'সংঘ' এর দেশপ্রেমের নমুনা:
সংঘ পরিবার আজ নিজেদেরকে দেশপ্রেমের ঝান্ডাধারী হিসেবে হিসেবে হাজির করে, ভারতমাতার নামে স্লোগান দিয়ে দেশের যুবসমাজ আর খেটে-খাওয়া মানুষের কাছে দেশের জন্য বলিদান দেওয়ার কথা প্রচার করে। আর.এস.এস এর দেশভক্তির ব্যাপারটা ঠিক কিরকম সেটা বোঝার জন্য আসুন, দেশ যখন ব্রিটিশের অধীন ছিলো, তখন বিদেশী সভ্যতা-সংস্কৃতির ভয়ঙ্কর বিরোধী আর.এস.এস ঠিক কী ভূমিকা পালন করছিলো একবার ফিরে দেখি।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ের ভূমিকা ছাড়াও সংঘের আরো কিছু পদক্ষেপ আমরা একটু ফিরে দেখবো। যখন তেরঙ্গা পতাকাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে গ্রহণ করা হল, তখন আর.এস.এস তাদের 'গেরুয়া পতাকা'কে জাতীয় পতাকা করা হোক এই দাবীতে গোঁ ধরে বসেছিলো। ওদের বক্তব্য ছিলো তিন সংখ্যাটা অশুভ আর তাই ১৯৪৭ এর ১ই আগস্ট আর.এস.এস এর লোকরা তাদের বাড়িতে গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করেছিলো। ওদের বক্তব্য ছিলো ভারতীয় সংবিধানের বদলে মনুস্মৃতির আদলে দেশের আইন বানানো হোক। কিন্তু যখন ওরা দেখলো গোটা দেশের মানুষের কাছে সংবিধান আর জাতীয় পতাকা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, তখন পাল্টি খেয়ে সংবিধান আর জাতীয় পতাকার ভয়ঙ্কর সমর্থক হয়ে গেলো।
স্বাধীনতা আন্দোলনে সংঘের ভূমিকা:
হিন্দু কট্টরবাদী সংগঠনগুলির তৈরির সময় থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল নামমাত্র। খিলাফত আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলনেকে হিন্দুত্ববাদীরা তীব্র ভাষাই নিন্দা করে এবং গান্ধী দ্বারা আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার কথা বুঝতে পেরে আন্দোলনের ব্যর্থতা মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দেয়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলি সংগঠিত হওয়ার সময় যে সংঘ পরিবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত ছিল, তারাই আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যুক্ত হয়ে সংগঠনকে দ্রুত বিস্তার করে। ৩০-এর দশকের শেষের দিকে উত্তর ভারতে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে সংঘ পরিবারের প্রচারকরা তাদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে, ৪৬-৪৭-এর দাঙ্গা শুরু হলে 'হিন্দুত্বে'র হয়ে দাঙ্গায় অংশগ্রহণ করে। স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের অংশগ্রহন গান্ধী এবং কংগ্রেসের মুসলিমদের প্রতি দুর্বলতা এবং হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের পরিপন্থী তত্ত্ব হাজির করে। সংঘ পরিবার এবং সাভারকরের ঘনিষ্ঠ নাথুরাম গডসের দ্বারা গান্ধী হত্যা এবং তারপর সংঘ পরিবারের উৎসব পালন, মিষ্টি বিতরণ তাদের এপ্রশ্নে ভাবনাচিন্তাকে প্রমান করে।
কে প্রকৃত দেশপ্রেমিক?
ইংরেজ সরকারের থেকে ক্ষমাভিক্ষা চেয়ে লেখা দ্বিতীয় চিঠিতে (১৪ই নভেম্বের,১৯৩১) 'হিন্দুত্বে'র প্রণেতা সাভারকার (কয়েদী নঃ ৩২৭৭৮) লেখেন— "... আমার (ইংরেজ সরকারের) সংবিধানের পক্ষে আসা ভারত এবং বাইরে থাকা বিপথগামী যুবদের, যারা আমাকে নিজেদের পথপ্রদর্শক হিসাবে দেখে তাদের আবার সঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে আনবে। আমি আমার পুরো শক্তি এবং সামর্থের সাথে সরকার যেমন চাইবে তার সেবা করতে প্রস্তুত। আমি যেহেতু ভেতর থেকে পালটে গেছি তাই ভবিষ্যতেও আমার ব্যবহার এরকমই থাকবে। আমায় জেলে রাখলে কোনো লাভই হবে না। ক্ষমতাবানই দয়া করতে পারেন। আর বিপথগামী পুত্র পিতৃ-মাতৃ স্বরূপ সরকার ছাড়া আর কোথায়ই বা ফিরে আসতে পারে? আশাকরি, আপনি আমার কথাগুলোতে মনোযোগ দেবেন।
এটা বলা প্রয়োজনীয় যে সাভারকার তার বাকি জীবনে ইংরেজ সরকারকে দেওয়া কথা রেখেছিলেন এবং ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন ছেড়ে মুসলিম বিরোধী কট্টর হিন্দুত্ববাদী কাজকর্ম সংগঠিত করতে থাকেন।
৭-এ অক্টোবর, ১৯৩০ সালে ইংরেজ আদালত ভগৎ সিং এর ফাঁসির নির্দেশ দেয়। ভগত সিং এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল তিনি সম্রাট পঞ্চম জর্জের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ২০-ই মার্চ, ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজের প্রাণ রক্ষা করার পরিবর্তে তিনি ইংরেজ গভর্নারকে চিঠিতে লেখেন—
"... আদালতের এই সিদ্ধান্তে দুটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে যায় প্রথমত: ইংরেজ এবং ভারতীয়দের মধ্যে একটা যুদ্ধ চলছে। দ্বিতীয়ত: আমরা নিশ্চিত ভাবে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। অতএব আমরা যুদ্ধবন্দি। ... এই লড়াইয়ে আমরা প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহণ করেছি এবং আমরা নিজেদের উপর গর্ব বোধ করি যে এই যুদ্ধ আমরা আরম্ভ করিনি এবং আমাদের মৃত্যুর সাথে এই যুদ্ধ শেষ হবে না। ... আপনারা 'জোর যার মুলুক তার' নীতি লাগু করছেন আর আপনারা এটাই করবেন। আমাদের অভিযোগের শুনানি থেকেই এটা স্পষ্ট যে— আমরা কখনো কোনো প্রার্থনা করিনি আর এখনো আমরা কোনো প্রকারের দয়াভিক্ষা করছিনা। আমরা শুধু আপনাকে এটা বলছি যে আপনারই এক আদালতের বিচারানুসারে আমরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছি। অর্থাৎ এই পরিস্থিতিতে আমরা যুদ্ধবন্দী। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আপনাদের কাছে আবেদন করছি যে— আমাদের প্রতি যুদ্ধবন্দীদের মতো আচরণ করা হোক আর ফাঁসি না দিয়ে আমাদের গুলি করে হত্যা করা হোক।"
আজ আমাদের সামনে রয়েছে একটিকে ভগৎ সিংহের ইতিহাস আর অন্যদিকে সাভারকার আর হিন্দুত্ববাদী শক্তিদের ইতিহাস। বিজেপি-সংঘ পরিবারের বাড়তে থাকা রাজনৈতিক শক্তি আমাদের সামনে পক্ষ নেবার প্রশ্নটাকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছে। এখন আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা কোন পক্ষ নেব?
No comments:
Post a Comment