রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারই পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়৷ এর উপরেই নির্ভর করে বিপুল অর্থের উপর নিয়ন্ত্রণের অধিকার৷ রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সাম্প্রতিক হিংসাত্মক সংঘর্ষের কারণ খুঁজলেন রজত রায়।
আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রক্তপাত শুরু হয়ে গিয়েছে৷ ইতিমধ্যেই নিহতের তালিকায় বিরোধী সিপিএম-এর একাধিক ব্যক্তি ও শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের একজনের নাম উঠে গিয়েছে৷ আহতদের সংখ্যা তো অগুন্তি৷ প্রতি দিনই নতুন নতুন এলাকা থেকে হিংসার খবর আসছে৷ কোথায় গিয়ে এই রক্তপাত থামবে কে জানে৷ সংবাদপত্রের পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায় এখন শুধু সংঘর্ষ, অভিযোগ- পাল্টা অভিযোগের খবর৷ সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও একটি উপাদান- সন্ত্রাসের আবহ৷ প্রতি দিনে কানে আসছে, শাসক দলের চোখ রাঁঙানির সামনে নতি-স্বীকার করে বিরোধী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন৷ সব মিলিয়ে, অবস্থাটা এমনই দাঁড়িয়েছে যা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো বিজ্ঞাপন নয়৷
কেন এত হিংসা? এত রক্ত কেন? রাজনৈতিক ব্যাখ্যা একটাই, সামনের বছর যেহেতু লোকসভা নির্বাচন, তাই পঞ্চায়েত ভোটকে তার সেমিফাইনাল ধরে নিয়ে সব দলই চাইবে নিজেদের শক্তি ও প্রভাব যতটা সম্ভব বাড়িয়ে নিতে৷ আর যেহেতু, দীর্ঘ দিন ধরেই ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে অপরাধ জগতের একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তাই রাজনৈতিক দলগুলি গণতন্ত্রের স্বার্থ মেনে মানুষের সমর্থন সংগ্রহের জন্য চেষ্টা না করে পেশীশক্তির সাহায্যে সন্ত্রাসের মাধ্যমে তা 'আদায়ের' সহজিয়া পথ অবলম্বন করছে৷ শাসক দলের জন্য কথাটা আরও বেশি করে সত্যি৷
কিন্ত্ত, শুধুই রাজনৈতিক ক্ষমতাটা বিস্তারের জন্যই এত রক্তপাত মনে করলে, সমস্যার সার্বিক চিত্রটা ধরা যাবে না৷ যদি, নিছক রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারই এই হিংসার মূলে থাকত, তা হলে পুরভোট, বিধানসভা ও লোকসভা- সব নির্বাচনের সময়েই হিংসা বাড়ত৷ অন্য ভোটের সময় হিংসা ও রক্তপাত হলেও তা পঞ্চায়েত নির্বাচনের সঙ্গে তুলনীয় নয়৷ তাই, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রেক্ষিতে এই হিংসাকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না৷ এই হিংসার একটা অর্থনৈতিক ভিত্তিও আছে৷
এক কথায় বলতে গেলে, প্রতি বছর গ্রাম-বাংলায় যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে উন্নয়নের জন্য আসছে, তার একটা বড়ো অংশ লুঠ করার অধিকার পেতেই পঞ্চায়েত ভোটের সময় যেনতেনপ্রকারেন ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে রাজনৈতিক দলগুলি৷ পশ্চিমবঙ্গে মোট ৩২০০টি গ্রাম-পঞ্চায়েত আছে, এ ছাড়া রয়েছে ৩২০টি পঞ্চায়েত সমিতি, আর ১৭টি জেলা-পরিষদ৷ প্রতি বছর গ্রাম-পঞ্চায়েতগুলি বছরে গড়ে দুই থেকে পাঁচ কোটি টাকা পেয়ে থাকে৷ এর মধ্যে আবার ১০০০টি এমন গ্রাম-পঞ্চায়েত রয়েছে, যারা কি না বিশ্ব-ব্যাঙ্কের প্রকল্পে আরও অনেক বেশি টাকা পায়৷ এ ছাড়া জেলা-পরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতিগুলিও আলাদা করে কেন্দ্রীয় প্রকল্প রূপায়নের জন্য টাকা পায়৷ যেমন, এন আর ই জি এস বাবদ টাকা গ্রাম-পঞ্চায়েতের হাতে সরাসরি এলেও ইন্দিরা আবাসনের টাকা পঞ্চায়েত সমিতির হাত ঘুরে আসে৷ কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের দেওয়া হিসাব থেকেই দেখা যাচ্ছে, ২০১০-১১ আর্থিক বছরে এন আর ই জি এস খাতে পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল ২৫৬৬ কোটি টাকা, আর শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল ২১১৭ কোটি টাকা৷ ২০১১-১২ আর্থিক বছরে এই খাতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ছিল ৩৭১৩ কোটি টাকা, আর খরচ হয়েছিল ২৫৯৭ কোটি টাকা৷ এ ভাবেই বিপুল পরিমাণ কেন্দ্রীয় অর্থ বরাদ্দ হয় শুধুই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের জন্য৷ এর মধ্যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের বেতন ইত্যাদির খরচ ধরা হয় না৷ আর এই উন্নয়নের টাকার একটা বড়ো অংশই নির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে চোরাপথে রাজনৈতিক দলগুলির নেতা ও কর্মীদের পকেট স্ফীত করে চলেছে৷ বছরের পর বছর ধারাবাহিক ভাবে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন কেন্দ্র প্রকল্পে গ্রাম বাংলায় আসে তার অন্তত ৬০ শতাংশ ঠিক মতো খরচ হলেই বাংলার হাল পাল্টে যেত৷ কিন্ত্ত গ্রাম বাংলার চেহারা যে এত দিনেও পাল্টালো না তার কারণ আর কিছুই না, এই টাকার সিংহ ভাগই চুরি হয়ে যায়৷
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক৷ এ বছর রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তর থেকে খুব ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হয়েছিল যে বীরভূম জেলার হাসান এলাকায় একটি গ্রাম-পঞ্চায়েত ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে (এন আর ই জি এস) ১০০ দিন করে ফেলেছে৷ গোটা রাজ্যে যেখানে গড়ে ৩২ দিনের বেশি কাজ দেওয়া যায়নি, সেখানে হাসান গ্রাম-পঞ্চায়েতের এই সাফল্য যে কিছুটা বিস্ময়ের সৃষ্টি করবে, তা বলাই বাহুল্য৷ তার ক' দিন পরেই জানা গেল, গোটাটাই পুকুর চুরির ব্যাপার৷ যেমন খুশি তালিকা তৈরি করে টাকাটা স্রেফ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে৷ এমন কী মৃত ব্যক্তিদের নাম ওই তালিকায় ঢুকিয়ে ১০০ দিনের কাজের হিসাব দিয়ে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে৷ গ্রাম-পঞ্চায়েতের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা না থাকলে এ রকম পুকুর চুরি কখনওই করা সম্ভব নয়৷ গোটা চুরির ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে হলে সমস্যার আর একটু গভীরে যাওয়া দরকার৷ এন আর ই জি এস প্রকল্পের আওতায় কী কাজ হচ্ছে, তা কখনই সরেজমিনে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা (ফিজিক্যাল অডিট) নেই, শুধুই খরচের হিসাব দেখে টাকা দেওয়া হয়৷ সরকারি পরিভাষায় গ্রাম-পঞ্চায়েতগুলি 'ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট' দিতে পারলেই হল৷ ফলে, ঠিক মতো 'ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট' দিতে পারলে, অর্থাত্ নামের তালিকা, কাজের দিনের সংখ্যা ও প্রাপ্য টাকার হিসেব ঠিক মতো জমা দিতে পারলেই সরকারের কোষাগার থেকে টাকা বেরিয়ে এসে সোজা রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে ঢুকে যাবে৷ ২০১০ সালে ওই বীরভূম জেলার বোলপুর মহকুমার আওতায় ৩১টি গ্রাম-পঞ্চায়েত সেবার গোটা বছরে নাকি এন আর ই জি এস প্রকল্পে ৪০ কোটি টাকা খরচ করেছিল৷ ওই অফিসারটি ৩১টি গ্রাম-পঞ্চায়েতের প্রধানকে চিঠি লিখে তাদের কাজের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে সেই সঙ্গে বললেন, তারা যদি তাদের এন আর ই জি এস কাজের দু' একটা নমুনার ছবি তুলে পাঠান৷ ওই চিঠির পরে তিনি ৬ মাস অপেক্ষা করে আবারও চিঠি দিয়ে সেটা মনে করিয়ে দেন৷ কিন্ত্ত, ৩১টি গ্রাম-পঞ্চায়েতের একটিও ছবি পাঠানো দূরের কথা, চিঠির প্রাপ্তি-স্বীকার পর্যন্ত করেনি৷ কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ পঞ্চায়েত দপ্তরের এক শীর্ষ আমলার কথায়, এন আর ই জি এস-এর টাকায় কাজের যে হিসাব জিপিগুলি দিয়েছিল, তার বেশিটাই জল মেশানো৷ যেহেতু এন আর ই জি এস কাজের অডিট শুধুই ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেটকে ভিত্তি করে হয়, তাই চুরি করার সুযোগ অনেক বেশি৷ রাজনৈতিক নেতারা তারই সুযোগ নেয়৷
কিন্ত্ত, এন আর ই জি এস সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা প্রকৃত গ্রহীতার হাতে যাতে পৌঁছে যায়, সে জন্য প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষেরও জিরো ব্যালেন্স ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা চালু হয়েছে৷ তা ছাড়া আধার কার্ড তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি টাকা দেওয়ার ব্যবস্থাও শুরু হয়েছে৷ উদ্দেশ্য- গ্রামের গরিবদের জন্য পাঠানো টাকা যাতে মাঝপথে দালাল মধ্যসত্ত্বভোগীরা (পঞ্চায়েতের সঙ্গে যুক্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিরা) মেরে না দিতে পারে৷ কিন্ত্ত, তাতেও চুরি কতটা ঠেকানো যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে৷ কারণ, ফিজিক্যাল অডিটের সুযোগ না থাকলেও এন আর ই জি এস কাজ-কর্মের অবস্থা খাতিয়ে দেখার জন্য সোশাল অডিটের সুযোগ তো রয়েছে৷ আর সেই সুবাদেই বেরিয়ে আসছে পুকুর চুরির আর এক গল্প৷ উত্তরবঙ্গের এক জেলায় এমনই এক সোশাল অডিট দেখার অভিজ্ঞতা৷ নিয়ম মাত্র, কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নির্দিষ্ট গ্রাম-পঞ্চায়েতে এক বছরের কাজের সালতামামি করে তার রিপোর্ট তৈরি করে এক সভার আয়োজন করে থাকে৷ ওই সভায় গ্রাম-পঞ্চায়েত প্রধানসহ অন্য পদাধিকারী যেমন হাজির থাকেন, তেমনই গ্রামবাসীরাও থাকেন৷ সেখানে সবার সামনে একটি একটি করে কাজের হিসাব (যেমন, একটা পুকুর কাটা হয়েছে ৭ লাখ টাকা খরচ করে) পেশ করা হয়৷ তা শুনে গ্রামবাসীরা মন্তব্য করবেন৷ পঞ্চায়েতের কর্তারাও তাদের স্বপক্ষে কিছু বলার থাকলে বলবেন৷ এমনই এক সভায় গ্রামের মানুষেরা একের পর এক কাজের হিসাবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসল প্রধানের সামনেই৷ জবাবে প্রধান আমতা আমতা করা ছাড়া আর কিছু করলেন না৷ কিন্ত্ত সব কিছু ছাপিয়ে গেল যখন এন আর ই জি এস কাজের কথা উঠল৷ এক জন বি পি এল তালিকাভুক্ত মানুষ জানালেন যে তিনি গত বছরে মাত্র আট দিনের কাজ পেয়েছিলেন, কিন্ত্ত ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখেন তার চাইতে অনেক বেশি দিনের টাকা জমা পড়েছে৷ বিষয়টি নিয়ে পঞ্চায়েত অফিসে জানালে জবাব মিলল, 'জানি, তুমি ৮ দিনের জায়গায় ১০ দিনের টাকা রেখে বাকি টাকাটা আমলাদের দিয়ে দাও৷ আর যদি তা না কর, তা হলে আর কাজ পাবে না৷' ওই মানুষটি এ কথা জানিয়ে বললেন, তিনি বাড়তি টাকা পঞ্চায়েত নেতাদের দিতে রাজি হননি, ফলে আর এন আর ই জি এস-এর কাজও পাননি৷ আর একজন জানালেন, তিনিও বাড়তি টাকা পেয়ে সেটা নেতাদের কথা মতো তাদের সঙ্গে ভাগ করে নেন, ফলে পরেও কাজ পেয়েছেন৷ অর্থাত্, আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এ সব দিয়ে সরাসরি টাকা গরিব মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা হলেও, রাজনীতিকরা ঠিক চুরির ছিদ্রপথ বার করে নেবেই৷ তাই গ্রাম-বাংলায়, নির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের বড়ো অংশেরই রাতারাতি অবস্থা ফেরার মধ্যে কোনও রহস্য নেই৷ সবটাই দুর্নীতির গণতন্ত্রীকরণের প্রতিফলন৷
নির্বাচন কমিশনকে কলা দেখিয়ে এখন যে প্রায়ই দলগুলিকে ভোটের সময় লাগামছাড়া অর্থব্যয় করতে দেখা যায়, সেই টাকার উত্স অনেকটাই এ ভাবে গ্রামোন্নয়নের টাকার লুঠ থেকে আসে৷ অবশ্যই বিশেষ করে সেই সুবিধাটুকু পায় ক্ষমতাসীন দল৷ সেই সঙ্গে পঞ্চায়েতের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকলে তা দিয়ে গ্রামের মানুষকেও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়৷ রাজনৈতিক অনুগত্য দেখালে কিছু টাকা পুরস্কার দিয়ে, এবং বশ্যতা স্বীকার করতে না চাইলে বরাদ্দ অর্থ সেই এলাকায় উন্নয়নের কাজে খরচ না করে আটকে রেখে শাস্তি দিয়ে বশ্যতা আদায়ের চেষ্টাও চলে এ ভাবেই৷ সব দিক থেকেই পঞ্চায়েত হল সেই মৃত সঞ্জীবনী, যা কি না রাজনৈতিক দলকে শুধু অক্সিজেনই জোগায় না, তার শরীরে নিয়মিত রক্ত যোগান দিয়ে সচল রাখে৷ এই জন্যেই পঞ্চায়েত দখলের জন্য এত মরিয়া থাকে শাসক দলগুলি৷ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এটা বেশি করে সত্য, কারণ, এখানে পঞ্চায়েত প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক নিয়ে লড়েন৷ অন্য অনেক রাজ্যেই দলহীন পঞ্চায়েত চলে, ফলে দলাদলি করার সুযোগ কম, বরং, কাজ দেখিয়ে ক্ষমতায় থাকার চ্যালেঞ্জ নিতে হয়৷ দুর্ভাগ্যক্রমে, পশ্চিমবঙ্গে তার সুযোগ নেই৷ উল্টে, রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলে পরিবেশ এতটাই বিষিয়ে গিয়েছে, বীরভূম জেলা তৃণমূল নেতা তো প্রকাশ্যেই বলে দেন যে বিরোধী দলের প্রার্থীদের সর্বশক্তি দিয়ে মনোনয়ন জমা দেওয়া আটকাতে হবে৷ এই পরিবেশে যা হওয়ার সেটাই ঘটছে, ভোটের আগে থেকেই পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রক্তপাত শুরু হয়ে গিয়েছে৷
আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রক্তপাত শুরু হয়ে গিয়েছে৷ ইতিমধ্যেই নিহতের তালিকায় বিরোধী সিপিএম-এর একাধিক ব্যক্তি ও শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের একজনের নাম উঠে গিয়েছে৷ আহতদের সংখ্যা তো অগুন্তি৷ প্রতি দিনই নতুন নতুন এলাকা থেকে হিংসার খবর আসছে৷ কোথায় গিয়ে এই রক্তপাত থামবে কে জানে৷ সংবাদপত্রের পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায় এখন শুধু সংঘর্ষ, অভিযোগ- পাল্টা অভিযোগের খবর৷ সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও একটি উপাদান- সন্ত্রাসের আবহ৷ প্রতি দিনে কানে আসছে, শাসক দলের চোখ রাঁঙানির সামনে নতি-স্বীকার করে বিরোধী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন৷ সব মিলিয়ে, অবস্থাটা এমনই দাঁড়িয়েছে যা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো বিজ্ঞাপন নয়৷
কেন এত হিংসা? এত রক্ত কেন? রাজনৈতিক ব্যাখ্যা একটাই, সামনের বছর যেহেতু লোকসভা নির্বাচন, তাই পঞ্চায়েত ভোটকে তার সেমিফাইনাল ধরে নিয়ে সব দলই চাইবে নিজেদের শক্তি ও প্রভাব যতটা সম্ভব বাড়িয়ে নিতে৷ আর যেহেতু, দীর্ঘ দিন ধরেই ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে অপরাধ জগতের একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তাই রাজনৈতিক দলগুলি গণতন্ত্রের স্বার্থ মেনে মানুষের সমর্থন সংগ্রহের জন্য চেষ্টা না করে পেশীশক্তির সাহায্যে সন্ত্রাসের মাধ্যমে তা 'আদায়ের' সহজিয়া পথ অবলম্বন করছে৷ শাসক দলের জন্য কথাটা আরও বেশি করে সত্যি৷
কিন্ত্ত, শুধুই রাজনৈতিক ক্ষমতাটা বিস্তারের জন্যই এত রক্তপাত মনে করলে, সমস্যার সার্বিক চিত্রটা ধরা যাবে না৷ যদি, নিছক রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারই এই হিংসার মূলে থাকত, তা হলে পুরভোট, বিধানসভা ও লোকসভা- সব নির্বাচনের সময়েই হিংসা বাড়ত৷ অন্য ভোটের সময় হিংসা ও রক্তপাত হলেও তা পঞ্চায়েত নির্বাচনের সঙ্গে তুলনীয় নয়৷ তাই, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রেক্ষিতে এই হিংসাকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না৷ এই হিংসার একটা অর্থনৈতিক ভিত্তিও আছে৷
এক কথায় বলতে গেলে, প্রতি বছর গ্রাম-বাংলায় যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে উন্নয়নের জন্য আসছে, তার একটা বড়ো অংশ লুঠ করার অধিকার পেতেই পঞ্চায়েত ভোটের সময় যেনতেনপ্রকারেন ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে রাজনৈতিক দলগুলি৷ পশ্চিমবঙ্গে মোট ৩২০০টি গ্রাম-পঞ্চায়েত আছে, এ ছাড়া রয়েছে ৩২০টি পঞ্চায়েত সমিতি, আর ১৭টি জেলা-পরিষদ৷ প্রতি বছর গ্রাম-পঞ্চায়েতগুলি বছরে গড়ে দুই থেকে পাঁচ কোটি টাকা পেয়ে থাকে৷ এর মধ্যে আবার ১০০০টি এমন গ্রাম-পঞ্চায়েত রয়েছে, যারা কি না বিশ্ব-ব্যাঙ্কের প্রকল্পে আরও অনেক বেশি টাকা পায়৷ এ ছাড়া জেলা-পরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতিগুলিও আলাদা করে কেন্দ্রীয় প্রকল্প রূপায়নের জন্য টাকা পায়৷ যেমন, এন আর ই জি এস বাবদ টাকা গ্রাম-পঞ্চায়েতের হাতে সরাসরি এলেও ইন্দিরা আবাসনের টাকা পঞ্চায়েত সমিতির হাত ঘুরে আসে৷ কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের দেওয়া হিসাব থেকেই দেখা যাচ্ছে, ২০১০-১১ আর্থিক বছরে এন আর ই জি এস খাতে পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল ২৫৬৬ কোটি টাকা, আর শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল ২১১৭ কোটি টাকা৷ ২০১১-১২ আর্থিক বছরে এই খাতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ছিল ৩৭১৩ কোটি টাকা, আর খরচ হয়েছিল ২৫৯৭ কোটি টাকা৷ এ ভাবেই বিপুল পরিমাণ কেন্দ্রীয় অর্থ বরাদ্দ হয় শুধুই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের জন্য৷ এর মধ্যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের বেতন ইত্যাদির খরচ ধরা হয় না৷ আর এই উন্নয়নের টাকার একটা বড়ো অংশই নির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে চোরাপথে রাজনৈতিক দলগুলির নেতা ও কর্মীদের পকেট স্ফীত করে চলেছে৷ বছরের পর বছর ধারাবাহিক ভাবে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন কেন্দ্র প্রকল্পে গ্রাম বাংলায় আসে তার অন্তত ৬০ শতাংশ ঠিক মতো খরচ হলেই বাংলার হাল পাল্টে যেত৷ কিন্ত্ত গ্রাম বাংলার চেহারা যে এত দিনেও পাল্টালো না তার কারণ আর কিছুই না, এই টাকার সিংহ ভাগই চুরি হয়ে যায়৷
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক৷ এ বছর রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তর থেকে খুব ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হয়েছিল যে বীরভূম জেলার হাসান এলাকায় একটি গ্রাম-পঞ্চায়েত ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে (এন আর ই জি এস) ১০০ দিন করে ফেলেছে৷ গোটা রাজ্যে যেখানে গড়ে ৩২ দিনের বেশি কাজ দেওয়া যায়নি, সেখানে হাসান গ্রাম-পঞ্চায়েতের এই সাফল্য যে কিছুটা বিস্ময়ের সৃষ্টি করবে, তা বলাই বাহুল্য৷ তার ক' দিন পরেই জানা গেল, গোটাটাই পুকুর চুরির ব্যাপার৷ যেমন খুশি তালিকা তৈরি করে টাকাটা স্রেফ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে৷ এমন কী মৃত ব্যক্তিদের নাম ওই তালিকায় ঢুকিয়ে ১০০ দিনের কাজের হিসাব দিয়ে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে৷ গ্রাম-পঞ্চায়েতের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা না থাকলে এ রকম পুকুর চুরি কখনওই করা সম্ভব নয়৷ গোটা চুরির ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে হলে সমস্যার আর একটু গভীরে যাওয়া দরকার৷ এন আর ই জি এস প্রকল্পের আওতায় কী কাজ হচ্ছে, তা কখনই সরেজমিনে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা (ফিজিক্যাল অডিট) নেই, শুধুই খরচের হিসাব দেখে টাকা দেওয়া হয়৷ সরকারি পরিভাষায় গ্রাম-পঞ্চায়েতগুলি 'ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট' দিতে পারলেই হল৷ ফলে, ঠিক মতো 'ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট' দিতে পারলে, অর্থাত্ নামের তালিকা, কাজের দিনের সংখ্যা ও প্রাপ্য টাকার হিসেব ঠিক মতো জমা দিতে পারলেই সরকারের কোষাগার থেকে টাকা বেরিয়ে এসে সোজা রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে ঢুকে যাবে৷ ২০১০ সালে ওই বীরভূম জেলার বোলপুর মহকুমার আওতায় ৩১টি গ্রাম-পঞ্চায়েত সেবার গোটা বছরে নাকি এন আর ই জি এস প্রকল্পে ৪০ কোটি টাকা খরচ করেছিল৷ ওই অফিসারটি ৩১টি গ্রাম-পঞ্চায়েতের প্রধানকে চিঠি লিখে তাদের কাজের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে সেই সঙ্গে বললেন, তারা যদি তাদের এন আর ই জি এস কাজের দু' একটা নমুনার ছবি তুলে পাঠান৷ ওই চিঠির পরে তিনি ৬ মাস অপেক্ষা করে আবারও চিঠি দিয়ে সেটা মনে করিয়ে দেন৷ কিন্ত্ত, ৩১টি গ্রাম-পঞ্চায়েতের একটিও ছবি পাঠানো দূরের কথা, চিঠির প্রাপ্তি-স্বীকার পর্যন্ত করেনি৷ কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ পঞ্চায়েত দপ্তরের এক শীর্ষ আমলার কথায়, এন আর ই জি এস-এর টাকায় কাজের যে হিসাব জিপিগুলি দিয়েছিল, তার বেশিটাই জল মেশানো৷ যেহেতু এন আর ই জি এস কাজের অডিট শুধুই ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেটকে ভিত্তি করে হয়, তাই চুরি করার সুযোগ অনেক বেশি৷ রাজনৈতিক নেতারা তারই সুযোগ নেয়৷
কিন্ত্ত, এন আর ই জি এস সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা প্রকৃত গ্রহীতার হাতে যাতে পৌঁছে যায়, সে জন্য প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষেরও জিরো ব্যালেন্স ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা চালু হয়েছে৷ তা ছাড়া আধার কার্ড তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি টাকা দেওয়ার ব্যবস্থাও শুরু হয়েছে৷ উদ্দেশ্য- গ্রামের গরিবদের জন্য পাঠানো টাকা যাতে মাঝপথে দালাল মধ্যসত্ত্বভোগীরা (পঞ্চায়েতের সঙ্গে যুক্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিরা) মেরে না দিতে পারে৷ কিন্ত্ত, তাতেও চুরি কতটা ঠেকানো যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে৷ কারণ, ফিজিক্যাল অডিটের সুযোগ না থাকলেও এন আর ই জি এস কাজ-কর্মের অবস্থা খাতিয়ে দেখার জন্য সোশাল অডিটের সুযোগ তো রয়েছে৷ আর সেই সুবাদেই বেরিয়ে আসছে পুকুর চুরির আর এক গল্প৷ উত্তরবঙ্গের এক জেলায় এমনই এক সোশাল অডিট দেখার অভিজ্ঞতা৷ নিয়ম মাত্র, কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নির্দিষ্ট গ্রাম-পঞ্চায়েতে এক বছরের কাজের সালতামামি করে তার রিপোর্ট তৈরি করে এক সভার আয়োজন করে থাকে৷ ওই সভায় গ্রাম-পঞ্চায়েত প্রধানসহ অন্য পদাধিকারী যেমন হাজির থাকেন, তেমনই গ্রামবাসীরাও থাকেন৷ সেখানে সবার সামনে একটি একটি করে কাজের হিসাব (যেমন, একটা পুকুর কাটা হয়েছে ৭ লাখ টাকা খরচ করে) পেশ করা হয়৷ তা শুনে গ্রামবাসীরা মন্তব্য করবেন৷ পঞ্চায়েতের কর্তারাও তাদের স্বপক্ষে কিছু বলার থাকলে বলবেন৷ এমনই এক সভায় গ্রামের মানুষেরা একের পর এক কাজের হিসাবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসল প্রধানের সামনেই৷ জবাবে প্রধান আমতা আমতা করা ছাড়া আর কিছু করলেন না৷ কিন্ত্ত সব কিছু ছাপিয়ে গেল যখন এন আর ই জি এস কাজের কথা উঠল৷ এক জন বি পি এল তালিকাভুক্ত মানুষ জানালেন যে তিনি গত বছরে মাত্র আট দিনের কাজ পেয়েছিলেন, কিন্ত্ত ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখেন তার চাইতে অনেক বেশি দিনের টাকা জমা পড়েছে৷ বিষয়টি নিয়ে পঞ্চায়েত অফিসে জানালে জবাব মিলল, 'জানি, তুমি ৮ দিনের জায়গায় ১০ দিনের টাকা রেখে বাকি টাকাটা আমলাদের দিয়ে দাও৷ আর যদি তা না কর, তা হলে আর কাজ পাবে না৷' ওই মানুষটি এ কথা জানিয়ে বললেন, তিনি বাড়তি টাকা পঞ্চায়েত নেতাদের দিতে রাজি হননি, ফলে আর এন আর ই জি এস-এর কাজও পাননি৷ আর একজন জানালেন, তিনিও বাড়তি টাকা পেয়ে সেটা নেতাদের কথা মতো তাদের সঙ্গে ভাগ করে নেন, ফলে পরেও কাজ পেয়েছেন৷ অর্থাত্, আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এ সব দিয়ে সরাসরি টাকা গরিব মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা হলেও, রাজনীতিকরা ঠিক চুরির ছিদ্রপথ বার করে নেবেই৷ তাই গ্রাম-বাংলায়, নির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের বড়ো অংশেরই রাতারাতি অবস্থা ফেরার মধ্যে কোনও রহস্য নেই৷ সবটাই দুর্নীতির গণতন্ত্রীকরণের প্রতিফলন৷
নির্বাচন কমিশনকে কলা দেখিয়ে এখন যে প্রায়ই দলগুলিকে ভোটের সময় লাগামছাড়া অর্থব্যয় করতে দেখা যায়, সেই টাকার উত্স অনেকটাই এ ভাবে গ্রামোন্নয়নের টাকার লুঠ থেকে আসে৷ অবশ্যই বিশেষ করে সেই সুবিধাটুকু পায় ক্ষমতাসীন দল৷ সেই সঙ্গে পঞ্চায়েতের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকলে তা দিয়ে গ্রামের মানুষকেও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়৷ রাজনৈতিক অনুগত্য দেখালে কিছু টাকা পুরস্কার দিয়ে, এবং বশ্যতা স্বীকার করতে না চাইলে বরাদ্দ অর্থ সেই এলাকায় উন্নয়নের কাজে খরচ না করে আটকে রেখে শাস্তি দিয়ে বশ্যতা আদায়ের চেষ্টাও চলে এ ভাবেই৷ সব দিক থেকেই পঞ্চায়েত হল সেই মৃত সঞ্জীবনী, যা কি না রাজনৈতিক দলকে শুধু অক্সিজেনই জোগায় না, তার শরীরে নিয়মিত রক্ত যোগান দিয়ে সচল রাখে৷ এই জন্যেই পঞ্চায়েত দখলের জন্য এত মরিয়া থাকে শাসক দলগুলি৷ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এটা বেশি করে সত্য, কারণ, এখানে পঞ্চায়েত প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক নিয়ে লড়েন৷ অন্য অনেক রাজ্যেই দলহীন পঞ্চায়েত চলে, ফলে দলাদলি করার সুযোগ কম, বরং, কাজ দেখিয়ে ক্ষমতায় থাকার চ্যালেঞ্জ নিতে হয়৷ দুর্ভাগ্যক্রমে, পশ্চিমবঙ্গে তার সুযোগ নেই৷ উল্টে, রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলে পরিবেশ এতটাই বিষিয়ে গিয়েছে, বীরভূম জেলা তৃণমূল নেতা তো প্রকাশ্যেই বলে দেন যে বিরোধী দলের প্রার্থীদের সর্বশক্তি দিয়ে মনোনয়ন জমা দেওয়া আটকাতে হবে৷ এই পরিবেশে যা হওয়ার সেটাই ঘটছে, ভোটের আগে থেকেই পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রক্তপাত শুরু হয়ে গিয়েছে৷
No comments:
Post a Comment