মাদ্রাজ হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায় হয়তো বদলে দেবে ভারতে লিঙ্গ-বৈষম্যের গোটা ছবিটাই৷ অন্তত এমনটা আশা করার ইঙ্গিত যথেষ্ট৷ লিখছেনরুচিরা গুপ্ত
সত্তরের দশকের সেই বচ্চন-যুগ৷ একের-পর-এক সুপারহিট ছবির মূল কাহিনি-কাঠামোটি ঠিক কী রকম ছিল? চিরকালীন মাতৃরূপা নিরুপা রায়৷ স্বামী বা প্রেমিকের দ্বারা প্রতারিতা বা পরিত্যক্তা৷ দুই সন্তানের জননী তিনি৷ এবং 'বাবা'টি যেহেতু পলাতক, সন্তানদের দায়িত্ব বর্তেছে একা মায়েরই উপর৷ মুখে রক্ত তুলে মা মানুষ করেন দুই পুত্রকে৷ একজন বনে যায় দুষ্কৃতী, অন্য জন পুলিশ অফিসার৷ সমাজের কাছে দু'জনেই দু'পথে ন্যায়প্রার্থী৷ এ সেই সমাজ, যে একজনকে পুরুষকে স্বেচ্ছায় চূড়ান্ত শক্তি দিয়েছে, যে শক্তির উপর ভর করে সেই পুরুষ সন্তান তো উত্পাদন করে, কিন্ত্ত সন্তানদের লালন-পালনের ভার এড়িয়ে যায়৷
এই সব ছবির মূল কাহিনি সেই সব মায়ের গল্প বলে, যাদের অপরাধ, তারা কোনও না কোনও সময়ে পুরুষ সঙ্গীটির উপর ভরসা করেছিল৷ বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখে অথবা বিয়ের অপেক্ষা না-রেখেই সেই পুরুষের সন্তানের মা হয়েছে৷ তারপর থেকে সন্তান-সহ পরিত্যক্তা সেই সব মা৷ পুরুষটির দায়িত্বজ্ঞানহীনতার মূল্য চুকিয়ে যেতে হয় মেয়েটিকেই৷ এই দেশে আজও কত মা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়, সমাজও তাদের পাশে দাঁড়ায় না৷ আর্থিক, সামাজিক দু'দিক থেকেই বিপন্ন এই মেয়েরা কুণ্ঠিত ভাবে বেঁচে থাকে, কোনওক্রমে৷ অথচ মূল অপরাধী যে পুরুষ, যে 'বিয়ে' নামক স্বীকৃতিটিও দেয় না, সন্তানের দায়ভারও অস্বীকার করে, সে বেঁচে থাকে মাথা উঁচু করে৷
এই চিরকালীন সামাজিক ব্যাধিটির মূলে প্রথম সে ভাবে আঘাত হানল মাদ্রাজ হাইকোর্ট৷ এক মহিলা, প্রেমিকের সন্তান গর্ভে ধারণ করেন, দু'টি সন্তানও হয়, যথারীতি এরপর 'বাবা'টি দায় নিতে অস্বীকার করে৷ রায় ঘোষণার সময় বিচারপতি সি এস কারনান নির্দেশ দেন, ওই পুরুষটিকে সন্তান রক্ষণাবেক্ষণের দায় নিতে হবে৷ পাশাপাশি, নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হলে তাকে বিয়ের সমতুল ঘোষণা করার কথাও এই রায়ে বলা হয়৷ তা হলে অন্তত সন্তানের দায় নিতে পুরুষটিকে বাধ্য করা যাবে৷ এবং এই রায় এই কথা আরও একবার প্রমাণ করল, যৌন সম্পর্কে যেমন নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মতি জরুরি, একই ভাবে সন্তান লালনের দায়িত্বও বাবা-মা দু'জনেরই৷ এবং সেই দায় এড়িয়ে যাওয়া আইনের চোখে অপরাধই৷
সেই ভাবে জাতীয় পরিসংখ্যান কিছু পাওয়া না-গেলেও কেরলের তফশিলি জাতি ও উপজাতি বিভাগের করা একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে রাজ্যে অবিবাহিত মায়ের সংখ্যা কম করে ৫৬৩৷ অন্য দিকে, কেরল মহিলা কমিশনের হিসেব বলছে এই সংখ্যাটি দু'হাজারেরও বেশি৷ ডেপুটি পুলিশ ইন্সপেক্টর-জেনারেল এস শ্রীজিত একটি তদন্ত চালিয়ে দেখেছেন ওই রাজ্যের উপজাতি এলাকায় রয়েছেন হাজারেরও বেশি সংখ্যক অবিবাহিত মা৷ কেরল মহিলা কমিশনের পর্যবেক্ষণ, অবিবাহিত মায়েদের অধিকাংশের বয়সই ১৪ থেকে ২০-এর মধ্যে৷ এবং বাস্তব এটাও, এই মায়েরা নিজেদের এবং সন্তানদের বাঁচাতে অধিকাংশই 'বেশ্যাবৃত্তি' বেছে নিতে বাধ্য হয়৷
বাস্তবের আরও একটি দিক রয়েছে৷ দেখা গিয়েছে, অবিবাহিত মায়েদের অনেকেই দলিত অথবা উপজাতি সম্প্রদায়ের৷ ঐতিহাসিক ভাবেই এটা সত্য৷ আজও৷ এর মূলে রয়েছে জাতপাতের চূড়ান্ত বৈষম্য৷ কারণ, এই দলিত বা উপজাতি মেয়েদের শরীর ভোগ করে উচ্চবর্ণের পুরুষেরা৷ যারা এই মেয়েদের কখনওই বিয়ে করে না, সন্তানের দায়িত্ব নেওয়া তো দূরস্থান৷ ভোগশেষে এই মেয়েরা নিক্ষিপ্ত হয়, নিজেদের টিকিয়ে রাখতে তারপর দেহব্যবসা ভিন্ন আর কোনও পথ খোলা থাকে না৷ আর তাদের ছেলেমেয়েরা? তারাই হল দেশের সবথেকে সস্তায় পাওয়া শ্রমিক! বলা যায়, এর উপরই দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারতের তামাম অর্থনীতি৷
মেয়েদের এই সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি কারনানের রায়টি গভীর সমবেদনার পরিচয় দেয়৷ ভারতের প্রাচীন সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ঘরানার চিন্তা-ভাবনার দ্বন্দ্ব, সেখান থেকে উত্তীর্ণ হয়ে কালজয়ী কোনও সত্যে পৌঁছবার চেষ্টা রয়েছে৷ রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ কিংবা উপনিষদে বিবিধ সংস্কৃতি ও বিভিন্ন আদর্শের এই সংঘাত বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়৷ পিতৃতান্ত্রিক, উচ্চবর্গীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে, ঠিক করা হয়েছে, কোনটি ঠিক, কোনটিই বা ভুল, একই ভাবে বিভিন্ন দলিত ও উপজাতি তথা নিম্নবর্গীয়দের জায়গায় দাঁড়িয়েও উচিত-অনুচিত স্থির করা হয়েছে৷ দেখা গিয়েছে, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন আইন কিংবা নীতিশাস্ত্রকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে৷ একটা আইন ভেঙে তৈরি হয়েছে অন্য একটি আইন৷ এই ভাঙাগড়ার পর্ব যুগে যুগে অব্যাহত থেকেছে৷
উপনিষদে যেমন ঋষি গৌতম কুমারী মাতা জাবালাকে রীতিমতো শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখেছেন৷ জাবালা-পুত্র সত্যকামের বড়ো হয়ে ওঠার যাবতীয় সামাজিক দায়-দায়িত্ব নিয়েছেন গৌতম৷ শুধু তা-ই নয়, মাতা-পুত্র যাতে সচ্ছল ভাবে, স্বাধীন ভাবে বসবাস করতে পারে, সে জন্য জাবালাকে ঋষি ১০০টি গাভী দান করেন৷ অন্য দিকে, তুলসী রামায়ণে রামচন্দ্র সীতাকে গ্রহণ করতেই চাননি, কারণ, রাজ্যবাসীদের একজন সীতাপুত্র লব-কুশের পিতা কে, এই নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন৷ তফাতটা এখানেই৷ দৃষ্টিভঙ্গির তফাত৷ বিচারপতি কারনানের রায়টি নানা দিক থেকে মেয়েদের পক্ষে স্বস্তিজনক, প্রগতিশীলও৷ কোনও মেয়ে যদি চায়, প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কের জেরে জন্ম নেওয়া সন্তানের দেখাশোনার দায়িত্ব প্রেমিকটিও নিক, তা হলে আইন মেয়েটির পাশেই রয়েছে৷ অন্য দিকে, এমন হতেই পারে, সে সন্তান চাইল, প্রেমিককেও চাইল সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে, কিন্ত্ত কোনও কারণে ওই পুরুষটিকে 'বিয়ে' করতে চাইল না৷ আইন তখনও মেয়েটির পাশেই থাকবে৷
আমাদের দেশে এ রকমও ঘটে৷ কোনও মেয়ে ধর্ষিতা হলে পারিবারিক চাপাচাপিতে মেয়েটি অনেক সময় তার ধর্ষককেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়৷ পুরুষতন্ত্র এমন জাল বিছিয়ে রেখেছে, এখনও অনেক ক্ষেত্রে মনে করা হয়, কোনও মেয়ের 'কৌমার্য' যে পুরুষ প্রথম 'হরণ' করে, সেই পুরুষেরই অধিকার তৈরি হয় মেয়েটির শরীরের উপর৷ আর মেয়েদের আত্মার খবর কে কবে রেখেছে! এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ধর্ষকের সঙ্গে বাড়ির মেয়ের বিয়ে দিতে পারলেই ধন্য হয়ে যান অভিভাবকরা৷ পুরুষটিও সমাজে দিব্যি মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ায়৷ কারণ এর উল্টো ছবিটাও সমান মর্মান্তিক৷ 'একা মা' সমাজে সন্তানকে মানুষ করতে হিমশিম খেতে থাকেন, দারিদ্র এক দিকে, অন্য দিকে সামাজিক কলঙ্ক৷ সব মিলিয়ে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে মায়ের জীবন৷
আজকের সমাজে কোনও যৌন সম্পর্কে পুরুষের দায়িত্ব কতটুকু? এক, বিয়ের মাধ্যমে থাকার জায়গা করে দেওয়া মেয়েটিকে, বড়জোর যৌন সম্পর্কের সময়ে কন্ডোম ব্যবহার করা৷ আজকের দিনেও মনে করা হয়, প্রাক্-বিবাহ যৌন সম্পর্কের পর 'বিয়ে' হল মেয়েটির কাছে সেই অসামান্য ঘটনা, যা কি না, পুরুষটি তাকে 'উপহার' দিচ্ছে৷ বিয়েতে সম্মত হওয়া মানে পুরুষটির চূড়ান্ত বদান্যতা প্রকাশ পাওয়া৷ কারণ বিয়ের মাধ্যমেই স্বামীর বাড়ি ও সম্পত্তির প্রতি আইনি অধিকার জন্মায় মেয়েটির৷ নিজের টিকে থাকার জন্য এবং সন্তানদের বড়ো করে তোলার জন্য যা জরুরি৷ বহু সন্তান ও তাদের মায়েদের কাছে বিয়ের সঙ্গে বৈধতার সম্পর্কটা একেবারেই প্রত্যক্ষ৷ হয়তো বিয়ের প্রয়োজনীয়তাও সেইখানেই৷ বিয়েতে পুরুষের সম্মতি তাই শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় একটি ব্রহ্মাস্ত্র৷ যা দিয়ে পুতুলের মতো খেলানো যাবে মেয়েদের৷
বিচারপতি কারনানের নির্দেশ অবশ্য ভিন্ন ধরনের নজিরও সৃষ্টি করতেই পারে৷ অন্তত সেই নজির তৈরির আশঙ্কা একটা থেকেই যায়৷ বহু মহিলা এর অপপ্রয়োগ ঘটাতে পারেন৷ বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে বা ভিতরে থেকে পুরুষদের উপর অন্যায় অভিযোগ করারও একটা আশঙ্কা তৈরি হয়৷ কিন্ত্ত সেই আশঙ্কা সত্ত্বেও কোনও একটা জায়গা থেকে শুরু তো করতে হবে! মাতৃত্ব এবং পিতৃত্ব- দুই-ই যাতে সমান ভার পায়, সেই ব্যবস্থার দিকে এগোতে হবে৷ প্রগতির, উন্নততর সমাজের চাবিকাঠিটি সেখানেই লুকনো আছে৷ পিতৃত্ব মানে নিছক আর্থিক ভার বহনই নয়, সন্তান লালনের সঙ্গে আরও সরাসরি যুক্ত থাকা৷ শিশুর যত্নে বাবারা যত বেশি সময় ব্যয় করবেন, ততই সহিষ্ণুতা, সহানুভূতির মতো মানবিক হৃদয়বৃত্তি বিকাশ পাবে৷ শিশুরা একটি অনুকূল পরিবেশ পাবে, যেখানে মানসিক শান্তি মিলবে, অকারণ হিংসার প্রবণতা দূর হবে৷ পরিবারের মধ্যেও নিগ্রহ ও অশান্তির পরিমণ্ডল থাকবে না৷
অনেক সময়েই কোনও আইনি পরিবর্তন বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তন আনতে সমর্থ হয়৷ আইনি পরিকাঠামোর মধ্যে সামাজিক বহু ছোটখাটো বিষয় কখনও কখনও বৈধতা পায়৷ আবার অনেক বৈধ বিষয়ও অবৈধ বলে ঘোষিত হয়৷ ব্রিটিশ আইনে সমকামিতাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়েছিল৷ তার জেরে আজও নানা রকম সামাজিক হয়রানির মধ্যে কাটাতে হয় সমকামীদের৷ পাশাপাশি, এই যে দেহব্যবসায়ীদের সম্পর্কে আমাদের একটা সাধারণ ধারণা কাজ করে যে তারা 'খারাপ', সেটাও আইনেরই অবদান৷ অথচ যে পুরুষেরা ওই মেয়েদের কাছে যান, তাঁরা নিছকই পুরুষ৷ 'ভালো', 'মন্দ' কোনও তকমা সমাজ তাঁদের গায়ে এঁটে দেয় না৷ প্রকাশ্যে সেই মেয়েদের অপমানজনক ভাবে গ্রেফতার করা হয়৷ কিন্ত্ত তাঁদের খদ্দের বা দালালরা কখন, কোথায় ধরা পড়ল, আদৌ ধরা পড়ল কি না, তা কত জন দেখতে পান? ক্রিমিনাল রেকর্ডস বরাদ্দ হয় মেয়েদের জন্যই৷ সমাজে কোনও পেশাকে কিংবা কোনও সম্পর্ককে কোন চোখে দেখা হবে, সেটা তাই শেষ পর্যন্ত ঠিক করে দেয় আইনই৷
মাদ্রাজ হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়টি যৌনতা, সম্পর্ক, বিয়ে, পিতৃত্ব ইত্যাদি প্রসঙ্গে বিতর্কের ঢেউ তুলতে পারে৷ কিন্ত্ত এই বিতর্কই এক উন্নততর ভারত নির্মাণের পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেবে৷ যে সমাজে লিঙ্গ-বৈষম্য অপেক্ষাকৃত কম৷ যে সমাজ অনেকটা সুইডেনের মতো৷ যে দেশে অবিবাহিত মায়েরা সন্তান বড়ো করার যাবতীয় খরচ পেয়ে যান সরকারি তহবিল থেকেই৷ সন্তানের বাবারা সেই খরচ আংশিক ভাবে বা পূর্ণ ভাবে মিটিয়ে দিতে বাধ্য থাকেন৷ অর্থাত্ সন্তান ধারণ সেই দেশে কোনও 'অভিশাপ' নয়৷ অস্বাভাবিকও নয়৷
লেখক 'আপনে আপ' সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা
সত্তরের দশকের সেই বচ্চন-যুগ৷ একের-পর-এক সুপারহিট ছবির মূল কাহিনি-কাঠামোটি ঠিক কী রকম ছিল? চিরকালীন মাতৃরূপা নিরুপা রায়৷ স্বামী বা প্রেমিকের দ্বারা প্রতারিতা বা পরিত্যক্তা৷ দুই সন্তানের জননী তিনি৷ এবং 'বাবা'টি যেহেতু পলাতক, সন্তানদের দায়িত্ব বর্তেছে একা মায়েরই উপর৷ মুখে রক্ত তুলে মা মানুষ করেন দুই পুত্রকে৷ একজন বনে যায় দুষ্কৃতী, অন্য জন পুলিশ অফিসার৷ সমাজের কাছে দু'জনেই দু'পথে ন্যায়প্রার্থী৷ এ সেই সমাজ, যে একজনকে পুরুষকে স্বেচ্ছায় চূড়ান্ত শক্তি দিয়েছে, যে শক্তির উপর ভর করে সেই পুরুষ সন্তান তো উত্পাদন করে, কিন্ত্ত সন্তানদের লালন-পালনের ভার এড়িয়ে যায়৷
এই সব ছবির মূল কাহিনি সেই সব মায়ের গল্প বলে, যাদের অপরাধ, তারা কোনও না কোনও সময়ে পুরুষ সঙ্গীটির উপর ভরসা করেছিল৷ বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখে অথবা বিয়ের অপেক্ষা না-রেখেই সেই পুরুষের সন্তানের মা হয়েছে৷ তারপর থেকে সন্তান-সহ পরিত্যক্তা সেই সব মা৷ পুরুষটির দায়িত্বজ্ঞানহীনতার মূল্য চুকিয়ে যেতে হয় মেয়েটিকেই৷ এই দেশে আজও কত মা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়, সমাজও তাদের পাশে দাঁড়ায় না৷ আর্থিক, সামাজিক দু'দিক থেকেই বিপন্ন এই মেয়েরা কুণ্ঠিত ভাবে বেঁচে থাকে, কোনওক্রমে৷ অথচ মূল অপরাধী যে পুরুষ, যে 'বিয়ে' নামক স্বীকৃতিটিও দেয় না, সন্তানের দায়ভারও অস্বীকার করে, সে বেঁচে থাকে মাথা উঁচু করে৷
এই চিরকালীন সামাজিক ব্যাধিটির মূলে প্রথম সে ভাবে আঘাত হানল মাদ্রাজ হাইকোর্ট৷ এক মহিলা, প্রেমিকের সন্তান গর্ভে ধারণ করেন, দু'টি সন্তানও হয়, যথারীতি এরপর 'বাবা'টি দায় নিতে অস্বীকার করে৷ রায় ঘোষণার সময় বিচারপতি সি এস কারনান নির্দেশ দেন, ওই পুরুষটিকে সন্তান রক্ষণাবেক্ষণের দায় নিতে হবে৷ পাশাপাশি, নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হলে তাকে বিয়ের সমতুল ঘোষণা করার কথাও এই রায়ে বলা হয়৷ তা হলে অন্তত সন্তানের দায় নিতে পুরুষটিকে বাধ্য করা যাবে৷ এবং এই রায় এই কথা আরও একবার প্রমাণ করল, যৌন সম্পর্কে যেমন নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মতি জরুরি, একই ভাবে সন্তান লালনের দায়িত্বও বাবা-মা দু'জনেরই৷ এবং সেই দায় এড়িয়ে যাওয়া আইনের চোখে অপরাধই৷
সেই ভাবে জাতীয় পরিসংখ্যান কিছু পাওয়া না-গেলেও কেরলের তফশিলি জাতি ও উপজাতি বিভাগের করা একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে রাজ্যে অবিবাহিত মায়ের সংখ্যা কম করে ৫৬৩৷ অন্য দিকে, কেরল মহিলা কমিশনের হিসেব বলছে এই সংখ্যাটি দু'হাজারেরও বেশি৷ ডেপুটি পুলিশ ইন্সপেক্টর-জেনারেল এস শ্রীজিত একটি তদন্ত চালিয়ে দেখেছেন ওই রাজ্যের উপজাতি এলাকায় রয়েছেন হাজারেরও বেশি সংখ্যক অবিবাহিত মা৷ কেরল মহিলা কমিশনের পর্যবেক্ষণ, অবিবাহিত মায়েদের অধিকাংশের বয়সই ১৪ থেকে ২০-এর মধ্যে৷ এবং বাস্তব এটাও, এই মায়েরা নিজেদের এবং সন্তানদের বাঁচাতে অধিকাংশই 'বেশ্যাবৃত্তি' বেছে নিতে বাধ্য হয়৷
বাস্তবের আরও একটি দিক রয়েছে৷ দেখা গিয়েছে, অবিবাহিত মায়েদের অনেকেই দলিত অথবা উপজাতি সম্প্রদায়ের৷ ঐতিহাসিক ভাবেই এটা সত্য৷ আজও৷ এর মূলে রয়েছে জাতপাতের চূড়ান্ত বৈষম্য৷ কারণ, এই দলিত বা উপজাতি মেয়েদের শরীর ভোগ করে উচ্চবর্ণের পুরুষেরা৷ যারা এই মেয়েদের কখনওই বিয়ে করে না, সন্তানের দায়িত্ব নেওয়া তো দূরস্থান৷ ভোগশেষে এই মেয়েরা নিক্ষিপ্ত হয়, নিজেদের টিকিয়ে রাখতে তারপর দেহব্যবসা ভিন্ন আর কোনও পথ খোলা থাকে না৷ আর তাদের ছেলেমেয়েরা? তারাই হল দেশের সবথেকে সস্তায় পাওয়া শ্রমিক! বলা যায়, এর উপরই দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারতের তামাম অর্থনীতি৷
মেয়েদের এই সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি কারনানের রায়টি গভীর সমবেদনার পরিচয় দেয়৷ ভারতের প্রাচীন সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ঘরানার চিন্তা-ভাবনার দ্বন্দ্ব, সেখান থেকে উত্তীর্ণ হয়ে কালজয়ী কোনও সত্যে পৌঁছবার চেষ্টা রয়েছে৷ রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ কিংবা উপনিষদে বিবিধ সংস্কৃতি ও বিভিন্ন আদর্শের এই সংঘাত বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়৷ পিতৃতান্ত্রিক, উচ্চবর্গীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে, ঠিক করা হয়েছে, কোনটি ঠিক, কোনটিই বা ভুল, একই ভাবে বিভিন্ন দলিত ও উপজাতি তথা নিম্নবর্গীয়দের জায়গায় দাঁড়িয়েও উচিত-অনুচিত স্থির করা হয়েছে৷ দেখা গিয়েছে, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন আইন কিংবা নীতিশাস্ত্রকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে৷ একটা আইন ভেঙে তৈরি হয়েছে অন্য একটি আইন৷ এই ভাঙাগড়ার পর্ব যুগে যুগে অব্যাহত থেকেছে৷
উপনিষদে যেমন ঋষি গৌতম কুমারী মাতা জাবালাকে রীতিমতো শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখেছেন৷ জাবালা-পুত্র সত্যকামের বড়ো হয়ে ওঠার যাবতীয় সামাজিক দায়-দায়িত্ব নিয়েছেন গৌতম৷ শুধু তা-ই নয়, মাতা-পুত্র যাতে সচ্ছল ভাবে, স্বাধীন ভাবে বসবাস করতে পারে, সে জন্য জাবালাকে ঋষি ১০০টি গাভী দান করেন৷ অন্য দিকে, তুলসী রামায়ণে রামচন্দ্র সীতাকে গ্রহণ করতেই চাননি, কারণ, রাজ্যবাসীদের একজন সীতাপুত্র লব-কুশের পিতা কে, এই নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন৷ তফাতটা এখানেই৷ দৃষ্টিভঙ্গির তফাত৷ বিচারপতি কারনানের রায়টি নানা দিক থেকে মেয়েদের পক্ষে স্বস্তিজনক, প্রগতিশীলও৷ কোনও মেয়ে যদি চায়, প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কের জেরে জন্ম নেওয়া সন্তানের দেখাশোনার দায়িত্ব প্রেমিকটিও নিক, তা হলে আইন মেয়েটির পাশেই রয়েছে৷ অন্য দিকে, এমন হতেই পারে, সে সন্তান চাইল, প্রেমিককেও চাইল সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে, কিন্ত্ত কোনও কারণে ওই পুরুষটিকে 'বিয়ে' করতে চাইল না৷ আইন তখনও মেয়েটির পাশেই থাকবে৷
আমাদের দেশে এ রকমও ঘটে৷ কোনও মেয়ে ধর্ষিতা হলে পারিবারিক চাপাচাপিতে মেয়েটি অনেক সময় তার ধর্ষককেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়৷ পুরুষতন্ত্র এমন জাল বিছিয়ে রেখেছে, এখনও অনেক ক্ষেত্রে মনে করা হয়, কোনও মেয়ের 'কৌমার্য' যে পুরুষ প্রথম 'হরণ' করে, সেই পুরুষেরই অধিকার তৈরি হয় মেয়েটির শরীরের উপর৷ আর মেয়েদের আত্মার খবর কে কবে রেখেছে! এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ধর্ষকের সঙ্গে বাড়ির মেয়ের বিয়ে দিতে পারলেই ধন্য হয়ে যান অভিভাবকরা৷ পুরুষটিও সমাজে দিব্যি মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ায়৷ কারণ এর উল্টো ছবিটাও সমান মর্মান্তিক৷ 'একা মা' সমাজে সন্তানকে মানুষ করতে হিমশিম খেতে থাকেন, দারিদ্র এক দিকে, অন্য দিকে সামাজিক কলঙ্ক৷ সব মিলিয়ে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে মায়ের জীবন৷
আজকের সমাজে কোনও যৌন সম্পর্কে পুরুষের দায়িত্ব কতটুকু? এক, বিয়ের মাধ্যমে থাকার জায়গা করে দেওয়া মেয়েটিকে, বড়জোর যৌন সম্পর্কের সময়ে কন্ডোম ব্যবহার করা৷ আজকের দিনেও মনে করা হয়, প্রাক্-বিবাহ যৌন সম্পর্কের পর 'বিয়ে' হল মেয়েটির কাছে সেই অসামান্য ঘটনা, যা কি না, পুরুষটি তাকে 'উপহার' দিচ্ছে৷ বিয়েতে সম্মত হওয়া মানে পুরুষটির চূড়ান্ত বদান্যতা প্রকাশ পাওয়া৷ কারণ বিয়ের মাধ্যমেই স্বামীর বাড়ি ও সম্পত্তির প্রতি আইনি অধিকার জন্মায় মেয়েটির৷ নিজের টিকে থাকার জন্য এবং সন্তানদের বড়ো করে তোলার জন্য যা জরুরি৷ বহু সন্তান ও তাদের মায়েদের কাছে বিয়ের সঙ্গে বৈধতার সম্পর্কটা একেবারেই প্রত্যক্ষ৷ হয়তো বিয়ের প্রয়োজনীয়তাও সেইখানেই৷ বিয়েতে পুরুষের সম্মতি তাই শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় একটি ব্রহ্মাস্ত্র৷ যা দিয়ে পুতুলের মতো খেলানো যাবে মেয়েদের৷
বিচারপতি কারনানের নির্দেশ অবশ্য ভিন্ন ধরনের নজিরও সৃষ্টি করতেই পারে৷ অন্তত সেই নজির তৈরির আশঙ্কা একটা থেকেই যায়৷ বহু মহিলা এর অপপ্রয়োগ ঘটাতে পারেন৷ বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে বা ভিতরে থেকে পুরুষদের উপর অন্যায় অভিযোগ করারও একটা আশঙ্কা তৈরি হয়৷ কিন্ত্ত সেই আশঙ্কা সত্ত্বেও কোনও একটা জায়গা থেকে শুরু তো করতে হবে! মাতৃত্ব এবং পিতৃত্ব- দুই-ই যাতে সমান ভার পায়, সেই ব্যবস্থার দিকে এগোতে হবে৷ প্রগতির, উন্নততর সমাজের চাবিকাঠিটি সেখানেই লুকনো আছে৷ পিতৃত্ব মানে নিছক আর্থিক ভার বহনই নয়, সন্তান লালনের সঙ্গে আরও সরাসরি যুক্ত থাকা৷ শিশুর যত্নে বাবারা যত বেশি সময় ব্যয় করবেন, ততই সহিষ্ণুতা, সহানুভূতির মতো মানবিক হৃদয়বৃত্তি বিকাশ পাবে৷ শিশুরা একটি অনুকূল পরিবেশ পাবে, যেখানে মানসিক শান্তি মিলবে, অকারণ হিংসার প্রবণতা দূর হবে৷ পরিবারের মধ্যেও নিগ্রহ ও অশান্তির পরিমণ্ডল থাকবে না৷
অনেক সময়েই কোনও আইনি পরিবর্তন বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তন আনতে সমর্থ হয়৷ আইনি পরিকাঠামোর মধ্যে সামাজিক বহু ছোটখাটো বিষয় কখনও কখনও বৈধতা পায়৷ আবার অনেক বৈধ বিষয়ও অবৈধ বলে ঘোষিত হয়৷ ব্রিটিশ আইনে সমকামিতাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়েছিল৷ তার জেরে আজও নানা রকম সামাজিক হয়রানির মধ্যে কাটাতে হয় সমকামীদের৷ পাশাপাশি, এই যে দেহব্যবসায়ীদের সম্পর্কে আমাদের একটা সাধারণ ধারণা কাজ করে যে তারা 'খারাপ', সেটাও আইনেরই অবদান৷ অথচ যে পুরুষেরা ওই মেয়েদের কাছে যান, তাঁরা নিছকই পুরুষ৷ 'ভালো', 'মন্দ' কোনও তকমা সমাজ তাঁদের গায়ে এঁটে দেয় না৷ প্রকাশ্যে সেই মেয়েদের অপমানজনক ভাবে গ্রেফতার করা হয়৷ কিন্ত্ত তাঁদের খদ্দের বা দালালরা কখন, কোথায় ধরা পড়ল, আদৌ ধরা পড়ল কি না, তা কত জন দেখতে পান? ক্রিমিনাল রেকর্ডস বরাদ্দ হয় মেয়েদের জন্যই৷ সমাজে কোনও পেশাকে কিংবা কোনও সম্পর্ককে কোন চোখে দেখা হবে, সেটা তাই শেষ পর্যন্ত ঠিক করে দেয় আইনই৷
মাদ্রাজ হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়টি যৌনতা, সম্পর্ক, বিয়ে, পিতৃত্ব ইত্যাদি প্রসঙ্গে বিতর্কের ঢেউ তুলতে পারে৷ কিন্ত্ত এই বিতর্কই এক উন্নততর ভারত নির্মাণের পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেবে৷ যে সমাজে লিঙ্গ-বৈষম্য অপেক্ষাকৃত কম৷ যে সমাজ অনেকটা সুইডেনের মতো৷ যে দেশে অবিবাহিত মায়েরা সন্তান বড়ো করার যাবতীয় খরচ পেয়ে যান সরকারি তহবিল থেকেই৷ সন্তানের বাবারা সেই খরচ আংশিক ভাবে বা পূর্ণ ভাবে মিটিয়ে দিতে বাধ্য থাকেন৷ অর্থাত্ সন্তান ধারণ সেই দেশে কোনও 'অভিশাপ' নয়৷ অস্বাভাবিকও নয়৷
লেখক 'আপনে আপ' সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা
No comments:
Post a Comment