শহীদ জননীর মৃত্যু : জ্বলন্ত ক্যানসারে আসিফ নজরুলাহুতিফজুলল বারী, অন্যতম সম্পাদক, এইদেশ নিউজ, মঙ্গলবার, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৩
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যারা চান, তারা আজ কেন আর আসিফ নজরুলকে নির্ভরযোগ্য নিজেদের লোক মনে করেন না? অথবা যিনি গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের দায়ে খালেদা জিয়ার চিহ্নিত ২৪ জন রাষ্ট্রদ্রোহীর একজন, তিনি আজ এ বিচারের সঙ্গে সক্রিয়দের সুহৃদতালিকায় কেন নেই? শাহবাগে যেতে এত ভয় করে কেন তার? এমন নানান প্রশ্ন প্রায় করা হয়। ফেসবুকের মেসেজ বক্সে আজকাল প্রশ্নগুলো আসা বেড়েছে। বিশেষ করে মাহমুদুর রহমান, পিয়াস করিম, আসিফ নজরুলদের পক্ষে খালেদা জিয়ার বিবৃতির পর আসা বেড়েছে সে প্রশ্নগুলো। জনে জনে জবাব দেয়ার সময়ের স্বল্পতার কারণে এখানে তার উত্তর লিখার চেষ্টা।
আসিফ নজরুলের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়, একজন নজরুল ইসলামের আসিফ নজরুল হয়ে ওঠা এসব সাপ্তাহিক ২০০০-এর একটি ঈদসংখ্যায় লেখা হয়েছিল। প্রায়োপন্যাসটির প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব -- এভাবে লেখাটি পত্রিকাটিতে কয়েক বছর বেরিয়েছে। ঢাকার মিডিয়ায় আমরা যারা খুব ছোট থেকে সংগ্রাম করে বড় হয়েছি, সে বিষয়গুলো ছিল লেখাটির উপজীব্য। নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডের বিচিন্তা অফিস লাগোয়া নির্মাণশ্রমিকদের জন্য তৈরি করা একচালা ঘরটিই মিনার মাহমুদের সৌজন্যে ঢাকায় প্রথম 'হাসিমুখ' ডেরা হয়। এমন নিজস্ব সেই সংগ্রামের দিনগুলোর আরও অনেক বৃত্তান্তও অকপটে লেখা হয়েছে সেখানে। মাসুক হেলাল ভাই, আমান-উদ-দৌলা ভাই, আনোয়ার শাহাদাত, আমিনুর রশিদ, মানিক রহমান বা আমাদের পরবর্তী ধাপের প্রভাষ আমিন, রোকন রহমান, জুলফিকার আলি মাণিক, ফজলুর রহমান, উত্তম সেন, জাহিদ নেওয়াজ খান জুয়েল, ইমন শিকদারসহ অনেকেরই তো এমন পুড়ে পুড়ে শক্ত-শুদ্ধ হওয়া জীবন! বিচিন্তার আগে নজরুল ইসলাম নামে আসিফ নজরুল খবর গ্রুপের ছায়াছন্দ-চিত্রবাংলা এসব পত্রিকায় খ্যাপ লিখতেন। প্রায়োপন্যাসটির একটি পর্বে তা লিখায় 'কে কী মনে করবে বলেন তো', 'আমাকে এভাবে ছোট করা কি আপনার ঠিক হলো' এসব বলে তিনি ফোনে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন!
শহিদজননী জাহানারা ইমামের সন্তান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ রুমি সহযোদ্ধা ছিলেন বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীর। সহযোদ্ধা শহিদ মায়ের কষ্ট লাঘবের চেষ্টায় তাই জাহানারা ইমামকে আম্মা ডাকতেন শাহাদাত চৌধুরী, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুসহ অনেকে! এভাবে তিনি হয়ে যান বিচিত্রা পরিবারের সবার কমন 'আম্মা'। শাহাদাত চৌধুরী, শাহরিয়ার কবিরদের উৎসাহে তিনি লিখেন তার অমর সৃষ্টি 'একাত্তরের দিনগুলি'। বিচিত্রার সৃষ্টি মিনার মাহমুদ সাপ্তাহিক বিচিন্তা বের করলে তিনি বিচিন্তা পরিবারেরও আম্মা হয়ে যান। স্বৈরাচারী এরশাদ ও পরে খালেদার আমলে সরকারি ট্রাস্টের পত্রিকা হিশেবে বিচিত্রার নানা সীমাবদ্ধতার সময়ে আম্মা ও তার সন্তানদের চিন্তা-খোরাকের বিকল্প মাধ্যম হয় বিচিন্তা, নয়া পদধ্বনি, প্রিয় প্রজন্ম এসব প্রথাবিরোধী পত্রিকা।
এরশাদের পতনের পর জনতার উল্লাস উৎসবের ফাঁকতালে ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামির আমির ঘোষণা করা হয়।মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, বাংলাদেশের জন্মশত্রু এই গোলাম আযম জিয়াউর রহমানের আমলে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে ঢাকায় আসেন। এদেশে তার নাগরিকত্ব না থাকলেও আর ফিরে যাননি। মুক্তিযুদ্ধের শত্রু পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে জামায়াতের আমির ঘোষণার খবরে বিস্ফোরণে ফেটে পড়েন শহিদ রুমির মা, আমাদের আম্মা জাহানারা ইমাম। স্বৈরাচারের পতনে জনতার বিজয়-উৎসব উপলক্ষে সেদিন কেন্দ্রীয় শহিদমিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে শহিদজননীকে প্রধান অতিথি করা হয়। সেই প্রধান অতিথির বক্তৃতায় গোলাম আযমকে জামায়াতের আমির ঘোষণায় ঘৃণা প্রকাশ করেন আম্মা। তার সেদিনের আগুনঝরানো বক্তৃতায় এই ঘাতক গণশত্রুকে প্রতিরোধের জন্য শহিদ রুমির সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আহবান জানান শহিদজননী। এর প্রতিক্রিয়ায় লে কর্নেল (অব.) কাজী নূরুজ্জামানের সিদ্ধেশ্বরীর আমিনাবাদ কলোনির বাসায় ধারাবাহিক বৈঠকে গঠন করা হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সংগঠনটি প্রতিষ্ঠারও অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন শাহরিয়ার কবির। বিচিত্রায়ও তিনি ছিলেন খুবই প্রভাবশালী। পত্রিকাটির দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি, নির্বাহী সম্পাদক। বিচিত্রার প্রদায়ক থাকাকালীন নজরুল শাহরিয়ার কবির ভাইয়ের স্নেহভাজন, ঘনিষ্ঠ হন । মূলত তার ঘনিষ্ঠ- স্নেহভাজন হিসাবেই নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠা-প্রস্তুতির বৈঠকগুলোতেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রাজনৈতিকভাবে তিনি বরাবর বিএনপি ঘরানার ছিলেন। শিক্ষক জীবনেও তাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন তারকা সন্ত্রাসী গোলাম ফারুক অভির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিশেবে অভিকে নায়ক করে একটি উপন্যাসও লিখেছেন! শাহরিয়ার কবিরসহ নির্মূল কমিটি, গণআদালতের উদ্যোক্তারা অবশ্য তখন আজকের মতো এতটা আওয়ামি-ঘেঁষাও ছিলেন না। সে কারনে আসিফ নজরুলদেরকেও তখন তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়নি! আন্দোলনের ঘাত-প্রতিঘাতের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতায় চিহ্নিত হয়েছে এর আজকের শত্রু-মিত্র, পক্ষ-বিপক্ষ!
মূলত শাহরিয়ার ভাই চেয়েছেন, তাই গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়াতেও তাকে সংযুক্ত করা হয়। আমাদের তরুণ টিমটির মধ্যে তখন শুধু নজরুলেরই আইনবিদ হিশেবে বার কাউন্সিলের সনদ-সদস্যপদ ছিল। সে কারনে গণআদালতে তাকে করা হয় গোলাম আযমের আইনজীবী! যেখানে গোলাম আযমের পক্ষে আইনজীবী হতে 'সম্মত' কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না, সেখানে নজরুল কেন সানন্দে তাতে রাজি হন? এ নিয়ে তখনও অনেকের প্রশ্ন ছিল। আজকের বাস্তবতায় অনেকের ধারণা -- তখন বিচিত্রার চাকরির আশাতেই তিনি তা করেছেন! বিচিত্রার একজন স্টাফ রিপোর্টার হতে পারাটা ছিল তখন বিশেষ গৌরবের। পত্রিকাটিতে তখন এ বিষয়ে বিশেষ প্রভাবশালী ছিলেন শাহরিয়ার কবির। নজরুল যেহেতু কখনও নিজের লাভ-লোকসান স্বার্থ-ধান্ধার বাইরে কিছু কোনদিন করেননি বা এখনও করেন না, তার সাবেক সহকর্মীদের ধারণা, বিচিত্রার চাকরির স্বার্থেই তিনি সেদিন গোলাম আযমেরও আইনজীবী হতে রাজি হয়েছিলেন! সে সূত্রে গণআদালত সংগঠনের দায়ে শহিদজননীসহ যে ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহমামলা হয়, নজরুল ইসলাম নামে তিনিও তাদের মধ্যে ছিলেন।
আবার এ নিয়ে পরে এক যাত্রায় পৃথক ফলও হয়! গণআদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় খালেদা জিয়ার সরকার শাহরিয়ার কবিরকে বিচিত্রা থেকে চাকরিচ্যূত করলেও আসিফ নজরুলের কোনো সমস্যা হয়নি! সে পরিস্থিতিতেও গোপনে বিএনপির নানা মহলের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা, শহিদজননীর বাসায় যাওয়া-আসা দুটোই তিনি সমান চালিয়ে যাচ্ছিলেন! গণআদালত তথা যুদ্ধাপরাধের বিচারবিরোধী বিএনপির নানা মহলের সঙ্গে তার রহস্য সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি তখন শহিদজননী ও শাহরিয়ার কবির ভাইকে একাধিকবার জানিয়েও তাদেরকে তার ব্যাপারে নির্মোহ করা যায়নি! আসলে দুজনেই আমাদের সবাইকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। নজরুলের ব্যাপারেও এর ব্যত্যয় হয়নি। স্বার্থধান্ধায় স্নেহের-আস্থার মানুষটি যে এভাবে আন্দোলনের পিছনে ছুরি চালাতে পারে, তা তারা কল্পনায়ও ভাবতে পারেননি!
গণআদালতের পরবর্তী ধাপ ছিল গণতদন্ত কমিশন গঠন ও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের একাত্তরের আমলনামা প্রকাশ। জুলফিকার আলি মাণিক, ফজলুর রহমান, প্রভাষ আমিন, জাহিদ নেওয়াজ খান জুয়েল, ইমন শিকদারসহ আরও অনেকে সারাদেশ ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা, শহিদপরিবারের সদস্য, ঘাতক-ধর্ষকদের হাতে ভিকটিমদের ইন্টারভিউ করে জোগাড় করেন গণতদন্ত কমিশনের তথ্য-উপাত্ত! এভাবে প্রথম গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্টও আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয়েছে! দ্বিতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট চূড়ান্তকরণ নিয়েই দেখা দেয় বিপত্তি! রিপোর্টটি সম্পাদনার
কথা বলে নিজের কবজায় নিয়ে যান আসিফ নজরুল! আর তো দিতে চান না! আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন
বিভাগের একাধিক সূত্র জানায় তোমাদের রিপোর্ট তো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে! বলা হয় এই রিপোর্ট আটকে দেবার কথা বলে আইন বিভাগের এরশাদুল
বারীর মাধ্যমে বিদেশি বৃত্তির ব্যবস্থা করছে আসিফ নজরুল!
খবর পেয়ে একদিন এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় গিয়ে আম্মা তথা শহিদ জননী জাহানারা ইমামকে ঘটনা বললাম। কিন্তু আম্মা তো আমার কথা আমলেই নিতে নারাজ! আমাকে বললেন, 'ধুর, তুমি ভুল শুনেছ। নজরুল এমন ছেলেই না। নজরুল আমাকে বলেছে আগামী সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দিয়ে দেবে। দেখিস ঠিকই দিয়ে দেবে সে'। কিন্তু আগামী সপ্তাহ যায়, মাস যায়, রিপোর্ট আর আসে না! এরপর থেকে আম্মার সামনে গেলেই তিনি কেমন চুপ মেরে যেতেন! দিন দিন তার শরীরও ভেঙ্গে পড়ছিল। ক্যানসারের কেমোথেরাপি নিতে তিনি আমেরিকার হাসপাতালে যেতেন নিয়মিত। কিন্তু এ রিপোর্টের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমেরিকা যাবার প্রোগ্রাম তিনি একাধিকবার বাতিল করেন! আসিফ তার বিদেশি বৃত্তিটি ম্যানেজ হয়ে যাবার পর অবশ্য রিপোর্টটি আম্মাকে দিয়েছেন! তিনি ততক্ষণে সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে! ডাক্তারদের সময়-প্রেসক্রিপশন অনুসারে সময়মতো কেমোথেরাপি না দেয়াতে ক্যানসারের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে তার সারা শরীরে! তাই আমেরিকা নিয়ে যাবার পরও তাকে আর বাঁচানো যায়নি! আম্মার মৃত্যুসংবাদ শোনার পর প্রথম মনে পড়েছে আসিফ নজরুলের নাম! মনের মধ্যে সৃষ্টি একটি ক্রোধের! অভিশাপের! আমি তাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারিনি। পারবও না। আমার কাছে আমাদের নেত্রী-আম্মা, শহিদজননী জাহানারা ইমামের মৃত্যু ত্বরাণ্বিত করার জন্য অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে দায়ী এই আসিফ নজরুল। আম্মা তার সন্তানদের মধ্যে এমন একজন ধান্ধাবাজকে তার জীবনঘাতী ক্যানসারযন্ত্রণার মাধ্যমে চিনে গেছেন! তাকে এখন চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ! তার ব্যাপারে আরও সব ভয়ংকর তথ্য নির্মূল কমিটির কাছে আছে।
আসিফ নজরুলের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়, একজন নজরুল ইসলামের আসিফ নজরুল হয়ে ওঠা এসব সাপ্তাহিক ২০০০-এর একটি ঈদসংখ্যায় লেখা হয়েছিল। প্রায়োপন্যাসটির প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব -- এভাবে লেখাটি পত্রিকাটিতে কয়েক বছর বেরিয়েছে। ঢাকার মিডিয়ায় আমরা যারা খুব ছোট থেকে সংগ্রাম করে বড় হয়েছি, সে বিষয়গুলো ছিল লেখাটির উপজীব্য। নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডের বিচিন্তা অফিস লাগোয়া নির্মাণশ্রমিকদের জন্য তৈরি করা একচালা ঘরটিই মিনার মাহমুদের সৌজন্যে ঢাকায় প্রথম 'হাসিমুখ' ডেরা হয়। এমন নিজস্ব সেই সংগ্রামের দিনগুলোর আরও অনেক বৃত্তান্তও অকপটে লেখা হয়েছে সেখানে। মাসুক হেলাল ভাই, আমান-উদ-দৌলা ভাই, আনোয়ার শাহাদাত, আমিনুর রশিদ, মানিক রহমান বা আমাদের পরবর্তী ধাপের প্রভাষ আমিন, রোকন রহমান, জুলফিকার আলি মাণিক, ফজলুর রহমান, উত্তম সেন, জাহিদ নেওয়াজ খান জুয়েল, ইমন শিকদারসহ অনেকেরই তো এমন পুড়ে পুড়ে শক্ত-শুদ্ধ হওয়া জীবন! বিচিন্তার আগে নজরুল ইসলাম নামে আসিফ নজরুল খবর গ্রুপের ছায়াছন্দ-চিত্রবাংলা এসব পত্রিকায় খ্যাপ লিখতেন। প্রায়োপন্যাসটির একটি পর্বে তা লিখায় 'কে কী মনে করবে বলেন তো', 'আমাকে এভাবে ছোট করা কি আপনার ঠিক হলো' এসব বলে তিনি ফোনে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন!
শহিদজননী জাহানারা ইমামের সন্তান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ রুমি সহযোদ্ধা ছিলেন বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীর। সহযোদ্ধা শহিদ মায়ের কষ্ট লাঘবের চেষ্টায় তাই জাহানারা ইমামকে আম্মা ডাকতেন শাহাদাত চৌধুরী, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুসহ অনেকে! এভাবে তিনি হয়ে যান বিচিত্রা পরিবারের সবার কমন 'আম্মা'। শাহাদাত চৌধুরী, শাহরিয়ার কবিরদের উৎসাহে তিনি লিখেন তার অমর সৃষ্টি 'একাত্তরের দিনগুলি'। বিচিত্রার সৃষ্টি মিনার মাহমুদ সাপ্তাহিক বিচিন্তা বের করলে তিনি বিচিন্তা পরিবারেরও আম্মা হয়ে যান। স্বৈরাচারী এরশাদ ও পরে খালেদার আমলে সরকারি ট্রাস্টের পত্রিকা হিশেবে বিচিত্রার নানা সীমাবদ্ধতার সময়ে আম্মা ও তার সন্তানদের চিন্তা-খোরাকের বিকল্প মাধ্যম হয় বিচিন্তা, নয়া পদধ্বনি, প্রিয় প্রজন্ম এসব প্রথাবিরোধী পত্রিকা।
এরশাদের পতনের পর জনতার উল্লাস উৎসবের ফাঁকতালে ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামির আমির ঘোষণা করা হয়।মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, বাংলাদেশের জন্মশত্রু এই গোলাম আযম জিয়াউর রহমানের আমলে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে ঢাকায় আসেন। এদেশে তার নাগরিকত্ব না থাকলেও আর ফিরে যাননি। মুক্তিযুদ্ধের শত্রু পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে জামায়াতের আমির ঘোষণার খবরে বিস্ফোরণে ফেটে পড়েন শহিদ রুমির মা, আমাদের আম্মা জাহানারা ইমাম। স্বৈরাচারের পতনে জনতার বিজয়-উৎসব উপলক্ষে সেদিন কেন্দ্রীয় শহিদমিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে শহিদজননীকে প্রধান অতিথি করা হয়। সেই প্রধান অতিথির বক্তৃতায় গোলাম আযমকে জামায়াতের আমির ঘোষণায় ঘৃণা প্রকাশ করেন আম্মা। তার সেদিনের আগুনঝরানো বক্তৃতায় এই ঘাতক গণশত্রুকে প্রতিরোধের জন্য শহিদ রুমির সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আহবান জানান শহিদজননী। এর প্রতিক্রিয়ায় লে কর্নেল (অব.) কাজী নূরুজ্জামানের সিদ্ধেশ্বরীর আমিনাবাদ কলোনির বাসায় ধারাবাহিক বৈঠকে গঠন করা হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সংগঠনটি প্রতিষ্ঠারও অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন শাহরিয়ার কবির। বিচিত্রায়ও তিনি ছিলেন খুবই প্রভাবশালী। পত্রিকাটির দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি, নির্বাহী সম্পাদক। বিচিত্রার প্রদায়ক থাকাকালীন নজরুল শাহরিয়ার কবির ভাইয়ের স্নেহভাজন, ঘনিষ্ঠ হন । মূলত তার ঘনিষ্ঠ- স্নেহভাজন হিসাবেই নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠা-প্রস্তুতির বৈঠকগুলোতেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রাজনৈতিকভাবে তিনি বরাবর বিএনপি ঘরানার ছিলেন। শিক্ষক জীবনেও তাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন তারকা সন্ত্রাসী গোলাম ফারুক অভির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিশেবে অভিকে নায়ক করে একটি উপন্যাসও লিখেছেন! শাহরিয়ার কবিরসহ নির্মূল কমিটি, গণআদালতের উদ্যোক্তারা অবশ্য তখন আজকের মতো এতটা আওয়ামি-ঘেঁষাও ছিলেন না। সে কারনে আসিফ নজরুলদেরকেও তখন তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়নি! আন্দোলনের ঘাত-প্রতিঘাতের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতায় চিহ্নিত হয়েছে এর আজকের শত্রু-মিত্র, পক্ষ-বিপক্ষ!
মূলত শাহরিয়ার ভাই চেয়েছেন, তাই গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়াতেও তাকে সংযুক্ত করা হয়। আমাদের তরুণ টিমটির মধ্যে তখন শুধু নজরুলেরই আইনবিদ হিশেবে বার কাউন্সিলের সনদ-সদস্যপদ ছিল। সে কারনে গণআদালতে তাকে করা হয় গোলাম আযমের আইনজীবী! যেখানে গোলাম আযমের পক্ষে আইনজীবী হতে 'সম্মত' কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না, সেখানে নজরুল কেন সানন্দে তাতে রাজি হন? এ নিয়ে তখনও অনেকের প্রশ্ন ছিল। আজকের বাস্তবতায় অনেকের ধারণা -- তখন বিচিত্রার চাকরির আশাতেই তিনি তা করেছেন! বিচিত্রার একজন স্টাফ রিপোর্টার হতে পারাটা ছিল তখন বিশেষ গৌরবের। পত্রিকাটিতে তখন এ বিষয়ে বিশেষ প্রভাবশালী ছিলেন শাহরিয়ার কবির। নজরুল যেহেতু কখনও নিজের লাভ-লোকসান স্বার্থ-ধান্ধার বাইরে কিছু কোনদিন করেননি বা এখনও করেন না, তার সাবেক সহকর্মীদের ধারণা, বিচিত্রার চাকরির স্বার্থেই তিনি সেদিন গোলাম আযমেরও আইনজীবী হতে রাজি হয়েছিলেন! সে সূত্রে গণআদালত সংগঠনের দায়ে শহিদজননীসহ যে ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহমামলা হয়, নজরুল ইসলাম নামে তিনিও তাদের মধ্যে ছিলেন।
আবার এ নিয়ে পরে এক যাত্রায় পৃথক ফলও হয়! গণআদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় খালেদা জিয়ার সরকার শাহরিয়ার কবিরকে বিচিত্রা থেকে চাকরিচ্যূত করলেও আসিফ নজরুলের কোনো সমস্যা হয়নি! সে পরিস্থিতিতেও গোপনে বিএনপির নানা মহলের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা, শহিদজননীর বাসায় যাওয়া-আসা দুটোই তিনি সমান চালিয়ে যাচ্ছিলেন! গণআদালত তথা যুদ্ধাপরাধের বিচারবিরোধী বিএনপির নানা মহলের সঙ্গে তার রহস্য সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি তখন শহিদজননী ও শাহরিয়ার কবির ভাইকে একাধিকবার জানিয়েও তাদেরকে তার ব্যাপারে নির্মোহ করা যায়নি! আসলে দুজনেই আমাদের সবাইকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। নজরুলের ব্যাপারেও এর ব্যত্যয় হয়নি। স্বার্থধান্ধায় স্নেহের-আস্থার মানুষটি যে এভাবে আন্দোলনের পিছনে ছুরি চালাতে পারে, তা তারা কল্পনায়ও ভাবতে পারেননি!
গণআদালতের পরবর্তী ধাপ ছিল গণতদন্ত কমিশন গঠন ও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের একাত্তরের আমলনামা প্রকাশ। জুলফিকার আলি মাণিক, ফজলুর রহমান, প্রভাষ আমিন, জাহিদ নেওয়াজ খান জুয়েল, ইমন শিকদারসহ আরও অনেকে সারাদেশ ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা, শহিদপরিবারের সদস্য, ঘাতক-ধর্ষকদের হাতে ভিকটিমদের ইন্টারভিউ করে জোগাড় করেন গণতদন্ত কমিশনের তথ্য-উপাত্ত! এভাবে প্রথম গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্টও আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয়েছে! দ্বিতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট চূড়ান্তকরণ নিয়েই দেখা দেয় বিপত্তি! রিপোর্টটি সম্পাদনার
কথা বলে নিজের কবজায় নিয়ে যান আসিফ নজরুল! আর তো দিতে চান না! আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন
বিভাগের একাধিক সূত্র জানায় তোমাদের রিপোর্ট তো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে! বলা হয় এই রিপোর্ট আটকে দেবার কথা বলে আইন বিভাগের এরশাদুল
বারীর মাধ্যমে বিদেশি বৃত্তির ব্যবস্থা করছে আসিফ নজরুল!
খবর পেয়ে একদিন এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় গিয়ে আম্মা তথা শহিদ জননী জাহানারা ইমামকে ঘটনা বললাম। কিন্তু আম্মা তো আমার কথা আমলেই নিতে নারাজ! আমাকে বললেন, 'ধুর, তুমি ভুল শুনেছ। নজরুল এমন ছেলেই না। নজরুল আমাকে বলেছে আগামী সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দিয়ে দেবে। দেখিস ঠিকই দিয়ে দেবে সে'। কিন্তু আগামী সপ্তাহ যায়, মাস যায়, রিপোর্ট আর আসে না! এরপর থেকে আম্মার সামনে গেলেই তিনি কেমন চুপ মেরে যেতেন! দিন দিন তার শরীরও ভেঙ্গে পড়ছিল। ক্যানসারের কেমোথেরাপি নিতে তিনি আমেরিকার হাসপাতালে যেতেন নিয়মিত। কিন্তু এ রিপোর্টের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমেরিকা যাবার প্রোগ্রাম তিনি একাধিকবার বাতিল করেন! আসিফ তার বিদেশি বৃত্তিটি ম্যানেজ হয়ে যাবার পর অবশ্য রিপোর্টটি আম্মাকে দিয়েছেন! তিনি ততক্ষণে সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে! ডাক্তারদের সময়-প্রেসক্রিপশন অনুসারে সময়মতো কেমোথেরাপি না দেয়াতে ক্যানসারের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে তার সারা শরীরে! তাই আমেরিকা নিয়ে যাবার পরও তাকে আর বাঁচানো যায়নি! আম্মার মৃত্যুসংবাদ শোনার পর প্রথম মনে পড়েছে আসিফ নজরুলের নাম! মনের মধ্যে সৃষ্টি একটি ক্রোধের! অভিশাপের! আমি তাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারিনি। পারবও না। আমার কাছে আমাদের নেত্রী-আম্মা, শহিদজননী জাহানারা ইমামের মৃত্যু ত্বরাণ্বিত করার জন্য অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে দায়ী এই আসিফ নজরুল। আম্মা তার সন্তানদের মধ্যে এমন একজন ধান্ধাবাজকে তার জীবনঘাতী ক্যানসারযন্ত্রণার মাধ্যমে চিনে গেছেন! তাকে এখন চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ! তার ব্যাপারে আরও সব ভয়ংকর তথ্য নির্মূল কমিটির কাছে আছে।
No comments:
Post a Comment