গর্বের সাথে বলো, আমরা বাঙালি বাঘের বাচ্চা
ছত্রিশগড়ের বাঙালী উদ্বাস্তু অধ্যুষিত পাখানজোড়ে ঐতিহাসিক বিশাল উদ্বাস্তু জনসমাবেশ
উপাস্থাপনা – শ্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস
দীর্ঘ দিন ধরে একটা প্রবাদ চলে আসছিল যে বাঙালীরা একজোট হতে পারেনা, তা আবার উদ্বাস্তু বাঙালীরা কি করে এক জোট হবে । এই প্রবাদটিকে যদিও নিখিল ভারত বাঙালী উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতি আনেকদিন আগেই খণ্ডন করেছে ভারতের রাজধানী শহর দিল্লির বুকে বিশাল জন সমূহের র্যালী করে ২০১১ সালেই । এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজ্য সমাবেশের মাধ্যমে । তবে গত একুশে সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালের দিনটি উদ্বাস্তু ইতিহাসে স্বার্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে চিরদিন । ছত্রিশগড়ের কাংকের জেলার পাখানজোড়ের শ্যমাপ্রসাদ মুখার্জী স্টাডিয়ামটি এই ইতিহাসের স্বাক্ষর বহন করবে চিরতরে । পাখানজোড় বা পারোলকোটে ১৩৩ টি গ্রামে কেন্দ্র সরকার দণ্ডকারণ্য প্রোজেক্টের মাধ্যমে পুনর্বাসন প্রদান করেছে উদ্বাস্তুদের । তা ছাড়াও সরগুজা জেলার অম্বিকাপুরে রয়েছে আরো ৩২টি গ্রাম । তার সাথে আরো বেশ কিছু জায়গায় যেমন কোণ্ডাগাঁ, বিচলি, জগদলপুর, বোরগাঁ ইত্যাদি জায়গায় রয়েছেন বাঙালী উদ্বাস্তুগণ ।
নিখিল ভারত বাঙালী উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতির আহ্বানে উক্ত দিনে উদ্বাস্তু বাঙালীদের জন সমুদ্র নেমেছিল পাখানজোড়ে । এলাকার ১৩৩টি গ্রামের প্রায় সবকটি বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেছিল সেদিন । আর দূর দুরান্ত থেকেও বহু মানুষ ছুটে এসেছিল এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে । পারুলকোট অঞ্চলের সব দোকান পাট স্কুল এমনকি সরকারী অফিসও অঘোষিত ভাবে বন্ধ হয়ে গেছিল । স্টাডিয়ামের ক্ষমতা ৫০ হাজার, আবাল বৃদ্ধ বনিতার উপস্থিতিতে সেই ক্ষমতা উপছে পড়েছিল । তারপর রাস্তা ঘাটেও তিল ধারণের জায়গা ছিল না । সম্মেলনের আয়োজকরা যদিও এতটা মানুষের স্রোত আশা করেন নাই তাও স্টাডিয়াম সংলগ্ন রাস্তায় এক কিমি পর্যন্ত মাইকের ব্যবস্থা করেছিলেন । গণ মাধ্যমের পরিসংখ্যান হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার জন সংখ্যার এই বিশাল ভীড় সেই এলাকায় এক নজীর সৃষ্টি করেছে । গণ মাধ্যম আরো বলেছে এর আগে এরকম বিশাল জনসমাগম কোন কারণেই পাখাঞ্জোড়ের বুকে হয় নাই । নিখিল ভারতের অনুমান ভীড়ের সংখ্যা সত্তর হাজারের ও বেশী কারণ স্টাডিয়ামের লোক ধারণের ক্ষমতা ৫০ হাজার উপছে পড়েও রাস্তা ঘাটে তিল ধারণের জায়গা ছিল না ।
বাঙালীরা এখানে একত্রিত হয়েছিল মুখ্যত তিনটি দাবি নিয়ে, প্রথমত বাংলা পাঠ্যক্রম অনিবার্যভাবে চালু করা, দ্বিতিয়ত নমশূদ্রদের তফশিলি জাতির মান্যতা প্রদান ও তৃতীয়টি হল পাখানজোড়কে জেলা মান্যতা প্রদান । সমন্বয় সমিতির সর্ব ভারতীয় অধক্ষ ডঃ সুবোধ বিশ্বাস বজ্র কণ্ঠে ঘোষনা করেন যে বাঙালী সন্তান নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস ভারত স্বাধীনতার অগ্রগামী দূত ছিলেন । দুঃখের বিষয় সেই বাঙালীদের আজ নিজের দেশেই নিজেদের জন্য আন্দোলনে নামতে হয়েছে, নিজেদের মৌলিক অধিকার ভাষা ও জাতির মান্যতা আদায় করার জন্য রাস্তায় নামতে হয়েছে । আজ শাষন ও প্রশাসনকে দেখিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে যে আমরাও কোন অংশে কম নই । আমাদের দাবি পূরণ না হলে পরবর্ত্তীতে লাখের সংখ্যায় রায়পুরে রাজ্য বিধান সভা ঘেরাও এবং দিল্লির বুকেও বিশাল জনসমাবেশের মাধ্যমে বিক্ষোভ পরিদর্শন করা হবে । সম্মলনের মঞ্চে নিজেদের মতামত রাখেন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অম্বিকা রায়, উপ-সভাপতি পরমানন্দ ঘারামি, উপদেষ্টা প্রাক্তন বিধায়ক নিমাই চন্দ্র সরকার, কেন্দ্র এক্সিকিউটিভ সদস্য সবিতা বিশ্বাস ও ছত্রিশগড় রাজ্য সভাপতি অসীম রায় এবং স্থানীয় কর্ম কর্ত্তা মনোজ মণ্ডল, বিকাশ পাল, পবিত্র ঘোষ, তপন রায়, পতিরাম মণ্ডল, মন্মথ মণ্ডল, দিনবন্ধু বিশ্বাস, জগবন্ধু বিশ্বাস, মিথুন মণ্ডল, সুবোধ বিশ্বাস, সুকলাল সরকার, রাজদীপ হালদার, গোপাল বিশ্বাস, জগো, কিশোর হালদার, নিমাই বিশ্বাস, পরিমল, বিথিকা বিশ্বাস, জিতেশ মুখার্জি, রবিন মণ্ডল, জতন, বুধুদেব সরকার, সুহাস রায় ।
সোমবারের এই মহা আন্দোলনে চলা কালীন পাখাঞ্জোড় থেকে সব বাস মটর চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় । দুই মাস ব্যাপী প্রস্তুতি সভা চলেছিল যার ফলে প্রশাসন আন্দাজ করতে পেরেছিল যে কতটা ভীড় হতে পারে তাই নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য রবিবার থেকেই প্রচুর সংখ্যায় পুলিস ফোর্স একত্রিত করেছিল প্রশাসন । দমকল বাহিনী ও তলব করা হয়েছিল সেখানে । পরলকোটের ব্যবসায়ীরাও এই আন্দোলনকে পূর্ণ মাত্রায় সমর্থন করে সব দোকান বাজার বন্ধ রেখেছিল । এমনকি চা পানের দোকান গুলি ও ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়াতে লোকেরা চা নাস্তাও কিনে খেতে পারে নাই । মানুষের এই জনসমূদ্র কে সামলাতে পুলিসি বল ও থত মত খাচ্ছিল কন্তু সব কিছু দারূণ শান্তি শৃঙ্খলার সাথে সম্পন্ন হয়ে যাওয়াতে স্বস্তির নিস্বাস ফেলেছিল আয়জকদের সাথে পুলিস ও প্রশাসন ।
এখানে উল্লেখ করে রাখা প্রয়োজন যে এই অঞ্চলে বেশ কিছু দিন ধরে স্থানীয় আদিবাসী ও বাঙালীদের ভেতর চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল । এমনকি আদিবাসীরা বাঙালীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে নালিশ পত্র ও দাখিল করেছিল । কিন্তু আজ আদিবাসীদের নেতৃবৃন্দ বাঙালীদের এই মহা আন্দোলনকে আন্তরিক ভাবে সমর্থন করেছে এবং বেশ কিছু আদিবাসী নেতা আন্দোলনের মঞ্চে উপস্থিত থেকে এই আন্দোলনকে তারা সমর্থন জানিয়েছে । নিখিল ভারতের সভা মঞ্চে যে সব আদিবাসী নেতা উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন স্থানীয় জনপদের অধক্ষ্য নোহর সিং উষেণ্ডি, সরপঞ্চ সংঘ আধক্ষ রূপ সিং পোটাই, জনপদ সদস্য লক্ষণ মণ্ডাবী ও লোকেশ শোডি প্রমুখ ।
আজ উদ্বাস্তু বাঙ্গালীদের মৌলিক অধিকার দাবিতে এই বিশাল জন সভার সমর্থনে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে সাথে স্থানীয় গণ মাধ্যম ফলাও করে এই সম্মেলনের প্রচার করেছে এমনকি পুরো সম্মেলনের লাইভ কভারেজও দেওয়া হয়েছে । অত্যান্ত পরিতাপের বিষয় যে পশ্চিম বঙ্গের কোন গণ মাধ্যম বাঙ্গালীদের এত বিশাল সফলতার খবর প্রচার করে নাই । আজ পাখাঞ্জোড়ে উদ্বাস্তুরা তাদের মৌলিক সমস্যা পুনর্বাসনের সমস্যা নিয়ে রাস্তায় নামেনাই । তারা ছত্রিশগড়ে বসবাসকারী সমগ্র বাঙ্গালী জাতির মৌলিক অধিকার মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকার। নমঃশুদ্রদের তফসিলি জাতির মান্যতা ইত্যাদি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল । তাই এই খবর টা বাংলা পত্র পত্রিকাতে প্রচার পাওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল কিন্তু তা হল না । বাঙ্গলা গণ-প্রচার-মাধ্যমগুলিকে অনুরোধ এই ধরণের বাঙ্গালী জাতি সম্পর্কীয় খবরগুলো প্রচার করলে সমগ্র বাঙ্গালীজাতি উপকৃত হেবে ।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল উদ্বাস্তু বাঙালীদের আর বোধহয় বেশীদিন এই উদ্বাস্তু নামটি বয়ে বেড়াতে হবে না । কারণ পাখানজোড়ের খবর প্রচার করতে গিয়ে প্রত্যেকটা খবর কাগজ উদ্বাস্তু মানুষদের আর শরণার্থী, বাংলাদেশী, রিফ্যুজী ইত্যাদি নামে অভিহিত না করে 'বঙ্গ বন্ধু' বঙ্গ সমাজ বলে নামিত করেছে । নই দুনিয়া লিখেছে – "চালিশ হাজার সে অধিক বঙ্গ বন্ধু জুটে", হরি ভূমি লিখেছে – "বঙ্গ বন্ধু অপনি মাঙ্গো কে লেকর সড়ক পর উৎরা", কাঙ্কের ভাষ্কর লিখেছে – "তিন সুত্রীয় মাঙ্গো কো লেকর ছেত্রীয় বঙ্গ সমাজকে চালিশ হাজার সে ভী লোগ জুটে"।
খবরের কাগজগুলি প্রায়ই মুখ্য পাতায় এই খবরটি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে পরিবেশন করেছে সে সব কাগজের কিছু উদ্ধৃতি এখানে দেওয়া বাঞ্ছনীয়
No comments:
Post a Comment