বল বীর -
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর -
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন "আরশ" ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!
মম ললাটে রুদ্র-ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর -
আমি চির-উন্নত শির!
আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!
আমি দুর্ব্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল!
আমি মানি নাকো কোনো আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,
ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
বল বীর -
চির উন্নত মম শির!
আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণী,
আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী!
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠুমকি' ছমকি'
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি'
ফিং দিয়া দিই তিন দোল্!
আমি চপলা-চপল হিন্দোল!
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা',
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি উদ্দাম, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর।
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর।
বল বীর -
আমি চির-উন্নত শির!
আমি চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ,
আমি দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্
ভরপুর মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি!
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য,
মম এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য।
আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর -
চির উন্নত মম শির।
আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক!
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্ত্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ-প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব!
আমি প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস, – আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি কভু প্রশান্ত, – কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী!
আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল!
আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি।
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধাতার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর!
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত
বুকে গতি ফের!
আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত- চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক'রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা'র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্।
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীনে গান গাওয়া!
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র রবি,
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! -
আমি তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে
সব বাঁধ!
আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন!
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ-মর্ত্ত্য করতলে,
তাজি বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেস্বা হেঁকে চলে!
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথর-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ,
আণি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি' ভূমি-কম্প!
ধরি বাসুকির ফনা জাপটি', -
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি'!
আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা- সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্
ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্
মম বাঁশরী তানে পাশরি'
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠে' যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হারিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরণীরে করি বরণিয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা -
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি মৃণ্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির দুর্জ্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্ত্য
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে
সব বাঁধ!!
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম স্কন্ধে,
আমি উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি আমি সেই দিন হব শান্ত!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর -
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৪ তম জন্ম জয়ন্তী আজঃ সাম্য, দ্রোহ আর প্রেমের কবির জন্মদিনে শুভেচ্ছা
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙ্গালি মনীষার এক মহত্তম বিকাশ। বাঙালির সৃষ্টিশীলতার এক তুঙ্গীয় নিদর্শন। সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রায় সর্বক্ষেত্রে তাঁর দৃপ্ত পদাচারণা। নজরুল তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভার স্পর্শে বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীতে যুক্ত করেছেন যুগ-মাত্রা।
সাম্য, দ্রোহ আর প্রেমের কবি, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাণ পুরুষ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৪ তম জন্ম জয়ন্তী আজ। মানবতার অগ্রদূত কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন । তবে বাংলাদেশের সঙ্গে বালক বয়স থেকে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত ছিল কবির গভীর সম্পর্ক। পিতৃহীন, সহায়-সম্বলহীন বালক নজরুলকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে তাকে মানুষ করে গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে, কবিকে মৈমনসিংহের এক পল্লীগ্রামে নিয়ে এসেছিলেন বর্ধমানে কর্মরত ওই গ্রামের এক পুলিশ অফিসার।
এক হাতে বাঁশের বাঁশরী, আরেক হাতে রণতূর্য নিয়ে ধুমকেতুর মতোই বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব হয়েছিলেন কবি নজরুল। তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার, শিল্পী, অভিনেতা, এবং পরিচালক। সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতিটি ধারায় তিনি ছিলেন সমুজ্জল। সাহিত্যকর্মে অসামান্য অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় 'জগত্তারিণী স্বর্ণ-পদক, ভারত সরকার'পদ্মভূষণ', রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 'ডি. লিট ডিগ্রীএবং বাংলাদেশ সরকার তাঁকে 'একুশে পদক প্রদান করেন। তাঁর লেখা গানের সংখ্যা প্রায় তিন হাজারের মত।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক বাংলার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনাবসান ঘটে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্রের চির ভাস্বর ও চির অম্লান জাতীয় কবির আজ জন্মদিন। সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে আজীবন নিবেদিত এই অমর কবির জন্মদিনে তাঁকে স্মরন করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবসায়।
(বিঃদ্রঃ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ, যুগস্রষ্টাম বিদ্রোহী কবি এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নাজরুল ইসলামের জন্ম-মৃত্যু ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আমরা সবাই কম বেশী ওয়াকিবহাল। তাই অধিক লিখে পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটানো থেকে বিরত থেকে স্বল্পপরিসরে তাঁর জন্ম দিনে আমার এই স্মৃতিচারণ, শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা নিবেদন)
শনিবার ফের নজরুল তীর্থ তৈরির কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষমতায় এসেই সল্টলেকের ইন্দিরাভবনে নজরুল ইসলামের নামে গবেষণাগার তৈরির কথা ঘোষণা করেছিল তৃণমূল সরকার। ইন্দিরা ভবনের নাম বদল করে নজরুল ভবন করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে রাজনৈতিক চাপে পড়ে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয় সরকারকে। নজরুল তীর্থ কোথায় তৈরি হবে তা স্পষ্ট করেননি মুখ্যমন্ত্রী।সল্টলেকের ইন্দিরা ভবন। ক্ষমতায় এসেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, ইন্দিরা ভবনেই হবে নজরুল ইসলাম গবেষণাগার।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় তীব্র প্রতিবাদ জানায় কংগ্রেস। চলতে থাকে দফায় দফায় বিক্ষোভ।
অবশেষে সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসতে হয় মুখ্যমন্ত্রীকে।
শনিবার আবার নজরুল তীর্থ করার কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। দায়িত্বে ফিরহাদ হাকিম। তবে কোথায় হবে, গোপন রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী।
আবারও কী ইন্দিরা ভবনেই। এবার একেবারে গোপনে? জল্পনার শুরু।
টিউন করেছেন : হারুন | প্রকাশিত হয়েছে : 25 May, 2011
কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ - দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়।
আমার সংগ্রহে কাজী নজরুল ইসলামের ২০টি বই আছে। বইগুলো হচ্ছেঃ
বিশের বাঁশ
সঞ্চিতা
বনগীতি
জিঞ্জীর
ঝড়
মরুভাস্কর
বাদল বরষনে
ব্যথার দান
ঘুমের ঘোরে
হেনা
মৃত্যু ক্ষুধা
সর্বহারা
বুলবুল
সিন্দু হিন্দোল
শিউলিমালা
অগ্নিবীনা
চক্রবাক
সন্ধ্যা
কবিতা সমগ্র
ডাউনলোড করতে এখনি ক্লিক করুন
http://www.techtunes.com.bd/download/tune-id/71948
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সাধনা ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র
বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক, দৈনিক আজাদীর সাহিত্য সম্পাদক কবি অরুণ দাশ গুপ্ত বলেছেন, বাঙালির জীবনে অসাম্প্রদায়িক সমাজ আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যেটির স্বপ্ন দেখেছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রবীন্দ্রনাথের চিন্তাই যেমন ছিল অসাম্প্রদায়িকতা, সব ধর্মের মিলন, তেমনি নজরুলের চিন্তায়ও তা প্রকাশ পেয়েছে। হিন্দু-মুসলমানের মাঝে সু-সম্পর্ক বজায় রাখার প্রচেষ্টা এই দুই কবির মাঝে বিদ্যমান ছিল। পৃথিবীতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া জেলকাটা কবি আর নেই। লেখা-লেখির জন্য কবি নজরুলকে দুবার জেলে যেতে হয়েছিল। আমাদের বাঙালি জাতিসত্বা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ফসল। আজ ২৪ মে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫২ তম ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৪ তম জন্ম জয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে নগরীর চট্টগ্রাম একাডেমি মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট চট্টগ্রাম জেলার উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি একথা বলেন।
বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি অনুপ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কবি নাজিমুদ্দিন শ্যামল, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর, নারীনেত্রী ও জোটের সহ-সভাপতি এডভোকেট রেহেনা বেগম রানু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নেতা দেওয়ান মাকসুদ আহমেদ, কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা আবদুল মান্নান ফেরদৌস, সংগীত শিল্পী কাজল দত্ত, অচিন্ত্য কুমার দাশ, সাংবাদিক মনিরুল মনির, কানাডা প্রবাসী রুপম দাশ গুপ্ত, আবৃত্তি শিল্পী মসরুর হোসেন, জোটের সাধারণ সম্পাদক নিজামুল ইসলাম সরফী, সংস্কৃতিকর্মী খোরশেদ আলম, ছাত্রনেতা ইয়াছিন আরাফাত। সুপ্রভাত রাউজান সম্পাদক স ম জিয়াউর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন তানভীর আহমেদ রিংকু, মহিউল ইসলাম সোহেল, মোঃ মুকছুদ আলী, ফয়সাল বাপ্পী, সাইফুল ইসলাম, মোঃ শাকিল, মহিউদ্দিন মাহি, নুরুল আবছার, রেদোয়ানুল কবির সজিব, হুমায়ূন কবির, মোঃ রাশেদুল ইসলাম, মোঃ রাশেদ, মোঃ ফারুক, আলমগীর আলম, রিংকু ভট্টচার্য্য, রতন ঘোষ, ওসমান গণি, আহমেদুল কবির চৌধুরী রুবেল, মোসাদেকুল মাওলা, মোহাম্মদ জুনাইদ, রায়হান মোস্তফা সুমন, মোঃ রাশেদ প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কবি অরুণ দাশগুপ্ত আরো বলেন, রবীন্দ্রনাথের দেবতা ছিলেন মানুষ। বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষ, গ্রাম আর কৃষি উন্নয়নই ছিল রবীন্দ্রনাথের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে। রবীন্দ্রনাথের ধারাবাহিকতায় ফিরে এসেছিলেন নজরুল। রবীন্দ্র ভাবনায় প্রভাবিত ছিলেন নজরুল। গানের সংখ্যার দিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করে গিয়েছেন নজরুল।অ আজকের তরুণ সমাজকে রবীন্দ্র-নজরুলের ভাবাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দেশ গঠনে এগিয়ে আসার জন্য তিনি আহবান জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, রবীন্দ্র-নজরুল আমাদের জাতীয় সম্পদ। এদের মাঝেই আমরা সংস্কৃতির আলো ও মাধুর্য ফিরে পাই। রবীন্দ্র-নজরুলের চেতনা অনন্তকাল ধরে আমাদের হৃদয়ে জাগরুক থাকবে। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী মুন্নি নন্দী, কাজল দত্ত, সুকর্ণা পাল, তমা দেবী, নারায়ন দাশ। কবিতা আবৃত্তি করেন কবি করুণা আচার্য্য, মনিরুল মনির ও মসরুর হোসেন।
http://www.banglapostbd.com/?p=9694
স্বদেশী আন্দোলনে কবি নজরুল কার্পাসডাঙ্গায় এসে গঠন করেছিলেন শ্রমিক প্রজা কৃষক পাটি - See more at:
শামসুজ্জোহা পলাশ, চুয়াডাঙ্গা সংবাদদাতা ঃ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৪ তম জন্মবার্ষিকী নজরুলের বিচরণভূমি চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গায় পালিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে দামুড়হুদা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৃহস্প্রতিবার ও শনিবার ২ দিন সেখানে কবিতা পাঠ প্রতিযোগীতা, নজরুলের গান, শোভাযাত্রা, আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বৃহস্প্রতিবার সকাল ১০ টায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে শুরু হওয়া কাজী নজরুলের ১১৪ তম জন্মবার্ষিকী গতকাল (আজ) শনিবার দুপুর ২ টার দিকে শেষ হয়। শনিবার সকার ১০ টায় কার্পাসডাঙ্গা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে শোভাযাত্রা বের হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে নজরুলের জীবদ্দশায় যে সময়টা (১৯২৬-১৯২৭ সালে ২ মাস) কার্পাসডাঙ্গায় কাটান তা নিয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিশিষ্ট নজরুল গবেষক অধ্যাপক আব্দুল গফুরের সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোনিয়া আফরিন। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি সিরাজুল আলম ঝন্টু, সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মঞ্জু, সাংবাদিক মফিজ ইমাম মিলন, নজরুল জয়ন্তী উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক কার্পাসডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাশেম ও সেক্রেটারী সাইফুল ইসলাম।
আলোচনা সভায় বক্তারা, নজরুলের স্মৃতি রক্ষার্থে সকল স্মারক যথাযথ সংরক্ষণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। তারা আরও বলেন, খুলনা বিভাগের একমাত্র নজরুল স্মৃতি বিজড়িত স্থান চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার এ কার্পাসডাঙ্গা। এখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে নজরুল জন্মজয়ন্তী পালন, পর্যটনকেন্দ্রসহ নজরুল কমপ্লেক্স গড়ে তোলার দাবি জানানো হলেও এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের সে দাবি এখনও উপেক্ষিত রয়ে গেছে। আলোচনা শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
প্রসঙ্গ, চুয়াডাঙ্গার জেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের ভৈরব নদীর তীরে কবির স্মৃতিঘেরা দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গা। ১৯২৬ সালের শেষ দিকে বিপ্লবী হেমন্ত কুমার ও মহিম সরকারের আমন্ত্রণে স্বদেশী আন্দোলনে যোগদিতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম কোলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে স্ত্রী প্রমিলা, শাশুড়ী গ্রিবালা এবং পুত্র বুলবুলসহ স্বপরিবারে কার্পাসডাঙ্গার খ্রিষ্টান অধ্যুষিত পল্লীতে আসেন। কবি এখানে টানা ২ মাস অবস্থান করেন। কার্পাসডাঙ্গায় অবস্থান কালে তিনি রাতের বেলায় স্বদেশী আন্দোলন করতেন এবং দিনে জমিদারের দুই কন্যা শিউলি রাণী সরকার ও আভা রাণী সরকারকে গান শিখাতেন। নজরুল টানা দু মাস (১৯২৬-১৯২৭) এখানে অবস্থান করেন। সে সময়ে কবি নজরুল গঠন করেছিলেন শ্রমিক প্রজা কৃষক পাটি। মূলত স্বদেশি আন্দোলনের নেতাদের উৎসাহ দিতেই পার্টির পক্ষে কবি স্বপরিবারে কার্পাসডাঙ্গায় আসেন। কবি এখানে যে মাটির আটচালা ঘরে স্বপরিবারের থাকতেন, সে ঘরটি এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির মালিক তৎকালীন নদীয়া কংগ্রেসের সাধারণ স¤পাদক হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের উত্তরসূরীরা নিজ অর্থায়নে নজরুলের স্মৃতি ঘেরা বাড়িটি গত প্রায় ১০০ বছর ধরে অক্ষত রেখেছেন।
নজরুল গবেষক এম ইব্রাহিমের মতে, কার্পাসডাঙ্গায় অবস্থানকালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভৈরব নদীর পাড়ে বসে লেখালেখি করতেন। সেই ভৈরব নদ আজ মৃত প্রায়। কার্পাসডাঙ্গায় অবস্থান কালে কবি নজরুল তার সাহিত্যকর্ম, মৃত্যুক্ষুধা ও পদ্মগোখরো এবং লিচুচোর কবিতা, গান আমার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরি একোন সোনারগায় সহ বিখ্যাত কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও অসংখ্য গান লিখেছেন। # #
- প্রকাশিত হয়েছে জাতীয়
- 25 মে 2013
ঢাকা, ২৫ মে ২০১৩ (বাংলা-নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম): টিআইবির চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন,মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের কোনো ধরনের আপসকামিতা দেখতে চাই না। তিনি মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাস দমনে সরকারকে আরো কঠোর হবার আহ্বান জানান।
সুলতানা কামাল বলেন,একটি মহল স্বঘোষিত জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে পেছন থেকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। যা দেশকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। শনিবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে বজলুর রহমান ফাউন্ডেশন আয়োজিত সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা ও রাজনৈতিক সহিংসতা শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে হরতাল ও সহিংস রাজনীতির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং বিশিষ্টজনরা। ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খালেদের সভাপতিত্বে আরো বক্তব্য রাখেন, এফবিসিসিআইর সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ,জাসদ নেত্রী শিরীন আক্তার,সোহরাব হোসেন ও এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সুলতানা কামাল বলেন, অনেক বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী এখনো রাজনীতির বাইরে থেকে মন্তব্য করেন। যারা সাতে-পাঁচে কোনোটাতেই নেই। এভাবে নীরব থেকে পার পাওয়া যাবে না। যে কোনো এক জায়গায় থাকতে হবে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ প্রেমের পরিচয় দিতে হবে। সুশাসন ফিরিয়ে আনতে না পারলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদ মুক্ত দেশ গড়তে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এদেশে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সামরিকতন্ত্রের উত্থান হয়েছে। হেফাজতে ইসলামকে ব্যবহার করে দেশে অরাজকতা সৃষ্টিকারীরা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, গত ডিসেম্বর থেকে দেশে সহিংসতা শুরু হয়েছে। এই সহিংসতার কারণে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গামের্ন্টসসহ শিল্প- কারখানা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
কথায় কথায় হরতাল দিয়ে দেশকে আর ধ্বংস করবেন না। তিনি বলেন, বিরোধী দলীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়েছি। কিন্তু সাক্ষাতের অনুমতি পাইনি। সাক্ষাত পেলে বলতাম, দেশ ধ্বংস হয়ে গেলে রাজনীতি করবেন কোথায়। এখনো সময় আছে আলোচনা করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের উপায় বের করুন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন বলেন, জনস্বার্থে নয়, রাজনৈতিক এজেণ্ডা বাস্তবায়ন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতেই হরতাল ও রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটানো হচ্ছে।
দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে পরিকল্পিতভাবেই সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠি এসব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া রাজনৈতিক ডামাডোলের সুযোগ নিয়ে দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে বলেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও বিশিষ্টজনরা। নিরপেক্ষ থাকার নামে নিজেদের পিঠ না বাঁচিয়ে, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানান তারা।
ঢাকা, ২৫ মে ২০১৩ (বাংলা-নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম): প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের ভোট ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়ে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ১৫ ফেব্রুয়ারি ও মাগুরার মতো নির্বাচন এ দেশে আর হবে না।
তিনি বলেন, 'জনগণের ভোট ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে এবং এ দেশে আর কখনোই মাগুরা বা ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো নির্বাচন হবে না।'
তিনি আরো বলেন, সরকার ইতোমধ্যে জনগণের ভোটাধিকার, সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার সুসংহত করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, 'আমরা অন্তত এটা নিশ্চিত করতে চাই যে, জনগণ যাদের ভোট দেবে তারা যেনো ক্ষমতায় যেতে পারে।'
প্রধানমন্ত্রী পুনরায় বিরোধী দলীয় নেত্রীর প্রতি জাতীয় সংসদে যোগদান এবং সেখানে তারা যা চান তা বলার আহবান জানান।
তিনি বলেন, 'সংসদে আসুন এবং আপনি যা চান বলুন। কিন্তু জনগণকে হত্যা, সরকারি ও বেসরকারি সম্পদে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের মতো জঘন্য কাজ করবেন না এবং জনগণের পেটে লাথি মারবেন না।'
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আজ সকালে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার সূচনা বক্তব্যে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন যে বর্তমান সরকারের আমলে গত সাড়ে চার বছরে জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদসহ ৫ হাজার ৬শ'রও বেশী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি বলেন, এসব নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্বাচনে কোনপ্রকার হস্তক্ষেপ করা হয়নি।
তিনি আরো বলেন, 'আমরা মাগুরা কিংবা ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো নির্বাচন না করায় কেউ এসব নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্নও তোলেনি।'
নির্বাচন কমিশন এখন পুরোপুরি স্বাধীন উল্লেখ করে শেখ হানিনা বলেন, প্রথমবারের মতো আলাপ-আলোচনা করে একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে এই ইসি গঠন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনার জন্য সকল রাজনৈতিক দলকে আহবান করেন এবং প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দল এ আলোচনায় অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন আহমেদ, দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম উপস্থিত ছিলেন।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন এই মতবিনিময় সভা পরিচালনা করেন। ২০১১ সালের শেষ দিকে শুরু হওয়া আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার অংশ হিসেবে আজ এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কর্মকর্তা, জাতীয় কমিটির সদস্য, দলীয় এমপি, কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসন কর্মকর্তা, দলের উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন ও পৌর শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরগণ সভায় অংশ নেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর কেউ যাতে সংবিধান লঙ্ঘন করে জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে সে লক্ষ্যে বর্তমান সরকার সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী এবং সংবিধান সংশোধন করেছেন।
তিনি বলেন, জেনারেল জিয়াই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল এবং জনগণের মৌলিক অধিকার হরন করে সংবিধান ক্ষত-বিক্ষত করেছিলেন। তিনি (জিয়া) মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠনকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও বন্ধ করেছিলেন।
শেখ হাসিনা যারা লাগামহীন দুর্নীতির আশ্রয়, জনগণের অর্থ আত্মসাৎ এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের জন্ম দিযেছিলেন তারা যাতে আবার ক্ষমতায় যেতে না পারে সেলক্ষ্যে তাদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতির কালো অধ্যায়ের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়েও খালেদা জিয়া দুর্নীতি করেছেন। কালো টাকা সাদা করাই এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, অপরদিকে বেগম জিয়ার দুই পুত্র দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত তাদের অর্থ বিদেশে পাচার করে।
বিরোধী দলীয় নেতার ৪৮ ঘণ্টা আল্টিমেটামের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে বেগম জিয়ার কাছে তিনি সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধী দলীয় নেত্রী এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং এর পরিবর্তে বর্তমান সরকারকে উৎখাতের জন্য ৪৮ ঘণ্টা আল্টিমেটাম ঘোষণা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেগম জিয়া আরো বলেছিলেন, তাদের দাবি পূরণ না করা হলে বর্তমান সরকার পালাবার পথ খুঁজে পাবে না।
শেখ হাসিনা বলেন, বিরোধী দলীয় নেত্রী হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে ঢাকাবাসীর প্রতি তাদের পাশে দাঁড়াবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমি বিরোধী দলের নেত্রীর কাছে জানতে চাই- কত লোক আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছিল?' তিনি বলেন, এমনকি তার ডাকে নিজ দলের নেতা-কর্মীরাও সাড়া দেয়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, বিরোধী দল যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য নিরীহ লোক হত্যা, লুটপাট, ভাঙচুর এবং সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি পোড়ানোসহ বিভিন্ন প্রকার ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে।
তিনি বলেন, বিএনপি কেবল সহিংস কার্যলাপেই লিপ্ত নয়, তারা সারাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালাবার জন্য হেফাজতে ইসলামকে সহায়তা দিচ্ছে। তিনি জানতে চান আন্দোলনের নামে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেয়ার অধিকার বিএনপির আছে কি-না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসকে শক্ত হাতে দমন করে দেশে শান্তি পূনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। তিনি বলেন, সরকার শান্তি শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করেছে। এছাড়া কৃষি, শিক্ষা, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, তথ্য প্রযুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অজিৃত হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জনগণ কিছু পায়, কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে তারা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতি ছাড়া আর কিছুই পায় না।
প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি জনগণের কাছে বর্তমান সরকারের সাফল্য তুলে ধরার পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান। তিনি তাদের প্রতি দলকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করার আহ্বান জানান।
জয়বাংলার কবি কাজী নজরুল ইসলাম
নজরুল ছিলেন শিক্ষানুরাগী। লেখাপড়ার জন্য তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তিনি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে সিয়ারসোল রাজ হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করতে থাকেন। কিন্তু সাংসারিক অভাব-অনটনের জন্য লেখাপড়া ছেড়ে যোগদান করেন নিমসা গ্রামের লেটোদলে। নিজে ছড়াগান লিখে সুর দিয়ে গাইতে লাগলেন আসরে আসরে। গাইতে লাগলেন 'চাষীর সঙ' 'রাজপুত্র', 'শকুনী বধ' কাব্য পালা। আসরের উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা মুগ্ধ হন নজরুলের দরাজ কণ্ঠে গান শুনে। নজরুল তাঁর প্রতিভাবলে লেটোদলে 'ক্ষুদে ওস্তাদজী' হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন। জনৈক এক রেলওয়ের গার্ড নজরুলের গান শুনে বিমোহিত হন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ঐ গার্ড নিজ বাড়িতে নজরুলকে খানসামার চাকরি দেন। কিছুদিন সেখানে কাজ করার পর নজরুল আসানসোলের এম. বকশের রুটির দোকানে এক টাকার বেতনে 'বয়গিরি' কাজে নিয়োজিত হন। এই সময় বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার কাজীর শিমলা গ্রামের পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর কাজী রফিজউল্লাহর সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। সুন্দর আচার-আচরণে নজরুল তাঁর স্নেহধন্য লাভ করতে সক্ষম হন। ১৯১৪ সালে কাজী রফিজউল্লাহ নিজ বাড়িতে নিয়ে এসে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। দরিরামপুর থেকে চলে এসে ভর্তি হন বর্ধমানের সিয়ারসোল রাজ হাই স্কুলে। নজরুল মেধাবী ছাত্র হিসেবে সাত টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই স্কুলে দশম শ্রেণীতে টেস্ট পরীক্ষা দেবার পরেই সেনাবাহিনীর ৪৯নং বাঙালি পল্টনে যোগদান করে তিনি করাচি চলে যান। সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় ১৯২৯ সালে মে সংখ্যায় 'সওগাত' পত্রিকায় 'বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী' প্রকাশের মাধ্যমে লেখকরূপে নজরুলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। নজরুলের লেখা 'মুক্তি' নামে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৩২৬ সালের শ্রাবণ সংখ্যায় 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য' পত্রিকায়।
১৯২০ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে বাঙালি পল্টন বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে নজরুল করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় এসে 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র অফিসে কমরেড মুজফফর আহমদ-এর সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন। এই সময় দু'বন্ধু মিলে সম্পাদনা করেন সান্ধ্য দৈনিক 'নবযুগ' পত্রিকা।
১৯২২ সালে ৬ জানুয়ারি সংখ্যায় 'বিজলি' পত্রিকায় নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতা প্রকাশিত হলে সারা ভারতবর্ষে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্যে এই বছরের ১২ আগস্ট তিনি সম্পাদনা করেন 'ধূমকেতু' নামে একটি অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা। ২৬ সেপ্টেম্বর 'ধূমকেতু' পত্রিকায় নজরুলের লেখা 'আনন্দময়ীর আগমনে' শীর্ষক কবিতাটি প্রকাশিত হয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার রাজদ্রোহের দায়ে নজরুলকে গ্রেফতার করে। ১৯২৩ সালে রাজদ্রোহীর মামলার আত্মপক্ষ সমর্থন করে নজরুলের কালজয়ী এক অনবদ্য বক্তব্য 'রাজবন্দীর জবানবন্দী' শিরোনামে প্রকাশিত হয় 'ধূমকেতু' পত্রিকায়। চীফ ম্যাজিস্ট্রেট কবি সুহান-হো-র কোর্টে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন নজরুল। কবি জেলের অভ্যন্তরে বসে লিখলেন অনবদ্য এক কাব্যগ্রন্থ 'দোলনচাঁপা'। ১৫ ডিসেম্বর নজরুল কারামুক্তি লাভ করেন। কারামুক্তির পর তিনি ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল মানিকগঞ্জের 'তেওতা' গ্রামের চাঁপাকান্তি ষোড়শী কন্যা আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে দোলন দেবী দুলির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। নজরুল ভালবেসে আশালতা সেনগুপ্তার নাম রেখেছিলেন 'প্রমীলা'। নজরুল দাম্পত্য জীবনে ছিলেন আজাদ কামাল (কৃষ্ণ মুহাম্মদ), বুলবুল সব্যসাচী, সানি ও অনিরুদ্ধ নিনি এই চার পুত্র সন্তানের জনক।
নজরুল সাহিত্যে, রাজনীতিতে, মননশীলতায়, সংগ্রামী চেতনায় জাতির জীবনে বয়ে এনেছেন মুক্তির দিশা। জাতিসত্তা বিকাশে নজরুলের অবদান অনন্য। তাই জাতির পক্ষ থেকে ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর অ্যালবার্ট হলে নজরুলকে এক সংবর্ধনা দেয়া হয়। এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু, অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন এস. ওয়াজেদ আলী।
১৯৪২ সালের ৯ জুলাই কলকাতা বেতারে ছোটদের আসরে গল্প বলতে বলতে কবির জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। তারপর ধীরে-ধীরে বাকশক্তি লোপ পায়। সত্যি একদিন চিরতরে কবির বাঁশী স্তব্ধ হয়ে যায়। কবি চির নির্বাক হয়ে পড়েন।
১৯৭২ সালের ২৪ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে কবি নজরুলকে কলকাতা থেকে ঢাকায় আনা হয়। পরদিন বিপুল উত্সাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করা হয় কবির ৭৪তম জন্ম-জয়ন্তী। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক কবিকে প্রদান করা হয় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। সেদিন জাতির পক্ষ থেকে কবি নজরুলের সামগ্রিক অবদানকে স্বীকৃতি প্রদান করে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থ কণ্ঠে বলেছিলেন: 'নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালির স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার।' ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ নজরুলকে একুশের পদকে ভূষিত করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি এই সোনার বাংলায় বেড়ে উঠেছেন একজন খাঁটি বাঙালির জীবনধারায়। দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কবি নজরুলের 'জয়বাংলা' শব্দমালা ধারণ করেন মনের মণিকোঠায়। পরবর্তী সময় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে 'জয়বাংলা' শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলার আকাশ-বাতাস। থর থর করে কেঁপে ওঠে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর ভিত!
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে 'জয় ধ্বনি' হিসেবে 'জয়বাংলা সমস্বরে উচ্চারিত হয় রণাঙ্গনে। 'জয়বাংলা' শব্দমালা প্রতিটি মুিক্তকামী মানুষের যুগিয়েছে শক্তি সাহস-উদ্দীপনা। 'জয়বাংলা' শব্দটি প্রথম প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই 'কাজী নজরুল ইসলামের 'ভাঙ্গার গান কাব্যগ্রন্থের পূর্ণ অভিনন্দন' শীর্ষক একটি কবিতায়। এই কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলাম মাদারীপুরের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামী নেতা পূর্ণচন্দ্রের জেলখানা থেকে মুক্তি উপলক্ষে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে রচনা করেন। কবিতাটির একটি অংশে কবি লেখেন:
'জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি অন্তরীণ,
জয় যুগে যুগে আসা সেনাপতি, জয় প্রাণ অন্তহীন'।
কবি নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী কবি,সাম্যের কবি, মানবতার কবি, দোলনচাঁপার কবি, ঝিঙ্গে ফুলের কবি, মুক্তিযুদ্ধের কবি। আবার অনেকে নজরুলকে 'জয় বাংলা'র কবি বলেও অভিহিত করে থাকেন। আগামী ১১ জ্যৈষ্ঠ কবি নজরুলের জন্ম-জয়ন্তী। কবির এই শুভ জন্ম-জয়ন্তী উপলক্ষে 'জয় বাংলা'র জয়ধ্বনি জাগ্রত হোক সমগ্র বাঙালির মনে-প্রাণে সংগ্রামী চেতনায়।
জন্ম জয়ন্তী অনুষ্ঠানে বাদশা /কাজী নজরুল ইসলামের চিন্তার আলোকে সমাজ গড়ার আহবান
স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য জননেতা ফজলে হোসেন বাদশা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিন্তার আলোকে সমাজ গড়ার আহবান জানিয়েছেন। গতকাল শনিবার বিকালে নগরীর টিটি কলেজ মিলনায়তনে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৪ তম জন্ম-জয়ন্তী উপলক্ষে নজরুল একাডেমী আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ আহবান জানান্ তিনি বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের চলার পথে আলোক বর্তিকা হিসাবে কাজ করবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে জাতীয় কবির দিয়েছেন। তিনি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলামের চর্চার দাবি জানান।
জননেতা ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহু প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন প্রেমিক। তিনি গণসঙ্গীত ও রণসঙ্গীত গেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। সে সময় সৈয়দা ও প্রমিলা দেবী নজরুলের প্রতি আসক্ত হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অপর দিকে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। একই সাথে তিনি ছিলেন সাম্যের কবি। কম: মোজাফফর আহম্মদের কাছে রাজনীতিতে হাতে খড়ি নেন। সেই সময় থেকে সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। তাই তিনি এক ধারে ছিলেন বিদ্রোহী কবি। তিনি ছিলেন বহুধা ধারার মানুষ। তিনি একাধারে কবি, শিল্পী, রাজনীতিক, সৈনিক এবং একজন প্রেমিক। এতে সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি প্রফেসর সুফিয়া বেগ।অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন রা:বি: উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. সারওয়ার জাহান চৌধুরী, রাজশাহী বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ আলী কামাল, নজরুল একাডেমীর সহ-সভাপতি আব্দুস সামাদ, রা:বি: ফোকলোর বিভাগের প্রফেসর ড.শহীদুর রহমান, রা:বি: ফোকলোর বিভাগের প্রফেসর আখতার হোসেন প্রমুখ।
অনুষ্ঠান শেষে সাংস্কৃতিক প্রতিযো-গীদের পুরস্কার বিতরণ করা হয়। বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জননেতা ফজলে হোসেন বাদশা, বিশেষ অতিথি রা:বি: উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড: সারওয়ার জাহান চৌধুরী। পরে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
নৈবেদ্য সাংস্কৃতিক অংগন
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৪ তম জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে মিয়াপাড়াস' জলি ভিলায় অবসি'ত নৈবেদ্য সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও উপাসনা সঙ্গীতালয়ের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় আবৃত্তি এবং নজরুল সঙ্গীতের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে কবির বিভিন্ন পর্যায়ের গান ও কবিতা পরিবেশন করেন শিল্পীরা।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন নৈবদ্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচালক বিশিষ্ট চিত্র শিল্পী ও কবি আশফাকুল আশেকিন। দেশের বরেণ্য সঙ্গীত সাধক পণ্ডিত অমরেশরায় চৌধুরী। পণ্ডিত শিবনাথ দাস, বিশিষ্ট বেহালা শিল্পী তপন কুমার দাসসহ অনেক গুণী এবং সুুধীজন উপসি'ত থেকে অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। অনুষ্ঠান উপস'াপনায় ছিলেন নাফিসা আনজুম এবং অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন বিশিষ্ট শিল্পী যতন কুমার পাল। তাল যন্ত্রে সহযোগিতা করেন সুমন বসাক, উৎসব কর্মকর্তার।
বিশ্ববাংলা ফাউন্ডেশন
গতকাল ১১ জৈষ্ঠ্য ২৫ মে শনিবার ২০১৩ সন্ধ্যা ৭টায় লক্ষ্মীপুরস' টিচার্স ট্রেনিংকলেজ মিলনায়তনে নজরুল একাডেমী, রাজশাহী আয়োজিত বাংলার বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৪ তম জন্ম-জয়ন্তী অনুষ্ঠানে বিশ্ববাংলা ফাউন্ডেশন ও সুন্দরম শিল্পলোক একাডেমী রাজশাহী যৌথভাবে উপস'াপন করে ড. হাসান রাজার গ্রন'না আবহসঙ্গীত ও নির্দেশনায় চির উন্নত শির শীর্ষক পূর্ণাঙ্গ আবৃত্তি প্রযোজনা। এতে অংশগ্রহণ করেন আয়েশা ঝরণা, স্বর্ণালী, বিথী রুনি ও অর্পি। সবশেষে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিবেদিত বাঁশের বাঁশিতে রাগ মিশ্র পিলু ও ভজন পরিবশেন করেন এবং ডা. হাসান রাজা, তবলা সহযোগিতায় ছিলেন উত্তম কুমার। অনুষ্ঠানটি উপস'াপনা করেন এ্যাড. রাশেদ উন নবী।
কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম | |
---|---|
তথ্য | |
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
যুগ | আধুনিক যুগ |
অঞ্চল | দক্ষিণ এশিয়া |
স্কুল | বাঙালি পুনর্জাগরণ |
মূল কর্মক্ষেত্র | কবিতা, সঙ্গীত, রাজনীতি,সমাজ |
কাজী নজরুল ইসলাম (মে ২৫, ১৮৯৯ – আগস্ট ২৯, ১৯৭৬)[১],(জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ - ভাদ্র ১২, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ), অগ্রণী বাঙালি কবি, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে –- কাজেই "বিদ্রোহী কবি"। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে।
নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় একমসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজও করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতেকিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনিকলকাতাতেই থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মত কবিতা; ধূমকেতুর মত সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী। এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্য তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল। এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়। মধ্যবয়সে তিনি পিক্স ডিজিজে[২] আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারেঢাকা আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পরিচ্ছেদসমূহ[আড়ালে রাখো] |
জীবনী [সম্পাদনা]
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন [সম্পাদনা]
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া ব্লকে অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদেরদ্বিতীয়া পত্নী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম| তারা ছিলেন তিন ভাই এবং বোন। তার সহোদর তিন ভাই ও দুই বোনের নাম হল: সবার বড় কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন, বোন উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল "দুখু মিয়া"। তিনি স্থানীয় মক্তবে (মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তাঁর শিক্ষাজীবন বাঁধাগ্রস্থ হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে নেমে যেতে হয় জীবিকা অর্জ্জনে।[৩][৪] এসময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন (আযান দাতা) হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলাম ধর্মের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তাঁর সাহিত্যকর্মকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়।
মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমান নাট্যদল)[৫] দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফারসি ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয়, বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্যঅধ্যয়ন শুরু করেন। একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে চাষার সঙ, শকুনীবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের গান, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং মেঘনাদ বধ।[৩] একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তব জীবন, অপর দিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে। নজরুল কালীদেবিকে নিয়ে প্রচুর শ্যামা সঙ্গিত ও রচনা করেন, নজরুল তার শেষ ভাষনে উল্লেখ্য করেন - " কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিম কে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালি কে গলাগলি তে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। "
১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। লেটো দলে তার প্রতিভায় সকলেই যে মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ নজরুল লেটো ছেড়ে আসার পর তাকে নিয়ে অন্য শিষ্যদের রচিত গান: "আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন / ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদ মনে / নামেতে নজরুল ইসলাম, কি দিব গুণের প্রমাণ"। এই নতুন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল। এরপর ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। মাথরুন স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস। কুমুদরঞ্জন স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে নজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন,
" | ছোট সুন্দর ছনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাশ পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল। | " |
যাহোক, আর্থিক সমস্যা তাকে বেশী দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ'র'সাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন।১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই স্কুলে অধ্যয়নকালে নজরুল এখানকার চারজন শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এরা হলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী চেতনা বিশিষ্ট নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।[৩]
সৈনিক জীবন [সম্পাদনা]
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিককর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। উক্ত রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে তিনিফারসি ভাষা শিখেন। এছাড়া সহসৈনিকদের সাথে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন, আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সাথে। করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন তার মধ্যে রয়েছে, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা); গল্প: হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি। এই করাচি সেনানিবাসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী,মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। এই সময় তার কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ফারসি কবি হাফিজের কিছু বই ছিল। এ সূত্রে বলা যায় নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি এই করাচি সেনানিবাসেই। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।
সাংবাদিক জীবন ও বিয়ে [সম্পাদনা]
যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ। এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতাবোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্। এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। এর প্রেক্ষিতে কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার খেয়া-পারের তরণী এবংবাদল প্রাতের শরাব কবিতা দুটির প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। এ থেকেই দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আফজালুল হক প্রমুখের সাথে পরিচয় হয়। তৎকালীন কলকাতার দুটি জনপ্রিয় সাহিত্যিক আসর গজেনদার আড্ডা এবং ভারতীয় আড্ডায়অংশগ্রহণের সুবাদে পরিচিত হন অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশির ভাদুড়ী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সাথে। ১৯২১সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে নজরুলের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই ১২ তারিখে নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলাএ.কে. ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। ঐ বছরই এই পত্রিকায় "মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে?" শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারী শুরু হয়। যাই হোক সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। একইসাথে মুজফ্ফর আহমদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিতা ও সঙ্গীতের চর্চাও চলছিল একাধারে। তখনও তিনি নিজে গান লিখে সুর দিতে শুরু করেননি। তবে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্তা তার কয়েকটি কবিতায় সুর দিয়ে স্বরলিপিসহ পত্রিকায় প্রকাশ করছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে:হয়তো তোমার পাব দেখা, ওরে এ কোন স্নেহ-সুরধুনী। সওগাত পত্রিকার ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম গান প্রকাশিত হয়। গানটি ছিল: "বাজাও প্রভু বাজাও ঘন"। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন। তার সাথেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে তার প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল। তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।[৬]
বিদ্রোহী নজরুল [সম্পাদনা]
তখন দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নজরুল কুমিল্লা থেকে কিছুদিনের জন্য দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে থেকে আবার কুমিল্লা ফিরে যান ১৯ জুনে। এখানে যতদিন ছিলেন ততদিনে তিনি পরিণত হন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীতে। তাঁর মূল কাজ ছিল শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে গান গাওয়া। তখনকার সময়ে তার রচিত ও সুরারোপিত গানগুলির মধ্যে রয়েছে "এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়, আজি রক্ত-নিশি ভোরে/ একি এ শুনি ওরে/ মুক্তি-কোলাহল বন্দী-শৃঙ্খলে" প্রভৃতি। এখানে ১৭ দিন থেকে তিনি স্থান পরিবর্তন করেছিলেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে আবার কুমিল্লায় ফিরে যান। ২১ নভেম্বর ছিল সমগ্র ভারতব্যাপী হরতাল। এ উপলক্ষে নজরুল আবার পথে নেমে আসেন; অসহযোগ মিছিলের সাথে শহর প্রদক্ষিণ করেন আর গান করেন, "ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী"। নজরুলের এ সময়কার কবিতা, গান ও প্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশিত হয়েছে। এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বিদ্রোহী নামক কবিতাটি। বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে। এই কবিতায় নজরুল নিজেকে বর্ণনা করেনঃ-
" | আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের, আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ জ্বালা, চির লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়, চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর ! আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন, আমি চপল মেয়ের ভালবাসা তার কাকন চুড়ির কন-কন । ... মহা- বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত। যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না- বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত। .......................... আমি চির বিদ্রোহী বীর – বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির ! | " |
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
" | কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু। আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন। | " |
পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লিখা থাকতো। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দী প্রদান করেন। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এই জবানবন্দী দিয়েছিলেন। তার এই জবানবন্দী বাংলা সাহিত্যে রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। এই জবানবন্দীতে নজরুল বলেছেন:
" | আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।... আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...। | " |
১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুলকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে যখন বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন (১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি ২২) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন। এই আনন্দে জেলে বসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাটি রচনা করেন।
অসুস্থতা [সম্পাদনা]
নবযুগে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নজরুল বেতারে কাজ করছিলেন। এমন সময়ই অর্থাৎ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার অসুস্থতা সম্বন্ধে সুষ্পষ্টরুপে জানা যায় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে। এরপর তাকে মূলত হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু এতে তার অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি। সেই সময় তাকে ইউরোপে পাঠানো সম্ভব হলে নিউরো সার্জারি করা হত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তারা নিভৃতে ছিলেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল নজরুলের আরোগ্যের জন্য গঠিত একটি সংগঠন যার নাম ছিল নজরুল চিকিৎসা কমিটি। এছাড়া তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি সহযোগিতা করেছিলেন। কবি চার মাস রাঁচিতে ছিলেন।
এরপর ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। মে ১০ তারিখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন ছাড়েন। লন্ডন পৌঁছানোর পর বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন: রাসেল ব্রেইন, উইলিয়াম সেজিয়েন্ট এবং ম্যাককিস্ক। তারা তিনবার নজরুলের সাথে দেখা করেন। প্রতিটি সেশনের সময় তারা ২৫০ পাউন্ড করে পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন। রাসেল ব্রেইনের মতে নজরুলের রোগটি ছিল দুরারোগ্য বলতে গেলে আরোগ্য করা ছিল ছিল অসম্ভব। একটি গ্রুপ নির্ণয় করেছিল যে নজরুল "ইনভল্যুশনাল সাইকোসিস" রোগে ভুগছেন। এছাড়া কলকাতায় বসবাসরত ভারতীয় চিকিৎসকরাও আলাদা একটি গ্রুপ তৈরি করেছিলেন। উভয় গ্রুপই এই ব্যাপারে একমত হয়েছিল যে, রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা ছিল খুবই অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত। লন্ডনে অবস্থিত লন্ডন ক্লিনিকে কবির এয়ার এনসেফালোগ্রাফিনামক এক্স-রে করানো হয়। এতে দেখা যায় তার মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব সংকুচিত হয়ে গেছে। ড: ম্যাককিস্কের মত বেশ কয়েকজন চিকিৎসক একটি পদ্ধতি প্রয়োগকে যথোপযুক্ত মনে করেন যার নাম ছিল ম্যাককিস্ক অপারেশন। অবশ্য ড: ব্রেইন এর বিরোধিতা করেছিলেন।
এই সময় নজরুলের মেডিকেল রিপোর্ট ভিয়েনার বিখ্যাত চিকিৎসকদের কাছে পাঠানো হয়। এছাড়া ইউরোপের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও পাঠানে হয়েছিল। জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জন অধ্যাপক রোঁয়েন্টগেন ম্যাককিস্ক অপারেশনের বিরোধিতা করেন। ভিয়েনার চিকিৎসকরাও এই অপারেশনের ব্যাপারে আপত্তি জানান। তারা সবাই এক্ষেত্রে অন্য আরেকটি পরীক্ষার কথা বলেন যাতে মস্তিষ্কের রক্তবাহগুলির মধ্যে এক্স-রেতে দৃশ্যমান রং ভরে রক্তবাহগুলির ছবি তোলা হয় (সেরিব্রাল অ্যানজিওগ্রাফি)। কবির শুভাকাঙ্খীদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে ভিয়েনার চিকিৎসক ডঃ হ্যান্স হফেরঅধীনে ভর্তি করানো হয়। এই চিকিৎসক নোবেল বিজয়ী চিকিৎসক জুলিয়াস ওয়েগনার-জাউরেগের অন্যতম ছাত্র। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বরকবিকে পরীক্ষা করানো হয়। এর ফলাফল থেকে ড. হফ বলেন যে, কবি নিশ্চিতভাবে পিক্স ডিজিজ নামক একটি নিউরন ঘটিত সমস্যায় ভুগছেন। এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিষের ফ্রন্টাল ও পার্শ্বীয় লোব সংকুচিত হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন বর্তমান অবস্থা থেকে কবিকে আরোগ্য করে তোলা অসম্ভব। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর তারিখে কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা ভিয়েনায় নজরুল নামে একটি প্রবন্ধ ছাপায় যার লেখক ছিলেন ডঃ অশোক বাগচি। তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ভিয়েনায় অবস্থান করছিলেন এবং নজরুলের চিকিৎসা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। যাহোক, ব্রিটিশ চিকিৎসকরা নজরুলের চিকিৎসার জন্য বড় অংকের ফি চেয়েছিল যেখানে ইউরোপের অন্য অংশের কোন চিকিৎসকই ফি নেননি। অচিরেই নজরুল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে আসেন। এর পরপরই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায় ভিয়েনা যান এবং ড. হ্যান্স হফের কাছে বিস্তারিত শোনেন। নজরুলের সাথে যারা ইউরোপ গিয়েছিলেন তারা সবাই ১৯৫৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর রোম থেকে দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।[৭]
বাংলাদেশে আগমন ও প্রয়াণ [সম্পাদনা]
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতেতাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। একুশে পদক বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানসূচক পদক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটার বাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কবি তার একটি কবিতায় বলেছিলেন:
" | পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল মূর্খরা সব শোন/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন | " |
তিনি কালীদেবিকে নিয়ে অনেক শ্যামা সঙ্গিত রচনা করেন , ইসলামী গজলও রচনা করেন । নজরুল তার একটি কবিতায় তাকে মসজিদের পাশে কবর দেয়ার অনুরোধ জানান। তার এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তাঁর সমাধি রচিত হয়। তার জানাজার নামাযে ১০ হাজারের মত মানুষ অংশ নেয়। জানাজা নামায আদায়ের পর রাষ্ট্রপতি সায়েম,মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, মেজর জেনারেল দস্তগীর জাতীয় পতাকা মন্ডিত নজরুলের মরদেহ সোহরাওয়ার্দী ময়দান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গনে নিয়ে যান। [৮] বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যু উপলক্ষ্যে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয়। আর ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
সাহিত্যকর্ম [সম্পাদনা]
- মূল নিবন্ধ: নজরুল রচনা তালিকা
কবিতা [সম্পাদনা]
- মূল নিবন্ধ: নজরুলের কবিতা
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ওভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা। এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: "প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা" ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
সঙ্গীত [সম্পাদনা]
- মূল নিবন্ধ: নজরুলগীতি
গদ্য রচনা, গল্প ও উপন্যাস [সম্পাদনা]
নজরুলের প্রথম গদ্য রচনা ছিল "বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী"। ১৯১৯ সালের মে মাসে এটি সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচি সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেছিলেন। এখান থেকেই মূলত তার সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটেছিল। এখানে বসেই বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে: "হেনা, ব্যাথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে"। ১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় যার নাম ব্যথার দান। এছাড়া একই বছর প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী প্রকাশিত হয়।
রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দর্শন [সম্পাদনা]
সৈনিক জীবন ত্যাগ করে নজরুল বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে মুজফ্ফর আহমদের সাথে বাস করছিলেন। মুজফ্ফর আহমদ ছিলেন এদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত। এখান থেকেই তাই নজরুলের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ শুরু হয়। মুজফ্ফর আহমদের সাথে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও বক্তৃতায় অংশ নিতেন। এ সময় থেকেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সাথে পরিচিত হন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ারসমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। তার লাঙ্গল ও গণবাণী পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেন সাম্যবাদী ও সর্বহারা কবিতাগুচ্ছ। এরই সাথে প্রকাশ করেছিলেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর অনুবাদ জাগ অনশন বন্দী ওঠ রে যত। তার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় রেড ফ্ল্যাগ-এর অবলম্বনে রচিত রক্তপতাকার গান।
তখন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন এবং মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন। অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের বিতারণ। আর খিলাফত আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কে মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা, কারণ এই সমন্বিত সুলতানী শাসন ব্যবস্থার প্রধান তথা তুরস্কের সুলতানকে প্রায় সকল মুসলমানরা মুসলিম বিশ্বের খলীফা জ্ঞান করতো। নজরুল এই দুটি আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা তথা স্বরাজ অর্জনে বিশ্বাস করতেন যা মহাত্মা গান্ধীর দর্শনের বিপরীত ছিল। আবার মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কের সালতানাত উচ্ছেদের মাধ্যমে নতুন তুরস্ক গড়ে তোলার আন্দোলনের প্রতি নজরুলের সমর্থন ছিল। তারপরও তিনি অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন যোগ দিয়েছিলেন। এর কারণ, এই সংগ্রাম দুটি ভারতীয় হিন্দু মুসলমানদের সম্মিলিত সম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল।
তবে সব দিক বিচারে নজরুল তার রাষ্ট্রীয় ধ্যান ধারণায় সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয়েছিলেন কামাল পাশার দ্বারা। কারণ কামাল পাশা তুরস্কে সামন্ততান্ত্রিক খিলাফত তথা সালতানাত উচ্ছেদ করে দেশটিকে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তুরস্কবাসীদের জীবন থেকে মৌলবাদ ও পর্দাপ্রথা দূর করতে পেরেছিলেন বলেই নজরুল তার প্রতি সবচেয়ে আকৃষ্ট হয়েছিলেন বলে অনেক বিশেষজ্ঞ(অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম)মত প্রকাশ করেছেন।নজরুল ভেবেছিলেন তুরস্কের মুসলমানরা তাদের দেশে যা করতে পেরেছে ভারতীয় উপমহাদেশে কেন তা সম্ভব হবেনা? গোড়ামী, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নজরুলের অবস্থান ছিল কঠোর। আর তার এই অবস্থানের পিছনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ছিল কামাল পাশার। সে হিসেবে তার জীবনের নায়ক ছিলেন কামাল পাশা। নজরুলও তার বিদ্রোহী জীবনে অনুরুপ ভূমিকা পালনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। উল্লেখ্য ১৯২১ সনের সেপ্টেম্বর মাসে মুজফ্ফর আহমদ ও নজরুল তালতলা লেনের যে বাসায় ছিলেন সে বাড়িতেই ভারতের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়েছিল। ১৯১৭ সনের রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমেও নজরুল প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে কখনই এই দলের সদস্য হননি, যদিও কমরেড মুজফ্ফর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আজীবন।
১৯২০ এর দশকের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে তিনি অংশ গ্রহণের চেষ্টা করেন। প্রথমে কংগ্রেসে সমর্থন লাভের জন্য তিনি কলকাতা যান। কিন্তু কংগ্রেসের কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে তিনি একাই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন।নির্বাচনে তিনি তেমন সাফল্য পাননি। এরপর সাহিত্যের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক চিন্তার বহিপ্রকাশ অব্যাহত থাকলেও রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ কমে যায়। [৯]
সমালোচনা [সম্পাদনা]
- মলয় রায়চৌধুরী রচিত উনিশতম অশ্বারোহীঃ নজরুল সম্পর্কে একটো পোস্টমডার্ন প্রতর্ক'। মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ঢাকা ( ২০০০ )।
সম্মান [সম্পাদনা]
কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। তাঁর রচিত "চল্ চল্ চল্, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল" বাংলাদেশের রণসংগীত হিসাবে গৃহীত। নজরুলের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী প্রতি বছর বিশেষভাবে উদযাপিত হয়। নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে (বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায়) ২০০৫ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় নামক সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে কবির জন্মস্থান চুরুলিয়ায় নজরুল অ্যাকাডেমি ও বাংলাদেশের রাজধানীঢাকায় কবির স্মৃতিতে নজরুল একাডেমী, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী ও শিশু সংগঠন বাংলাদেশ নজরুল সেনা স্থাপিত হয়। এছাড়া সরকারীভাবে স্থাপিত হয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান নজরুল ইন্সটিটিউট, কলকাতায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও মূল শহরের সংযোগকারী প্রধান রাস্তাটি কবির নামে উৎসর্গ করে কাজী নজরুল ইসলাম সরণি করা হয়। এছাড়াও কলকাতা মেট্রোর গড়িয়া বাজার স্টেশনটিকে কবির সম্মানে কবি নজরুল নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। ঢাকা শহরের একটি প্রধান সড়কের নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ।
তথ্যসূত্র [সম্পাদনা]
- ↑ "কাজী নজরুল ইসলাম"। এশিয়াটিক সোসাইটি।
- ↑ Farooq, Dr. Mohammad Omar (2007-03-10)। "Nazrul's Illness and Treatment"(HTML)। Nazrul.org (March 2007)। সংগৃহীত 2007-03-10।
- ↑ ৩.০ ৩.১ ৩.২ "Kazi Nazrul Islam" (HTML)। 2006-07-08। সংগৃহীত 2006-07-08।
- ↑ Chaudhuri, Dilip (2006-09-22)। "Nazrul Islam: The unparalleled lyricist and composer of Bengal" (HTML)। Press Information Bureau, Government of India। সংগৃহীত 2006-09-22।
- ↑ কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) - রফিকুল ইসলাম; কলকাতার সাহিত্যম্ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত নজরুল শ্রেষ্ঠ সংকলনে এই প্রবন্ধটি সংযুক্ত আছে।
- ↑ নজরুল জীবনে নারী ও প্রেম; ড. আবুল আজাদ
- ↑ 1. Muzaffar Ahmad, Kazi Nazrul Islam Smritikatha [Memoirs of Kazi Nazrul Islam - Kolkata, India: National Book Agency, 10th print, 1998] 2. Rafiqul Islam, Nazrul Jiboni [Life of Nazrul - Department of Bangla, Dhaka University, May 1972]; Prof. Rafiqul Islam is a national Nazrul professor in Bangladesh and one of the leading Nazrul researchers. 3. Sushilkumar Gupta, Nazrul Chorit-manosh [Kolkata, India: De's Publishing, 1990]
- ↑ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর- রফিকুল ইসলাম; পৃষ্ঠা: ২৭১
- ↑ http://www.thedailystar.net/magazine/2010/05/03/tribute.htm
আরো দেখুন [সম্পাদনা]
বহিঃসংযোগ [সম্পাদনা]
উইকিমিডিয়া কমন্সে নিচের বিষয় সংক্রান্ত মিডিয়া রয়েছে: কাজী নজরুল ইসলাম |
এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সমৃদ্ধ করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |
No comments:
Post a Comment