রমাপতি কহিল, "সে কী কথা! আপনি খাবেন না? চাটুজ্জের ওখানে খাওয়া-দাওয়া করে তার পরে যাবেন।"

গোরা কহিল, "আমার কর্তব্য আমি করব, এখন তুমি খাওয়া-দাওয়া সেরে কলকাতায় চলে যেয়ো— ঐ ঘোষপুর-চরে আমাকে বোধ হয় কিছুদিন থেকে যেতে হবে— তুমি সে পারবে না।"

রমাপতির শরীর কণ্টকিত হইয়া উঠিল। গোরার মতো ধর্মপ্রাণ হিন্দু ঐ ম্লেচ্ছের ঘরে বাস করিবার কথা কোন্‌ মুখে উচ্চারণ করিল তাই সে ভাবিয়া পাইল না। গোরা কি পানভোজন পরিত্যাগ করিয়া প্রায়োপবেশনের সংকল্প করিয়াছে তাই সে ভাবিতে লাগিল। কিন্তু তখন ভাবিবার সময় নহে, এক-এক মুহূর্ত তাহার কাছে এক-এক যুগ বলিয়া বোধ হইতেছে; গোরার সঙ্গ ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় পলায়নের জন্য তাহাকে অধিক অনুরোধ করিতে হইল না। ক্ষণকালের জন্য রমাপতি চাহিয়া দেখিল, গোরার সুদীর্ঘ দেহ একটি খর্ব ছায়া ফেলিয়া মধ্যাহ্নের খররৌদ্রে জনশূন্য তপ্ত বালুকার মধ্য দিয়া একাকী ফিরিয়া চলিয়াছে।

ক্ষুধায় তৃষ্ণায় গোরাকে অভিভূত করিয়াছিল, কিন্তু দুর্‌বৃত্ত অন্যায়কারী মাধব চাটুজ্জের অন্ন খাইয়া তবে জাত বাঁচাইতে হইবে, এ কথা যতই চিন্তা করিতে লাগিল ততই তাহার অসহ্য বোধ হইল। তাহার মুখ-চোখ লাল ও মাথা গরম হইয়া মনের মধ্যে বিষম একটা বিদ্রোহ উপস্থিত হইল। সে ভাবিল, 'পবিত্রতাকে বাহিরের জিনিস করিয়া তুলিয়া ভারতবর্ষে আমরা এ কী ভয়ংকর অধর্ম করিতেছি! উৎপাত ডাকিয়া আনিয়া মুসলমানকে যে লোক পীড়ন করিতেছে তাহারই ঘরে আমার জাত থাকিবে আর উৎপাত স্বীকার করিয়া মুসলমানের ছেলেকে যে রক্ষা করিতেছে এবং সমাজের নিন্দাও বহন করিতে প্রস্তুত হইয়াছে তাহারই ঘরে আমার জাত নষ্ট হইবে! যাই হোক, এই আচারবিচারের ভালোমন্দের কথা পরে ভাবিব, কিন্তু এখন তো পারিলাম না।'

নাপিত গোরাকে একলা ফিরিতে দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। গোরা প্রথমে আসিয়া নাপিতের ঘটি নিজের হাতে ভালো করিয়া মাজিয়া কূপ হইতে জল তুলিয়া খাইল এবং কহিল— ঘরে যদি কিছু চাল ডাল থাকে তো দাও আমি রাঁধিয়া খাইব। নাপিত ব্যস্ত হইয়া রাঁধিবার জোগাড় করিয়া দিল। গোরা আহার সারিয়া কহিল, "আমি তোমার এখানে দু-চার দিন থাকব।"

নাপিত ভয় পাইয়া হাত জোড় করিয়া কহিল, "আপনি এই অধমের এখানে থাকবেন তার চেয়ে সৌভাগ্য আমার আর কিছুই নেই। কিন্তু দেখুন, আমাদের উপরে পুলিসের দৃষ্টি পড়েছে, আপনি থাকলে কী ফেসাদ ঘটবে তা বলা যায় না।"

গোরা কহিল, "আমি এখানে উপস্থিত থাকলে পুলিস কোনো উৎপাত করতে সাহস করবে না। যদি করে, আমি তোমাদের রক্ষা করব।"

নাপিত কহিল, "দোহাই আপনার, রক্ষা করবার যদি চেষ্টা করেন তা হলে আমাদের আর রক্ষা থাকবে না। ও বেটারা ভাববে আমিই চক্রান্ত করে আপনাকে ডেকে এনে ওদের বিরুদ্ধে সাক্ষী জোগাড় করে দিয়েছি। এতদিন কোনোপ্রকারে টিঁকে ছিলুম, আর টিঁকতে পারব না। আমাকে সুদ্ধ যদি এখান থেকে উঠতে হয় তা হলে গ্রাম পয়মাল হয়ে যাবে।"

গোরা চিরদিন শহরে থাকিয়াই মানুষ হইয়াছে, নাপিত কেন যে এত ভয় পাইতেছে তাহা তাহার পক্ষে বুঝিতে পারাই শক্ত। সে জানিত ন্যায়ের পক্ষে জোর করিয়া দাঁড়াইলেই অন্যায়ের প্রতিকার হয়। বিপন্ন গ্রামকে অসহায় রাখিয়া চলিয়া যাইতে কিছুতেই তাহার কর্তব্যবুদ্ধি সম্মত হইল না। তখন নাপিত তাহার পায়ে ধরিয়া কহিল, "দেখুন, আপনি ব্রাহ্মণ, আমার পুণ্যবলে আমার বাড়িতে অতিথি হয়েছেন, আপনাকে যেতে বলছি এতে আমার অপরাধ হচ্ছে। কিন্তু আমাদের প্রতি আপনার দয়া আছে জেনেই বলছি, আপনি আমার এই বাড়িতে বসে পুলিসের অত্যাচারে যদি কোনো বাধা দেন তা হলে আমাকে বড়োই বিপদে ফেলবেন।"

নাপিতের এই ভয়কে অমূলক কাপুরুষতা মনে করিয়া গোরা কিছু বিরক্ত হইয়াই অপরাহ্নে তাহার ঘর ছাড়িয়া বাহির হইল। এই ম্লেচ্ছাচারীর ঘরে আহারাদি করিয়াছে মনে করিয়া তাহার মনের মধ্যে একটা অপ্রসন্নতাও জন্মিতে লাগিল। ক্লান্তশরীরে এবং উত্ত্যক্তচিত্তে সন্ধ্যার সময়ে সে নীলকুঠির কাছারিতে আসিয়া উপস্থিত হইল। আহার সারিয়া রমাপতি কলিকাতায় রওনা হইতে কিছুমাত্র বিলম্ব করে নাই, তাই সেখানে তাহার দেখা পাওয়া গেল না। মাধব চাটুজ্জে বিশেষ খাতির করিয়া গোরাকে আতিথ্যে আহ্বান করিল। গোরা একেবারেই আগুন হইয়া উঠিয়া কহিল, "আপনার এখানে আমি জলগ্রহণও করব না।"

মাধব বিস্মিত হইয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিতেই গোরা তাহাকে অন্যায়কারী অত্যাচারী বলিয়া কটুক্তি করিল, এবং আসন গ্রহণ না করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। দারোগা তক্তপোশে বসিয়া তাকিয়া আশ্রয় করিয়া গুড়গুড়িতে তামাক টানিতেছিল। সে খাড়া হইয়া বসিল এবং রূঢ়ভাবে জিজ্ঞাসা করিল, "কে হে তুমি? তোমার বাড়ি কোথায়?"

গোরা তাহার কোনো উত্তর না করিয়া কহিল, "তুমি দারোগা বুঝি? তুমি ঘোষপুরের চরে যে-সমস্ত উৎপাত করেছ আমি তার সমস্ত খবর নিয়েছি। এখনো যদি সাবধান না হও তা হলে— "

দারোগা। ফাঁসি দেবে না কি? তাই তো, লোকটা কম নয় তো দেখছি। ভেবেছিলেম ভিক্ষে নিতে এসেছে, এ যে চোখ রাঙায়!ওরে তেওয়ারি!

মাধব ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া দারোগার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, "আরে কর কী, ভদ্রলোক, অপমান কোরো না।"

দারোগা গরম হইয়া কহিল, "কিসের ভদ্রলোক! উনি যে তোমাকে যা-খুশি-তাই বললেন, সেটা বুঝি অপমান নয়?"

মাধব কহিল, "যা বলেছেন সে তো মিথ্যে বলেন নি, তা রাগ করলে চলবে কী করে? নীলকুঠির সাহেবের গোমস্তাগিরি করে খাই, তার চেয়ে আর তো কিছু বলবার দরকার করে না। রাগ কোরো না দাদা, তুমি যে পুলিসের দারোগা, তোমাকে যমের পেয়াদা বললে কি গাল হয়? বাঘ মানুষ মেরে খায়, সে বোষ্টম নয়, সে তো জানা কথা। কী করবে, তাকে তো খেতে হবে।"

বিনা প্রয়োজনে মাধবকে রাগ প্রকাশ করিতে কেহ কোনোদিন দেখে নাই। কোন্‌ মানুষের দ্বারা কখন কী কাজ পাওয়া যায়, অথবা বক্র হইলে কাহার দ্বারা কী অপকার হইতে পারে তাহা বলা যায় কি? কাহারো অনিষ্ট বা অপমান সে খুব হিসাব করিয়াই করিত— রাগ করিয়া পরকে আঘাত করিবার ক্ষমতার বাজে খরচ করিত না।

দারোগা তখন গোরাকে কহিল, "দেখো বাপু, আমরা এখানে সরকারের কাজ করতে এসেছি; এতে যদি কোনো কথা বল বা গোলমাল কর তা হলে মুশকিলে পড়বে।"

গোরা কোনো কথা না বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। মাধব তাড়াতাড়ি তাহার পশ্চাতে গিয়া কহিল, "মশায়, যা বলছেন সে কথাটা ঠিক— আমাদের এ কসাইয়ের কাজ— আর ঐ-যে বেটা দারোগা দেখছেন ওর সঙ্গে এক বিছানায় বসলে পাপ হয়— ওকে দিয়ে কত যে দুষ্কর্ম করিয়েছি তা মুখে উচ্চারণ করতেও পারি নে। আর বেশি দিন নয়— বছর দুত্তিন কাজ করলেই মেয়ে-কটার বিয়ে দেবার সম্বল করে নিয়ে তার পরে স্ত্রী-পুরুষে কাশীবাসী হব। আর ভালো লাগে না মশায়, এক-এক সময় ইচ্ছা হয় গলায় দড়ি দিয়ে মরি! যা হোক, আজ রাত্রে যাবেন কোথায়? এইখানেই আহারাদি করে শয়ন করবেন। ও দারোগা বেটার ছায়া মাড়াতেও হবে না, আপনার জন্যে সমস্ত আলাদা বন্দোবস্ত করে দেব।"

গোরার ক্ষুধা সাধারণের অপেক্ষা অধিক— আজ প্রাতে ভালো করিয়া খাওয়াও হয় নাই— কিন্তু তাহার সর্বশরীর যেন জ্বলিতেছিল— সে কোনোমতেই এখানে থাকিতে পারিল না, কহিল, "আমার বিশেষ কাজ আছে।"

মাধব কহিল, "তা, রসুন, একটা লণ্ঠন সঙ্গে দিই।"

গোরা তাহার কোনো জবাব না করিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেল।

 

 

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : দ্বাত্রিংশ পর্ব

মুসলমান খণ্ড—৪

১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ সিলেটে গিয়েছিলেন। সিলেটের ব্রাহ্ম সমাজ, মহিলা সমিতি ও আনজুমানে ইসলামিয়া ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান থেকে কবিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। খান বাহাদুর আবদুল মজিদ,মৌলভী আবদুল করিম, রায়বাহাদুর সুখময় চৌধুরী, রায়বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র দত্ত প্রমুখ জননেতা রেল স্টেশনে কবিকে অভ্যর্থনা জানান।

সৈয়দ মুর্তাজা আলী স্মৃতিকথায় লিখেছেন, চাঁদনি ঘাটে সিলেটের বনিয়াদী জমিদার পরিবারের– মজুমদার বাড়ি, কাজী বাড়ি (এহিয়া ভিলা) ও দস্তিদার বাড়ির প্রতিনিধিরা ঘোড়ায় চড়ে এসে কবিকে সম্বর্ধনা করেন। কবি, মৌলভী আবদুল করিমকে নিয়ে বসেন এক সুসজ্জিত ফিটন গাড়িতে।

কবিকে অভ্যর্থনা করা হয় রতনমণি লোকনাথ টাউন হলে। সেখানে সর্বাগ্রগণ্য জননেতা সৈয়দ আবদুল মুজিদ কবিকে অভিনন্দন জানান উর্দু ভাষায়। ছাত্রদের কাছে আকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন কবি। মুর্তজা আলীর ভাই সৈয়দ মুজতবা আলীর বয়স তখন মাত্র চৌদ্দ।

রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনে মুজতবা আলী কারো কাছে পরামর্শ না করে রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেন—'আকাঙ্ক্ষা করতে হলে কি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার'।

রবীন্দ্রনাথ তখন সিলেট থেকে গেছেন আগরতলাতে। সেখান থেকে চিঠির উত্তর দিয়েছেন দশ বারো লাইনে। চিঠির মর্ম ছিল, আকাঙক্ষা উচ্চ করতে হবে—এ কথাটার মোটামুটি অর্থ এই—যেন স্বার্থই মানুষের কাম্য না হয়। দেশের মঙ্গলের জন্য ও জনসেবার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত উদগ্র কামনাই মানুষের কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। তোমার পক্ষে কি করা উচিৎ তা এতদূর থেকে বলে দেয়া সম্ভব নয়। তবে তোমার অন্তরের শুভেচ্ছাই তোমাকে কল্যাণের পথে নিয়ে যাবে।

কবির এই চিঠি পেয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তি নিকেতনে পড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। মুজতবা আলীই বিশ্বভারতীর কলেজ বিভাগের প্রথম বাইরের প্রথম ছাত্র।

প্রায় এক বছর সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তি নিকেতনে একই ঘরের নিচে কবির সঙ্গে বসত করেছেন। মুজতবা আলী লিখেছেন—সেখান থেকে জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালেই দেখতে পেতুম, গুরুদেব তাঁর জানালার পাশে বসে লেখাপড়া করছেন। সকালে চারটার সময় দুঘণ্টা উপাসনা করতেন। তারপর ছটার সময় স্কুলের ছেলেদের মত লেখাপড়া করতেন। সাতটা-আটটা, নটা, তারপর দশ মিনিটের ফাঁকে জলখাবার। আবার কাজ—দশটা, এগারোটা, বারোটা। তারপর খেয়ে দেয়ে আধঘণ্টা বিশ্রাম। আবার কাজ—লেখাপড়া। একটা, দুটো, তিনটে, চারটা, পাঁচটা—কাজ—কাজ—কাজ। পাঁচটা থেকে সাতটা ছেলেমেয়েদের গান শেখাতেন—বা দিনুবাবুর আসরে বসে গান শুনতেন, অথবা গল্প-সল্প করতেন। তারপর খাওয়া সেরে আবার লেখালেখা পড়া। মাঝে মাঝে গুণগুণ করে গান—আটটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত। কী অমানুষিক কাজ করার ক্ষমতা! আর কী অপরিসীম জ্ঞানতৃষ্ণা।

সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, কবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ধরা ছোঁয়ার অতীত; সাধারন মানুষের নাগালের বাইরে—কিন্তু আমাদের কাছে তিনি ছিলেন স্নেহাসক্ত গুরু; নিতান্তই মাটির মানুষ।

সঙ্গীতজ্ঞ আব্দুল আহাদ ১৯৩৮ সালে শান্তি নিকেতনে সঙ্গীতভবনে ভর্ত্তি হন। তাঁর প্রথম রবীন্দ্রদর্শন বিষয়ে লিখেছেন, আমি (শান্তি নিকেতন) যাবার অল্পদিনের মধ্যেই হিন্দীভবনের উদ্বোধন করা হল। উদ্বোধনের দিনে প্রথম কবিগুরুকে দেখলাম, কী শান্ত সৌম্য মূর্তি। সাদা চুল এবং দাড়ি, সবকিছু মিলে সবার থেকে স্বতন্ত্র এক ব্যক্তিত্ব। কবিগুরু তখন কিছুটা কুঁজো হয়ে হয়ে গেছেন। বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া কবিগুরু উত্তরায়ণের বাইরে আসেন না।

কবি বন্দে আলী আলী মিয়ার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কটা ছিল সহজ। তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রকাশিত অনুরাগ কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে দেখা করেন। তিনি লিখেছেন, দোতলার সিঁড়ির মুখে উত্তর দিকে, বারান্দায় কবি চেয়ারে বসে লিখছিলেন। আমি গিয়ে কদমবুসি করে বইখানি হাতে দিলুম।কবি আমায় বসতে বলে ফাইন্টেন পেনটা মুড়ে অনুরাগের পাতা উল্টাতে শুরু করলেন। কবি (টেলিফোন পেয়ে) নিজেই উঠে দাঁড়ালেন। দীর্ঘ সুঠাম দেহ, ধুসর রঙের দীর্ঘ আলখাল্লা পা অবধি পড়েছে—নীচে সবুজ সাটিন লুঙ্গি ধরনের পরা। যীশুখ্রীস্টের ছবি দেখেছি– দণ্ডায়মান রবীন্দ্রনাথকে দেখে সেই কথা মনে পড়লো। রূপ, গুণ, স্বাস্থ্য, আভিজাত্য ইত্যাদির এমন সুসংহত সন্নিবেশ অপর কোনো মহাপুরুষের মধ্যে দেখতে পাওয়া গেছে কিনা জানি না।

শাহেদ সোহরাওয়ার্দী রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখেছিলেন অক্সফোর্ডে। সেটা ১৯১৩ সালে। রবীন্দ্রনাথ সবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। শাহেদ সোহারাওয়ার্দি বাংলা জানতেন না। তিনি লিখেছেন, প্রথম প্রথম রবীন্দ্রনাথের গানের সমাদরের কথা, বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরেই তা গাওয়া হচ্ছে—এ খবর যখন শুনি– অনেকটা অবিশ্বাসের সঙ্গেই সে কথা গ্রহণ করেছিলাম। কবির সঙ্গে যাদের প্রথম পরিচিতি ঘটে অনুবাদের ভিতর দিয়ে, তাদের মত আমার কাছেও তাঁর কাব্যের স্বকৃত ইংরেজী সংস্করণ যে এক আশ্চর্য আবির্ভারের মত বোধ হয়েছিল তা শুধু নতুনত্বের খাতিরেই নয়, তাঁর কাব্যের নিজস্ব সাহিত্যিক রসের জন্যই সে বিস্ময় এত বেশী।

প্যাডিংটন স্টেশনে পৌঁছে আমি একটা ট্যাক্সি করে চেলসীতে গেলাম, সেখানে এক বিরাট বাড়িতে কবি সদলবলে ছিলেন। একটা প্রশস্ত কামরায় আমায় নিয়ে গেলেন। আমি সেখানেই কবিকে প্রথম দেখি। কবি একটা ডিভানের উপর বসেছিলেন, আর দেওয়ালের চারদিক ঘিরে নানা জাতীয়—ভারতীয়, ইংরেজ ও অন্যান্য ইয়োরোপীয়—স্ত্রীপুরুষ চেয়ারের উপর বসেছিলেন। সমস্ত ঘরে এমন তন্ময় নিঃশব্দতা যেন সবাই গীর্জায় বসে আছেন। ঘরের এক কোণে একজন ইংরাজ মহিলা মাটি দিয়ে কবির মাথার ছাঁচ গড়ছিলেন। আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম অন্য এক কোণে হিংস্রদর্শন যুবা, তাঁকে পোল মনে হল, কবির আলখাল্লার অনবদ্য ভাঁজগুলি রেখায় ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করছে।

…সেদিন ভেবেছিলাম যে ভাস্কর ও চিত্রকরের সুবিধার জন্যই কবি নিশ্চল মূর্তিতে নিমীলিত চোখে বসে আছেন, কিন্তু পরে তার তাৎপর্য ভাল করে বুঝেছি। ইচ্ছামত ও বিনা আয়াসে তিনি নিজের মধ্যে ডুবে যেতে পারতেন এবং তখন তাঁর যে নিস্পন্দ ভাস্কর্য রূপ তা অনন্য সাধারণ। এ দূর্লভ শক্তির বিকাশ কবির মধ্যে যে পরিমাণে দেখেছি, অন্য কোথাও তা দেখি নাই। সাহচর্যের ভিতর সুদূর নিঃসঙ্গতা, কথাবার্তার মধ্যে হঠাৎ অন্তরতম জীবনের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ, পারিপার্শ্বিক থেকে বিচ্ছিন্ন করবার এ শক্তি স্বপ্নদ্রষ্টা ও আদর্শবাদিদের থাকে—তাঁরও ছিল। এ রকম ব্যক্তিদের সঙ্গে সহবতী চলে কিন্তু ঘনিষ্ট হওয়া যায় না। …কবি চিরকালই আমার কানের চেয়ে চোখকে বেশী আকর্ষণ করেছে।

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আমি দেখেছিলাম প্রাচ্যের সুর-ঝঙ্কার, ঐশ্বর্য ও মাধুর্যের প্রতীক। নদীর জলধারা যেমন করে বয়, বায়ূহিল্লোলে ধানের শীষ যেমন করে জাগে, বিশ্বের সৌন্দর্যলক্ষ্মী তাঁর কাছে তেমন করে আসে। স্বভাবে কোমল লঘুপদক্ষেপে প্রিয়তমের কাছে ইপ্সিতার যে অভিসার, রবীন্দ্রনাথের কাছে সৌন্দর্যলক্ষ্মীর সেই গতি।

মোহাম্মদ হেদায়তুল্লাহ রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে প্রথম যখন গিয়েছিলেন—রবীন্দ্রনাথ তখন প্রাসাদপ্রতীম সৌধের একটি কক্ষে বসেছিলেন। কক্ষটির সাজসজ্জা সাদামাটা ধরনের। কবি বসে আছেন একটি সাবেকী তক্তপোষ আশ্রয় করে। সেখানে চেয়ার টেবিলের বাহুল্য নেই। তক্তপোষের একপাশে বই রাখার একটি মঞ্চবিশেষ। তাঁর সঙ্গে কবির দেখা হল। মোহাম্মদ হেদায়তুল্লাহ লিখেছেন—যেন কতদিনের পরিচয়। যিনি সবাইকে আপন জ্ঞান করেন তাঁহার কাছে আমি আপন—বিশেষতঃ আমার সাক্ষাৎ যে উদ্দেশ্যপ্রোণেদিত তাহা অবগত হইয়া তিনি নিতান্তই পরিচিতের মত আলোচনায় রত হইলেন।

কবি জসীমউদ্দিন রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন একটি নাট্যাভিনয়ে। জসীমউদ্দিন তখন ফরিদপুর থেকে কলকাতায় পড়তে এসেছেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে সেদিন রবীন্দ্রনাথের শেষবর্ষণ নাটকটির অভিনয় দেখতে গিয়েছিলেন তিনি আট আনার টিকিট কেটে। দর্শকদের মধ্যে কলকাতার অভিজাত শ্রেণীর সুসজ্জিত মেয়েরা রহস্যময়ী চাঁদের মত বসে আছে। জসীমউদ্দিন লিখেছেন, কিছুক্ষণ পরে সামনের মঞ্চের পর্দা উঠিয়া গেল। বর্ষাকালের যত রকমের ফুল সমস্ত আনিয়া মঞ্চটিকে অপূর্বভাবে সাজান হইয়াছে। সেই মঞ্চের উপর গায়ক-গাযিকা পরিবৃত হইয়া রবীন্দ্রনাথ আসিয়া যখন উপবেশন করিলেন, তখন আমার সামনে উপবিষ্ট সেই রহস্যময়ী চাঁদেরা জোনাকীর মতো যেন ম্লান হইয়া গেল।

নাটক শেষ হলে কবি মঞ্চের উপর দাঁড়ালেন। অনেকে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন। জসীমউদ্দিনও তাদের সঙ্গে দাঁড়ালেন। কিন্তু প্রণাম করলেন না। আর দশজনের মত তাকে প্রণাম জানিয়ে পথের দশজনের মধ্যেই মিলিয়া যাবেন—কবির সঙ্গে তরুন কবি জসীমউদ্দিনের সেই সম্পর্ক নয়। তিনি শুধু এক দৃষ্টিতে রবিকবির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে কবি ঢাকায় এসেছিলেন। সেদিন বিকেলে করোনেশন পার্কের বিশাল জনসভায় প্রথম দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে লেখক আবুল ফজল। তিনি রেখাচিত্র বইয়ে লিখেছেন সেদিনের স্মৃতি—কবির জন্য মঞ্চ তৈরী হয়েছিল পার্কের পূব ধারে—কাজেই কবি যখন বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালেন তখন তিনি সূর্যের মুখোমুখি। দীর্ঘ বপু, চুল দাড়ি গোঁফ সবই রূপার মতো সাদা। কিন্তু দেহের কোথাও জরার চিহ্ণ লক্ষ্য গোচর নয়। যখন ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে– সে সূর্যের তখনকার কিরণের সঙ্গে তার গায়ের রং একাকার হয়ে মিশে গেছে, সে সূর্যের দিকে চেয়ে, তার অস্তগমনের সঙ্গে নিজের অস্তগমনোন্মুখ জীবনের তুলনা দিয়ে এক অতুলনীয় ভাষায় বক্তৃতা শুরু করলেন, তখন বিপুল জনতা কবি-মুখ-নিসৃত ভাষার সৌন্দর্যে ও কণ্ঠের মাধুর্যে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো।

কোনো কথা কি ভাষার জন্য তাকে ভাবতে দেখিনি, ঝরণার ধারার মতো তাঁর কণ্ঠ থেকে বানীর স্রোত বয়ে চলেছে। কোনো উত্তেজনা নেই, হাত-পায়ের ছোড়াছুড়ি নেই, নেই কোনো পেশাদার বক্তার মতো কণ্ঠের উত্তান-পতন, স্থির শান্ত মুখশ্রীতে নেই কোন বিপর্যয়—প্রায় আধ ঘণ্টা কি তারো বেশী এক অপূর্ব বাণী স্রোতে আমরা যেন অবগাহন করে উঠলাম।

কবি জসীমউদ্দিন ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় বইটিতে একটি ঘটনার কথা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঘটনাটি তাঁকে বলেছিলেন—দেখ, জমিদারির তদারকী করতে সাজাদপুরে যেতাম। আমাদের একজন বুড়ো প্রজা ছিল। যৌবনকালে সে অনেক ডাকাতি করেছে। বুড়ো বয়েসে সে আর ডাকাতি করতে যেত না। কিন্তু ডাকাতরা তাকে বড়ই মানত। একবার আমাদের এক প্রজা অন্য দেশে নৌকা করে ব্যবসা করতে যায়। ডাকাতের দল এসে তার নৌকা ঘিরে ধরল। তখন সে আমাদের জমিদারির সেই বুড়ো প্রজার নাম করল। তারা নৌকা ছেড়ে চলে গেল। এই বলে চলে গেল, ও তোমরা অমুক দেশের অমুকের গাঁয়ের লোক। যাও, তোমাদের কোনো ভয় নেই। সেই বৃদ্ধ মুসলমান আমাকে বড়ই ভালবাসত। তখন নতুন বয়স। আমি জমিদারির তদারক করতে এসেছি। বুড়ো প্রায় পাঁচশ প্রজা কাছারির সামনের ডেকে নিয়ে এসেছে। আমি বললাম, এত লোক ডেকে এনেছ কেন? সে উত্তর কলল, ওরা আপনাকে দেখতে এসেছে। ওরে তোরা দেখ। একবার প্রাণভরে সোনার চাঁদ দেখে নে। আমি দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলাম।

 

 

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ত্রয়স্ত্রিংশ পর্ব

মুসলমান খণ্ড—৫

 

সুফিয়া কামাল রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে একটি কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন। ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের বৈশাখে। কবি তখন আলমোড়ায়। কবি সুফিয়া কামালকে কয়েকটি লাইন লিখে পাঠালেন—

বিদায়-বেলার রবির সনে

বনশ্রী তার অর্ঘ্য আনে

অশোক ফুলের বরুণ অঞ্জলি।

আভাস তারই রঙিন মেঘে

শেষ নিমিষে রইল লেগে

রবি যখন অস্তে যাবে চলি।

কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের স্ফুলিঙ্গ কাব্যের ২৬৭ সংখ্যক কবিতাংশে সংকলিত হয়েছে। কবিতাটি পাঠিয়ে কবি সুফিয়া কামালকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। সুফিয়া কামালের বাড়ি বরিশালে জেনে কৌতুক করে বলেছিলেন-তুমি আমার বেয়াইয়ের দেশের মানুষ। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মধুর-মিষ্টি তুমি। কবির মেজো মেয়েটির বিয়ে দিয়েছিলেন বরিশালে।

সুফিয়া কামাল লিখেছেন, তিনি (রবীন্দ্রনাথ) সুরসিক সুন্দর মনের মানুষ। কতবার তাঁর বাড়িতে গিয়েছি। তাঁর নিজের করা নাটক দেখতে আমাকে ডেকেছেন। নিজ হাতে নাম লিখে তাঁর গোরা বইখানা আমাকে উপহার দিয়েছেন। লিখেছেন– শ্রীমতি কল্যাণীয়া সুফিয়া খাতুনকে স্নেহ উপহার দিলাম

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৭ আশ্বিন ১৩৩৬।

সুফিয়া কামাল প্রথম দিন জোড়াসাঁকোতে গিয়েছিলেন বোরকা পরে। সঙ্গে তাঁর স্বামী নেহাল হোসেন। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকাও গিয়েছিলেন কবির কাছে বোরকা ছাড়াই। পায়ে হাত দিয়ে কবিকে সালাম করছেন। তিনি লিখেছেন, আমি সেলাম করে উঠলে দুহাত উর্দ্ধ তুলে চোখ বন্ধ করে বহুক্ষণ ধরে কি প্রার্থনা করলেন। আমি অবাক হয়ে দেখেছি তাঁর সর্বদেহ থেকে আলোক বিচ্ছুরিত হতে লাগলো। তারপরে তিনি পাশে বসিয়ে গল্প করতে আরম্ভ করলেন—তোমরা যে পর্দ্দা থেকে বাইরে এসেছ এই আমি আশ্চর্য হয়েছি। দ্যাখো সূর্যের কিরণ না পেলে যেমন গাছপালা বড় হয় না ফলমুল ভালো দেয় না, মানুষও তেমনি বাইরের আলোবাতাস ছাড়া পূর্ণ হতে পারে না। পদ্ম পঙ্ক থেকে  উর্দ্ধে উঠেই সূর্যের কিরণ লাভ করে, না হলে সে লাভ করতে পারত না। আর এখানেই তার সার্থকতা।

রাহাত আরা বেগম রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটক উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন। ১৯২৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর তিনি স্বামীর সঙ্গে জোড়াসাঁকোর বাসায়  গিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, খুবই ভদ্রতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি (রবীন্দ্রনাথ) আমাদের সঙ্গে মিশলেন। অনেক কথা বললেন। …আমাদের দুজনকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে কিছুদিন থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সওগাত পত্রিকার প্রথম সংখ্যা বের হওয়ার পরে জোড়াসাঁকোতে কবির সঙ্গে দেখা করলেন। কবিকে সালাম জানালেন। শান্তস্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তিনি সালাম গ্রহণ করে বসতে বললেন।  সওগাত পত্রিকা থেকে দুটো কবিতা পড়লেন। সওগাত নামটির প্রশংসাও করলেন। নাসিরউদ্দিন সওগাত পত্রিকার জন্য কবির কাছে কবিতা চাইলেন।

কবির সব লেখাই তখন বিশ্বভারতীর কাছে প্রদান করেছেন। কবির লেখা পেতে হলে বিশ্বভারতীকে টাকা দিতে হয়।  এই লেখা থেকে প্রাপ্ত টাকা বিশ্বভারতীর পরিচালনার কাজে ব্যয় হয়।

নাসিরউদ্দিন সেকথা শুনে ফিরে গেলেন। টাকা দিয়ে লেখা নেওয়ার সঙ্গতি তাঁর নেই। কদিন পরেই ডাকে কবির একটি চিঠি তিনি পেলেন। সঙ্গে একটি কবিতা। কবি তাঁকে লিখেছেন– বিশ্বভারতীকে টাকা দিয়ে আমার লেখা নেয়া তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না বলে সেদিন জানিয়েছিলে। আমি লক্ষ্য করেছি তুমি খুব নিরাশ হয়ে চলে গেলে। একটা কবিতা পাঠালাম। আশা করি তোমার ভাল লাগবে। এর জন্য তোমাকে টাকা দিতে হবে না। এরপর মাঝে মাঝেই কবি নিজের উদ্যোগেই সওগাত পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছেন। সওগাতের দ্বিতীয় সংখ্যায় একটি কথিকা পাঠিয়েছিলেন। নাম ছিল—সওগাত।

কবি জসীমউদ্দিনের নকশী কাঁথার মাঠ প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করে লিখেছিলেন—জসীমউদ্দিনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির কদর এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমন খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।

একরামউদ্দীন (১৮৮০—১৯৩৫) 'রবীন্দ্রপ্রতিভা' সমালোচনাগ্রন্থ লিখেছিলেন।  বইটিকে তিনি রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন। কবি চিঠিতে লিখেছিলেন– আপনি যে সরস বাংলা ভাষায় আমার রচনার সমালোচনা করিয়াছেন তা পাঠ করিয়া আমি বিস্মিত হইয়াছি।

ইমাম গাজ্জালীর ইয়াহিয়া-উল-উলমুদ্দিনের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ কিমিয়া সাআদাত  অনুবাদ করেছিলেন মীর্জা মোহাম্মদ ইউসফ। বইটির নাম রেখেছিলেন সৌভাগ্য স্পর্শমণি। রবীন্দ্রনাথ বইটি পড়ে পরম তৃপ্তি লাভ করেছেন। গ্রন্থটির মধ্যে ভাবের মহত্ত্ব দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলেন।

সারা তৈফুর (১৮৮৮-১৯৭১) হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর  প্রথম বাঙালি মুসলমান মহিলাজীবনীকার। তিনি এ কে ফজলুল হকের ভাগ্নি ও ইতিহাসবিদ-পুরাতত্ত্ববিদ সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুরের স্ত্রী। তাঁর স্বর্গের জ্যোতিঃ পুস্তিকা রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন। বইটির একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছিল মৌলবী মুজিবর রহমান সম্পাদিত দি মুসলমান পত্রিকা। সেখানে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠির উদ্ধৃতি ছিল—আপনার স্বর্গের জ্যোতি: গ্রন্থখানি পাঠ করিয়া আনন্দিত হইলাম, ইহার ভাষা ও রচনা সুন্দর হইয়াছে। বাংলা ভাষায় এরূপ গ্রন্থের অভাব ছিল, আপনি তাহা দূর করিয়াছেন।

মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮০—১৯৪০) হযরত মোহাম্মদের কিশোর জীবনী লিখেছেন নূরনবী নামে। রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠির বইটির পুনর্মুদ্রিত সংস্করণে চিঠিটির অংশ বিশেষ ছাপা হয়েছিল। সেখানে নূরনবীর বইটির প্রশংসা করেছেন। বইটির বিষয় ও রচনাপ্রণালী শিশু পাঠকদের পক্ষে মনোরম বলে প্রশংসা করেছেন।

কাজী আবদুল ওদুদের নদীবক্ষে উপন্যাসটি পড়ে ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১৫ বৈশাখ কবি লিখেছেন– আপনার লিখিত নদীবক্ষে উপন্যাসখানিতে মুসলমান চাষীগৃহস্থের যে সরল জীবনের ছবিখানি নিপুণভাবে পাঠকদের কাছে খুলিয়া দিয়াছেন তাহার স্বাভাবিকতা, সরসতা ও নূতনত্বে আমি বিশেষভাবে আনন্দলাভ করিয়াছি—এই কারণে আমার কৃতজ্ঞতা জানিবেন।

কাজী আবদুল ওদুদের প্রথম প্রবন্ধ সংকলনে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তিনটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন—রবীন্দ্রনাথের কবিতা, রবীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভা এবং রবীন্দ্রনাথ ও প্রতিভাবর প্রথম বিকাশ। তিনটি প্রবন্ধ শুরুতে ১৩৩২ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশি হয়েছিল। কবি বইটি পড়ে লিখেছেন—এতে মনের জোর, বুদ্ধির জোর, কলমের জোর একসঙ্গে মিশেছে।…গোঁড়ামীর নিবিড় বিভীষিকার ভিতর দিয়ে কুঠার হাতে তুমি পথ কাটতে বেরিয়েছ, তুমি ধন্য।

১৬ অক্টোবর ১৯৩৪ সালে কাজী আবদুল ওদুদকে শান্তিনিকেতন থেকে চিঠিতে  কবি তাঁর নিজের গান বিষয়ে আলোচনা করেছেন। বলেছেন, আমার গান সম্বন্ধে আপনার প্রবন্ধ পূর্ব্বেই পড়ে আমি বিশেষভাবে খুশি হয়েছিলাম। তার কারণ আমার পাঠকেরা আমার গানকে কাব্যের সম্পূর্ণতা থেকে স্বতন্ত্র করে দেখে।  সুরের একান্ত আশ্রিত সে রকম কবিতাও আমার আছে—সুর থেকে বিচ্ছিন্নতার বৈধব্য দশায় সে শ্রীহীন এবং প্রায় নিরর্থক। কিন্তু আমার বিস্তর গান আছে তা কাব্য, বাইরে থেকে সুর যোজনা না করলেও সুর আছে তার অন্তর্নিহিত। আমার নিজের বিশ্বাস কাব্য হিসাবে আমার অধিকাংশ কবিতার চেয়ে সেগুলো শ্রেষ্ঠ। বঙ্গসাহিত্যে জাতীয়তার আদর্শ বিষয়ে তিনি ওদুদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। এ বিষয়ে তিনি ওদুদকে লেখেন–সাহিত্যের প্রধান ধর্ম্মই এই সকল আদর্শ তার মধ্যে প্রধানত পরোক্ষভাবে প্রকাশ পায় প্রত্যক্ষভাবে নয়, এই কারণেই সে আদর্শ সর্ব্বজাতীয় হয়ে ওঠে—উপস্থিত কালের মধ্যেই তার ফল ফলে না দীর্ঘকালে তার সফলতা।

কাজী ইমদাদুল হকের (১৮৮২—১৯২৬) আবদুল্লাহ (১৯৩৩) উপন্যাস পড়ে কবি ওদুদকে লিখেছিলেন, আব্দুল্লাহ বইখানি পড়ে আমি খুশি হয়েছি। বিশেষ কারণ এই বই থেকে মুসলমানদের ঘরের খবর জানা গেল। এ দেশের সামাজিক আবহাওয়াঘটিত একটা কথা এই বই আমাকে ভাবিয়েছে। দেখলুম যে ঘোরতর বুদ্ধির অন্ধতা হিন্দুর আচারে হিন্দুকে পদে পদে বাধাগ্রস্থ করেছে সেই অন্ধতাই ধুতি চাদর ত্যাগ করে লুঙ্গি ও ফেজ পরে মুসলমানের ঘরে মোল্লার অন্ন জোগাচ্ছে। একি মাটির গুণ? এই রোগ বিষে ভরা বর্ব্বরতার হাওয়া এ দেশে আর কতদিন বইবে। আমরা দুই পক্ষ থেকে কি বিনাশের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত পরস্পরকে আঘাত ও অপমান করে চলে চলব।

ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ভাষা ও সাহিত্য ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩১ সালে। বইটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ শহীদুল্লাহকে ১৯৩২ সালের ২৯ জুলাই  চিঠি লিখে জানান, বাংলা সাহিত্যে মুসলমান লেখকদের আহবান করে আপনি যে প্রবন্ধ কয়টি লিখেছেন, তা হিন্দুদেরও বিচার্য্য। বাংলার ভাষাতত্ত্ববিচার সম্বন্ধে আপনার যোগ্যতার প্রশংসা অনাবশ্যক। এ প্রসঙ্গে আপনি আমাকে সাধুবাদ দিয়েছেন তাতে আমি সংকোচ বোধ করি। যে সময়ে আমি এই অনুশীলনে প্রবৃত্ত হয়েছিলেম তখন এ পথে আমি ছিলাম একা। তাছাড়া বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে আমি সম্পূর্ণ আনাড়ি। অন্ধকারে আমার প্রদীপ ছিল না, হাতড়িয়ে বেড়িয়েছি। যখন থেকে আপনাদের হাতে আলো জ্বলল, তখন থেকেই এই অধ্যবসায় ত্যাগ করেছি।

ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ইরানী কবি হাফেজের কবিতার পদ্যে অনুবাদ করেছিলেন। সেগুলো পড়ে কবি এই চিঠিতে  অনুবাদ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন কবি—বাংলা ভাষায় আরবী ও পারসী সাহিত্যের অনুবাদ অবশ্য কর্তব্য আমার তাতে সন্দেহ নেই। যদি বিশ্বিভারতীর এ অর্থদৈণ্য কখনো দূর হয় তবে এ কাজে নিশ্চয়ই প্রবৃত্ত হব।

বিদেশী ভাষার উচ্চ শ্রেণীর কাব্যগুলিকে পদ্যে অনুবাদ করার চেষ্টা বর্জ্জনীয় বলে আমি মনে করি। কবিতায় এক দিকে ভাবার্থ, আর এক দিকে ধ্বনির ইন্দ্রজাল। ভাষার্থকে ভাষান্তরিত করা চলে কিন্তু ধ্বনির মোহকে এক ভাষা থেকে আর এক ভাষায় কোনোমতেই চালান করা যায় না। চেষ্টা করতে গেলে ভাবার্থের প্রতিও জুলুম করতে হয়। এই কারণেই পদ্যে আপনার হাফেজ অনুবাদ চেষ্টার আমি অনুমোদন করতে পারলেম না।

ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বাঙ্গালা ব্যাকরণ ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয়। কবি সেটি পড়ে কবি সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে   চিঠিতে জানিয়েছেন। ব্যাকরণখানি সকল দিক থেকেই সম্পূর্ণ হয়েছে—এতে ছাত্রদের উপকার হবে বলেও লিখেছেন। বইটি শান্তিনিকেতনের শিক্ষকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ছাত্রদের ব্যবহারের জন্য।

ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে একমাত্র ছেলে রথীন্দ্রনাথের বিয়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন। ১৯২২ সালে ১২ মে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়র ম্যানেজিং কমিটির (সিন্ডিকেট) সদস্যরূপে বরণ করে চিঠি লিখেছিলেন মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে। শহীদুল্লাহ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সমস্যার কারণে তিনি বিশ্বভারতীর প্রথম সংসদের সদস্যপদ লাভের দুর্লভ সম্মান গ্রহণে দ্বিধাবোধ করেছিলেন। তবে সংসদের সদস্যদের তালিকায় শহীদুল্লাহর নাম মুদ্রিত হয়েছিল।  অধ্যাপক ভুঁইয়া ইকবাল লিখেছেন–সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী শহীল্লাহর নিযুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। অথচ এই শাস্ত্রীই ১১ মাস আগে শহীদুল্লাহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার সময়ে তাঁর নিযুক্তির সমর্থন করেছিলেন।  আমাদের ধারণা, ওই পরিস্থিতিতে শহীদুল্লাহ হয়তো রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে উপযুক্ত সাড়া দেওয়া নিরাপদ বিবেচনা করেন নি।

নবীন কবিযশোপ্রার্থী আজিজুল হাকিম কবির বাণী চেয়েছিলেন। কবি ১৯২৯ সালের ১০ অক্টোবর তাঁকে লিখেছিলেন, আমার বাণী আমার কাজের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। যখন আমার কাজের সঙ্গে পরিচয় হবে তখন আমার বাণী শুনতে পাবে। আমাদের দেশে আমরা কেবল কথা বলচি এবং কথা বলচি এবং কতকগুলি বাধা-কথার বন্ধনে বদ্ধ হয়ে পড়েচি। বড়ো কথা মাত্রই অত্যন্ত পুরোনো, কাজের মধ্যে দিয়েই জীবনে তাদের নূতন করে আবিষ্কার করি। যতক্ষণ না করি ততক্ষণ সে কথাগুলো বস্তার ভিতরকার বীজের মতো, যে বীজ উপযুক্ত মাটির মধ্যেই সক্রিয়, সার্থক হয়। অন্যত্র কেবল মাত্র বোঝা হয়ে থাকে।

মুরশিদাবাদের নবাব বাহাদুরের নেতৃত্ত্বে হিন্দু মোসলেম সম্প্রীতি সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে ১৯৩৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দন্তচিকিৎসক ডাঃ আর আহমদকে শুভেচ্ছা পত্র লিখেছিলেন। তিনি কবির দাঁতের চিকিৎসা করেছিলেন। তাঁর চিকিৎসায় সন্তুষ্ট হয়ে কবির সহকর্মী প্রমোদেলাল গাঙ্গুলির দন্তক্ষয়ের চিকিৎসা করার অনুরোধ করেছিলেন।

বন্দে আলী মিয়ার ময়নামতি চর কাব্যগ্রন্থ পড়ে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখেছেন, তোমার ময়নামতির চর কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট, কোথাও ফাঁকি নেই। সমস্ত মনের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছ এবং কলমের অনায়াস ভঙ্গিতে লিখেছ। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক শব্দগুলি যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুণ্ঠিত হওনি তাতে করে কবিতাগুলি আরো সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাপাড়ের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকট স্পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোনো কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না।

পদ্মা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে বড়ো জায়গা আছে। সারা জীবন ধরে যে নদীকে দেখেছেন বা ভেবেছেন বা গড়েছেন সে নদী পদ্মাই। শিলাইদহ থেকে চলে আসার অনেক দিন পরে, যখন তিনি খুব বুড়ো হয়ে গেছেন, বাইরে যাওয়ার আর সামর্থ্যটি নেই—তখন তিনি লিখেছিলেন শান্তি নিকেতনের কোপাই নদীটিকে নিয়ে একটি কবিতা। কোপাই নদীটিকে লিখতে গিয়ে হঠাৎ করে লিখে ফেলেন পদ্মার কথাই।

পদ্মা কোথায় চলেছে দূর আকাশের তলায়,

মনে মনে দেখি তাকে।

এক পারে বালুর চর,

নির্ভীক কেননা নিঃস্ব, নিরাসক্ত—

অন্য পারে বাঁশবন, আমবন,

পুরোনো বট, পোড়ো ভিটে,

অনেক দিনের গুঁড়ি-মোটা কাঁঠালগাছ—

পুকুরের ধারে সর্ষেখেত,

পথের ধারে বেতের জঙ্গল,

দেড়শো বছর আগেকার নীলকুঠির ভাঙা ভিত,

তার বাগানে দীর্ঘ ঝাউগাছে দিনরাত মর্মরধ্বনি।

ওইখানে রাজবংশীদের পাড়া,

ফাটল-ধরা খেতে ওদের ছাগল চরে,

হাটের কাছে টিনের-ছাদ-ওয়ালা গঞ্জ—

সমস্ত গ্রাম নির্মম নদীর ভয়ে কম্পান্বিত।

পুরাণে প্রসিদ্ধ এই নদীর নাম,

মন্দাকিনীর প্রবাহ ওর নাড়ীতে।

ও স্বতন্ত্র। লোকালয়ের পাশ দিয়ে চলে যায়—

তাদের সহ্য করে, স্বীকার করে না।

বিশুদ্ধ তার আভিজাতিক ছন্দে

এক দিকে নির্জন পর্বতের স্মৃতি, আর-এক দিকে নিঃসঙ্গ সমুদ্রের আহ্বান।

একদিন ছিলেম ওরই চরের ঘাটে,

নিভৃতে, সবার হতে বহুদূরে।

ভোরের শুকতারাকে দেখে জেগেছি,

ঘুমিয়েছি রাতে সপ্তর্ষির দৃষ্টির সম্মুখে

নৌকার ছাদের উপর।

আমার একলা দিন-রাতের নানা ভাবনার ধারে ধারে

চলে গেছে ওর উদাসীন ধারা—

পথিক যেমন চলে যায়

গৃহস্থের সুখদুঃখের পাশ দিয়ে, অথচ দূর দিয়ে।

১৮৯১ সালের অক্টোবরে (সোমবার ৩ কার্তিক) ইন্দিরাকে লিখেছিলেন কবি, কোজাগার পূর্ণিমার দিন নদীর ধারের আস্তে আস্তে বেড়াচ্ছিলুম—আর মনের মধ্যে স্বগত কথোপকথন চলছিল;ঠিক 'কথোপকথন' বলা যায় না, বোধ হয় আমি একলাই বকে যাচ্ছিলুম আর আমার সেই কাল্পনিক সঙ্গীটি অগত্যা চুপচাপ করে শুনে যাচ্ছিল, নিজের হয়ে একটে জবাব দেওয়াও সে বেচারার জো ছিল না—আমি তার মুখে যদি একটা নিতান্ত অসঙ্গত কথাও বসিয়ে দিতুম তা হলেও তার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু কী চমৎকার হয়েছিল, কী আর বলব। কতবার বলেছি, কিন্তু সম্পূর্ণ কিছুতেই বলা যায় না। নদীতে একটি রেখামাত্র ছিল না;–ও-ই সেই চরের পরপারে যেখানে পদ্মার জলের শেষ প্রান্ত দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে আর এ পর্যন্ত একটি প্রশস্ত জ্যোৎস্না ঝিক ঝিক করছে; একটি লোক নেই, একটি নৌকো নেই, ও পারের নতুন চরে একটি গাছ নেই, একটি তৃণ নেই—মনে হয়, যেন একটি উজাড় পৃথিবীর উপরে একটি উদাসীন চাঁদের উদয় হচ্ছে, জনশূণ্য জগতের মাঝখান দিয়ে একটি লক্ষ্যহীন নদী বহে চলেছে, মস্ত একটা পুরাতন গল্প এই পরিত্যাক্ত পৃথিবীর উপরে শেষ হয়ে গেছে, আজ সেই-সব রাজা রাজকন্যা পাত্র মিত্র স্বর্ণপুরী কিছুই নেই, কেবল সেই গল্পের 'তেপান্তের মাঠ' এবং 'সাত সমুদ্র তেরো নদী; ম্লান জ্যোৎস্নায় ধূ ধু করছে। আমি যেন সেই মুমূর্ষু পৃথিবীর একটি মাত্র নাড়ীর মতো আস্তে আস্তে চলছিলুম। আর সকলে ছিল আর-এক পারে, জীবনের পারে…

বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড়ো ভালোবাসি। ইন্দ্রের যেমন ঐরাবত আমরা তেমনি পদ্মা-আমার যথার্থ বাহন; খুব বেশি পোষ-মানা- নয়, কিছু বুনোরকম; কিন্তু ওর পিঠে এবং কাঁধে হাত বুলিয়ে ওকে আমার আদর করতে ইচ্ছে করে। …আমি যখন শিলাইদহে বোটে থাকি তখন পদ্মা আমার পক্ষে সত্যিকারের একটি স্বতন্ত্র মানুষের …

(ছিন্নপত্র, ২ মে ১৮৯৩)

 

 

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি :চতুস্ত্রিংশ পর্ব

মুসলমান খণ্ড—৬

রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৩ সালের ১৩ জুলাই পাবনার সিরাজগঞ্জের সেবক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা আবুল মনসুর এলাহী বক্সকে চিঠিতে লিখেছেন, মানুষের দুঃখ দূর ঈশ্বরের উপাসনার শ্রেষ্ঠ অঙ্গ। তোমরা সেই শ্রেয়ঃ সাধনায় ব্রতী হয়েছো, তার সফলতা চিরদিন অন্তরে বাহিরে তোমাদের অনুবর্তী হোক এই আমার সর্বান্তঃকরণের আশীর্বাদ।

এর পরই তাঁকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন মুসলমান সম্পর্কে তাঁর ধারণা, বোগদাদের মরুভূমিতে একজন বেদুয়িন দলপতি আমাকে এই বলেছিলেন যে, যাঁর বাক্যের দ্বারা , কর্মের দ্বারা, কোনো মানুষ পীড়িত হয় না, তিনিই যথার্থ মুসলমান। যাঁর বাক্য অসহায়ের সহায়, নিরাশ্রয়ের আশ্রয়, দুঃখীর সান্ত্বনা তিনিই সত্য ধর্মের দূত।

জসীমউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হলেই রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। তিনি এই সমস্যার মূলসূত্রটি ধরিয়ে দিয়েছেন তাঁকে। বলেছেন, দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে দিলেই যে ঘরে আগুন লাগে তার কারণ সেই ঘরের মধ্যে বহুকাল আগুন সঞ্চিত ছিল। যাঁরা বলতে চান, আমরা সবাই মিলে মিশ হয়ে ভালো ছিলুম, ভাল ইংরেজ এসেই আমাদের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিল, তাঁরা সমস্যাটি এড়িয়ে যেতে চান।

সে সময়ে বন্দে মাতরম গানটি নিয়ে হিন্দু-মুসলমান হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে খুব বিরোধ চলছিল। রবীন্দ্রনাথ জসীমউদ্দিনকে বলেছিলেন, বন্দে মাতরম গানটি যেভাবে আছে, তোমরা মুসলমানেরা এ জন্য আপত্তি করতে পার। কারণ এ গানে তোমাদের ধর্মমত ক্ষুণ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।  তখন কংগ্রেসের জহর লাল নেহেরু গানটি রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়েছিলেন।  কবির এ গানে মুসলমানদের আপত্তিজনক অংশটি কেটে ফেলার জন্য কবি নেহেরুকে পরামর্শ দেন। এর কংগ্রেসের কোনো সভায় বন্দে মাতরমের আপত্তির জায়গাটি আর না গাওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।

জসীমউদ্দিনের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে কবি বলেছেন, কেন যে মানুষ একের অপরাধের জন্য অপরকে মারে! ও-দেশের মুসলমানেরা হিন্দুদের মারল, তাই এদেশের হিন্দুরা এখানকার নিরীহ মুসলমানদের মেরে তার প্রতিবাদ করবে, এই বর্বর মনোবৃত্তির হাত থেকে দেশ কিভাবে উদ্ধার পাবে বলতে পার? দেখ, কী সামান্য ব্যাপার নিয়ে কলহ হয়। গরু কোরবানী নিয়ে, মসজিদের সামনে বাজনা নিয়ে। একটা পশুকে রক্ষা করতে কত মানুষকে হত্যা করছে।

এইসব আলোচনা করতে করতে কবি মাঝে মাঝে বড়ই উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। জসীমউদ্দিন জানাচ্ছেন, কবির মনে একদেশদর্শী হিন্দুত্বের স্থান ছিল না। মুসলমানদের মধ্যে যাহারা স্বাধীন মতবাদ নিয়ে ধর্ম ও সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করতেন, তাদের প্রতি কবির মনে প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল।

বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনের নেতা কাজী আব্দুল ওদুদকে বিশ্বভারতীতে নিজাম-বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করেন। আব্দুল ওদুদ সেখানে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ বিষয়টি নিয়ে তিনদিন  লিখিত বক্তৃতা দেন। কবি তখন বেশ অসুস্থ। কিন্তু অসুস্থতা নিয়েও তিনি নিজে উপস্থিত থেকে বক্তৃতা শুনেছেন। কবি আব্দুল কাদির জানিয়েছেন, সে-সময় তাঁর (কাজী আবদুল ওদুদ) সঙ্গী হয়ে আমি ও সৈয়দ মোতাহের হোসেন চৌধুরী শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম। আমরা প্রায় সপ্তাহকাল রবীন্দ্রনাথের অতিথিরূপে শান্তিনিকেতনে অবস্থান করেছিলাম। প্রত্যহ দুপুরে দক্ষিণায়নে আমাদের আহারের সময় কবিগুরু উপস্থিত থাকতেন এবং নানা প্রসঙ্গে আলাপ করতেন। সে আলাপ জুড়ে থাকত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি—হিন্দু-মুসলমানের মিলন কামনা।

শামসুন্নাহার মাহমুদকে ১৯৩৩ সালের ৭ নভেম্বর শান্তিনিকেতন থেকে চিঠিতে তৎকালীন সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি এবং বিশেষভাবে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ বিষয়ে কবি লিখেছিলেন—আমি পারস্য ইরাক ইজিপ্ট ভ্রমণ করে এসেছি। বহু শতাব্দীর মোহান্দকার ভেদ করে সর্বত্রই নবপ্রভাতের আলোক আজ প্রকাশিত, সর্বত্রই সেখানকার নানা লোকের মুখে শুনে এলেম ভারতবাসীর অন্ধতার প্রতি ধিক্কার। স্পষ্ট উপলদ্ধি করেছি আজকের দিনে নবজীবনের উৎসাহে উদ্দীপ্ত সমস্ত প্রাচ্য মহাদেশের মধ্যে একমাত্র ভারতবর্ষেই আমরা মুক্তির ক্ষেত্রে কাঁটাগাছ রোপণ করে বসেছি। এই মূঢ়তার অপমান সমস্ত পৃথিবীর সম্মুখে আজ অনাবৃত্ত অথচ হতভাগ্য দেশে এর প্রতিকার আজ এত দুঃস্বাধ্য।

ময়মনসিংহের করিমগঞ্জের জুট রেজিস্ট্রেশনের সহকারী ইন্সপেক্টর কাজী আহমদকে লেখা চিঠিতে জানা যাচ্ছে কবি ধর্মান্ধদেরকে ক্ষুদ্র হৃদয়ের অধিকারী হিসাবে মনে করেন। তিনি লিখেছেন —ধর্ম যদি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে খর্ব্ব করে তার চেয়ে শোচনীয় কিছু হতে পারে না। যারা সর্ব্ব মানুষের এক ঈশ্বরে যথার্থ বিশ্বাস রাখেন তারা কোনো কারণেই মানবকে অপমান করে নিজের ধর্মকে অপমানিত করতে পারে না। এই আমার মত। ক্ষুদ্র হৃদয় যাদের ঈশ্বরের সিংহাসনকে তারা সংকীর্ণ করে—এটা আপরাধ।

এই অপরাধের জন্য তিনি কঠোরভাবে সেকালের হিন্দু-মুসলমান উভয়কেই দায়ী করেছেন। তবে সেই অপরাধটা কিন্তু নিম্নবর্গীয় হিন্দু বা মুসলমানের মধ্যে দেখতে পান নি। শিলাইদহ সহ পূর্ব বঙ্গে জমিদারী পরিচালনা করার সময়ে তিনি নিম্নবর্গের বাউলদের দেখেছেন। সে অভিজ্ঞতা থেকে কবি লিখেছেন—আমাদের দেশে যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত বলেন তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অন্য দেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাঁদের শিক্ষা। কিন্তু, আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত, প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে। বাউল হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই; একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করে নি। এই মিলনে সভাসমিতির প্রতিষ্ঠা হয় নি; এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অর্ধ অশিক্ষিত মাধুর্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে; কোরান পুরানে ঝগড়া বাধে নি। এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়, বিবাদে বিরোধে বর্বরতা। বাংলাদেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা ইস্কুল-কলেজের অগোচরে আপনা-আপনি কিরকম কাজ করে এসেছে, হিন্দু মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে, এই বাউল গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়।

হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্বটা শুরু হয়েছিল বৃটিশদের আগমণের পরে। বৃটিশ বেনিয়ারা শুরুতে শাসক মুসলমানদের বদলে হিন্দুদের শাসনকার্যে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে। মুসলমানরা ইংরেজদের শত্রুজ্ঞানে মুখ ফিরিয়ে নেয়।  ফলে শিক্ষা দীক্ষা অর্থ বিত্তে হিন্দুরা মুসলমানদের চেয়ে এগিয়ে যায়। তবে এই এগিয়ে যাওয়াটা কিন্তু উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত হিন্দু সম্প্রদায়েই ঘটে। এদেরকে বাবু হিসাবে গণ্য করা হত। মুসলমানদের এই পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসাবে ইংরেজরা যতটা দায়ী—ততটা মুসলমান সম্প্রদায় নিজেরাও দায়ী। তারা ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে।  এবং এক্ষেত্রে হিন্দুরাও দায়ী। কারণ ক্রমঅগ্রসরমান হিন্দু সম্প্রদায় অর্থনীতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের সমতা আনার কোনো চেষ্টা করে নি। বরং তারা তাদেরকে সামাজিকভাবেও পিছিয়ে যেতে দিয়েছে। এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসমতা থেকেই সাম্প্রদায়িক বিভেদের জন্ম।

রবীন্দ্রনাথ যখন এই সাম্প্রদায়িক বিভেদকে দেখেন তখন কিন্তু নির্মোহভাবে সকলের ছিদ্রটাকে দেখিয়ে দেন। এবং একটা বিষয় স্পষ্ট যে এই বিভেদটা উচ্চবিত্ত হিন্দু ও মধ্যবিত্ত হিন্দু বাবুদের মধ্যেই ছিল। তারা একে পুষ্টি দিয়েছে। অথচ নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে কোনো ভেদ ছিল না। নিম্নবর্গের একজন জোলা মুসলমান এবং একজন নমশুদ্র হিন্দু সমভাবে এই বাবুদের কর্তৃক অপমানিত ও শোষিত হয়েছে। গোরা উপন্যাসের দরিদ্র চাষী ফরু সর্দার যখন জমিদার বা ইজারাদারদের শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তখন তাকে সহযোগিতা করে হিন্দু নাপিত। আবার যখন মুসলমান অধ্যুষিত পাবনা সিরাজগঞ্জে প্রজাবিদ্রোহ হয়েছিল তার নেতৃত্ব দিয়েছিল একজন হিন্দু প্রজা। তাঁর সহযোগী মুসলমান প্রজা। ইতিহাস বলে এই বাবু হিন্দুরা যেমন নিম্নবর্গের হিন্দু-মুসলমানকে শোষণ করেছে—একইভাবে মুসলমান জমিদার-ধনী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে নিম্নবর্গের স্বধর্মের প্রজাদের দিক থেকে।

সেকালে বাংলায় মুসলমান জমিদার শ্রেণীর সংখ্যাও কিন্তু কম ছিল না। তারা এই নিম্নবর্গের মুসলমান প্রজাদেরকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে হিন্দুর বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছে। আবার নিম্নবর্গের হিন্দুদেরকে প্রতিবেশী মুসলমানের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছে।  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ফেসাদে নামিয়েছে। দাবার গুটি হিসাবে ব্যবহার করেছে। নিম্নবর্গের মানুষের স্বার্থরক্ষার  জন্য শিক্ষিত ধনী হিন্দু-মুসলমান কেউ-ই কখনো ভাবেন নি। তাদের জন্য কাজ করেন নি। তারা নিজেদের আখের গোছানোর রাজনীতিটা করেছেন। তাদের  এই রাজনীতিটা কখনো ধর্মরক্ষায় ছিল না। ছিল উচ্চবিত্ত হিন্দুদের সঙ্গে উচ্চবিত্তের মুসলমানদের ক্ষমতার লড়াই। প্রতিটা দাঙ্গার ইতিহাসটাও এই রকম। এগুলোর দিকে গভীর দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে–এগুলো ধনীগরীবের লড়াই। শোষক-শোষিতের লড়াই।  শোষকদের মধ্যে যেমন সম্প্রীতি আছে, আবার শোষকদের মধ্যেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে লড়াই আছে।  ধর্মকে—সম্প্রদায়-বিভেদকে এই শোষক শ্রেণীই নানা কায়দায় ব্যবহার করেছে।

কবি ঠিকই বুঝেছেন যে, ভারতের স্বরাজ-সমস্যার অন্যতম প্রধান বাধা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের বৈষম্য—অর্থাৎ একদিকে সামাজিক ভেদবুদ্ধির পাপ, অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব। এই স্বার্থ প্রধানত উপরতলার মানুষের, এবং দুই পক্ষেরই সাধারণ গ্রামীণ জনতা এই স্বার্থবুদ্ধির শিকার। আর এই খেলায় বাতাস দিয়েছে শাসক ইংরেজের চতুর কুটনীতি।

ব্যাধি ও তার প্রতিকার লেখায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলো ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা এক ভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখে দুঃখে মানুষ; তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মুনষ্যোচিত., যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া এমন-একটি পাপ আমরা পোষণ করিয়াছি যে, একত্রে মিলিয়াও আমরা বিচ্ছেদকে ঠেকাইতে পারি নাই। এ পাপকে ঈশ্বরকে কোনোদিনই ক্ষমা করিতে পারিবেন না।

হিন্দু ও মুসলমান নামে একটি লেখায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, অন্য দেশের কথা জানি না কিন্তু বাংলাদেশে যে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দ্য ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। বাংলায় হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানের সংখ্যা বেশি এবং হিন্দু-মুসলমানে প্রতিবেশিসম্বন্ধ খুব ঘনিষ্ঠ। কিন্তু একজন সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলমান বলিতেছিলেন বাল্যকালে তাঁহারা তাঁহাদের প্রতিবেশী ব্রাহ্মণ পরিবারের সহিত নিতান্ত ভালোভাবে মেশামেশি করিতেন। তাঁহাদের মা-মাসিগণ ঠাকুরানীদের কোলো পিঠে মানুষ হইয়াছেন। কিন্তু আজকাল শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে নূতন হিন্দুয়ানি অকস্মাৎ নারদের ঢেঁকি অবলম্বন করিয়া অবতীর্ণ হইয়াছে। তাঁহারা নবোপার্জিত আর্য অভিমানকে সজারুর শলাকার মতো আপনাদের চারি দিকে কণ্টকিত করিয়া রাখিয়াছেন; কারো কাছে ঘেঁসিবার জো নাই। হঠাৎবাবুর বাবুয়ানার মতো তাঁহাদের হিন্দুয়ানি অত্যন্ত অস্বাভাবিক উগ্রভাবে প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। উপন্যাসে কাগজে পত্রে অকারণে বিধর্মীদের প্রতি কটাক্ষপাত করা হইয়া থাকে। আজকাল অনেক মুসলমানেও বাংলা শিখিতেছেন এবং বাংলা লিখিতেছেন—সুতরাং স্বভাবতই এক পক্ষ হইতে ইট এবং অপর পক্ষ হইতে পাটকেল বর্ষণ হইয়াছে।

তিনি রাজনীতিকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন ১৯০৮ সালে পাবনায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মিলনীতে—কত শত বৎসর হইয়া গেল, আমরা হিন্দু ও মুসলমান একই দেশমাতার দুই জানুর উপরে বসিয়া একই স্নেহ উপভোগ করিয়াছি, তথাপি আজও আমাদের মিলনে বিঘ্ন ঘটিতেছে। এই দুর্বলতার কারণ যতদিন আছে ততদিন আমাদের দেশের মহৎ কোনো আশাকে সম্পূর্ণ  সফল করা সম্ভবপর হইবে না; আমাদের সমস্ত রাষ্ট্রিয় কর্তব্য-পালনই পদে পদে দুরূহ হইতে থাকিবে।

কবি তাঁর দীর্ঘ জীবনে দেখেছেন, বাইরে থেকে এই বিভেদকে উস্কানী দেওয়া হয় বটে, কিন্তু সেটা ব্যাধির লক্ষ্মণ—ব্যধি নয়। ব্যাধিটা রয়েছে আমাদের মধ্যে। সুতরাং ব্যাধির প্রকাশ নিয়ে হাক পাড়লেই হবে না। ব্যাধির কারণটা দুর করতে হবে। ব্যাধির কারণটা দুর করা গেলে ব্যাধির প্রকাশটাও দূরে চলে যাবে। তখন মিলনের জন্য হাপিত্যেশ করা লাগবে না। একই হৃদয়ে হৃদয়ে মিল হবে স্বাভাবিকভাবে। তখন হিন্দু শুধু মুসলমানের সুবিধার্থে, মুসলমান শুধু হিন্দুদের সুবিধার্থে মিলবে না— পরস্পরের অসুবিধায়ও মিলবে। সুখে মিলবে—অসুখে মিলবে। আনন্দে মিলবে—বেদনায়ও মিলবে। এটাই আত্মার মিলন। সুবিধা কথাটাই সব সময় সন্দেহজনক। সুবিধার পরিস্থিতিটা চলে গেলে অসুবিধা চলে আসে। তখন সকল ব্যবস্থাই ফাঁকি বলে মনে হয়।

'হিন্দু মুসলমান' রচনায় এই বিষয়টিই ব্যাখ্যা করে বলেছেন — আমরা মুসলমানকে যখন আহ্বান করিয়াছি তখন তাহাকে কাজ উদ্ধারের সহায় বলিয়া ডাকিয়াছি আপন বলিয়া ডাকি নাই। যদি কখনো দেখি তাহাকে কাজের জন্য আর দরকার নাই তবে তাহাকে অনাবশ্যক বলিয়া পিছনে ঠেলিতে আমাদের বাধিবে না। তাহাকে যথার্থ আমাদের সঙ্গী বলিয়া অনুভব করি নাই, আনুষাঙ্গিক বলিয়া মানিয়া লইয়াছি। যেখানে দুই পক্ষের মধ্যে অসামঞ্জস্য আছে সেখানে যদি তাহারা শরীক হয়, তবে কেবল ততদিন পর্যন্ত তাহাদের বন্ধন থাকে যতদিন বাহিরের কোনো বাধা অতিক্রমের জন্য তাহাদের একত্র থাকা আবশ্যক হয়—সে আবশ্যকটা অতীত হইলেই ভাগবাঁটোয়ারার বেলায় উভয় পক্ষেই ফাঁকি চলিতে থাকে।

রবীন্দ্রনাথ এই বিভেদের কারণটি আরও সুর্নিদিষ্ট করে উন্মোচন করেছেন–  আমরা গোড়া হইতেই ইংরেজির ইস্কুলে বেশি মনোযোগের সঙ্গে পড়া মুখস্ত করিয়াছি বলিয়া গভর্নমেন্টের চাকরি ও সম্মানের ভাগ মুসলমান ভ্রাতাদের চেয়ে আমাদের অংশে বেশি পড়িয়াছে সন্দেহ নাই। এইরূপে আমাদের মধ্যে একটা পার্থক্য ঘটিয়াছে। এইটুকু কোনোমতে  মিটিয়া না গেলে আমাদের ঠিক মনের মিলন হইবে না, আমাদের মাঝখানে একটা অসূয়ার অন্তরাল থাকিয়া যাইবে। মুসলমানেরা যদি যথেষ্ট পরিমাণে পদমান লাভ করিতে থাকেন তবে অবস্থার অসাম্য-বশত জ্ঞাতিদের মধ্যে যে মনোমালিন্য ঘটে তাহা ঘুচিয়া গিয়া আমাদের মধ্যে সমকক্ষতা স্থাপিত হইবে। যে রাজপ্রসাদ এতদিন আমরা ভোগ করিয়াছি আজ প্রচুর পরিমাণে তাহা মুসলমানদের ভাগে পড়ুক, ইহা আমরা যেন সম্পূর্ণ প্রসন্নমনে প্রার্থনা করি। পদ-মানশিক্ষায় তাহারা হিন্দুর সমান হইয়া উটে ইহা হিন্দুদের পক্ষেই মঙ্গলকর।

সমস্যা প্রবন্ধে কবি বলেছেন, ভারতবর্ষের কল্যাণ যদি চাই তাহলে হিন্দু-মুসলমানে কেবল যে মিলিত হতে হবে তা নয়, সমকক্ষ হতে হবে। এই সমকক্ষতা তাল ঠোকা পালোয়ানীর ব্যক্তিগত সমকক্ষতা নয়, উভয় পক্ষের সামাজিক শক্তির সমকক্ষতা।

হিন্দু মুসলমান রচনায় দেখিয়েছেন দিনে দিনে কীভাবে এই ভেদরেখাটি ঘনীভূত হচ্ছে।  কবি বলেছেন,  এই সমকক্ষতার অভাবে ভেদটা এমন দাঁড়িয়েছে যে ধর্মমতে হিন্দুর বাঁধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল, আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল। একপক্ষের যেদিকে দ্বার খোলা অন্যদিকে সেদিকে দ্বার রুদ্ধ। এরা কী করে মিলবে?

সমস্যা রচনায় তিনি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, আত্মীয়তার দিক থেকে মুসলমান হিন্দুকে চায় না, তাকে কাফের বলে ঠেকিয়ে রাখে; আত্মীয়তার দিক থেকে হিন্দুও মুসলমানকে চায়না, তাকে ম্লেচ্ছ বলে ঠেকিয়ে রাখে। ধর্মই তাদের মানববিশ্বকে সাদা কালো বলে ছক কেটে দুই সুস্পষ্ট ভাগে বিভক্ত করেছে—আত্ম ও পর।

গোরা উপন্যাসে পরেশবাবু নামে একটি চরিত্র বলেছিলেন, একটা বিড়াল পাতের কাছে বসে ভাত খেলে কোনো দোষ হয় না অথচ একজন মানুষ সে ঘরে প্রবেশ করলে ভাত ফেলে দিতে হয়, মানুষের প্রতি এমন আপমান এবং ঘৃণা যে জাতিভেদে জন্মায়, সেটাকে অধর্ম না বলে কী বলব? মানুষকে যারা এমন ভয়ানক অবজ্ঞা করতে পারে তারা কখনোই পৃথিবীতে বড়ো হতে পারে না, অন্যের অবজ্ঞা তাদের সইতে হয়। আরেকটি জায়গায় বলেছেন, 'আমাদের দেশে মানুষ মানুষকে অসহ্য ঘৃণা করছে এবং তাতে আমাদের সকলকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।' হিন্দুতে মুসলমানে বিচ্ছিন্নতা এসেছে। হিন্দুতে-হিন্দুতে বিচ্ছিন্নতা এসেছে। এসেছে মুসলমানে মুসলমানে। আশরাফে আতরাফের সেই জাতিভেদের অসাধারণ উন্মোচন করেছেন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমানের মিলনের বিষয়টি তাত্ত্বিকভাবে দেখেন নি। দেখেছেন বাস্তবতার ভিতর থেকে। এক্ষেত্রে তাঁর ভাবনা প্রচলিত হিন্দুত্ববাদিদের সন্তুষ্ট করে না। তাদের বিরুদ্ধেই যায়। তিনি হিন্দুত্বের অন্যতম পরিচায়ক ধূতি চাদরকে জাতীয় পোষাক হিসাবে বাতিল করে দিয়েছেন। বলেছেন ধূতি পাঞ্জাবী আধুনিক নয়। অফিস আদালতের উপযোগী নয়। এর বদলে তিনি জাতীয় পোষাক হিসাবে চাপকানকে বেছে নিয়েছেন। এই চাপকান পরা নিয়ে সেকালে কোনো কোনো হিন্দু আপত্তি তুলেছিলেন। বলেছিলেন চাপকানটা মুসলামানী ড্রেস। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ মিলনের উৎসের মধ্যে থেকেই চাপকানকে থেকে থাকেন। বলেন, মুসলমানদের সহিত বসনভূষণ শিল্পসাহিত্যে আমাদের এমনই ঘনিষ্ট আদানপ্রদান হইয়াছে গেছে যে, উহার মধ্যে কতটা কার, তাহার সীমা নির্ণয় করা কঠিন। চাপকান হিন্দু মুসলমানের মিলিত বস্ত্র। উহা যে সকল পরিবর্তনেরই মধ্য দিয়া বর্তমান আকারে পরিণত হইয়াছে, তাহাতে হিন্দুমুসলমান উভয়ের সহায়তা করিয়াছে। এখনো পশ্চিমে ভিন্ন ভিন্ন রাজাধিকারে চাপকানের অনেক বৈচিত্র্য দেখা যায়, সে-বৈচিত্র্যে যে একমাত্র মুসলমানের কর্তৃত্ব তাহা নহে, তাহার জন্য হিন্দুদেরও স্বাধীনতা আছে।

তিনি এরপরই দিচ্ছেন সঙ্গীতের উদাহরণ। ভারতবর্ষীয় সঙ্গীত মুসলমানেরও বটে হিন্দুরও বটে, উহাতে উভয় জাতীয় গুণীরই হাত আছে। যেমন মুসলমান-রাজ্যপ্রণালীতে হিন্দু মুসলমান উভয়েরই স্বাধীন ঐক্য ছিল।

তাহা না হইয়া যায় না। কারণ মুসলমান ভারতবর্ষের অধিবাসী ছিল। তাহাদের শিল্পবিলাস ও নীতিপদ্ধতির আদর্শ ভারতবর্ষ হইতে সুদূরে থাকিয়া আপন আদিমতা রক্ষা করে নাই এবং মুসলমান যেমন বলের দ্বারা ভারতবর্ষকে আপনার করিয়া লইয়াছিল, ভারতবর্ষও তেমনই স্বভাবের অমোঘ নিয়মে কেবল আপন বিপুলতা আপন প্রাণশক্তির দ্বারা মুসলমানকে আপনার করিয়া লইয়াছিল—চিত্র, স্থাপত্য, বস্ত্রবয়ন, সূচিশিল্প, ধাতুদ্রব্য-নির্মাণ, দণ্ডকার্য, নৃত্য, গীত এবং রাজকার্য, মুসলমানের ইহার কোনোটাই একমাত্র মুসলমান বা হিন্দুর দ্বারা হয় নাই; উভয়ে পাশাপাশি বসিয়া হইয়াছে।

কিন্তু ধীরে ধীরে একটি দ্বন্দ্ব হিন্দু-মুসলমানে হয়েছে। সেটাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মনের মিলনের অভাব। ঠিক এইখানে দার্শনিক কারণের মধ্যে তিনি থাকেন না। তিনি দেখেছেন আসলে মনের মিলটা অর্থনৈতিক কারণের উপর নির্ভর করে। এই অর্থনীতিক অসাম্য দূর করতে না পারলে কোনো মিলনপ্রচেষ্টাই ভেতর থেকে হবে না। রবীন্দ্রনাথের এই ধারণাটা যে অসত্য ছিল না তার প্রমাণ হিসাবে দেখা যায় বঙ্গবিভাগের পক্ষে মুসলমানদের সমর্থন চলে যায়। তারা মনে করেছিলেন মুসলমানদের জন্য আলাদা ভুখণ্ড হলে পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায় অর্থনীতক বৌদ্ধিক সর্বপ্রকার উন্নতির দিকেই চলে যাবে।

কবি বলেন, মুসলমানের এ কথা অসঙ্গত নহে যে আমি যদি পৃথক থাকিয়াই বড়ো হইতে পারি তবেই তাহাতে আমার লাভ। এই বিভেদকে দূর করার জন্য তিনি অর্থনৈতিক-সামাজিত অসমতা দূর করা পাশাপাশি শিক্ষাকে ফলপ্রসূ মাধ্যম হিসাবে মনে করেন। এ কারণে তিনি পাঠ্যপুস্তকে মুসলমান জীবনের কথা লেখার আহ্বান জানান। স্বধর্মের সদুপদেশ এবং স্বজাতির সাধুদৃষ্টান্ত মুসলমান বালকের পক্ষে একান্ত আবশ্যক, একথা কেহ অস্বীকার করিবেন না। আমরা আরও বলি মুসলমান শাস্ত্র ও সাধুদৃষ্টান্তের সহিত পরিচয় হিন্দু বালকদের শিক্ষার অবশ্যধার্য অঙ্গ হওয়া উচিৎ।

বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান যখন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, পরস্পরের সুখ-দুঃখ নানা সূত্রে বিজড়িত, একের গৃহে অগ্নি লাগিলে অন্যকে যখন জল আনিতে ছুটাছুটি করিতে হয়, তখন শিশুকাল হইতে সকল বিষয়েই পরস্পরের সম্পূর্ণ পরিচয় থাকা চাই। বাঙালি হিন্দুর ছেলে তাহার প্রতিবেশী মুসলমানের শাস্ত্র ও ইতিহাস, এবং মুসলমানের ছেলে তাহার প্রতিবেশী হিন্দু শাস্ত্র ও ইতিহাস অবিকৃতভাবে না জানে তবে সেই অসম্পূর্ণ শিক্ষার দ্বারা তাহারা কেহই আপন জীবনের কর্তব্য ভালো করিয়া পালন করিতে পারিবে না। …বাংলা বিদ্যালয়ে হিন্দু ছেলের পাঠ্য পুস্তকে তাহার স্বদেশীয় নিকটতম প্রতিবেশী মুসলমানদের কোনো কথা না থাকা অন্যায় এবং অসংগত। (মুসলমান ছাত্রের বাঙ্গালা শিক্ষা, রর।)

জীবনের শেষ দিকে কবি ইরাক ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে বাগদাদ পৌরসভা থেকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন ইতিহাসের গৌরবের যুগে আপনাদের আরবসভ্যতা প্রাচ্য ও প্রতীচ্য জগতের অর্ধেকেরও বেশি জায়গাজুড়ে প্রাধান্য লাভ করেছিল; আজও ভারতবর্ষের মুসলমান অধিবাসীদের আশ্রয় করে আমার দেশের মানসিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে আরবসভ্যতা প্রতিষ্ঠিত আছে। আজ আরবসাগর পার হয়ে আসুক আপনাদের বাণী সার্বজনীন আদর্শ নিয়ে; আপনাদের পুরোহিতরা আসুন তাঁদের বিশ্বাসের আলো নিয়ে; জাতিভেদ, সম্প্রদায়ভেদ ও ধর্মভেদ প্রেমের মধ্যে অতিক্রম করে সকল শ্রেণীর মানুষকে আজ সখ্যের সহযোগিতায় মিলিয়ে দিন তাঁরা।

মানুষের মধ্যে যা-কিছু পবিত্র ও শাশ্বত তারই নামে আজ আমি আপনাদের কাছে আমার প্রার্থনা জানাই, আপনাদের মহানুভব ধর্মপ্রতিষ্ঠাতার নামে আজ আমি আপনাদের অনুরোধ করি—মানুষে মানুষে প্রীতির আদর্শ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আচার-ব্যবহারগত পার্থক্য নির্বিবাদে সহ্য করার আদর্শ, সহযোগিতার উপর সভ্য জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করবার আদর্শ, প্রতিবেশীর প্রতি ভ্রাত্বভাবের আদর্শ আজ আপনারা সকলের সম্মুখে প্রচার করুন। আমাদের ধর্মসমূহ আজ হিংস্র ভ্রাতৃহত্যার বর্বরতায় কলুষিত, তারই বিষে ভারতের জাতীয় চেতনা জর্জরিত, স্বাধীনতার দিকে ভারতের অভিযান আজ বাধাপ্রাপ্ত। তাই আমার প্রার্থনা, তমসাচ্ছন্ন কুবুদ্ধিজনিত সমস্ত কুসংস্কার ও মোহ অতিক্রম করে আজ আপনাদের কবিদের আপনাদের চিন্তাবীরদের বাণী আমার দুর্ভাগা দেশে প্ররণ করুন, তাকে দেখিয়ে দিন কল্যাণের পথ, দেখিয়ে দিন নৈতিক বিনষ্টি থেকে মুক্তিলাভের পথ।

বন্ধুগণ, আজ আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে, স্বদেশের রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক অভাব মোচন করাতেই জাতীয় আত্মপ্রকাশের সকল দ্বায়িত্ব শেষ হয় না—দেশকালে সীমানা অতিক্রম করে আপনাদের বাণী পৌঁছানো চাই সেইখানে যেখানে মনুষ্যত্বের নৈতিক সমস্যাগুলো আপনাদের বিচার ও বিবেচনার জন্য অপেক্ষা করে আছে। প্রয়োজন হলে দ্বিধা না করেই সত্যবাক্য শোনাতে হবে।

 

 

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : পঞ্চত্রিংশ পর্ব

মুসলমান খণ্ড—৭

কবি আবদুল কাদিরের দিলরুবা কাব্যগ্রন্থখানি ১৯৩৩ সালে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ পেয়ে আবদুল কাদিরকে জানান তিনি বইখানি পেয়ে খুব খুশী হয়েছেন। ভাষা ও ছন্দে আবদুল কাদিরের প্রভাব অপ্রতিহত। এবং কবি তাঁর প্রশংসা করে লেখেন, বাংলার কবি সভায় তোমার আসনের অধিকাংশ অসংশয়িত।

তারপর কবি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন—বিষয় অনুসারে যে কবিতায় তুমি মাঝে আরবী পারসী শব্দ ব্যবহার করেছ আমার কানে তা অসঙ্গত বোধ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ আবদুল কাদিরের কবিতার উপর শুধু চোখ বোলাননি। জহুরীর মত খুটে খুটে দেখেছেন তার ভাব, ভাষা, ছন্দ ও শব্দ। ফলে ঐ চিঠিটি সংক্ষিপ্ত হলেও কবি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চোখা মন্তব্য করেছেন খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিনের মুসলিম বীরাঙ্গনা বইটি সম্পর্কে। লিখেছেন, উদ্দীপনার বেগে মুসলিম বীরাঙ্গনার ভাষাসংযম রক্ষা হয়নি, বলবৃদ্ধির চেষ্টায় তার বলহানী করা হয়েছে। চিঠিটি লেখা হয়েছিল আবদুল কাদিরকে ১৯৩৮ সালে।

আবদুল কাদিরের চিঠিটি পড়েছিলেন খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিন। রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা পড়ে তিনি কবির সঙ্গে মুসলিম বীরাঙ্গনা কাব্যের অন্যান্য দিক বিষয়ে কবির কাছ থেকে শোনার জন্য আলাপের আগ্রহ বোধ করেন। খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিনকে ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি কবি চিঠিতে লেখেন, মুসলিম বীরাঙ্গনার আরবী পারসী শব্দ ব্যবহার নিয়ে কোনো আপত্তি করিনে। আমার বক্তব্য এই যে, ঐতিহাসিক যে সকল ঘটনার মধ্যেই স্বতঃই বীরত্বের প্রকাশ আছে তাদের বিবরণ যত সহজ হয় ততই তাদের নিজের দিপ্তি সুস্পষ্ট থাকে, লেখক যদি ব্যগ্র হয়ে কলমের উত্তেজনা প্রয়োগ করেন তাহলে ইতিহাসের স্বাভাবিক শক্তির উপর হস্তক্ষেপ করা হয়—পাঠকের চিত্ত যে অসাড় নয় একথা ধরে নেওয়া ভালো।

এইটুকু লেখার পরে রবীন্দ্রনাথ চিঠিটিতে তারিখ বসিয়েছেন। চিঠিটি এখানেই শেষ হতে পারত। তিনি শেষ না করে আরেকটি বাক্য যুক্ত করেছেন তারিখের পরে—বইখানি (মুসলিম বীরাঙ্গনা) সাধারণের পাঠোপযোগী তাতে সন্দেহ নাই। অর্থাৎ বইটির বিষয়বস্তুকে তিনি প্রশংসা করেছেন। কিন্তু বইটির শব্দ ব্যবহার নিয়ে কিছু অনুযোগ করেছেন।

মুসলিম বীরাঙ্গনার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার ভিত্তি তিনটি—

১. ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে সাহিত্য রচনার বিবরণ সহজ হওয়া দরকার।

২. লেখকদের আবেগ প্রকাশ করা ভালো কথা নয়।

৩. পাঠককে চিন্তা করার স্বাধীনতা দিতে হবে। প্রতিটি চিন্তাই সৃজনশীল বলেই বহুরেখিক। এই বহুরৈখিকতাকে লেখক সম্মান না করলে তার বিষয় ক্লিশে হয়ে পড়ে।

আবুল ফজলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের হয়েছিল ঢাকায় ১৯২৬ সালে। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিলেন ৩১ আগস্ট। ১৯৪০ সালে আবুল ফজল তাঁর লেখা চৌচির ও বিচিত্র কথা বই দুটি পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে গল্পকার আবুল ফজল লিখেছিলেন—

'গল্পগ্রন্থ দুটিতে বঙ্গের পূর্ব সীমান্তবাসী মুসলমান সমাজ ও পরিবার-জীবনের কিছু কিছু ছবি আঁকবার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে তাদেরও মুখের ও জীবনের সাহিত্যে এখনো অপ্রচলিত বহু শব্দ ও প্রকাশ ভঙ্গিমা বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি এবং আমার বিবেচনায় মুসলমান সমাজের ছবি আঁকতে গেলেই এ রকম বহু অপ্রচলিত শব্দ বাংলা ভাষাকে হজম করতেই হবে।

মুসলমান নায়িকা মুসলমান নায়ককে দস্তরখানা বিছিয়ে নাস্তা পরিবেশন করছে, বহু ভেবেও এরকম বাক্যকে বিশুদ্ধ বাংলায় পরিবর্তিত করতে পারিনি। দস্তরখানার কোনো বাংলা প্রতিশব্দ আমি খঁজে পাইনি, তৈয়ার করে নিতেও পারিনি। অথচ দস্তরখানা মুসলমান পরিবারে রোজ দুবেলাই ব্যবহার করা হয়। নাস্তার প্রতিশব্দ জোর করে হয়ত 'জলখাবার' করা যায়, কিন্তু তা করলে মুসলমানের কানে তা শব্দের শুদ্ধিকরণের মতই শোনাবে। আর নিশ্চিত মুসলমান জীবনেও শব্দের ব্যবহার না হয়ে পোষাকী হয়েই থাকে।

হাসান সোহরাওয়ার্দীর বাড়ির জেয়াফতে আমার দাওয়াত আছে, এর পরিবর্তে কোন মুসলমান হাসান সোহরাওয়ার্দীর বাড়ির ভোজে আমার নিমন্ত্রণ আছে বলে না, বল্লে অনুবাদের মত শোনাবে।'

আবুল ফজল চিঠির শেষ দিকে বলেছিলেন, যে জীবনকে অবলম্বন করে সাহিত্য রূপ নেবে, সে জীবনের পরিবেষ্টনকে বাদ দিয়ে সে সাহিত্যের অন্য কোনো স্বধর্ম আশা করা যায় কিনা ভাববার বিষয়। ব্যাকরণ ও অভিধান ঘেটেই সম্ভবত সে স্বধর্ম খুঁজে বের করতে হবে।

চিঠিতে সর্বশেষে তার রচনায় মুসলমান সমাজে প্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দের সাহিত্যে ব্যবহার সম্পর্কে কবির অভিমত জানতে চেয়েছিলেন। সে সময় রবীন্দ্রনাথ চোখে কম দেখেন। পড়তে কষ্ট হয়। ডাক্তার  চোখকে বিশ্রাম দিতে বলেছেন।

আবুল ফজলকে এর দিন ছয়েক পরে ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪০ বেশ বড়ো সড়ো একটা জবাব পাঠান। শুরুতেই কবি জানাচ্ছেন, ভাষা ব্যবহার সম্বন্ধে আপনি ঠিকই বলছেন। আচারের পার্থক্য ও মনস্তত্ত্বের বিশেষত্ব অনুবর্তন না করলে ভাষার সার্থকতাই থাকে না, তথাপি ভাষার নমনীয়তার একটা সীমা আছে।  ভাষার যেটা মূল স্বভাব তার অত্যন্ত প্রতিকূল করলে ভাব প্রকাশের বাহনকে অকর্মন্য করে ফেলা হয়। প্রয়োজনের তাগিদে ভাষা বহুকাল থেকে বিস্তর নতুন কথা আমদানী করে এসেছে। বাংলাভাষায় পারসী আরবি শব্দের সংখ্যা কম নয় কিন্তু তারা সহজেই স্থান পেয়েছে। ভাষার মূল প্রকৃতির মধ্যে একটি বিধান আছে যার দ্বারা নতুন শব্দের যাচাই হতে থাকে।

ধরা যাক খুন শব্দটি। এটা হত্যা বা কিলিং অর্থে আমাদের ভাষায় পরিচিত এবং বহুল ব্যবহৃত। এই শব্দটি থেকে খুনোখুনি, খুন খারাবি বা খুন জখমও হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম মোহররম কবিতায় লিখেছেন–

নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া,-

"আম্মা ! লা'ল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া !"

কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,

সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে !

এ কবিতায় খুন শব্দটি রক্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু খুন শব্দটি  এখানে রক্ত অর্থে ব্যবহার করায় অর্থের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে খুনের বদলে রক্ত অর্থে প্রচলিত কোনো শব্দ বসালেই যুক্তিযুক্তি হত।

এর পরেই রবীন্দ্রনাথ খুনের মামলাটি করে বসেন। তিনি লিখেছেন—'খুন খারাবি' শব্দ ভাষা সহজে মেনে নিয়েছে। আমরা তাকে যদি না মানি তবে তাকে বলব গোঁড়ামী, কিন্তু রক্ত অর্থে খুন শব্দকে ভাষা স্বীকার করেনি। কোনো বিশেষ পরিবারে বা সম্প্রদায়ে ওই অর্থই অভ্যস্ত হতে পারে তবু সাধারণ বাংলা ভাষায় ওই অর্থ চালাতে গেলে ভাষা বিমুখ হবে।

এ সময় কোনো কোনো মুসলিম লেখক বা পত্রিকাগোষ্ঠীর বাংলার শব্দের সঙ্গে অকাতরে এবং অসাহিত্যজনোজিতভাবে আরবী-ফারসি শব্দের বহুল ব্যবহার দেখা দেয়। এমন কি তাদের মাতৃভাষা কী হবে এ সংশয়ও গ্রাস করে। এ বিষয়গুলো নিয়ে আলতাফ চৌধুরীকে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, আজকাল সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে আশ্রয় করে ভাষা ও সাহিত্যকে বিকৃত করবার যে চেষ্টা করছে তার মতো বর্বরতা আর হতে পারে না। এ যেন ভাইয়ের উপর রাগ করে পারিবারিক বাস্তুঘরে আগুন লাগানো। সমাজের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিরুদ্ধতা অন্যান্য দেশের ইতিহাসে দেখেছি কিন্তু আজ পর্যন্ত নিজের দেশভাষাকে পীড়িত করবার  চেষ্টা কোনো সভ্য দেশে দেখা যায়নি।

রবীন্দ্রনাথ  বাংলাদেশের মুসলমানদের বাঙ্গালি বলে মনে করেন বলেই এই অনুযোগটি করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের মুসলমানকে যদি বাঙ্গালি বলে গণ্য না করতুম তাহলে সাহিত্যিক এই অদ্ভুত কদাচার সম্বন্ধে তাদের কঠিন নিন্দা ঘোষণা না করে সান্ত্বনা পেতুম।

শব্দের কোনো ধর্ম হয় না। ধর্মেরও কোনো শব্দ হয় না। শব্দ জীবনাচরণের সঙ্গে গড়ে ওঠে, ব্যবহৃত হয়—শব্দ বেঁচে থাকে, রূপান্তরিত হয় এবং কখনো কখনো শব্দ মরেও যায়। আবার মৃত শব্দেরা পূনর্জীবিতও হয়। ধরা যাক পিতা শব্দটি। যাত্রাপালায় এখনো ব্যবহৃত হলেও হতে পারে। কিন্তু শব্দটি এখন বাহ্যত আমাদের জীবন থেকে দুরে চলে যাচ্ছে।  শব্দটি সংস্কৃত। তবুও কোনো হিন্দুও বর্তমানে পিতা শব্দটিকে সচরাচর ব্যবহার করে না। বাবা শব্দটি সকল বাঙ্গালি ব্যবহার করেন। বাবা শব্দটি আরবী।

মার্কিন দেশে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্প্যানিস প্রচলিত। স্প্যানিস ভাষায় বাবা শব্দ হল পাপী। কিন্তু বাংলায় বাবা শব্দের সমার্থক শব্দ হিসাবে পাপী শব্দটি অপরিচিত। যারা স্পেন দেশে থাকেন বা স্প্যানিস ভাষা জানেন তারা হয়তোবা পাপী বলে মাঝে সাজে সম্বোধন করে থাকেন। বাংলায় পাপী শব্দটির অর্থ যে পাপ করেছে বা ইংরেজিতে সিনার। বাংলা ভাষায় পাপী শব্দটা ব্যবহার করলে শব্দটি পাঠকদের কাছে অনর্থ হয়ে উঠবে। কেউ-ই পাপী হতে চাইবে না। প্রবল আপত্তি করে বসবে।  সেক্ষেত্রে ইংরেজী ফাদার শব্দটি বাংলায় এত বেশী পরিচিত যে ফাদার বললে বা লিখলে কেউ আপত্তি করবে না।

সাধারণ লোকের ধারণা বাবু শব্দটি সংস্কৃত শব্দ—সংস্কৃত শব্দ থেকে উঠে এসেছে।  বাবু শব্দটি হিন্দুদের নামের আগে দেওয়া না হলে অসম্মানজনক মনে হত। মনে করা হয় বাবু শব্দটি হিন্দু ভদ্রলোক বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়। আবার মুসলমানদের সাহেব বলাই চল। বিশিষ্ট সাহিত্যিক আবুল বাশার জানাচ্ছেন– বাবু শব্দটা ফার্সি। সাহেব শব্দটাও ফার্সি। সুতরাং  বাবু শব্দটাতে হিন্দুত্ব খোঁজার কোনো মানেই হয় না। যদি সেটা করা হয় সেটা সাম্প্রদায়িকতা হবে। বাবু শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হল 'বু' মানে গন্ধ এবং 'বা' মানে সহিত বা সাথে। অর্থাৎ গন্ধের সহিত অর্থাৎ যে গন্ধ মাখে, সে-ই হচ্ছে 'বাবু।. সেজন্য কলকাতার বাবু মানে হল সুগন্ধিত হয়ে যে রাস্তায় বেরোয় তার থেকে বাবু, বাবু-সম্প্রদায়। বাবু সম্প্রদায় কলকাতায় জন্মেছিল—তারা জমিদার বা উচ্চবিত্ত। জমিদারদের ভেতর থেকেই তথাকথিত অভিজাত হিন্দু জমিদারদের বাবু বলা হত। পানি শব্দটা আরবী নয়। এটা প্রাকৃত হিন্দি। পানীয় শব্দটা সংস্কৃত। পানীয় থেকে পানি হয়েছে। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই জলকে পানি বলছে। আবার বাংলাদেশের এক সময় সবাই জলই বলত। এখন হিন্দু-মুসলমান সবাই জলকে পানি-ই বলতে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গে হিন্দুরা জলকে পানি বলে পান করবে না।  আঙ্কেল শব্দের বাংলা কাকা শব্দটিও সংস্কৃত নয়। চাচা শব্দটির মতই কাকা শব্দটিও বিদেশী।

রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ কবিতাটি বহুল পঠিত। হিন্দু পুরাণ থেকে বিদায় অভিশাপের কাহিনীটি তিনি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছিলেন বিদায় শব্দটি আদৌ সংস্কৃত জাত নয়—একটা আরবী শব্দ।  রবীন্দ্রনাথ হিন্দু পুরাণের গল্প নিয়ে কাহিনী-কবিতা লিখেছের আরবী শব্দ ব্যবহার করে। একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি—লতা মুঙ্গেস্করের গাওয়া এই গানটি বাংলার সকল মানুষের প্রিয় গান। এই গানের মা শব্দটির মধ্যে যারা সংস্কৃত বা ব্রাহ্মণ্যত্ব খোঁজেন তারা  বিদায় শব্দের বেলায় কি করবেন? বাতিল করে দেবেন? আফ্রিকান এবং স্প্যানিস ভাষাতেও মা মানে স্নেহময়ী জননী।

উলু শব্দটি বিষয়ে বঙ্গীয় শব্দার্থকোষে কলিম খান লিখেছেন—বিবাহাদি উৎসবে স্ত্রীলোকের করণীয় মঙ্গলধ্বনিবেশেষ। নিজেদের কোনো সাফল্য প্রকাশ করার জন্য যে ধ্বনি করা হয়, সেটি উলুধ্বনি নাম পেয়েছে। হিন্দু নারীরাই শুধু উলুধ্বনি দেয় না, বিভিন্ন উৎসবে আনন্দে বিয়ে সাদিতে আরবের নারীরাও উলুধ্বনি দেয়। কোনো দেশের খ্রিষ্টানরাও দেয়। হিব্রু ভাষায় হালেলুইয়া নামে একটি শব্দ আছে। ঈশ্বরের উদ্দশ্যে সমবেত ইহুদিরা জয়ধ্বনি করে এই হালেলুইয়া শব্দের মাধ্যমে।  কলিম খান মনে করেন এই হালেলুইয়া উলু ধ্বনির জ্ঞাতি।

বই শব্দটি এসেছে আরবী অহি শব্দ থেকে অর্থাৎ বই শব্দটি আল্লার চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। অহি হচ্ছে ঈশ্বর বা আল্লার প্রত্যাদেশ। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ অহি পেতেন। এই অহি শব্দ থেকেই বহি—বহি থেকে বই শব্দটি এসেছে। বই শব্দটি সম্পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ একটি শব্দ। কিন্তু এক সময় বইকে হিন্দু শব্দ বলে বাতিল করে মুসলমানী শব্দ হিসেবে কিতাব শব্দকে প্রচলন করা হয়েছিল। তৃতীয় বড় বোনকে বা দিদিকে সেজ দিদি বা সেজদি বলা হয়। সেজ দিদির মধ্যে আছে সেহ্ । সেহ্ শব্দটি ফার্সি। সেহ্ শব্দটির অর্থ তিন। যেমন সেতার—তিন তারের সমাহার। ফার্সি সেহ্ এর সঙ্গে সংস্কৃত-ধাতু 'জ' যুক্ত হয়ে সেজ শব্দটি তৈরি হয়েছে। অফিস-আদালত-জমি-জিরাত ফার্সি শব্দ। বাংলায় হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ব্যবহার করেন। এগুলো এখন বাংলা শব্দ-ই। আবার কেদারা শব্দটি চেয়ার অর্থে বাংলায় টেকেনি। চেয়ার শব্দটিই চলেছে। জরকাঠি শব্দটির জন্মমাত্রেই মৃত্যু ঘটেছে। জরকাঠি দিয়ে নয়–থার্মোমিটার দিয়েই বাঙ্গালিদের জ্বর দেখা হয়।

আবার তৎসম শব্দ নির্বান, যোগ, প্রাণায়াম—ইংরেজীতে দিব্যি নির্বানা, ইয়োগা এবং প্রাণায়ামা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমন কি 'বাৎসায়নের কামসূত্র'টি কামসূত্র নামেই মার্কিন দেশে লেখা হয়। মেডিটেশন শব্দটির সঙ্গে ধ্যান শব্দটি জায়গা করে নিচ্ছে। এই সব সংস্কৃতজাত বাংলা শব্দগুলি ইংরেজীতে ধীরে ধীরে মিশে গেছে। কেউ আপত্তি করছে না।  হালাল বা হারাম শব্দটির সঙ্গে মার্কিনীরা পরিচিত। রেস্তোরাতে বড় বড় করে লেখা হয়—হালাল ফুড। কেউ মুসলিমদের মুখের শব্দ বলে হেলা করে না। এখন হালাম বা হারাম শব্দদ্বয় বাংলা ভাষারই অন্তর্গত। কিন্তু  উর্দু শব্দ 'সাজিস' ষড়যন্ত্র শব্দ হিসেবে অপরিচিত। সুতরাং সাজিস শব্দটি কেউ ব্যবহার করতে চাইলে ব্রাকেটে ষড়যন্ত্র অর্থটি বলে দেওয়া ছাড়া তার উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথ এইখানেই আপত্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন—যে শব্দ সাধারণ্যে ব্যবহৃত বা প্রচলিত সে শব্দ ব্যবহারে বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের লাভই হবে। এ কারণে তিনি আহ্বান করেছিলেন মুসলমান সাহিত্যিকদের লেখালেখিতে আসতে। তারা লিখলে তাদের ঘরে ব্যবহৃত শব্দ সাহিত্যের ভাষাকে সমৃদ্ধ করবে। ভাষাগত অসাম্যতা দূর হবে। হিন্দু-মুসলমানদের সম্প্রদায়গত বিভেদও কমে আসবে— তাদের মিলনের পথ দেখাবে।

তিনি আবুল ফজলকে চিঠিতে বলেছেন, আধুনিক মুসলমান সমাজের সমস্যা অই সমাজের অন্তরের দিক থেকে জানতে হলে সাহিত্যের পথ দিয়েই জানতে হবে—এই প্রয়োজন আমি বিশেষ করেই অনুভব করি।… চাঁদের এক পৃষ্ঠায় আলো পড়ে না, সে আমাদের অগোচর, তেমনি দুর্দৈবক্রমে বাংলাদেশের আধখানায় সাহিত্যের আলো যদি না পড়ে তাহলে আমরা বাংলাদেশকে চিনতে পারব না, না পারলে তার সঙ্গে ভুল ঘটতে থাকবে।

এই বিশ্বাস থেকেই তিনি ভাষা বা সাহিত্যে সম্প্রদায়গত ভেদরেখায় বিশ্বাস করতেন না। তাঁর দুরাশা গল্পটি এক মুসলমান রমনীকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি  উর্দু জবানী ব্যবহার করেছেন। এই রমনীটি বদ্রাওনের নবাব গোলাম কাদের খাঁর মেয়ে। গল্পটি রবীন্দ্রনাথ সাধু ভাষায় লিখেছেন। গল্পে রমনী বলছেন, বাবুজী, এক সময় আমি যে-জেনানায় ছিলাম সেখানে আমার সহোদর ভাইদের প্রবেশ করিতে হইলেও অনুমতি লইতে হইত। আজ বিশ্বসংসারে আমার পর্দা নাই। …তৎক্ষণাৎ সুগম্ভীর মুখে দীর্ঘ সেলাম করিয়া কহিলাম, বিবিসাহেব, মাপ করো, তোমাকে চিনিতে পারি নাই। রবীন্দ্রনাথ অবলীলায় জেনানর বদলে মহিলামহল, পর্দার বদলে ঘোমটা বা আড়াল, বিবিসাহেবার বদলে বউঠান, মাপ করোর বদলে ক্ষমা করো বসাতে পারতেন। সেটা না করে যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন—সেগুলো মুসলমান উচ্চবিত্ত পরিবারের নিত্যব্যবহার্য শব্দ। এই শব্দগুলো আমাদের বাঙ্গালী সমাজেও অপরিচিত নয়। ফলে রবীন্দ্রনাথ এ শব্দগুলোকে মুসলমানী শব্দ হিসাবে ব্যবহার করেন নি। মানুষের শব্দ হিসেবেই ব্যবহার করেছেন। একজন মুসলমান নবাব নন্দিনীকে বিশ্বস্তভাবে ফুটিয়ে তুলতে অবিকৃতভাবে শব্দগুলির ব্যবহার সিদ্ধ মনে করেছেন।

ঠিক এই গল্পের অন্যত্রই তিনি সংস্কৃতবহুল শব্দ বহুলভাবে ব্যবহার করেছেন। তিনি লিখেছেন, হিমালয়বক্ষে শিলাতলে একান্তে দুইটি নরনারীর রহস্যালাপকাহিনী সহসা সদ্যসম্পূর্ণ কবোষ্ণ কাব্যকথার মতো শুনিতে হয়, পাঠকের হৃদয়ের মধ্যে দূরাগত নির্জন গিরিকন্দরের নির্ঝরপ্রপাতধ্বনি এবং কালীদাস-রচিত মেঘদূত-কুমার সম্ভবের বিচিত্র সঙ্গীত মর্মর জাগ্রত হইয়া উঠিতে থাকে, তথাপি একথা সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে যে, বুট এবং ম্যাকিন্টস পরিয়া ক্যালকাটা রোডের ধারে কর্দমাসনে এক দীনবেশিনী হিন্দুস্থানী রমনীর সহিত একত্র উপবেশনপূর্বক সম্পূর্ণ আত্মগৌরব অক্ষুণ্নভাবে অনুভব করিতে পারে, এমত নব্যবঙ্গ অতি অল্পই আছে।

আমরা ধীরে ধীরে টের পাই রবীন্দ্রনাথের বয়স বাড়ছে আর তিনি তাঁর ভাষার শরীর থেকে সাধুভাষার এই বাহুল্য ছেড়ে যাচ্ছেন। সংস্কৃতশাসিত ভাষাকে মুক্ত করার জন্য এককভাবে লড়াই করে যাচ্ছেন। লড়াইয়ে জয় তাঁরই হচ্ছে। বাঙ্গালীর জীবনের মুখের ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা হিসাবে তিনি নির্মাণ করছেন । সে বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান। কোনো ভেদ নেই। পদ্মায় তাঁর নৌকার মাঝি ঝড় এলে আজান দিয়ে উঠেছে। মুসলমান মাঝিটির আল্লা শব্দটি তাঁর কলমে আল্লা শব্দ হিসেবেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাগজের বুকে নেমে এসেছে। একটুকু দ্বিধা আসে নি রবীন্দ্রনাথের মনে। আল্লা সার্বজনীন মানুষেরই শব্দ।

 

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ষটত্রিংশ পর্ব

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ

 

১৭৬৫ সালের পর থেকেই বাংলার সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যা একত্রে ছিল। সে সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা দখল করে বসেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার মানুষের কাছ থেকে অর্থসম্পদ লুটপাট করা। যে কোনোভাবেই হোক না  কেন খাজনা আদায়ই তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। তারা একাজে স্থানীয় জমিদারদের ব্যবহার করে। সে সময়ে বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সূচনা হয়। খাবারের অভাবে এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। এক তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে বাংলা ছেড়ে পালিয়ে যায়। মাটি কামড়ে পড়ে থাকা অবশিষ্ট মানুষ নির্মম শোষণের শিকার হয়। ফলে সে সময় কিছু কিছু প্রজাবিদ্রোহও দেখা দিয়েছিল।

বাংলার সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যা যুক্ত থাকায় বাংলার আয়তন অতিরিক্ত বড় হয়েছিল। ফলে বনিক ইংরেজদের পক্ষে বড় বাংলাকে শাসন-শোষণ করা ঝামেলাপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এ কারণে ইংরেজরা বঙ্গকে ভাগ করার একটা পরিকল্পনা বহু পূর্ব থেকেই করে এসেছিল।

বঙ্গভঙ্গের আদিকথা  

বঙ্গভঙ্গের আদিকথা – বঙ্গপ্রদেশের আয়তন ছিল সে সময় ১,৮৯,০০০ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ছিল ৭৮,৫ মিলিয়ন। হিসাবটা ১৮৩৬ সালের। তখন বঙ্গে পূর্বাঞ্চল ভৌগলিক ও অপ্রতুল যোগাযোগ ববস্থার কারণে পশ্চিমাঞ্চল থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল।

১৮৩৬ সালে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোকে বঙ্গ থেকে পৃথক করে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে ন্যাস্ত করা হয়। ১৮৫৪ সালে বঙ্গের প্রশাসনিক দায়িত্ব হতে গভর্নর-ইন-কাউন্সিলকে অব্যাহতি দিয়ে গভর্নরের উপর অর্পন করা হয়। ১৮৭৪ সালে সিলেটসহ আসামকে বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশে পরিণত করা হয়।

১৮৯৬ সালে আসামের চীফ কমিশনার উইলিয়াম ওয়ার্ড প্রস্তাব করেন, চট্টগ্রাম ডিভিশন ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে একটি লেফটেনান্ট গভর্নর-শাসিত প্রদেশ গঠন করা হোক—কিন্তু তাঁর উত্তরসূরী স্যার হেনরী কটন ও জনগণের প্রতিবাদে কেবল লুসাই পর্বতমালা হস্তান্তর করে প্রস্তাবটি পরিত্যাক্ত হয়। ১৯০১ সালে মধ্যপ্রদেশের চীফ কমিশনার অ্যান্ড্রু ফ্রেজার সম্বলপুর-সহ উড়িষ্যাকে মধ্যপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করে বাংলার সীমানা-পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব করলে ব্যাপারটি কার্জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি তাঁর বিখ্যাত Round and round নোটে (২৪ মার্চ ১৯০২) সমস্ত ব্যাপারটিকে ত্বরাণ্বিত করার হুকুম দিলেন। ফ্রেজার ২৮ মার্চ ১৯০৩ সালের নোটে ওয়ার্ডের পরিকল্পনাটি উপস্থাপিত করলে কার্জন তাঁর ১ জুন ১৯০৩ তারিখের নোটে 'একটি প্রজন্মের জন্য ভারতের শাসন-সীমানা' নির্দিষ্ট করে দেওয়ার আশা প্রকাশ করলেন। এরইপর ভিত্তি করে ভারত সরকারের প্রধান সচিব হার্বার্ট রিজলে বাংলা গভর্নমেন্টের চীফ সেক্রেটারিকে তার বিখ্যাত ৩ ডিসেম্বর ১৯০৩ তারিখের চিঠিতে Artificial agitation এবং interested outcry—এর সম্ভাবনা সত্বেও শাসনতান্ত্রিক নৈপুণ্য ও সুবিধার স্বার্থে সীমানা-পুনর্বিন্যাসের যৌক্তিকতা সমর্থন করলেন। রিজলি তার নোটে লিখেছিলেন, আমাদের প্রধান লক্ষ্য হল বঙ্গদেশকে বিভক্ত করা এবং এভাবে আমাদের শাসন-বিরোধীদের দুর্বল করে দেওয়া।

একটি বিষবৃক্ষের সন্ধানে–

সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে ইংরেজরা একটা ধাক্কা খেয়েছিল। এই বিদ্রোহকে সামাল দিতে তাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহের সঙ্গে প্রজাদের যোগ ছিল না। তারা উনিশ শতকের শেষভাগে প্রজাসাধারণের উত্থানকে ভয় পাওয়া শুরু করে। তবে এই উত্থানটা তখনই ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেবে যখন সকল ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে আসবে। ইংরেজরা হিসেব করে দেখল—মুগলদের শাসনকালে হিন্দুরা ধর্মীয় প্রসঙ্গে কখনোই বিদ্রোহী হয়ে উঠেনি। তারা তাদের নিজস্ব ধর্মের খোলসে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু মুগলশাসকরা হিন্দুদের শাসনকার্যে কাজে লাগিয়েছে। এজন্য উত্তম সরকারী কর্ম পাবার জন্য বহু হিন্দু ফার্সী শিখে নিয়েছে। বিপরীতক্রমে ভারতের মুসলমানগণ নিম্নবর্গ থেকে ধর্মান্তরিত বলে শাসনকার্যের উপযোগী শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে ছিল। ফলে খাজনা আদায় থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে সকলপ্রকার শাসনকার্যে মুসলিম শাসকবর্গ হিন্দু ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যদের কাজে লাগিয়েছে। আবার যখন ইংরেজরা মুসলমান শাসকদের কাছ থেকে শাসনদণ্ড গ্রহণ করেছে তখন মুসলমানগণ শাসনক্ষমতা থেকে দূরে সরে গেছে—নিজস্ব ধর্মীয় খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

তারা শিক্ষিত-দক্ষ-অভিজ্ঞ-উচ্চাভিলাসী হিন্দু সম্প্রদায়কে কাজে লাগিয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ও এক্ষেত্রে ইংরেজদের কাছ থেকে সকলপ্রকার শিক্ষা-চাকরীসহ বৈষয়িক সুবিধাদি আদায় করেছে। তারা হয়েছে বাবু শ্রেণী। মুসলমানদের চেয়ে হয়েছে অর্থবান। ফলে এই দিক থেকে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট ভেদরেখা ছিল। তবে এই ভেদরেখাটি নিম্নবর্গের হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ছিল না। এই নিম্নবর্গের মানুষরা ছিল সবদিক থেকেই পিছিয়ে পড়া শ্রেণী। এমন কি নিম্নবর্গের হিন্দুরা উচ্চবর্গের হিন্দুদের কাছে ছিল দলিত—আর নিম্নবর্গের মুসলমানগণ উচ্চবর্গের মুসলমান বা আশরাফ শ্রেণীর কাছে ছিল আতরাফ বা নিচুজাত। তাহলে দেখা যাচ্ছে রেশারেশিটা ছিল উচ্চবর্গের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে।

সৈয়দ মুজতবা আলী এই উচ্চবর্গের বিভেদ বিষয়ে 'বঙ্গে মুসলিম সংস্কৃতি প্রবন্ধে' লিখেছেন—"আজ যদি শুধুমাত্র সংস্কৃত পুস্তকপত্র থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখতে হয় তাহলে এ দেশে মুসলমান ধর্ম আদৌ প্রবেশ করেছিল কিনা সে নিয়ে বিলক্ষণ তর্কের অবকাশ থাকবে। অথচ আমরা ভালো করেই জানি, মুসলমান-আগমণের পর প্রচুর সংস্কৃত পুস্তক লেখা হয়েছে, ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণ রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা পাননি সত্য, কিন্তু তাঁদের ব্রহ্মোত্তর দেবোত্তর জমিজমার উপর হস্তক্ষেপ না হওয়ার ফলে তাঁদের ঐতিহ্যগত বিদ্যাচর্চা বিশেষ মন্দীভূত হয়নি। কিন্তু এইসব পণ্ডিতগণ পার্শ্ববর্তী মুসলমানদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন থেকেই আপন আপন লেখনী সঞ্চালন করেছেন। …সেই ষঢ়দর্শননির্মাতা আর্য মণীষীগণের ঐতিহ্যগর্বিত পুত্রপৌত্রেরা মুসলমান আগমণের পর সাত শত বৎসর ধরে যে আপন চতুষ্পাঠীতে দর্শনচর্চা করলেন, কিন্তু পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাদ্রাসায় ঐ সাত শত বৎসর ধরে যে আরবীতে প্লাতো থেকে আরম্ভ করে নিওপ্লাতনিজম তথা কিন্দী, ফারাবী, বু আলিসীনা (লাতিনে আভিসেনা), অল গজ্জালী (লাতিনে অল-গাজেল), আবু রূশদ (লাতিনে আভেরস) ইত্যাদি মণীষীগনের দর্শনচর্চা হল তার কোনো সন্ধান পেলেন না।

এবং মুসলমান মৌলানারাও কম গাফিলী করলেন না। যে মৌলানা অমুসলমান প্লাতো-আরিস্তোতলের দর্শনচর্চায় সোৎসাহে সানন্দে জীবন কাটালেন তিনি একবারের তরেও সন্ধান করলেন না, পাশের চতুষ্পাঠীতে কিসের চর্চা হচ্ছে। তিনি জানতেও পারলেন না যে, তিনি প্লাতোর আদর্শবাদ দৃঢ়ভূমিতে নির্মাণ করার জন্য যেসব যুক্তি আকাশ-পাতাল থেকে আহরণ করেছেন তাঁর পাশের চতুষ্পাঠীতেই হিন্দু দার্শনিক শঙ্করাচার্যের আদর্শবাদ সমর্থনার্থে সেইসব যুক্তিই খুঁজে বেড়াচ্ছে। তিনি 'গুলাত' নাস্তিকদের জড়বাদ যেভাবে খণ্ডণ করছেন, ব্রাহ্মণও চার্বাকের নাস্তিকতা সেইভাবেই খণ্ডন করছেন। এবং সবচেয়ে পরমাশ্চর্য, তিনি যে চরক-সুশ্রুতের আরবী অনুবাদে পুষ্ঠ বু আলী সিনার চিকিৎসাশাস্ত্র—'য়ুনানী' নামে প্রচলিত (কারণ তার গোড়াপত্তন গ্রীক 'আইওনিয়ান=য়ুনানী' চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর)-আপন মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন, সুলতান বাদশার চিকিৎসার্থে প্রয়োগ করছেন, সেই চরক-সুশ্রুতের মূল পাশের টোলে পড়ানো হচ্ছে।"

এই হল বিভাজনচিহ্ণ। এই বিভাজন রেখাকে চতুর ইংরেজ ঠিকই বুঝে নিয়েছিল। বুঝে নিয়েছিল এই বিভাজন রেখায় স্ফুলিঙ্গ দিলে আগুন জ্বলে উঠবে। দুপক্ষকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে।

ফলে সরকার সে সময় ডিভাইড এন্ড রুল নীতি করে। তারা ঠিক করে হিন্দু মুসলমানদের ব্যবহার করা হবে একে অন্যের বিরুদ্ধে। এ জন্যে শিক্ষা ও চাকরীর ক্ষেত্রে মুসলমানদের কিছু বাড়তি সুযোগসুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারা আশা করে অচিরেই পূর্বে সুবিধাভোগী হিন্দুরা মুসলমানদের এই সুবিধাপ্রাপ্তিকে সন্দেহ করা শুরু করবে। এইভাবে বঙ্গে বিভেদের বিষবৃক্ষ রোপিত হল।

বঙ্গভঙ্গের প্রথম প্রতিবাদ : 

এলাহাবাদের দি পাইওনিয়ার পত্রিকায় মুদ্রিত প্রবন্ধ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে দি বাঙ্গালী প্রথম প্রতিবাদমূলক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে ১০ ডিসেম্বর ১৯০৩ তারিখে। এরপর ইন্ডিয়া গেজেটে রিজলের সম্পূর্ণ  চিঠিটি প্রকাশিত হলে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। থ্রেটেন্ড পার্টিশন অব বেঙ্গল শিরোনামায় এই সময়ে প্রত্যহ দি বাঙ্গালী পত্রিকায় বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভার খবর ছাপা হতে থাকে।

অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদও ১৯০৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি  স্টার থিয়েটারে রমেশচন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ অধিবেশনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষতির আশঙ্কা করে প্রস্তাবটি বিরোধিতা করে। কার্জন স্বভাবতই এইসব চেঁচামেচিতে বিরক্ত বোধ করেছেন। ১৯০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ভারতসচিব ব্রডরিককে লিখলেন, 'বাঙালীরা নিজেদের একটা মহা জাতি মনে করে এবং তারা এমন একটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে যখন দেশ থেকে ইংরেজরা বিতাড়িত হয়েছে এবং জনৈক 'বাবু' কলকাতার লাট-প্রাসাদে অধিষ্ঠিত। এই সুখ-স্বপ্নের প্রতিকূল যে-কোনও ব্যবস্থা তারা নিশ্চয়ই ভীষণভাবে অপছন্দ করবে। আমরা যদি দুর্বলতাবশত: তাদের হট্টগোলের কাছে নতি স্বীকার করি তবে কোনও দিনই আর বাংলার আয়তন হ্রাস বা বাংলা ব্যবচ্ছেদ সম্ভব হবে না। (এ পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে) আপনি ভারতবর্ষের পূর্ব-সীমান্তে এমন একটা শক্তিকে সংহত ও সুদৃঢ় করবেন যা এখনই প্রচণ্ড, এবং ভবিষ্যতে যা সুনিশ্চিতভাবেই ক্রমবর্ধমান অশান্তির উৎস হয়ে উঠবে।

কার্জনরা ভারতে তাদের ভবিষ্যৎকে নিষ্কণ্টক করতে একটি ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আয়োজন করলেন। তারা ভয় পাচ্ছিলেন– উনিশ শতকের জাগরণ, ইউরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি-দর্শন-বিজ্ঞান-ইতিহাসের উদার পাঠ এদেশের মানুষের চেতনার বন্ধ দরোজায় আঘাত হানছে।  পুরনো অন্ধকারের মধ্যে হাজার সূর্যের আলো পড়তে শুরু করেছে। রাজনীতি কেবলমাত্র আর সামন্তশ্রেণীর মধ্যে আটকে থাকছে না। প্রজাসাধারণের মধ্যেও শাসনতান্ত্রিক অধিকারবোধটি জাগ্রত হয়ে উঠছে। তারা আর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে না। আত্মশক্তির বোধটির জন্ম হচ্ছে।

বঙ্গভঙ্গের বিচ্ছেদ রঙ্গ 

এরই অংশ হিসাবে কার্জন পূর্ববঙ্গ সফরে চলে গেলেন। তিনি ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহকে এক লক্ষ পাউন্ড ঋণ দিলেন এবং নবজাগ্রত জাতীয়তাবোধকে দুর্বল করার মারাত্মক অস্ত্রে পরিণত করলেন। পাকিস্তানের বীজ রোপিত হল। এবং এক ধরনের হিন্দু নেতাদেরও হিংসার প্রবল বিষবৃক্ষ  হিসাবে তৈরি করা হল। দেশের নতুন জাগ্রত চৈতন্যের মধ্যে পাপের জন্ম হল।

১৯০৪ সালের সীমানায় হস্তান্তরযোগ্য জেলার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় রংপুর, বগুড়া ও পাবনা (৬ এপ্রিল), পাঁচমাস পরে (১৩ সেপ্টেম্বর) ভারত গভর্নমেন্ট রাজশাহী, দিনাজপুর, মালদহ, জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার হস্তান্তরের সুপারিশ করে। কিন্তু এগুলি হয়েছিল গোপনে, কার্জন তখন ভারতসচিব ও অন্যান্যদের মন থেকে দ্বিধার কাঁটা তুলে ফেলতে ব্যস্ত। ফলে প্রস্তাবটি পরিত্যাক্ত হয়েছে ভেবে জনসাধারণের বিক্ষোভও স্তিমিত হয়ে আসে। এটা ছিল কার্জনের একটি কৌশল।

কার্জনের শিক্ষা সংকোচন পদক্ষেপ 

কিন্তু কার্জন অন্যভাবেও বিক্ষোভ জাগিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। দীর্ঘ নীরবতার পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে সুপ্রীম কাউন্সিলে একটি বিল আনেন। বিলটি আনার আগে তিনি ১৯০২ সালে ২৭ জানুয়ারি ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটিজ কমিশন নিয়োগ করেন। কার্জনের 'এফিসিয়েন্সি তত্ত্বের' মাধ্যমে শিক্ষা সংকোচনের নীতির প্রস্তাব রিপোর্টে করা হয়। সিনেটে সদস্য সংখ্যা কমিয়ে ইংরেজ সদস্য সংখ্যা বাড়ানো, বেসরকারী কলেজে আইন-পড়ানো বন্ধ করা, দ্বিতীয় শ্রেণীর কলেজগুলির অবলুপ্তি, শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে পাশ মার্ক ও বেতন বৃদ্ধি, সিন্ডিকেটের হাতে স্কুল-কলেজের স্বীকৃতিদান বা এফিলিয়েশন ও প্রত্যাহারের অপার ক্ষমতাদান প্রভৃতি সুপারিশও কার্জনের রিপোর্টে প্রস্তাব করা হয়।। কমিশনের অন্যতম সদস্য ডঃ গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই রিপোর্টের সঙ্গে দ্বিমত ঘোষণা করেন এবং স্বতন্ত্র প্রতিবাদী মন্তব্য পেশ করেন। আগস্টের গোড়ায় এই রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হলে দেশ জুড়ে বিক্ষোভ হয়।

রবীন্দ্রনাথের নীরবতা 

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ শুরুতে নেই।  কোনো সভাতে অংশ নিতে তাঁকে দেখা যায় না। তিনি কোনো ব্ক্তৃতাও করছেন না। কোনো প্রবন্ধও লিখছেন না। ঠাকুরবাড়ির অনেকেই এই আন্দোলনে আছেন। এমন কি শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধেও রবীন্দ্রনাথ নীরবতা পালন করছেন। অথচ এর চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। এই নীরবতায় অনেককে আশ্চর্য করে।

এই সময়ে তিনি বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদনা করছেন। ছোটো গল্প লিখছেন। ঈশ্বর ও দেশ নিয়ে নৈবেদ্যের কবিতাগুলি লিখছেন। জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা ওরফে বেলার বিয়ে  দিয়েছেন। মেজো মেয়েটারও বিয়ে হয়েছে। শান্তি নিকেতনের বিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। এবং তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন ২৩ নভেম্বর ১৯০২ সালে। লিখছেন নৌকাডুবি উপন্যাস।  ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর লেখালেখি চলছে।

রবীন্দ্রনাথ নীরবতা ভাঙলেন :

১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন মজফ্ফরপুরে। সেখান থেকে সাময়িক প্রসঙ্গ শিরোণামে বঙ্গবিচ্ছেদ ও য়ুনিভার্সিটি বিল দুটি বিষয়েই তার নিজস্ব মত প্রকাশ করলেন। কার্জন কিছুদিন নীরব থাকলেন এবং প্রস্তাবটি পরিত্যাক্ত হয়েছে ভেবে আন্দোলনকারীরাও নিরব হয়ে গেলেন তখন রবীন্দ্রনাথ সরব হলেন। এই নিরবতার সময়টিকেই কবি কথা বলার উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নিলেন। তিনি নিজেই লিখেছেন, আন্দোলন যখন উত্তাল হইয়া উঠিয়াছিল আমরা তখন কোনো কথা বলি নাই; এখন বলিবার সময় আসিয়াছে।

তিনি এই দীর্ঘ আন্দোলন-মুখর সময়ে দূরে থেকে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেছেন। নিয়মিত পত্র-পত্রিকা পড়ছেন। নিজের লোকজনের কাছে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। তিনি বললেন, এই বঙ্গবিচ্ছেদ আন্দোলন অপূর্ব। অর্থাৎ এ ধরনের আন্দোলন এ দেশে পূর্বে হয় নি। রাজশক্তির বিরুদ্ধে দেশে রাজনৈতিক উত্থান পর্বের সুচনা হয়েছে। দেশের মানুষের ঘুম ভেঙেছে রাজশক্তির তীব্র আঘাতে।

প্রচলিত রাজনীতির সমালোচনা

এর আগে কংগ্রেস প্রভৃতি রাজনৈতিক দলগুলো ইংরেজ রাজশক্তির আশ্রয়ে থেকেই কথা বলেছে। তাদের নেতৃত্বে আছে ভূস্বামী বা জমিদার, উচ্চবিত্ত বা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। সিংহভাগ নিম্নবিত্তকে তারা কখনো রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে নি।  তারা ইংরেজদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতেই পছন্দ করেছে। তাদের শ্রেণীর কিছু চাওয়া-পাওয়া নিয়ে রাজশক্তির কাছে দেনদরবার করেছে—আবেদন নিবেদন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এটা ছিল এক ধরনের ভিক্ষাবৃত্তি।  দেশের মানুষের যে রাষ্ট্রশক্তির কাছে আবেদন নিবেদন নয়—অধিকার আছে, সে অধিকার দাবী করারও শক্তি আছে—সেটা তারা কখনো মনে করে নি।

তারা যেটা করেছে সেটা হল একধরনের বক্তৃতাবাজি। এই বক্তৃতাগুলোর উদ্দেশ্যই ছিল নানা কায়দায় ইংরেজতোষণ। তাদের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরতার আকুতি। আর প্রাপ্ত সুবিধাদির জন্য কৃতজ্ঞতাবাচক শব্দজঞ্জাল সৃষ্টি করেছেন।এটুকু করেই তারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। নিজেরা যে কিছু করতে পারেন সে ধরনের আত্মশক্তি এইসব নেতাদের ছিল না– ছিল না কোনো মনোবল-ব্যক্তিত্ব বা পরিকল্পনা । যখন তারা কখনো রাজশক্তির কাছে কোনো আবেদন নিবেদন করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাকে বলেছেন রাজভক্তির ভড়ং। 'সামলাইয়া কথা কহিবার প্রয়াস'।

তারা কখনো 'মনের কথা স্পষ্ট করিয়া কহিবার চেষ্টাই' করে নি। রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন এরা রাজনৈতিক সভাস্থলে দুই কূল রক্ষা বাঁচাইয়া কথা কহিবার চেষ্টা করিয়াছে। রাজশক্তির অজস্র গৌরচন্দ্রিকার দ্বারা তারা সর্বপ্রথমেই 'গোরার' মনোহরণব্যাপার সমাধা করিয়া তাহার পরে 'কালার' তরফের কথা তুলিয়াছে। রবীন্দ্রনাথ এই মেরুদণ্ডহীন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে হতভাগ্য ও হতবল বলে কঠোর ভাষায় ধিক্কার দিয়েছেন। তাঁর মতে,  তাদের এতকালের কর্মকাণ্ড সবই নিষ্ফল এবং উপহাসযোগ্য।

এই আন্দোলনের ইতিবাচক দিক 

চলমান এই আন্দোলনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছেন– এবারই প্রথম রাজনীতিকরা দুটো বিষয়কে সকলের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন–

১. বিশ্ববিদ্যালয় বিলের মাধ্যমে ইংরেজরা এদেশের উচ্চশিক্ষা, স্বাধীন শিক্ষার মূলোচ্ছেদ করতে চায়।

২. বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে বাঙালিজাতিকে দুর্বল করতে চায়।

শিক্ষা ও ঐক্য—এ দুটো বিষয়ই জাতিমাত্রেরই আত্মোন্নতি ও আত্মরক্ষার চরমসম্বল। এ দুটোর উপর আঘাত পড়ায় দেশের মানুষ নড়ে চড়ে উঠেছে। নিজেদের মুখে নিজেদের কথা বলার একটা সুযোগ ঘটেছে। এই প্রথম রাজশক্তির প্রতি অবিশ্বাস জন্মেছে। এটা অভূতপূর্ব।

রবীন্দ্রনাথ এইটুকু বলেই ক্ষান্ত হননি। তিনি বিস্ময়কর রকমভাবে রাজনীতিকদের চরিত্র বিষয়ে একটি সত্যপ্রকাশ করে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন—রাজশক্তির প্রতি অবিশ্বাস করা শুরু করলেও রাজশক্তির প্রতি বিশ্বাসের বন্ধন ছেদন করা যায়নি। ফলে আন্দোলন-সংগ্রামে অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে। এই ছিদ্রপথে সকল অর্জনই বেরিয়ে পড়ছে—ধরে রাখা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় ছিদ্রটি হল দেশের নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে এই রাজনীতিকদের কোনো সম্পর্কই নেই। মুষ্টিমেয় জমিদার, উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থেই অন্ধের মত চলছে। ফলে দেশের মানুষের সঙ্গে তাদের হৃদয়ের সংযোগ নেই।

স্বদেশপ্রেম : নতুন অর্জন 

কিন্তু এই অপূর্ব আন্দোলনটিকে স্বাগত জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি মনে করেন, পরের কাছ থেকে সুস্পষ্ট আঘাত পেয়ে পরতন্ত্রতা শিথিল হলে নিজেদের ঐক্য সুদৃঢ় হয়ে উঠবে। 'আমাদের  নিজের দিকে যদি সম্পূর্ণ ফিরিয়া দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের লেশমাত্র কারণ দেখি না। বাহিরের কিছুতে আমাদের বিচ্ছিন্ন করিবে এ কথা আমাদের কোনোমতেই স্বীকার করিব না। বিচ্ছেদের চেষ্টাতেই আমাদের ঐক্যানুভূতি দ্বিগুণ করিয়া তুলিবে। পূর্বে জড়ভাবে আমরা একত্র ছিলাম, এখন সচেতনভাবে আমরা এক হইব। বাহিরের শক্তি যদি প্রতিকূল হয়, তবেই প্রেমের শক্তি জাগ্রত হইয়া প্রতিকারচেষ্টায় প্রবৃত্ত হইবে। সেই চেষ্টাই আমাদের লাভ।

এই দেশ প্রেম একটা শক্তি, তার নাম দেশ প্রেম।  এই শক্তি যখন হৃদয়ের  সম্মিলনের মধ্যে দিয়ে যায় তখন তা পরিণত হয় এক মহাশক্তিতে। এই মহাশক্তি দিয়ে রাজশক্তির বিরুদ্ধে যে প্রবল লড়াই করা যায়–সেই লড়াইটারই  সূচনাপর্ব রবীন্দ্রনাথ  দেখতে পেয়েছেন। এর আগে বাংলায় এই দেশপ্রেমের উন্মেষ রবীন্দ্রনাথের  আগে কেউ এভাবে দর্শন করতে পারেন নি।

১৯০৪ সালের ১৬ জুন বঙ্গদর্শনে দীনেশচন্দ্র সেনের সাহিত্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে বিলিতি সভ্যতার মোহ কেটে গিয়ে আমাদের দেশ যথানিয়মে আমাদের হৃদয়কে পাইতেছে। ইহাই পরম লাভ। ধনলাভের চেয়ে ইহা অল্প নহে।

 

 

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : সপ্তত্রিংশ পর্ব

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন  রবীন্দ্রনাথ 

শিক্ষা বিষয়ে ভাবনা

কার্জনের  শিক্ষা সংকোচন বিল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, বিলিতি য়ুনিভার্সিটির ব্যয়বহুল আয়োজন দেশীয় জীবনযাত্রার জন্য সংগতিপূর্ণ নয়, 'আমাদের সমাজ শিক্ষাকে সুলভ করিয়া রাখিয়াছিল—দেশের উচ্চনিচ্চ সকল স্তরেই শিক্ষা নানা সহজ প্রণালীতে প্রবাহিত হইতেছিল। কিন্তু বিলিতি আদর্শে শিক্ষা যদি দুর্মূল্য হয় তবে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অত্যন্ত বৃহৎ হয়ে উঠবে।

অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে ছাত্র ও অধ্যাপকদের মধ্যে ব্যবধান নেই, তাই শিক্ষাদানের উন্মুখতা ও বিদ্যালাভের জন্য প্রস্তুতি মানসিক সাযুজ্য প্রাপ্ত হয়। তিনি এক্ষেত্রে বিদেশী শিক্ষা অধিকর্তা পেডলারের সঙ্গে সেই মানসিক সম্পর্ক স্থাপন করা অতি দুরুহ ও অনিষ্টকর বলে ঘোষণা করেন, 'হৃদয়ে হৃদয়ে যেখানে স্পর্শ নাই, যেখানে সুস্পষ্ট বিরোধ ও বিদ্বেষ আছে, সেখানে দৈববিড়ম্বনায় যদি দানপ্রতিদানের সম্বন্ধ স্থাপিত হয় তবে সে-সম্বন্ধ হইতে শুধু নিষ্পলতা নহে, কুফলতা প্রত্যাশা যায়। জাপানের মতো সুযোগ ও আনুকূল্য পেলে সহজেই ভারতীয়রা সেই শিক্ষা আয়ত্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি জগদীশচন্দ্র ও প্রফুল্লাচন্দ্রের সাধনা ও সাফল্য উল্লেখ করেন।

সুতরাং রবীন্দ্রনাথ নিজেদের বিদ্যাদানের ব্যবস্থা নিজেদেরই করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তিনি লিখেছেন, এ স্থলে আমাদের একমাত্র কর্তব্য, নিজেরা সচেষ্ট হওয়া, আমাদের দেশে ডাক্তার জগদীশ বসু প্রভৃতির মতো যে-সকল প্রতিভাসম্পন্ন মনস্বী প্রতিকূলতার মধ্যে থাকিয়াও মাথা তুলিয়াছেন, তাঁহাদিগকে মুক্তি দিয়া তাঁহাদের হস্তে দেশের ছেলেদের মানুষ করিয়া তুলিবার স্বাধীন অবকাশ দেওয়া; অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা-অনাদরের হাত হইতে বিদ্যাকে উদ্ধার করিয়া দেবী সরস্বতীর প্রতিষ্ঠা করা; জ্ঞানশিক্ষাকে স্বদেশের জিনিস করিয়া দাঁড় করানো; আমাদের শক্তির সহিত, সাধনার সহিত, প্রকৃতির সহিত তাহাকে অন্তরঙ্গরূপে সংযুক্ত করিয়া তাহাকে স্বভাবের নিয়মে পালন করিয়া তোলা।'

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী সমাজ পরিকল্পনা 

বঙ্গভঙ্গ, য়ুনিভার্সিটি বিল ও দেশের কথা এই তিনটি সাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঐক্য ও আত্মশক্তির কথা বলেছিলেন। তাকেই তিনি একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আকারে হাজির করলেন স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে।

তিনি প্রথমেই ঘোষণা করেন, আমাদের যে-সকল অভাব বিদেশীরা গড়িয়াছে ও তুলিতেছে, সেগুলো না হয় বিদেশী পূরণ করুক। …আমাদের দেশে সরকার বাহাদুর সমাজের কেহই নন, সরকার সমাজের বাহিরে। অতএব যে-কোনো বিষয়ে তাঁহার কাছ হইতে প্রত্যাশা করিব, তাহা স্বাধীনতার মূল্য দিয়া লাভ করিতে হইবে। যে-কর্ম সমাজ সরকারের দ্বারা করাইয়া লইবে, সেই কর্মসম্বন্ধে সমাজ নিজেকে অকর্মণ্য করিয়া তুলিয়া তুলিবে। অথচ এই অকর্মণ্যতা আমাদের দেশের স্বভাবসিদ্ধ ছিল না। আমরা নানা জাতির, নানা রাজার আধীনতাপাশ গ্রহণ করিয়া আসিয়াছি, কিন্তু সমাজ চিরদিন আপনার সমস্ত কাজ আপনি নির্বাহ করিয়া আসিয়াছে, ক্ষুদ্রবৃহৎ কোনো বিষয়েই বাহিরের কাহাকেই হস্তক্ষেপ করিতে দেয় নাই। সেইজন্য রাজ্যশ্রী যখন দেশ হইতে নির্বাসিত, সমাজলক্ষ্মী তখনো বিদায় গ্রহণ করেন নাই।

এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছেন বাঙালির চিত্ত ঘরমুখ নিয়েছে। স্বদেশের শাস্ত্র, স্বদেশী ভাষা স্বদেশী সাহিত্যের মাধ্যমে অলঙ্কৃত হয়ে উঠছে। তারচেয়েও বড় বিষয় হল—স্বদেশের শিল্পদ্রব্য নিজেদের কাছে আদর পাচ্ছে, স্বদেশের ইতিহাস বাংলার গবেষণাবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলছে।

এ সময়  রাজনৈতিক সাধনার চরম উদ্দেশ্য একমাত্র দেশের হৃদয়কে ধারণ করাই সকলের কর্তব্য। সে হৃদয়কে ধারণ করার জন্য করণীয় তিনি নির্ধারণ করেছেন–

১. কৃষিমেলার আয়োজন

তিনি বিলেতি ধরনের সভার বদলে দেশী ধরনের মেলা করার প্রস্তাব করেন। সেখানে যাত্রা-গান-আমোদ-আহ্লাদে দেশের লোক দূর দূরান্ত হতে একত্র হবে। সেখানে দেশী পণ্য ও কৃষিদ্রব্যের প্রদর্শনী হবে। সেখানে ভালো কথক, কীর্তন-গায়ক ও যাত্রার দলকে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে ম্যাজিক-লণ্ঠন প্রভৃতির সাহায্যে সাধারণ লোকদেরকে স্বাস্থ্যতত্ত্বের উপদেশসুস্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে হবে এবং নিজেদের যা কিছু বলার কথা আছে, যা-কিছু সুখদুঃখের পরামর্শ আছে তা ভদ্রাভদ্রে একত্রে মিলে সহজ বাংলা ভাষায় করতে হবে।

. হিন্দু-মুসলমান মিলন

প্রত্যেক জেলার ভদ্র শিক্ষিত সম্প্রদায় তাহাদের জেলার মেলাগুলিকে যদি নবভাবে জাগ্রত, নবপ্রাণে সজীব করিয়া তুলিতে পারেন, ইহার মধ্যে দেশের শিক্ষিতগণ যদি তাহাদের হৃদয় সঞ্চার করিয়া দেন, এই-সকল মেলায় যদি তাহারা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন করেন—কোনোপ্রকার নিষ্ফল পলিটিক্সের সংস্রব না রাখিয়া বিদ্যালয়, পথঘাট, জলাশয়, গোচর-জমি প্রভৃতি সম্বন্ধে জেলার যে-সমস্ত অভাব আছে, তাহার প্রতিকারের পরামর্শ করেন, তবে অতি অল্পকালের মধ্যে স্বদেশকে যথার্থই সচেষ্ট করিয়া তুলিতে পারেন।

৩.ধর্মীয় দূষিত মেলা সংস্কার 

কবি দেখেছেন আমাদের দেশে যে-সকল মেলা ধর্মের নামে প্রচলিত আছে—সেগুলোর অধিকাংশই লোকশিক্ষার অযোগ্য হয়ে উঠে হয়েছে—কুশিক্ষারও মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তিনি এইসব কুৎসিত আমোদের উপলক্ষ এই ধর্মীয় মেলাগুলোকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করেন। তার বদলে দেশী মেলার আয়োজন করতে হবে।

৪. নতুন ধরনের নেতৃত্ত্ব সন্ধান : জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের রূপরেখা

স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে উপলদ্ধির কথা বলেন। শর্করারস যেমন একটি সূত্রকে অবলম্বন করে মিছরির দানায় পরিণত হয়, তেমনি সমাজের বিচ্ছিন্ন শক্তি ও কর্মপ্রয়াসকে সংহত করার জন্য তিনি একজন সমাজপতি মনোনয়নের কথা বলছেন।  তিনি বলেন, এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব। তাঁহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।

এজন্য একজন সমাজপতি দরকার। তার সঙ্গে তার পার্ষদসভা থাকবে। তারা সবাই মিলে সমাজের সমস্যা, সমাজের মানুষের জন্য করণীয়-কর্তব্য নিরূপণ করবে। সেখানে সকলে আলোচনা করবেন। লোকসাধারণ প্রাণ খুলে তাদের কথা বলতে পারবেন। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গৃহীত হবে এবং সেগুলো সমাজপতির নেতৃত্ত্বে বাস্তবায়ন করা হবে। এইভাবে তিনি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করার একটি রূপরেখা দিয়েছেন। এটাকে একটি স্বাধীন জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা বলা যেতে পারে।

তিনি বলেন, বাহির হইতে যে উদ্যত শক্তি প্রত্যহ সমাজকে আত্মসাৎ করিতেছে, তাহা ঐক্যবদ্ধ, তাহা দৃঢ়—তাহা আমাদের বিদ্যালয় হইতে আরম্ভ করিয়া প্রতিদিনের দোকানবাজার পর্যন্ত অধিকার করিয়া সর্বত্রই নিজের একাধিপত্য স্থুলসূক্ষ সর্ব আকারেই প্রত্যক্ষগম্য করিয়াছে। এখান সমাজকে ইহার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করিতে হইলে অত্যন্ত  নিশ্চিতরূপে তাহার আপনাকে দাঁড় করাইতে হইবে।

এই স্থানীয় সরকার বা সমাজের প্রধান সমাজপতি কখনো ভালো, কখনো মন্দ হইতে পারেন, কিন্তু সমাজ যদি জাগ্রত থাকে, তবে মোটের উপরে কোনো ব্যক্তি সমাজের স্থায়ী অনিষ্ট করিতে পারে না। তার নেতৃত্বেই সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকবে। এর অধীনে দেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন নায়ক নিযুক্ত হবেন। সমাজের সমস্ত অভাবমোচন, মঙ্গলকর্মচালনা ও ব্যবস্থারক্ষা এঁরা করবেন এবং সমাজপতির নিকট দায়ী থাকবেন।  তিনি বিশেষভাবে বলেন, আমাদের দেশে মধ্যে মধ্যে সামান্য উপলক্ষে হিন্দু-মুসলমানে যে বিরোধ বেধে ওঠে, সেই বিরোধ মিটিয়ে দিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রীতিশান্তিস্থাপন, উভয় পক্ষের স্ব স্ব অধিকার নিয়মিত করে দেবার বিশেষ কর্তৃত্ব সমাজপতির নেতৃত্বে থাকবে।

সমাজপতির হওয়ার মতো এমন লোক পাওয়া কঠিন। একটি ব্যবস্থাতন্ত্র গড়ে তোলা না করা গেলে এই সমাজপতি নির্বাচন করা কঠিন। এ সমস্ত সমস্যা থাকা সত্বেও তিনি লিখেছেন, যদি সমাজপতি-নিয়োগের প্রস্তাব সময়োচিত হয়, যদি রাজা সমাজের অন্তর্গত হওয়াতে সমাজ অধিনায়কের যথার্থ অভাব ঘটিয়া থাকে, যদি পরজাতির সংঘর্ষে আমরা প্রত্যহ অধিকারচ্যূত হইতেছি বলিয়া সমাজ নিজেকে বাঁধিয়া তুলিয়া দাঁড়াইবার জন্য ইচ্ছুক হয়, তবে কোনো একটি যোগ্য লোককে দাঁড় করাইয়া তাঁহার অধীনে এক দল লোক যথার্থভাবে কাজে প্রবৃত্ত হইলে এই সমাজ-রাজতন্ত্র দেখিতে দেখিতে প্রস্তুত হইয়া উঠিবে—পূর্ব হইতে হিসাব করিয়া কল্পনা করিয়া আমরা যাহা আশা করিতে না পারিব, তাহাও লাভ করিব—সমাজের অন্তর্নিহিত বুদ্ধি এই ব্যাপারের চালনাভার আপনিই গ্রহণ করিবে।

রবীন্দ্রনাথের তৎপরতা 

এই স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ মজফ্ফরপুরে। কলকাতায় ফিরেই তাঁর বন্ধু বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে পড়ে শোনালেন। অন্য কিছু ব্যক্তিকেও তাঁর স্বদেশভাবনা বিষয়ক পরিকল্পনার কথা জানালেন। চৈতন্য লাইব্রেরী এন্ড বীডন স্কোয়ার লিটারেরি ক্লাবের উৎসাহী সম্পাদক গৌরহরি সেন ২২ জুলাই ১৯০৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধপাঠের ব্যবস্থা করেন।

প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনীতে জানাচ্ছেন যে,  চৈতন্য লাইব্রেরীর এই প্রবন্ধপাঠের বিষয়বস্তু মুখে মুখে প্রচারিত হওয়ায় প্রায় এক হাজার জন ছাত্র ও জনসাধারণ  সেখানে উপস্থিত হয়। কিন্তু তাদের জায়গা দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। ফলে সভাস্থলে ও সভার বাইরে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়—কর্মকর্তা ও পুলিশের সঙ্গে মারামারি ও ইঁটপাটকেল ছোঁড়া কিছুই বাদ যায়নি। রবীন্দ্রনাথ বিষয়গুলি বিস্তৃতভাবে বলে উপসংহারে প্রবন্ধ-লেখক স্বদেশের পূজার জন্য সকলকে কবিত্বপূর্ণ ভাষায় আহ্বান করেছিলেন।  কলকাতা শহরের অনেক গণ্যমান্য লোক কবির এই প্রবন্ধপাঠ শুনে চিত্রার্পিতের ন্যায় নীরবে শুনেছিলেন।

যারা প্রবন্ধটি শুনতে পারেননি তাদের অনুরোধে মিনার্ভা হলে কবি আবার প্রবন্ধটি পাঠ করেন। সেখানে ৩০ পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধটি ২০০০ কপি ছেপে বিতরণ করা হয়েছিল পাঠের আগে। প্রবন্ধটিতে কিছু বক্তব্য সংযোজন করেছিলেন।  সেদিন রবীন্দ্রনাথের গায়ে জ্বর ছিল। তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। একটি চেয়ারে বসে প্রবন্ধটি পাঠ করেন।

রাজনীতিতে বাঁক পরিবর্তনের লক্ষণ 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে রাজনীতি আর পুরনো জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। রাজনীতির একটি নূতন বাক পরিবর্তন ঘটছে। তিনি বলেন, দেশ যখন একদা জাগ্রত হইয়া 'কনষ্টিটিউশনাল অ্যাজিটেশনে'র রেখা ধরিয়া রাজ্যেশ্বরের দ্বারের মুখে ছুটিয়াছিল, তখন সমস্ত শিক্ষিত সমাজের বুদ্ধিবেগ তাহার মধ্যে ছিল। আজ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে সেই স্রোতের পথ বাঁক লইবার উপক্রম করিতেছে।…যাঁহারা সাধনাদ্বারা, তপস্যাদ্বারা, ধীশক্তিদ্বারা ইংরেজশিক্ষিত সমাজের চিত্তকে স্বদেশের কার্যে চালিত করিয়াছেন, স্বদেশের কার্যে একাগ্র করিবার আয়োজন করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে আমি ভক্তির সহিত নমস্কার করি। তাঁহারা যে পথে গিয়াছিলেন সে পথে যাত্রা যে ব্যর্থ হইয়াছে, এ আমি কখনোই বলিব না। তখন সমস্ত দেশের ঐক্যের মুখ রাজদ্বারেই ছিল।

…এখন সে চিরন্তন সমুদ্রের আহ্বান শুনিয়াছে—এখন সে আত্মশক্তি আত্মচেষ্টার পথে সার্থকতালাভের দিকে অনিবার্যবেগে চলিবে, কোনো-একটা বিশেষ মুষ্টিভিক্ষা বা প্রাসাদলাভের দিকে নহে। এই-যে পথের দিক-পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা দিতেছে ইহা কোনো ব্যক্তিবিশেষের কৃতকর্ম নহে—যে চিত্তস্রোত প্রথমে এক দিকে পথ লইয়াছিল ইহা তাহারই কাজ, ইহা নূতন স্রোত নহে।

সভাভঙ্গের আগে রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আরও কিছু কথা বলেন লিখিত বক্তব্যের বাইরে। বলেন, আজ সমবেত ব্যক্তিগণকে সমবেত ব্যক্তিগণকে সাহিত্যরস দেওয়ার জন্য আমি দাঁড়াই নাই। শুধু উদ্দীপনায় কোনো কাজই হয় না; আগুন জ্বালাইতে হইবে, সঙ্গে সঙ্গে হাঁড়িও চড়াইতে হইবে।..আমরা যেন প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষুদ্রভাবে দেশের জন্য কাজ করিতে পারি। আমার প্রস্তাব—প্রত্যেকে নিজেদের গৃহে স্বদেশের জন্য যদি প্রত্যহ কিছু উৎসর্গ করিয়া রাখেন তবে ভবিষ্যতে সেই সঞ্চয় কাজে লাগিবে। তাহা ছাড়া উহা আমাদের একটা চেতনা প্রবুদ্ধ করিয়া রাখিবে। …আমাদের স্বদেশ ভক্তিও যেন সেইরূপ কোনো সভা-সমিতির তাগিদের প্রতীক্ষা না করিয়া নীরবে আপন কার্য সমাপন করে।  স্বদেশের কাজ যেন বৃহৎ বাহ্য অনুষ্ঠানে পরিণত না হয়।

 রবীন্দ্রনাথের জনসংযোগ  

প্রবন্ধপাঠের পরে তিনি কলকাতার বিদ্বজ্জনের কাছে এই বার্তা নিয়ে আলোচনা করতে ছুটে বেড়ালেন। ২৯ জুলাই  সকাল সন্ধ্যায় দুবার গেলেন সুকিয়া স্ট্রিটে, ৩০ জুলাই গেলেন বসুপাড়ায় সিস্টার নিবেদিতার কাছে, ১ আগস্ট  গেলেন নারকেলডাঙায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি, ২ আগস্ট শ্যামবাজার ও কর্ণওয়ালিস স্টিটে, ৪-৫ আগস্ট গিয়েছেন পার্শিবাগান, ৬ আগস্ট আবার কর্ণওয়ালিস স্টিটে গিয়েছেন। উদ্দেশ্য স্বদেশী সমাজ গঠন। এছাড়া নিজেদের জোড়াসাঁকোতে প্রতিদিন নানাজন আসছেন। তাঁদের সঙ্গে তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে চিঠিতে জানিয়েছেন, একটা সমাজ গঠনের জন্যে চেষ্টা চলছে।

স্বদেশী সমাজ গঠনের প্রথম উদ্যোগ 

অমল হোম অনুসন্ধান করে বের করেছেন– স্বদেশী সমাজ গঠনের কিছু তথ্য পাওয়া যায় দি ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেটে।  ছাপা হয়েছিল ১৯৪১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। সেখানে স্বদেশী সমাজের একটি খসড়া সংবিধান দেওয়া হয়েছিল। সেখানে লেখা আছে—

আমরা স্থির করিয়াছি আমরা কয়েকজন মিলিয়া একটি সমাজ স্থপান করিব।

আমাদের নিজের সম্মিলিত চেষ্টায় যথাসাধ্য অভাব মোচন ও কর্তব্য-সাধন আমরা নিজে করিব, আমাদের শাসনভার নিজে গ্রহণ করিব, যে-সকল কর্ম আমাদের স্বদেশীয়ের দ্বারা সাধ্য তাহার জন্য অন্যের সাহায্য লইব না। এই অভিপ্রায়ে আমাদের সমাজের বিধি আমাদের প্রত্যককে একান্ত বাধ্যভাবে পালন করিতে হইবে। অন্যথা করিলে সমাজবিহিত দণ্ড স্বীকার করিব।

সমাজের অধিনায়ক ও তাহার সহায়কারী সচিবগণকে তাঁহাদের সমাজনির্দিষ্ট অধিকার অনুসারের নির্বিচারে যথাযোগ্য সম্মান করিব।

বাঙালী মাত্রেই এ সমাজে যোগ দিতে পারিবেন।

সাধারণত ২১ বৎসরের নীচে কাহাকেও গ্রহণ করা হইবে না।

এ সভার সভ্যগণের নিম্নলিখিত বিষয়ে সম্মতি থাকা আবশ্যক:

১) আমাদের সমাজের ও সাধারণ ভারতবর্ষীয় সমাজের কোনো প্রকার সামাজিক বিধিব্যবস্থার জন্য আমরা গবর্নমেন্টের শরণাপন্ন হইব না।

২) ইচ্ছাপূর্বক আমরা বিলাতি পরিচ্ছদ ও বিলাতি দ্রব্যাদি ব্যবহার করিব না।

৩)কর্মের অনুরোধ ব্যতীত বাঙালীকে ইংরেজিতে পত্র লিখিব না।

৪) ক্রিয়াকর্মে ইংরেজী খানা, ইংরেজি সাজ, ইংরেজি বাদ্য, মদ্যসেবন এবং আড়ম্বরের উদ্দেশ্য ইংরেজ-নিমন্ত্রণ বন্ধ করিব। যদি বন্ধুত্ব বা অন্য বিশেষ কারণে ইংরেজ-নিমন্ত্রণ করি, তবে তাহাকে বাংলা রীতিতে খাওয়াইব।

৫) যতদিন না আমরা নিজেরা স্বদেশী বিদ্যালয় স্থাপন করি ততদিন যথাসাধ্য স্বদেশীচালিত বিদ্যালয়ে সন্তানদিগকে পড়াইব।

৬) সমাজস্থ ব্যক্তিগণের মধ্যে যদি কোনো প্রকার বিরোধ উপস্থিত হয় তবে আদালতে না গিয়া সর্বাগ্রে সমাজনির্দিষ্ট বিচারব্যবস্থা গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিব।

৭)স্বদেশী দোকান হইতে আমাদের ব্যবহার্য ক্রয় করিব।

৮) পরস্পরের মধ্যে মতান্তর ঘটিলেও বাহিরের লোকের নিকট সমাজের বা সামাজিকের নিন্দাজনক কোনো কথা বলিব না।

এই দীর্ঘ সংবিধানে সমাজের কার্যপ্রণালীর খুঁটিনাটি, এমন-কি কর প্রদানের ব্যবস্থাদিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

রবীন্দ্রনাথের এই স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধটির তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সে সময়। একে আকাশকুসুম রচনা বলেছিলেন কেউ কেউ। ১১ আগস্ট সঞ্জীবনীতে একটি দীর্ঘ সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখেছিলেন কৃষ্ণকুমার মিত্র। তিনি লিখেছিলেন, রবীন্দ্রবাবুর ন্যায় একজন শিক্ষিত লোকও রাজশক্তি, সমাজশক্তি ও আমাদের সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে অজ্ঞতা প্রকাশ করিতে পারেন, এবং আকাশকুসুম রচনা করিয়া তাহারই পশ্চাতে ধাবিত হইবার জন্য আহ্বান করিতে পারেন, ইহা আশ্চর্যের বিষয়। বিশিষ্ট কংগ্রস নেতা পৃথ্বীশচন্দ্র রায় শ্রাবণ-সংখ্যা ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ও সমাজনৈতিক মতামতকে 'দেশের পক্ষে বিশেষ অনিষ্টকর ও নানা দোষে দুষ্ট' বলে সমালোচনা করেন। যতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এই প্রবন্ধকে একটি সামাজিক কবিতা বলে উপহাস করেন।

এই স্বদেশী সমাজ গঠন কার্যক্রম আর এগোতে পারে নি। গোঁড়া হিন্দুসমাজী ও রাজনীতিকদের বিরোধিতার জন্যই সম্ভবত স্বদেশী সমাজ পরিকল্পনার অপমৃত্যু ঘটে।

 

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : অষ্টাত্রিংশ পর্ব

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন  রবীন্দ্রনাথ

 

স্বদেশী সমাজের সঙ্গে বিপ্লবীদেরও সম্পর্ক হয়েছিল। এ বিষয়ে বিপ্লবী ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন—

অনুমান হয় ১৯০৫ খৃষ্টাব্দে বারীন্দ্র প্রভৃতি কর্ম্মীদের দ্বারা অনুরুদ্ধ হইয়া আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়কে একটি পত্র লিখি যে, আমরা ভারতীয় সভার (কংগ্রস) সহযোগে কর্ম্ম করিতে প্রস্তুত নই। তাঁহার সহিত সংযুক্তভাবে কর্ম্ম করিতে চাই। ইহাতে তিনি তাঁহার দ্বারকানাথ ঠাকুর ষ্ট্রীটস্থ বাসায় আমাকে আহ্বান করেন এবং বলেন, ''আমার ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহিত এই বিষয়ে কথা কও''…।

ইহাতে সখারাম বাবু, দেবব্রত বাবু এবং আমি সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বালিগঞ্জের বাড়ীতে যাই। তিনি বলিলেন, রবি বাবু আমায় জিজ্ঞাসা করেন, 'ইঁহারা কাহারা?'' আমি সব কথা বলি। তিনি বলেন, তিনি বক্তৃতা এবং সাহিত্য দ্বারা কার্য্য করিবেন। ইহাতে সখারাম বাবু ব্যঙ্গ করেন—'কবিতা লিখিয়া ভারতোদ্ধার হইবে না।'' পরে এই সহযোগিতার তাগাদার জন্য ব্যোমকেশ মুস্তফীর সহিত সাহিত্য-পরিষদ অফিসে…আমি সাক্ষাৎ করি। তিনি 'স্বদেশী সমাজ' পরিকল্পনা লইয়া ব্যস্ত ছিলেন। তিনি বলিলেন এই কর্ম্মপদ্ধতি এখনও সম্পূর্ণভাবে লিখিত হয় নাই। লিখিত কর্ম্মপদ্ধতির পাণ্ডুলিপির মুদ্রিত প্রুফ তিনি তৎকালে দেখিতেছিলেন এবং বলিলেন, পরিকল্পনা পূর্ণভাবে তৈয়ারী হইলে পরীক্ষার জন্য একস্থলে তাহা বাস্তবিক কর্ম্মে পরিণত করার চেষ্টা হইবে।..পরে এই দলের কোন এক মিটিং-এ রবি বাবু আমাদের ডাকিয়াছিলেন। আমি তখন 'ভবানী মন্দির' পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে বিহারে প্রেরিত হইয়াছিলাম। প্রত্যাবর্তন করিয়া অন্নদা কবিরাজের কাছ হইতে ইহা শুনিলাম' তিনি এই আহ্বানে এই সভায় গমন করিয়াছিলেন। সভায় নানাদল নানাকথা বলে, রবি বাবু তাঁহার দিকে চাহিয়া বলিলেন, 'আপনার কি মত'! কবিরাজ জবাব দেন, 'আমরা তর্ক করিতে অক্ষম, কার্য্য দিন, করিতে প্রস্তুত।' রবি বাবু বলিলেন, 'তাহা আমি জানি।'

তবে এই কার্য্যক্রম আর না এগুলেও স্বদেশী বিপ্লবীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কিছু যোগাযোগ ছিল। তিনি পূর্ববঙ্গে তার গ্রামোন্নয়ন প্রকল্পে তাঁদের কাউকে কাউকে কাজে লাগিয়েছিলেন।

বেঙ্গলী পত্রিকার ৩ আগস্ট সংখ্যায় একটি খবরে জানা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ স্টার থিয়েটারে বিকেল পাঁচটায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধ সভায় সভাপতিত্ব করবেন। সেখানে বিপিনচন্দ্র পাল বক্তব্য রাখবেন। বিষয় আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধিকার। রবিজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল জানাচ্ছেন– রবীন্দ্রনাথ অনুপস্থিত ছিলেন সভায়। এই সভায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য যে স্ট্যান্ডিং কমিটি হয় তাতে যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, ঠাকুরবাড়ির জামাই স্বর্ণকুমারীর স্বামী জানকীনাথ ঘোষাল, মেজো দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভাতিজা গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে রাখা হয়নি। তিনি এই আন্দোলন থেকে প্রত্যক্ষভাবে একটু সরেই ছিলেন। প্রশান্তকুমার পাল এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন, সম্ভবত ঝড়ের কেন্দ্রস্থলে না থেকে দূর থেকে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিটি কবি বুঝে নিতে চাইছিলেন। তাঁর কৌশলটি হল—এভাবে অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থার পরামর্শ দেওয়া সম্ভব হবে।

ভাদ্র-সংখ্যা বঙ্গদর্শনে 'স্ত্রীসমাজে' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে মেয়েদেরকে এই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি লিখেছেন—জগতে স্ত্রীলোক যদি বা যুদ্ধ না করিয়া থাকে, ত্যাগ করিয়াছে; সময় উপস্থিত হইলে ভূষণ হইতে প্রাণ পর্যন্ত ত্যাগ করিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। …আজ আমাদের বঙ্গদেশ রাজশক্তির নির্দয় আঘাতে বিক্ষত হইয়াছে, আজ বঙ্গ রমণীদের ত্যাগের দিন। আজ আমরা ব্রতগ্রহণ করিব। আজ আমরা পীড়িত জননীর রোগসজ্জায় বিলাতের সাজ পরিয়া শৌখিনতা করিতে যাইব না। বয়কট আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর চিন্তার স্বতন্ত্রতা প্রকাশ পেয়েছিল 'অবস্থা ও ব্যবস্থা' ভাষণে। প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলেন টাউন হলে ২৫ আগস্ট। এই ভাষণে রবীন্দ্রনাথ কার্জনের বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব ও বাঙ্গালীদের বিলেতি দ্রব্য বয়কট আন্দোলনকে ক্ষতির দিক থেকে দেখেননি। তিনি দেখেছেন লাভের দিক থেকে। একই সঙ্গে তিনি ইংরেজ উপনিবেশকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেন।

বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে দেশের মানুষের মধ্যে ঐক্যের সম্ভানা জেগেছে। এই ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে স্বদেশী সমাজ গঠন করা যায় সে বিষয় ইতিপূর্বে তিনি পরিকল্পনা হাজির করেছিলেন। সেজন্য রাজনীতিকরা তাকে উপহাস করেছিলেন। সে উপহাসেও তিনি দমিত হননি। তিনি মনে করেছেন, এই বঙ্গভঙ্গ আঘাতের ফলে যে বাঁক বদলটি ঘটছে রাজনীতিতে—তাতে রাজনীতি কেবলমাত্র রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। রাজনীতি চলে আসতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষের দরোজায়। এটা অভূতপূর্ব ঘটনা। পূর্বে রাজন্যবর্গ-শাসিত রাষ্ট্রে প্রজাসাধারণের কর দেওয়া ছাড়া শাসন ক্ষমতা নির্ধারণে কোনো ভূমিকাই ছিল না। তারা ছিল রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক—জড় পদার্থের ন্যায় ছিল তাদের অবস্থা। এখন তাদের মধ্যে প্রাণসঞ্চারের সুযোগ এসেছে।

সুতরাং এই সময়ে কিছু কর্তব্যের তাড়নায় তিনি মুখর হয়েছেন। তাঁকে এর আগে যারা উপহাস করেছিলেন, তাদের উপহাসকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, স্বদেশের কর্মভার দেশের লোকের নিজেদের গ্রহণ করিবার চেষ্টা একটা পাগলামী নহে—বস্তুত দেশের হিতেচ্ছু ব্যক্তিদের এইরূপ চেষ্টা করাই স্বাভাবিক। তিনি সেটাই করছেন।

বৃটিশ শাসকদের সমালোচনা–

রবীন্দ্রনাথ বৃটিশ শাসনের কঠোর সমালোচনা করে তাদের শোষণ প্রক্রিয়াটি তুলে ধরেছেন অবস্থা ও ব্যবস্থা প্রবন্ধে। তিনি বলেছেন, ইহা আমরা স্পষ্টত দেখিয়াছি, যে-সকল জাতি ইংরেজের সঙ্গে বর্ণে ধর্মে প্রথায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তাহাদিগকে ইহারা নিজের পার্শ্বে স্বচ্ছন্দ্যবিহারের স্থান দিয়াছেন এমন ইহাদের ইতিহাসে কোথাও নেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় ইংরেজদের উপনিবেশের উদাহরণ দিয়েছেন—এশিয়ার লোকদের ইংরেজরা কোনো প্রকারেই আশ্রয় দেয় না। ব্যবসায় অথবা বসবাসের জন্য তাদেরকে ঘর ভাড়া দেওয়া হয় না—যদি কেউ এশিয়ানদের ঘর ভাড়া দেয় তাহলে তাদের প্রতি ইংরেজরা অসন্তুষ্ট হয়। এশিয়ীদের দোকান থেকে ইংরেজরা কিছু কেনে না। এদের দোকানে অন্য কাউকে কিনতে যাওয়া থেকে বিরত রাখে। ইংলন্ডে সে সময়ে এশীয়ানদের কোনো আড্ডা গাড়তে দেওয়া হয় নি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ইহা স্পষ্টত দেখা যায় যে, এশিয়াকে যুরোপ কেবলমাত্র পৃথক বলিয়া জ্ঞান করে না, তাহাকে হেয় বলিয়াই জানে। …য়ুরোপের শ্রেষ্ঠতা নিজেকে জাহির করা এবং বজায় রাখাই চরম কর্তব্য বলিয়া জানে। অন্যকে রক্ষা করা যদি তাহার সঙ্গে সম্পূর্ণ খাপ খাইয়া যায় তবেই অন্যের পক্ষে বাঁচোয়া, যে অংশে লেশমাত্র খাপ না খাইবে সে অংশে দয়া-মায়া বাছ বিচার নাই।

আরেকটি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, বাঙালি এক সময় জাহাজ তৈরি করতে দক্ষ ছিল। ইংরেজরা এই দেশে আসার পরে সে বিদ্যা বিলুপ্ত করেছে। তারা একটি জাতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। একটি বিদেশী নয়—একটি বিদেশী জাতি বহুদূর থেকে বাঙালিকে শাসন করছে—শোষণ করছে। সুতরাং এই বিদেশী ইংরেজ শাসনকে শুধু অবিশ্বাস করলেই চলবে না—এদের প্রতি ন্যূনতম বিশ্বাসের সূত্রটাকেও ছিন্ন করতে হবে।

এখন বৃটিশ রাজশক্তি এই পঙ্গুত্বকে চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করছে ঐক্যকে বিনষ্ট করার মধ্যে দিয়ে। ঐক্য এক মহাশক্তি।  তারা জানে ঐক্য বিনষ্ট করা গেলে মহাশক্তিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা সম্ভব। এভাবেই তাদের উপনিবেশিক শাসনক্ষমতা নিষ্কণ্টক থাকবে। ঐক্যের অনুভূতির মধ্যে কেবল একটা শক্তিমাত্র নহে, পরন্তুও এমন একটা আনন্দ আছে যে, সেই অনুভূতির আবেগে মানুষ সমস্ত দুঃখ ও ক্ষতি তুচ্ছ করিয়া অসাধ্যসাধনে প্রবৃত্ত হয়। এ কারণে ইংরেজ রাজ বাঙালির ঐক্যের বিনষ্টির জন্য যে কোনো অপকৌশল গ্রহণ করছে।

এ পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ 'আমাদের স্বদেশহিতকর সমস্ত চেষ্টাকে নিজের দিকে ফিরাইয়া আনা'টাই কর্তব্য হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। আমাদের অবিশ্বাসের মধ্যে এইটুকুই আমাদের লাভের বিষয়। তিনি বলেন, ইংরেজদের উপর ক্ষোভের কারণে নয়—আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই আমাদের ঐক্য দরকার। ক্ষোভের কারণে সৃষ্ট ঐক্য সীমিত সময়ের জন্য টেকে—কিন্তু নিজেদের হৃদয়ের প্রয়োজনে সৃষ্ট ঐক্যের ক্ষমতা অসীম। সেই ঐক্য সৃজনশীল। তখন সেখানে  বাইরের কোনো শক্তি প্রবেশ করতে পারে না।

বিলেতি দ্রব্য বয়কট আন্দোলনকেও লাভের দিক থেকে দেখেছেন। বিলেতি দ্রব্যের বদলে দেশী দ্রব্য ব্যবহার শুরু করা গেলে দেশের প্রতি সত্যিকারের প্রেম অনুভব করা সম্ভব হবে। এবং এভাবে এদেশীয় শিল্পকাঠামো গড়ে উঠবে। দেশী দ্রব্য ব্যবহার করায় অভ্যস্থ হয়ে এভাবে ইংরেজ বেনিয়ারা তাদের ব্যবসা হারাবে। তারা শক্তিহীন হয়ে পড়বে। পাশাপাশি আমাদের দেশের মানুষের অর্থনৈতিক ভিতও শক্তিশালী হবে।

তিনি বলেছেন, আমাদের দেশে বঙ্গচ্ছেদের আক্ষেপে আমরা যথাসম্ভব বিলেতি জিনিস কেনা বন্ধ করিয়া দেশী জিনিস কিনিবার যে সংকল্প করিয়াছি সেই সংকল্পটিকে স্তব্ধভাবে, গভীরভাবে, স্থায়ী মঙ্গলের উপর স্থাপন করিতে হইবে। আমি আমাদের এই বর্তমান উদযোগটির সম্বন্ধে যদি আনন্দ অনুভব করি তবে তাহার কারণ এ নয় যে তাহাতে ইংরেজের ক্ষতি হইবে।

এদিন তিনি স্বদেশী সমাজের রূপরেখাটি আরও বিস্তৃতভাবে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, দেশের কর্মশক্তিকে একটি বিশেষ কর্মসভার মধ্যে বদ্ধ করিতে হইবে। অন্তত একজন হিন্দু ও একজন মুসলমানকে আমরা এই সভার অধিনায়ক করিব—তাঁহাদের নিকটে নিজেকে সম্পূর্ণ অধীন, সম্পূর্ণ নত করিয়া রাখিব; তাহাদিগকে কর দান করিব, তাহাদের আদেশ পালন করিব, নির্বিচারে তাহাদের শাসন  মানিয়া চলিব; তাহাদিগকে সম্মান করিয়া আমাদের দেশকে সম্মানিত করিব।

'আমাদের নিজেদের দিকে যদি সম্পূর্ণ দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের কারণ দেখি না। বাহিরের কিছুতে আমাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিবে, এ কথা আমরা কোনোমতেই স্বীকার করিব না।…আমাদের কিছুতেই পৃথক করিতে পারে এ ভয় যদি আমাদের যদি জন্মে তবে সে ভয়ের কারণ নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে আছে এবং তাহার প্রতিকার আমাদের নিজেদের চেষ্টা ছাড়া আর কোনো কৃত্রিম উপায়ের দ্বারা হইতে পারে না'।

এই ভয়ের কারণটি তিনি নানাভাবে প্রত্যক্ষ এবং রূপকের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। সেটা সেই নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে উচ্চবর্গের মানুষের ভেদ, নিম্নবর্ণের মানুষের সঙ্গে উচ্চবর্ণের মানুষের ভেদ, এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের মানুষের ভেদ এবং অশিক্ষিত মানুষের সঙ্গে শিক্ষিত মানুষের ভেদের মধ্যে অবস্থান করছে।

এই দিনগুলোতে এই উত্তাল সময়ে বাউল সুরে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন  আমার সোনার বাংলা গানটি। গানটি  কোলকাতায় মানুষের মুখে মুখে গীত হচ্ছে। আন্দোলনের প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করছে।

১ সেপ্টেম্বর সিমলা থেকে ঘোষণা করা হয়—১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবে। ঘোষণাটি আসার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের গতি আরও বেড়ে যায়। ৩ রা সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে চারটেয় ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় কলেজ স্কোয়ারে। প্রায় চার হাজার ছাত্র খালি পায়ে পতাকা হাতে সমাবেশে যোগদান করে। তারা উদাত্ত কণ্ঠে আমার সোনার বাংলা গানটি গাইতে গাইতে শহর প্রদক্ষিণ করে। ঘোষণা করা হয়– যদি ১৬ অক্টোবর সতি সত্যি বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় তবে সেদিনটিতে সারা দেশে পাদুকা বর্জন ও চাদর বর্জন করার মধ্যে দিয়ে ৩দিনের শোক দিবসের কর্মসূচি পালন করা হবে।

এই দিনগুলোতে রবীন্দ্রনাথ গিরিডিতে অবস্থান করছিলেন। গিরিডিও তৎকালীন বঙ্গের অন্তর্ভূক্ত ছিল। সেখানে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঢেউ লাগে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ  দেশীয় কোম্পানীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাদের শেয়ার কেনেন। বাঙালী মালিকাধীন একটি ব্যাংকে টাকা রাখেন। গিরিডিতে বসে তিনি এক মাসে বাউল সুরে ২১টি স্বদেশী সঙ্গীত লেখেন। তাঁর গান লেখার খবর পেয়ে কোলকাতায় স্বদেশী গান শেখানের জন্য একটি গানের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গানগুলি খেয়া কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছে।

স্বদেশী গানগুলির তালিকা

১) ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা, ২) মা কি তুই পরে দ্বারে পাঠাবি কি তোর ঘরের ছেলে, ৩) এবার তোর মরা গাঙ্গে বান এসেছে, ৪) যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা, ৫) যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে, ৬) যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু, ৭) তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে, ৮) সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, ৯) আমি ভয় করব না ভয় করব না, ১০) ওরে তোরা নেই বা কথা বললি, দাঁড়িয়ে হাটের মধ্যিখানে নেই জাগালি পল্লী, ১১) ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি, ১২) বুক বেধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই,  ১৩) নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে, ১৪) আমরা পথে পথে যাব সারে সারে, তোমার নাম গেয়ে ফিরিব দ্বারে দ্বারে, ১৫) আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে, ১৭) আমাদের যাত্রা হল শুরু এখন, ওগো কর্ণধার, ১৮) বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান, ১৯) ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন কাটবে, ২০) আজ সবাই জুটে আসুক ছুটে, ২১) ওরে ভাই মিথ্যা ভেবো না। হবার যা নয় কোনোমতেই হবেই না সে, হতে দেব না।।

রাখি বন্ধন কর্মসূচি–

গিরিডি থেকে কোলকাতায় এসে ১৭ সেপ্টেম্বর  সাবিত্রী লাইব্রেরী স্বধর্ম সমিতির বিশেষ অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। সভাপতির ভাষণে তিনি প্রস্তাব রাখেন –১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর তারিখ থেকে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ওই আইন কার্যকর হলে সেদিন কোন বাড়িতে রান্নাবান্না হবে না। বাঙালি জনসাধারণ অরন্ধন পালন করে উপোষ থাকবে। বাঙালির ঐক্য বজায় রাখার জন্য দেশজুড়ে হবে রাখিবন্ধন উৎসব। দিনটিকে মিলন দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাজনীতিকরা ওই তারিখে রাজধানী কলকাতায় হরতাল আহ্বান করে।

রাখিবন্ধন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ রাখি-সঙ্গীত 'বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ূ, বাংলার ফল—পূণ্য হউক, পূণ্য হউক' রচনা করেন।  ৭ আগস্ট বাগবাজারে রায় পশুপতিনাথ বসুর সুরম্য প্রাসাদপ্রাঙ্গণে বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রিত হন। বিজয়া সম্মিলনী মূলত হিন্দুদের অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সব প্রতীকই হিন্দুদের প্রতীক থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব প্রতীকের সাম্প্রদায়িক চরিত্র আছে। বঙ্গদেশ কেবল হিন্দুদের নয়—হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান—সকল মানুষেরই দেশ। এতকাল সকল মানুষ এক সঙ্গেই আছে। বঙ্গদেশটি ভাঙলে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান—সকল মানুষের বঙ্গদেশই ভাঙবে। কেবল হিন্দুর বঙ্গদেশ ভাঙবে না।  বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হলে সকল মানুষের অংশগ্রহণ চাই। এমন আন্দোলন চাই যেখানে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষই অন্তর থেকে অংশ নিতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তাই স্পষ্টত ভেবেছেন–  বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের এই হিন্দু প্রতীকগুলো মুসলমানদের কাছে টানার বদলে আরও দূরে সরাবে। সুতরাং তিনি এই বিজয় সম্মিলনীতে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্ভাষণ করার আহ্বান করেন। তিনি লিখেছেন–হে বন্ধুগণ, আজ আমাদের বিজয়া-সম্মিলনের দিনে হৃদয়কে একবার আমাদের এই বাংলাদেশের সর্বত্র প্রেরণ করো। উত্তরে হিমাচলের পাদমূল হইতে দক্ষিণে তরঙ্গমুখর সমুদ্রকূল পর্যন্ত, নদীজালজড়িত পূর্বসীমান্ত হইতে শৈলমালাবন্ধুর পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত চিত্তকে প্রসারিত করো। যে চাষি চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগৃহে এতক্ষণ ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, শঙ্খমুখরিত দেবালয়ে যে পূজার্থী আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, অস্তসূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নমাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো।

আরেকটি প্রবন্ধ 'বঙ্গবিচ্ছেদে' লিখেছেন, এই ব্যবচ্ছেদের ফলে দেশবাসীর অন্নবস্ত্র, বাসস্থানের বিশেষ ক্ষতি না হইলেও ইহাতে আমাদের একমাত্র যথার্থ অনিষ্ট এই যে, সমস্ত বাংলা দেশ এক শাসনাধীনে থাকিলে বাঙালির অন্তঃকরণে যে একটা ঐক্যের অনুভূতি জাগ্রত থাকে, নানাকারণে বাঙালির একত্রে মিলিবার যে বহুতর উপলক্ষ ঘটে, তাহা নষ্ট হইলে আমরা ভিতরে ভিতরে যে বল-লাভের পথে চলিতেছিলাম, তাহাতে বাধা পড়িবে। তবে এই বঙ্গবিচ্ছেদ নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে–তাতে রবীন্দ্রনাথ মনে করছেন পার্টিশন আমাদের ক্ষতি করবে না। সকলের মধ্যে একটা প্রাণশক্তি সৃষ্টি করেছে। ফলে দুই বঙ্গ ভাগ হলেও বাঙালির কিছু ক্ষতি হবে না। কারণ এই প্রাণশক্তি পার্টিশনের উপর জয়ী হবে—এই আশা থাকবে। মিলনে-বিরহে, আনন্দ-বেদনায়, সুখে-দুঃখে, সুবিধা-অসুবিধ বাঙালি ঐক্য অনুভব করবে।

 

 

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ঊনচত্বারিংশ পর্ব

ঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ—৪

বৃটিশ পার্লামেন্টে ১৯০৫ সালের ৪ জুলাই বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব গ্রহণ করায় আবেদন-নিবেদনের রাজনীতি ত্যাগ করে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেওয়া হয় ৭ আগস্ট টাউন হলের একটি সভায়। প্রত্যেক জেলার বিপুল সংখ্যক  প্রতিনিধি, ছাত্র-জনতা এ সভায় উপস্থিত ছিল। সেখানে নরেন্দ্রনাথ সেন বিলেতি-বর্জন বা বয়কট প্রস্তাব ঘোষণা করেন। বয়কট ঘোষণার পর বৃহত্তর বঙ্গের সর্বত্র শত শত সভায় বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরোধিতা ও বিলেতি বর্জনের শপথ গৃহীত হয়। বহু তরুণ ছাত্র দোকানে দোকানে পিকেটিং করে। দূর গ্রামে মাথায় করে দেশীয় দ্রব্যাদি বিক্রয় করতে থাকে। বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবে ভারতের ইংরেজ বনিকরাও কিছু অসুবিধা আশঙ্কা করে প্রথমে প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেছিল। বয়কট ঘোষণা হওয়ার হওয়ার পরে তারা প্রস্তাবটির পক্ষে চলে যায়। দেশি কাপড়ের তুলনায় বিলেতি কাপড়ের দাম কম ছিল। বিলেতি কাপড়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরীব মানুষের অসুবিধা হয়ে যায়। কোথাও কোথাও বিলেতি দ্রব্য বিক্রিতে জোর জবরদস্তি করা হয়। এরই কারণে ফরিদপুর ২৬ আগস্ট ফরিদপুরে ছোটো খাটো দাঙ্গার ঘটনাও ঘটে।

রবীন্দ্রনাথ ঘরে বাইরে উপন্যাসে এইরকম একটা ঘটনা লিখেছেন। সেখানে শিক্ষিত প্রজাহিতৈষী জমিদার নিখিলেশের কাছে এক গ্রামীণ খুদে কাপড় ব্যবসায়ীকে নিয়ে এসেছেন মাস্টার মশায়।  তার নাম পঞ্চু। ঘরে বাইরে থেকে পড়া যাক–

মাস্টারমশায় পঞ্চুকে আমার কাছে নিয়ে এসে উপস্থিত। ব্যাপার কী?

ওদের জমিদার হরিশ কুণ্ডু পঞ্চুকে এক-শো টাকা জরিমানা করেছে।

কেন, ওর অপরাধ কী?

ও বিলিতি কাপড় বেচেছে। ও জমিদারকে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে বললে, পরের কাছে ধার-করা টাকায় কাপড় কখানা কিনেছে, এইগুলো বিক্রি হয়ে গেলেই ও এমন কাজ আর কখনো করবে না। জমিদার বললে, সে হচ্ছে না, আমার সামনে কাপড়গুলো পুড়িয়ে ফেল্‌, তবে ছাড়া পাবি। ও থাকতে না পেরে হঠাৎ বলে ফেললে, আমার তো সে সামর্থ্য নেই, আমি গরিব ; আপনার যথেষ্ট আছে, আপনি দাম দিয়ে কিনে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলুন। শুনে জমিদার লাল হয়ে উঠে বললে, হারামজাদা, কথা কইতে শিখেছ বটে— লাগাও জুতি। এই বলে এক চোট অপমান তো হয়েই গেল, তার পরে এক-শ টাকা জরিমানা।

সেনাপতি লর্ড কিচেনের সঙ্গে কার্জনের মতভেদ হওয়ায় কার্জন পদত্যাগ করেন। তার স্থলে লর্ড মিন্টোর নিয়োগ হয়। মিন্টো তখন ছিলেন কানাডায়। তার আসতে দেরী হওয়ার সুযোগ নিয়ে কার্জন সিমলা থেকে ঘোষণা জারি করে বসেন, ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হবে। নবগঠিত প্রদেশ আসাম ও পূর্ব বাংলার লেফটেনান্ট গভর্নর নিযুক্ত হলেন কার্জনের চেয়েও পাষণ্ড শাসক ব্যামফিল্ড ফুলার। অ্যান্ড্রু ফ্রেজার পুনর্গঠিত বাংলা প্রদেশের লেফটেনান্ট গভর্নর থাকেন।

বঙ্গভঙ্গের এই খবরগুলো সে সময়কার পত্রপত্রিকাগুলো কালো বর্ডার দিয়ে প্রকাশ করছিল। শোকচিহ্ণের প্রতীক হিসাবে এই কালো বর্ডার দিয়ে খবর প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন সম্পাদকগণ। বাঙালিদের মধ্যে আত্মীয় স্বজনের মৃত্যুতেও কালো পেড়ে কাগজ বা কালো খাম ব্যবহারের চল হচ্ছিল। এটা বিদেশী প্রথা। শোকের দেশী চিহ্ণ হল সাদা—শ্বেত শুভ্র। প্রাচীনকাল থেকে এই সাদা রং বাঙালির শোককে শুভ্রতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করছে। রবীন্দ্রনাথ শোকচিহ্ণ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে পত্রিকার সম্পাদকদের প্রতি অনুরোধ করেছিলেন সাদা শুভ্রতায় ফিরে আসতে। তিনি লিখেছিলেন, এই (কালো) চিহ্ণ ব্যবহার করে কলঙ্ক বাড়িও না। আমাদের শোক আজি শুভ্র হউক, সংযত হউক, নিরাভরণ হউক—কঠোর ব্রত দ্বারা তাহা আপনাকে সফল করুক, অনাবশ্যক অনুকরণের দ্বারা তাহা দেশে বিদেশে আপনার কৃষ্ণাশ্রুরেখাকে হাস্য করিয়া না তুলুক।

শোকচিহ্ণের মতো করতালি দেওয়ার প্রথাকেও বিদেশী বলে বাতিলের প্রস্তাব করেন কবি। তিনি করতালি প্রবন্ধে লিখেছেন, এরূপ উৎকট উপায়ে মান্য ব্যক্তিকে সম্মান করা হয় না, কারণ, সম্মান করিবার উপায় কখনোই অসংযত হইতে পারে না। আমাদের দেশে করতালি চিরকাল অপমানের উদ্দেশ্যই ব্যবহার করা হইয়াছে-বস্তুত তাহাই সঙ্গত—কারণ, অসংযমের দ্বারাই অপমান করা যায়। তাই চিৎকার-রব দুয়ো বা সশব্দে করতালি দেওযা অপমানের উপায়। অপরপক্ষে যিনি আমাদের সম্মানের যোগ্য, তাঁহার কাছে আমরা আত্মসম্বরণ করিয়া থাকি। কবি মান্য ব্যক্তিকে সাধু সাধু বলার প্রস্তাব করেন।

উৎসাহ উদ্দীপনার আতিসাহ্যে জনপ্রিয় লোককে ঘাড়ে তুলে নেওয়া হয়।  আবার কখনো টেনে নেয় ভক্তবৃন্দ—এই প্রথাকেও অপমানজনক বিদেশী অনুকরণ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি।

সে সময়ে কোলকাতার অনেকগুলো থিয়েটার ছিল। তাদের নাম ছিল ইংরেজিতে—স্টার, ক্লাসিক, গ্রান্ড, য়ুনিক। এগুলোর মালিক কিন্তু বাঙালি। থিয়েটারগুলোর ইংরেজি নামের বদলে বাংলা নাম রাখতে এই মালিকদের প্রতি কবি অনুরোধ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, বর্তমানে এমন একটি সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে যখন এই নাট্যাশালাগুলির পক্ষে বিলাতি নাম  বিলেতি পোষাকের মত ছাড়িয়া ফেলাটা লোকের চক্ষে আকস্মিক ও অপ্রাসাঙ্গিক বলিয়া ঠেকিবে না। বরঞ্চ তাহা আমাদের দেশের বর্তমান হৃদয় ভাবের সহিত মিশ খাইয়া আমাদের স্বদেশ প্রেমের আনন্দোচ্ছ্বাসে নূতন তরঙ্গ তুলিবে।

তাঁর ইচ্ছে জেগেছিল স্বদেশী ভাবধারা জনগনের মধ্যে প্রচারের জন্য স্বদেশী ভিক্ষুসম্প্রদায় গড়ে উঠুক। তিনি লিখেছেন—যে সকল ভিক্ষুক নাম গান করিয়া দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা সংগ্রহ করে—তাহারা যাহা পায় তাহার চেয়ে অনেক বেশি দেয়—তাহারা দেশের চিত্ত আকাশ হইতে প্রত্যহ কলুষ মোচন করিয়া, তাহাকে মধুময় করিয়া তুলিতেছে। কর্ম্মের ঘোরতর আন্দোলনের মধ্যেও তাহারা জীবনের চরম লক্ষ্যকে স্মরণ করাইয়া সংসারের কত আবর্জনা দূর করিতেছে তাহার হিসাব লওয়া শক্ত। এই রূপে যে সম্প্রদায় স্বার্থনিরত লোকদিগকে প্রত্যহ স্বদেশী কর্তব্য স্মরণ করাইয়া বেড়াইবেন—স্বদেশের স্বরূপকে অন্যমনস্কের মনে জাগ্রত করিয়া রাখিবেন, স্বদেশের প্রতি প্রেমকে প্রত্যহ সুরে তানে দেশের পথে ঘাটে উদ্বোধিত করিয়া তুলিবেন তাহারা এই মহৎ কর্তব্য সাধনের দ্বারা যদি জীবিকা সম্বন্ধে নিশ্চিত হইতে পরেন তবে তাহাতে লজ্জার বিষয় নাই।

স্বদেশী আন্দোলনের আদর্শে কোলকাতায় দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে এই রকম বৈতালিক গোষ্ঠী গঠিত হয়েছিল। তারা রাস্তায় রাস্তায় গান গাইতেন। তখন পানওয়ালা বিড়িওয়ালা পর্যন্ত টাকা পয়সা দিত। সংগৃহীত এই চাঁদা জাতীয় অর্থভাণ্ডারে জমা দেওয়া হত।

উদ্বোধন নামে প্রবন্ধে কবি নারীদের উদ্দেশ্যে লেখেন, তোমরা—যাহারা আজ বিশ্ববঙ্গের বেদনায় ব্যথা পাইয়াছ, চক্ষু বিশ্ববঙ্গের মিলনাবেগে গৌরব অনুভব করিতেছ, তোমরা আজ সকলে প্রস্তুত হইয়া এস,–তোমাদের দুটি চক্ষু হইতে বিদেশী হাটের মোহাঞ্জন আজ চোখের জলে একেবারে ধুইয়া মুছিয়া এস—যে বিদেশের অলঙ্কার তোমাদের অঙ্গকে সোনার শৃঙ্খলে আপাদমস্তক বন্দি করিয়া রাখিয়াছে, তাহা আজ খণ্ড খণ্ড করিয়া ভাঙিয়া এস, আজ তোমাদের যে সজ্জা তাহার প্রীতির সজ্জা হউক, মঙ্গলের সজ্জা হউক, তাহাতে বিদেশের রেশম-পশম-লেস-ফিতার জাল-জালিয়াতি অপেক্ষা তোমাদিগকে অনেক বেশি মানাইবে।

রবীন্দ্রনাথ ১৭ সেপ্টেম্বর সাবিত্রী লাইব্রেরীর সভায় রাখীবন্ধনের প্রস্তাব রেখেছিলেন। জনসাধারণ উৎসাহের সঙ্গে রাখীবন্ধন কর্মসূচিটি গ্রহণ করে। বেঙ্গলী পত্রিকায় রাখী সংক্রান্ত ব্যবস্থা নামে একটি ঘোষণা ছাপা হয়েছিল—

দিন। এই বৎসর ৩০ শে আশ্বিন ১৬ অক্টোবর

আগামী বৎসর হইতে আশ্বিনের সংক্রান্তি।

ক্ষণ। সূর্য্যোদয় হইতে রাত্রির প্রথম প্রহর পর্যন্ত।

নিয়ম। উক্ত সময়ে সংযম পালন।

উপকরণ। হরিদ্রাবর্ণের তিন সুতার রাখী।

মন্ত্র। ভাই ভাই এক ঠাঁই, ভেদ নাই ভেদ নাই।

অনুষ্ঠান। উচ্চ নিচ হিন্দু মুসলমান, খৃস্টান বিচার না করিয়া ইচ্ছামত বাঙ্গালী মাত্রেই হাতে রাখী বাঁধা, অনুপস্থিত ব্যক্তিকে সঙ্গে মন্ত্রটি লিখিয়া ডাকে অথবা লোকের হাতে রাখী পাঠাইলেও চলিবে।

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। সেদিন কোলকাতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, ৩০ শে আশ্বিন প্রভাতে রবীন্দ্রনাথকে পুরোভাগে রাখিয়া বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আপামর জনসাধারণ এক বিরাট শোভাযাত্রা করিয়া গঙ্গাতীরে সমবেত হইল। গঙ্গাস্নান করিয়া পরস্পরের হস্তে রাখী বন্ধন করিল। রবীন্দ্রনাথ সজনীকান্ত দাশকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সামনে যাকে পেতাম, তারই হাতে বাঁধতাম রাখি। সরকারী পুলিস এবং কনস্টেবলদেরও বাদ দিতাম না। মনে পড়ে, একজন কনস্টেবল হাত জোড় করে বলেছিল, মাফ করবেন হুজুর, আমি মুসলমান।

দুপুর সাড়ে তিনটার সময় ২৯৪ আপার সার্কুলার রোডে ফেডারেশন হল ভিত্তি প্রস্তর অনুষ্ঠানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোক উপস্থিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সে অনুষ্ঠানের ঘোষণাপত্রটির বঙ্গানুবাদ পাঠ করেছিলেন। সভার শেষে সেই বিশাল জনতা পায়ে হেটে সার্কলার রোড ধরে বাগবাজারে চলে যায়। ঐ মিছিলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। মিছিলে সহস্র কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ রচিত স্বদেশী সঙ্গীত গীত হচ্ছিল।

এর আগে ১২ অক্টোবরে ময়মনসিংহের মহারাজার বাড়িতে একটি সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল—১৬ আক্টোবর জাতীয় অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলা হবে। সে টাকা দিয়ে একটি তুলার কারখানা গড়ে তোলা হবে। জনসাধারণকে অনুরোধ করা হবে তারা যেন অন্তত এক দিনের আয় এই ভাণ্ডারে দান করেন।  ১৬ অক্টোবর পশুপতিনাথ বসুর বাড়ির আঙিনায় অনুষ্ঠিত সভায় অর্থসংগ্রহ সভায় উপস্থিত মতে প্রায় তিরিশ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন ১০০ টাকা।

বঙ্গবঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রথম পর্যায় শেষ হয়। এই প্রথম পর্যায়ের প্রদান ৩টি কার্যকরী পদক্ষেপ ছিল।

১) বিলেতি ভোগ্যপণ্য বয়কট।

২) স্বদেশী শিল্পের সংগঠন ও প্রচার এবং এই উপলক্ষ্যে জাতীয় অর্থভাণ্ডার স্থাপন।

৩) মিছিল, বক্তৃতা ও লেখালেখি।

প্রশান্তকুমার পাল জানাচ্ছেন, এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ৫টি সভায় যোগ দিয়েছেন, ২টি সভায় লিখিত ভাষণ পাঠ করেছেন। ১টিতে সভাপতিত্ব ও মৌখিক ভাষণ দিয়েছেন। একটিতে ঘোষণাপত্রের বঙ্গানুবাদ পাঠ করেছেন। একটি সভায় শুধু উপস্থিত ছিলেন। এই হিসেব থেকে বোঝা যায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রবীন্দ্রনাথের অংশগ্রহণ ছিল অন্যদের চেয়ে কম। তবে ভাণ্ডার ও বঙ্গদর্শন পত্রিকায় এ বিষয়ে তাঁর লেখালেখির পরিমাণ মোটেই কম নয়। এইসব লেখালেখির মাধ্যমে তিনি কয়েকটি বিষয়ের উপর সুস্পষ্টভাবে জোর দিয়েছেন—

১) বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি রক্ষা।

২) ভিতর থেকে ঐক্য গড়ে তোলা গেলে সে ঐক্য বাইরে কোনো শক্তি ভাঙতে পারে না।

৩) ইংরেজদের উপর রাগ করে নয়—দেশকে ভালোবেসে দেশীয় শিল্পজাত দ্রব্যাদি ব্যবহার করা দরকার।

৪) দেশীয় শিল্পোদ্যোগকে গড়ে তোলার জন্য কিছু বিলেতি ভোগ্যবস্তু থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে হবে। এই ত্যাগের মধ্যেকার ইতাবাচক বা ভাবগত দিকটিকেই জোর দিয়েছেন।

৫) সহজ পরিচিত সুরের মাধ্যমে রচিত গানগুলো মাধ্যমে দেশজননীর একটি সৌন্দর্য্যময়ী কল্পমূর্তি রচনা করেছেন। এ-গানগুলোর মাধ্যমে তিনি বাঙালির আত্মশক্তিকে জাগিয়েছেন। এবং একটি জনসম্প্রদায়কে একটি জাতি হিসাবে পরিণত করার চেষ্টা কবি রবীন্দ্রনাথ করেছেন।

৬) বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে সকল ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের জন্য মিলনের স্রোতধারায় নিতে চেষ্টা করেছেন।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন প্রকৃতি 

বঙ্গভঙ্গ থেকে কয়েকটি ধারায় আন্দোলন শুরু হয় বঙ্গে। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা এবং তা কার্যকর করার পর বাংলায় সশস্ত্র আন্দোলন বিকাশ লাভ করে। ১৯০৬ সালে কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশনে 'স্বরাজ' শব্দ গৃহীত হয়। স্বরাজ বলতে কংগ্রেসের নরমপন্থীরা বুঝলো ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন, চরমপন্থীরা বুঝলো স্বাধীনতা। এর থেকে উৎপত্তি হলো বিদেশী পণ্য বর্জন প্রসঙ্গ। চরমপন্থীরা চাইলো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীণ বয়কট। এই পুরো আন্দোলনটিকেই স্বদেশী আন্দোলন হিসাবে চিহ্ণিত করা হয়।

ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার দেখিয়েছেন, স্বদেশী আন্দোলন তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল সে সময়। প্রথমধারাকে বলা যায় গঠনমূলক স্বদেশী। 'স্বদেশী সমাজ' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এ ধরনের গঠনমূলক কাজের কথা বিশদ করেছিলেন। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, আত্মশক্তির উদ্বোধন। দ্বিতীয়ধারা বয়কটকে প্রাধান্য দিয়েছিল। তৃতীয়ধারায় ছিল চরমপন্থীরা। তাদের কাছে স্বদেশী আন্দোলন এবং বয়কট গৌণ হয়ে যায়। মুখ্য হয়ে ওঠে স্বরাজ। এ নিয়ে কংগ্রেসে তুমুল বিতর্কও হয়। এরই মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে জনমত সংগঠনের জন্য জেলায় জেলায় সমিতি গড়ে ওঠে। গৃহীত নীতি কার্যকর করার জন্য তৈরি করা হয় জাতীয় স্বেচ্ছাসেবীদল। বরিশালে 'স্বদেশ বান্ধব', ময়মনসিংহে 'সুহৃদ' ও 'সাধনা', ফরিদপুরে 'ব্রতী' আর সবচেয়ে বিখ্যাত ঢাকার 'অনুশীলন' সমিতি। জেলা সমিতির অধীনে অনেক শাখাও স্থাপিত হয়।কলকাতায় গড়ে ওঠে 'যুগান্তর' নামে আরেক সংগঠন।এই দলের নেতা অরবিন্দ ঘোষ। সহোদর বারীন ঘোষ তার সহযোগী। এরা অস্ত্র হিসেবে বোমা ব্যবহার চালু করেন।

 

 

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : চত্বারিংশ পর্ব

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ—৫

বঙ্গবঙ্গ আন্দোলনে ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। ছাত্রদের এই আন্দোলনটা কঠোর হাতে দমনের চেষ্টা করে বৃটিশরাজ। ২২ অক্টোবর দি স্টেটসম্যান পত্রিকার সরকার একটি সার্কুলার জারি করে সকলপ্রকার স্কুল-কলেজের ছাত্রদের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা হয় এবং নানাবিধ শাস্তির বিধান করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভয় দেখানো হয় যদি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখা যায় তাহলে তার সরকারী সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হবে। সরকারের এই ঘোষণায় কোলকাতায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যারিস্টার আবদুল রসুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় জাতীয় বিশ্বিবিদ্যালয় গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবটি রবীন্দ্রনাথ আগে থেকেই দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন—শিক্ষাকে সরকারী আওতামুক্ত রাখতে হবে। তাহলে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর ইচ্ছে মত ছড়ি ঘোরাতে পারবে না। দেশের মানুষ সমাজের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে পারবে—তাদের জন্য কোন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা দরকার। কবিকল্পনা বলে রাজনীতিকরা রবীন্দ্রনাথের এই প্রস্তাবে কখনই কর্ণপাত করেননি।

১৯০৫ সালের ২৭ অক্টোবর পটলডাঙায় সহস্র ছাত্রের উপস্থিতিতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করেন। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রস্তাব সকলের সামনে বিষদভাবে আবার তুলে ধরেন। সে সভায় সিটি কলেজের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শচীন্দ্রনাথ বসু সরকারী সার্কুলারটি প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন, আমরা কোলকাতার ছাত্রবৃন্দ সম্মিলিত হইয়া প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, যদি গভর্নমেন্টের বিশ্ববিদ্যালয় আমাদিগকে পরিত্যাগ করিতেও হয় তাহাও স্বীকার করি, তথাপি স্বদেশ সেবারূপ যে মহাব্রত আমরা গ্রহণ করিয়াছি তাহা কখনো পরিত্যাগ করিব না।

সে সভায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, আমাদের সমাজ যদি নিজেদের বিদ্যাদানের ভার নিজে গ্রহণ না করে, তবে এক দিন ঠকিতে হইবে। আজকার এই অবমাননা যে নূতন তাহা নহে, অনেকদিন হইতেই ইহার সূত্র আরম্ভ হইয়াছে। আমাদের উচ্চ শিক্ষার উপর গভর্নমেন্টের অনুকূল দৃষ্টি নাই; সুতরাং গভর্নমেন্ট যদি এই পরোয়ানা প্রত্যাহারও করেন, তবুও আমরা তাহাদের হাতে শিক্ষার ভার সমর্পণ করিয়া শান্ত থাকিতে পরিব না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আমাদের অন্তকরণকে অস্থি মজ্জায় একেবারে দাসত্বে অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছে। তাই আমাদের নিজেদের শিক্ষার ভার নিজেদের হাতে রাখিতে হইবে।

২৯ অক্টোবর বাংলার ভগিনীদের জাতীয় ধনভাণ্ডারে দান করার আহ্বান করে আবেদন প্রচার করা হয়। আবেদনপত্রটিতে স্বাক্ষর করেন—শ্রী শিশিরকুমার ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, জগদিন্দ্রনাথ রায়, নলিনীবিহারী সরকার, মতিলাল ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সূর্যকান্ত আচার্যচৌধুরী, নবাব আবদুল সোভান চৌধুরী, কুমার সতীশচন্দ্র সিংহ ও গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ব্যধি ও প্রতিকার :

২৬ অক্টোবর মল্লিকবাজার ট্রাম ডিপোর কাছে ব্যারিস্টার আবদুল রসুলের সভাপতিত্বে স্বদেশী সভায় যোগদান করেন রবীন্দ্রনাথ। সভাটিতে প্রধানত মুসলমানদের উপস্থিতিই ছিল প্রধান। সেদিনের রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যটি ব্যধি ও প্রতিকার প্রবন্ধে ছাপা হয়েছিল।  এখানে তিনি মূলত হিন্দু-মুসলমান বিরোধের পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে, ইংরেজ মুসলমানদিগকে গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তজিত করিয়া দিয়াছে। কথাটা যদি সত্যিই হয় তবে ইংরেজদের উপর রাগ করিব কেন? দেশের মধ্যে যতগুলো সুযোগ আছে তাহা নিজের দিকে টানিবে না, এই ইংরেজকে এতোবড়ো নির্বোধ বলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিব এমন কি কারণ ঘটিয়াছে।

মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগান যাইতে পারে  এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়, কে লাগাইল সেটা গুরুতর বিষয় নয়। শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না। অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে। আমাদের মধ্যে যেখানে পাপ আছে সেখানে জোর করিবেই—আজ যদি না করে তো কাল করিবে, এক শত্রু যদি না করে তো অন্য শত্রু করিবে—এতএব শত্রুকে দোষ না দিয়া পাপকেই ধিক্কার দিতে হইবে।

তিনি বলেন, মিথ্যা কথা বলিবার কোনো প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝে একটা বিরোধ আছে। আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নহে। আমরা বিরুদ্ধ।

এরপর তিনি এই ভেদব্যাধির কারণটি বর্ণনা করছেন–

আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে বসিয়া এক ক্ষেত্রের ফল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি, আমরা এক ভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখদুঃখে মানুষ, তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ, যাহা ধর্মবিহীত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া এমন-একটি পাপ আমরা পোষণ করিয়াছি, একত্রে মিলিয়াও  আমরা বিচ্ছেদকে ঠেকাইতে পারি নাই। এ পাপকে ঈশ্বর কোনোমতেই ক্ষমা করিতে পারেন না।

পূর্ববঙ্গে জমিদারী পরিচালনা করতে যখন এসেছিলেন তখন প্রথম দিনেই তিনি দেখেছিলেন ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী অনুসারে আলাদা আলাদা বসার স্থান। সেই দিনই এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ করেছিলেন তার জমিদারী থেকে। সে অভিজ্ঞতার আলোকে কবি বলেন–

আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাশে হিন্দু-মুসলমান বসে না—ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়। হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়।

এক করিবার বেলায় বলিয়া থাকি, কী করা যায়, শাস্ত্র তো মানিতে হইবে। অথচ শাস্ত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করিয়া ঘৃণা করিবার বিধান তো দেখি না। যদি-বা শাস্ত্রের সেই বিধানই হয়—তবে সে শাস্ত্র লইয়া স্বদেশ-স্বজাতি-স্বরাজের প্রতিষ্ঠা কোনোদিন হইবে না। মানুষকে ঘৃণা করা যে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতিরক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই। তাহারা যাহাদিগকে ম্লেচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিতেছে সেই ম্লেচ্ছের অবজ্ঞা তাহাদের সহ্য করিতেই হইবে।

তিনি এই সময়ের হিন্দু নেতৃবৃন্দের ভেদাশ্রিত আন্তকরণ দেখে ব্যাথিত হয়েছিলেন। এ কারণে তিনি দেখেছিলেন, এভাবে চলতে থাকলে এই ভেদের বীজটি একদিন বিষবৃক্ষে পরিণত হবে। বিচ্ছেদটি চূড়ান্ত হবে হৃদয়ে, দেশবিচ্ছেদে, সংস্কৃতি বিচ্ছেদে,  মনুষ্যত্ব বিচ্ছেদে। ভয়ঙ্করভাবে নিপীড়িতরা পীড়কদের উপর প্রতিশোধ নেবে। কবি বলেন,   একদিন

মানুষকে মানুষ বলিয়া গণ্য করা যাহাদের অভ্যাস নহে, পরস্পরের অধিকার যাহারা সূক্ষাতিসূক্ষভাবে সীমাবদ্ধ রাখিবার কাজে ব্যাপৃত—যাহারা সামান্য স্খলনেই আপনার লোককেই ত্যাগ করিতেই জানে, পরকে গ্রহণ করিতে জানে না—সাধারণ মানুষের প্রতি সামান্য শিষ্টতার নমস্কারেও যাহাদের বাধা আছে—মানুষের সংসর্গ নানা আকারে বাঁচাইয়া চলিতে যাহাদিগকে সর্বদা সতর্ক থাকিতে হয়—মনুষ্যত্ব হিসাবে তাহাদিগকে দুর্বল হইতেই হইবে। যাহারা নিজেকেই নিজে খণ্ডিত করিয়া রাখিয়াছে, ঐক্যনীতি অপেক্ষা ভেদবুদ্ধি যাহাদের বেশি দৈন্য অপমান ও অধীনতার হাত হইতে তাহারা কোনোদিন নিষ্কৃতি পাইবে না।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আরও কিছু ত্রুটির কথাটাও তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বয়কট ও স্বরাজ মন্ত্র গ্রহণের মধ্যে দিয়ে ধরা পড়েছে এই আন্দোলনের প্রধান শত্রু  ইংরেজের চেয়ে  নিজেরাই নিজেদের ভেদ সম্পর্কটাই বড় শত্রু। বাইরের ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমে দেখা গেল নিজেদের মধ্যেই একটা যুদ্ধ লেগে আছে। এই আত্মকলহ বজায় রেখে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা অসম্ভব।

তিনি বলেন, আজ আমাদের ইংরেজী পড়া শহরের লোক যখন নিরক্ষর গ্রামের লোকের কাছে গিয়া বলে 'আমরা উভয়ে ভাই'—তখন এই কথাটার মানে সে বেচারা কিছুতেই বুঝিতে পারে না। যাহাদিগকে আমরা 'চাষা বেটা'বলিয়া জানি, যাহাদের সুখদুঃখের মূল্য আমাদের কাছে অতি সামান্য, যাহাদের অবস্থা জানিতে হইলে আমাদিগকে গবর্ণমেন্টের প্রকাশিত তথ্যতালিকা পড়িতে হয়, সুদিনে-দুর্দিনে আমরা যাহাদের ছায়া মাড়াই না, আজ হঠাৎ ইংরেজের প্রতি আস্পর্দ্দা প্রকাশ করিবার বেলায় তাহাদের নিকট ভাই-সম্পর্কের পরিচয় দিয়া তাহাদিগকে চড়া দামে জিনিস কিনিতে ও গুর্খার গুতা খাইতে আহ্বান করিলে আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দেহ জন্মিবার কথা। সন্দেহ জন্মিয়াও ছিল। কোনো বিখ্যাত স্বদেশী প্রচারকের নিকট শুনিয়াছি যে, পূর্ববঙ্গে মুসলমান শ্রোতারা তাঁহাদের বক্তৃতা শুনিয়া পরস্পর বলাবলি করিয়াছে যে, বাবুরা বোধ করি বিপদে ঠেকিয়াছে। এই বাবুদের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া, কিছু সুবিধার জন্য ঐক্যের কথা বলা এবং ঐক্যের আগ্রহে হৃদয়ের যোগ না থাকায় এই বয়কট বা স্বরাজের আন্দোলনটা সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে উঠেছে বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন।

এই রকম একটি পরিস্থিতিতে বিদেশী রাজা চলিয়া গেলেই দেশ যে আমাদের স্বদেশ হয়ে উঠবে এটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। দেশের লোককেই দেশের সকল মানুষের অন্ন-বস্ত্র-সুখস্বাস্থ্য-শিক্ষাদীক্ষা দানে সর্বপ্রধান সহায় হতে হবে।  দুঃখে বিপদে দেশের মানুষই সকল মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িতে হবে—কেবল সুবিধায় নয়। অসুবিধায়ও। অসুবিধায়ও ভাই বলে তাঁর কাছে যেতে হবে। তবেই স্বরাজ সম্ভব। অন্য কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে কবি বলেন।

কবির এই চিন্তাটা ছিল প্রচলিত রাজনীতিকদের চেয়ে ভিন্ন। শুধু ভিন্ন বলাটা সঙ্গত হয় না—বলা উচিৎ একেবারে তাঁদের বিপরীত চিন্তার প্রকাশ। নেতারা যখন বঙ্গবঙ্গ আন্দোলনকে তাঁদের সাময়িক সুবিধার কর্মনীতি হিসেবে গ্রহণ করছে—সেখানে একটা সুদূর প্রসারী চিন্তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাকে উপস্থান করেছেন, উল্টো পথে হাঁটছেন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় : ছাত্রসমাজ প্রস্তুত–দোদুল্যমান রাজনীতিক

২৭ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ কোলকাতায় ফিরে আসেন। সেখানে ফিল্ড এন্ড একাডেমী ভবনে সদস্য ও ছাত্রদের সান্ধ্যসম্মিলনে সভাপতিত্ব করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, বঙ্গবঙ্গ ব্যাপারটি সর্বজনীন বলেই ছাত্ররা যোগদান করবে—এটা খুব স্বাভাবিক। নেতাদের ত্যাগ স্বীকার যথেষ্ট নয় বলে অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের পাঁজনের শক্তিকে সংহত করা গেলে নেতারাও যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত হবেন। জাতীয় ধনভাণ্ডারের ইংরেজি নাম National Fund না রেখে বঙ্গভাণ্ডার রাখার প্রস্তাব করেন এই  সভায়। তাঁর মতে স্বদেশী কলকারখানা গড়ে তোলা গেলে স্বদেশী দ্রব্যের যোগান বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া আমাদের শিক্ষাকে স্বাধীন করার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যায়লয প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে। গভর্নমেন্টের সম্মন ও চাকরীর মায়া ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে ছাত্রদের পরামর্শ দেন। যদি ছাত্ররা প্রস্তুত থাকে এই ত্যাগ স্বীকারে তাহলে নেতারা বাধ্য হবে তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে।

৫ নভেম্বর বিকেলে  ডন সোসাইটিতে দুহাজার ছাত্রের উপস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, বাংলাদেশে আজ নবজীবনের সূত্রপাত হয়েছে। বিদেশী বর্জন ও স্বাধীন স্বদেশী শিক্ষার দ্বিমুখী সংকল্পকে আশ্রয় করে চলেছে বাংলা। প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় শুরুতেই জীবিকোপার্জনের ব্যবস্থা, অভিভাবকদের মতগঠন, ইঞ্জিয়ারিং ডাক্তারি ভূবিদ্যা ইত্যাদি বিষয় চালু করা না গেলে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ইংরেজের বিশ্বিদ্যালয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশেও যেতে হবে।

এ সময়কার সভায় রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের রাজনৈতিক দিকের চেয়ে জাতীয় শিক্ষার আন্দোলনে বেশী সক্রিয় অংশগ্রহণ করছেন। তবে পাশাপাশি তিনি স্বদেশী গান লিখছেন, স্বদেশী দ্রব্য প্রস্তুত ও প্রচারেও তিনি বিস্তৃতভাবে অংশ নিচ্ছেন এই সময়ে।

১ লা নভেম্বর সারাদেশে Proclamation Day পালিত হয়। রংপুরে বন্দে মাতরম গানটি গাওয়ার অভিযোগে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট টি এমোরসন প্রায় ২০০ জন ছাত্রকে ৫ টাকা হারে জরিমান করেন।  খবরটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ৪ নভেম্বর। গোলদিঘির পাড়ে সেদিনই এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা সংকোচন পরওয়ানা বিরোধী সমিতি বা Anti Circular Society তৎক্ষণাৎ গঠিত হয়। গভর্নমেন্টের বিশ্ববিদ্যালয় পরিত্যাগ করে ছাত্রদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হওয়ার আবেদন জানানো হয় এই জমায়েতে। ৫ নভেম্বর বগুড়ার নবাব আবদুল সোভান চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত  সভায় পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিন্দা করে বক্তব্য রাখে। কিন্তু উপস্থিত ছাত্র-জনতা এই নিন্দা পছন্দ করে নি। তারা পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়কে বক্তব্য অসমাপ্ত রেখেই বসিয়ে দেয়।

৭ নভেম্বর এন্টি সার্কুলার সোসাইটির পক্ষ থেকে শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু ও জাপান-ফেরত ইঞ্জিনিয়ার রমাকান্ত রায় রংপুরে যান। সেখানে ছাত্রসভায় প্রস্তাবিত জাতীয় বিশ্বদ্যালয়ের অধীনে রংপুর জাতীয় বিদ্যালয় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ৮ নভেম্বর ঔপন্যাসিক ব্যারিস্টার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়কে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বিদ্যালয়ের কাজ শুরু হয়। রংপুরের ঘটনায় রাজনৈতিক নেতাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবটিকে বিবেচনা করতে বাধ্য করে।

৯ নভেম্বর মাদারীপুরে পূর্ববঙ্গে ছোটো লাট র‍্যামফিল্ড ফুলারের আদেশে কয়েকজন ছাত্রকে বেত মারার শাস্তি দেওয়া দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তারা বন্দে মাতরম বলেছিল। এই খবর কোলকাতায় পৌঁছালে গোলদিঘিতে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সুবোধচন্দ্র মল্লিক এক লক্ষ টাকা দানে ঘোষণা করেন প্রস্তাবিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে। সভায় বক্তব্য রাখেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাস, মৌলবী আবুল হোসেন প্রমুখ। তারা বলেন,  জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। ছাত্ররা সুবোধ মল্লিককে রাজা উপাধীতে ঘোষণা করে।

১০ নভেম্বর গোলদিঘিতে আরেকটি ছাত্রজনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ময়মনসিংহ-গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পাঁচ লক্ষ টাকা দান করার প্রতিশ্রুতি দেন। ১১ নভেম্বর ১০ হাজার ছাত্রের উপস্থিতিতে আশুতোষ চৌধুরী ছাত্রদের অনুরোধ করেন, তারা যেন বি.এ. ও এম.এ পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকার সংকল্প ত্যাগ করে। তখনো জাতীয় বিশ্বিবদ্যালয় বিষয়ে নেতাদের দোদুল্যমানতা ছিল। ১৩ নভেম্বর পান্তির মাঠে বিরাট জনসভায় আশুতোষ চৌধুরী, সিস্টার নিবেদিতা, অশ্বিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় বক্তব্য রাখেন। ছাত্রদের দাবীর মুখে আশুতোষ চৌধুরী জানান—নেতারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য চেষ্টা করছেন।

১৬ নভেম্বর বিকেল তিনটায় পার্ক স্ট্রিটে বেঙ্গল ল্যান্ডহোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভায়  জাতীয়ভাবে এবং জাতীয় তত্ত্বাবধানে সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক এবং কারিগরী এই ত্রিবিধ শিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য  ১৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় শিক্ষা সমাজ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে রবীন্দ্রনাথ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আরেকটি প্রস্তাবে ছাত্রদের পরীক্ষা বর্জনের সংকল্প ত্যাগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। এই সভায় National Council of Education এর জন্য একজন ভদ্রলোক পাঁচলক্ষ টাকা বা বার্ষিক কুড়ি হাজার টাকার আয়ের ভূ-সম্পত্তি, একজন নগদে দুই লক্ষ টাকা ও একটি সুন্দর বাড়ি, একজন নগদ এক লক্ষ টাকা ও অপর একজন বার্ষিক ত্রিশ হাজার টাকা আয়ের সম্পত্তি দেওযার কথা ঘোষণা করেন। এই সভায় রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন। ডঃ রাসবিহারী ঘোষ, স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, আশুতোষ চৌধুরী, প্রমথ চৌধরী, মহম্মদ এ গজনভি, ডাঃ নীলরতন সরকার, মৌলবী আবদুল মজিদ, মৌলবী শামসুল হুদা, রেভারেন্ড নাগ, সুবোধচন্দ্র মল্লিক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

আন্দোলনে মতবিরোধ

১৭ নভেম্বর স্বদেশী শিক্ষা সংক্রান্ত মন্ত্রণাসভার সিদ্ধান্তের জন্য পান্তির মাঠে সমবেত হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিনন্দন জানানোর জন্য সভাস্থলে পত্রপুষ্পে শোভিত করা হয়েছিল। মঞ্চে ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যাঞ্চেলর স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাক্তার রাসবিহারী ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। তৎকালীন সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কোলকাতা রিপন কলেজের মালিক। তাঁর কর্মকাণ্ডে ছাত্রজনতা তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারছিল না।  তিনি বলেন, আমি শুনিয়াছি কেহ কেহ বলিতেছেন যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইলে রিপন কলেজের ক্ষতি হইতে পারে এই আশঙ্কায় আমি ইহার প্রতিবন্ধকতা করিব—আমি বলিতে পারি যে যখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইবে তখন রিপন কলেজই সর্ব্বপ্রথমে তাহার অন্তর্ভুক্ত হইবে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছাত্রদের কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তখনই ত্যাগ না করার পরামর্শ দেন। তার এই দুকূল বজায় রাখার পরামর্শটি উপস্থিত ছাত্ররা পছন্দ করেনি। তারা তাকে কঠোরভাবে নিন্দা জানায়। দেশের ছাত্রসমাজ, সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবীগণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে থাকলেও রাজনীতিকরা তাদের সুবিধাবাদিতার কারণে এই দাবী নিয়ে ইংরেজদের বেশি ঘাটাতে চায় নাই। পরিহাসের বিষয় হল,  ১৯০৬ সালে আগস্ট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন হলে রিপন কলেজসহ বাংলার কোনো কলেজই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়নি। পরে এইভাবে জনগণের আকাঙ্খা জাতীয় সুবিধাবাদি রাজনীতিকদের হাতে মার খায়।

২৪ নভেম্বর পান্তির মাঠে আর একটি ছাত্রসভায় বিপিনচন্দ্র পাল, মৌলবী লিয়াকত হোসেন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সেখানে দ্বিতীয় প্রস্তাবটির কঠোর সমালোচনা করে বলা হয়—আজ যদি রংপুরের ছাত্রগণকে ফেলিয়া কলিকাতার ছাত্ররা পরীক্ষায় উপস্থিত হন তবে গবর্নমেন্ট যে বঙ্গব্যবচ্ছেদ  করিতে পারেন নাই, বাঙালি নিজেই সেই বঙ্গব্যবচ্ছেদ করিবেন।

হতাশার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আশা

এই পর্যায়ে এসে দেখা যাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নে মতবিরোধ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ এইসব মতবিরোধ সত্বেও  প্রস্তাবিত শিক্ষা কমিটিকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করে যেতে থাকেন। তিনি আশা করে আছেন বঙ্গবঙ্গের এই জাগরণের মধ্যে আর কিছু না হোক অন্তত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে উঠবে। এটা গড়ে উঠলে দেশের মানুষ তাদের আত্মশক্তি বুঝতে পারবে। প্রকৃত স্বদেশ গড়ে তুলবে।  ১৯ নভেম্বর কমিটি খসড়া পরিকল্পনাটিকে চূড়ান্ত রূপ দেয়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়কে ২৬ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে জানাচ্ছেন, হীরেন্দ্রবাবু, মোহিনীবাবু…নীররতন সরকার (প্রভৃতি) মিলিয়া সংকল্পিত (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের) নিয়ম ও গঠনে (প্রণালী প্রণয়নে) নিযুক্ত ছিলাম—(যখন) ছাত্রগণ এক সংকল্প গ্রহণ করিয়াছেন তখন নিষ্ফল আশঙ্কা বোধ হয় মন হইতে দূর করিয়া দেওয়া যাইতে পারে। আমি তো অনেকদিন হইতে ঔদাসীন্য ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আশাপথ চাহিয়া কাজ করিয়া যাইতেছি—বর্ত্তমান উদ্যোগও যদি ব্যর্থ হয় তবু আমি আশা ছাড়িবনা। দেশের কল্যাণের জন্য যখন অন্য পথ নাই তখন বারবার প্রতিহত হইয়াও এই একই লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হইতেই হইবে।

শিক্ষার আন্দোলন নামে সে সময়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ পুস্তিকাটির ভূমিকা লিখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে স্বদেশী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য যে-সকল সভা সমিতি বসিয়াছে, তাহার মধ্যে নানা মতের, নানা বয়সের, নানা দলের লোক সমবেত হইয়াছেন। ইঁহারা সকলে মিলিয়া যাহা কিছু স্থির করিতেছেন, তাহা ইঁহাদের প্রত্যেকেরই সম্পূর্ণ মনঃপুত হইতে পারে না। এই-সকল সমিতির সঙ্গে বর্তমান লেখকেরও যোগ ছিল। প্রস্তাবিত বিদ্যালয়ের যে শিক্ষাপ্রণালী ও নিয়ম নির্ধারিত হইয়াছে, লেখকের যদি সম্পুর্ণ স্বাধীনতা থাকিত তবে ঠিক সেরূপ হইত না সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহা লইয়া লেখক বিবাদ করিতে প্রস্তুত নহেন। তিনি কাজ আরম্ভ হওয়াকেই সকলের  চেয়ে বেশি করেন। যদি তাঁহার মনোমতো প্রণালীই বাস্তবিক সর্বোৎকৃষ্ট হয়, তবে কাজ আরম্ভ হইলে পর সে-প্রণালীর প্রবর্তন যথাকালে সম্ভবপর হইবে, এ ধৈর্য তাঁহাকে রক্ষা করিতেই হইবে।

 

 

রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : একচত্বারিংশ পর্ব

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন  রবীন্দ্রনাথ

জাতীয় শিক্ষার আন্দোলন নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সুবিধাবাদিতাও রবীন্দ্রনাথকে হতাশ করে ফেলে।  ১৯০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি শান্তিনিকেতনে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁকে কোনো ধরনের সভাসমিতিতে যোগ দিতে দেখা যায় না। ১১ ডিসেম্বর মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি একটি চিঠিতে লিখেছেন—কিছুদিনের জন্য সভাসমিতি হইতে পলায়ন করিয়া বোলপুরে আশ্রয় লইয়াছি। বেশিদিন এমন আরামে কাটিবে না। আবার কখন জনতার হঠাৎ ডাক পড়িবে, নির্জনতা হইতে বিদায় লইতে হইবে।

১১৯০৬ সালের ১১ মার্চ রবীন্দ্রনাথের মেজো দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শিক্ষা কমিটির সভায় শিক্ষাসমাজের গঠনপ্রণালীর চূড়ান্ত রিপোর্ট গৃহীত হয়। রবীন্দ্রনাথ এ সভায় অনুপস্থিত ছিলেন।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের রাজনৈতিক অংশে রবীন্দ্রনাথ কিছুটা যোগ দিলেও জাতীয় শিক্ষা-আন্দোলনে তাঁর যোগ ছিল সর্বাঙ্গীন। কিন্তু জাতীয় নেতাদের মতিগতি দেখে মাস-দেড়েকের মধ্যেই তাঁর মোহমুক্তি ঘটে। ১২ ডিসেম্বর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে চিঠিতে লেখেন, আমাকে লইয়া টানাটানি করিয়া কি লাভ? বস্তুত দেশ যদি প্রস্তুত হইয়া না থাকে তবে আমি মাথা খুঁড়িয়া মরিলে কেবল আমারই মাথার পক্ষে অসুবিধা—তাহাতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বৃহৎ ব্যাপারের কোনোই সুবিধা হইবে না।…আমি ইহাঁদের কাছে যাতায়াত করিয়া বৃথাই সময় নষ্ট করিয়াছি।

ইহা নিশ্চয়ই জানিবেন উচ্চতর লক্ষ্য বিস্তৃত হইয়া যাঁহারা গবর্নমেন্টের বিরুদ্ধে স্পর্দ্ধা প্রকাশ করাকেই আত্মশক্তি-সাধনা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা বলিয়া মনে করেন—যাঁহারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনাকে এই স্পর্দ্ধা প্রকাশেরই একটা উপলক্ষ্য বলিয়া জ্ঞান করেন তাঁহাদের দ্বারা স্থিরভাবে দেশের স্থায়ী মঙ্গল সাধন হইতে পারিবে না। দেশে যদি এরূপ লোকেরই সংখ্যা এবং ইহাদের প্রভাবই অধিক থাকে তবে আমাদের মত লোকের কর্তব্য নিভৃতে যথাসাধ্য নিজের কাজে মনোযোগ করা। বৃথা চেষ্টায় নিষ্ফল আন্দোলনে শক্তি ও সময় ক্ষয় করা আমাদের পক্ষে অন্যায় হইবে।..আমি তাই ঠিক করিয়াছি যে, অগ্নিকাণ্ডের আয়োজনে উন্মত্ত না হইয়া যতদিন আয়ূ আছে আমার এই প্রদীপটি জ্বালিয়া পথের ধারে বসিয়া থাকিব। আমি কোনো জন্মেই লীডার বা জনসংঘের চালক নই—আমি ভাট মাত্র—যুদ্ধ উপস্থিত হইলে গান গাহিতে পারি এবং যদি আদেশ দিবার কেহ থাকেন তাঁহার আদেশ পালনেই প্রস্তুত আছি। যদি দেশ কোনোদিন দেশীয় বিদ্যালয় গড়িয়া তোলেন এবং তাহার কোনো সেবাকার্যে আমাকে আহ্বান করেন তবে আমি অগ্রসর হইব—কিন্তু কোনো নেতা হইবার দুরাশা আমার মনে নাই—যাহারা নেতা বলিয়া পরিচিত তাহাদিগকে আমি নমস্কার করি—ঈশ্বর তাঁহাদিগকে শুভবুদ্ধি প্রদান করুন।

এই আন্দোলনে শুধু রাজনীতিকরা নয়—আমলাতন্ত্রে কাজ করেছেন এমন লোকজনও যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের দুর্বলতা নিয়েও কবি সরব হয়েছিলেন। বিপিনগুপ্তকে ১৯১১ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর চিঠিতে লিখেছিলেন, একটা Sysmem এর যাঁরা মানুষ হয়ে কর্মক্ষেত্রে খুব সফলতা লাভ করেন, তাঁরা সেই সে Sysmem থেকে কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারেন না। গুরুদাস বাবু হাইকোর্টের জজ হলেন, কিন্তু পুরাতন শিক্ষা-পদ্ধতি থেকে মুক্ত করতে পারেননি। আবার যেটা ন্যাশনাল হওয়া দরকার, সেটাকে হিন্দু করবার চেষ্টা দেখে সফলতার আশা বড় করতে পারিনি। দেশের শিক্ষাপদ্ধতির মর্মকথাটুকু বুঝতে না পারলে, নিজেকে ভাল করে চিনতে না পারলে একটা মিথ্যে মেকি নিয়ে আত্মবঞ্চনা করা ত স্বদেশের অপমান করা হয়।

১৯০৫ সালের ২৭-৩০ ডিসেম্বর বারানসিতে জাতীয় কংগ্রেসের একুশতম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। গোপালকৃষ্ণ গোখলের সভাপতিত্বে এই অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গের নিন্দা করা হয়। স্বদেশী আন্দোলনকে প্রশংসা করলেও বয়কটকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি তারা। তাদের ভাষায়—Perhaps the constitutional and effective means ছিল বয়কট। বয়কট আন্দোলনকে সর্বভারতীয় করতে আগ্রহী ছিল না। বস্ত্র-বয়কটের ফলে সে সময় বোম্বে ও আহমেদাবাদের ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছিল। কংগ্রসের অবাঙালি নেতৃবৃন্দ তাদের ব্যবসাটাকে বড়ো করে দেখেছিল—বাংলার স্বার্থ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিল না।  রবীন্দ্রনাথের মত ব্যক্তিবর্গের দাবী ছিল বস্ত্রবয়কট করলেই হবে না, তার বদলে বঙ্গে বস্ত্রকারখানা গড়ে উঠুক বাঙালিদের উদ্যোগে। এজন্য জাতীয় ধনভাণ্ডারও গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এখানে বাঙালিদেরকে অর্থদান করার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেসীরা বোম্বে ও আহমেদাবাদের স্বার্থে এই উদ্যোগকে বাতিল করে দেয়। গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন—চিরস্থায় বন্দোবস্তের কল্যাণে বাঙালি জমিদাররা অনেক টাকা পয়সা কামাই করেছে। সুতরাং তাদের দায়িত্ব—স্বদেশী মিল গড়ে তোলার জন্য মূলধন দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ এর উত্তরে লিখেছিলেন বিলাসের ফাঁদ নামে একটি প্রবন্ধ। সেখানে বলেছিলেন, ইংরেজের অনুকরণে ব্যক্তিগত ভোগস্পৃহা চরিতার্থ করতে গিয়ে সেই অর্থ সমাজের কল্যাণে ব্যয়িত হতে পারছে না। তিনি লিখেছেন– দেশের অধিকাংশ (জমিদারদের) অর্থ শহরে আকৃষ্ট হইয়া , কোঠাবাড়ি গাড়িঘোড়া সাজসরঞ্জাম আহারবিহারেই উড়িয়া যাইতেছে । অথচ যাঁহারা এইরূপ ভোগবিলাসে ও আড়ম্বরে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন , তাঁহারা প্রায় কেহই সুখে স্বচ্ছন্দে নাই ; তাঁহাদের অনেকেরই টানাটানি , অনেকেরই ঋণ , অনেকেরই পৈতৃক সম্পত্তি মহাজনের দায়মুক্ত করিবার জন্য চিরজীবন নষ্ট হইতেছে—কন্যার বিবাহ দেওয়া , পুত্রকে মানুষ করিয়া তোলা , পৈতৃক কীর্তি রক্ষা করিয়া চলা , অনেকেরই পক্ষে বিশেষ কষ্টসাধ্য হইয়াছে।

বঙ্গভঙ্গ চলমান  আন্দোলনের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের দ্বিধা ও পশ্চাদপসারণ লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।   বাংলার চরমপন্থী রাজনীতিকরা বয়কট ও স্বদেশীকে স্বরাজের প্রধান হাতিয়ার রূপে ভাবতে শুরু করেছিল।

সে সময় সপ্তম এডওয়ার্ডের পুত্র যুবরাজ ও তাঁ স্ত্রী ভারত সফরে এসেছিলেন। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তাদেরকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। তারা এই জন্যই চেয়েছিলেন বৃটিশকে বেশী ঘাটানো যাবে না। কংগ্রেসে অন্যতম নেতা ভূপেন্দ্রনাথ বসু ২৯ পিসেম্বর বারানসির কংগ্রেস সম্মলনের অধিবেশন থেকে ছুটে এসে কোলকাতায় স্টীমার ঘাটায় উপস্থিত হয়েছিলেন যুবরাজকে অভ্যর্থনা জানাতে। সেদিন কোলকাতার গোলদীঘিতে স্বদেশী সভা চলছিল। ভূপেন্দ্রনাথ বসু যুবরাজকে অভ্যর্থনা জানিয়েই জাহাজ ঘাটা থেকে গোলদীঘীর স্বদেশী সভায় যোগ দেন। হোমপ্রসাদ ঘোষ লিখেছেন, লোকে তাঁকে দেখিয়া উত্তজিত হইয়া উঠিয়া—তাহাকে ধিক্কার দিল। দুই দলে মতান্তর যত স্পষ্ট হইতে লাগিল, ততই ছাড়াছাড়ি হইতে লাগিল।

বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে ইংরেজ সরকার  দমননীতি গ্রহণ করে। পূর্ব ও আসামের লেফটেন্যান্ট স্যার বামফিল্ড ফুলার ন্যায়বিচারের তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে দমন-পীড়ন শুরু করে দেয়। এটা নিয়েও রবীন্দ্রনাথের অনেক ক্ষোভ ছিল। ১৯০৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কোলকাতায় গ্রান্ড থিয়েটারে স্বদেশী আন্দোলনরত নির্বাচিত কিছু ব্যক্তিকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ সেখানে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, বাংলাদেশের বর্তমান স্বদেশী আন্দোলনে কুপিত রাজদণ্ড যাঁহাদিগকে পীড়িত করিয়াছে, তাঁহাদের প্রতি আমার নিবেদন এই যে, তাহাদের বেদনা যখন আজ সমস্ত বাংলাদেশের হৃদয়ের মধ্যে বহন করিয়া লইল, তখন এত বেদনা অমৃতে পরিণত হইয়া তাহাদিগকে অমর করিয়া তুলিয়াছে। রাজচক্রের যে অপমান তাঁহাদের অভিমুখে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, মাতৃভূমির করুণ করস্পর্শ তাহা বরমাল্যরূপে ধারণ করিয়া তাহাদের ললাটকে আজ ভূষিত করিয়াছে।

দেশী শিল্প-ব্যবসা-বানিজ্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৮ মার্চ কোলকাতায় একটি দেশী ইন্সুরেন্স কোম্পানী যাত্রা শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথও এই ইন্সুরেন্স কোম্পনীর সঙ্গে ছিলেন।

এই সময়কালে রবীন্দ্রনাথ আরও বেশি করে বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন থেকে সরে এসেছেন। জাতীয় শিক্ষাআন্দোলনের নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত মতবিরোধ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ত্বের এই আন্দোলনের প্রতি অনীহাকে তিনি অপছন্দ করেছেন। কিন্তু পুরোপুরি শিক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে  সম্পর্ক ছেদ করেননি।

ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মারা গেছেন। সেজো মেয়েটিরও অসুস্থ হয়ে হয়ে আছে। মাতৃহীন ছোটো ছেলেটি আর ছোটো মেয়েটিকে দেখভাল করার মত লোকও তেমন পাচ্ছেন না। বড়ো ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন বিলেতে কৃষি বিদ্যা শেখার জন্য। অর্থ সংকট রয়েছে। ধীরে ধীরে গড়ে তুলতেন শান্তি নিকেতন—বিদ্যালয়। তার সকল দ্বায়িত্ব তাঁর একার উপর। আর রয়েছে বিপুল রচনাকর্মের তাড়না। সংসার এবং কর্মজাল থেকে ধীর ধীরে মুক্তি চাচ্ছিলেন। তাছাড়া ঈশ্বরমুখীন এক ধরনের আধ্যাত্মিকতাও তাঁর মধ্যে কাজ করছে। ফলে তিনি এইসব সংশয়াপন্ন, দোদুল্যমান, সুবিধাবাদী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন হৃদয়বৃত্তি আর রাজনীতির মধ্যে ব্যবধান দুস্তর। রাজনীতি ছলনাপূর্ণ হতে পারে—হৃদয়কে সে গণ্যকে করে না।

১৪ এপ্রিল বরিশালে তিনদিনব্যাপী সাহিত্য সম্মেলন শুরু হয়। ব্যারিস্টার আবদুল রসুল সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এমারসন বরিশালের রাস্তায়  তখন বন্দে মাতরম ধ্বনি দেওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ব্যারিস্টার আবদুল রসুলকে সামনে রেখে শোভাযাত্রা বের হয়েছিল। রাস্তায় বেরিয়েই শোভাযাত্রা থেকে বন্দেমাতরম ধ্বনি দেওয়া শুরু হয়। পুলিশ তখন বেধড়ক মারপিঠ করে শোভাযাত্রায়। কংগ্রসের নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় পুলিশের হাতে তিনি আটক হন। ৪০০ টাকা জরিমানা দিয়ে তিনি ছাড়া পান। দ্বিতীয় দিনের সম্মেলন শুরু হলে পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট কেম্প ঘোষণা কর সম্মেলনস্থলে বন্দেমাতরম ধ্বনি দেওয়া হবে না এই মর্মে নিশ্চিত করা হলে সম্মেলনের অনুমতি দেওয়া হবে। কেম্পের এই দাবী মানতে নেতৃবৃন্দ অস্বীকার করলে তখন সম্মেলন বন্ধ করে দেয় পুলিশ। তৃতীয় দিনে সম্মলনে রবীন্দ্রনাথের অংশ নেওয়ার কথা ছিল। তিনি এই উপলক্ষ্যে বরিশালে উপস্থিতও হয়েছিলেন। তাঁকে রাখা হয়েছিল কীর্ত্তনখোলা নদীবক্ষে। সম্মেলনে পণ্ড হয়ে গেলে তিনি ফিরে যান। এ ঘটনায় কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় হিরো মর্যাদাপ্রাপ্ত হন বঙ্গে। কোলকাতা ফেরার সময় তাঁর গাড়ি মানুষেরা টেনে শোভাযাত্রা সহকারে ইংরেজ স্টাইলে শহরে আনা হয়। রবীন্দ্রনাথ এই বিদেশী প্রথার সমালোচনা অনেক থেকেই করে আসছিলেন। তিনি জানেন, দেশ থেকে ইংরেজ  তাড়ালেই হয় না—মন থেকে ইংরেজকে তাড়ানোর দরকার আগে। দেহের আগে আত্মার স্বাধীনতা দরকার। বিদেশী তাড়ানোর আগে স্বদেশী হওয়াটাই সবার চেয়ে জরুরী।

রবীন্দ্রনাথ ২১ এপ্রিল দীনেশচন্দ্র সেনকে চিঠিতে লেখেন, আত্মার স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো স্বাধীনতা নাই—আমরা নতুন বন্ধনকেই মুক্তি বলিয়া ভ্রম করি। আমি এ সময়ে জঞ্জালের মধ্যে নিজেকে জড়াইয়া লক্ষ্যভ্রষ্ট হইতে চাই না—বেশ একটু নিরালায় ভাল করিয়া নিজের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করিয়া লই—আগে নির্মল অন্তঃকরণে সমস্ত জিনিসটাকে তলাইয়া দেখি—তারপর যদি কথা বলার আবশ্যক হয় ত কথা বলিব। আমি এখন লোকলোচনের অন্তরালে থাকিতে ইচ্ছা করি—আমার আর যশোমানে কাজ নাই। ভিড়ের মধ্যেই যদি দিন কাটাই তবে ঘরের কাজ কখন করিব? এতএব এবারে আমি সরিয়া পড়িলাম।

২৬ এপ্রিল বরিশাল নির্যাতন-পীড়নের প্রতিবাদে রাই পশুপতিনাথের বাড়িতে আয়োজিত সভায় রবীন্দ্রনাথ দেশনায়ক প্রবন্ধটি পড়েন। তিনি লিখেছেনআপনারা ভাবিয়া দেখুন, বাংলার পার্টিশনটা আজ খুব একটা বড়ো ব্যাপার নহে। আমরা তাহাকে ছোটো করিয়া ফেলিয়াছি। …এই পার্টিশনের আঘাত উপলক্ষে আমরা সমস্ত বাঙালি মিলিয়া পরম বেদনার সহিত স্বদেশের দিকে যেমনি ফিরিয়া চাহিলাম অমনি এই পার্টিশনের কৃত্রিম রেখা ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্র হইয়া গেল। আমরা যে আজ সমস্ত মোহ কাটাইয়া স্বহস্তে স্বদেশের সেবা করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইয়াছি, ইহার কাছে পার্টিশনের আঁচড়টা কতই তুচ্ছ হইয়া গেছে। কিন্তু আমরা যদি কেবল পিটিশন ও প্রোটেস্ট্‌, বয়কট ও বাচালতা লইয়াই থাকিতাম, তবে এই পার্টিশনই বৃহৎ হইয়া উঠিত—আমরা ক্ষুদ্র হইতাম, পরাভূত হইতাম। কার্লাইলের শিক্ষা-সার্ক্যুলর আজ কোথায় মিলাইয়া গেছে। আমরা তাহাকে নগণ্য করিয়া দিয়াছি। গালাগালি করিয়া নয়, হাতাহাতি করিয়াও নয়। গালাগালি-হাতাহাতি করিতে থাকিলে তো তাহাকে বড়ো করাই হইত।

যাঁহারা পিটিশন বা প্রোটেস্ট্‌, প্রণয় বা কলহ করিবার জন্য রাজবাড়ির বাঁধা রাস্তাটাতেই ঘন ঘন দৌড়াদৌড়ি করাকেই দেশের প্রধান কাজ বলিয়া গণ্য করেন আমি সে দলের লোক নই সে কথা পুনশ্চ বলা বাহুল্য। আজ পর্যন্ত যাঁহার দেশহিতব্রতিদের নায়কতা করিয়া আসিতেছেন তাঁহারা রাজপথের শুষ্ক বালুকায় অশ্রু ও ধর্ম সেচন করিয়া তাহাকে উর্বরা করিবার চেষ্টা করিয়া আসিয়াছেন, তাহাও জানি। ইহাও দেখিয়াছি, মৎস্যবিরল জলে যাহারা ছিপ ফেলিয়া প্রত্যহ বসিয়া থাকে অবশেষে তাহাদের, মাছ পাওয়া নয়, ঐ আশা করিয়া থাকাই একটা নেশা হইয়া যায়। ইহাকে নিঃস্বার্থ নিষ্ফলতার নেশা বলা যাইতে পারে, মানবস্বভাবে ইহারও একটা স্থান আছে। কিন্তু এজন্য নায়কদিগকে দোষ দিতে পারি না, ইহা আমাদের ভাগ্যেরই দোষ। দেশের আকাঙ্ক্ষা যদি মরীচিকার দিকে না ছুটিয়ে জলাশয়ের দিকেই ছুটিত তবে তাঁহারা নিশ্চয় তাহাকে সেই দিকে বহন করিয়া লইয়া যাইতেন, তাহার বিরুদ্ধপথে চলিতে পারিতেন না।

দেশের হিতসাধন একটা বৃহৎ মঙ্গলের ব্যাপার, নিজের প্রবৃত্তির উপস্থিত চরিত্রার্থসাধন তাঁর কাছে তুচ্ছ। ঠিক এই উপস্থিত চরিতার্থসাধনটিকে রবীন্দ্রনাথকে হতাশ করেছিল। তিনি দেখেছিলেন এর মধ্যে দেশের বৃহৎ মঙ্গল সাধনের আকাঙ্খাটা নেই। এ কারণে এই তার কাছে দেশে সম্প্রতি যে আন্দোলন-আলোচনার ঢেউ উঠেছে তার অনেকটাই কলহ মাত্র মনে হয়েছে। কলহ অক্ষমের উত্তেজনাপ্রকাশ, তাহা অকর্মণ্যের একপ্রকার আত্মনিবেদন। এইখানে এসে তিনি বয়কট আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর বিরোধীতার জায়গাটিকে পরিস্কার করে দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, আপনাদের কাছে আমি স্পষ্টই স্বীকার করিতেছি, বাঙালির মুখে 'বয়কট' শব্দের আস্ফোলনে আমি বারংবার মাথা হেঁট করিয়াছি। আমাদের পক্ষে এমন সংকোচজনক কথা আর নাই। বয়কট দুর্বলের প্রয়াস নহে, ইহা দুর্বলের কলহ। আমি নিজের মঙ্গলসাধনের উপলক্ষ্যে নিজের ভালো করিলাম না, আজ পরের মন্দ করিবার উৎসাহেই নিজের ভালো করিতে বসিয়াছি, এ কথা মুখে উচ্চারণ করিবার নহে। আমি অনেক বক্তাকে উচ্চৈঃস্বরে বলিতে শুনিয়াছি–'আমরা য়ুনিভার্সিটি বর্জন করিব।' কেন করিব। য়ুনিভার্সিটি যদি ভালো জিনিস হয়, তবে তাহার সঙ্গে গায়ে পড়িয়া আড়ি করিয়া দেশের অহিত করিবার অধিকার আমাদের কাহারো নাই।…দেশের যাহাতে ইষ্ট, তাহা যেমন করিয়াই হউক সংগ্রহ করিতে হইবে, সেজন্য সমস্ত সহ্য করা পৌরুষের লক্ষণ—তাহার পর সংগ্রহকার্য শেষ হইলে স্বাতন্ত্র্যপ্রকাশ করিবার দিন আসিতে পারে।

তিনি আরও সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, আজ আমরা দেশের কাপড় পরিতেছি কেবল পরের উপর রাগ করিয়া, এই যদি সত্য হয়, তবে দেশের কাপড়ের এতবড়ো অবমাননা আর হইতেই পারে না। আজ আমরা স্বায়ত্তভাবে দেশের শিক্ষার উন্নতিসাধনে প্রবৃত্ত হইয়াছি, রাগারাগিই যদি তাহার ভিত্তিভূমি হয়, তবে এই বিদ্যালয়ে আমরা জাতীয় অগৌরবের স্মরণস্তম্ভ রচনা করিতেছি।

১৯০৬ সালের ৪ জুন কোলকাতার পান্তির মাঠে শিবাজী-উৎসব পালিত হয়। সেখানে শিবাজী-মেলা উপলক্ষ্যে উৎসবের প্রবর্তক চরমপন্থী বালগঙ্গাধ তিলককে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। ‌উৎসবে সখারাম গণেশ দেউস্কর-প্রণীত শিবাজী পুস্তিকাটি বিতরণ করা হয়। স্বদেশি আন্দোলনকে হিন্দুরূপ দেওয়ার প্ররোচনামুলক ও অদূরদর্শী প্রচেষ্টা সূত্রপাত হয় এই উৎসব থেকেই। রবীন্দ্রনাথ এই উৎসবকে লক্ষ্মীছাড়া বিশেষণে ভূষিত করেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান হিন্দুয়ানী রূপটিও তাঁর এই আন্দোলন থেকে সরে আসার অন্যতম কারণ।  তিনি চরমপন্থী আন্দোলনেরও তীব্র বিরোধিতা করেন। ঘরে বাইরে উপন্যাসে চরমপন্থী আন্দোলন বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়।

বয়কট আন্দোলন জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এইসব চরমপন্থীরা ব্রিটিশ পণ্য না-কেনা, তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি কাণ্ডগুলো ঘটনাতে শুরু করে। তাতে সাফল্য আসে খুব অল্পই।  এ আন্দোলনের ফলে কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কোনো কোনো পণ্য রাতারাতি বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। সেটা কিনতে হয় চড়া দামে লুকিয়ে চুরিয়ে। বিশেষ করে বস্ত্র ব্যবসায়ী মুসলমান তাঁতী বা জোলা সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্থ হয় সবচেয়ে বেশি। ফলে অধিকাংশ মুসলমান এর বিরোধিতা করেছিলেন। তারা ছিলেন নিম্নবর্গের মানুষ। তাদের আয়ই ছিল এই বস্ত্রব্যবসা। তাদের পূঁজীও ছিল সামান্য। বিদেশী সুতার দাম অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় এই সুতা কিনে তারা বস্ত্র বয়ন করত। তার দামও ছিল কম। পাশাপাশি বিদেশী বস্ত্রের দামও কম থাকায় এগুলোও তারা হাটে বিক্রি করত। এই ছোট ব্যবসা থেকে তারা কোনোক্রমে বেঁচেবর্তে থাকত। কিন্তু স্বদেশী শিক্ষিত বাবুরা যখন গ্রাম্য হাঁটে-বাজারে তাদের এই বিদেশী বস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দিল, তাদের কারো কারো বস্ত্র পুড়িয়ে দিয়ে তাদের কপর্দক শূন্য করে দিল, এর বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ গর্জে উঠেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এভাবে জোর করে আদর্শ চাপানো যায় না। তিনি ঘরে-বাইরে উপন্যাসে এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।

ঘরে বাইরের  মাস্টার মশায়ের বয়ানে স্বদেশীদের বয়কটপন্থীদের উদ্দেশ্য বলেছিলেন

তোমাদের মনে (বৃটিশের উপর) রাগ হয়েছে, জেদ হয়েছে, সেই নেশায় তোমরা যা করছ খুশি হয়ে করছ। তোমাদের পয়সা আছে, তোমরা দু পয়সা বেশি দিয়ে দিশি জিনিস কিনছ, তোমাদের সেই খুশিতে ওরা তো বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু ওদের তোমরা যা করাতে চাচ্ছ সেটা কেবল জোরের উপরে। ওরা প্রতিদিনই মরণ-বাঁচনের টানাটানিতে পড়ে ওদের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়ছে কেবলমাত্র কোনোমতে টিঁকে থাকবার জন্যে— ওদের কাছে দুটো পয়সার দাম কত সে তোমরা কল্পনাও করতে পার না— ওদের সঙ্গে তোমাদের তুলনা কোথায়? জীবনের মহলে বরাবর তোমরা এক কোঠায়, ওরা আর-এক কোঠায় কাটিয়ে এসেছে ; আর আজ তোমাদের দায় ওদের কাঁধের উপর চাপাতে চাও, তোমাদের রাগের ঝাল ওদের দিয়ে মিটিয়ে নেবে? আমি তো একে কাপুরুষতা মনে করি। তোমরা নিজে যত দূর পর্যন্ত পার করো, মরণ পর্যন্ত— আমি বুড়োমানুষ, নেতা বলে তোমাদের নমস্কার করে পিছনে পিছনে চলতে রাজি আছি। কিন্তু ঐ গরিবদের স্বাধীনতা দলন করে তোমরা যখন স্বাধীনতার জয়পতাকা আস্ফালন করে বেড়াবে তখন আমি তোমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব, তাতে যদি মরতে হয় সেও স্বীকার।

… মাস্টারমশায় বললেন, শুধু তাই নয়, যারা (বয়কট) ব্রত নিয়েছে তারা বিব্রত করবারই ব্রত নিয়েছে। তোমরা চাও, যারা ব্রত নেয় নি তারাই ঐ (দেশী দামী) সুতো কিনে যারা ব্রত নেয় নি এমন লোককে দিয়ে কাপড় বোনাবে, আর যারা ব্রত নেয় নি তাদের দিয়ে এই কাপড় কেনাবে। কী উপায়ে? না তোমাদের গায়ের জোরে আর জমিদারের পেয়াদার তাড়ায়। অর্থাৎ ব্রত তোমাদের কিন্তু উপবাস করবে ওরা, আর উপবাসের পারণ করবে তোমরা।

এই বস্ত্রবয়কটের জোরজবরদস্তির কারণে  সে সময় ফরিদপুরে ছোটোখাটো দাঙ্গা পর্যন্ত হয়েছিল। দরিদ্র জোলা সম্প্রদায়ের মানুষ এই স্বদেশী বাবুদের রুখে দিয়েছিল। এই আন্দোলনের সঙ্গে নিম্নবিত্ত মানুষেরও যোগ ছিল না। তাদের মতামত কখনোই নেওয়া হয়নি। তাদের স্বার্থের দিকে রাজনৈতিক নেতারা বা এই স্বদেশীবাবুরা খুব কমই তাকিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি তাঁর পূর্ববঙ্গের জমিদারী এলাকায় তাঁতের স্কুল বসিয়েছিলেন। তাঁদেরকে কম দামে সুতো কিনে দিয়েছিলেন। জোলা প্রজাদের উৎপাদিত বস্ত্রবিক্রির চেষ্টাও করেছিলেন। তবে এই কাজে যাদের উপর তিনি নির্ভর করেছিলেন—তারা তাঁকে আর্থিকভাবে ঠকিয়েছিল। সেটা অন্য ইতিহাস।

বঙ্গভঙ্গকে উপলক্ষ্য করে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমানের ভেদরেখাটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। এই ধরনের বিরোধের নজির ইতিপূর্বে ছিল না। মুসলমানদের মনে তাদের না পাওয়ার বেদনাটি জেগে উঠেছিল। মুসলমান শাসনকালে মুসলমান সম্প্রদায় হিন্দুদের সংকীর্ণতাকে ক্ষমার চোখে দেখেছে, দেখে তারা ঠকেছে—কিন্তু ইংরেজ আমলে হিন্দুদের এই সংকীর্ণতা প্রবল হয়েছে, তখন মুসলমান সমাজ সে ক্ষমার জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা বৈষম্যকে রুখে দাঁড়াতে চেয়েছে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে।  শিক্ষিত মুসলমান আবিষ্কার করলেন, তারা রাষ্ট্র কাঠামোতে হিন্দুদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। এই পিছিয়ে থাকার কারণটি দুরীভূত করার কোনো চেষ্টাই করেনি হিন্দু জমিদার-উচ্চবিত্ত শ্রেণী। হিন্দুদের সঙ্গে থাকলে তাঁরা সে ধরনের সুযোগও পাবে না। পরিস্থিতিটা সত্যি ছিল। তবে এই পরিস্থিতিটা ইংরেজের সৃষ্টি ছিল। ইংরেজরা হিন্দুদেরই রাষ্ট্রে বেশী বেশী সুযোগ সুযোগ দিয়েছে, আর মুসলমানদের বঞ্চিত করে রেখেছে। কিন্তু যখন বঙ্গদেশে ইংরেজবিরোধী চেতনা জাগতে শুরু করেছে—তখন থেকেই চেতনার শক্তিটাকে নস্যাৎ করার জন্য ইংরেজরা মুসলমানদের মনে এই বঞ্চনার কারণটি হিন্দুদের ঘাড়ে চাপায়। এবং তাদের প্রতি বিভেদ সৃষ্টির কৌশল করে সফল হয়। এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতারা এই হিন্দু-মুসলমানদের বিভেদের কারণটি কখনো কার্যকরভাবে দূর করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। একমাত্র রবীন্দ্রনাথই শুরু থেকে এই বিভেদের দিকে সকলের উদ্দেশ্য বক্তব্য দিয়েছে। বলেছেন শিক্ষা-দীক্ষা-পেশাসহ অর্থনৈতিক দিক থেকে মুসলমানদের হিন্দুদের সমকক্ষ করার ব্যবস্থা করা ছাড়া এই বিভেদ দূর হতে পারে না।  জীবিকার মিলে, সামাজিক আচার-আচরণের মিলে, সাহিত্য-সাধনার মিলে, সর্বোপরি মনুষ্যত্বের মিলে এ ভেদবুদ্ধি দূর হতে পারে। দুই সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক সমতা মিলনের, সেই সূত্রে স্বশাসনের চাবিকাঠি। এ জন্য প্রয়োজনে হিন্দুদেরই বেশী ছাড় দিতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনীতিকরা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের উল্টোপথে। তারা মিলনের কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ফলে, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনটা হয়ে উঠেছিল—একটা যতুগৃহ বা মোমের ঘর। একটু স্ফুলিঙ্গ পেলেই ফস করে জ্বলে উঠেছিল। পুরো গৃহটি পুড়ে গিয়েছিল। ঠেকানোর কোনো সুযোগ ছিল না। পুরো বঙ্গদেশটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে ৪০-৪২ বৎসর সময়ের মধ্যে। দেখা যায় ১৯০৬ সালে রাজনৈতিক কারণে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গারও শুরু হয়। এই সময় থেকে হিন্দুরা মসজিদের সামনে জোরে জোরে ঢাক ঢোল পিটাতে শুরু করে, আর মুসলমানরাও বেশি বেশি প্রকাশে গরু কোরবানী দিতে শুরু করে। সহনশীলতাটার হ্রাস ঘটতে শুরু করে।

এই বিভেদ রেখাটি ধরে ১৯০৬ সালে ডিসেম্বর মাসে স্যার সলিমুল্লাহর আহ্বানে ঢাকায় মুসলিম লীগের জন্ম হয়। এই মুসলিম লীগ মুসলমান জমিদার, উচ্চবিত্ত মুসলমানদের উদ্যোগে গড়ে উঠলেও সকল শ্রেণীর মুসলমানের সমর্থন লাভ করে। ভাগ্যের পরিহাস যে, একই সময়ে হিন্দু মহাসভা নামে হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনও গড়ে ওঠে।

বঙ্গভঙ্গের সময়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন দানা বাঁধে। তখনকার শিক্ষিত তরুণদের এক অংশ মনে করেছে—কংগ্রেসের সাংবিধানিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আসবে না। এলেও সেটা দেরী করে আসবে। অথবা বৃটিশ যদি দয়া করে দেয়, তবেই সেই স্বাধীনতা পাওয়া যাবে।

১৯০৫ সালে বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নেতৃত্বে অনুশীলন নামে একটি গড়ে ওঠে। এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীন করা। এই আন্দোলন তখনকার শিক্ষিত হিন্দুদের মনে অসাধারণ উৎসাহ সৃষ্টি সৃষ্টি করেছিল। এ আন্দোলনের একটা সাম্প্রদায়িক রূপও প্রকট ছিল। মুসলমান সম্প্রদায় সে কারণেই এই সন্ত্রাসবাদি আন্দোলনে যোগ দেননি। বা তাকে সমর্থনও দেননি। এমন কি বন্দে মাতরম গানটিও ছিল মুসলমানদের কাছে অসহনীয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বন্দে মাতরম গানটিতে মুসলমানদের আপত্তি করার জায়গা আছে। পরে জহরলাল নেহেরুর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ গানটির সাম্প্রদায়িক অংশটি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেন। সন্ত্রাসবাদীরা এই সংশোধিত বন্দে মাতরমকে মেনে নেননি। তারা তাদের আন্দোলনের শক্তি হিসাবে কালীকে/দুর্গাকে দেখতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের মন্ত্র হয়ে উঠেছিল গীতা। এই সব কারণ এই আন্দোলনে মুসলমানদের  অংশগ্রহণের বাঁধা সৃষ্টি করেছে। তাঁদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।

রবীন্দ্রনাথ এই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সবর্নাশা রূপটি একেছেন তার ঘরে বাইরে উপন্যাসে। তারা ছিল ব্যক্তিগত লোভমোহের উর্ধ্ব উঠতে পারেনি। বিপ্লবীপনাতে এসেও বাবুপনা এদের ঘোঁচেনি। ফলে দরিদ্র মানুষ তখনো তাদের কাছে ব্রাত্যই ছিল। জনগণের কাছ থেকে ছিল বিচ্ছিন্ন।  একপর্যায়ে ডাকাতি-দস্যুতার মত উপায়ও তারা গ্রহণ করেছে। রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরের সন্দ্বীপ চরিত্রটি এই সন্ত্রাসবাদি নেতাদের মনে রেখেই নির্মাণ করেছিলেন। এরা স্বদেশকে গড়ার ব্রতটা গ্রহণ করেনি। এদের সে ধরনের পরিকল্পনাও ছিল না। ফলে শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ই নয়, এদের আন্দোলনের সঙ্গে নিম্নবর্গের হিন্দুদেরও সমর্থন ছিল না।

জাতীয় শিক্ষার আন্দোলনটি বাস্তববুদ্ধি ও আন্তরিকতার অভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল। সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরী এই ত্রিমুখী শিক্ষার সংকল্প নিয়ে পরিষদ গঠিত হয়েছিল। কিন্তু তারকানাথ পালিত, ডাঃ নীলরতন সরকার, মণীন্দ্রনাথ সরকার প্রমুখ নেতারা কারিগরী শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন পরিষদের আর্থিক সংগতি ও দেশের প্রয়োজনের দিকটির কথা মনে রেখে। অন্যরা এটা মানেননি। ১৯০৬ সালের ১ জুন জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‌একটি নয়—দুপক্ষ দুটি প্রতিষ্ঠানকে ইংরেজের আইনঅনুসারে রেজিস্ট্রশন করা হয়। তবে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ এন্ড স্কুলই সক্রিয় ছিল। রবীন্দ্রনাথকে এই প্রতিষ্ঠানের বাংলা বিভাগের ডাইরেক্টর করা হয়েছিল।  জাতীয় প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হলে হলেও কলকাতা ও মফস্বলের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এই জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তারা ইংরেজের কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঙ্গেই থেকেছে। জাতীয় শিক্ষাপরিষদের পরিকল্পনাঅনুসারে পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়নি। উত্তীর্ণ ছাত্রদেরকে উচ্চশিক্ষা ও কর্মনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিট্যুটের সঙ্গে মিলিত হয়ে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ এন্ড টেকনিক্যাল ইনস্টিট্যুট নাম ধারণ করে। এবং অধিকাংশ সম্পদ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য দান করে দেয়। ১৯০৬ সালের মার্চ মাসে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর পদে ডঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নিয়োগ পেলে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ে।

রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন—তাঁর স্বদেশ অন্যদের স্বদেশের চেয়ে আলাদা। তিনি তাঁর মতো করে তাঁর স্বদেশের কাছে ফিরে গেলেন—গেলেন পূর্ববঙ্গে, পল্লীপূনর্গঠনে।

http://porimanob.wordpress.com/2011/11/22/%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%A5%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%97%E0%A6%BF%E0%A6%B0/

No comments:

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...