'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' ও দেশের মালিকানা :আনু মুহাম্মদ
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে ক্ষমতায় এলেও এই সরকারের ভূমিকায়ও এর কোনো প্রতিফলন নেই। বরং উল্টো জ্বালানি সম্পদ, বিদ্যুৎ, বন্দর, রেলওয়ে, বীজ, পানিসম্পদের ওপর বহুজাতিক পুঁজির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার যে নীতি গত দুই দশকে স্পষ্ট রূপ নিয়েছে, তারই ধারাবাহিকতা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিকতর সক্রিয়তা, আমরা এই সরকারের সময় দেখতে পাচ্ছি, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই জনপদের মানুষের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ, বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়নবিরোধী যে চেতনা ও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা বারবার পদদলিত করে দেশে এখন চোরাই কোটিপতি লুটেরা নিপীড়ক সাম্প্রদায়িক জাতিবিদ্বেষী দখলদারদের শাসন তৈরি হয়েছে।
যে কেউ বর্তমান সরকারের বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের অন্যায় নিপীড়ন বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ালে বর্তমান সরকারি দল বা কর্তাব্যক্তিদের একটা মোক্ষম ঢাল হলো এটা বলা যে এটা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। শিক্ষক, গার্মেন্টশ্রমিক, জমি ও সম্পদ রক্ষার আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা আন্দোলন, খুনের বিচার দাবি, সন্ত্রাসের প্রতিবাদ- সবাইকেই এই গালি শুনতে হয়। কিন্তু রামদা হাতে সরকারি পাণ্ডা, নিয়োগবাণিজ্যে নিয়োজিত মন্ত্রী, এমপি, গুম খুনে সক্রিয় নানা বাহিনী, সরকারি হামলা, নির্যাতন ও দখল, আর অদক্ষ বিচারপ্রক্রিয়া ইত্যাদি ঠিক করার কোনো আগ্রহ দেখা যায় না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দুই দল বা জোটের সংঘাত কখনোই জমিদারি লড়াইয়ের চরিত্র থেকে বের হতে পারেনি। যে অংশ ক্ষমতায় থাকে, তাদের ইচ্ছা হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেওয়ার। তাই একপর্যায়ে বিরোধ চরমে ওঠে। দুই দলের ব্যানার দেখে পুরো চিত্র পাওয়া যাবে না। দেখতে হবে ব্যানারের পেছনে দাঁড়ানো লুটেরা, দখলদার ও কমিশনভোগীদের। দলের ব্যানার আসলে ব্যবহৃত হয় তাদের মুখ ঢাকার জন্য। মানুষ দল দিয়ে বিচার করে, দলের ওপর ভরসা করে, দলের ওপর বিরক্ত হয়, ক্ষুব্ধ হয়, ক্ষোভে-দুঃখে চিৎকার করে। দল আসে-যায়। কিন্তু কমিশনভোগী, দখলদার, লুটেরাদের কোনো পরিবর্তন হয় না। তাদের শক্তি ও অবস্থান আরো জোরদার হয়। দুই দলের তীব্র সংঘাত চোখে পড়ে, আড়ালে দখল-লুণ্ঠন-কমিশনসহ নানা তৎপরতায় অংশীদারি ঠিকই চলে বহাল তবিয়তে। ব্যাংক, শেয়ারবাজার, মুদ্রা পাচার, মিডিয়াসহ নানা জায়গায় তার প্রমাণ আছে। একেই বলে শ্রেণিক্ষমতা। সহিংসতা বা অস্থিরতায় এক শতাংশের হাতে আরো সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে কোনো বাধা নেই। পাহাড়-নদী-বন দখলের কাজে কোনো সমস্যা নেই। দেশের সমুদ্র সম্পদ, অর্থনীতিতে দেশি-বিদেশি লুটেরাদের আধিপত্য বৃদ্ধির আয়োজনে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। ক্ষমতাবানরা যখন এভাবে নিজের অর্থনীতি তৈরি করেন, তখন রাজনীতি কেন জমিদারি থেকে আলাদা হবে? আমাদেরই বা সদা আতঙ্ক ছাড়া আর কী পাওয়ার আছে?
যদি সামনে বিএনপি-জামায়াত, বিশেষত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয় না থাকত তাহলে যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে তাদের ক্ষোভেই এই সরকার টালমাটাল হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এটাই আত্মরক্ষার প্রধান অবলম্বন। ক্ষুুব্ধ সমর্থকদের ধরে রাখায় বিএনপি-জামায়াতের ভয় ও যুদ্ধাপরাধীদের অস্তিত্ব তাদের প্রধান ভরসা। বিএনপি-জামায়াতও এ রকম ভয়ের অস্ত্রই বরাবর কাজে লাগিয়েছে। আওয়ামী আমলের ভীতি প্রচার, কৃত্রিম ভারতবিরোধিতা, ইসলাম ধর্ম বিপন্নতার প্রচারণা তাদের অনেক অপকর্ম জায়েজ করার প্রধান অবলম্বন। যারা এখন আওয়ামী লীগ বা বিএনপির পেছনে আছে, তাদের অধিকাংশ অপছন্দ নিয়েই আছে, আছে অন্য দলের ভয়ে। অতএব জমিদারি রাজনীতির দুই ধারা পরস্পর পরস্পরের ভরসা, পরস্পর পরস্পরের জন্য অপরিহার্য। ঐক্য ও ধারাবাহিকতারও তাই কোনো কমতি নেই। দেশি-বিদেশি দখলদারদের জন্য দুই দলের পালাবদল খুবই সুবিধাজনক। -
বর্তমান সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে জাতীয় সম্পদ রক্ষা, জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ ও জনগণের সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে শ্রেণি, জাতি, ধর্ম ও লিঙ্গীয় বৈষম্য ও নিপীড়নবিরোধী রাজনীতি-সংস্কৃতির বিকাশ। এর জন্য সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মবাদ ও দেশীয় লুটেরা ধনিকশ্রেণির সৃষ্ট সব মতাদর্শিক আধিপত্য ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিধিব্যবস্থার বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করাই অতএব বর্তমান সময়ের 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'।
- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2014/12/15/163053#sthash.s6JhfQcJ.79l9Am89.dpuf
- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2014/12/15/163053#sthash.s6JhfQcJ.79l9Am89.dpuf
No comments:
Post a Comment