সিপাহি বিদ্রোহের শাস্তি, বাংলাদেশে ফাঁসির মুখে ১৫২
বিচারের বাণী
নিভৃতে কাঁদে
মরিচঝাঁপির তদন্ত
শুরু হল না
তিন দশক পরেও
পলাশ বিশ্বাস
রাজনৈতিক সদিচ্ছার
অভাবেই বিচারের বাণী
নিভৃতে কাঁদে
মরিচঝাঁপির তদন্ত
শুরু হল না
তিন দশক পরেও
এপার বাংলার
সামাজিক বৈষম্যের
চালচিত্রে শুধু
একচেটিয়া আধিপাত্যবাদ
দিদিকে একের পর
এক প্রমাণ জুগিয়ে
চলেছি আমরা
দিন প্রতিদিন
তুষার ভট্টাচার্যের
ফিল্ম দেখিয়ে
তফসিলী উদ্বাস্তু
ভোট ব্যান্ক বেদখল
অথচ আজও
বিচারের বাণী
নিভৃতে কাঁদে
বাবরি বিধ্বংসের বিচার
হল না আজও
মানবতার বিরুদ্ধে
যুদ্ধঅপরাধী যারা
সবাই কিন্তু
রাষ্ট্রনেতা তাঁরা
বিচার হয় নি
ভুপাল রসায়নিক
নরমেধ যজ্ঞেরও
বিচার হয়নি
আশি নব্বই দশকজুড়ে
শিখ সংহারেরও
বিচার হয়নি
গুজরাট নরসংহারেরও
তবু আমাদের গর্ব
বিশ্বের সব চেয়ে
বড় গণতলন্ত্র আমরাই
যেখানে ধর্ম কর্মই
রাজনীতি,অন্ধ জাতিসত্তা
ক্ষমতার চাবিকাঠি
অথচ অর্দ্ধেক দেশ জুড়ে
সশস্ত্র সৈন্য বিশেষাধিকার
আইনে সমানে চলছে
রাজকীয় গণসংহার
রাজকীয় গণধর্ষণ
নিঃশব্দ আততায়ীরা
রক্তনদী বইয়ে দিচ্ছে
সারা দেশে
উন্নয়নের নামে
চলছে প্রকৃতি ও
মনুষ্যতার বিরুদ্ধে
অক্লান্ত যুদ্ধ
মস্তান বাহিনীর
দাপাদাপি নির্বাধ
রাজকোষে মাথা
নোয়াতে বাধ্য
কামদুনি সারা দেসে
দুর্নীতিতে দাগী যারা
ক্ষমতায় তাঁরাই
আমাদের জন্য
অবাধ হত্যালীলা
নির্বাধ ধর্ষণ
ইলিশ সহ ভুরিভোজ
লুন্ঠিত রাজকোষ থেকে
ক্ষতিপুরণ
এবং চাকরির আশ্বাসণ
বিদ্রোহী অশান্ত
জনগণকে উন্নয়নের
ললিপপ
উন্নয়নের কলা
দেখিয়ে সংসকারের নামে
জল জমি জঙ্গল
আজীবিকা নাগরিকত্বের
বিরুদ্ধে একচেটিয়া
করপোরেট আগ্রাসন
আমরা সবাই বায়োমেট্রিক
আমরা সবাই ডিজিটাল
আমরা সবাই অন লাইন
তবূ বিচারের বাণী
নিভৃতে কাঁদে
পশ্চিম বঙ্গ ব্যাতীত
অন্য কোনো রাজ্যে
তফসিলী, ওবিসি বা
সংখ্যালঘু মুখ্যমন্ত্রী হয়নি
এমন রাজ্যের নাম
আমি জানিনা
তবু মনে করে উল্লাস
জাত পাঁত নেই
আমাদের সোনার
পশ্টিম বাংলায়
যাবতীয় উল্লাস
শুধু নাগরিক কোলকাতায়
বাকী বাংলা বেনাগরিক
হতচ্ছাড়া যাদের
কোনো সমস্যায় নেই
শুধু ভোট দিতে জানে
তাই তোয়াজ করতেই হয়
মাণিক মারা গেছে বহুদিন
সত্তর দশকে যারা
লিখেছিল বা গেয়েছিল
ভিন্ন সুরে
আজ নাম মুছে গেছে
তাঁদের সবার
ভোজবাজিতে এই বাংলায়
লাল যারা ছিল এতদিন
সবাই এখন সবুজ
সমাজ বাস্তবের
ধার ধারে না কিউই
সিনেমা,সাহিত্য,শিল্প, সঙ্গীত
সাংবাদিকতায় সবাই
এখন নীরার
হাত ছুঁয়ে আছেন
হয়ত এইজন্যই
বাংলাদেশ যা পারে
পারিনা আমরা
হয়ত এইজন্যই
মরিচঝাঁপির
তদন্ত কোনো দিনই
হবে না হবে না
হয়ত এইজন্যই
বিচারের বাণী
নিভৃতে কাঁদে
পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ১৫২ আসামির ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত।
চার বছর আগে নতুন একটি সরকার দায়িত্ব নেয়ার মাত্র এক মাসের মাথায় আধাসামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহের সেই ঘটনা পুরো বিশ্বে আলোড়ন তোলে। এক মামলায় এতো আসামির সর্বোচ্চ সাজার আদেশও নজিরবিহীন।
ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আখতারুজ্জামান মঙ্গলবার বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাসে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, দেশের সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়ে পিলখানায় সেই বিদ্রোহ ঘটানো হয়েছিল।
ন্যায্যমূল্যে পণ্যবিক্রির মতো কাজে বিডিআরকে জড়ানো ঠিক হয়নি বলেও রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন তিনি।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয়া বিডিআরের উপ সহকারী পরিচালক তৌহিদুল আলমসহ (৫৫) বাহিনীর ১৫২ জওয়ান ও নন কমিশন্ড কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয় রায়ে। পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।
এ মামলার সাড়ে আটশ আসামির মধ্যে জীবিত আছেন ৮৪৬ জন। তাদের মধ্যে ১৬১ জনকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড নেতা তোরাব আলীও রয়েছেন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে। তাদের দুজনকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো পাঁচ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন বিচারক।
১৬১ জন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি অস্ত্র লুটের দায়ে আরো ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা জারিমানা,অনাদায়ে আরো দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।তাদের পর্যায়ক্রমে এই সাজা খাটতে হবে।
এছাড়া ২৫৬ আসামিকে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। কারো কারো সাজা হয়েছে একাধিক ধারায়।
অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় রায়ে ২৭৭ জনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন বিচারক।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল সাংবাদিকদের বলেন, এই বিচারে তারা ন্যায়বিচার পেয়েছেন।
অন্যদিকে রায়ে সুবিচার পাননি মন্তব্য করে আপিল করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী শামীম সরদার, এস এম রিফাজ উদ্দিন ও আতাউর রহমান।
বিচারকের আদেশ পাওয়ার পর অদালত কক্ষেই উল্লাস প্রকাশ করেন খালাসপ্রাপ্তরা। অন্যদিকে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়া আসামিদের কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করেন, অনেককে কাঁদতেও দেখা যায়।
পিলখানায় নিহত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার পরিবারের সদস্য , মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহহার আকন্দ এবং বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ রায় জানতে আদালতে এসেছিলেন।
আজিজ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, "দীর্ঘদিন আমরা এই রায়ের জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম। বিজিবিতে যে কলঙ্কতিলক ছিল- আজ এই রায় ঘোষণার মাধ্যমে তা দূর হলো।"
সকাল ১০টায় রায় ঘোষণার কথা থাকলেও বিচারক আদালতে পৌঁছান বেলা ১২টার পর। তবে ১২টা ৩৩ মিনিটে বক্তব্যের শুরুতেই বিলম্বের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।
এর আগে সকালেই এ মামলায় কারাবন্দি ৮১৩ আসামিকে প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে নিয়ে আসা হয়। জামিনে থাকা ১৩ আসামির মধ্যে ১০ জনও আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
হরতালের কারণে নওগাঁর দুই আসামি ও যশোরের এক আসামি আসতে পারেননি বলে তাদের আইনজীবী আদালতকে জানান।
রায় উপলক্ষে সকাল থেকেই অলিয়া মাদ্রাসা মাঠ ও আশেপাশের এলাকায় কড়া নিরাপত্তার ব্যাবস্থা নেওয়া হয়।
'উদ্দেশ্য ছিল সামরিক নিরাপত্তা ধ্বংস'
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির 'অপারেশন ডালভাত' কর্মসূচিতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরকে জড়ানো ঠিক হয়নি। এটা বাহিনীর 'ঐতিহ্য' নষ্ট করেছে।
রায়ে বলা হয়, ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনার পেছনে অর্থনৈতিক 'মোটিভ' ছিল। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক 'মোটিভও' থাকতে পারে।"
এই বিদ্রোহের তথ্য আগে জানতে না পারার ঘটনায় 'গোয়েন্দা দুর্বলতা' ছিল বলেও মনে করেছে আদালত।
বিচারক বলেন, "সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধ্বংস করার মোটিভ নিয়ে এই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। বহির্বিশ্বের কাছে আমাদের দেশকে ছোট করা, বিদেশি বিনিয়োগ না আসার জন্য কলকাঠি নাড়া হয়েছে।"
আদালত মনে করে, দেশের 'অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড' দুর্বল করার জন্য ওই বিদ্রোহ ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। আর সশস্ত্র বাহিনীকে নিরুত্সাহিত করাও এর একটি কারণ হতে পারে।
এই বাহিনীর সদস্যদের আবারো জাতিসংঘ শান্তি মিশনে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া এবং পিলখানার ভেতরে স্কুলে সাধারণ বিডিআর সদস্যদের সন্তানদের ভর্তির ব্যাপারে আরো ছাড় দেয়ার পরামর্শ দেন বিচারক।
"সেনাসদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে বিডিআর সদস্যরা দেশের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত আছেন। এ জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতো ২০ শতাংশ ভাতা তাদের পাওয়া উচিত। তাদের ঝুঁকিভাতা দেয়া যায় কি না, তাও দেখা উচিত।"
সেদিন যা ঘটেছিল
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার পরপরই পিলখানা বিডিআর সদর দপ্তরে গুলির শব্দ পাওয়া যেতে থাকে। বিডিআর সপ্তাহ চলার কারণে প্রথমে অনেকেই ভাবছিলেন, কোনো কর্মসূচি চলছে। কিন্তু কিছু সময় পর জানা যায়- বিদ্রোহ হয়েছে; পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জওয়ানরা।
বিদ্রোহের পর সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এরই মধ্যে পিলখানার চার দিকে সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়।
এদিকে পিলখানার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় বিডিআর দপ্তরে বিদ্রোহের খবর আসতে থাকে।
এক পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে শুরু হয় আলোচনা। স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, হুইপ মীর্জা অাজম ও সাংসদ ফজলে নূর তাপস এ আলোচনার নেতৃত্ব দেন।
বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও বিদ্রোহীদের আলোচনা হয়। পরে পিলখানার প্রধান ফটকের পাশের একটি রেস্তোরাঁয় আলোচনায় অংশ নেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন।
গভীর রাতে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পিলখানায় গেলে বিদ্রোহীরা তার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেরিয়ে আসার সময় বিদ্রোহীদের হাতে জিম্মি কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। তারা মুক্ত হন।
কিন্তু এরপরও পিলখানা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল থেকে পিলখানা শূন্য হয়ে পড়লে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবসান ঘটে প্রায় ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের।
এদিকে বিদ্রোহের প্রথম দিন দুপুরে কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধের কাছে ম্যানহোলের মুখে দুই বিডিআর কর্মকর্তার লাশ পাওয়া গেলে হৈ চৈ পড়ে যায়। বোঝা যায়, ভেতরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
বিদ্রোহ অবসানের পরদিন পিলখানায় পাওয়া যায় একাধিক গণকবর। সেখানে পাওয়া যায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের লাশ।
রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পুনর্গঠন করা হয়। নাম বদলের পর এ বাহিনী এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) হিসেবে পরিচিত।
মামলা বৃত্তান্ত
বিডিআর হত্যাযজ্ঞ ঘটনায় প্রথমে লালবাগ থানায় মামলা হয়। পরে তা স্থানান্তরিত হয় নিউমার্কেট থানায়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে সিআইডি হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেয়ায় আলাদাভাবে দুই অভিযোগের বিচার শুরু হয়।
হত্যার ঘটনায় অভিযোগপত্র দেয়া হয় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়।
এছাড়া বিস্ফোরক আইনে ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয়।
২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি হত্য মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু করেন ঢাকার বিশেষ জজ জহুরুল হক। ওই বছরের ২৪ অগাস্ট এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। পরে এ মামলার দায়ত্ব পান মো. আখতারুজ্জামান।
মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সাবেক ও বর্তমান সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা, পুলিশের সাবেক ও বর্তমান আইজি, বেসামরিক ব্যক্তিসহ মোট ১ হাজার ৩৪৫ জনকে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষী করা হলেও শেষ পর্যন্ত ৬৫৪ জন আদালতে জবানবন্দি দেন।
সাক্ষ্য ও সাফাইসাক্ষ্য শেষে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। পরে নয় কার্যদিবসে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়।
গত ২০ অক্টোবর আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে বিচারক এ মামলার রায়ের জন্য ৩০ অক্টোবর দিন ঠিক করে দেন। পরে তা বদলে ৫ নভেম্বর নতুন দিন রাখা হয়।
মামলার বিচার চলাকালেই ৮৫০ জন আসামির মধ্যে ডিএডি রহিমসহ চার আসামির মৃত্যু হয়। আর ২০ জন আসামি এখনো পলাতক।
জামিনে থাকা ১৩ আসামির মধ্যে দশজনকে ৩বছর করে কারাদণ্ড এবং তিন জনকে বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত।
এছাড়া বিদ্রোহের ঘটনায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিজস্ব আইনে মোট ৫৭টি মামলা হয়। প্রায় তিন বছর সময় নিয়ে ওই বিচার চলে এবং ৫ হাজার ৯২৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দেয়া হয়। বিদ্রোহের মামলায় সর্বোচ্চ সাজা ছিল সাতবছর কারাদণ্ড।
ঢাকা: ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারিতে সেনাবিদ্রোহে ৫৭ জন সামরিক আধিকারিক-সহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে বাংলাদেশের একটি যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত আদালত৷ বিচারে ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২৬২ জনকে তিন থেকে দশ বছরের কারাবাসের সাজা দেওয়া হয়েছে৷ প্রমাণের অভাবে মুক্তি পেয়েছেন ২৭১ জন৷ এই হত্যাকাণ্ডে যুযুধান দুই পক্ষ ছিল বাংলাদেশ সেনা ও বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর)৷ অভিযুক্তদের অধিকাংশই বিডিআর-এর কর্মী ছিলেন৷
মঙ্গলবার পুরোনো ঢাকার বক্সিবাজারের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে অস্থায়ী ভাবে তৈরি আদালতে সেনাবিদ্রোহের চূড়ান্ত রায় পড়ে শোনান প্রধান বিচারপতি মহম্মদ আখতারুজ্জামান৷ সকাল দশটায় আরম্ভ হওয়ার কথা থাকলেও, রায়দান পর্ব শুরু হতে ১২টা বেজে যায়৷
রায়দানকে ঘিরে মানুষের মধ্যে কৌতূহলের অন্ত ছিল না৷ এ দিন সকাল থেকেই অস্থায়ী আদালতের বাইরে বহু মানুষ ভিড় জমান৷ যুদ্ধাপরাধ আদালত চত্বরে নিরাপত্তা ছিল চোখে পড়ার মতো৷ ভিড় বাড়তে শুরু করলে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়৷ অনেকের মতে, ভিড় নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হওয়ার জন্যই রায়দান শুরু হতে দু'ঘণ্টা দেরি হয়ে যায়৷
১২টা নাগাদ আদালতের কাজ শুরু হলে প্রথমেই বিচারপতি আখতারুজ্জামান বলেন, 'আমাকে রায় দিতে হবে৷ আমার বিবেচনায় যা মনে হয়েছে, তা-ই দিয়েছি৷ আসামিরা উচ্চ আদালতে যেতে পারবেন৷' এর পরই তিনি ২০০৯-এর সেনাবিদ্রোহ মামলার রায় ঘোষণা করেন৷
মামলা রুজু হওয়ার সময় অভিযুক্তের মোট সংখ্যা ছিল ৮৫০ জন৷ কিন্ত্ত বিচার চলাকালে চার জনের মৃত্যু হয়৷ বাকি ৮৪৬ জনকেই মঙ্গলবার রায় শোনানো হয়৷ এর মধ্যে ১৫২ জনকে মোট ৭৪ জনকে খুন করার দায়ে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে৷ মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (তত্কালীন বাংলাদেশ রাইফেল বা বিডিআর) তদানীন্তন উপ সহ-অধিকর্তা তউহিদুল আলম আছেন৷
আওয়ামি লিগের তোরাব আলি এবং বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন-সহ ১৬১ জনকে যাবজ্জীবনের সাজা শোনানো হয়েছে৷ একই সঙ্গে অস্ত্রাগারে যথেচ্ছ লুঠপাট চালানোর অপরাধে ওই ১৬১ জনকে দশ বছরের অতিরিক্ত সাজাও দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত বিশেষ আদালত৷
যাবজ্জীবনের রায় শোনানোর সময় এজলাসে হাজির আসামিরা চিত্কার শুরু করে দেন৷ তাঁদের কেউ কেউ বলেন, 'সর্বশক্তিমানের দরবারে বিচার হবে৷' আবার কেউ বলেন, 'এ দেশে কোনও বিচার নেই৷' শেষে তাঁদের সকলকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানান আসামি পক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম৷
যাবজ্জীবনের সাজাপ্রাপ্তদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'আপনারা কেউ কথা বলবেন না৷ আমি আপনাদের হয়ে লড়ছি৷ আপনাদের ওপর আমার অধিকার আছে৷ এর পর আরও আদালত আছে৷ আমরা সেখানে আবেদন জানাব৷'
তিন থেকে দশ বছরের কারাবাসের শাস্তি পেয়েছেন ২৬২ জন৷ এর মধ্যে ২০৭ জনকে দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি পাঁচ হাজার টাকা (বাংলাদেশি টাকা) জরিমানা ধার্য করেছে আদালত৷ একই সঙ্গে তাঁদের আরও একটি গুরুতর অভিযোগে অতিরিক্ত তিন বছরের জেলের সাজা শোনানো হয়েছে৷ অর্থাত্ ওই ২০৭ জনকে একটানা ১৩ বছর গরাদের পিছনে কাটাতে হবে৷ বাকি ৫৫ জনকে অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী ন্যূনতম তিন বছর থেকে বিভিন্ন মেয়াদের হাজতবাসের শাস্তি দেওয়া হয়েছে৷
রায় সম্পূর্ণ হওয়ার পর বিচারপতি আখতারুজ্জামান সকলের উদ্দেশে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, '২০০৯-এর সেনাবিদ্রোহ আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে৷ এমন ঘটনা যাতে আবার না হয়, তার জন্য সেনাবাহিনী, আধা-সামরিক বাহিনী সকলকেই সজাগ থাকতে হবে৷'
এই প্রসঙ্গে ২০০৯-এর সেনাবিদ্রোহের বেশ কিছু সম্ভাব্য কারণের দিকে প্রধান বিচারপতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন৷ তিনি বলেন, '২০০৯-এর ফেব্রুয়ারিতে যে বিদ্রোহ সংগঠিত হয়, তা বাহিনীর সদস্যদের দীর্ঘ বঞ্চনার ফলে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ৷ কাজেই শুধু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নয়, সীমান্ত সুরক্ষার সঙ্গে যুক্ত আধা-সামরিক বাহিনীর অধিকার রক্ষার দায়িত্বও সরকারকেই নিতে হবে৷'
দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী নাগরিকদের ভরপেট খাবার ও মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে ২০০৯ সালে 'অপারেশন ডাল-ভাত' কর্মসূচি গ্রহণ করে বাংলাদেশ৷ বিডিআর-এর নেতৃত্বেই চলতে থাকে কাজ৷ অভিযোগ, এই খাতে বরাদ্দ টাকার একটা বড় অংশ আত্মসাত্ করেন সেনাবাহিনীর একাংশ৷ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি৷
রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনার প্রবেশাধিকার থাকলেও, বিডিআর জওয়ানদের ক্ষেত্রে তা ছিল না৷ নিরাপত্তার কাজে যুক্ত থাকার সুবাদে বাংলাদেশ সেনাকর্মীদের জন্য ২০ শতাংশ ভাতার ব্যবস্থা করেছিল বাংলাদেশ সরকার৷ কিন্ত্ত সীমান্তের নিরাপত্তায় মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও বিডিআর এই সুবিধা থেকে ছিল বঞ্চিত৷ বারংবার অভিযোগ করা হলেও, প্রশাসনের তরফে কোনও পদক্ষেপই করা হয়নি৷
এরই মধ্যে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সেনা জওয়ানদের হাতে বন্দি হন বিডিআর-এর তত্কালীন সেক্রেটারি জেনারেল শাকিল আহমেদ৷ ঘটনাস্থল ঢাকার পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরের দরবার হল৷ শাকিল আহমেদের বক্তৃতা চলাকালে আচমকাই সেখানে এসে উপস্থিত হন বাংলাদেশ সেনার দুই জওয়ান৷ জওয়ানদের গুলির উত্তরে গুলি চালায় বিডিআর-ও৷ দু'দিনের নারকীয়া হত্যালীলায় ৫৭ জন সেনা ও ১০ জন বিডিআর জওয়ান-সহ মোট ৭৪ জনের মৃত্যু হয়৷
বিডিআর জওয়ানদের অত্যাচারের বদলা নিতে তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানদের ওপর আক্রমণ চালায় বাংলাদেশ সেনা৷ ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ শুরুর কিছুক্ষণ পর জনাকয়েক বিক্ষুব্ধ সেনা শাকিল আহমেদের বাড়িতে ঢুকে তাঁর স্ত্রী নাজনিনকে যৌন হেনস্থা করে খুন করেন৷ বাড়ির পরিচারিকাকেও নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়৷ বাদ পড়েননি অতিথি হয়ে আসা শাকিলের এক বন্ধু ও তাঁর স্ত্রীও৷ ব্যাপক লুঠপাটও চালানো হয়৷ শাকিল ছাড়াও বিডিআর-এর আরও কয়েক জন পদস্থ আধিকারিকের পরিবারের উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়৷
নিহতদের দেহ লোপাটেরও চেষ্টা করা হয়৷ পরে তদন্ত শুরু হলে হাসপাতালের লাশকাটা ঘর থেকে ন'টি, গণকবর থেকে ৪৮টি, ডিজি বাংলো থেকে দু'টি ও অন্য জায়গা থেকে ১৫টি দেহ উদ্ধার করা হয়৷ - প্রথম আলো
মা ন ব তা বি রো ধী অ প রা ধে র বি চা রএকাত্তরে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের যে বর্বরভাবে হত্যা করা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোনো সাজা ওই বর্বরতার বিচারে অক্ষম। একমাত্র ও একমাত্র সর্বোচ্চ শাস্তিই গোটা জাতি এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে পারে।
একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের আগমুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অন্যতম দুই হোতা, গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণাকালে এ কথা বলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। একাত্তরের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে তাঁদের দুজনকেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তাঁদের বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ। গতকাল রোববার এ রায় ঘোষণা করা হয়।
স্বাধীনতার চার দশক পর প্রথমবারের মতো বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার হলেও রায় ঘোষণার সময় এজলাসে আসামির কাঠগড়া ছিল শূন্য। কারণ, স্বাধীনতার পরপরই মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান বিদেশে পালিয়ে যান। এ জন্য পলাতক ঘোষণা করে তাঁদের অনুপস্থিতিতেই বিচার হয়েছে। বর্তমানে মুঈনুদ্দীন থাকেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে, আশরাফুজ্জামান থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেন। এ সময় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের কয়েকজন সদস্য ও এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কয়েকজন সাক্ষী এজলাসে উপস্থিত ছিলেন।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, 'আমরা বিশ্বাস করি, জামায়াতে ইসলামীর মস্তিষ্কপ্রসূত ঘাতক বাহিনী আলবদর একাত্তরে বুদ্ধিজীবী নিধনের যে নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে, তা গোটা জাতির বুকে ক্ষত হয়ে আজও রক্ত ঝরাচ্ছে। আমরা আরও বিশ্বাস করি, গত চার দশকে মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যাকারীদের বিচার করতে না পারায় জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত; এ লজ্জা আমাদের ক্ষতকে দিন দিন বাড়িয়ে তুলেছে। বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ বাঙালি জাতিকে চিরদিন নিদারুণ যন্ত্রণাই দিয়ে যাবে।'
বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে রায়ে বলা হয়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের হিংস্রতা মৌলিক মানবতাবোধের জন্য হুমকি। ইতিহাস বলে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে নানা ধরনের নৃশংস আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি, যেখানে জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্য করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞ শুধু অপরাধীর অপরাধের মাত্রাই বাড়ায়নি, গোটা জাতির জন্য যন্ত্রণার ছাপ এঁকে দিয়েছে। দশকের পর দশক ধরে জাতি ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যরা সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকে চেপে আছেন, আইনের অক্ষর এখানে নির্বিকারভাবে বসে থাকতে পারে না। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে অপরাধের গভীরতার বিচারে একমাত্র মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে ন্যায়বিচার করা হবে।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও দালিলিক তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন আলবদর বাহিনীর একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন। আশরাফুজ্জামান ছিলেন বুদ্ধিজীবী নিধন পরিকল্পনার 'চিফ এক্সিকিউটর', মুঈনুদ্দীন ছিলেন 'অপারেশন ইনচার্জ'। তাঁদের অংশগ্রহণে যেমন বন্দুকের নলের মুখে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে হত্যা করা হয়েছে, তেমনি পুরো হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিষয়ে তাঁরা সবকিছু জানতেন। এ জন্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য তাঁদের ব্যক্তিগত অংশগ্রহণের দায় ও ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ নিয়ে নয়টি মামলার রায় দিলেন। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-২ দিয়েছেন ছয়টি রায়, ট্রাইব্যুনাল-১ দিয়েছেন তিনটির রায়। এ নিয়ে দ্বিতীয় কোনো মামলায় আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার করা হলো। মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলার রায় হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে। তিনিও পালিয়ে যাওয়ায় তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচার হয়েছিল।
মুঈনুদ্দীন-আশরাফের হত্যাযজ্ঞের শিকার ১৮ বুদ্ধিজীবী: মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলায় একাত্তরে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল ১১টি অভিযোগে, যার সব কটি প্রমাণিত হয়েছে। যে বুদ্ধিজীবীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তাঁরা হলেন: দৈনিক ইত্তেফাক-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, পিপিআইয়ের (পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল) প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশ-এর প্রধান প্রতিবেদক এ এন এম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ, শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীন, দৈনিক সংবাদ-এর যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, ড. মো. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজির অধ্যাপক ফজলে রাব্বী ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরী। একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাত থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বুদ্ধিজীবীদের অপহরণের পর হত্যা করা হয়। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের মরদেহ পরে রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া গেছে, কয়েকজনের মরদেহের খোঁজ মেলেনি।
রায়ে বুদ্ধিজীবী নিধনের বিবরণ: ১৫৪ পৃষ্ঠায় ৪৫৩ অনুচ্ছেদে বিস্তৃত পূর্ণাঙ্গ রায়ে একাত্তরে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের প্রামাণ্য বিবরণ উঠে এসেছে। সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও দালিলিক তথ্যপ্রমাণ মূল্যায়ন করে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, চূড়ান্ত বিজয়ের আগমুহূর্তে সুপরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার বুদ্ধিজীবীদের তাঁদের বাসা থেকে অপহরণ করে জামায়াতের সশস্ত্র শাখা গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবী নিধনের নেতৃত্ব দেওয়া মুঈনুদ্দীন একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এ জন্যই অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে অপহরণের সময় তিনি মুঈনুদ্দীনকে চিনতে পেরেছিলেন। সাক্ষ্যপ্রমাণে উঠে এসেছে, বুদ্ধিজীবী নিধনের 'অপারেশন ইনচার্জ' হিসেবে মুঈনুদ্দীন শুধু নিধনে নেতৃত্বই দেননি, নিজেও অংশ নিয়েছেন। বন্দুকের নলের মুখে বাসা থেকে অপহরণ করে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে যাওয়া হতো মোহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা কলেজে স্থাপিত আলবদরের সদর দপ্তরে, সেখানে তাঁদের চরম নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো রায়েরবাজার বা মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে।
রায়ে বলা হয়, বিজয়ের পর আশরাফুজ্জামানের একটি ডায়েরি পাওয়া যায়, যা তাঁদের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অন্যতম প্রমাণ। ডায়েরিটিতে ১৯ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল। পাকিস্তানি গবেষক সেলিম মনসুর খালিদের লেখা আলবদর গ্রন্থ অনুসারে, ওই বইয়ের লেখকের কাছে আশরাফুজ্জামান ডায়েরি লেখার বিষয়টি স্বীকারও করেছেন।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রত্যেক বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ ও হত্যার সঙ্গে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও দালিলিক নথির ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ডা. আলীম চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আলীম চৌধুরীকে অপহরণের সঙ্গে মাওলানা আবদুল মান্নান জড়িত ছিলেন। একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর মান্নানকে রমনা থানায় সোপর্দ করা হলেও পরে অজ্ঞাত কারণে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। জাতির জন্য লজ্জা, মাওলানা মান্নান পরে স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হন!
রায়ে বলা হয়, কেন বিজয়ের অব্যবহিত পরে মুঈনুদ্দীন পালিয়ে গেলেন এবং আজও বিদেশে রয়েছেন? সম্প্রতি আল-জাজিরা টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুঈনুদ্দীন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ ও অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। একজন অপরাধী সাধারণত তাঁর অপরাধ স্বীকার করেন না। স্বাধীনতার পরপরই তাঁর পালিয়ে যাওয়া অপরাধী মানসিকতার স্পষ্ট উদাহরণ। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মুসলিম এইডের সাবেক ট্রাস্টি মুঈনুদ্দীন বর্তমানে লন্ডনের টটেনহামে থাকেন। তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের মুসলিম স্পিরিচুয়াল কেয়ার প্রভিশনের পরিচালক। আশরাফুজ্জামান থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জ্যামাইকায়। তিনি সেখানে ইসলামিক সার্কেল অব নর্থ আমেরিকার (আইসিএনএ) শুরা সদস্য এবং স্থানীয় মসজিদের ইমাম।
প্রতিক্রিয়া: রায়ের পর আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে যান। তাঁরা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তাঁদের বিদেশ থেকে আইনসংগতভাবে ফিরিয়ে আনতে সরকার চেষ্টা করবে। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় তাঁদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হবে।
রায়ের পর ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের সমন্বয়ক এম কে রহমান বলেন, 'আমরা রায়ে সন্তুষ্ট। এই দুই আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হবে।'
মামলার দুই তদন্ত কর্মকর্তা শাহজাহান কবীর ও আতাউর রহমান রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, 'আমাদের তদন্ত বৃথা যায়নি।'
আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবদুস শুকুর খান ও সালমা হাই বলেন, 'আমরা আসামিদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাইনি। তার পরও নিজেরাই বেশ কয়েকটি নথি জোগাড় করে তাঁদের নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করেছি। আসামিরা আত্মসমর্পণ করে আপিল করলে সাজা থেকে খালাস পেতে পারেন।'
তিন দিনের ধর্মঘটের প্রথম দিনেই বাংলাদেশে হত দুই
ঢাকা: একেই বলে শাঁখের করাতের মতো অবস্থা৷ একদিকে ভোটের আগে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে বিরোধীদের ডাকা তিন দিনের লাগাতার বন্ধ, আবার অন্য দিকে বস্ত্র শিল্পে সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরির বিরোধিতায় পোশাক মালিকদের পথে নামার হুমকি- দ্বিমুখী চাপে নাজেহাল দশা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ প্রশাসনের৷
সোমবার থেকে বাংলাদেশে টানা ৬০ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বিরোধী সংগঠন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) এবং তার প্রধান সহযোগী জামাত-ই-ইসলামি-সহ ১৮ দলের শরিক জোট৷ তিন দিনব্যাপী এমন ধর্মঘট এ নিয়ে গত দশ দিনে দ্বিতীয় বার ডাকা হল৷
বন্ধের প্রথম দিনেই রণক্ষেত্র হয়ে উঠল রাজধানী ঢাকা-সহ বাংলাদেশ৷ গাড়িতে ভাঙচুর, আগুন ধরিয়ে দেওয়া, পেট্রল বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগ এসেছে নাটোর, রাজশাহি, কুমিল্লা এবং বগুড়া থেকেও৷ বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে দু'জনের মৃত্যু হয়েছে৷ আহত বহু৷
লালমনিরহাটের পাটগ্রামে বিএনপি-র ছাত্র সংগঠনের প্রচার সম্পাদক নাসিরউদ্দিন (২২) গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন৷ প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, পাটগ্রামের সোহাগপুর এলাকায় সকাল ন'টা নাগাদ বিএনপি ও আওয়ামি লিগ সমর্থকরা মুখোমুখি হন৷ বাদানুবাদের পর তাঁরা যখন মারমুখী হয়ে ওঠেন তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলি চালায়৷ সেই সময় একটি বুলেট এসে লাগে নাসিরউদ্দিনের গায়ে৷ ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয় বলে জানা গিয়েছে৷
বিরোধী সংগঠনের পক্ষ থেকে নাসিরউদ্দিনের মৃত্যুর জন্য পুলিশকে কঠগড়ায় দাঁড় করানো হলেও, পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক তা পুরোপুরি অস্বীকার করে বলেছেন, 'শুধু পুলিশ নয়, পাল্টা গুলি চালিয়েছে বিরোধীরাও৷ কাজেই কার গুলিতে নাসিরউদ্দিনের মৃত্যু হয়েছে, এই মুহূর্তে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না৷'
কুমিল্লায় ছুরিকাহত আওয়ামি লিগের এক যুবনেতা৷ সূত্রের খবর, বন্ধের বিরোধিতা করার সময় হঠাত্ই আওয়ামি লিগের ওই ছাত্রনেতাকে একদল দুষ্কৃতী আক্রমণ করে৷ তাদের আক্রমণেই ছুরিকাহত হন ওই নেতা৷ গুরুতর জখম অবস্থায় তাঁকে কুমিল্লা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তাঁর অবস্থা এখনও স্থিতিশীল নয় বলেই হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে৷ আওয়ামি লিগের কুমিল্লা সংগঠনের অভিযোগ, দুষ্কৃতীরা বিএনপি-র মদতপুষ্ট৷
শুধু রাজনৈতিক কর্মীই নয়, হিংসার রাজনীতির শিকার নিরপরাধ গরিব শ্রমিকরাও৷ নাটোরে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার পথে বিএনপি সমর্থকদের বিরোধিতার মুখে পড়ে শ্রমিক-বোঝাই একটি ট্রাক৷ কোনও কথা ছাড়াই ওই ট্রাককে লক্ষ করে বিরোধীরা ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে বলে অভিযোগ৷ ইটের আঘাতে আহত হন এক শ্রমিক৷ কিন্ত্ত বন্ধ সমর্থকরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেও বাধা দেয়৷ অভিযোগ, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে রাস্তায় পড়ে থেকেই বেঘোরে প্রাণ হারান তিনি৷
ধর্মঘটে দেশীয় অর্থনীতিতে মারণ প্রভাব পড়ে, এই যুক্তিতে বিরোধী দলকে বন্ধের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেওয়ার অনেক অনুরোধ করেছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামি লিগ৷ কিন্ত্ত বিএনপি বাংলাদেশ সরকারের সেই আবেদনে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি৷
সোমবার এক বিবৃতিতে বিএনপি-র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগির বলেন, 'আলোচনায় বসতে রাজি আমরাও৷ কিন্ত্ত আগে সরকার পক্ষকে কথা দিতে হবে, নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা সরে দাঁড়াবেন৷ দায়িত্ব নেবে অরাজনৈতিক ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার৷ সেই সরকারের তদারকিতেই ভোটের আয়োজন হবে৷ এই প্রতিশ্রুতি না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ তুলে নেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই৷'
এ দিকে, বাংলাদেশের পোশাক সংগঠনও ন্যূনতম মজুরি নিয়ে সরকারের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় পথে নামার হুমকি দিয়েছে৷ সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি রফা করার চেষ্টা করছে হাসিনা প্রশাসন৷ - সংবাদসংস্থা
বাংলাদেশ অশান্ত, ঘোজাডাঙায় বন্ধ বাণিজ্য
অতনু দাস
বসিরহাট: বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ঘোজাডাঙা সীমান্তে বাণিজ্যিক লেনদেন বন্ধ হতে বসেছে৷ বাংলাদেশে ১৪টি বিরোধী দলের জোট ৭২ ঘণ্টা ধর্মঘটের ডাক দেওয়ায় ঘোজাডাঙা সীমান্তে বাণিজ্যে অচল অবস্থা তৈরি হয়েছে৷ রবিবার রাত থেকে ওই সীমান্তে দাঁড়িয়ে পড়েছে সারি সারি পণ্য বোঝাই ট্রাক৷ গত ২৭ অক্টোবর থেকে ৬০ ঘণ্টার টানা ধর্মঘটের ফলে এপার-ওপারে কোনও গাড়ি চলাচল করেনি৷ এই কারণে এপারে প্রায় ১ হাজার ট্রাক আটকে পড়েছিল৷ জরুরি ভিত্তিতে কিছু ট্রাক পেট্রাপোল দিয়ে পাঠানো গেলেও অধিকাংশের সেই সুযোগ ছিল না আইনি কারণেই৷ হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান, হরিয়ানা মহারাষ্ট্র বা পঞ্জাবের মতো বিভিন্ন রাজ্য থেকে এই সীমান্ত দিয়ে পণ্য যাতায়াত করে বাংলাদেশে৷ মূলত ফল-সব্জি ইত্যাদি পণ্য দিনের পর দিন আটকে পড়লে সেগুলি পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে৷ তার জন্য ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় রপ্তানিকারী সংস্থাগুলিকে৷ এ ছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে প্রচুর মাছও রপ্তানি হয় ঘোজাডাঙা সীমান্ত দিয়ে৷ প্রায় তিন দিন আটকে থাকার পর ধর্মঘট উঠে গেলেও ওই সব ট্রাক বাংলাদেশে ঢুকতে পেরেছিল৷ তার জের কাটতে না-কাটতেই আবার বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলি তিনদিনের ধর্মঘট ডেকে বসেছে৷ এতেও বিপুল ক্ষতির আশঙ্কা করছে বিভিন্ন সংস্থা৷
বসিরহাট সীমান্তের ক্লিয়ারিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ভোলা ঘোষ মঙ্গলবার জানান, ওপার বাংলার ধর্মঘটের জেরে এ দেশের ব্যবসায়ীদেরও আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে৷ এই সমস্যা মেটাতে না-পারলে ভিনরাজ্যের ব্যবসায়ীরা এই বাণিজ্যিক পথটি ব্যবহার বন্ধ করে দিতে পারেন৷ সে ক্ষেত্রে এখানকার শ্রমিকদের রুটিরুজির সমস্যা হবে৷ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেবু চৌধুরী জানান, একদিকে যেমন ওই সব পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনই গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলে শ্রমিকদের অতিরিক্ত পয়সা দিতে হয়৷ তাঁর মতে, বন্ধের দিনগুলোয় পেট্রাপোল এই রপ্তানির দায়িত্ব নিতে পারে৷ তবে, বনগাঁ ক্লিয়ারিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী জানান, লেটার অফ ক্রেডিটে যদি বনগাঁ সীমান্তে বেনাপোল বা পেট্রাপোলের নাম না-থাকে, তা হলে ট্রাক এই পথ দিয়ে ঢোকানো সম্ভব নয়৷ বসিরহাটের মহকুমা শাসক শেখর সেন জানান, বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কারণে ঘটছে৷ তাই এ ব্যাপারে তাঁর কিছু বলার নেই৷
এ দিকে এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যেই আজ, বুধবার পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে ভারত ও বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে যৌথ কুচকাওয়াজ হবে৷ তার প্রস্ত্ততি শুরু হয়েছে দিন কয়েক আগে থেকেই৷
http://eisamay.indiatimes.com/state/business-closed-in-ghojdanga/articleshow/25304871.cms
পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ১৫২ জনের ফাঁসি
আহমেদ আল আমীন
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ ও নৃশংসতম বিডিআর বিদ্রোহের সময় সেনাকর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ১৫২ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। একই সঙ্গে ১৬১ জনকে যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দেওয়া হয়েছে আরও ২৬২ জনকে। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পেয়েছেন ২৭১ জন। বিচার কার্যক্রম শেষ হওয়ার ২০তম দিনে, অধিকাংশ আসামির উপস্থিতিতে, জনাকীর্ণ বিচারকক্ষে, গতকাল এ মামলার রায় ঘোষণা করেন রাজধানীর বকশীবাজারের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান। রায়ে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয়েছে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীও। আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করতে পারবে ব্যক্তি বা সংক্ষুব্ধ পক্ষ। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিপুলসংখ্যক মৃত্যুদণ্ডসহ একসঙ্গে এত আসামির শাস্তির ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে এটাই প্রথম। আর এ কারণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও দৃষ্টি ছিল এই বিচারের দিকে। রায় ঘোষণা উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় আদালতপাড়ায়। সকাল ১০টায় কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও আদালত বসেন বেলা ১২টা ৩৪ মিনিটে। এ সময় এজলাসে আসন গ্রহণ করেন বিচারক মো. আখতারুজ্জামান। বিচার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার জন্য প্রথমে মামলাসংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান আদালত। পরে দেওয়া হয় আদালতের বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ। এতে উঠে আসে বিডিআর বিদ্রোহের কারণ ও অপারেশন ডাল-ভাত কর্মসূচি সম্পর্কে আদালতের মূল্যায়ন। উঠে আসে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বিডিআরের গৌরবোজ্জ্বল এবং ত্যাগী ভূমিকার কথাও। বাংলায় লিখিত রায়ে একে একে দণ্ড ঘোষণা করেন আদালত। মাঝখানে আদালত একবার বিরতিতে যান বেলা আড়াইটার দিকে। পরে দণ্ড ঘোষণা করে বিকাল সোয়া ৪টার দিকে এজলাস ত্যাগ করেন আদালত।
বিচারকক্ষ : এজলাসকে সামনে রেখে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বসেন বাঁ পাশে। আর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সামনে ও ডানে বসেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। বিচারকক্ষের পেছনে গ্রিলের তৈরি একাধিক ছোট কক্ষে অবস্থান করেন ডাণ্ডা বেড়ি পরা অভিযুক্তরা। নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনরাও উপস্থিত ছিলেন বিচারকক্ষে। এদের মধ্যে কর্নেল মুজিব, কর্নেল আনিস, কর্নেল শামসুল আরেফিন, কর্নেল কাজী এমদাদুল হক, লে. কর্নেল ইমসাদ ইবনে আমিন, লে. কর্নেল শামসুল আজম, লে. কর্নেল আবু মুসা মো. আইয়ূব কায়সার, মেজর মোসাদ্দেক এবং মেজর সালেহর পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন আদালতে। এ ছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের ছিল উপচেপড়া ভিড়। তবে আসামির স্বজনদের দেখা যায়নি আদালত চত্বরে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ : রায় ঘোষণার আগে ঘটনার ব্যাপারে কিছু পর্যবেক্ষণ দেন আদালত। এ সময় আদালত বলেন, 'অপারেশন ডাল-ভাত' কর্মসূচি এ ঘটনার একটি বড় কারণ। কোনো শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী- যেমন, সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী বা সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে যুক্ত রাখা উচিত নয় অপারেশন ডাল-ভাতের মতো কর্মসূচিতে। পিলখানার ভেতরের স্কুলগুলোতে বিডিআর জওয়ানদের সন্তানদের ভর্তির ব্যাপারে আরও ছাড় দেওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আরও স্কুল তৈরি করা যায় কি না, তা কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা উচিত।' আদালত বলেন, 'সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মতো বিডিআর সদস্যদেরও শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠানো যায় কি না, জাতিসংঘের সঙ্গে সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে দেখতে পারেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সেনাসদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে দেশের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন বিডিআর সদস্যরা। এ জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতো ২০ শতাংশ ভাতা বিডিআর সদস্যদেরও পাওয়া উচিত। বিডিআর সদস্যদের ঝুঁকি ভাতা দেওয়া যায় কি না, তা ভেবে দেখা উচিত।' পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেন, 'বিডিআর বিদ্রোহের কারণ হিসেবে সামরিক নিরাপত্তা-সম্পর্কিত কারণও থাকতে পারে; যাতে নষ্ট করা যায় আমাদের সেনাবাহিনীর মনোবল। বহির্বিশ্বে আমাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীকে 'উচ্ছৃঙ্খল' দেখানো, যাতে ক্ষুণ্ন হয় দেশের ভাবমর্যাদা। দেশে গণ্ডগোল থাকলে উচ্ছৃঙ্খলতা থাকবে বাহিনীর মধ্যে। এতে হবে না বিনিয়োগ। অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড দুর্বল করার জন্যও হতে পারে এমন কাজ। এ ছাড়া সশস্ত্র বাহিনীকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করাও হতে পারে এ ঘটনার একটি কারণ।' আদালত উল্লেখ করেন, 'সুরতহাল প্রতিবেদন পড়ে শিউরে উঠেছে আমারও গা। নূ্যনতম সম্মানটুকুও প্রদর্শন করা হয়নি লাশের প্রতি। যা তার পাওয়ার কথা ছিল।' আদালত পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, 'আমাকে রায় দিতে হবে। আমার বিবেচনায় যা মনে হয়েছে তা-ই দিয়েছি। আসামিরা উচ্চ আদালতে যেতে পারবেন। এটাই সর্বশেষ বিচার নয়।'
দণ্ডিত ৫৭৫ : হত্যা মামলায় বিচার অনুষ্ঠিত হয় ৮৫০ জনের বিরুদ্ধে। বিচারে দণ্ডিত হয়েছেন সর্বমোট ৫৭৫ জন। এর মধ্যে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্য করার নির্দেশ দেওয়া হয় ১৫২ জনকে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন- বিডিআরের তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদুল ইসলাম, নাসির উদ্দিন খান, মেজর গোফরান, সাজ্জাদ হোসেন, শাহ আলম, সেলিম রেজা, মিজানুর রহমান প্রমুখ। ৩০২ ধারায় ১৬১ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন দণ্ড। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপি নেতা পিন্টু এবং আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীও। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তদের এই দণ্ডের পাশাপাশি পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেন; অনাদায়ে আরও পাঁচ বছরের কারাদণ্ডেরও আদেশ দেন আদালত। এই ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন দণ্ডের পাশাপাশি আবার এদের প্রত্যেককে অবৈধভাবে অস্ত্র লুণ্ঠনের দায়ে আরও ১০ বছরের কারাদণ্ডও দেন আদালত। একই সঙ্গে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দেওয়া হয় আরও ২৬২ জনকে। এ ছাড়া চারজনের মৃত্যু হয়েছে বিচার চলাকালে।
২৭১ জনকে অব্যাহতি : এ ছাড়া প্রমাণিত না হওয়ায় ২৭১ জনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন আদালত। আদালতের রায়ে জানানো হয়, এসব অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
আপিল প্রসঙ্গ : এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা পক্ষ। আপিল করতে হবে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে। এরপর আবেদন করা যাবে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগেও। তবে আপিল করতে পারবেন না পলাতক আসামিরা। আপিল করতে হলে তাদের গ্রেফতার বা আত্দসমর্পণ করতে হবে।
নিরাপত্তাচাদর : রায় ঘোষণা উপলক্ষে গত সোমবার মধ্যরাত থেকে নিরাপত্তাচাদরে জড়ানো হয় আদালত ও এর আশপাশের এলাকা। পুলিশ, র্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের একাধিক ইউনিট মোতায়েন করা হয় ওই এলাকায়। পুলিশের ঊধর্্বতন কর্মকর্তারা জানান, ওই এলাকায় দায়িত্ব পালন করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় সাত হাজার সদস্য। রাস্তার প্রতিটি গলির মুখে বড় বড় ভবনের ছাদেও দায়িত্ব পালন করেন র্যাব ও পুলিশের সদস্যরা। বিপুল সংখ্যক পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারিও ছিল চোখে পড়ার মতো। পরিচয় নিশ্চিত করে সংশ্লিষ্টদের কড়া নিরাপত্তায় প্রবেশ করানো হয় আদালতে।
আপিল করবে আসামিপক্ষ : দেড়শর বেশি আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণার পর আপিল করার কথা জানিয়েছেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। তারা বলেছেন, 'ন্যায়বিচার হয়নি এই রায়ে।' রায়ের পর আসামি পক্ষের আইনজীবী শামীম সরদার বলেন, 'আমরা মনে করি, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব।' আসামি পক্ষের আরেক আইনজীবী এস এম রিফাজ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, 'ন্যায় বিচার পাইনি। আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে প্রমাণ করতে পারেনি একটি অভিযোগও। তবু মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাকে। আপিলে যাব এর বিরুদ্ধে।'
ন্যায় বিচার বলছে রাষ্ট্রপক্ষ : পিলখানা হত্যা মামলায় ১৫২ আসামির ফাঁসির রায়ে ন্যায়বিচার হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'ঘটনার ওই দিন সেনা কর্মকর্তাদের খুন করা হয়েছে, লুটপাট করা হয়েছে, সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে করা হয়েছে নিষ্ঠুর আচরণ। অসম্মান করা হয়েছে তাদের মৃতদেহকেও। এখন যে বিচার পেয়েছি, তাতে মনে হচ্ছে ন্যায়বিচারই পেয়েছি আমরা।'
মামলার ইতিবৃত্ত : পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় মামলা হয় মোট তিনটি। বিদ্রোহের মামলার আসামি ছয় হাজার ৪৬ জন। হত্যা মামলার আসামি ৮৫০ জন। আর বিস্ফোরক দ্রব্য মামলার আসামি ৭৮৭ জন। বিদ্রোহের ঘটনায় ঢাকার লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নবজ্যোতি খিসা প্রথমে লালবাগ পরে নিউমার্কেট থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা করেন দুটি। এই দুই মামলায় আসামি ছিলেন দুই হাজার ৩২৮ জন। এদের মধ্যে গ্রেফতার করা হয় দুই হাজার ৫৫৯ জনকে। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ৫৫৯ জন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এক হাজার ৪৭৪ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয় প্রাথমিক তদন্তে। মামলার তদন্তের সময় মারা যান সাতজন আসামি। ২০১০ সালের ১২ জুলাই হত্যা মামলা এবং ২৭ জুলাই বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ। বিডিআর বিদ্রোহ হত্যা মামলায় অভিযোগপত্রের আসামিদের মধ্যে পোশাকধারী বিডিআর সদস্য ৮২৭ জন। আর বেসামরিক লোক ২৩ জন। ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয় মামলা। এই মামলায় নথির সংখ্যা ৮৭ হাজার পৃষ্ঠা। ২০১১ সালের ১০ আগস্ট অভিযোগ গঠন করা হয় ৮৫০ আসামির বিরুদ্ধে। আসামিদের মধ্যে পলাতক ২০ জন।
ফিরে দেখা সেই ট্র্যাজেডি : ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের সময় ঢাকার পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরে ঘটে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ প্রাণ হারান ৭৪ জন। বিচারের মুখোমুখি করা হয় ৮৫০ বিডিআর জওয়ানকে। আসামির সংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হত্যা মামলা। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের সূচনা হয় সুসজ্জিত দরবার হল থেকে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক শাকিল আহমেদের বক্তব্যের সময় অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন দুই সিপাহি। এরপর জওয়ানেরা দুই দিন ধরে বিডিআর মহাপরিচালকসহ হত্যা করেন ৭৪ জনকে। লুটপাট ও ভাঙচুর চালান কর্মকর্তাদের বাড়িঘরে। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় সরকারি নথিপত্রেও। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান ঘটে বিদ্রোহ শুরুর ৩৩ ঘণ্টা পরে। বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পুনর্গঠন করা হয় রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে। নাম বদলের পর এ বাহিনী এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) হিসেবে পরিচিত।
বিশ্ব মিডিয়ায় বিডিআর বিদ্রোহের রায় : বিডিআর বিদ্রোহের ঐতিহাসিক রায় গতকাল বাংলাদেশের মতো বিদেশি মিডিয়াতেও আলোড়ন তোলে। রায় ঘোষণার পরপরই তা গুরুত্ব সহকারে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রচার করা হয়। তাৎক্ষণিক ব্রেকিং নিউজ হিসেবে প্রচার করে বিবিসি, আল-জাজিরা ও ডন। গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে এএফপি, এপি, নিউইয়র্ক টাইমস, ইয়াহু নিউজ, হাফিংটন পোস্ট, ভয়েস অব আমেরিকা, গার্ডিয়ান, রয়টার্স, এনডিটিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য হিন্দু, ইন্ডিয়ান এঙ্প্রেস, পিটিআই, এবিসি নিউজসহ বিশ্বের প্রখ্যাত সংবাদমাধ্যমগুলো।
'বাংলাদেশে বিদ্রোহীদের মৃত্যুদণ্ড' শিরোনামে প্রতিবেদনে বিবিসি জানায়, ২০০৯ ?সালে রক্তাক্ত বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে অন্তত ১৫০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অন্য দোষীদের কারাদণ্ড ও নির্দোষদের খালাস দেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়। আল-জাজিরার খবরে শিরোনাম করা হয় 'বাংলাদেশে বিদ্রোহের ঘটনায় কয়েকশ জনের দণ্ড'। এতে বলা হয়, ২০০৯ সালে বিদ্রোহের মাধ্যমে কয়েক ডজন সেনা কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় কয়েকশ জওয়ানকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন আদালত। এ মামলায় ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ১৫৭ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন বিশেষ আদালতের বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামান। '২০০৯ সালে বিদ্রোহের ঘটনায় বাংলাদেশের আদালতে ১৫২ জওয়ানের মৃত্যুদণ্ড' শিরোনামে প্রতিবেদন করে এএফপি। বলা হয়, এ বিদ্রোহ ঘটিয়ে বেশ কিছু সেনা কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে ১৫২ জওয়ানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন বাংলাদেশের বিশেষ ?আদালত। ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার ঘটনায় তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এএফপির বরাতে খবর প্রচার করে টাইমস অব ইন্ডিয়া। আর এপির বরাত দিয়ে সংবাদটি প্রকাশ করে এনডিটিভি অনলাইন। 'বাংলাদেশে ২০০৯ সালে বিদ্রোহের ঘটনায় ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড' শিরোনামে ডন অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিডিআরের সাবেক উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদুল ইসলামসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা তোরাব আলীসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
- See more at: http://www.bd-pratidin.com/2013/11/06/25340#sthash.75VPcPc2.dpuf
No comments:
Post a Comment