ক্যারল কিং, দ্য টেম্পটেশন সহ সাত মোননীতদের অন্যতম ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তবে মৃত্যুর কারণে নয়। এবছর ৭ জনের মধ্যে থেকে লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্টের জন্য তাঁকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। অ্যাওয়ার্ড কমিটির পক্ষ থেকে স্টেফানি শেল সংবাদ সংস্থা এএফপিকে জানান গত সপ্তাহেই টেলিফোনে রবিশঙ্করকে জানানোও হয়েছিল সেকথা।
এরপর বিদেশের দরবারে ভারতীয় সঙ্গীতকে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রবেশ করেন চলচ্চিত্র জগতেও। সৃষ্টি হয় পথের পাঁচালির অমর আবহ সঙ্গীতের মতো বেশ কিছু সুরের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে নিউইয়র্কে আয়োজিত হয় ঐতিহাসিক কনসার্ট। বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিটলসকে সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠিত সেই কনসার্ট ফর বাংলাদেশের শুরু হয় রবিশঙ্কর ও ওস্তাদ আলি আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দী `বাংলা ধুন` দিয়ে। বাংলার লোকগীতি ও পল্লিগীতির সুর থেকে তাঁর সৃষ্ট নতুন সুরে ভেসে যায় পাশ্চাত্যের সঙ্গীত দুনিয়া। রবিশঙ্করের কাছেই মার্গ সঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করেন বিটলস্ খ্যাত জর্জ হ্যারিসন। ইউরোপ-আমেরিকার কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পরে ভারতীয় সঙ্গীত।
ঐতিহ্যধর্মী ধ্রুপদী সঙ্গীতের মাধ্যমেই নতুনভাবে দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে যান রবিশঙ্কর। ভারতরত্নের সঙ্গে অনন্য প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে রবিশঙ্করের নাম উঠে আসে গিনেসবুকে। সঙ্গীত জগতের সেরা সম্মান গ্র্যামি পান তিনবার। মনোনীত হয়েছিলেন ২০১৩ সালের গ্র্যামি পুরস্কারে জন্যও। কিন্তু তার আগেই চলে গেলেন তিনি। মঙ্গলবার সঙ্গীতের দুনিয়ার অনন্য সেই নক্ষত্রের মৃত্যু হল সান দিয়েগোর হাসপাতালে।
১৯২০-র ৭ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেন ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। প্রথম জীবনে নাম ছিল রবীন্দ্রশঙ্কর চৌধুরী। মাত্র দশ বছর বয়সে দাদা উদয়শঙ্করের ব্যালে ট্রুপে যোগ দিয়ে ইউরোপ সফর করেছিলেন তিনি। ১৯৩৮-এ নর্তকের জীবন শেষ করে যন্ত্রসঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করেন। মাইহার ঘরানায় শাস্ত্রীর সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন প্রখ্যাত সেতারশিল্পী উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে। প্রিয় ছাত্র রবিশঙ্করকে ধ্রুপদ, ধামার ও খেয়ালের তামিল দিয়েছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন।
সঙ্গীতশিক্ষা শেষে ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই সারে জাঁহাতে আচ্ছা গানটিতে নতুন করে সুরারোপ করে সাড়া ফেলে দেন তিনি। সাত বছর তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওর ডিরেক্টর ছিলেন। সত্যজির রায়ের পথের পাঁচালি, অপরাজিত ও অপুর সংসার, এই তিনটি ছবিরও সুরকার ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
প্রতিবছরের মতো এবারও জাকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হল ক্রিস্টমাস ইন ওয়াশিংটন কনসার্ট। ন্যাশানাল চিলড্রেন্স মেডিক্যাল সেন্টারের অর্থ সাহায্যের জন্য প্রতিবছর এই কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এবারের কনসার্ট ছিল ব্যতিক্রমী। কনসার্টে অংশ নেন একদা মার্কিন বিরোধী দক্ষিণ কোরিয়ার র্যাপার সাই (PSY)। যদিও সম্প্রতি মার্কিন বিরোধীতার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন তিনি। এই গণতন্ত্রের আবহে আমরা অপরিচিত।
রবিবারের এই কনসার্টে হাজির ছিলেন ফার্স্ট লেডি মিসেল ওবামা সহ প্রেসিডেন্টের দুই কন্যা সাসা আর মালিয়া। নানা কারণে যাঁরা বড়দিনের আন্দন্দে সামিল হতে পারবেন না, তাদের জন্য প্রার্থনা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
প্রায় তিন দশক বহির্বিশ্বে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন রবিশঙ্কর।
মৃত্যুকালে রবিশঙ্করের বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। সেতার-সুরের এই মহান স্রষ্টা গত এক সপ্তাহ চিকিত্সাধীন ছিলেন। শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা নিয়ে গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।
১৯২০ সালে ভারতের বেনারসে জন্মেছিলেন রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরী; যিনি 'রবিশঙ্কর' নামেই বিশ্বে সুপরিচিত। শৈশবে ভাই উদয় শঙ্করের নাচের দলে কাজ করেছেন। ১৯৩৮ সালে নাচ ছেড়ে দিয়ে সংগীতজ্ঞ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সেতার শেখা শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে সংগীতপরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে তাঁর। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অল ইন্ডিয়া রেডিওর সংগীতপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সত্যজিত্ রায়ের 'পথের পাঁচালী' (১৯৫৫), 'অপরাজিত' (১৯৫৬) এবং 'অপুর সংসার' (১৯৫৯) ছবির গীতপরিচালনা করে ব্যাপক প্রশংসিত হন রবিশঙ্কর।
১৯৫৬ সাল থেকে বেশ কটি সফরের মাধ্যমে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত জনপ্রিয় করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন এই গুণী শিল্পী। ষাটের দশকে তিনি কয়েকটি দেশে শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এসব কাজ করতে গিয়ে বিটলস ব্যান্ডের জর্জ হ্যারিসন ও প্রখ্যাত মার্কিন বেহালাবাদক মেনুহিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেন।
"রবিই প্রথমজন যিনি আমাকে মুগ্ধ করার কোনও চেষ্টাই করেননি বরং আমিই ওনাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম"।
মার্টিন স্কোর্সের তথ্যচিত্র জর্জ হ্যারিসন: `লিভিং ইন দ্য মেটিরিাল ওয়ার্ল্ডে` রবিশঙ্করের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের কথা এভাবেই জানিয়েছেন বিটলস সম্রাট জর্জ হ্যারিসন।
প্রথম সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাত শুধুমাত্র দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্বেই পরিণত হয়নি, রবিশঙ্করের মাধ্যমেই হ্যারিসন পরিচিত হন ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে। যা পরবর্তীকালে তাঁর জীবনে অনেক পরিবর্তন এনছিল। "রবির সঙ্গে জর্জের সাক্ষাত শুধু দু`জন পৃথক মানুষের সাক্ষাত ছিল না, দুটো পৃথক সংস্কৃতির সাক্ষাত ঘটেছিল সেদিন"।গতবছর স্কোর্সের তথ্যচিত্র প্রদশর্নীর সময় বলেছিলেন জর্জের স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসন। সেই তথ্যচিত্রে কিছুটা অংশ জুড়েও স্থান পেয়েছিলেন রবিশঙ্কর।
১৯৬৬ সালে লন্ডনে প্রথম দেখা হয় দুই মহীরুহর। রবিশঙ্করের সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ জর্জ ভারতে এসেছিলেন শুধুমাত্র তাঁর কাছে সেতার শিখবেন বলেই। রবিশঙ্কর শুধু তাঁকে সেতারই শেখাননি তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনকেও প্রভাবিত করেছিলেন। জর্জের সঙ্গে রবিশঙ্করের যোগাযোগ আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর জনপ্রিয়তাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল। বিশ্বের দরবারে ভারতীয় সঙ্গীতকে উচ্চাসনে বসিয়ে দেয়। ১৯৬৭ সালে মনটেরে পপ ফেস্টিভ্যালে টানা ৪ ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন রবিশঙ্কর। ১৯৬৯ সালে উডস্টক ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন করেন তিনি। ১৯৭১ সালে বাজান কনসার্ট ফর বাংলাদেশে।
জর্জ হ্যারিসেনর প্রচুর গানেই পাওয়া গেছে ভারতীয় সঙ্গীতের ছোঁয়া। বিটলসের ৩টি অ্যালবামে সেতারের ব্যবহার করেছিলেন জর্জ। `রাবার সোল`, `রিভলভার` ও `লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ড` ৩ টি অ্যালবামে পাওয়া যায় সেতারের মূর্ছনা।
পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর নেই। চলে গেছেন না ফেরার দেশে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই কিংবদন্তির মৃত্যুর খবর ভারতে এসে পৌঁছার পর পুরো সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। অনেকেই শোক প্রকাশ করেছেন, শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, স্মৃতিচারণা করেছেন। তার মধ্য থেকে কিছু দেওয়া হলো এই প্রতিবেদনে।
মনমোহন সিং, প্রধানমন্ত্রী
একটি যুগের পরিসমাপ্তি হলো পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে। আমার সঙ্গে পুরো জাতি তাঁর অনতিক্রম্য মেধার প্রতি সম্মান জানাচ্ছে, সম্মান জানাচ্ছে তাঁর শিল্প এবং বিনম্রতার প্রতি। তিনি ছিলেন আমাদের জাতীয় সম্পদ এবং বিশ্বের দরবারে ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শুভেচ্ছাদূত।
পণ্ডিত বিরজু মহারাজ
তাঁকে আমি ভাইয়া বলে ডাকতাম। ছেলেবেলা থেকে তাঁর শুভকামনা পেয়ে এসেছি। আমার কাজে সব সময় খুশি হতেন, বলতেন আরও কঠোর পরিশ্রম করতে। দেশের মানুষের সামনে যে কজন সেতারের সুর পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের একজন তিনি। সেতার বাজাতে পছন্দ করতেন। যখন বাজাতেন, তখন প্রতিটি সুরের প্রকাশ থাকত তাঁর মুখে।
এ আর রহমান
সবচেয়ে বড় শুভেচ্ছাদূতকে হারাল ভারতের উচ্চাঙ্গসংগীত। আর ভারত হারাল ভারতরত্ন। সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
সাজন মিশ্র
সেতারের রাজা পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর নেই—এটা আমাদের জন্য বড় কষ্টের। তাঁর দেখানো পথে হাঁটছি আমরা। তাঁর মতো শিল্পী ১০০ বছরে একজন জন্ম নেয়। খুব কষ্টের দিন আমাদের জন্য। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা, তাঁর আত্মা যেন শান্তি পায় এবং তাঁর ঐতিহ্য যেন আরও সামনে নিয়ে যেতে পারেন তাঁর অনুসারীরা।
রাজন মিশ্র
তিনি কেবল ভারতের শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন গোটা বিশ্বের শিল্পী। সেতার এবং পণ্ডিত রবিশঙ্কর সমার্থক।
তনুশ্রী শঙ্কর
উচ্চাঙ্গসংগীতের শিল্পীদের জন্য এটা বিরাট ক্ষতি। তরুণ প্রজন্মের জন্যও বিশাল ক্ষতি। আমি বঞ্চিত হব মহান এক শিল্পীর সুরের মূর্ছনা থেকে। সংগীতের ঈশ্বর ছিলেন তিনি।
করণ জোহর
শান্তিতে থাকুন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন কালজয়ী ও চিরন্তন অনেক কিছু।
মহেশ ভাট
জাতির সম্পদ পণ্ডিত রবিশঙ্কর আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তবে তাঁর সংগীত গোটা বিশ্বের চেতনায় অনুরণিত হবে আজীবন।
ঋতুপর্ণ ঘোষ
সকালটি ছিল অপার্থিব সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত, কারণ হয়তো সকালটি উদ্যাপন করছিল পণ্ডিত রবিশঙ্করের বিদায়ের রাগ! শান্তিতে থাকুন।
প্রিয়াঙ্কা চোপড়া
সংগীতের একটি যুগের পরিসমাপ্তি হলো। এ বছর আমরা কয়েকজন লিজেন্ডকে হারিয়েছি। তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা। শান্তিতে থাকুন পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
সূত্র: এএনআই, আইএএনএস
সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত রবিশঙ্করের মৃত্যৃতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া।
এক শোকবার্তায় তিনি বলেছেন, "তার মৃত্যু বিশ্ব সংগীত জগতে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করল।"
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগোর একটি হাসপাতালে মারা যান এই সংগীতগুরু। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত ওই শোকবার্তায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রবি শংকরের অবদানের কথা স্মরণ করে খালেদা জিয়া বলেন, "তিনি বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের সময় রবিশঙ্করের ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষ চিরদিন স্মরণ রাখবে।"
সেতারের এই জাদুকর একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বন্ধু হয়ে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা এবং জনমত সৃষ্টির জন্য নিউ ইয়র্কে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' এর আয়োজন করেন তিনি।
বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, "পণ্ডিত রবিশঙ্কর সংগীত জগতের এক অনন্য কিংবদন্তি। উপমহাদেশে যে কয়জন সংগীত গুরুর সাধনায় শাস্ত্রীয় সংগীত সারাবিশ্বে সমাদৃত হয়েছে, রবিশঙ্কর তাদেরই একজন।"
খালেদা জিয়া এই সংগীতজ্ঞের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন।
| ||||||||||||||
অনুষ্ঠানটা পিছোতে হয়েছিল তিন বার। নবতিপর সুরস্রষ্টার শরীর সায় দিচ্ছিল না। চতুর্থ দফায়, সেই তিনিই শাসন করলেন সব অসুস্থতাকে। সেতার হাতে মঞ্চে যখন বসলেন, তখন নাকে বাঁধা অক্সিজেন মাস্ক। সঙ্গে কন্যা অনুষ্কা। '৯ দশকব্যাপী এক সঙ্গীতজীবনের চূড়ান্ত উদ্যাপন' সে দিনের অনুষ্ঠান সম্পর্কে বলেছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধরা। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির পারফর্মিং আর্ট সেন্টারে গত ৪ নভেম্বরের ওই অনুষ্ঠানেই শেষ বার প্রকাশ্যে বাজিয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। ঘনিষ্ঠরা বলেন, অনুষ্ঠানের অনুরোধ ফেরাতে চাইতেন না তিনি। চাইতেন না ছুটি। তবু গত কাল ছুটি হয়েই গেল তাঁর। ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোয় ৯২ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন কিংবদন্তি সেতারবাদক। হৃদ্যন্ত্র ও শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যায় ভুগছিলেন বেশ কয়েক বছর ধরে। সম্প্রতি অসুস্থতা বেড়েছিল। লা জোলা-র স্ক্রিপস মেমোরিয়াল হাসপাতালে গত বৃহস্পতিবার তাঁর হৃদ্যন্ত্রের ভাল্ভ প্রতিস্থাপন হয়। অশক্ত শরীর সেই অস্ত্রোপচারের ধকলটাই আর সামলাতে পারল না। রবিশঙ্করের জীবনাবসান হয় হাসপাতালেই। বিবৃতি দিয়ে সেই খবর জানায় প্রয়াত শিল্পীর পরিবার। রবিশঙ্করের স্ত্রী সুকন্যা এবং মেয়ে অনুষ্কাশঙ্কর ওই বিবৃতিতে বলেছেন, "অস্ত্রোপচার হয়তো ওঁকে নতুন প্রাণশক্তি দিত। কিন্তু চিকিৎসকদের সব চেষ্টা সত্ত্বেও শরীর সেই ধকল সামলাতে পারেনি। ওঁর মৃত্যুর সময়ে আমরা পাশে ছিলাম।" অসুস্থতার সময়ে যাঁরা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, পাশে থেকেছেন সকলকে ধন্যবাদ দিয়েছেন সুকন্যা-অনুষ্কা। আর বলেছেন, "ওঁকে আমাদের জীবনে পেয়ে আমরা কৃতজ্ঞ। ওঁর সৃষ্টির ধারা বেঁচে থাকবে।" সেই ধারা বহনের ভার রবিশঙ্কর দিয়ে গেলেন দুই মেয়ে, সেতারশিল্পী অনুষ্কা এবং সঙ্গীতশিল্পী নোরাকে (ওরফে গীতালি)। রইল অনেকগুলি নাতি-নাতনি। রইলেন ছাত্রছাত্রীরা। | ||||||||||||||
সুরের এ হেন উত্তরাধিকারের সার্থক সমাপতনের এক মুহূর্তে মাত্র ক'দিন আগে উচ্ছ্বসিত শুনিয়েছিল সেতার-সাধককে। যখন তিনি জেনেছিলেন, ৫৫তম গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য বিশ্ব সঙ্গীতের বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তাঁর এবং অনুষ্কার। গর্বিত বাবা বলেছিলেন, "অদ্ভুত লাগছে। আশা করি অনুষ্কাই জিতবে।" আর মেয়ের প্রতিক্রিয়া ছিল, "বাপি মনোনয়ন পেয়েছে! আমি কিছুতেই জিতব না।" অনুষ্কার 'বাপি'র ইতিমধ্যেই তিনটি গ্র্যামি রয়েছে। দিদি নোরার গ্র্যামির সংখ্যা বাবার তিনগুণ। কিন্তু এ বার একেবারে বাবা বনাম ছোট মেয়ে! শেষ পর্যন্ত বাবার অ্যালবাম 'দ্য লিভিং রুম, সেশনস পার্ট ১' এ বারের গ্র্যামি জেতে, না মেয়ের অ্যালবাম 'ট্র্যাভেলার' সেই উত্তর জানতে এখনও অনেক দেরি। ২০১৩-র ১০ ফেব্রুয়ারি লস অ্যাঞ্জেলেসের স্টেপলস সেন্টারে গ্র্যামি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। কিন্তু সেই সন্ধের অপেক্ষা আর করলেন না রবিশঙ্কর। যদিও মৃত্যুর ঠিক আগের কয়েকটা দিনে তিনি তৈরি করে গেলেন ওই গ্র্যামি-নাটকের মতোই কিছু অভাবনীয় মুহূর্ত। যার প্রতিক্রিয়া একত্রিশ বছরের অনুষ্কার মতোই ঝাঁকিয়ে দেয় সত্তর ছোঁয়া এক মুম্বইবাসী 'যুবক'কে। এ বারের অস্ত্রোপচারের আগের দিন রবিশঙ্কর ফোন করেন অমিতাভ বচ্চনকে। তার পর উত্তেজনায় ফেটে পড়তে পড়তে অমিতাভ ব্লগে লেখেন, "অদ্ভুত ভাবে জীবনে এই প্রথম বার পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাড়ি থেকে ফোন পেলাম। উনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। আগে কয়েক বার ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাবাকে চিনতেন। আমিও ওঁর ছেলে-পুত্রবধূকে চিনতাম। কিন্তু এই প্রথম বার এমন একটা ব্যাপার!... ওঁর শরীরটা কিন্তু ভাল নেই। বৃহস্পতিবার অস্ত্রোপচার। বললেন, ওঁর এবং ওঁর স্ত্রীর আমার কাজ ভাল লাগে। উফ্! তার পর আশীর্বাদ করলেন আমাকে!" সাত সমুদ্র পেরিয়ে এ ভাবেই তাঁর চিঠি পেত তাঁর দেশ, তাঁর শহর। মার্কিন প্রবাসের অবসরে তিনিও শুনেছেন ঘরের ডাক। চলতি বছরের গোড়ায় যখন ভারতে এসেছিলেন, বাজিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুতে। যদিও ওই শহরে সেটাই যে তাঁর শেষ অনুষ্ঠান, সে কথা লেখা ছিল শিরোনামেই 'ফেয়ারওয়েল টু বেঙ্গালুরু'। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২। এ দেশের অনুরাগীদের কাছে তখন ঈষৎ অচেনা চেহারা তাঁর। বাজানোর মাঝে মাঝে দাড়িগোঁফের ফাঁকে ঝকঝক করছে হাসি। তার পর আবার সেতারে খেলা করছে প্রবীণ আঙুলগুলো। বেঙ্গালুরুর ওই কনসার্টের ঠিক তিন বছর আগে শেষ বার বাজিয়েছিলেন কলকাতায়। সে-ও ৭ ফেব্রুয়ারি, সাল ২০০৯। ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন, এ বছরের শীতে আরও এক বার আসতে চেয়েছিলেন কলকাতায়। প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন। তাঁর প্রিয় শিল্পীদের নিয়ে একটা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও চলছিল। তবে রবিশঙ্কর নিজে ওই অনুষ্ঠানে বাজানোর মতো সুস্থ থাকেন কি না, সেটা নিয়েই ছিল চিন্তা। তখন কে জানত, এ শহরের সঙ্গে আর দেখাই হবে না তাঁর! http://www.anandabazar.com/13binodan1.html
|
ওয়াশিংটনঃ বুধবার ভোর৷ শহরের আকাশজুড়ে মেঘমল্লার৷ হাজার হাজার মাইল দূরে মার্কিন মুলুকে তখন হঠাত্ স্তব্ধ সেতারের সুর৷ চলে গেলেন ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের যুগপুরুষ৷ আধুনিক বাংলা তথা ভারতবর্ষের অন্যতম বিশ্বপথিক৷ প্রবাদপ্রতিম সেতারশিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর প্রয়াত৷ আরও একবার পিতৃহারা এ-শহর, এই দেশ৷ বুধবার ভোরে আমেরিকার সান দিয়েগোর এক হাসপাতালে মৃত্যু হয় পণ্ডিত রবিশঙ্করের৷ বয়স হয়েছিল ৯২ বছর৷ দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন শ্বাসকষ্টজনিত রোগে৷গত বৃহস্পতিবার তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর অস্ত্রোপচার করা হলেও তা সফল হয়নি বলে পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে৷ তাঁর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে জানানো হয়েছে পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রয়াণে শোকাহত প্রধানমন্ত্রী৷ পণ্ডিত রবিশঙ্কর জাতীয় সম্পদ৷ তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির বিশ্বদূত৷ রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও তাঁর শোকবার্তায় গভীর শোকপ্রকাশ করে জানিয়েছেন, প্রবাদপ্রতিম পণ্ডিত রবিশঙ্করের মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত৷ তিনি ছিলেন সংস্কৃতির স্তম্ভ৷ সঙ্গীতের মাধ্যমে সব হৃদয়কে এক করেছিলেন তিনি৷ সব ভৌগোলিক গণ্ডি মুছে দেয় তাঁর সৃষ্টি৷ তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই৷ ঈশ্বরের কাছে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর শোকবার্তায় জানিয়েছেন, ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট সেতার শিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি৷ সেতারের মুর্চ্ছনায় বিষাদ৷ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর অবদান থেকে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, ঘুরেফিরে আসা টুকরো স্মৃতি৷ ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ৷ বুধবার রাজ্যসভাতেও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়৷
সেতারের মূর্ছনায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি৷ ভারতরত্ন-সহ একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর৷ তাঁর মৃত্যু সারা বিশ্বের সঙ্গীত জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি৷ তাঁর মৃত্যুতে একটি যুগের অবসান হল৷ তিনবার গ্র্যামি জয়ী এই শিল্পী, আবার ২০১৩ সালে গ্র্যামির জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।
বিশুদ্ধ মার্গসঙ্গীত থেকে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন৷ অনন্য সৃজনীর পরশপাথরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মহিমা৷ জীবনের শেষ অনুষ্ঠানটি করেছিলেন গত ৪ নভেম্বর, মুখে অক্সিজেন মাস্ক নিয়েই৷ সঙ্গে ছিলেন মেয়ে অনুষ্কাও৷ শরীর ভেঙে পড়েছিল, তবু অসুস্থতা কেড়ে নিতে পারেনি তাঁর সৃষ্টিকে৷ কিন্তু, বুধবারের ভোর, এক লহমায় নিঃস্ব করে দিয়ে গেল এ-শহরকে, এ-পৃথিবীকে৷ ঘুমভাঙা শহরের চোখ তাই কি ছিল অকাল বৃষ্টিতে সিক্ত?
http://abpananda.newsbullet.in/national/60-more/31293-2012-12-12-04-04-18
পণ্ডিত রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসন
:: পরিবর্তন ডেস্ক ::
১৯৭১ সাল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালাচ্ছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিয়েছে সীমান্তের ওপারে, ভারতে। শরণার্থী শিবিরে খাদ্যের অভাবে ধুঁকছে লাখ লাখ মানুষ, মরণাপন্ন বাবা-মায়ের জন্য ওষুধ না পেয়ে মাথা কুটছে সন্তান, বমি করতে করতে মরছে শিশুরা।
এদিকে, দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে পাকিস্তানি সেনারা। সঙ্গে আছে রাজাকার বাহিনী। এরকম এক মানবেতর অবস্থায় সহায়তার আশায় বাংলাদেশ তখন তাকিয়ে আছে সারা বিশ্বের দিকে।
১৯৭১ সালের ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হলো 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে হওয়া এই কনসার্টের মাধ্যমে পৃথিবীর বহু মানুষ প্রথম জেনেছিল বাংলাদেশের নাম। আর এই কনসার্টের মূল পরিকল্পনা ছিল উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত রবিশঙ্করের।
১৯৭১ সালে নিজেকে একজন বাঙালি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। বাঙালি হয়ে তাই বাঙালির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজেকে তিনি ভারতীয় মনে করেননি। মনে করেছেন বাঙালি। সেতার দিয়ে আমাদের পক্ষে লড়েছেন এই পণ্ডিত রবিশঙ্কর। সেতার নিয়ে তার নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা আর নতুন ফিউশন তাকে পরিচিত করে তুলে সর্বত্র। এ সময় বিশ্ব জুড়ে কাঁপন ধরানো রক গায়কের অনেকেই প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠলেন রবিশঙ্করের। জর্জ হ্যারিসন ছিলেন তাদেরই একজন। রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের বন্ধুত্ব হয়েছিল ১৯৬৬ সালে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য লড়ছে, মুক্তির সংগ্রাম করছে, রবিশঙ্করই তা জানান বন্ধু হ্যারিসনকে। সব জানার পর রবিশঙ্করের সঙ্গে একমত হন হ্যারিসন। সে সময় 'কোয়ায়েট বিটল' নামে দুনিয়া খ্যাত ছিলেন বিটলসের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসন। ষাটের দশকে দুনিয়া জুড়ে যে অস্থিরতা ও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল তরুণদের মধ্যে, তারই প্রতিনিধি ছিলেন বিটলসরা। পুরো একটি প্রজন্মকে সংগীত দিয়ে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন তাঁরা। সেই বিটলস তখন ভেঙে গেছে। জর্জ হ্যারিসন একক ক্যারিয়ার করার কথা ভাবছেন। সে সময়ই রবিশঙ্করের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে জর্জ হ্যারিসনের।
বাংলাদেশ নিয়ে কনসার্ট করার কথা প্রথম রবিশঙ্কর ভাবলেও কাজটি সম্ভব হয়েছিল জর্জ হ্যারিসনের জন্যই। তিনিই উদ্যোগী হয়ে শিল্পীদের জোগাড় করেছিলেন। আত্মাভিমান ভুলে তিনি বিটলসের সহশিল্পীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়েছিলেন ড্রামার রিঙ্গো স্টার। বিল প্রেস্টন ও লিওন রাসেলও রাজি হন। তবে জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও কনসার্টের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান ও এরিক ক্ল্যাপটন। বিশেষ করে এরিক ক্ল্যাপটনের গিটারের ঝংকার আর বব ডিলানের বিখ্যাত সেই গান 'ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড' মানুষ আজীবন মনে রাখবে। একই দিনে দুটি কনসার্ট হয়েছিল, একই নামে।
কনসার্টটি শুরু হয়েছিল রবিশঙ্কর ও আলী আকবর খানের যুগলবন্দী দিয়ে। তবলায় ছিলেন আল্লারাখা। রবিশঙ্কর 'বাংলা ধুন' নামের নতুন একটি সুর সৃষ্টি করেছিলেন। সেটি দিয়েই শুরু হয়েছিল কনসার্ট। আর শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ
হ্যারিসনের অবিস্মরণীয় সেই গান 'বাংলাদেশ'। এই গানটির মধ্য দিয়ে জর্জ হ্যারিসন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সংকটের প্রকৃত চিত্র। গানটি কিন্তু শুরু হয়েছিল বন্ধু রবিশঙ্করের কথা দিয়েই। 'মাই ফ্রেন্ড কেইম টু মি/ উইথ স্যাডনেস ইন হিজ আইজ/ টোল্ড মি দ্যাট হি ওয়ান্টেড হেল্প/ বিফোর হিজ কান্ট্রি ডাইজ'।
'আই মি মাইন' বিটলসের একটি গান, লিখেছিলেন জর্জ হ্যারিসন। এই নামে তার একটি আত্মজীবনীও আছে। সেখানে দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ নিয়ে অনেক কিছুই লিখেছেন। রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য কনসার্ট থেকে ২৫ হাজার ডলার তোলা যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ উঠেছিল। টিকিট বিক্রি থেকে আয় হয়েছিল আড়াই লাখ ডলার। এর বাইরে কনসার্টের অ্যালবাম ও কনসার্ট নিয়ে তৈরি ছবি বিক্রি করে আরও অর্থ আয় হয়। বাংলাদেশকে কখনোই ভুলে যাননি জর্জ হ্যারিসন। ১৯৮২ সালে এক মার্কিন টিভি অনুষ্ঠানে জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের শিশুদের জন্য আবারও কয়েক লাখ ডলারের একটি চেক তুলে দিয়েছিলেন।
কঠিন এক দুঃসময়ে সারা বিশ্বে 'বাংলাদেশ' নামটি তুলে ধরেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং জর্জ হ্যারিসন। রাষ্ট্র তাদের প্রাপ্ত সম্মান দিতে না পারলেও বাংলাদেশের মানুষের অন্তরে সব সময়ই থেকে যাবে রবিশঙ্কর ও হ্যারিসনের নাম।
বিজয়ের এই মাসে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বাংলাদেশের এই দুই প্রিয় বন্ধুকে।
http://poriborton.com/article_details.php?article_id=7355
থেমে গেল সেতার সম্রাটের ঝংকার
আনন্দবাজার – বুধ, ১২ ডিসেম্বর, ২০১২মাত্র তিন ঘণ্টায় সত্যজিৎ রায়ের প্রথম সিনেমা পথের পাঁচালির সুর বেঁধেছিলেন তিনি। ২০১৩ গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য মেয়ের সঙ্গে একই ক্যাটাগরিতে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। কিন্তু মেয়ের সঙ্গে লড়াইয়ের ফয়সালা হওয়ার আগেই থেমে গেল সেতার সম্রাটের সুরের মূর্চ্ছনা। ভারতীয় সময় বুধবার সকাল ছ'টায় প্রয়াত হলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। গত বৃহস্পতিবার থেকে শ্বাসকষ্ট নিয়ে মার্কিন মুলুকের সান দিয়েগোর একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। এদিন হাসপাতালেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৯২ বছরের কিংবদন্তি সেতারশিল্পীর মৃত্যুতে সঙ্গীত জগতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
বাঙালি হলেও পণ্ডিত রবিশঙ্করের পরিচয় ছিল বিশ্ববাসী হিসেবে। ভারতীয় সঙ্গীতকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। কলকাতা থেকে সানফ্রান্সিসকো সুরের মূর্চ্ছনা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখতেন এই শিল্পী। বয়স যে তাঁর কাজে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি, তার প্রমাণ ২০১৩ গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়া। এমনকী, ৪ নভেম্বর ক্যালিফোর্নিয়ায় কন্যা অনুষ্কাশঙ্করের সঙ্গে একটি মিউজিক কনসার্টও করেন তিনি।
রবিশঙ্করের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। তিনি জানিয়েছেন, পণ্ডিতজির মৃত্যুতে সঙ্গীত জগতের একটা যুগের অবসান হল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রবিশঙ্করের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে জানিয়েছেন, পণ্ডিত রবিশঙ্করের মৃত্যুতে সঙ্গীত জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। পণ্ডিতজির পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। শোকস্তব্ধ তনুশ্রীশঙ্কর জানান, খবরটা বিশ্বাস করতে পারছি না। অভিভাবকহীন হয়ে পড়লাম বলে মন্তব্য করেন রাশিদ খান। কবীর সুমন বলেন, রবিশঙ্কর মানেই সঙ্গীত। এই শূন্যতা পূরণ করবে কে?
১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে জন্ম হয়েছিল সুরের জাদুকরের। দাদা উদয়শঙ্করের ব্যালেট্রুপে যোগ দিয়ে ইউরোপ সফর করেছিলেন মাত্র ১০ বছর বয়সে। কিন্তু নৃত্য ছেড়ে সেতারের তালিম নিতে শুরু করেন ১৮ বছর বয়সে। প্রখ্যাত সেতারশিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে মাইহার ঘরানার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ইকবালের "সারে জাঁহাসে আচ্ছা" গানটিতে নতুন করে সুর দিয়ে সাড়া ফেলে দেন রবিশঙ্কর। পথের পাঁচালি ছাড়াও সত্যজিৎ রায়ের আরও দুটি সিনেমা 'অপরাজিত' এবং 'অপুর সংসার'-এর সুরকার ছিলেন তিনি।
মৌলিক সুরসৃষ্টির জন্য দেশ বিদেশে বহু সম্মান পেয়েছেন রবিশঙ্কর। ১৯৯৯ সালে ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত হন তিনি। সঙ্গীত জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার গ্র্যামি জিতেছেন তিনবার। তাঁর শেষ অ্যালবাম 'দ্য লিভিং রুম সেশনস পার্ট-ওয়ান' এর জন্য ৫৫তম গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের একই ক্যাটাগরিতে কন্যা অনুষ্কাশঙ্করের সঙ্গে মনোনীত হয়েছেন রবিশঙ্কর। ২০১৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ৫৫তম গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হবে। সুরের জাদুকর তার আগেই সুরলোকের উদ্দেশে রওনা দিলেন।
| ||||||||||||||||||||||
সেতার বাজিয়েই যুগযুগান্তের জাতপাত ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কে ধ্রুপদী সঙ্গীত বোঝে, কোন ঘরানা থেকে উঠে এসেছে বা রাগরাগিণী শব্দটা আদতে শুনেছে কিনা, তা নিয়ে রবিশঙ্কর কোনও দিনই ভাবিত ছিলেন না। সকলের জন্যই দরজা খুলে দিত তাঁর বাজনা। এক বার নিউ ইয়র্কের এক ট্যাক্সিওয়ালাকে দেখলাম, অক্লেশে প্রশ্ন করল, 'হোয়েন আর ইউ কামিং ব্যাক, রবি'? আটের দশকেও ভারতীয়দের সঙ্গে ব্রিটিশ অভিবাসন দফতরের অফিসাররা বেশ দুর্ব্যবহার করতেন। কিন্তু তখনও ব্রিটিশ ইমিগ্রেশনের এক কর্তা রবিশঙ্করকে দেখেই আপ্লুত, 'একটা অটোগ্রাফ দেবেন, স্যার?' রবিশঙ্করের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল ওখানেই। মানুষকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা। ডোভার লেনে দেড় ঘণ্টা বা কার্নেগি হলে ১৫ মিনিটের 'পিস', তার মধ্যেই নিয়ে আসতেন যথাসম্ভব বৈচিত্র্য। তাঁর চেহারা, কথাবার্তা বা বাজানো, সর্বত্র আসল কথা একটিই। কমিউনিকেশন! সব রকমের মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করত তাঁর বাজনা। এই কমিউনিকেশনটা তৈরি হল কী ভাবে? রবিশঙ্কর প্রথম থেকেই একটা বিষয়ে সচেতন ছিলেন। রাগরাগিণীর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন! স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন মানে? উত্তর ভারতে বেশির ভাগ ঘরানাই সৃষ্টি হয়েছে তানসেন থেকে। কিন্তু তখন যোগাযোগ এত সহজ ছিল না। একই গুরুর কাছ থেকে এসে কেউ কলকাতায় শেখালেন এক রকম, জয়পুরে অন্য রকম। ভারতীয় সঙ্গীতে স্বরলিপি সে ভাবে বিশদে নেই, সবই তখন গুরুর কাছে শোনা বিদ্যা। শ্রুত বিদ্যায় কেউ হয়তো কোনও রাগের চলনে দু'টো নি লাগিয়ে দিলেন, কেউ নি-র সঙ্গে সা। কোনওটাই ভুল নয়। কিন্তু পরবর্তী কয়েক পুরুষ ধরে শিষ্যরা লড়ে গেলেন, 'আমার গুরু এই ভাবে শিখিয়েছিলেন। এটাই শুদ্ধ।' | ||||||||||||||||||||||
কিন্তু পঞ্চাশের দশকে দেশ স্বাধীন। রেলগাড়ি, পোস্ট অফিস, রেডিওর দৌলতে যোগাযোগ অনেক সহজ। তখন ওই ঝগড়াটা রেখে লাভ কী? কোনও বিদেশি হয়তো গান শিখতে এলেন। একই রাগ গ্বালিয়রে এক গুরু এক ভাবে শেখালেন, আগরায় আর এক গুরু অন্য ভাবে। সে তো ভয়ে পালাবে। কোনটা ঠিক? রবিশঙ্কর শুরু থেকে রাগ রূপায়ণের এই 'স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন' তৈরির চেষ্টা করেছেন। এবং কোনও ভেদাভেদ মানেননি। একটা উদাহরণ দিই। তাঁর গুরু বাবা আলাউদ্দিন খান মেঘ রাগের অন্তরায় শুদ্ধ নিখাদ প্রয়োগ করতেন। আমির খান অবশ্য আগাগোড়া কোমল নি লাগাতেন। রবিশঙ্কর কিন্তু নিজের প্রতিভামাফিক ব্যাপারটা 'এডিট' করে নিলেন। মাইহার ঘরানার ব্যাকরণ ভেঙে শুধু কোমল নি-টাই রাখলেন। ভারতের সর্বত্র ওটিই বেশি ব্যবহৃত হত যে! স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের খাতিরে এই ধরনের 'এডিটিং' ধ্রুপদী সঙ্গীতে ছিল না। যে যার ঘরানা তোতাপাখির মতো আউড়ে যেত। রবিশঙ্করই যুক্তি, বুদ্ধি এবং শিক্ষা দিয়ে তোতাকাহিনীর বাইরে ধ্রুপদী সঙ্গীতকে বের করে আনলেন। রাগরাগিণীর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের পাশে তালকেও প্রাধান্য দিলেন রবিশঙ্কর। তিনিই প্রথম বুঝলেন, তবলার তাল মোটেই সহযোগী শিল্প নয়। কিষেণ মহারাজ, কেরামতুল্লা খান, আল্লারাখার তবলায় রয়েছে ছন্দ। ফলে, সেতার বাজাতে বসে তবলাকেও ছাড়া হল কিছুটা জায়গা। সেতারের সুরে ঢুকে এল তাল আর ছন্দ। আপনি-আমি যে ভাবে নিঃশ্বাস নিই, যে ভাবে কথা বলি, সবের মধ্যেই তো থাকে ছন্দ। রবিশঙ্করের বাজনার হাত ধরেই সঙ্গীতে সেই ছন্দ খুঁজে পেল পৃথিবী। তিনিই হয়ে উঠলেন ভারতের অন্যতম 'ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার।' বছর কয়েক আগে বিবিসিতে 'ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট' নামে অনুষ্ঠান। মহাত্মা গাঁধীর জন্য বরাদ্দ ৫ মিনিট, জওহরলাল নেহরুর জন্য ২ মিনিট। আর রবিশঙ্কর ৩৫ মিনিট! ঘরানার ব্যাকরণ ভেঙে দেওয়া, তালবাদ্যকে প্রাধান্য দেওয়া...এটা রাগরাগিণী ভাল না জানলে হয় না। বাবা আলাউদ্দিন খানের কাছে তাঁর পুত্র আলি আকবর খান থেকে বাহাদুর খান, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রায় সব শিষ্যই মার খেয়েছেন। সামান্য ভুলচুক হলেই খড়মপেটা করতেন বাবা। এক মাত্র রবিশঙ্করের গায়ে কোনও দিন হাত দেননি। সেই রকম ভুল তাঁর হতই না! আধ ঘণ্টার অনুষ্ঠানেও তাই প্রৌঢ় রবিশঙ্কর সেতারে আলাপের পর জোড় বাজাতেন। জোড়ের চারটি ভাগ। বিলম্বিত জোড়, মধ্যলয় জোড়, গমক জোড় আর লোরি জোড়। বেশির ভাগ বাজিয়ে দু' একটা জোড় বাজিয়ে ছেড়ে দেন। কিন্তু রবিশঙ্কর চারটিই বাজাতেন। ওই জোড় বাজানো শেষ হয়ে গেল! সেতারের কাঠামোও বদলে দিয়েছিলেন তিনি। রুদ্রবীণার আদলে তাঁর সেতারে খড়জ আর পঞ্চমে মোটা তার। যন্ত্রটা সুরবাহার আর সেতারের মাঝামাঝি। লখনউয়ের ইউসুফ আলি খানকে দিয়ে ওই যন্ত্র তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন বাবা আলাউদ্দিন। প্রথাগত সেতারের বাইরে এই যন্ত্রে মন্দ্রসপ্তকে আরও একটি 'অক্টেভ' বেড়ে গেল, আলাপ এবং জোড়ে চমৎকার বাজে। কিন্তু তার পর? কলকাতার নদেরচাঁদ মল্লিকের সাহায্যে দুটো হুক তৈরি করলেন রবিশঙ্কর। খড়জ, পঞ্চমে পারফেক্ট সুরে, অনায়াস সাবলীলতায় যাতায়াত করে শেষ দিকে হুক লাগিয়ে তবলার সঙ্গে গৎ বাজাতেন। এক যন্ত্রে সুরবাহার এবং সেতার দুটোর সুবিধাই নিতেন তিনি। এখন সবাই রবিশঙ্করের আদলে সেতার তৈরি করান এবং প্রথম থেকেই হুক লাগিয়ে দেন। রবিশঙ্কর এটি করতেন না। অনায়াসেই চারটি তারে ঘোরাফেরা করে সুন্দর সঙ্গীতের সৃষ্টি করতেন। | ||||||||||||||||||||||
| ||||||||||||||||||||||
এই প্রতিভাই 'বিট্ল' জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে সেতার বাজাতে পারে, ইহুদি মেনুহিনকে দিয়ে পিলু রাগ বাজাতে পারে। ফিউসন মিউজিক তো মুম্বইয়ের ছবিতে রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ মল্লিক অনেক আগেই শুরু করেছিলেন। স্যাক্সোফোনের সঙ্গে সেতার বা গিটারের সঙ্গে তবলা। কিন্তু রবিশঙ্কর নিজে মিউজিক কম্পোজ করে ইহুদি মেনুইনকে দিয়ে বাজিয়েছেন। পিলুর শুদ্ধতা এক চুলও এ দিক-ও দিক না করে 'ইম্প্রোভাইজ্ড ফিউসন' নয়, 'কম্পোজ্ড ফিউসন।' তাঁর অস্তিত্বের আলাপ আর ঝালার মাঝে মিশেছিল আরও অনেক কিছু। সুপুরুষ চেহারা ও চর্চিত বৈদগ্ধ্য। মাইহারে রবিশঙ্করের ছবি দেখবেন, সরু গোঁফ তরুণ। দাদা উদয়শঙ্করের সঙ্গে প্যারিসে গিয়ে যা কিছু শিখেছিলেন, সবই ঝেড়ে ফেলেছেন। শুধুই যেন বারাণসীর তরুণ। পরে বুঝলেন, বাজনার সঙ্গে বদলাতে হবে চেহারা, হাবভাব, কথাবার্তা। সুপুরুষ রবিশঙ্কর তখন কলারওয়ালা 'গুরু' পাঞ্জাবি পরেন। তাঁর ফ্যাশনসচেতনতা প্রথম দেখাল, ট্রাউজার্সের সঙ্গে ওই রকম পাঞ্জাবিও গায়ে দেওয়া যায়। সত্তর দশকের শেষাশেষি সামান্য ভুঁড়ি হয়েছে। বালিগঞ্জ পার্ক রোডের বাড়িতে বসে ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, 'না, এটা শিগ্গির বাতিল করতে হবে।' তেলমশলা তখনই বাদ, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল থেকে আসতে শুরু করল কন্টিনেন্টাল লাঞ্চ। পরের বার বিদেশ থেকে এলেন, ছিপছিপে চেহারা। শুধু চেহারা? প্রথাগত লেখাপড়া না শিখেও হাবভাবে নিয়ে এসেছেন বৈদদ্ধ্য। নিজে মদ পছন্দ না করলেও ভাল ওয়াইন কোথায় পাওয়া যায়, ভাল ছবি কী ভাবে কিনতে হবে, লন্ডনে ভাল থিয়েটার কী চলছে সব কিছু নিয়ে কথা বলতে পারেন। লন্ডনের লর্ড মাউন্টব্যাটেন হলে বাজাতে নয়, ৭৫ মিনিটের বক্তৃতা দিতে এসেছেন রবিশঙ্কর। সকলে অবাক হয়ে শুনছে তাঁর কথা। মাইহারের সরু গোঁফ নিজের চেষ্টায় হয়ে উঠেছেন এক জন বিশ্বনাগরিক। এই বিশ্বনাগরিকের মধ্যে লুকিয়ে আছে ছাত্রদরদি, প্রেমিক সত্তা। আবার, নিজের স্টারডম নিয়ে পূর্ণ সচেতন। ক্যালিফোর্নিয়ায় এক ভারতীয় রেস্তোরাঁয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকাররা অনেকে খেতে যেতেন। সকলে হইহই করে দরজা পেরিয়ে যেতেন, রবিশঙ্কর গ্যাঁট হয়ে গাড়িতে বসে থাকতেন। ম্যানেজার এসে দরজা না খুলে দিলে তিনি নামবেন না। এক দিকে বারাণসীর তরুণ, অন্য দিকে ক্যারিশমাটিক তারকা। পরস্পরবিরোধী এই দুটি সত্তাকে আজীবন বয়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। যিনি রেড মিটের সঙ্গে কোন রেড ওয়াইন ভাল যায়, তা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা চালাতে পারেন, তিনিই উড়ানে উঠে বিমানসেবিকাকে সটান জিজ্ঞেস করেন, 'মাংসটা কীসের? গোরু বা শুয়োর হলে দিয়ো না।' প্রতিভাবানরা এই রকমই হন। প্রতিভা! মাইহার ঘরানার সন্তান রবিশঙ্করের ঘরের নাম আসলে সেটাই। ভবিষ্যতে হয়তো অনেক বিখ্যাত সেতারবাদক আসবেন, কিন্তু প্রতিভা দিয়ে নতুন ব্যাকরণ তৈরি? রবিশঙ্করেই সেই ঘরানার শুরু ও শেষ! http://www.anandabazar.com/13binodan5.html
|
মুম্বইঃ কিংবদন্তী সেতার শিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর হঠাতই এই বছর ডিসেম্বরের ৭ তারিখের সকালে ফোন করেছিলেন অমিতাভ বচ্চনকে। তারপর ঠিক তার পাঁচ দিন বাদে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে বিশাল এক শূন্যতা তৈরি করে চিরতরে চলে গেলেন তিনি ১২ তারিখের ভোরে। আমেরিকার সান দিয়াগোর এক হাসপাতালে আমেরিকার সময় মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটের সময় তাঁর মৃত্যু হয়। তবে মৃত্যুর দিন কয়েক আগে বিগ বিকে হঠাত্ করেই ফোন করেন রবিশঙ্কর। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে রবিশঙ্করের পরিবারের দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্ব ছিল।কিন্তু খুবই অদ্ভুত ভাবে প্রথমবারের জন্য পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাড়ির থেকে ৭ তারিখ সকালে রবিশঙ্কের স্ত্রী সুকন্যা বিগ বিকে ফোন করেন, এবং রবিশঙ্করকে ফোনটা ধরিয়ে দেন কথা বলার জন্যে। তাঁর স্ত্রীর জানিয়ে ছিলেন, সেতার শিল্পী তাঁর সঙ্গে একবার কথা বলতে চেয়েছিলেন। সেই সময়ই অমিতাভকে সুকন্যাদেবী জানান, রবিশঙ্করের শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। একটি অস্ত্রোপচারের জন্য তিনি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
সিনিয়র বচ্চন তাঁর ব্লগে লিখেছেন, রবিশঙ্কেরর পরিবারের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের দীর্ঘ দিনের আত্মীয়তা থাকলেও, কিংবদন্তীর কাছ থেকে এই ফোন তাঁকে অবাক করেছে, তাঁর প্রয়াণে তাই আজ তিনি বাক্যহারা। পণ্ডিত রবিশঙ্করকে প্রতিটি মানুষই চেনেন। বেশ কিছু অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দেখাও হয়েছে। বিগ বি-র বাবার সঙ্গে পণ্ডিত রবিশঙ্করের যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক ছিল। রবিশঙ্করের বড় ভাই, নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর, উদয়শঙ্কের ছেলে আনন্দ শঙ্কর এবং তাঁর স্ত্রী তনুশ্রী শঙ্কর এবং উদয়শঙ্করের কন্যা মমতা শঙ্করের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত ছিল তাঁর। কিন্তু রবিশঙ্করের সঙ্গে ফোনে কথা, তাঁরই অনুরোধে, একেবারেই অন্য অভিজ্ঞতা, জানিয়েছেন বিগ বি। আজকে তাঁর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ বিগ বি জানিয়েছেন, এই ফোনে কথা বলার মুহূর্তটা তাঁর চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে।
http://abpananda.newsbullet.in/entertainment/54/31295
সুরসম্রাটের নারীরা
প্রায় কিশোর বয়সে গুরু আলাউদ্দিন খানের কন্যা অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় রবি শঙ্করের। দুটি সন্তানও হয় তাঁদের। সুরের প্রতি অদম্য টান দু`জনকে কাছাকাছি আনলেও বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি তাঁদের। চল্লিশের দশক থেকেই তাঁদের সম্পর্কে চিড় ধরলেও ষাটের দশকের প্রথম দিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ছাড়াছাড়ি হয় দু`জনের। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যেই নৃত্যশিল্পী কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় রবিশঙ্করের। তবে সেখানেও তিনি বাঁধা পড়েননি কোনওদিন। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে স্বামী, স্ত্রীর মতো জীবনযাপন করলেও ওই সময়েই আরও দু`জন মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন তিনি। জন্ম দিয়েছেন দুই মেয়ের। আত্মজীবনী রাগ মালায় রবিশঙ্কর লিখেছিলেন, "আমি অনুভব করতাম আমি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নারীর প্রেমে পড়তে পারি। প্রতিটি বন্দরে একজন নারী থাকার মতো.....সেটা অনেক সময় একের জায়গায় একাধিকও ছিল।"
কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন ১৯৭২ সালে তাঁর কনসার্টে তানপুরা সঙ্গত করেছিলেন সুকন্যা রাজন। সুকন্যা বিবাহিত ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৮১ সালে সুকন্যা তাঁদের একমাত্র মেয়ে অনুষ্কার জন্ম দেন। তার আগে ১৯৭৯ সালে নিউ ইয়র্কে তাঁর কনসার্টের আয়োজন সু জোনসের প্রেমে পড়েন রবিশঙ্কর। ওই বছরই জন্ম হয় তাঁদের সন্তান নোরা জোনসের।
অনুষ্কার জন্মের পরও বহুদিন পর্যন্ত সুকন্যার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে যাননি রবিশঙ্কর। যদিও অন্য দু`জন মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রবিশঙ্করের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সুকন্যা বরাবরই চেয়েছিলেন তাঁকে বিয়ে করতে। মনস্থির করতে পারেননি রবিশঙ্কর। একটি ইংরেজি দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাত্কারে সুকন্যা জানিয়েছিলেন, "রবিশঙ্কর তখন ৫৮ বছরের পৌঢ়। আমাকে বলেছিলেন উনি নিজেকে বদলাতে পারবেন না। ওঁকে এতোটাই ভালবাসতাম যে বছরে মাত্র কয়েকটা দিন উনি আমার সঙ্গে কাটালেই আমি খুশি হতাম। সেই কয়েকটা দিনের জোয়ারে আমি সারাবছর কাটিয়ে দিতে পারতাম।"
রবিশঙ্কর যখন সুকন্যাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন সু জোনস তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছিলেন। এমনকী মেয়ে নোরার সঙ্গেও রবিশঙ্করকে কোনওদিন দেখা করতে দেননি। কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দু`দশকের সম্পর্ক ভেঙে যায় তখন। ১৯৮৯ সালে অনুষ্কার ৮ বছর বয়সে সুকন্যাকে বিয়ে করেন রবিশঙ্কর। প্রেম বহু নারীর থেকে পেলেও সুকন্যাই তাঁর জীবনে স্থায়িত্ব এনে দেয়।
রবিজি কোনওদিনই সেভাবে পারিবারিক জীবন পাননি। খুব কম বয়সে বিয়ে হয় ওনার। যখন সমস্যা শুরু হয় উনি বিদেশে অনুষ্ঠানে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শুরু করেন। উনি সম্পূর্ণ বোহেমিয়ান ছিলেন। অবশ্যই ওনার জীবনে কমলা আন্টি ছিল। কিন্তু উনিও রবিজিকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। আমি ওনাকে সংসার দিতে চেয়েছিলাম যা উনি সত্যিই কোনওদিন পাননি। সাক্ষাত্কারে জানিয়েছিলেন সুকন্যা।
সুকন্যা শঙ্করের কাছ থেকেই রবিশঙ্কর ভালবাসা, খুশি, স্থিতি সবকিছুই পেয়েছিলেন। সুকন্যা শুধু তাঁর দোষত্রুটিই মেনে নেননি, তাঁর আসেপাশের মানুষগুলোকেও কাছে টেনে নিয়েছিলেন। কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে গভীর সখ্য ছিল রবিশঙ্করের। পণ্ডিতজিতে কমলা বলেছিলেন সুকন্যাকে বিয়ে করাই তাঁর জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত। তাঁর জীবনের সব নারীরাই বিভিন্ন সময়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তবুও আজীবন ভালবেসে গেছেন সকলেই। আসলে তিনি ছিলেনই স্বতন্ত্র। তাঁর সৃষ্টির মতোই।
http://zeenews.india.com/bengali/entertainment/ravi-shankar-and-his-women_9928.html
আর কে বাজাবে বাংলা ধুন
বিশ্বজনীন বাঙালি সুরস্রষ্টাদের শেষ প্রতিনিধি
বিশ্বাসই করতে পারছি না, পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর নেই৷ দাদা বলে ডাকতাম যে ওঁকে৷ সঙ্গীতের এমন একটা অধ্যায় ওঁর সঙ্গে শেষ হয়ে গেল যাকে জাদুকরী ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না৷ দাদার অবদানের মৌলিকত্ব এবং অনন্যতা এতটাই যে, কোনও কিছুর সঙ্গে তার তুলনা চলে না৷
আমার শ্রদ্ধেয় পিতা উস্তাদ হাফিজ আলি খান এবং রবিজির গুরু উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের সঙ্গীতশিক্ষা একই গুরুর কাছে৷ উস্তাদ ওয়াজির খানের কাছেই সেনিয়া বিকানির ঘরানায় হাতেখড়ি দু'জনের৷ এক সময় রবিজি আমাকে একটা চিঠিতে বলেওছিলেন, চলো আমরা দু'জনে সেনিয়া বিকানির ঘরানার সঙ্গীতকে প্রচারের আলোয় এনে সুরের জগতে তাকে একটা উঁচু জায়গা দেওয়ার চেষ্টা করি৷ আসলে রবিজির সুরসৃষ্টি এবং সেতারবাদনে একটা আলাদা আমেজ ছিল, নতুন একটা অনুভূতি ছিল৷ সেই কারণেই ওঁকে 'মিরাকল ম্যান' বলেও উল্লেখ করেছি আমি৷ বিশ্বজুড়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চেহারাটাই তো বদলে দিয়েছিলেন দাদা৷ আমার সৌভাগ্য যে, কিষেণ মহারাজ, উস্তাদ আল্লারাখা, চতুর লাল এবং কানাই দত্তর মতো প্রথিতযশা তবলাবাদকদের সঙ্গে রবিশঙ্করের বাজনা শুনেছি৷ শুধু তো বাজানো নয়, দাদার উপস্থাপনাতেও যে একটা অভিনবত্ব ছিল, সেটা সব সময় আমায় আকর্ষণ করত৷ কলকাতা, বার্মিংহাম, দিল্লি, নিউ ইয়র্কে আমার অনুষ্ঠান দেখতে এসেছেন দাদা৷ আমার কাছে সে এক অনন্য সম্মান৷ যতদিন বাঁচব, তোমায় মিস করব দাদা৷
পন্ডিতজির সঙ্গে লন্ডনে এক বেলা
দিনটা সম্ভবত ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১১৷ লন্ডনে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে আর ক'দিন পরেই কলকাতায় ফিরব৷ কত্থক-গুরু সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্রী জৈনা মোদাসিয়ার মঞ্চ-প্রবেশ অনুষ্ঠানে গাইবার কথা ছিল আমার৷ দিদির অনুরোধে সেই অনুষ্ঠানে আসবেন বলে কথা দিয়েছিলেন পণ্ডিতজি৷ ওঁর শরীর ভাল যাচ্ছিল না, তাই আসবেন কি না সেই নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না কেউ৷
গান-বাজনার ফাঁকে, সুজাতাদির কাছ থেকে এর আগেও শুনেছি পণ্ডিতজি সম্পর্কে ঘরোয়া নানা কথা... তাই ওঁকে দেখার আগ্রহটা আরও বেড়ে গিয়েছিল৷ 'এত কাছে থেকেও এক বার দেখা হবে না?' শুধউ এই কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়৷
৯ তারিখ ছিল শেষ রিহার্সাল৷ সুজাতাদির বাড়িতে গিয়ে শুনলাম, রিহার্সাল দেখবেন বলে নিজেই বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন পণ্ডিতজি৷ শুনে প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি... তার পর কোথাও যেন একটা হারিয়ে গিয়েছিলাম কয়েকটা ঘণ্টার জন্য৷ যতটুকু সময় ওঁকে সামনে থেকে দেখেছিলাম, সেটুকুই বাকি জীবনের সঞ্চয় হয়ে রইল৷
টেমস-এর তীরে একটা বাড়িতে সেই সময় থাকছিলেন পণ্ডিতজি৷ সুজাতাদি, তবলা অনিরুদধে মুখোপাধ্যায়, সেতারে চন্দ্রচূড় ভট্টাচার্য এবং জৈনা মোদাসিয়া-সহ আমরা সবাই পৌঁছে গিয়েছিলাম ওঁর বাড়িতে৷ মিনিট কতক পরেই নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পণ্ডিতজি বললেন, 'তোমাদের অনেক ক্ষণ বসিয়ে রেখেছি, চলো এ বার গান-বাজনা শুরু করা যাক৷' শিখলাম, এই বয়সেও মানুষটি কতটা ঘড়ি-ধরে চলেন৷
পণ্ডিতজি সবাইকে যাতে শুনতে পান, তাই আমরা ওঁর কাছ ঘেঁষে বসলাম৷ শুরু হল, গান আর তার সঙ্গে জৈনার দুরন্ত নাচ৷ জৈনা বয়সে ছোট, তাই নিজের সবটুকু উজাড় করে দিল৷ কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলল আমাদের গান-বাজনা৷ পণ্ডিতজি প্রচণ্ড উল্লসিত হয়ে হাতে তাল রেখে গেলেন বরাবর- প্রায় মিনিট ৫০ ধরে৷ পণ্ডিতজি এতটা খুশি হতে দেখে, যারপর নাই খুশি আমরাও৷ বুঝলাম, যাকে একটি বার দেখার জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করা যায়, যাঁর পা এক বার ছুঁলে জীবন সার্থক মনে করেন শিল্পীকুল... সেই মানুষটা মনেপ্রাণে আসলে কতটা সাধারণ, কতটা অমায়িক!
অনুষ্ঠান শেষে ওঁর পাশে বসে যখন একটু আশীর্বাদের জন্য ঘুরঘুর করছি আমরা, তখন প্রত্যেককে আলাদা করে ডেকে কথা বলায় ব্যস্ত উনি৷ জিজ্ঞেস করলেন, লন্ডনে আমার পড়াশুনা আর অভিজ্ঞতার কথা৷ এ ছাড়াকার কাছে তালিম, কত দিন শিখেছ, দেশের রাজনীতির হাল-হকিকত বা শেষ ম্যাচে ভারতের ফলাফল- সব কিছু বিষয়ে ওঁর আগ্রহ দেখে অবাক হলাম৷ বুঝলাম তবেই না তিনি রবিশঙ্করজি, তবেই না তিনি সম্পূর্ণ৷
হাতের কাছে ক্যামেরা তৈরি-ই ছিল৷ খালি মনে হচ্ছিল যদি এই মুহূর্তটা আর ফিরে না আসে, যদি ক্যামেরা-বন্দি করে রাখতে পারি! অনেক ভয়ে ভয়ে বললাম, 'আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে পারি?' উনি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বললেন, 'ইয়েস, অফ কোর্স!' বললেন, 'ছবি যদি তুলতেই হয়, ভালো করে তোল... কাছে এসো' বলে নিজেই এগিয়ে এলেন৷ এই সারল্য সত্যি অপ্রত্যাশিত, আর তাই বোধ হয় তিনি সকলের পণ্ডিতজি!
বেরনোর আগে ওঁর শেষ কতগুলো কথা আজও কানে বাজে৷ বললেন, 'তোমাদের আরও ভালো করে শুনতে চাই, আজ পুরোটা হল না৷ তবে কী জান, গান-বাজনা ভেতরের জিনিস৷ ওটা তোমাদের আছে৷ এ বার শুধু করে যাও, সঙ্গে একটা সুন্দর জীবনযাত্রা৷ ব্যস, তাহলেই হবে! পরের বার নিশ্চয়ই আমেরিকায় দেখা হবে৷'
তার পর দেখা হয়েছিল৷ আমেরিকায় নয়, দিল্লিতেই৷ রিম্পার বার্ষিক অনুষ্ঠানে, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে... সেটাই শেষ দেখা৷
রবি আঙ্কলের মতো করেই গড়ে তুলেছিলাম নিজেকে
রবি আঙ্কল৷ এই নামেই ডাকতাম পণ্ডিতজিকে৷ আমাদের আলাপ কবে থেকে বলুন তো? আমার যখন চার বছর বয়স৷ আমার জন্মদিনে মাহিমে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন আঙ্কল৷ ওখানেই সেতার সম্রাটের প্রথম অনুষ্ঠান শুনি আমি৷
অবাক লাগে, অত ছোট বয়েসেও রবি আঙ্কলের সুর আমার মনে গভীর ভাবে ছেয়ে গিয়েছিল৷ তখন থেকেই উনি আমার আইডল৷ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নিজেকে সব সময়ই গড়ে তুলতে চেয়েছি ওঁর মতো করে৷ সেটা ভাবনা হোক বা উপস্থাপনা৷ আমার যখন চোদ্দো বছর বয়স, সেই সময় প্রথম রবিশঙ্করের সঙ্গে তবলা বাজানোর সুযোগ আসে৷ মুম্বইয়ের সম্মুখানন্দে ওই দিনটার কথা কখনও ভুলতে পারব না৷ তার পর অন্তত কয়েকশো অনুষ্ঠান করেছি আঙ্কলের সঙ্গে৷ এবং অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, ওই প্রতিটা অনুষ্ঠান থেকে নিজের সঙ্গীতজীবনে যে শিক্ষা পেয়েছি তার কোনও তুলনা হয় না৷
বিশ্বসঙ্গীতের শ্রেষ্ঠতম আইকন ছিলেন তিনি৷ আজ তাঁর প্রয়াণে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হল ঠিকই, কিন্ত্ত আনন্দলোক সমৃদ্ধ হল তাঁকে পেয়ে৷ তাঁর মতো শিল্পীর তো মৃত্যু হতে পারে না৷
ভাল থাকবেন রবি আঙ্কল৷
No comments:
Post a Comment