এই সময়: বিরোধীদের মনোনয়নে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্য বেশ খানিক সিদ্ধ হলেও পঞ্চায়েত ভোটে জেলায় জেলায় শাসক তৃণমূ্ল নেতৃত্বের মাথাব্যথা হয়ে উঠেছেন দলেরই বিক্ষুব্ধরা৷ দক্ষিণবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময়সীমাও পার হয়ে যাওয়ার পর 'গোঁজ'দের সংখ্যা রীতিমতো উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে শাসক-শিবিরে৷
ভোট ঘোষণার ঢের আগে থেকেই এক-একটি আসনে প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে ছিলেন তৃণমূলের অন্তত হাফ-ডজন করে নেতা-কর্মী৷ প্রতীক পাওয়া নিয়ে গোষ্ঠীবিবাদ কম হয়নি৷ বস্ত্তত, জেলায় জেলায় গোলমাল-সংঘর্ষের পিছনে শাসকদলের গোষ্ঠীবিবাদের ইন্ধনও যথেষ্টই৷ মনোনয়ন-পর্বের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নেতাদের ধরাধরি-ঝুলোঝুলি চালিয়ে গিয়েছেন প্রার্থী হতে ইচ্ছুকের দল৷ কাউকে খুশি এবং অন্যকে নিরস্ত করার চেষ্টা চালিয়েছেন নেতারাও৷ জেলা বা রাজ্য পর্যায়ে নেতাদেরও অবশ্য নিজের নিজের শিবিরভাগ রয়েছে৷ ফলে এক নেতার সঙ্গে অন্যের দ্বন্দ্বেও ঝুলে থেকেছে প্রার্থী-ভাগ্য৷ মনোনয়ন জমা দিয়ে দিয়েছেন ইচ্ছুকদের অধিকাংশই৷ শেষে যাঁদের ভাগ্যে প্রতীকের শিকে ছিঁড়েছে, তাঁরা ছাড়াও বিপুল সংখ্যক তৃণমূল কর্মী থেকে গিয়েছেন লড়াইয়ে৷ প্রতীক না মেলার গোঁসা তাঁদের আরও বেশিই মরিয়া করেছে৷ আপাতত তাঁদের অতি নগণ্য অংশকেই লিফলেট দিয়ে লড়াই থেকে সরাতে সমর্থ হয়েছেন নেতৃত্ব৷ বাকিরা 'শেষ দেখে ছাড়া'র হুঙ্কার দিচ্ছেন৷ প্রতীক পাওয়া 'অফিসিয়াল'রা এখন এই গোঁজদের নিয়েই রীতিমতো শঙ্কিত৷ শক্তি-প্রয়োগে বিরোধীদের বহু ক্ষেত্রে ঠেকিয়ে রাখতে পেরে যে নেতারা উল্লসিত হয়েছেন, এখন তাঁরাই চিন্তায়৷ বিক্ষুব্ধরা নিজেদের নাক কেটে 'অফিসিয়াল'দের যাত্রাভঙ্গের কারণ হতে পারেন--এমন আশঙ্কা দিন দিন প্রবল হয়ে উঠছে শাসক-শিবিরে৷
রীতিমতো অন্তর্ঘাতের পরিস্থিতি এমনকী পরিবর্তনের আঁতুরঘর নন্দীগ্রামেও৷ নন্দীগ্রাম-১ ব্লকের ১৪০টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মাত্র ২৭টিতে, পঞ্চায়েত সমিতির ৩০টির মধ্যে মোটে ৫টিতে যেখানে প্রার্থী দিতে পেরেছে বামেরা, সেখানে তৃণমূলের মূল লড়াইটা হতে চলেছে দলেরই বিক্ষুব্ধ অংশের সঙ্গে৷ বিপুল সংখ্যায় নির্দল দাঁড়িয়ে গিয়েছেন পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতির আসনে৷ গোকুলনগর পঞ্চায়েতের ১৬টি আসনের একটিতেও প্রার্থী দিতে পারেনি বামেরা৷ ৩টি আসনে তাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছে তৃণমূল৷ কিন্ত্ত বাকি ১৩ আসনে তাদের লড়তে হচ্ছে দলেরই বিক্ষুব্ধদের সঙ্গে৷ গোকুলনগরে তৃণমূলের প্রথম সারির দুই নেতা স্বদেশ দাস অধিকারী আর স্বদেশ দাসের দ্বন্দ্ব কোনও দিনই গোপন ছিল না৷ পঞ্চায়েত ভোটের আগেও সেই দ্বন্দ্ব মেটেনি৷ বরং ফাটল বেড়েছে৷ একই ভাবে সামসাবাদেও ১০ টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে তৃণমূল বনাম তৃণমূল লড়াই হচ্ছে৷ এখানে আবু তাহের আর শেখ সুফিয়ান গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব রীতিমতো বেআব্রু৷ নন্দীগ্রাম-২ ব্লকেও বামেরা কোণঠাসা হলে কী হবে--তৃণমূল নেতাদের ঘুম কেড়েছেন দলেরই বিক্ষুব্ধরা৷ খোদামবাড়ি থেকে পঞ্চায়েত সমিতির আসনে প্রার্থী দলের ব্লক সভাপতি তথা বিদায়ী সমিতি-বোর্ডের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ মহাদেব বাগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন সমিতির কৃষি ও সেচ কর্মাধ্যক্ষ সুব্রত হাজরা৷ নন্দীগ্রামের জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা, পটাশপুর বা হলদিয়া-সুতাহাটাতেও লড়াইয়ের মূল আকর্ষণ সেই তৃণমূল বনাম তৃণমূল৷ এই জেলায় দলের শীর্ষ নেতৃত্বেও বিভাজন স্পষ্ট৷ একদিকে শিশির-শুভেন্দু অধিকারীর মতো দাপুটে সাংসদ তো অন্য দিকে অখিল গিরি, শিউলি সাহার মতো পুরনো-নতুন বিধায়কেরা৷
নন্দীগ্রামের মতোই রাজ্য-রাজনীতিতে বিশেষ আগ্রহের বিন্দু জঙ্গলমহল৷ সেখানেও তৃণমূল শিবিরের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছেন দলের প্রতীক না-পাওয়া গোঁজেরাই৷ ঘাসফুল মেলেনি তো কী, গোলাপ, মোবাইল, লাঙ্গল, মোটরগাড়ি--হরেক প্রতীকে আসরে হাজির শাসকদলের বিক্ষুব্ধরা৷ বিনপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতিতে তৃণমূলের 'অফিসিয়াল' প্রার্থী ২৯ জন, আর গোঁজের সংখ্যা ৩৮! এই ব্লকের গ্রাম পঞ্চায়েতে ১২৬ জন 'অফিসিয়াল' তৃণমূল প্রার্থীর সঙ্গে টক্কর দিচ্ছেন ১২৫ জন নির্দল! যাঁদের ৯০ শতাংশই বিক্ষুব্ধ তৃণমূল৷ ঝাড়গ্রাম মহকুমার ৮টি ব্লকেই কমবেশি অবস্থাটা এ রকম৷ বেলপাহাড়ি ব্লক তৃণমূল সভাপতি বনপতি মাহাতোর পঞ্চায়েত সমিতিতে নির্বাচিত হওয়ার পথে কাঁটা দলেরই গোঁজ ধীমান লাহা৷ বেলপাহাড়িতে দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ধীমানবাবু প্রতীক না-পেয়ে বেজায় ক্ষুব্ধ৷ তাঁর বিস্ফোরক অভিযোগ, টাকা নিয়ে প্রতীক বিলি করা হয়েছে৷ অন্য আর এক বিক্ষুব্ধের মন্তব্য, 'কাজের সময়ে আমরা আর ভোটে লড়বে অন্যজন, তা হবে না৷ প্রতীক দেয়নি তো কী, নির্দল হয়েই লড়ে যাব৷' দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক দুর্গেশ মল্লদেব অবশ্য এ হেন বিদ্রোহে আমল দিচ্ছেন না৷ এখনও তাঁর আশা, 'ভোটর আগে ঠিক সমাধান বেরোবে৷' এমন আশাবাদী হওয়ার অবশ্য বিশেষ কারণ দেখছেন না সাধারণ তৃণমূল কর্মীরা৷ গোঁজের ঠেলায় জেতা ঘুঁটি কেঁচে যাওয়ার আশঙ্কায় তাঁরা৷ জঙ্গলমহলের আর এক জেলা পুরুলিয়ায় সব আসনে প্রার্থী দিতে না-পারলেও শাসকদলকে গোঁজের ঠেলা সামলাতে হচ্ছে ভালো রকমই৷ গ্রাম পঞ্চায়েত-স্তরে এই জেলায় শতাধিক আসনে তৃণমূলের সঙ্গে লড়াইয়ে রয়েছে তৃণমূলই৷
বর্ধমান, বীরভূম, উত্তর চব্বিশ পরগনাতেও শাসকদলের পক্ষে পরিস্থিতি আলাদা নয়৷ বর্ধমানে গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪০৬৭ আসনের ৪১টিতে এবং পঞ্চায়েত সমিতির ৭৭৯টির মধ্যে ৮টিতে প্রার্থী দিতে না-পারলে কী হবে, পঞ্চায়েত-স্তরে বিপুল সংখ্যক আসনে 'নির্দল' গোঁজদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে শাসকদলকে৷ দলের জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) তথা ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথকেও স্বীকার করতে হচ্ছে, 'কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে৷' এমনকী নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া বিক্ষুব্ধদের একাংশকে সমর্থনের কথাও যে ভাবতে হচ্ছে, কবুল করেছেন স্বপনবাবু৷ বিরোধীদের মনোনয়ন জমায় বাধাদানের প্রকাশ্য আহ্বান জানানো শাসকদলের ডাকাবুকো নেতা অনুব্রত মণ্ডলের বীরভূমে তাঁদের নিজেদেরই কঠিন অবস্থা৷ জেলা পরিষদের ৪২ আসনে সরকারি ও বিক্ষুব্ধ মিলে তৃণমূল প্রার্থীই কিনা ৭৫! ১৯টি পঞ্চায়েত সমিতির ৪৬৫ আসনেও শাসকদলের একাধিক গোষ্ঠী মিলে মনোনয়ন ৬৩৩টি! গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরেও বিক্ষুব্ধ প্রায় শ'তিনেক৷ অনুব্রতের অবশ্য দাবি, 'ও সব ডামি প্রার্থী ঠিক সময়েই সরে আসবে৷'
তবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার জো বিশেষ থাকছে না৷ নব্য-তৃণমূলের সঙ্গে আদি-তৃণমূলের দ্বন্দ্ব সব জেলাতেই প্রকাশ্যে৷ ১৯৯৮-এ উত্তর চব্বিশ পরগনার শাসনে জেলা পরিষদের আসনে দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা মজিদ মাস্টারকে হারানো আদি-তৃণমূলের আব্দুর রউফ এ বার টিকিটই পাননি৷ শেষে গ্রাম পঞ্চায়েতে শিকে ছিঁড়লেও নব্য-তৃণমূলের 'গোঁজ' আসগর আলিই হয়ে উঠেছেন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী৷ দুই মন্ত্রীর কোন্দলে গাইঘাটা, বনগাঁর মতুয়া ভোটেও আড়াআড়ি বিভাজনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে শাসকশিবিরে৷
ভোটের আগে বিরোধীশূন্য বহু গ্রাম তাই অশান্ত শাসকদলের সংঘাতেই৷ ভোটে এই অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রভাব কতখানি পড়ল--জানতে অপেক্ষা করতে হবে ফলপ্রকাশের৷ যা নিয়ে শাসকদলের বড়-মেজো-ছোট নেতাদের আগ্রহও এখন চরমে৷
ভোট ঘোষণার ঢের আগে থেকেই এক-একটি আসনে প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে ছিলেন তৃণমূলের অন্তত হাফ-ডজন করে নেতা-কর্মী৷ প্রতীক পাওয়া নিয়ে গোষ্ঠীবিবাদ কম হয়নি৷ বস্ত্তত, জেলায় জেলায় গোলমাল-সংঘর্ষের পিছনে শাসকদলের গোষ্ঠীবিবাদের ইন্ধনও যথেষ্টই৷ মনোনয়ন-পর্বের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নেতাদের ধরাধরি-ঝুলোঝুলি চালিয়ে গিয়েছেন প্রার্থী হতে ইচ্ছুকের দল৷ কাউকে খুশি এবং অন্যকে নিরস্ত করার চেষ্টা চালিয়েছেন নেতারাও৷ জেলা বা রাজ্য পর্যায়ে নেতাদেরও অবশ্য নিজের নিজের শিবিরভাগ রয়েছে৷ ফলে এক নেতার সঙ্গে অন্যের দ্বন্দ্বেও ঝুলে থেকেছে প্রার্থী-ভাগ্য৷ মনোনয়ন জমা দিয়ে দিয়েছেন ইচ্ছুকদের অধিকাংশই৷ শেষে যাঁদের ভাগ্যে প্রতীকের শিকে ছিঁড়েছে, তাঁরা ছাড়াও বিপুল সংখ্যক তৃণমূল কর্মী থেকে গিয়েছেন লড়াইয়ে৷ প্রতীক না মেলার গোঁসা তাঁদের আরও বেশিই মরিয়া করেছে৷ আপাতত তাঁদের অতি নগণ্য অংশকেই লিফলেট দিয়ে লড়াই থেকে সরাতে সমর্থ হয়েছেন নেতৃত্ব৷ বাকিরা 'শেষ দেখে ছাড়া'র হুঙ্কার দিচ্ছেন৷ প্রতীক পাওয়া 'অফিসিয়াল'রা এখন এই গোঁজদের নিয়েই রীতিমতো শঙ্কিত৷ শক্তি-প্রয়োগে বিরোধীদের বহু ক্ষেত্রে ঠেকিয়ে রাখতে পেরে যে নেতারা উল্লসিত হয়েছেন, এখন তাঁরাই চিন্তায়৷ বিক্ষুব্ধরা নিজেদের নাক কেটে 'অফিসিয়াল'দের যাত্রাভঙ্গের কারণ হতে পারেন--এমন আশঙ্কা দিন দিন প্রবল হয়ে উঠছে শাসক-শিবিরে৷
রীতিমতো অন্তর্ঘাতের পরিস্থিতি এমনকী পরিবর্তনের আঁতুরঘর নন্দীগ্রামেও৷ নন্দীগ্রাম-১ ব্লকের ১৪০টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মাত্র ২৭টিতে, পঞ্চায়েত সমিতির ৩০টির মধ্যে মোটে ৫টিতে যেখানে প্রার্থী দিতে পেরেছে বামেরা, সেখানে তৃণমূলের মূল লড়াইটা হতে চলেছে দলেরই বিক্ষুব্ধ অংশের সঙ্গে৷ বিপুল সংখ্যায় নির্দল দাঁড়িয়ে গিয়েছেন পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতির আসনে৷ গোকুলনগর পঞ্চায়েতের ১৬টি আসনের একটিতেও প্রার্থী দিতে পারেনি বামেরা৷ ৩টি আসনে তাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছে তৃণমূল৷ কিন্ত্ত বাকি ১৩ আসনে তাদের লড়তে হচ্ছে দলেরই বিক্ষুব্ধদের সঙ্গে৷ গোকুলনগরে তৃণমূলের প্রথম সারির দুই নেতা স্বদেশ দাস অধিকারী আর স্বদেশ দাসের দ্বন্দ্ব কোনও দিনই গোপন ছিল না৷ পঞ্চায়েত ভোটের আগেও সেই দ্বন্দ্ব মেটেনি৷ বরং ফাটল বেড়েছে৷ একই ভাবে সামসাবাদেও ১০ টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে তৃণমূল বনাম তৃণমূল লড়াই হচ্ছে৷ এখানে আবু তাহের আর শেখ সুফিয়ান গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব রীতিমতো বেআব্রু৷ নন্দীগ্রাম-২ ব্লকেও বামেরা কোণঠাসা হলে কী হবে--তৃণমূল নেতাদের ঘুম কেড়েছেন দলেরই বিক্ষুব্ধরা৷ খোদামবাড়ি থেকে পঞ্চায়েত সমিতির আসনে প্রার্থী দলের ব্লক সভাপতি তথা বিদায়ী সমিতি-বোর্ডের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ মহাদেব বাগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন সমিতির কৃষি ও সেচ কর্মাধ্যক্ষ সুব্রত হাজরা৷ নন্দীগ্রামের জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা, পটাশপুর বা হলদিয়া-সুতাহাটাতেও লড়াইয়ের মূল আকর্ষণ সেই তৃণমূল বনাম তৃণমূল৷ এই জেলায় দলের শীর্ষ নেতৃত্বেও বিভাজন স্পষ্ট৷ একদিকে শিশির-শুভেন্দু অধিকারীর মতো দাপুটে সাংসদ তো অন্য দিকে অখিল গিরি, শিউলি সাহার মতো পুরনো-নতুন বিধায়কেরা৷
নন্দীগ্রামের মতোই রাজ্য-রাজনীতিতে বিশেষ আগ্রহের বিন্দু জঙ্গলমহল৷ সেখানেও তৃণমূল শিবিরের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছেন দলের প্রতীক না-পাওয়া গোঁজেরাই৷ ঘাসফুল মেলেনি তো কী, গোলাপ, মোবাইল, লাঙ্গল, মোটরগাড়ি--হরেক প্রতীকে আসরে হাজির শাসকদলের বিক্ষুব্ধরা৷ বিনপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতিতে তৃণমূলের 'অফিসিয়াল' প্রার্থী ২৯ জন, আর গোঁজের সংখ্যা ৩৮! এই ব্লকের গ্রাম পঞ্চায়েতে ১২৬ জন 'অফিসিয়াল' তৃণমূল প্রার্থীর সঙ্গে টক্কর দিচ্ছেন ১২৫ জন নির্দল! যাঁদের ৯০ শতাংশই বিক্ষুব্ধ তৃণমূল৷ ঝাড়গ্রাম মহকুমার ৮টি ব্লকেই কমবেশি অবস্থাটা এ রকম৷ বেলপাহাড়ি ব্লক তৃণমূল সভাপতি বনপতি মাহাতোর পঞ্চায়েত সমিতিতে নির্বাচিত হওয়ার পথে কাঁটা দলেরই গোঁজ ধীমান লাহা৷ বেলপাহাড়িতে দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ধীমানবাবু প্রতীক না-পেয়ে বেজায় ক্ষুব্ধ৷ তাঁর বিস্ফোরক অভিযোগ, টাকা নিয়ে প্রতীক বিলি করা হয়েছে৷ অন্য আর এক বিক্ষুব্ধের মন্তব্য, 'কাজের সময়ে আমরা আর ভোটে লড়বে অন্যজন, তা হবে না৷ প্রতীক দেয়নি তো কী, নির্দল হয়েই লড়ে যাব৷' দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক দুর্গেশ মল্লদেব অবশ্য এ হেন বিদ্রোহে আমল দিচ্ছেন না৷ এখনও তাঁর আশা, 'ভোটর আগে ঠিক সমাধান বেরোবে৷' এমন আশাবাদী হওয়ার অবশ্য বিশেষ কারণ দেখছেন না সাধারণ তৃণমূল কর্মীরা৷ গোঁজের ঠেলায় জেতা ঘুঁটি কেঁচে যাওয়ার আশঙ্কায় তাঁরা৷ জঙ্গলমহলের আর এক জেলা পুরুলিয়ায় সব আসনে প্রার্থী দিতে না-পারলেও শাসকদলকে গোঁজের ঠেলা সামলাতে হচ্ছে ভালো রকমই৷ গ্রাম পঞ্চায়েত-স্তরে এই জেলায় শতাধিক আসনে তৃণমূলের সঙ্গে লড়াইয়ে রয়েছে তৃণমূলই৷
বর্ধমান, বীরভূম, উত্তর চব্বিশ পরগনাতেও শাসকদলের পক্ষে পরিস্থিতি আলাদা নয়৷ বর্ধমানে গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪০৬৭ আসনের ৪১টিতে এবং পঞ্চায়েত সমিতির ৭৭৯টির মধ্যে ৮টিতে প্রার্থী দিতে না-পারলে কী হবে, পঞ্চায়েত-স্তরে বিপুল সংখ্যক আসনে 'নির্দল' গোঁজদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে শাসকদলকে৷ দলের জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) তথা ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথকেও স্বীকার করতে হচ্ছে, 'কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে৷' এমনকী নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া বিক্ষুব্ধদের একাংশকে সমর্থনের কথাও যে ভাবতে হচ্ছে, কবুল করেছেন স্বপনবাবু৷ বিরোধীদের মনোনয়ন জমায় বাধাদানের প্রকাশ্য আহ্বান জানানো শাসকদলের ডাকাবুকো নেতা অনুব্রত মণ্ডলের বীরভূমে তাঁদের নিজেদেরই কঠিন অবস্থা৷ জেলা পরিষদের ৪২ আসনে সরকারি ও বিক্ষুব্ধ মিলে তৃণমূল প্রার্থীই কিনা ৭৫! ১৯টি পঞ্চায়েত সমিতির ৪৬৫ আসনেও শাসকদলের একাধিক গোষ্ঠী মিলে মনোনয়ন ৬৩৩টি! গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরেও বিক্ষুব্ধ প্রায় শ'তিনেক৷ অনুব্রতের অবশ্য দাবি, 'ও সব ডামি প্রার্থী ঠিক সময়েই সরে আসবে৷'
তবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার জো বিশেষ থাকছে না৷ নব্য-তৃণমূলের সঙ্গে আদি-তৃণমূলের দ্বন্দ্ব সব জেলাতেই প্রকাশ্যে৷ ১৯৯৮-এ উত্তর চব্বিশ পরগনার শাসনে জেলা পরিষদের আসনে দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা মজিদ মাস্টারকে হারানো আদি-তৃণমূলের আব্দুর রউফ এ বার টিকিটই পাননি৷ শেষে গ্রাম পঞ্চায়েতে শিকে ছিঁড়লেও নব্য-তৃণমূলের 'গোঁজ' আসগর আলিই হয়ে উঠেছেন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী৷ দুই মন্ত্রীর কোন্দলে গাইঘাটা, বনগাঁর মতুয়া ভোটেও আড়াআড়ি বিভাজনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে শাসকশিবিরে৷
ভোটের আগে বিরোধীশূন্য বহু গ্রাম তাই অশান্ত শাসকদলের সংঘাতেই৷ ভোটে এই অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রভাব কতখানি পড়ল--জানতে অপেক্ষা করতে হবে ফলপ্রকাশের৷ যা নিয়ে শাসকদলের বড়-মেজো-ছোট নেতাদের আগ্রহও এখন চরমে৷
No comments:
Post a Comment