সিকিমের পদধ্বনি
মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ভারতে পরিকল্পিতভাবে অভ্যর্থিত হয়ে ঢাকায় যে ধরনের উল্লাস প্রকাশ করেছেন, তা দেখে ভারতীয় চর সিকিমের কাজী লে›দ্রুপ দর্জির শেষ বয়সের আক্ষেপের কথা মনে পড়ে। সিকিমের স্বাধীনতা ও অস্তিত্ব ভারতের হাতে তুলে দেয়ার আগে ও পরে ভারত লে›দ্রুপ দর্জির সাথে যে পরস্পরবিরোধী আচরণ করেছে, তার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেছিলেন - যে নতুন দিল্লী তাকে একসময় লাল গালিচা সংবর্ধনা জানাত, সিকিমের ভারতভূক্তি করিয়ে দেয়া সত্বেও পরে ভারত তার কোন খোঁজ-খবর নেয় নি। ভারতের তৃতীয় শ্রেণীর কোন রাজনীতিকও তার সাথে দেখা করে নি। আসলে চর আর দালালদের শেষ পরিণতি এমনই, কিংবা আরো ভয়াবহ হয়। প্রভুর স্বার্থসিদ্বি হয়ে গেলে চর-দালালদের আর কোন মূল্যই যে থাকে না, তাদের স্থায়ী আসন হয় ইতিহাসের আস্তাকুড়ে, দেশদ্রোহী মিরজাফর হিসেবে তারা হয় গণধিকৃত নিন্দিত - এমন হাজার হাজার উদাহরণ রয়েছে। হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ ভারতে যে কথিত উঞ্চ অভ্যর্থনা পেয়েছেন এবং ঢাকায় এসে যে উল্লসিত মন্তব্য করেছেন, তার পরিণতি কি হবে, বাংলাদেশের ভাগ্যও বিড়ম্বিত হবে, তা এ মুহুর্তে বলা মুসকিল। কারণ সিকিম গ্রাসের আগে ভারত লে›দ্রুপ দর্জিকেও এভাবে গুরুত্ব দিয়ে তাকে হাত করেছিল।
সমসাময়িক ইতিহাস দর্জিকে একজন দেশদ্রোহী হিসেবেই চিত্রিত করেছে। এ দুর্নাম নিয়েই তিনি জীবনের পরবর্তী দিনগুলো নিন্দা ও ধিক্কারের বোঝা মাথায় নিয়ে একাকী কাটিয়েছিলেন এবং একই দুর্নামের বোঝা নিয়ে একেবারে স্বজনহীন ও সেবাহীন পরিবেশে মৃত্যু বরণ করেন।
জীবনের পড়ন্ত বেলায় (২০০৪ সালে) নেপালের একটি সাপ্তাহিকের সাথে কথা (বাণীবদ্ধকৃত) বলতে গিয়ে আত্ম-অপরাধ স্বীকার করে দর্জি বলেন, সিকিমকে ভারতভূক্ত করার জন্য আমি সবকিছুই করেছি। কিন্তু কার্যসিদ্ধির পর ভারত আমাকে ভুলে গিয়েছে, আমাকে উপেক্ষা করেছে। তিনি বলেন, আগে আমাকে লালগালিচা অভ্যর্থনা দেয়া হতো, এখন দ্বিতীয় সারির রাজনীতিকের সাথে সাক্ষাত করতে আমাকে চাইলে কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়।
কোন একসময় জওহরলাল নেহেরু ও ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতীয় নেতারা তাকে উঞ্চ অভ্যর্থনা জানাতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবার পর তিনি রাজনৈতিক ভাঁড়ে পরিণত হন এবং তাকে ডাস্টবিনে ছোঁড়ে ফেলা হয়। কেননা, দর্জির ভাষায়, তার প্রয়োজন পুরিয়ে গেছে।
১৯৭৫ সনে লে›দ্রুপ দর্জি এবং অন্যান্য ভারতীয় চরদের সহযোগিতায়, সর্বোপরি সিকিমের রাজার সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ভারত সিকিম দখল করার ২৯ বছর পর ২০০৪ সনে লে›দ্রুপ দর্জি উপরোক্ত মন্তব্য করেন। এরপরেও দর্জি আরো সাত বছর জীবিত ছিলেন এবং ২০১১ সনে পশ্চিম বাংলার কালিমপঙ্ শহরে অযতেœ-অবহেলায় মৃত্যু বরণ করেন। এক সময়ে প্রদত্ত দিল্লীর লালগালিচা সংবর্ধনার স্মৃতি তাকে কেবল ক্ষত-বিক্ষতই করেছে, দিল্লীর প্রভুদের অভ্যর্থনা তার হৃদয়ে শেল হিসেবে বিঁধেছে। মরণবেলায় তিনি আর কিছুই পাননি। মৃত্যুর বহু বছর আগেই ভারত তাকে প্রত্যাখান করে। তার চেয়েও বিশ্বত্ব এবং আরো দুর্বলদের ক্ষমতায় আনার প্রক্রিয়া ১৯৭৯ সনের নির্বাচনে সিকিম পরিষদ নির্বাচনে তার দল একটি আসনও পায় নি। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করার উদ্দেশ্যে দর্জি মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে দেখেন ভোটার তালিকা তার নামও নেই। ভারতের এ আচরণ তাবৎ দালালদের জন্যই শিক্ষণীয়
লে›দ্রুপ দর্জির স্বীকারুক্তি বিশ্লেষণ করলে যা বেরিয়ে আসে তা হলো সিকিমকে গ্রাস করার উদ্দেশ্যেই ভারত তাকে একদা দুর্লভ সম্মান দিয়েছে, আদার-অ্যাপায়ন করেছে, তাকে মাসোহারাসহ সার্বিক সুবিধা দিয়েছে, তাকে নেতা বানিয়েছে, সিকিমের প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী বানিয়েছে, ভারতের সহযোগিতা ছাড়া যা সে কোনদিনই হয়তো পেতো না। ব্যক্তি লে›দ্রুপকে এসব সুবিধা প্রদানের বিনিময় (মূল্য) হলো সিকিমের অস্তিত্বের চিরন্তর বিলোপ। আর সিকিম বিলুপ্ত হবার পর লে›দ্রুপ দর্জির প্রয়োজনীয়তাও বিলুপ্ত হয়। তাকে থুথুর মতো ছুঁড়ে ফেলা হয়। এসব কাহিনী থেকে এরশাদসহ অন্যান্য সব চিহ্নিত কিংবা অচিহ্নিত চরদের শিক্ষা নেয়া উচিত।
এরশাদ বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের কেউ নন। তিনি মূলত বাংলাদেশের একটি সাবেক মহাকুমা বর্তমানে (রংপুর) জেলার নেতা । তার ডিগবাজি, একান্ত ব্যক্তিগত আচরণ, অভ্যাস ও চরিত্র জাতীয় পর্যায়ে প্রায়ই বহুভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়, মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। এতদসত্বেও তার মতো একজন গণধিকৃত ও জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকে দিল্লীর প্রভুরা কেন উঞ্চ অভ্যধর্থনা ও লালগালিচা সংবর্ধনা জানালেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ের সব প্রভুরা তাকে কাছে ডেকে কথা বললেন, এ ধরনের অন্যসব প্রশ্নের জবাব পেতে হলে শুধুমাত্র লে›দ্রুপ দর্জির সাথে ভারতের আচরণের কারণ বিশ্লেষণই যথেষ্ঠ ।
তবে এরশাদ ভারতীয় আশীর্বাদপ্রাপ্তিকে যেমন নির্লজ্জভাবে জাহির করে উল্লাস ও উৎফুল্লবোধ করেছেন, লে›দ্রুপ দর্জি তেমনি করেছেন কি না, তা আমার জানা নেই। চর হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করে মনে হয় এরশাদ নিজেকে ধন্য মনে করেন। আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন ।
এটা কোন ধরনের গৌরবজনক আত্মতৃপ্তি? আমাকে অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করবে, আমি অন্য কারো ক্রীড়নক হয়ে কাজ করবো - এর চেয়ে লজ্জা আর কী হতে পারে ? কীভাবে আমাদের দেশের একশ্রেণীর উপরের তলার মানুষ নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে এমন নির্লজ্জ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন, তা ভাবতেও অবাক লাগে। এতে দেশের মান-মর্যাদা যে ধূলিস্মাৎ, এমনকি অস্তিত্ব যে ধূলিস্মাৎ হয়ে যায়, এ শ্রেণীর মানুষ যেন তা বুঝেও, কেবল আপন স্বার্থের কাছে দেশের স্বার্থ ও অস্তিত্বকে বিলিয়ে দেয়। স্বার্থছাড়া তো ভারত এরশাদের মতো জনবিচ্ছিন্ন একজেলার (রংপুর) নেতাকে আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানের আদলে সম্মান দেখাবে এমনটি বিশ্বাস করা যায় না। স্বার্থহীন ভালোবাসা কবির মস্তিষ্কে আছে, বাস্তবে নেই, এ বাস্তবতাও এরশাদ আমার চেয়ে বেশী ভালো বুঝেন।
সাংবাদিকদের এরশাদ জানিয়েছেন: 'এই সফর থেকে বলা যায়, আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- আমরা বড় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি এবং এখন ভারতও আমাদের মূল্যায়ন করতে শুরু করেছে।' তারা আমার সফরকে খুব গুরুত্ব দিয়েছে।" ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা শিব শঙ্কর মেনন ও পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই ছাড়ও গোয়েন্দা সংস্থা 'রা'এর কর্মকর্তাদের সাথেও আলাদা আলাদাভাবে এরশাদের শলা-পরামর্শ হয়েছে।
বাংলাদেশে কিছু হতে হলে ভারতের সমর্থন নিতে হবে - এমন মানসিকতা ও অসহায়ত্ব একজন ব্যক্তির জন্য লজ্জাজনক। আর একটি দেশের জন্য তার চেয়ে বেশী বিপদজনক। দেশের রাজনীতিকরা যা করছেন, তাতে প্রমাণিত হয়, তারা দেশের খেয়ে অন্যের জন্য কাজ করছেন। তারা প্রমাণ করছেন, তাদের ক্ষমতার মূল উৎস বাংলাদেশের জনগণ নন - ভারত। তারা এমন ভাব দেখাচ্ছেন ভারত যাকে চাইবে, তাকেই ক্ষমতায় আনতে পারে, ভারতের ইচ্ছের বাইরে বাংলাদেশে কেউ ক্ষমতায় আসতেও পারবে না, আসলেও শান্তিমত দেশ চালাতে কিংবা ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের কাছে ধর্ণা দেয়ার মূল রহস্য হলো বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজের একটা বিরাট অংশ বিভিন্ন স্বার্থের বিনিময়ে ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন। শিক্ষাজীবন থেকেই এ প্রক্রিয়া শুরু হয় অপেক্ষাকৃত অযোগ্য স্বার্থশিকারীদের প্রাথমিক পর্যায়ে মাসোহারা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে প্রমোট করার মাধ্যমে। অন্যদিকে এই ক্রয় প্রক্রিয়া প্রথম দিকে রাজনৈতিক অঙ্গনের কিছু লোক, প্রশাসনের গুটি কয়েক আমলা এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দু-চার জনকে হাত করা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এখন এ প্রক্রিয়া সমাজের সর্বস্তরে একেবারে গ্রামে-গঞ্জেও শেকড় গেড়েছে। নানাবিধ কৌশলে বিক্রি হওয়াদেরকে ক্ষমতায় বা ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে আসা হয় কিংবা দেশের এমনসব সেক্টরের এমন দায়িত্বে বসিয়ে দেয়া, যা সম্পদ লুট করার এবং ভারতের স্বার্থে কাজ করার চাবিকাঠি, যাদের ওপর যেকোন সরকারকে নির্ভর করতে হয়, যাদের সহযোগিতা ছাড়া সরকার কোন কাজই বাস্তবায়ন করতে পারে না, সাফল্য অর্জন তো দূরের কথা, এমনকি ক্ষমতায়ও থাকতে পারে না। এসব পালিত পৌষ্যরা জানে, তারা এসব পদ ও দায়িত্ব পাবার যোগ্য নয়, ভারতই তাদেরকে এসব পদে আসার সুযোগ করে দিয়েছে এবং তারা নিশ্চিত ভারতের হয়ে কাজ না করলে তাদেরকে এখান থেকে সরে যেতে হবে। তাই তারা ভারতের প্রতি অনুগত থাকে। ভারত যখন যা বলে দায়িত্বে আসার আগে বা এমন কি পরেও এরা ভারতের দেয়া দেশবিরোধী পরামর্শের বাইরে কাজ করতে পারে না। প্রশাসনে যারা থাকে তারা সরকারকে ভারতমুখী হতে যুক্তি দেখায়, শলা-পরামর্শ দেয়, চুক্তি স্বাক্ষরের সময় এমনসব শব্দ চয়ন করে, যার একাধিক অর্থ দাঁড়ায়, যা সংশ্লিষ্টদের অজান্তেই দেশের স্বার্থের বাইরে চলে যায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতার বাইরে থাকাকালীন ভারতের ইঙ্গিতে হরতাল অবরোধ ডাকে, কলকারখানা-যানবাহন ভাঙ্চুর করে কিংবা আগুন লাগায়, দেশ অচল করে দেয়। ক্ষমতায় এসে দেশের স্বার্থের চেয়ে ভারতের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, দেশের স্পর্শকাতর সুবিধাগুলো ভারতের হাতে তুলে দিতে সম্মত হয়, ভারতের নির্দেশেই দেশের সাংস্কৃতিক সীমান্ত উপড়ে ফেলে - এক কথায় ভারত যখন যেমন চায়, ঠিক তেমনটি করে। দেশের জনগণই যে দেশের মূলশক্তি তারা তা ভুলে যায়, তাদের প্রভুকেই তাদের ভাগ্য নিয়ন্তা হিসেবে মনে করে।
ভারতের সাথে শলা-পরামর্শ করেই যদি দেশ চালাতে হয়, অথবা ভারতই যদি ঠিক করে দেয় বাংলাদেশে কখন কে ক্ষমতায় আসবে, কিভাবে দেশ চালাতে হবে, কে কে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী এমপি, সচিব হবে তবে এদেশে নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন, কিংবা পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং তার অধীনে পরীক্ষা নেয়ার থাকার কি প্রয়োজন। ভারত তার পছন্দসই ব্যক্তিদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেই তো চলে। অযথা সময়, শক্তি ও অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন নেই।
আমাদের দেশের একশ্রেণীর মানুষ এ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে স্বার্থসিদ্ধির পাশাপাশি অমর হতে চান। দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দালালীতে চ্যাম্পিয়ন হওয়াও যে একধরনের গৌরবজনক অর্জন তা আমাদের দেশের উপরের তলার ব্যক্তিবর্গ প্রতিনিয়ত দেখাচ্ছেন। এর ফলে দেশপ্রেমিক, জনদরদী, সৎ, যোগ্য, মেধাবীরা পেছনে পড়ে যান। কারণ এঁরা তাদের বিবেকবোধ, আত্মসম্মান, ব্যক্তিত্ব অন্যের কাছে বিকিয়ে দেন না। তাদেরকে দিয়ে কোন আগ্রাসী শক্তি সুবিধা আদায় করতে পারে না। যারা অযোগ্য, প্রতিযোগিতায় টেকার মতো মেধা নেই, যারা লোভী ও স্বার্থান্বেষী তারাই পরজীবী হয়ে কাজ করে। কোন দেশই আমাকে কিনতে পারে না, যদি আমি নিজে থেকে বিক্রি হয়ে না যাই। যারা স্বদেশ স্বজাতির সক্রীয়তা ও স্বার্থে বিশ্বাস করেন তারা তাদেরকে কারো কাছে বিক্রি করেন না।
এক শ্রেণীর স্বার্থ-শিকারীরাই প্রমাণ করছে, বাংলাদেশ নামক দেশটির জনগণ তাদের দেশকে নিজেরা নিজেদের মতো করে চালাতে পারছেনা। তাই তাদেরকে দিল্লীর মোসাহেবী করতে হবে, দিল্লী যা বলবে তা-ই করতে হবে। এরপর এসব মোসাহেবদেরই কোন এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী একদিন সরাসরি লে›দ্রুপ দর্জির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে জাতীয় অস্তিত্ব বিলীন করার অনুকূলে যুক্তি দেখাবে, পরিবেশ তৈরী করবে, সম্ভব হলে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের ভারতভূক্তির প্রস্তাব - হাঁ জয়যুক্ত হয়েছে হাঁ জয়যুক্ত হয়েছে হাঁ জয়যুক্ত হয়েছে - ধ্বনি শোনার পর দৌড়ে দিল্লির প্রভুদের পায়ে পড়ে বলবে, ''প্রভু আপনাদের অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে আপনাদের পায়ের নিচে আশ্রয় দিন।" অথবা নিজেদের মধ্যে মারামারি বাঁধিয়ে ভারতকে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে মূলত দেশ চালানোর দায়িত্ব তাদের হাতেই তুলে দিয়ে লে›দ্রুপ দর্জির মতো ক্রীতদাসের হাসি হাসবে।
এ চক্রের প্রকাশ্যে ভারতের হয়ে কাজ করার নির্লজ্জ ভূমিকা দেখে অন্যরা - যাদের মধ্যে সামান্য দেশপ্রেম এখনো নিভু নিভু করে জ্বলছে তারাও ভারতের কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। তারাও এক সময়ে বিশ্বাস করতে শুরু করে ক্ষমতায় যেতে হলে তাদেরকেও তাবেদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকেনা ।
আগে নগন্য সংখ্যক মানুষ হয়তো অনুমান করতো আমাদের কোন কোন নেতা বা দল কোন দেশের সমর্থন পান। এ সমর্থন ছিল অনেকটা পরোক্ষ, অতীব গোপনীয়। কিন্তু ২০০৯ সনের পর বিষয়টি একেবারে প্রকাশ্যে চলে আসে। এ গোপন বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসতে ভারতই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে । ভারতই তাদেরকে আমাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয় কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ভারতের আশীর্বাদপ্রাপ্ত। ভারতের ভয় ভারতের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক স্বার্থ এবং নানাবিদ সুবিধা নিয়ে দায়িত্বে আসার পর নাকি অনেকেই ভারতের স্বার্থ-সুবিধা ও প্রেসক্রিপশন মতো কাজ করে না। এ অবস্থায় থেকে উত্তরণের জন্য ভারত এমন পন্থা অবলম্বন করে যে, যাতে তারা জনসাধারণ্যে পরিচিত হয় যে, বাংলাদেশে কারা কারা ভারতের আশীর্বাদপ্রাপ্ত। এ নীতি অনুযায়ী সর্বপ্রথম মুখ খুললেন প্রণব মুখার্জি । বিডিআর সদর দফতরে সেনা কর্মকর্তা নিধনের পরপরই তিনি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে বলে ফেললেন, শেখ হাসিনাকে বিব্রত করা হলে ভারত চুপচাপ বসে থাকবে না। তিনি বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য পাঠানোর ইচ্ছেও প্রকাশ করলেন। আরো বললেন, শেখ হাসিনাকে উদ্ধার করার জন্য ভারতীয় বিমান বাহিনী কলিকাতায়, আগরতলায়, গৌহাটিতে প্রস্তত রয়েছে। এ ঘটনার দুই-আড়াই বছর পর হঠাৎ একটা ভূয়া সেনা অভ্যুত্থানের কাহিনী প্রচার করা হলো। এবার সামনে আসলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনিও প্রণবের মতো বললেন, ভারত শেখ হাসিনার পাশে আছে। এ ধরনের মন্তব্য আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে জঘন্য হস্তক্ষেপের নগ্ন সংকেত। শেখ হাসিনা কিংবার তার দলের কেউই ভারতের এ ধরনের বক্তব্যের কোন প্রতিবাদ না করে প্রমাণ করলেন, শেখ হাসিনারা ভারতের আশীর্বাদপ্রাপ্ত, যা শেখ হাসিনা তথা বাংলাদেশের জন্য চরম অপমানজনক।
তবে এ দফা শেখ হাসিনাও প্রমাণ করেছেন ভারতের চাওয়া-পাওয়া মেটাতে তিনি কোন ধরনের কার্পণ্য করেননি। শেখ মুজিব থেকে শুরু করে খালেদা জিয়া পর্যন্ত সরকারগুলো হাজারো চাপ সত্বেও ভারতকে যেসব সুবিধা প্রদান করেন নি, শেখ হাসিনা সেগুলো অকাতরে দান করেছেন, ভারত থেকে সম-সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি ব্যতিরেকেই। এমনসব চুক্তি করেছেন সেগুলোতে কি লেখা আছে, তার কিছুই কাউকে, এমনকি জাতীয় সংসদকেও জানানো হয় নি। ঐ সব চুক্তির শর্তগুলো মনে হয় এতো মারাত্মক হতে পারে যে, ভারত সরকারই এ চিন্তায় আতঙ্কিত: শেখ হাসিনা পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতায় না আসলে বাংলাদেশ ঐসব চুক্তি বা শর্ত প্রত্যাখান করবে। তাই যেকোন মূল্যে শেখ হাসিনার বাইরে অন্য কেউ বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসুক তা ভারত কোনভাবেই ভাবতে পারে না।
কোন কোন রাজনীতিকের প্রকাশ্যে ভারতের হয়ে কাজ করার নির্লজ্জ ভূমিকা দেখে যাদের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা এখনো নিভু নিভু করে জ্বলছে তারাও ভারতের কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হন। তারাও মনে করতে শুরু করেন ক্ষমতায় যেতে হলে তাদেরও তেমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই । এ অবস্থার আশু অবসান হওয়া উচিত। এ স্রোতের বিপরীত অবস্থান নিতে হবে। আমাদেরকে সিকিমের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ভারত যদি প্রস্তর ও পার্বত্যময় একটি ক্ষুদ্র দেশকে গ্রাস করতে পারে, তবে আমাদের মতো ভোগোলিক ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্ভবনাময় দেশকে ভারত কোন এক সময়ে দখল করবে না, তা বলা যায় না। কোন কোন ভারতীয় তো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ দখল করে 'লেটা চুকিয়ে দেয়ার' জন্য ভারত সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে। তাদের অনেকের মতে বাংলাদেশ পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকলে ভারতের মানচিত্র সুন্দর হয় না, এটা ভারতের জন্য কোন না কোন সময়ে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে ভারত শক্তি প্রয়োগ করে আমাদের দেশ আক্রমণ না করে বাংলাদেশী লে›দ্রুপ দর্জিদের মাধ্যমে তেমন পরিবেশ তৈরী করাবে, সিকিম নাটক পুনঃমঞ্চস্থ করার কৌশল নেবে। আমাদেরকে দিয়েই বলাবে: আমাদেরকে আশ্রয় দাও। নেহেরু সিকিম প্রশ্নে এমনি একটি কৌশলের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সিকিম গ্রাসের ১৫ বছর আগে। ১৯৬০ সনে সিকিম গ্রাস প্রসঙ্গে ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে জওহর লাল নেহেরু বলেছিলেন: 'Taking a small country like Sikkim by force would be like shooting a fly with a rifle." (সিকিমের মতো একটা ক্ষুদ্র দেশকে শক্তি প্রয়োগ করে দখল করা হবে একটি মাছিকে বন্দুক দিয়ে গুলি করার শামিল)। নেহেরুর এ উক্তি কতো নির্মম তা প্রিয় পাঠকরাই নির্ণয় করুন।*
সমসাময়িক ইতিহাস দর্জিকে একজন দেশদ্রোহী হিসেবেই চিত্রিত করেছে। এ দুর্নাম নিয়েই তিনি জীবনের পরবর্তী দিনগুলো নিন্দা ও ধিক্কারের বোঝা মাথায় নিয়ে একাকী কাটিয়েছিলেন এবং একই দুর্নামের বোঝা নিয়ে একেবারে স্বজনহীন ও সেবাহীন পরিবেশে মৃত্যু বরণ করেন।
জীবনের পড়ন্ত বেলায় (২০০৪ সালে) নেপালের একটি সাপ্তাহিকের সাথে কথা (বাণীবদ্ধকৃত) বলতে গিয়ে আত্ম-অপরাধ স্বীকার করে দর্জি বলেন, সিকিমকে ভারতভূক্ত করার জন্য আমি সবকিছুই করেছি। কিন্তু কার্যসিদ্ধির পর ভারত আমাকে ভুলে গিয়েছে, আমাকে উপেক্ষা করেছে। তিনি বলেন, আগে আমাকে লালগালিচা অভ্যর্থনা দেয়া হতো, এখন দ্বিতীয় সারির রাজনীতিকের সাথে সাক্ষাত করতে আমাকে চাইলে কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়।
কোন একসময় জওহরলাল নেহেরু ও ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতীয় নেতারা তাকে উঞ্চ অভ্যর্থনা জানাতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবার পর তিনি রাজনৈতিক ভাঁড়ে পরিণত হন এবং তাকে ডাস্টবিনে ছোঁড়ে ফেলা হয়। কেননা, দর্জির ভাষায়, তার প্রয়োজন পুরিয়ে গেছে।
১৯৭৫ সনে লে›দ্রুপ দর্জি এবং অন্যান্য ভারতীয় চরদের সহযোগিতায়, সর্বোপরি সিকিমের রাজার সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ভারত সিকিম দখল করার ২৯ বছর পর ২০০৪ সনে লে›দ্রুপ দর্জি উপরোক্ত মন্তব্য করেন। এরপরেও দর্জি আরো সাত বছর জীবিত ছিলেন এবং ২০১১ সনে পশ্চিম বাংলার কালিমপঙ্ শহরে অযতেœ-অবহেলায় মৃত্যু বরণ করেন। এক সময়ে প্রদত্ত দিল্লীর লালগালিচা সংবর্ধনার স্মৃতি তাকে কেবল ক্ষত-বিক্ষতই করেছে, দিল্লীর প্রভুদের অভ্যর্থনা তার হৃদয়ে শেল হিসেবে বিঁধেছে। মরণবেলায় তিনি আর কিছুই পাননি। মৃত্যুর বহু বছর আগেই ভারত তাকে প্রত্যাখান করে। তার চেয়েও বিশ্বত্ব এবং আরো দুর্বলদের ক্ষমতায় আনার প্রক্রিয়া ১৯৭৯ সনের নির্বাচনে সিকিম পরিষদ নির্বাচনে তার দল একটি আসনও পায় নি। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করার উদ্দেশ্যে দর্জি মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে দেখেন ভোটার তালিকা তার নামও নেই। ভারতের এ আচরণ তাবৎ দালালদের জন্যই শিক্ষণীয়
লে›দ্রুপ দর্জির স্বীকারুক্তি বিশ্লেষণ করলে যা বেরিয়ে আসে তা হলো সিকিমকে গ্রাস করার উদ্দেশ্যেই ভারত তাকে একদা দুর্লভ সম্মান দিয়েছে, আদার-অ্যাপায়ন করেছে, তাকে মাসোহারাসহ সার্বিক সুবিধা দিয়েছে, তাকে নেতা বানিয়েছে, সিকিমের প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী বানিয়েছে, ভারতের সহযোগিতা ছাড়া যা সে কোনদিনই হয়তো পেতো না। ব্যক্তি লে›দ্রুপকে এসব সুবিধা প্রদানের বিনিময় (মূল্য) হলো সিকিমের অস্তিত্বের চিরন্তর বিলোপ। আর সিকিম বিলুপ্ত হবার পর লে›দ্রুপ দর্জির প্রয়োজনীয়তাও বিলুপ্ত হয়। তাকে থুথুর মতো ছুঁড়ে ফেলা হয়। এসব কাহিনী থেকে এরশাদসহ অন্যান্য সব চিহ্নিত কিংবা অচিহ্নিত চরদের শিক্ষা নেয়া উচিত।
এরশাদ বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের কেউ নন। তিনি মূলত বাংলাদেশের একটি সাবেক মহাকুমা বর্তমানে (রংপুর) জেলার নেতা । তার ডিগবাজি, একান্ত ব্যক্তিগত আচরণ, অভ্যাস ও চরিত্র জাতীয় পর্যায়ে প্রায়ই বহুভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়, মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। এতদসত্বেও তার মতো একজন গণধিকৃত ও জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকে দিল্লীর প্রভুরা কেন উঞ্চ অভ্যধর্থনা ও লালগালিচা সংবর্ধনা জানালেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ের সব প্রভুরা তাকে কাছে ডেকে কথা বললেন, এ ধরনের অন্যসব প্রশ্নের জবাব পেতে হলে শুধুমাত্র লে›দ্রুপ দর্জির সাথে ভারতের আচরণের কারণ বিশ্লেষণই যথেষ্ঠ ।
তবে এরশাদ ভারতীয় আশীর্বাদপ্রাপ্তিকে যেমন নির্লজ্জভাবে জাহির করে উল্লাস ও উৎফুল্লবোধ করেছেন, লে›দ্রুপ দর্জি তেমনি করেছেন কি না, তা আমার জানা নেই। চর হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করে মনে হয় এরশাদ নিজেকে ধন্য মনে করেন। আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন ।
এটা কোন ধরনের গৌরবজনক আত্মতৃপ্তি? আমাকে অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করবে, আমি অন্য কারো ক্রীড়নক হয়ে কাজ করবো - এর চেয়ে লজ্জা আর কী হতে পারে ? কীভাবে আমাদের দেশের একশ্রেণীর উপরের তলার মানুষ নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে এমন নির্লজ্জ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন, তা ভাবতেও অবাক লাগে। এতে দেশের মান-মর্যাদা যে ধূলিস্মাৎ, এমনকি অস্তিত্ব যে ধূলিস্মাৎ হয়ে যায়, এ শ্রেণীর মানুষ যেন তা বুঝেও, কেবল আপন স্বার্থের কাছে দেশের স্বার্থ ও অস্তিত্বকে বিলিয়ে দেয়। স্বার্থছাড়া তো ভারত এরশাদের মতো জনবিচ্ছিন্ন একজেলার (রংপুর) নেতাকে আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানের আদলে সম্মান দেখাবে এমনটি বিশ্বাস করা যায় না। স্বার্থহীন ভালোবাসা কবির মস্তিষ্কে আছে, বাস্তবে নেই, এ বাস্তবতাও এরশাদ আমার চেয়ে বেশী ভালো বুঝেন।
সাংবাদিকদের এরশাদ জানিয়েছেন: 'এই সফর থেকে বলা যায়, আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- আমরা বড় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি এবং এখন ভারতও আমাদের মূল্যায়ন করতে শুরু করেছে।' তারা আমার সফরকে খুব গুরুত্ব দিয়েছে।" ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা শিব শঙ্কর মেনন ও পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই ছাড়ও গোয়েন্দা সংস্থা 'রা'এর কর্মকর্তাদের সাথেও আলাদা আলাদাভাবে এরশাদের শলা-পরামর্শ হয়েছে।
বাংলাদেশে কিছু হতে হলে ভারতের সমর্থন নিতে হবে - এমন মানসিকতা ও অসহায়ত্ব একজন ব্যক্তির জন্য লজ্জাজনক। আর একটি দেশের জন্য তার চেয়ে বেশী বিপদজনক। দেশের রাজনীতিকরা যা করছেন, তাতে প্রমাণিত হয়, তারা দেশের খেয়ে অন্যের জন্য কাজ করছেন। তারা প্রমাণ করছেন, তাদের ক্ষমতার মূল উৎস বাংলাদেশের জনগণ নন - ভারত। তারা এমন ভাব দেখাচ্ছেন ভারত যাকে চাইবে, তাকেই ক্ষমতায় আনতে পারে, ভারতের ইচ্ছের বাইরে বাংলাদেশে কেউ ক্ষমতায় আসতেও পারবে না, আসলেও শান্তিমত দেশ চালাতে কিংবা ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের কাছে ধর্ণা দেয়ার মূল রহস্য হলো বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজের একটা বিরাট অংশ বিভিন্ন স্বার্থের বিনিময়ে ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন। শিক্ষাজীবন থেকেই এ প্রক্রিয়া শুরু হয় অপেক্ষাকৃত অযোগ্য স্বার্থশিকারীদের প্রাথমিক পর্যায়ে মাসোহারা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে প্রমোট করার মাধ্যমে। অন্যদিকে এই ক্রয় প্রক্রিয়া প্রথম দিকে রাজনৈতিক অঙ্গনের কিছু লোক, প্রশাসনের গুটি কয়েক আমলা এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দু-চার জনকে হাত করা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এখন এ প্রক্রিয়া সমাজের সর্বস্তরে একেবারে গ্রামে-গঞ্জেও শেকড় গেড়েছে। নানাবিধ কৌশলে বিক্রি হওয়াদেরকে ক্ষমতায় বা ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে আসা হয় কিংবা দেশের এমনসব সেক্টরের এমন দায়িত্বে বসিয়ে দেয়া, যা সম্পদ লুট করার এবং ভারতের স্বার্থে কাজ করার চাবিকাঠি, যাদের ওপর যেকোন সরকারকে নির্ভর করতে হয়, যাদের সহযোগিতা ছাড়া সরকার কোন কাজই বাস্তবায়ন করতে পারে না, সাফল্য অর্জন তো দূরের কথা, এমনকি ক্ষমতায়ও থাকতে পারে না। এসব পালিত পৌষ্যরা জানে, তারা এসব পদ ও দায়িত্ব পাবার যোগ্য নয়, ভারতই তাদেরকে এসব পদে আসার সুযোগ করে দিয়েছে এবং তারা নিশ্চিত ভারতের হয়ে কাজ না করলে তাদেরকে এখান থেকে সরে যেতে হবে। তাই তারা ভারতের প্রতি অনুগত থাকে। ভারত যখন যা বলে দায়িত্বে আসার আগে বা এমন কি পরেও এরা ভারতের দেয়া দেশবিরোধী পরামর্শের বাইরে কাজ করতে পারে না। প্রশাসনে যারা থাকে তারা সরকারকে ভারতমুখী হতে যুক্তি দেখায়, শলা-পরামর্শ দেয়, চুক্তি স্বাক্ষরের সময় এমনসব শব্দ চয়ন করে, যার একাধিক অর্থ দাঁড়ায়, যা সংশ্লিষ্টদের অজান্তেই দেশের স্বার্থের বাইরে চলে যায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতার বাইরে থাকাকালীন ভারতের ইঙ্গিতে হরতাল অবরোধ ডাকে, কলকারখানা-যানবাহন ভাঙ্চুর করে কিংবা আগুন লাগায়, দেশ অচল করে দেয়। ক্ষমতায় এসে দেশের স্বার্থের চেয়ে ভারতের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, দেশের স্পর্শকাতর সুবিধাগুলো ভারতের হাতে তুলে দিতে সম্মত হয়, ভারতের নির্দেশেই দেশের সাংস্কৃতিক সীমান্ত উপড়ে ফেলে - এক কথায় ভারত যখন যেমন চায়, ঠিক তেমনটি করে। দেশের জনগণই যে দেশের মূলশক্তি তারা তা ভুলে যায়, তাদের প্রভুকেই তাদের ভাগ্য নিয়ন্তা হিসেবে মনে করে।
ভারতের সাথে শলা-পরামর্শ করেই যদি দেশ চালাতে হয়, অথবা ভারতই যদি ঠিক করে দেয় বাংলাদেশে কখন কে ক্ষমতায় আসবে, কিভাবে দেশ চালাতে হবে, কে কে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী এমপি, সচিব হবে তবে এদেশে নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন, কিংবা পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং তার অধীনে পরীক্ষা নেয়ার থাকার কি প্রয়োজন। ভারত তার পছন্দসই ব্যক্তিদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেই তো চলে। অযথা সময়, শক্তি ও অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন নেই।
আমাদের দেশের একশ্রেণীর মানুষ এ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে স্বার্থসিদ্ধির পাশাপাশি অমর হতে চান। দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দালালীতে চ্যাম্পিয়ন হওয়াও যে একধরনের গৌরবজনক অর্জন তা আমাদের দেশের উপরের তলার ব্যক্তিবর্গ প্রতিনিয়ত দেখাচ্ছেন। এর ফলে দেশপ্রেমিক, জনদরদী, সৎ, যোগ্য, মেধাবীরা পেছনে পড়ে যান। কারণ এঁরা তাদের বিবেকবোধ, আত্মসম্মান, ব্যক্তিত্ব অন্যের কাছে বিকিয়ে দেন না। তাদেরকে দিয়ে কোন আগ্রাসী শক্তি সুবিধা আদায় করতে পারে না। যারা অযোগ্য, প্রতিযোগিতায় টেকার মতো মেধা নেই, যারা লোভী ও স্বার্থান্বেষী তারাই পরজীবী হয়ে কাজ করে। কোন দেশই আমাকে কিনতে পারে না, যদি আমি নিজে থেকে বিক্রি হয়ে না যাই। যারা স্বদেশ স্বজাতির সক্রীয়তা ও স্বার্থে বিশ্বাস করেন তারা তাদেরকে কারো কাছে বিক্রি করেন না।
এক শ্রেণীর স্বার্থ-শিকারীরাই প্রমাণ করছে, বাংলাদেশ নামক দেশটির জনগণ তাদের দেশকে নিজেরা নিজেদের মতো করে চালাতে পারছেনা। তাই তাদেরকে দিল্লীর মোসাহেবী করতে হবে, দিল্লী যা বলবে তা-ই করতে হবে। এরপর এসব মোসাহেবদেরই কোন এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী একদিন সরাসরি লে›দ্রুপ দর্জির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে জাতীয় অস্তিত্ব বিলীন করার অনুকূলে যুক্তি দেখাবে, পরিবেশ তৈরী করবে, সম্ভব হলে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের ভারতভূক্তির প্রস্তাব - হাঁ জয়যুক্ত হয়েছে হাঁ জয়যুক্ত হয়েছে হাঁ জয়যুক্ত হয়েছে - ধ্বনি শোনার পর দৌড়ে দিল্লির প্রভুদের পায়ে পড়ে বলবে, ''প্রভু আপনাদের অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে আপনাদের পায়ের নিচে আশ্রয় দিন।" অথবা নিজেদের মধ্যে মারামারি বাঁধিয়ে ভারতকে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে মূলত দেশ চালানোর দায়িত্ব তাদের হাতেই তুলে দিয়ে লে›দ্রুপ দর্জির মতো ক্রীতদাসের হাসি হাসবে।
এ চক্রের প্রকাশ্যে ভারতের হয়ে কাজ করার নির্লজ্জ ভূমিকা দেখে অন্যরা - যাদের মধ্যে সামান্য দেশপ্রেম এখনো নিভু নিভু করে জ্বলছে তারাও ভারতের কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। তারাও এক সময়ে বিশ্বাস করতে শুরু করে ক্ষমতায় যেতে হলে তাদেরকেও তাবেদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকেনা ।
আগে নগন্য সংখ্যক মানুষ হয়তো অনুমান করতো আমাদের কোন কোন নেতা বা দল কোন দেশের সমর্থন পান। এ সমর্থন ছিল অনেকটা পরোক্ষ, অতীব গোপনীয়। কিন্তু ২০০৯ সনের পর বিষয়টি একেবারে প্রকাশ্যে চলে আসে। এ গোপন বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসতে ভারতই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে । ভারতই তাদেরকে আমাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয় কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ভারতের আশীর্বাদপ্রাপ্ত। ভারতের ভয় ভারতের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক স্বার্থ এবং নানাবিদ সুবিধা নিয়ে দায়িত্বে আসার পর নাকি অনেকেই ভারতের স্বার্থ-সুবিধা ও প্রেসক্রিপশন মতো কাজ করে না। এ অবস্থায় থেকে উত্তরণের জন্য ভারত এমন পন্থা অবলম্বন করে যে, যাতে তারা জনসাধারণ্যে পরিচিত হয় যে, বাংলাদেশে কারা কারা ভারতের আশীর্বাদপ্রাপ্ত। এ নীতি অনুযায়ী সর্বপ্রথম মুখ খুললেন প্রণব মুখার্জি । বিডিআর সদর দফতরে সেনা কর্মকর্তা নিধনের পরপরই তিনি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে বলে ফেললেন, শেখ হাসিনাকে বিব্রত করা হলে ভারত চুপচাপ বসে থাকবে না। তিনি বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য পাঠানোর ইচ্ছেও প্রকাশ করলেন। আরো বললেন, শেখ হাসিনাকে উদ্ধার করার জন্য ভারতীয় বিমান বাহিনী কলিকাতায়, আগরতলায়, গৌহাটিতে প্রস্তত রয়েছে। এ ঘটনার দুই-আড়াই বছর পর হঠাৎ একটা ভূয়া সেনা অভ্যুত্থানের কাহিনী প্রচার করা হলো। এবার সামনে আসলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনিও প্রণবের মতো বললেন, ভারত শেখ হাসিনার পাশে আছে। এ ধরনের মন্তব্য আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে জঘন্য হস্তক্ষেপের নগ্ন সংকেত। শেখ হাসিনা কিংবার তার দলের কেউই ভারতের এ ধরনের বক্তব্যের কোন প্রতিবাদ না করে প্রমাণ করলেন, শেখ হাসিনারা ভারতের আশীর্বাদপ্রাপ্ত, যা শেখ হাসিনা তথা বাংলাদেশের জন্য চরম অপমানজনক।
তবে এ দফা শেখ হাসিনাও প্রমাণ করেছেন ভারতের চাওয়া-পাওয়া মেটাতে তিনি কোন ধরনের কার্পণ্য করেননি। শেখ মুজিব থেকে শুরু করে খালেদা জিয়া পর্যন্ত সরকারগুলো হাজারো চাপ সত্বেও ভারতকে যেসব সুবিধা প্রদান করেন নি, শেখ হাসিনা সেগুলো অকাতরে দান করেছেন, ভারত থেকে সম-সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি ব্যতিরেকেই। এমনসব চুক্তি করেছেন সেগুলোতে কি লেখা আছে, তার কিছুই কাউকে, এমনকি জাতীয় সংসদকেও জানানো হয় নি। ঐ সব চুক্তির শর্তগুলো মনে হয় এতো মারাত্মক হতে পারে যে, ভারত সরকারই এ চিন্তায় আতঙ্কিত: শেখ হাসিনা পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতায় না আসলে বাংলাদেশ ঐসব চুক্তি বা শর্ত প্রত্যাখান করবে। তাই যেকোন মূল্যে শেখ হাসিনার বাইরে অন্য কেউ বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসুক তা ভারত কোনভাবেই ভাবতে পারে না।
কোন কোন রাজনীতিকের প্রকাশ্যে ভারতের হয়ে কাজ করার নির্লজ্জ ভূমিকা দেখে যাদের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা এখনো নিভু নিভু করে জ্বলছে তারাও ভারতের কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হন। তারাও মনে করতে শুরু করেন ক্ষমতায় যেতে হলে তাদেরও তেমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই । এ অবস্থার আশু অবসান হওয়া উচিত। এ স্রোতের বিপরীত অবস্থান নিতে হবে। আমাদেরকে সিকিমের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ভারত যদি প্রস্তর ও পার্বত্যময় একটি ক্ষুদ্র দেশকে গ্রাস করতে পারে, তবে আমাদের মতো ভোগোলিক ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্ভবনাময় দেশকে ভারত কোন এক সময়ে দখল করবে না, তা বলা যায় না। কোন কোন ভারতীয় তো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ দখল করে 'লেটা চুকিয়ে দেয়ার' জন্য ভারত সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে। তাদের অনেকের মতে বাংলাদেশ পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকলে ভারতের মানচিত্র সুন্দর হয় না, এটা ভারতের জন্য কোন না কোন সময়ে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে ভারত শক্তি প্রয়োগ করে আমাদের দেশ আক্রমণ না করে বাংলাদেশী লে›দ্রুপ দর্জিদের মাধ্যমে তেমন পরিবেশ তৈরী করাবে, সিকিম নাটক পুনঃমঞ্চস্থ করার কৌশল নেবে। আমাদেরকে দিয়েই বলাবে: আমাদেরকে আশ্রয় দাও। নেহেরু সিকিম প্রশ্নে এমনি একটি কৌশলের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সিকিম গ্রাসের ১৫ বছর আগে। ১৯৬০ সনে সিকিম গ্রাস প্রসঙ্গে ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে জওহর লাল নেহেরু বলেছিলেন: 'Taking a small country like Sikkim by force would be like shooting a fly with a rifle." (সিকিমের মতো একটা ক্ষুদ্র দেশকে শক্তি প্রয়োগ করে দখল করা হবে একটি মাছিকে বন্দুক দিয়ে গুলি করার শামিল)। নেহেরুর এ উক্তি কতো নির্মম তা প্রিয় পাঠকরাই নির্ণয় করুন।*
Pl see my blogs;
Feel free -- and I request you -- to forward this newsletter to your lists and friends!
No comments:
Post a Comment