পাহাড়ের মুখে হাসি, কিন্ত্ত বাংলার বিবিধ ক্রিয়াকর্মে তারা উপযুক্ত জায়গা পাবে তো?
সুমন চট্টোপাধ্যায়
মাটির গন্ধ-মাখা রূপকালঙ্কারে কথা বলা আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর দীর্ঘ দিনের অভ্যেস৷ কলকাত্তাইয়া বাবুদিগের অনেক সময় সে সব কথা কানে এলে বেজায় আমোদ হয়, বিশেষ কারও কারও বমনোদ্রেক হয় বলেও শুনেছি৷ কিন্ত্ত গুটিকয় উন্নত-নাসিকা ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়ার সুশীল আভিজাত্যের ধার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কবেই বা ধারলেন? ধারতে যাবেন কোন দুঃখে?
কৃষি ও শিল্পের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে এ রাজ্যে রাজনৈতিক স্লোগান-কাব্য কম রচিত হয়নি৷ অনেক মাথা ঘামানোর পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, 'কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষত্৷' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন সব অকারণ খটমট শব্দ-সম্ভারের মধ্যে প্রবেশই করলেন না৷ তিনি নাম দিলেন 'হাসি-খুশি'৷ কৃষি 'হাসি', শিল্প 'খুশি'৷ 'হাসি-খুশি বনগাঁ মাসি, মোদের ঘরে এসো' পড়ে যাঁরা বড় হয়েছে বা হচ্ছে এই শব্দ-বন্ধটি তাদের মনে ধরে গেল চোখের নিমেষে৷ কাব্যিক বংশ-কৌলীন্য ও প্রেসিডেন্সির বাংলা অনার্স ক্লাসে এত সময় কাটিয়েও যোগমায়া দেবীর মেয়ের কাছে দশ গোল খেয়ে গেলেন বুদ্ধদেব!
অম্ল আর কোষ্ঠ-কাঠিন্যে জর্জর এই গোমড়া-মুখো বঙ্গদেশে যত্র-তত্র, যখন-তখন হাসি-র সন্ধান পাওয়া আদৌ চাট্টিখানি ব্যাপার নয়৷ হাসির ব্যাপার তো নয়ই৷ অথচ আমাদের মুখ্যমন্ত্রী এক রকম অক্লেশে এই কাজটা করে চলেছেন সেই কবে থেকেই৷ কৃষিকে 'হাসি' নাম দেওয়ার পরে খুশিতে তিনি ইদানীং প্রায়ই বলে থাকেন, 'জঙ্গল-মহল হাসছে৷ পাহাড় হাসছে৷ কমরেড-বন্ধুগণ বলুন তো দেখি, এতদিন ধরে আপনারা কী করছিলেন? নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন না তো?'
জঙ্গল-মহলের 'হাসি' নিয়ে জঙ্গল-মহলের বাইরে তেমন একটা চর্চা হয় না৷ রাজানুগত্যে গোপাল ভাঁড়কেও যাঁরা নিত্য-দিন লজ্জা দিচ্ছেন সেই সব তৃণমূলি মিডিয়া-সম্প্রদায়কেও বড় একটা দেখি না, এই 'হাসি'-র তাত্পর্য বিশ্লেষণে তেমন একটা আগ্রহ আছে৷ যতদিন অশান্তি ছিল, রোজ লাশ পড়ত আর বন্ধ হত, জঙ্গলমহল ছিল সংবাদের শিরোনামে৷ এখন শান্তি ফিরেছে তাই ফুরিয়েছে গপ্পো-ফাঁদার তাগিদও৷ ওই কুকুর মানুষকে কামড়ালে খবর নয়, মানুষ কুকুরকে কামড়ালে তবেই খবর গোছের ব্যাপার আর কী!
জঙ্গল-মহলে যাঁদের বসবাস, শুধু তাঁরাই জানেন, মুখ্যমন্ত্রীর রূপক আদতে হাসির বিষয় নয়, তাঁদের জীবনের একমাত্র জ্বলন্ত সত্য৷ কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই 'হাসি'-র কথা তাঁরা ভাবতেও পারতেন না৷ সকালে ঘুম থেকে উঠে তাঁরা টেলিভিশনে দেখে নিতেন আজ বন্ধ কি না, হলে কত দিন চলবে, না হলে ফের কবে হবে৷ রাতে শুতে যাওয়ার আগে আবার ওই টেলিভিশনের খবরেই গুণে নিতেন গত চব্বিশ ঘন্টায় ক'টা বডি পড়ে গেল, তাদের মধ্যে কয়টা সিপিএমের, কয়টা মাওবাদীদের, কয়টা পুলিশের৷ বডিগুলোর কোনওটা আত্মীয়-স্বজন বা পাড়া-পড়শির কি না, থাকত সে সম্পর্কে সঙ্গত বাড়তি কৌতুহল৷
সেই ভয়ার্ত, কর্মহীন,অশান্তি আর অনিশ্চয়তায় ভরা অরণ্যের দিন-রাত্রিগুলি এখন পাড়ার আড্ডায় অতিরঞ্জিত গাল-গল্পের বিষয় হয়ে বেঁচে আছে কেবল৷ জঙ্গল-মহলে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে এসেছে, ছেলে-মেয়েরা নিয়মিত ইস্কুল-কলেজে যাচ্ছে, দোকানপাট, হাট-বাজারে রোজকার কর্মব্যস্ততা৷ জঙ্গলমহলে এর ফলে রাম-রাজ্য ফিরে এসেছে তা নয়, তবে রাজনৈতিকভাবে তৃণমূলই একা তাদের প্রাপ্য ফসল ঘরে তুলেছে৷ বিধানসভার পরে পঞ্চায়েত ভোটেও ঘাসফুলে ছয়লাপ হয়ে গিয়েছে জঙ্গল-মহল৷ এর জন্য মুকুল রায় বা শুভেন্দু অধিকারীদের গুন্ডা-মস্তানের ব্যবস্থা করতে হয়নি, গোটা এলাকাটাকে পরিণত করতে হয়নি 'চমকাইতলা'য়৷ জঙ্গল-মহলের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দু'হাত তুলে আর্শীবাদ করেছেন মুখ্যমন্ত্রীকে৷ একদা তাঁদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে মূষিক-শাবকের অবস্থা কালকের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কমরেডদের৷ গোটা তল্লাটে সবচেয়ে নোংরা ও ঘৃণিত শব্দের নাম এখন সিপিএম৷
ক্ষমতায় আসার পরে প্রায় যুদ্ধকালীন ব্যস্ততায় নতুন ত্রিপাক্ষিক চুক্তি ও গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে(জিটিএ) ভোট করিয়ে দেওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রীর মনে হয়েছিল পাহাড়ও বুঝি হাসছে৷ কিন্ত্ত বাস্তবে তা হয়নি, সেই হাসি ছিল মেকি, ঘর ভালো করে গুছিয়ে নেওয়ার কৌশল মাত্র৷ ফলে কিছুকাল পরেই দেখা গেল ফের পৃথক রাজ্যের দাবিকে কেন্দ্র করে অশান্তি ফিরে এসেছে পাহাড়ে, আবার শুরু হয়েছে লাগাতার বনধ, ইতি-উতি অগ্নি-সংযোগ৷ চকিতে ফের স্তব্ধ পাহাড়ি জীবন৷ কেন্দ্রীয় সরকার তেলেঙ্গানাকে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার পরে পাহাড়ি নেতাদেরও ফের মনে হতে শুরু এই মওকায় কার্যসিদ্ধি হয়ে যাবে তাঁদেরও৷
হল না যে তার কারণ বহুবিধ৷ প্রথমত, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতাদের আশা ছিল কলকাতার বিরুদ্ধে তাঁদের এই লড়াইয়ে তাঁরা দিল্লিকে সঙ্গে পাবেন৷ উত্তরবঙ্গের গুটিকতক আপনি মোড়ল কংগ্রেসি নেতা সেই উচ্চাশায় ইন্ধনও জুগিয়েছিলেন৷ কিন্ত্ত অন্ধ্রবিভাজনের ফলস্বরূপ ঘরেবাইরে ল্যাজে-গোবরে অবস্থা হওয়া কংগ্রেস নেতৃত্ব গুরুং এন্ড কোং-কে কোনও পাত্তাই দেননি৷ নেতারা রাজধানীতে গিয়ে দরজায় দরজায় কড়া নেড়েছেন, কেউ চা-বিস্কুট খাইয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন, কেউ আবার দরজাও খোলেননি৷ ফলে দপ করে জ্বলে ওঠা আগুন খপ করে আবার নিভেও গিয়েছে৷
দ্বিতীয়ত, জনজীবন স্তব্ধ করে লাগাতার আন্দোলন সফল করার মতো পরিস্থিতিই আর পাহাড়ে নেই৷ পাহাড়বাসী দেখে শিখেছেন, ঠেকেও শিখেছেন৷ সেই আশির দশকের গোড়া থেকে আন্দোলন দেখতে অভ্যস্ত মানুষ বুঝে গিয়েছেন, আন্দোলনে তাঁদের আম ও ছালা দু'টোই চলে যাওয়ার উপক্রম হয়, তদতিরিক্ত আর কিছুই জোটে না৷ তাঁরা জানেন, বন্ধ মানে ভুখা পেট, বন্ধ মানে নৈরাজ্য৷ এত লড়াইয়ের পরেও তাঁদের প্রাপ্যের ঝুলিতে যে জিটিএ ছাড়া কিছুই জুটবে না, সে ব্যাপারেও একটা নীরব ঐকমত্য তৈরি হয়ে গিয়েছে পাহাড়ে৷ অতএব, জমি চাষযোগ্য কি না তা ভালো করে পরখ না করেই বীজ ছড়িয়েছিলেন মোর্চা নেতারা৷ অঙ্কুর গজানোর আগেই তা নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷
তৃতীয়ত, মোর্চার সর্বাধিনায়ক বিমল গুরুংয়ের গুন্ডার সর্দার বলে পাহাড়ে যতটুকু পরিচয় আছে, নেতা হিসেবে ততটা নেই৷ সাত জার্মানের বিরুদ্ধে লড়া তিনি একলা জগাই৷ রাজনীতি বোঝেন না, কৌশল বোঝেন না, বাস্তব পরিস্থিতির ধার ধারেন না, কেবল পেশি-আস্ফালন করে ফোঁস করতে জানেন৷ গতকালই জিটিএ গড়তে রাজি হয়ে আজ গোর্খাল্যান্ডের দাবি জানানো যে মামা বাড়ির আবদার ছাড়া কিছুই নয় এটুকু বোঝার মতো রাজনৈতিক বিচক্ষণতাও নেই গুরুংয়ের৷ অন্য যত দোষ বা দুর্বলতাই থাক গুরুংয়ের তুলনায় অনেক বেশি বিচক্ষণ ছিলেন সুবাস ঘিসিং৷ গোর্খাল্যান্ডের আন্দোলনকে ধীরে ধীরে চরম বিন্দুতে নিয়ে যাওয়ার পরে তিনি বিচক্ষণের মতো মেনে নিয়েছিলেন স্ব-শাসিত পরিষদ৷ বুঝেছিলেন, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো, বুঝেছিলেন এমনতরো অসম লড়াইয়ে, বিপদাপন্ন পণ্ডিতের মতো অর্ধেক ত্যাগ করাই শ্রেয়৷
এর পরিপ্রেক্ষিতেই সফল হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর 'ক্যারট অ্যান্ড স্টিক' পাহাড়-নীতি৷ পাহাড়ের বঞ্চনাবোধের যন্ত্রণাটা যে বাস্তব সত্য মমতা সেটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে থেকেই৷ ফলে মহাকরণে প্রবেশের অব্যবহিত পর থেকেই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল পৃথক রাজ্যের দাবির বদলে পাহাড়বাসীর ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার জন্য সর্বতো ভাবে সচেষ্ট হওয়া৷ সেই সূত্রেই গত সোয়া দু'বছরে বার বার পাহাড়ে গিয়ে তিনি সেখানকার মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত সেতুবন্ধনের চেষ্টা করেছেন, বার বার শোনাতে চেয়েছেন তাঁর সরকারের সদিচ্ছার বার্তা৷ প্রতিটি সফরে এক দিকে যেমন উন্নয়নের বিবিধ বিষয়ে তিনি কল্পতরু হতে চেয়েছেন, অন্যদিকে তেমনই গোর্খাল্যান্ড শব্দটিকে সম্মানের ইস্যু করে তোলেননি৷ পাহাড়কে এই রকম গুরুত্ব, পাহাড়বাসীর সঙ্গে এই ভাবে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা বাম আমলের দুই মুখ্যমন্ত্রীর কেউই করেননি৷ প্রথমে গোর্খাল্যান্ডের আন্দোলন পুলিশ দিয়ে দমন করার চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পরে সাপের ছুঁচো গেলার মতো মেনে নিয়েছেন স্বায়ত্তশাসন৷ তার পর বছরের পর বছর ঘিসিংয়ের বিচিত্র স্বেচ্ছাচারী শাসনের মুখে পাহাড়বাসীকে ফেলে দিয়ে কলকাতায় বসে উপভোগ করেছেন শান্তির মৌতাত৷ জ্যোতিবাবু কিংবা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কেউই সে অর্থে দার্জিলিংয়েরও মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না৷ মমতা সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেননি৷
ফলে গুরুং এন্ড কোং যখন বেগড়বাঁই করতে শুরু করেছেন তাঁর মতো করে 'রাফ অ্যান্ড টাফ' হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ কলকাতায় বসে না থেকে লড়াইটাকে তিনি নিয়ে গিয়েছেন প্রতিপক্ষের ডেরায়৷ পুলিশি বন্দোবস্ত আঁটোসাঁটো করেছেন, দলকে কাজে লাগিয়েছেন, বেশ কয়েক জন মোর্চা নেতাকে হাজতে ভরেছেন, নরমপন্থীদের নিজের কাছে টেনেছেন, ধর্মঘটীদের বেতন কাটার হুমকি দিয়েছেন, গুরুংদের আর্থিক রসদের জোগানটাও বন্ধ করে দিয়েছেন কড়া হাতে৷ একদিকে পাহাড়বাসীর ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা এবং অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রীর সাজানো চক্রব্যুহের মাঝখানে পড়ে প্রায় রাতারাতি চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো দেখাচ্ছে বিমল-সর্দারকে৷
দিদি ছেড়ে দিলে এ বার তিনি কেঁদে বাঁচতে পারেন একটু৷ আর মোর্চা নেতারা মিউ মিউ করে জানিয়ে দিয়েছেন, ঘাট হয়েছে, এই কান ধরছি, আর কোনও দিন ধর্মঘটের প্রলোভনে পা দেব না৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের টুপিতে এটা যে সবচেয়ে ঝলমলে পালক, ঢোঁক গিলে হলেও তা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁর সমালোচকেরাও৷ এক দিক থেকে দেখতে গেলে পাহাড়ের সমস্যার চরিত্র জঙ্গলমহলের সমস্যার চরিত্রের চেয়ে পৃথক৷ জঙ্গলের সমস্যা ছিল প্রধানত আইন-শৃঙ্খলার৷ পাহাড়ের সমস্যা একটি জনজাতির ভাবাবেগের, যার শিকড় ঐতিহাসিক বাস্তবতায় এবং ব্যাপ্তি আপামর পাহাড়বাসীর মনে৷ চোখের বদলে চোখের নীতি নিলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জেহাদ দমন করা সহজ হয়, বিশেষ করে যখন সেই লড়াইয়ের পিছনে জনসমর্থন নেই৷ কিন্ত্ত লাঠ্যৌষধি প্রয়োগ করে ভাবাবেগ নির্মূল করা যায় না, যাবেও না৷
অতএব, পাহাড়ের মন জেতার লড়াই গুরুংদের আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে গেল এমনটা ভাবা হবে নিছকই মূর্খামি৷
আশঙ্কার কথা যেটা তা হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সাফল্যের মধ্যে অনেকে, বিশেষ করে তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা প্রায় যুদ্ধজয়ের তৃপ্তি অনুভব করছেন৷ তাঁদের ভাবখানা এমন যেন পাকিস্তানি ফৌজ মুচলেকা দিচ্ছে ভারতের সেনানায়কের কাছে৷ এই প্রবণতাটাই বিপজ্জনক৷ দার্জিলিংয়ের বিচ্ছিন্নতাবোধের উত্সটি নিহিত আছে সমতলের এই যুদ্ধং-দেহি মনোভাবেই৷
সবার উপরে সবচেয়ে বড় সত্যটা হল সমতল-বাংলার মানসপটে গোর্খা বা নেপালিদের কোনও জায়গা নেই৷ সমতলের কাছে পাহাড় সস্তায় বেড়ানোর গন্তব্য আর নেপালিরা দারোয়ান ছাড়া কিছুই নয়৷ রাষ্ট্রশক্তি চাইলে ভূখণ্ড নিজের নিয়ন্ত্রণে যে রেখে দিতে পারে ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত আছে অজস্র৷ কিন্ত্ত মানসিক নৈকট্যের পূর্বশর্ত বাংলার বিবিধ ক্রিয়া-কর্মের মূল স্রোতে পাহাড়বাসীকে সসম্মানে এবং সহানুভূতির সঙ্গে জায়গা করে দেওয়া৷ স্বাধীনতা উত্তর পশ্চিমবঙ্গে এই কাজটাই কোনও সরকার করেনি এত কাল৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করবেন কি?
যদি করেন বা করতে পারেন তবেই এক দিন প্রাণখোলা হাসি হাসবে কাঞ্চনজঙ্ঘা, তার কিরণে উদ্ভাসিত হব আমরা সবাই৷
মাটির গন্ধ-মাখা রূপকালঙ্কারে কথা বলা আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর দীর্ঘ দিনের অভ্যেস৷ কলকাত্তাইয়া বাবুদিগের অনেক সময় সে সব কথা কানে এলে বেজায় আমোদ হয়, বিশেষ কারও কারও বমনোদ্রেক হয় বলেও শুনেছি৷ কিন্ত্ত গুটিকয় উন্নত-নাসিকা ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়ার সুশীল আভিজাত্যের ধার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কবেই বা ধারলেন? ধারতে যাবেন কোন দুঃখে?
কৃষি ও শিল্পের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে এ রাজ্যে রাজনৈতিক স্লোগান-কাব্য কম রচিত হয়নি৷ অনেক মাথা ঘামানোর পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, 'কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষত্৷' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন সব অকারণ খটমট শব্দ-সম্ভারের মধ্যে প্রবেশই করলেন না৷ তিনি নাম দিলেন 'হাসি-খুশি'৷ কৃষি 'হাসি', শিল্প 'খুশি'৷ 'হাসি-খুশি বনগাঁ মাসি, মোদের ঘরে এসো' পড়ে যাঁরা বড় হয়েছে বা হচ্ছে এই শব্দ-বন্ধটি তাদের মনে ধরে গেল চোখের নিমেষে৷ কাব্যিক বংশ-কৌলীন্য ও প্রেসিডেন্সির বাংলা অনার্স ক্লাসে এত সময় কাটিয়েও যোগমায়া দেবীর মেয়ের কাছে দশ গোল খেয়ে গেলেন বুদ্ধদেব!
অম্ল আর কোষ্ঠ-কাঠিন্যে জর্জর এই গোমড়া-মুখো বঙ্গদেশে যত্র-তত্র, যখন-তখন হাসি-র সন্ধান পাওয়া আদৌ চাট্টিখানি ব্যাপার নয়৷ হাসির ব্যাপার তো নয়ই৷ অথচ আমাদের মুখ্যমন্ত্রী এক রকম অক্লেশে এই কাজটা করে চলেছেন সেই কবে থেকেই৷ কৃষিকে 'হাসি' নাম দেওয়ার পরে খুশিতে তিনি ইদানীং প্রায়ই বলে থাকেন, 'জঙ্গল-মহল হাসছে৷ পাহাড় হাসছে৷ কমরেড-বন্ধুগণ বলুন তো দেখি, এতদিন ধরে আপনারা কী করছিলেন? নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন না তো?'
জঙ্গল-মহলের 'হাসি' নিয়ে জঙ্গল-মহলের বাইরে তেমন একটা চর্চা হয় না৷ রাজানুগত্যে গোপাল ভাঁড়কেও যাঁরা নিত্য-দিন লজ্জা দিচ্ছেন সেই সব তৃণমূলি মিডিয়া-সম্প্রদায়কেও বড় একটা দেখি না, এই 'হাসি'-র তাত্পর্য বিশ্লেষণে তেমন একটা আগ্রহ আছে৷ যতদিন অশান্তি ছিল, রোজ লাশ পড়ত আর বন্ধ হত, জঙ্গলমহল ছিল সংবাদের শিরোনামে৷ এখন শান্তি ফিরেছে তাই ফুরিয়েছে গপ্পো-ফাঁদার তাগিদও৷ ওই কুকুর মানুষকে কামড়ালে খবর নয়, মানুষ কুকুরকে কামড়ালে তবেই খবর গোছের ব্যাপার আর কী!
জঙ্গল-মহলে যাঁদের বসবাস, শুধু তাঁরাই জানেন, মুখ্যমন্ত্রীর রূপক আদতে হাসির বিষয় নয়, তাঁদের জীবনের একমাত্র জ্বলন্ত সত্য৷ কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই 'হাসি'-র কথা তাঁরা ভাবতেও পারতেন না৷ সকালে ঘুম থেকে উঠে তাঁরা টেলিভিশনে দেখে নিতেন আজ বন্ধ কি না, হলে কত দিন চলবে, না হলে ফের কবে হবে৷ রাতে শুতে যাওয়ার আগে আবার ওই টেলিভিশনের খবরেই গুণে নিতেন গত চব্বিশ ঘন্টায় ক'টা বডি পড়ে গেল, তাদের মধ্যে কয়টা সিপিএমের, কয়টা মাওবাদীদের, কয়টা পুলিশের৷ বডিগুলোর কোনওটা আত্মীয়-স্বজন বা পাড়া-পড়শির কি না, থাকত সে সম্পর্কে সঙ্গত বাড়তি কৌতুহল৷
সেই ভয়ার্ত, কর্মহীন,অশান্তি আর অনিশ্চয়তায় ভরা অরণ্যের দিন-রাত্রিগুলি এখন পাড়ার আড্ডায় অতিরঞ্জিত গাল-গল্পের বিষয় হয়ে বেঁচে আছে কেবল৷ জঙ্গল-মহলে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে এসেছে, ছেলে-মেয়েরা নিয়মিত ইস্কুল-কলেজে যাচ্ছে, দোকানপাট, হাট-বাজারে রোজকার কর্মব্যস্ততা৷ জঙ্গলমহলে এর ফলে রাম-রাজ্য ফিরে এসেছে তা নয়, তবে রাজনৈতিকভাবে তৃণমূলই একা তাদের প্রাপ্য ফসল ঘরে তুলেছে৷ বিধানসভার পরে পঞ্চায়েত ভোটেও ঘাসফুলে ছয়লাপ হয়ে গিয়েছে জঙ্গল-মহল৷ এর জন্য মুকুল রায় বা শুভেন্দু অধিকারীদের গুন্ডা-মস্তানের ব্যবস্থা করতে হয়নি, গোটা এলাকাটাকে পরিণত করতে হয়নি 'চমকাইতলা'য়৷ জঙ্গল-মহলের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দু'হাত তুলে আর্শীবাদ করেছেন মুখ্যমন্ত্রীকে৷ একদা তাঁদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে মূষিক-শাবকের অবস্থা কালকের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কমরেডদের৷ গোটা তল্লাটে সবচেয়ে নোংরা ও ঘৃণিত শব্দের নাম এখন সিপিএম৷
ক্ষমতায় আসার পরে প্রায় যুদ্ধকালীন ব্যস্ততায় নতুন ত্রিপাক্ষিক চুক্তি ও গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে(জিটিএ) ভোট করিয়ে দেওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রীর মনে হয়েছিল পাহাড়ও বুঝি হাসছে৷ কিন্ত্ত বাস্তবে তা হয়নি, সেই হাসি ছিল মেকি, ঘর ভালো করে গুছিয়ে নেওয়ার কৌশল মাত্র৷ ফলে কিছুকাল পরেই দেখা গেল ফের পৃথক রাজ্যের দাবিকে কেন্দ্র করে অশান্তি ফিরে এসেছে পাহাড়ে, আবার শুরু হয়েছে লাগাতার বনধ, ইতি-উতি অগ্নি-সংযোগ৷ চকিতে ফের স্তব্ধ পাহাড়ি জীবন৷ কেন্দ্রীয় সরকার তেলেঙ্গানাকে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার পরে পাহাড়ি নেতাদেরও ফের মনে হতে শুরু এই মওকায় কার্যসিদ্ধি হয়ে যাবে তাঁদেরও৷
হল না যে তার কারণ বহুবিধ৷ প্রথমত, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতাদের আশা ছিল কলকাতার বিরুদ্ধে তাঁদের এই লড়াইয়ে তাঁরা দিল্লিকে সঙ্গে পাবেন৷ উত্তরবঙ্গের গুটিকতক আপনি মোড়ল কংগ্রেসি নেতা সেই উচ্চাশায় ইন্ধনও জুগিয়েছিলেন৷ কিন্ত্ত অন্ধ্রবিভাজনের ফলস্বরূপ ঘরেবাইরে ল্যাজে-গোবরে অবস্থা হওয়া কংগ্রেস নেতৃত্ব গুরুং এন্ড কোং-কে কোনও পাত্তাই দেননি৷ নেতারা রাজধানীতে গিয়ে দরজায় দরজায় কড়া নেড়েছেন, কেউ চা-বিস্কুট খাইয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন, কেউ আবার দরজাও খোলেননি৷ ফলে দপ করে জ্বলে ওঠা আগুন খপ করে আবার নিভেও গিয়েছে৷
দ্বিতীয়ত, জনজীবন স্তব্ধ করে লাগাতার আন্দোলন সফল করার মতো পরিস্থিতিই আর পাহাড়ে নেই৷ পাহাড়বাসী দেখে শিখেছেন, ঠেকেও শিখেছেন৷ সেই আশির দশকের গোড়া থেকে আন্দোলন দেখতে অভ্যস্ত মানুষ বুঝে গিয়েছেন, আন্দোলনে তাঁদের আম ও ছালা দু'টোই চলে যাওয়ার উপক্রম হয়, তদতিরিক্ত আর কিছুই জোটে না৷ তাঁরা জানেন, বন্ধ মানে ভুখা পেট, বন্ধ মানে নৈরাজ্য৷ এত লড়াইয়ের পরেও তাঁদের প্রাপ্যের ঝুলিতে যে জিটিএ ছাড়া কিছুই জুটবে না, সে ব্যাপারেও একটা নীরব ঐকমত্য তৈরি হয়ে গিয়েছে পাহাড়ে৷ অতএব, জমি চাষযোগ্য কি না তা ভালো করে পরখ না করেই বীজ ছড়িয়েছিলেন মোর্চা নেতারা৷ অঙ্কুর গজানোর আগেই তা নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷
তৃতীয়ত, মোর্চার সর্বাধিনায়ক বিমল গুরুংয়ের গুন্ডার সর্দার বলে পাহাড়ে যতটুকু পরিচয় আছে, নেতা হিসেবে ততটা নেই৷ সাত জার্মানের বিরুদ্ধে লড়া তিনি একলা জগাই৷ রাজনীতি বোঝেন না, কৌশল বোঝেন না, বাস্তব পরিস্থিতির ধার ধারেন না, কেবল পেশি-আস্ফালন করে ফোঁস করতে জানেন৷ গতকালই জিটিএ গড়তে রাজি হয়ে আজ গোর্খাল্যান্ডের দাবি জানানো যে মামা বাড়ির আবদার ছাড়া কিছুই নয় এটুকু বোঝার মতো রাজনৈতিক বিচক্ষণতাও নেই গুরুংয়ের৷ অন্য যত দোষ বা দুর্বলতাই থাক গুরুংয়ের তুলনায় অনেক বেশি বিচক্ষণ ছিলেন সুবাস ঘিসিং৷ গোর্খাল্যান্ডের আন্দোলনকে ধীরে ধীরে চরম বিন্দুতে নিয়ে যাওয়ার পরে তিনি বিচক্ষণের মতো মেনে নিয়েছিলেন স্ব-শাসিত পরিষদ৷ বুঝেছিলেন, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো, বুঝেছিলেন এমনতরো অসম লড়াইয়ে, বিপদাপন্ন পণ্ডিতের মতো অর্ধেক ত্যাগ করাই শ্রেয়৷
এর পরিপ্রেক্ষিতেই সফল হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর 'ক্যারট অ্যান্ড স্টিক' পাহাড়-নীতি৷ পাহাড়ের বঞ্চনাবোধের যন্ত্রণাটা যে বাস্তব সত্য মমতা সেটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে থেকেই৷ ফলে মহাকরণে প্রবেশের অব্যবহিত পর থেকেই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল পৃথক রাজ্যের দাবির বদলে পাহাড়বাসীর ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার জন্য সর্বতো ভাবে সচেষ্ট হওয়া৷ সেই সূত্রেই গত সোয়া দু'বছরে বার বার পাহাড়ে গিয়ে তিনি সেখানকার মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত সেতুবন্ধনের চেষ্টা করেছেন, বার বার শোনাতে চেয়েছেন তাঁর সরকারের সদিচ্ছার বার্তা৷ প্রতিটি সফরে এক দিকে যেমন উন্নয়নের বিবিধ বিষয়ে তিনি কল্পতরু হতে চেয়েছেন, অন্যদিকে তেমনই গোর্খাল্যান্ড শব্দটিকে সম্মানের ইস্যু করে তোলেননি৷ পাহাড়কে এই রকম গুরুত্ব, পাহাড়বাসীর সঙ্গে এই ভাবে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা বাম আমলের দুই মুখ্যমন্ত্রীর কেউই করেননি৷ প্রথমে গোর্খাল্যান্ডের আন্দোলন পুলিশ দিয়ে দমন করার চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পরে সাপের ছুঁচো গেলার মতো মেনে নিয়েছেন স্বায়ত্তশাসন৷ তার পর বছরের পর বছর ঘিসিংয়ের বিচিত্র স্বেচ্ছাচারী শাসনের মুখে পাহাড়বাসীকে ফেলে দিয়ে কলকাতায় বসে উপভোগ করেছেন শান্তির মৌতাত৷ জ্যোতিবাবু কিংবা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কেউই সে অর্থে দার্জিলিংয়েরও মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না৷ মমতা সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেননি৷
ফলে গুরুং এন্ড কোং যখন বেগড়বাঁই করতে শুরু করেছেন তাঁর মতো করে 'রাফ অ্যান্ড টাফ' হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ কলকাতায় বসে না থেকে লড়াইটাকে তিনি নিয়ে গিয়েছেন প্রতিপক্ষের ডেরায়৷ পুলিশি বন্দোবস্ত আঁটোসাঁটো করেছেন, দলকে কাজে লাগিয়েছেন, বেশ কয়েক জন মোর্চা নেতাকে হাজতে ভরেছেন, নরমপন্থীদের নিজের কাছে টেনেছেন, ধর্মঘটীদের বেতন কাটার হুমকি দিয়েছেন, গুরুংদের আর্থিক রসদের জোগানটাও বন্ধ করে দিয়েছেন কড়া হাতে৷ একদিকে পাহাড়বাসীর ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা এবং অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রীর সাজানো চক্রব্যুহের মাঝখানে পড়ে প্রায় রাতারাতি চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো দেখাচ্ছে বিমল-সর্দারকে৷
দিদি ছেড়ে দিলে এ বার তিনি কেঁদে বাঁচতে পারেন একটু৷ আর মোর্চা নেতারা মিউ মিউ করে জানিয়ে দিয়েছেন, ঘাট হয়েছে, এই কান ধরছি, আর কোনও দিন ধর্মঘটের প্রলোভনে পা দেব না৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের টুপিতে এটা যে সবচেয়ে ঝলমলে পালক, ঢোঁক গিলে হলেও তা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁর সমালোচকেরাও৷ এক দিক থেকে দেখতে গেলে পাহাড়ের সমস্যার চরিত্র জঙ্গলমহলের সমস্যার চরিত্রের চেয়ে পৃথক৷ জঙ্গলের সমস্যা ছিল প্রধানত আইন-শৃঙ্খলার৷ পাহাড়ের সমস্যা একটি জনজাতির ভাবাবেগের, যার শিকড় ঐতিহাসিক বাস্তবতায় এবং ব্যাপ্তি আপামর পাহাড়বাসীর মনে৷ চোখের বদলে চোখের নীতি নিলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জেহাদ দমন করা সহজ হয়, বিশেষ করে যখন সেই লড়াইয়ের পিছনে জনসমর্থন নেই৷ কিন্ত্ত লাঠ্যৌষধি প্রয়োগ করে ভাবাবেগ নির্মূল করা যায় না, যাবেও না৷
অতএব, পাহাড়ের মন জেতার লড়াই গুরুংদের আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে গেল এমনটা ভাবা হবে নিছকই মূর্খামি৷
আশঙ্কার কথা যেটা তা হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সাফল্যের মধ্যে অনেকে, বিশেষ করে তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা প্রায় যুদ্ধজয়ের তৃপ্তি অনুভব করছেন৷ তাঁদের ভাবখানা এমন যেন পাকিস্তানি ফৌজ মুচলেকা দিচ্ছে ভারতের সেনানায়কের কাছে৷ এই প্রবণতাটাই বিপজ্জনক৷ দার্জিলিংয়ের বিচ্ছিন্নতাবোধের উত্সটি নিহিত আছে সমতলের এই যুদ্ধং-দেহি মনোভাবেই৷
সবার উপরে সবচেয়ে বড় সত্যটা হল সমতল-বাংলার মানসপটে গোর্খা বা নেপালিদের কোনও জায়গা নেই৷ সমতলের কাছে পাহাড় সস্তায় বেড়ানোর গন্তব্য আর নেপালিরা দারোয়ান ছাড়া কিছুই নয়৷ রাষ্ট্রশক্তি চাইলে ভূখণ্ড নিজের নিয়ন্ত্রণে যে রেখে দিতে পারে ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত আছে অজস্র৷ কিন্ত্ত মানসিক নৈকট্যের পূর্বশর্ত বাংলার বিবিধ ক্রিয়া-কর্মের মূল স্রোতে পাহাড়বাসীকে সসম্মানে এবং সহানুভূতির সঙ্গে জায়গা করে দেওয়া৷ স্বাধীনতা উত্তর পশ্চিমবঙ্গে এই কাজটাই কোনও সরকার করেনি এত কাল৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করবেন কি?
যদি করেন বা করতে পারেন তবেই এক দিন প্রাণখোলা হাসি হাসবে কাঞ্চনজঙ্ঘা, তার কিরণে উদ্ভাসিত হব আমরা সবাই৷
No comments:
Post a Comment