সমস্যা শুধু প্রেসিডেন্সির নয় রাজ্যটাকেই গ্রাস করেছে হিংসা
http://eisamay.indiatimes.com/post-editorial/articleshow/19721140.cms
আপনি-আমি দ্বীপ হয়ে বাঁচব? সেই অপচেষ্টাকে যদি রুখতে না পারি, তা হলে ছেলেমেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে করতে রাতে ঘুমোনোর জন্য স্যারিডন খাব, কিন্ত্ত অবস্থা সেই তিমিরেই থাকবে৷ লিখছেন সুনন্দন রায়চৌধুরী
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-সংসদ নির্বাচন করতে দিতে হবে- এই দাবিতে সিপিএম-পন্থী ছাত্র-সংগঠনের আইন অমান্য কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেছিল সুদীপ্ত৷ পুলিশের গাফিলতি না ঔদ্ধত্য জানি না, ছেলেটি মারা গেল৷ রাজ্যের সর্বময়ী নেত্রী বললেন, 'তুচ্ছ ঘটনা'৷ সি পি এম প্রভাবিত বামফ্রন্ট শহর জুড়ে সুদীপ্তর মিষ্টি মুখটার ছবি দিয়ে পোস্টার ছেপে শোক বাজার করল৷ মমতাদেবী তিন মন্ত্রী সহ দিল্লির যোজনা কমিশনের কাছে রাজ্যের উন্নয়নের জন্য অর্থ দাবি করতে গেলেন৷ সুদীপ্তর দলের সুবেশী এক মস্তানসুলভ নেতা আর অন্যান্য সাঙ্গপাঙ্গ মমতাকে ঘিরে ধরে হেনস্থা করল৷ বয়স্ক ভদ্র এক মন্ত্রীকে বেধড়ক মারল, তিনি অসুস্থ হয়ে দিল্লিতেই হাসপাতালে ভর্তি হলেন৷ নেত্রীর উপর শত্রুপক্ষ চড়াও হয়েছে শুনে, এবং মা-মাটি-মানুষের নেত্রী ও নেতার প্ররোচনার অপেক্ষা না করে 'তৃণমূল' জনতা জেলায় জেলায় লাল পার্টির অফিস- যেখান থেকে ৩৪ বছর বাংলাকে শাসন করেছে ওই দল- ভাঙচুর করল, আগুন লাগিয়ে দিল৷ লালেরাও এলাকাভিত্তিক ক্ষমতা অনুযায়ী ইঁটের বদলায় পাটকেল মারল৷ একদল 'তৃণমূলী' মাস্তান প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে ভাঙচুর করল, মেয়েদেরকে অনাচারের ভয় দেখাল৷ প্রেসিডেন্সিতে ঘটে যাওয়া লজ্জাজনক গুন্ডামির প্রতিবাদে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক শিক্ষাকর্মী প্রাক্তনীরা ধিক্কার মিছিলে হাঁটলেন৷
পর পর ঘটে যাওয়া ঘটনার মিছিল৷ শেষ থেকে শুরু করি৷ প্রেসিডেন্সির উপর হামলা হয়েছে, হিংসায় উন্মত্ত জনতার রোষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি সম্মান ভূ-লুণ্ঠিত৷ তার প্রতিবাদে মিছিল৷ মিছিলে হাঁটলেন প্রেসিডেন্সির ছাত্র শিক্ষক শিক্ষাকর্মী প্রাক্তনীরা৷ তাঁরা তো হাঁটবেনই, সেটা তো স্বাভাবিক৷ বিদ্যাসাগর, স্কটিশ, বেথুন, ব্রেবোর্ন, সুরেন্দ্রনাথ, বঙ্গবাসী, মৌলানা আজাদ, যোগমায়া, আশুতোষ, যাদবপুর, সেন্ট জেভিয়ার্স- এখানকার ছাত্র শিক্ষক শিক্ষাকর্মীরা কেন হাঁটলেন না, কেন সম্মিলিত ভাবে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের উপাচার্য এবং অধ্যক্ষরা একযোগে বেরিয়ে এসে ধিক্কার জানালেন না এই বর্বরতাকে? কেনই বা প্রেসিডেন্সির রেলিং থেকে শুরু করে গোটা কলেজস্ট্রিট পাড়ায় বিস্তত বই ব্যবসার জগতের কোনও ব্যক্তি ওই মিছিলে পা মেলালেন না? প্রেসিডেন্সির যাঁরা মিছিল করলেন, করাটা একান্ত জরুরি ছিল, আছে এবং থাকবে- তাঁরা কি কেউ একবারও বিদ্যাসাগর কলেজের প্রিন্সিপাল, মৌলানা আজাদের শিক্ষক বা বেথুনের ছাত্রীকে ফোন করেছিলেন মিছিলে হাঁটার জন্য? হলফ করে বলতে পারি, এক-আধজন ফোন করলেও করে থাকতে পারেন, ১০০০ জনের মধ্যে ৯৯৫ জন করেননি৷
প্রেসিডেন্সিতে হামলা হয়েছে, নিন্দনীয়৷ তৃণমূলের লোকেরা করেছে সেটা তো নিন্দনীয় বটেই, বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের মস্তানসুলভ মন্তব্যও নিন্দনীয়৷ কিন্ত্ত হামলার ঘটনা কি শুধু প্রেসিডেন্সির সমস্যা? বর্তমান সরকারের আমলে মনে পড়ছে যাদবপুর বিদ্যাপীঠের ঘটনা, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা, বর্তমান দল ক্ষমতায় আসার একটু আগে সাউথ সিটি কলেজের ঘটনা৷ আর লাল-গোলাপি সরকারের ৩৪ বছরে তো এ ধরনের ঘটনার এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি করা যায়৷ ঘটনাটা যদি প্রেসিডেন্সির বিচ্ছিন্ন ঘটনা না হয়, তা হলে শুধু কেন একটা ঘটনায় প্রতিবাদ করব, কেন সকলকে জড়ো করে গোটা প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সরব হয় না৷ আজ এই কলেজ, কাল ওই ক্যাম্পাস, পরশু ওই স্কুল- এ ভাবে বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে বাজারি-পার্টিনীতি সর্বস্ব দুটো দল দাপাদাপি করবে আর আমজনতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে থাকবে? সবচেয়ে বড়ো কথা, আমরা কি এক প্রেসিডেন্সিকে নিয়ে পথে নামলে প্রেসিডেন্সিকে বাঁচাতে পারব? যদি সমস্ত শিক্ষাঙ্গনে হিংসার বিরুদ্ধে সরব না হই, যদি রাজনৈতিক হিংসা, রাজনীতিকদের দল সর্বস্ব রাজনীতি ও অপরিণামদর্শিতার বিরুদ্ধে সমস্ত মানুষকে সজাগ না করি, এক সঙ্গে যদি শান্তিপূর্ণ দৃঢ়তার এই ক্ষমতালোভী উন্মত্ত হিংসাকে প্রতিরোধ না করি, তা হলে কি প্রেসিডেন্সি বাঁচবে নাকি শিক্ষা বাঁচবে, নাকি পশ্চিমবাংলা বাঁচবে?
যে ঔদ্ধত্য আজ তৃণমূলের মন্ত্রীদের গলায় তারই চরম প্রকাশ ঘটেছিল ৩৪ বছরের সি পি এম শাসনে যখন তাঁরা রাজ্যকে চালানো বা রাজ্যের উন্নয়নের থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণকে৷ এক দিকে স্থির করতেন কারা চাকরি পারে, অন্য দিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন ছাত্র রাজনীতির চাবিকাঠি৷ আগের লাল নেতাকুল ও বর্তমান সবুজ নেতার ক্লাব- দু' পক্ষই বুঝেছেন ছাত্র রাজনীতি কব্জায় রাখতে হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ও শিক্ষার গোটা ব্যবস্থাকে দখলে রাখতে হবে৷
অথচ দেখবেন যদি মুখ্যমন্ত্রীকে একান্তে প্রশ্ন করা হয়, দিদি, আপনি কি 'তুচ্ছ ঘটনা' বলে ঠিক করলেন, ভদ্রমহিলা হয়তো বলবেন- না ওই কথাটা না বললেই ভালো হত৷ যদি আগমার্কা সি পি এম নেতাকে জিজ্ঞাসা করা হয়- কমরেড, অমিত মিত্রকে মারল আপনার দলের লোকেরা, এটা কি ঠিক হল, তিনিও বলবেন খুবই ভুল হয়েছে৷ যে তৃণমূলের লোকেরা সি পি এম অফিস ভাঙচুর করেছে আর যারা প্রেসিডেন্সিতে গুন্ডামি করেছে, তারাও কোথাও একা-দোকা অবস্থায় নিজেদের কৃতকর্মের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত৷ তবুও হিংসায় একটা মিছিল ক্রমশ শহরটাকে রাজ্যটাকে গ্রাস করছে৷
বাংলা তথা ভারতীয় সাংবাদিকতার ইতিহাসে তদন্তমূলক খবর পরিবেশনের যিনি পথিকৃত্ সেই শ্রীনিরপেক্ষ অমিতাভ চৌধুরীর কাছে একটা কথা শুনেছি৷ উনি একবার দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সোল শহরে সামসুত্ বা হিউন্ডাই, এই জাতীয় কোনও বড়ো শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধারের সঙ্গে কথা বলছিলেন৷ কথা প্রসঙ্গে কোরীয় ভদ্রলোকটি ভারতীয় সাংবাদিককে বলেন, জানেন একটা দেশের বাত্সরিক মাথাপিছু গড় আয় যখন চার হাজার ডলারে পৌঁছায়, তখন সেখানে রাজপথের বিক্ষোভ প্রায় থাকে না বললেই চলে৷ চার হাজার ডলার মানে কম-বেশি দু' লাখ ভারতীয় টাকা৷ অর্থাত্ মাসে ষোল হাজার টাকা৷ কাকতালীয় কিনা জানি না প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরিপ্রার্থী যে ৪৫ লাখ যুবক-যুবতীর কথা লিখেছিলাম (৩ এপ্রিল, ২০১৩), তাঁদের অভীপ্সা কিন্ত্ত মাসিক চোদ্দ হাজার টাকার একটা মাইনে৷ খোঁজ নিয়ে দেখবেন, দিল্লিতে অমিত মিত্র মশাইকে যাঁরা মেরেছেন- ইন্ধনজোগানিদের কথা বলছি না- প্রেসিডেন্সিতে যাঁরা ভাঙচুর করেছেন, তাঁদের নিয়মিত আয় বছরে দু' লাখ টাকার নীচেই হয়তো হবে৷
হিংসা প্রক্রিয়ার অনুসন্ধানের চাকাটা তা হলে এক দিকে আঙুল দেখায় অর্থনৈতিক লোভী রাজনীতির দিকে৷ এই দুইয়ের বাইরে থেকে যায় একটা তৃতীয় মেরু, সেটা হল আপনার আমার দ্বীপ হয়ে বেঁচে থাকা৷ আপনি স্কুলের বা কলেজের শিক্ষক৷ শুনবেন, কাগজে পড়বেন, টিভিতে দেখবেন, এক সরকারি দলের বিধায়ক শিক্ষিকাকে চড় মেরেছেন, আপনি প্রতিবাদে সামিল হবেন না, জানবেন যাদবপুর বিদ্যাপীঠে এক এক দল অভিভাবক পাড়ার কাউন্সিলারের নেতৃত্বে অধ্যক্ষাকে শিক্ষিকাদের উপর মারধোর হয়েছে, আপনি নির্বিকার, প্রেসিডেন্সিতে হামলরা হয়েছে, আপনি যদি ওই কলেজের না হল, তা হলে আপনি নির্বিকল্প সমাধিতে থাকবেন৷ প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা দ্বীপ হয়ে থাকব, দ্বীপগুলো শাসন করবে লাল দল বা সবুজ দল, ছাত্র রাজনীতির নামে দলীয় হিংসার দাপট চলবে- আর আপনি, আমি দেখতে থাকব৷
পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির কোমর ভেঙে গিয়েছে, রাজনীতির নৃপতিরা সার্জারি করতে দিতেও নারাজ, দেশজ হোমিয়োপ্যাথির উপর তাঁদের গূঢ় প্রেম৷ বাকি থাকে তিন মেরুর অন্য দুই মেরু- রাজনীতির লোভ আর আপনার আমার দ্বীপ হয়ে বাঁচার অপচেষ্টা৷
এই শেষটাকে যদি বদলাতে না পারি, উঠতে বসতে হাপিত্যেস করব, ছেলেমেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে করতে রাতে ঘুমোনোর জন্য স্যারিডন খাব, কিন্ত্ত অবস্থা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকবে৷ এই দ্বীপ মানসিকতার থেকে বেরোনোর জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ দরকার৷ কয়েকটা কথা বলতে হবে জোর দিয়ে পথে প্রান্তরে৷
এক, সমস্যাটা প্রেসিডেন্সি বা কোনও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নয়, এটা গোটা পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ক্ষেত্রে হিংসার রাজনীতির সমস্যা৷ দুই, গুন্ডারা কোথাও তৃণমূল, কোথাও সি পি এম, কোথাও কংগ্রেস, কোথাও বা নকশাল- কিন্ত্ত তারা যদি গুন্ডামি করে সেটা গুন্ডামিই, সেটা করা চলবে না৷ তিন, যদি একটি শিক্ষাঙ্গনে হামলা হয়, ন্যূনতম ভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে জড়িত সবার সেই হামলার প্রতিবাদে সামিল হওয়া দরকার৷ চার, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি বাঞ্ছনীয়, দলবাজির তাণ্ডব নয়৷ রাজনীতির তাণ্ডব যখন ক্রমশ চলছে, দিল্লির সংসদ মার্গের সঙ্গে যখন কলেজ স্ট্রিটের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে, একটা কথা না বলে পারছি না৷ নিন্দুকেরা বলেন, আজ যিনি পশ্চিমবঙ্গের সর্বময় নেত্রী তিনি নাকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে- যা প্রেসিডেন্সির দু' হাত দূরে, এক সর্বভারতীয় নেতার গাড়ির ঢোকা পথে বাধাসৃষ্টিকারী অবরোধে সামিল হয়েছিলেন৷ সেটা প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা৷ সেখান থেকে অনেক সিঁড়ি বেয়ে এখন তিনি শাসনকর্তা৷ ভয় হয়, আজ যে বালক লাল পার্টির হয়ে সেই নেত্রীকে দিল্লিতে ভয় দেখানোর চেষ্টায় ব্রতী, যার মুখ কাগজে একটা লাল গোলের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি, সে-ও না এক দিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বসে৷
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-সংসদ নির্বাচন করতে দিতে হবে- এই দাবিতে সিপিএম-পন্থী ছাত্র-সংগঠনের আইন অমান্য কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেছিল সুদীপ্ত৷ পুলিশের গাফিলতি না ঔদ্ধত্য জানি না, ছেলেটি মারা গেল৷ রাজ্যের সর্বময়ী নেত্রী বললেন, 'তুচ্ছ ঘটনা'৷ সি পি এম প্রভাবিত বামফ্রন্ট শহর জুড়ে সুদীপ্তর মিষ্টি মুখটার ছবি দিয়ে পোস্টার ছেপে শোক বাজার করল৷ মমতাদেবী তিন মন্ত্রী সহ দিল্লির যোজনা কমিশনের কাছে রাজ্যের উন্নয়নের জন্য অর্থ দাবি করতে গেলেন৷ সুদীপ্তর দলের সুবেশী এক মস্তানসুলভ নেতা আর অন্যান্য সাঙ্গপাঙ্গ মমতাকে ঘিরে ধরে হেনস্থা করল৷ বয়স্ক ভদ্র এক মন্ত্রীকে বেধড়ক মারল, তিনি অসুস্থ হয়ে দিল্লিতেই হাসপাতালে ভর্তি হলেন৷ নেত্রীর উপর শত্রুপক্ষ চড়াও হয়েছে শুনে, এবং মা-মাটি-মানুষের নেত্রী ও নেতার প্ররোচনার অপেক্ষা না করে 'তৃণমূল' জনতা জেলায় জেলায় লাল পার্টির অফিস- যেখান থেকে ৩৪ বছর বাংলাকে শাসন করেছে ওই দল- ভাঙচুর করল, আগুন লাগিয়ে দিল৷ লালেরাও এলাকাভিত্তিক ক্ষমতা অনুযায়ী ইঁটের বদলায় পাটকেল মারল৷ একদল 'তৃণমূলী' মাস্তান প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে ভাঙচুর করল, মেয়েদেরকে অনাচারের ভয় দেখাল৷ প্রেসিডেন্সিতে ঘটে যাওয়া লজ্জাজনক গুন্ডামির প্রতিবাদে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক শিক্ষাকর্মী প্রাক্তনীরা ধিক্কার মিছিলে হাঁটলেন৷
পর পর ঘটে যাওয়া ঘটনার মিছিল৷ শেষ থেকে শুরু করি৷ প্রেসিডেন্সির উপর হামলা হয়েছে, হিংসায় উন্মত্ত জনতার রোষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি সম্মান ভূ-লুণ্ঠিত৷ তার প্রতিবাদে মিছিল৷ মিছিলে হাঁটলেন প্রেসিডেন্সির ছাত্র শিক্ষক শিক্ষাকর্মী প্রাক্তনীরা৷ তাঁরা তো হাঁটবেনই, সেটা তো স্বাভাবিক৷ বিদ্যাসাগর, স্কটিশ, বেথুন, ব্রেবোর্ন, সুরেন্দ্রনাথ, বঙ্গবাসী, মৌলানা আজাদ, যোগমায়া, আশুতোষ, যাদবপুর, সেন্ট জেভিয়ার্স- এখানকার ছাত্র শিক্ষক শিক্ষাকর্মীরা কেন হাঁটলেন না, কেন সম্মিলিত ভাবে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের উপাচার্য এবং অধ্যক্ষরা একযোগে বেরিয়ে এসে ধিক্কার জানালেন না এই বর্বরতাকে? কেনই বা প্রেসিডেন্সির রেলিং থেকে শুরু করে গোটা কলেজস্ট্রিট পাড়ায় বিস্তত বই ব্যবসার জগতের কোনও ব্যক্তি ওই মিছিলে পা মেলালেন না? প্রেসিডেন্সির যাঁরা মিছিল করলেন, করাটা একান্ত জরুরি ছিল, আছে এবং থাকবে- তাঁরা কি কেউ একবারও বিদ্যাসাগর কলেজের প্রিন্সিপাল, মৌলানা আজাদের শিক্ষক বা বেথুনের ছাত্রীকে ফোন করেছিলেন মিছিলে হাঁটার জন্য? হলফ করে বলতে পারি, এক-আধজন ফোন করলেও করে থাকতে পারেন, ১০০০ জনের মধ্যে ৯৯৫ জন করেননি৷
প্রেসিডেন্সিতে হামলা হয়েছে, নিন্দনীয়৷ তৃণমূলের লোকেরা করেছে সেটা তো নিন্দনীয় বটেই, বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের মস্তানসুলভ মন্তব্যও নিন্দনীয়৷ কিন্ত্ত হামলার ঘটনা কি শুধু প্রেসিডেন্সির সমস্যা? বর্তমান সরকারের আমলে মনে পড়ছে যাদবপুর বিদ্যাপীঠের ঘটনা, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা, বর্তমান দল ক্ষমতায় আসার একটু আগে সাউথ সিটি কলেজের ঘটনা৷ আর লাল-গোলাপি সরকারের ৩৪ বছরে তো এ ধরনের ঘটনার এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি করা যায়৷ ঘটনাটা যদি প্রেসিডেন্সির বিচ্ছিন্ন ঘটনা না হয়, তা হলে শুধু কেন একটা ঘটনায় প্রতিবাদ করব, কেন সকলকে জড়ো করে গোটা প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সরব হয় না৷ আজ এই কলেজ, কাল ওই ক্যাম্পাস, পরশু ওই স্কুল- এ ভাবে বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে বাজারি-পার্টিনীতি সর্বস্ব দুটো দল দাপাদাপি করবে আর আমজনতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে থাকবে? সবচেয়ে বড়ো কথা, আমরা কি এক প্রেসিডেন্সিকে নিয়ে পথে নামলে প্রেসিডেন্সিকে বাঁচাতে পারব? যদি সমস্ত শিক্ষাঙ্গনে হিংসার বিরুদ্ধে সরব না হই, যদি রাজনৈতিক হিংসা, রাজনীতিকদের দল সর্বস্ব রাজনীতি ও অপরিণামদর্শিতার বিরুদ্ধে সমস্ত মানুষকে সজাগ না করি, এক সঙ্গে যদি শান্তিপূর্ণ দৃঢ়তার এই ক্ষমতালোভী উন্মত্ত হিংসাকে প্রতিরোধ না করি, তা হলে কি প্রেসিডেন্সি বাঁচবে নাকি শিক্ষা বাঁচবে, নাকি পশ্চিমবাংলা বাঁচবে?
যে ঔদ্ধত্য আজ তৃণমূলের মন্ত্রীদের গলায় তারই চরম প্রকাশ ঘটেছিল ৩৪ বছরের সি পি এম শাসনে যখন তাঁরা রাজ্যকে চালানো বা রাজ্যের উন্নয়নের থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণকে৷ এক দিকে স্থির করতেন কারা চাকরি পারে, অন্য দিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন ছাত্র রাজনীতির চাবিকাঠি৷ আগের লাল নেতাকুল ও বর্তমান সবুজ নেতার ক্লাব- দু' পক্ষই বুঝেছেন ছাত্র রাজনীতি কব্জায় রাখতে হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ও শিক্ষার গোটা ব্যবস্থাকে দখলে রাখতে হবে৷
অথচ দেখবেন যদি মুখ্যমন্ত্রীকে একান্তে প্রশ্ন করা হয়, দিদি, আপনি কি 'তুচ্ছ ঘটনা' বলে ঠিক করলেন, ভদ্রমহিলা হয়তো বলবেন- না ওই কথাটা না বললেই ভালো হত৷ যদি আগমার্কা সি পি এম নেতাকে জিজ্ঞাসা করা হয়- কমরেড, অমিত মিত্রকে মারল আপনার দলের লোকেরা, এটা কি ঠিক হল, তিনিও বলবেন খুবই ভুল হয়েছে৷ যে তৃণমূলের লোকেরা সি পি এম অফিস ভাঙচুর করেছে আর যারা প্রেসিডেন্সিতে গুন্ডামি করেছে, তারাও কোথাও একা-দোকা অবস্থায় নিজেদের কৃতকর্মের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত৷ তবুও হিংসায় একটা মিছিল ক্রমশ শহরটাকে রাজ্যটাকে গ্রাস করছে৷
বাংলা তথা ভারতীয় সাংবাদিকতার ইতিহাসে তদন্তমূলক খবর পরিবেশনের যিনি পথিকৃত্ সেই শ্রীনিরপেক্ষ অমিতাভ চৌধুরীর কাছে একটা কথা শুনেছি৷ উনি একবার দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সোল শহরে সামসুত্ বা হিউন্ডাই, এই জাতীয় কোনও বড়ো শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধারের সঙ্গে কথা বলছিলেন৷ কথা প্রসঙ্গে কোরীয় ভদ্রলোকটি ভারতীয় সাংবাদিককে বলেন, জানেন একটা দেশের বাত্সরিক মাথাপিছু গড় আয় যখন চার হাজার ডলারে পৌঁছায়, তখন সেখানে রাজপথের বিক্ষোভ প্রায় থাকে না বললেই চলে৷ চার হাজার ডলার মানে কম-বেশি দু' লাখ ভারতীয় টাকা৷ অর্থাত্ মাসে ষোল হাজার টাকা৷ কাকতালীয় কিনা জানি না প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরিপ্রার্থী যে ৪৫ লাখ যুবক-যুবতীর কথা লিখেছিলাম (৩ এপ্রিল, ২০১৩), তাঁদের অভীপ্সা কিন্ত্ত মাসিক চোদ্দ হাজার টাকার একটা মাইনে৷ খোঁজ নিয়ে দেখবেন, দিল্লিতে অমিত মিত্র মশাইকে যাঁরা মেরেছেন- ইন্ধনজোগানিদের কথা বলছি না- প্রেসিডেন্সিতে যাঁরা ভাঙচুর করেছেন, তাঁদের নিয়মিত আয় বছরে দু' লাখ টাকার নীচেই হয়তো হবে৷
হিংসা প্রক্রিয়ার অনুসন্ধানের চাকাটা তা হলে এক দিকে আঙুল দেখায় অর্থনৈতিক লোভী রাজনীতির দিকে৷ এই দুইয়ের বাইরে থেকে যায় একটা তৃতীয় মেরু, সেটা হল আপনার আমার দ্বীপ হয়ে বেঁচে থাকা৷ আপনি স্কুলের বা কলেজের শিক্ষক৷ শুনবেন, কাগজে পড়বেন, টিভিতে দেখবেন, এক সরকারি দলের বিধায়ক শিক্ষিকাকে চড় মেরেছেন, আপনি প্রতিবাদে সামিল হবেন না, জানবেন যাদবপুর বিদ্যাপীঠে এক এক দল অভিভাবক পাড়ার কাউন্সিলারের নেতৃত্বে অধ্যক্ষাকে শিক্ষিকাদের উপর মারধোর হয়েছে, আপনি নির্বিকার, প্রেসিডেন্সিতে হামলরা হয়েছে, আপনি যদি ওই কলেজের না হল, তা হলে আপনি নির্বিকল্প সমাধিতে থাকবেন৷ প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা দ্বীপ হয়ে থাকব, দ্বীপগুলো শাসন করবে লাল দল বা সবুজ দল, ছাত্র রাজনীতির নামে দলীয় হিংসার দাপট চলবে- আর আপনি, আমি দেখতে থাকব৷
পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির কোমর ভেঙে গিয়েছে, রাজনীতির নৃপতিরা সার্জারি করতে দিতেও নারাজ, দেশজ হোমিয়োপ্যাথির উপর তাঁদের গূঢ় প্রেম৷ বাকি থাকে তিন মেরুর অন্য দুই মেরু- রাজনীতির লোভ আর আপনার আমার দ্বীপ হয়ে বাঁচার অপচেষ্টা৷
এই শেষটাকে যদি বদলাতে না পারি, উঠতে বসতে হাপিত্যেস করব, ছেলেমেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে করতে রাতে ঘুমোনোর জন্য স্যারিডন খাব, কিন্ত্ত অবস্থা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকবে৷ এই দ্বীপ মানসিকতার থেকে বেরোনোর জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ দরকার৷ কয়েকটা কথা বলতে হবে জোর দিয়ে পথে প্রান্তরে৷
এক, সমস্যাটা প্রেসিডেন্সি বা কোনও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নয়, এটা গোটা পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ক্ষেত্রে হিংসার রাজনীতির সমস্যা৷ দুই, গুন্ডারা কোথাও তৃণমূল, কোথাও সি পি এম, কোথাও কংগ্রেস, কোথাও বা নকশাল- কিন্ত্ত তারা যদি গুন্ডামি করে সেটা গুন্ডামিই, সেটা করা চলবে না৷ তিন, যদি একটি শিক্ষাঙ্গনে হামলা হয়, ন্যূনতম ভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে জড়িত সবার সেই হামলার প্রতিবাদে সামিল হওয়া দরকার৷ চার, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি বাঞ্ছনীয়, দলবাজির তাণ্ডব নয়৷ রাজনীতির তাণ্ডব যখন ক্রমশ চলছে, দিল্লির সংসদ মার্গের সঙ্গে যখন কলেজ স্ট্রিটের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে, একটা কথা না বলে পারছি না৷ নিন্দুকেরা বলেন, আজ যিনি পশ্চিমবঙ্গের সর্বময় নেত্রী তিনি নাকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে- যা প্রেসিডেন্সির দু' হাত দূরে, এক সর্বভারতীয় নেতার গাড়ির ঢোকা পথে বাধাসৃষ্টিকারী অবরোধে সামিল হয়েছিলেন৷ সেটা প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা৷ সেখান থেকে অনেক সিঁড়ি বেয়ে এখন তিনি শাসনকর্তা৷ ভয় হয়, আজ যে বালক লাল পার্টির হয়ে সেই নেত্রীকে দিল্লিতে ভয় দেখানোর চেষ্টায় ব্রতী, যার মুখ কাগজে একটা লাল গোলের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি, সে-ও না এক দিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বসে৷
ছাত্রনেতার মৃত্যু ঘিরে ধোঁয়াশাঅলীক কুনাট্য আর কতকাল?
রাজ্য জুড়ে নিষ্ঠুরতার এক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে৷ একটি মৃত্যু বা অত্যাচারের ঘটনাকে বৈধতা দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে আগে ঘটে যাওয়া কোনও মৃত্যু বা অত্যাচারের ঘটনাকে শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহার করে৷ লিখছেন প্রসেনজিত্ বসু।
এস এফ আই নেতা সুদীপ্ত গুপ্তের মৃত্যুর পর সব থেকে খারাপ যেটা হতে পারত সেটাই হয়েছে৷ 'দুর্ঘটনা' হিসেবে এই মৃত্যুকে চালাবার চেষ্টা করা হয়েছে৷ এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে এটাকে 'তুচ্ছ, ছোটো' ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন, তা এই চেষ্টারই একটি অংশ৷
কলকাতা পুলিশ দাবি করেছে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় একটি ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খেয়ে 'আকস্মিক' ভাবে সুদীপ্তর মৃত্যু হয়৷ এই দাবি ধোপে টেকে না৷ কারণ যখন এই 'আকস্মিক' ঘটনাটি ঘটে তখন সুদীপ্ত পুলিশের হেফাজতে ছিল৷ তাঁর মৃত্যুর পর কয়েক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে৷ এখনও জানা যায়নি ঠিক কী ভাবে সুদীপ্ত রাস্তার ধারের একটি ল্যাম্প পোস্টে গিয়ে ধাক্কা খেল, বা গ্রেপ্তার হওয়ার পর মাথার আঘাত ছাড়া তাঁর দেহে অন্য কোনও আঘাত ছিল কিনা৷ রাজ্য সরকার এক জন মেধাবী এবং প্রতিশ্রুতিবান ছাত্র নেতার মৃত্যুর পরেও কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেনি৷ প্রশাসনিক সুবিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ ছড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সমাজে ও রাজনীতিতে৷
পশ্চিমবঙ্গের গোড়ার সমস্যা হল, ছোটোবড়ো যে কোনও সমস্যাকেই সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির নিরিখে বিচার করা হয়৷ সে তাপসী মালিক বা রিজওয়ানুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রশ্নই হোক, বা নন্দীগ্রামের হিংসা বা জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হওয়ার মতো বড়ো মাপের ট্র্যাজেডিই হোক৷ সত্যের অনুসন্ধান ও সুষ্ঠু ন্যায়বিচারের প্রশ্ন সব সময়ই উপেক্ষিত৷ প্রায় অনিবার্য ভাবে সব কিছু ছাপিয়ে ওঠে তিক্ত রাজনৈতিক দোষারোপের পালা৷ মৃতদেহ সমাধিস্থ বা দাহ হওয়ার আগেই লাভক্ষতির হিসেব কষা শুরু হয়ে যায়৷ কে বেশি লাভবান হল- সিপিএম না তৃণমূল? ফলত সুবিচারের কোনও পথই আর অবশিষ্ট থাকে না৷ এই ভাবে সারা রাজ্যেই নিষ্ঠুরতার এক সংস্কতি তৈরি হয়েছে৷ যে সংস্কতিতে একটি মৃত্যু বা অত্যাচারের ঘটনাকে এক ধরনের বৈধতা দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয় আগে ঘটে যাওয়া কোনও মৃত্যু বা অত্যাচারের ঘটনাকে শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহার করে৷ শেষমেশ কোনও ঘটনার ক্ষেত্রেই কেউ দোষী সাব্যস্ত হয় না৷ কারও কোনও রকম শাস্তি হয় না৷ হিংসা চলতে থাকে অনিবার৷ শুধু দগদগে একটা ক্ষত জেগে থাকে৷ যার মধ্যে ধরা পড়ে এই রাজ্যে গণতন্ত্রের এক বিকৃত চেহারা৷
কেউ কেউ বলতে পারেন পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজনৈতিক ভাবে দুই মেরুতে বিভাজিত রাজ্যে এই রকমই হয়ে এসেছে চিরকাল৷ বা কেউ কেউ বলতে পারেন যে মৃত্যু নিয়ে রাজনৈতিক দোষারোপের কুনাট্য শুধু এই রাজ্যেই হয় না৷ যুক্তিটি শুধু সিনিকালই নয়, অনৈতিহাসিকও বটে৷ প্রায় তিন দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার টিঁঁকে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিংসায় দীর্ণ সত্তর দশকের রক্তাক্ত স্মৃতি৷ যে স্মৃতি পরবর্তী প্রজন্মকেও তাড়া করে এসেছে৷ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেসি সরকার এই হিংসার জন্য শুধু দায়ী ছিল তাই নয়,
সাধারণ মানুষের কাছেও এতটা ঘৃণিত হয়ে উঠেছিল যে তার পর আর কোনও দিন কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেনি৷ আমাদের প্রজন্ম বড়োদের মুখে সত্তরের সেই ভয়াবহ কাহিনি শুনে বেড়ে উঠেছি৷ সেই কাহিনির সঙ্গে আমাদের এটাও বলা হত যে ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পরেই কী ভাবে জ্যোতি বসু এবং প্রমোদ দাশগুপ্ত সক্রিয় ভাবে রাজবন্দীদের মুক্তি এবং সামাজিক জীবনে শান্তি ও স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন৷ উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার ছিল৷ যাতে রাজনৈতিক মতনির্বিশেষে প্রত্যেকে ঘরে ফেরেন এবং নির্ভয়ে দৈনন্দিন জীবন কাটাতে পারেন৷ এবং তাঁদের সেই প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল৷ যার কথা সাধারণ মানুষও ভোলেননি৷
২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ঐতিহাসিক মুশিরুল হাসান জ্যোতি বসুর একটি সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন৷ সেই সাক্ষাত্কারে যখন তাঁকে তাঁর জীবনের কোনও 'উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত' রোমন্থন করতে বলা হয়, জ্যোতিবাবু উত্তর দিয়েছিলেনঃ 'সেই রকম বিশেষ কোনও মুহূর্ত তো মনে নেই৷ কিন্ত্ত পশ্চিমবঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রকে আবার প্রতিষ্ঠা করতে পারায় আমি খুশি হয়েছিলাম' ('উই স্টিল হ্যাভ আ লং ওয়ে টু গো', দ্য হিন্দু, ৫ মে, ২০০১)৷ ব্যাপারটা ভেবে দেখার মতো৷ অপারেশন বর্গা বা পঞ্চায়েতি রাজের মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ বাদ দিয়ে জ্যোতি বসু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সব থেকে 'উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত' হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন 'পশ্চিমবঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রকে আবার প্রতিষ্ঠা' করতে পারার ঘটনাটিকে৷ অর্থাত্, ১৯৭৭ সালে তাঁর কাছে এবং তাঁর রাজনৈতিক সতীর্থদের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাজ্যে শান্তির বাতাবরণ প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস৷ আজকের পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ভাবে সাহসী এবং নৈতিকতায় স্থিতপ্রজ্ঞ এই ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিদারুণ অভাব৷ যে নেতৃত্ব রাজ্যবাসীর বাঁচামরার প্রশ্নে তাত্ক্ষণিক দলীয় লাভক্ষতির হিসেবের উপরে উঠে স্পষ্ট ভাবে বলতে পারেন কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল৷
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এই রকম কোনও পদক্ষেপ আশা করাটাই বাতুলতা৷ কারণ গত কয়েক বছর ধরে রাজ্যের চালচিত্র জুড়ে হিংসা ও প্রতিহিংসার যে পালা নিরন্তর ঘটে চলেছে, মনে হওয়া অসঙ্গত নয় যে মুখ্যমন্ত্রী তার থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছেন৷ তিনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন যে সাধারণ মানুষ সব সময় সরকারে ক্ষমতাসীন দলের থেকে অনেক বেশি দায়িত্বজ্ঞান প্রত্যাশা করেন৷ কারণ তাঁদের হাতেই আছে কিছু করা বা কিছু না করার ক্ষমতা৷ সাধারণ মানুষ নন্দীগ্রাম এবং নেতাইয়ের হিংসাত্মক ঘটনার জন্য সি পি আই এম-কেই কিন্ত্ত দোষী সাব্যস্ত করেছেন৷ এটা মোটামুটি জানা যে এই ঘটনাগুলি ঘটার সময় হিংসা সব ক্ষেত্রে একতরফা ছিল না৷ বহু সি পি আই এম কর্মীও এই রকম হিংসার ঘটনায় নিহত হয়েছেন৷ কিন্ত্ত ক্ষমতাসীন দল হিসেবে রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসার যাবতীয় দায়ভার সি পি এম-কেই নিতে হয়েছিল৷ সর্বোপরি ক্ষমতায় থাকতে থাকতে সি পি এম দল হিসেবে জ্যোতি বসু এবং প্রমোদ দাশগুন্তর মতো নেতাদের রেখে যাওয়া রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে ধ্বংস করে ফেলেছিল৷ যার ফলে ২০১১ সালে জনমত তাদের বিরুদ্ধে যায়৷
যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী এখন ক্ষমতার শীর্ষে, অতএব তিনি তাঁর দায়িত্ব এড়িয়ে রাজ্যের সব খারাপের দায় সি পি আই এম-এর উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না৷ সুদীপ্ত গুপ্তর মৃত্যুর আগে ঘটে যাওয়া দু'টি ঘটনার থেকেই স্পষ্ট তাঁর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের কী হাল হয়েছে৷ প্রথমটি গত বছর এক পূর্বতন এমএল এ-কে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা৷ এবং কয়েক মাস আগে প্রকাশ্য দিবালোকে এক পুলিশ অফিসারের গুলিবিদ্ধ হওয়ার দ্বিতীয় ঘটনাটি৷
দিল্লিতে সি পি আই এম-এর সমর্থকদের হাতে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর নিগৃহীত হওয়ার ঘটনাটি অবশ্যই নিন্দনীয়৷ এই ভাবে বিক্ষোভ দেখাবার কোনও প্রয়োজনই ছিল না৷ অত্যুত্সাহ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে যা হয় তাই হয়েছে৷ যদিও আরও হাস্যকর হল সি পি আই এম নেতৃত্বের একাংশের তরফে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা৷ প্রথমত, সি পি আই এম নেতৃত্বের উচিত এই খামখেয়ালিপনার জন্য যিনি দোষী তাঁকে চিহ্নিত করা৷ এবং দ্বিতীয়ত, পার্টি এবং গণসংগঠনের পারস্পরিক সম্পর্ককে খতিয়ে দেখাটা ভীষণ জরুরি৷ কারণ,
বোঝাই যাচ্ছে যে এই সম্পর্কের মধ্যেই অনেক গণ্ডগোল থেকে গিয়েছে৷ কিন্ত্ত কোনও ভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে দিল্লির ঘটনাটি আদতে মুখ্যমন্ত্রীর উপর 'পূর্বনির্ধারিত আক্রমণ'৷ যদিও মাননীয় রাজ্যপাল মহাশয় একপেশে ভাবে ঘটনাটিকে সেই ভাবেই দেখাবার চেষ্টা করেছেন৷ এই ধুয়ো তোলার এক মাত্র কারণ হল সুদীপ্ত গুপ্তর মৃত্যুর ঘটনা থেকে মানুষের দৃষ্টিকে সরিয়ে দেওয়া, এবং সারা রাজ্যে আবার আর এক দফা হিংসাত্মক তাণ্ডবের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ যে তাণ্ডবে বিধ্বস্ত করা হয়েছে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যকে৷ ধ্বংস করা হয়েছে বিরোধী দলগুলির শত শত পার্টি অফিস৷
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির এই অলীক কুনাট্যে পুলিশি হেফাজতে এক ছাত্রনেতার রহস্যজনক মৃত্যুর মতো গুরুতর ঘটনাকে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে 'ছোটো, তুচ্ছ' ঘটনা বলে৷ অন্য দিকে দিল্লির একটি অবাঞ্ছিত ঘটনার অজুহাতে শাসক দল সারা রাজ্যে প্রতিহিংসার তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে৷ প্রকৃত প্রস্তাবে দিল্লির ঘটনাটির ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয় বিশেষণটি প্রয়োগ করলে বরং বিশেষ ভুল হত না৷ রাজ্যে সমস্ত শান্তিকামী এবং গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের এখন একটাই প্রশ্ন৷ এই অলীক কুনাট্যের পালা আর কত দিন চলবে? আমরা আর কবে চাইব যে রাজনীতিতে চোখের বদলে চোখ উপড়ে নেওয়ার এই লজ্জাজনক ঐতিহ্যের শেষ হোক? যুক্তি ও বিচক্ষণতার স্বরগুলি আরও জোরালো হয়ে ওঠার দাবি আর কবে রাখব আমরা? যতই চাতুরির আশ্রয় নেওয়া হোক না কেন, এটা ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব নয় যে সুদীন্ত গুন্তর মৃত্যু হয়েছিল পুলিশি হেফাজতে৷ পশ্চিমবঙ্গের ক্যাম্পাসগুলিতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল৷ মৃত্যু হয়েছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ একটি ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার সময়৷ যদি সেই মৃত্যুর জন্য কোনও দোষীকে চিহ্নিত না করা হয়, তবে তা হবে ন্যায়বিচারের চড়ান্ত ব্যর্থতা৷ মুখ্যমন্ত্রী কেন এখনও পুলিশি হেফাজতে সুদীন্ত গুন্তর মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্তের আদেশ দিচ্ছেন না? যদি সুদীন্ত গুন্তর মৃত্যুকে 'দুর্ঘটনা' বলে মেনে নেওয়ার কোনও যথার্থ কারণ থাকে, তা হলে নিরপেক্ষ তদন্তের ক্ষেত্রে এই অনীহা কেন? এই ব্যাপারে একগুঁয়েমি অব্যাহত থাকলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে রাজ্য সরকার একটা কিছু লুকাতে চেষ্টা করছেন৷ সুদীন্তর ক্ষেত্রে যদি ন্যায়বিচার না হয়, মনে রাখা দরকার যে সেই অন্যায়কে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না৷ আর ভবিষ্যত্ও ক্ষমাও করবে না এই অন্যায়৷
লেখক বামপন্থী অর্থনীতিবিদ
এস এফ আই নেতা সুদীপ্ত গুপ্তের মৃত্যুর পর সব থেকে খারাপ যেটা হতে পারত সেটাই হয়েছে৷ 'দুর্ঘটনা' হিসেবে এই মৃত্যুকে চালাবার চেষ্টা করা হয়েছে৷ এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে এটাকে 'তুচ্ছ, ছোটো' ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন, তা এই চেষ্টারই একটি অংশ৷
কলকাতা পুলিশ দাবি করেছে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় একটি ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খেয়ে 'আকস্মিক' ভাবে সুদীপ্তর মৃত্যু হয়৷ এই দাবি ধোপে টেকে না৷ কারণ যখন এই 'আকস্মিক' ঘটনাটি ঘটে তখন সুদীপ্ত পুলিশের হেফাজতে ছিল৷ তাঁর মৃত্যুর পর কয়েক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে৷ এখনও জানা যায়নি ঠিক কী ভাবে সুদীপ্ত রাস্তার ধারের একটি ল্যাম্প পোস্টে গিয়ে ধাক্কা খেল, বা গ্রেপ্তার হওয়ার পর মাথার আঘাত ছাড়া তাঁর দেহে অন্য কোনও আঘাত ছিল কিনা৷ রাজ্য সরকার এক জন মেধাবী এবং প্রতিশ্রুতিবান ছাত্র নেতার মৃত্যুর পরেও কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেনি৷ প্রশাসনিক সুবিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ ছড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সমাজে ও রাজনীতিতে৷
পশ্চিমবঙ্গের গোড়ার সমস্যা হল, ছোটোবড়ো যে কোনও সমস্যাকেই সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির নিরিখে বিচার করা হয়৷ সে তাপসী মালিক বা রিজওয়ানুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রশ্নই হোক, বা নন্দীগ্রামের হিংসা বা জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হওয়ার মতো বড়ো মাপের ট্র্যাজেডিই হোক৷ সত্যের অনুসন্ধান ও সুষ্ঠু ন্যায়বিচারের প্রশ্ন সব সময়ই উপেক্ষিত৷ প্রায় অনিবার্য ভাবে সব কিছু ছাপিয়ে ওঠে তিক্ত রাজনৈতিক দোষারোপের পালা৷ মৃতদেহ সমাধিস্থ বা দাহ হওয়ার আগেই লাভক্ষতির হিসেব কষা শুরু হয়ে যায়৷ কে বেশি লাভবান হল- সিপিএম না তৃণমূল? ফলত সুবিচারের কোনও পথই আর অবশিষ্ট থাকে না৷ এই ভাবে সারা রাজ্যেই নিষ্ঠুরতার এক সংস্কতি তৈরি হয়েছে৷ যে সংস্কতিতে একটি মৃত্যু বা অত্যাচারের ঘটনাকে এক ধরনের বৈধতা দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয় আগে ঘটে যাওয়া কোনও মৃত্যু বা অত্যাচারের ঘটনাকে শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহার করে৷ শেষমেশ কোনও ঘটনার ক্ষেত্রেই কেউ দোষী সাব্যস্ত হয় না৷ কারও কোনও রকম শাস্তি হয় না৷ হিংসা চলতে থাকে অনিবার৷ শুধু দগদগে একটা ক্ষত জেগে থাকে৷ যার মধ্যে ধরা পড়ে এই রাজ্যে গণতন্ত্রের এক বিকৃত চেহারা৷
কেউ কেউ বলতে পারেন পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজনৈতিক ভাবে দুই মেরুতে বিভাজিত রাজ্যে এই রকমই হয়ে এসেছে চিরকাল৷ বা কেউ কেউ বলতে পারেন যে মৃত্যু নিয়ে রাজনৈতিক দোষারোপের কুনাট্য শুধু এই রাজ্যেই হয় না৷ যুক্তিটি শুধু সিনিকালই নয়, অনৈতিহাসিকও বটে৷ প্রায় তিন দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার টিঁঁকে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিংসায় দীর্ণ সত্তর দশকের রক্তাক্ত স্মৃতি৷ যে স্মৃতি পরবর্তী প্রজন্মকেও তাড়া করে এসেছে৷ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেসি সরকার এই হিংসার জন্য শুধু দায়ী ছিল তাই নয়,
সাধারণ মানুষের কাছেও এতটা ঘৃণিত হয়ে উঠেছিল যে তার পর আর কোনও দিন কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেনি৷ আমাদের প্রজন্ম বড়োদের মুখে সত্তরের সেই ভয়াবহ কাহিনি শুনে বেড়ে উঠেছি৷ সেই কাহিনির সঙ্গে আমাদের এটাও বলা হত যে ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পরেই কী ভাবে জ্যোতি বসু এবং প্রমোদ দাশগুপ্ত সক্রিয় ভাবে রাজবন্দীদের মুক্তি এবং সামাজিক জীবনে শান্তি ও স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন৷ উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার ছিল৷ যাতে রাজনৈতিক মতনির্বিশেষে প্রত্যেকে ঘরে ফেরেন এবং নির্ভয়ে দৈনন্দিন জীবন কাটাতে পারেন৷ এবং তাঁদের সেই প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল৷ যার কথা সাধারণ মানুষও ভোলেননি৷
২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ঐতিহাসিক মুশিরুল হাসান জ্যোতি বসুর একটি সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন৷ সেই সাক্ষাত্কারে যখন তাঁকে তাঁর জীবনের কোনও 'উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত' রোমন্থন করতে বলা হয়, জ্যোতিবাবু উত্তর দিয়েছিলেনঃ 'সেই রকম বিশেষ কোনও মুহূর্ত তো মনে নেই৷ কিন্ত্ত পশ্চিমবঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রকে আবার প্রতিষ্ঠা করতে পারায় আমি খুশি হয়েছিলাম' ('উই স্টিল হ্যাভ আ লং ওয়ে টু গো', দ্য হিন্দু, ৫ মে, ২০০১)৷ ব্যাপারটা ভেবে দেখার মতো৷ অপারেশন বর্গা বা পঞ্চায়েতি রাজের মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ বাদ দিয়ে জ্যোতি বসু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সব থেকে 'উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত' হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন 'পশ্চিমবঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রকে আবার প্রতিষ্ঠা' করতে পারার ঘটনাটিকে৷ অর্থাত্, ১৯৭৭ সালে তাঁর কাছে এবং তাঁর রাজনৈতিক সতীর্থদের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাজ্যে শান্তির বাতাবরণ প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস৷ আজকের পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ভাবে সাহসী এবং নৈতিকতায় স্থিতপ্রজ্ঞ এই ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিদারুণ অভাব৷ যে নেতৃত্ব রাজ্যবাসীর বাঁচামরার প্রশ্নে তাত্ক্ষণিক দলীয় লাভক্ষতির হিসেবের উপরে উঠে স্পষ্ট ভাবে বলতে পারেন কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল৷
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এই রকম কোনও পদক্ষেপ আশা করাটাই বাতুলতা৷ কারণ গত কয়েক বছর ধরে রাজ্যের চালচিত্র জুড়ে হিংসা ও প্রতিহিংসার যে পালা নিরন্তর ঘটে চলেছে, মনে হওয়া অসঙ্গত নয় যে মুখ্যমন্ত্রী তার থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছেন৷ তিনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন যে সাধারণ মানুষ সব সময় সরকারে ক্ষমতাসীন দলের থেকে অনেক বেশি দায়িত্বজ্ঞান প্রত্যাশা করেন৷ কারণ তাঁদের হাতেই আছে কিছু করা বা কিছু না করার ক্ষমতা৷ সাধারণ মানুষ নন্দীগ্রাম এবং নেতাইয়ের হিংসাত্মক ঘটনার জন্য সি পি আই এম-কেই কিন্ত্ত দোষী সাব্যস্ত করেছেন৷ এটা মোটামুটি জানা যে এই ঘটনাগুলি ঘটার সময় হিংসা সব ক্ষেত্রে একতরফা ছিল না৷ বহু সি পি আই এম কর্মীও এই রকম হিংসার ঘটনায় নিহত হয়েছেন৷ কিন্ত্ত ক্ষমতাসীন দল হিসেবে রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসার যাবতীয় দায়ভার সি পি এম-কেই নিতে হয়েছিল৷ সর্বোপরি ক্ষমতায় থাকতে থাকতে সি পি এম দল হিসেবে জ্যোতি বসু এবং প্রমোদ দাশগুন্তর মতো নেতাদের রেখে যাওয়া রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে ধ্বংস করে ফেলেছিল৷ যার ফলে ২০১১ সালে জনমত তাদের বিরুদ্ধে যায়৷
যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী এখন ক্ষমতার শীর্ষে, অতএব তিনি তাঁর দায়িত্ব এড়িয়ে রাজ্যের সব খারাপের দায় সি পি আই এম-এর উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না৷ সুদীপ্ত গুপ্তর মৃত্যুর আগে ঘটে যাওয়া দু'টি ঘটনার থেকেই স্পষ্ট তাঁর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের কী হাল হয়েছে৷ প্রথমটি গত বছর এক পূর্বতন এমএল এ-কে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা৷ এবং কয়েক মাস আগে প্রকাশ্য দিবালোকে এক পুলিশ অফিসারের গুলিবিদ্ধ হওয়ার দ্বিতীয় ঘটনাটি৷
দিল্লিতে সি পি আই এম-এর সমর্থকদের হাতে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর নিগৃহীত হওয়ার ঘটনাটি অবশ্যই নিন্দনীয়৷ এই ভাবে বিক্ষোভ দেখাবার কোনও প্রয়োজনই ছিল না৷ অত্যুত্সাহ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে যা হয় তাই হয়েছে৷ যদিও আরও হাস্যকর হল সি পি আই এম নেতৃত্বের একাংশের তরফে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা৷ প্রথমত, সি পি আই এম নেতৃত্বের উচিত এই খামখেয়ালিপনার জন্য যিনি দোষী তাঁকে চিহ্নিত করা৷ এবং দ্বিতীয়ত, পার্টি এবং গণসংগঠনের পারস্পরিক সম্পর্ককে খতিয়ে দেখাটা ভীষণ জরুরি৷ কারণ,
বোঝাই যাচ্ছে যে এই সম্পর্কের মধ্যেই অনেক গণ্ডগোল থেকে গিয়েছে৷ কিন্ত্ত কোনও ভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে দিল্লির ঘটনাটি আদতে মুখ্যমন্ত্রীর উপর 'পূর্বনির্ধারিত আক্রমণ'৷ যদিও মাননীয় রাজ্যপাল মহাশয় একপেশে ভাবে ঘটনাটিকে সেই ভাবেই দেখাবার চেষ্টা করেছেন৷ এই ধুয়ো তোলার এক মাত্র কারণ হল সুদীপ্ত গুপ্তর মৃত্যুর ঘটনা থেকে মানুষের দৃষ্টিকে সরিয়ে দেওয়া, এবং সারা রাজ্যে আবার আর এক দফা হিংসাত্মক তাণ্ডবের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ যে তাণ্ডবে বিধ্বস্ত করা হয়েছে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যকে৷ ধ্বংস করা হয়েছে বিরোধী দলগুলির শত শত পার্টি অফিস৷
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির এই অলীক কুনাট্যে পুলিশি হেফাজতে এক ছাত্রনেতার রহস্যজনক মৃত্যুর মতো গুরুতর ঘটনাকে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে 'ছোটো, তুচ্ছ' ঘটনা বলে৷ অন্য দিকে দিল্লির একটি অবাঞ্ছিত ঘটনার অজুহাতে শাসক দল সারা রাজ্যে প্রতিহিংসার তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে৷ প্রকৃত প্রস্তাবে দিল্লির ঘটনাটির ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয় বিশেষণটি প্রয়োগ করলে বরং বিশেষ ভুল হত না৷ রাজ্যে সমস্ত শান্তিকামী এবং গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের এখন একটাই প্রশ্ন৷ এই অলীক কুনাট্যের পালা আর কত দিন চলবে? আমরা আর কবে চাইব যে রাজনীতিতে চোখের বদলে চোখ উপড়ে নেওয়ার এই লজ্জাজনক ঐতিহ্যের শেষ হোক? যুক্তি ও বিচক্ষণতার স্বরগুলি আরও জোরালো হয়ে ওঠার দাবি আর কবে রাখব আমরা? যতই চাতুরির আশ্রয় নেওয়া হোক না কেন, এটা ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব নয় যে সুদীন্ত গুন্তর মৃত্যু হয়েছিল পুলিশি হেফাজতে৷ পশ্চিমবঙ্গের ক্যাম্পাসগুলিতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল৷ মৃত্যু হয়েছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ একটি ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার সময়৷ যদি সেই মৃত্যুর জন্য কোনও দোষীকে চিহ্নিত না করা হয়, তবে তা হবে ন্যায়বিচারের চড়ান্ত ব্যর্থতা৷ মুখ্যমন্ত্রী কেন এখনও পুলিশি হেফাজতে সুদীন্ত গুন্তর মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্তের আদেশ দিচ্ছেন না? যদি সুদীন্ত গুন্তর মৃত্যুকে 'দুর্ঘটনা' বলে মেনে নেওয়ার কোনও যথার্থ কারণ থাকে, তা হলে নিরপেক্ষ তদন্তের ক্ষেত্রে এই অনীহা কেন? এই ব্যাপারে একগুঁয়েমি অব্যাহত থাকলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে রাজ্য সরকার একটা কিছু লুকাতে চেষ্টা করছেন৷ সুদীন্তর ক্ষেত্রে যদি ন্যায়বিচার না হয়, মনে রাখা দরকার যে সেই অন্যায়কে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না৷ আর ভবিষ্যত্ও ক্ষমাও করবে না এই অন্যায়৷
লেখক বামপন্থী অর্থনীতিবিদ
Palash Biswas
Pl Read my blogs:
No comments:
Post a Comment