সাহিত্য অকাদেমি পাচ্ছেন সাঁওতালি শিশুসাহিত্যিক
অরূপকুমার পাল
ঝাড়গ্রাম: 'খোকার মনের ঠিক মাঝখান ঘেঁষে, যে পথ গিয়েছে সৃষ্টিশেষে..' সে পথের সন্ধান মিলে গিয়েছিল আচমকাই৷ 'সকল উদ্দেশ হারা, সকল ভূগোল-ছাড়া..' সে রাস্তা আর ছাড়েননি ঝাড়গ্রামের সারিধরম হাঁসদা৷ সে পথে তাঁর অক্লান্ত চলা এই ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত৷ জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রামে বসে সাঁওতালি ভাষায় রচনা করে গিয়েছেন একের পর শিশু সাহিত্য৷ ছোট্ট মনের কল্পনা, চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্খার কথা ফুটিয়ে তুলেছেন কাগজ-কলমে৷ শুধু গল্প উপন্যাস নয়, নাটক, যাত্রাপালা, প্রবন্ধও লিখেছেন শিশুদের সমস্যা সংক্রান্ত নানা বিষয়ে৷ তবে কবি হিসেবেই তাঁর খ্যাতি৷ সত্তরের দশক থেকে আজ পর্যন্ত লেখনী থামেনি একবারও৷ তারই স্বীকৃতি এসেছে এত দিনে৷ তাঁর 'ডোঁবে বাহা' (বাংলা অর্থ - ফুলের কুঁড়ি) কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য অকাদেমি তাঁকে ভূষিত করছে ২০১৩ সালের শিশু সাহিত্য পুরস্কারে৷ গত ২৩ অগস্ট দিল্লির অকাদেমি কার্যালয় থেকে ফোনে তাঁকে এ খবর জানানো হয়৷ ২৮ অগস্ট ডাকে চিঠি পান৷ পুরস্কার নিতে নভেম্বর মাসে গোয়া যাবেন সারিধরম৷ ঝাড়গ্রাম মহকুমার তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিক কুশল চক্রবর্তী বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন সারিধরমবাবু৷ ওঁকে সহকর্মী হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত৷'
সারিধরম নামটি অবশ্য তাঁর পিতৃদত্ত নয়৷ ১৯৫৫ সালে জন্মের সময় বাপ-মা নাম রেখেছিলেন বাসুদেব৷ বাড়ি ছিল বিনপুরের শিলদায়৷ ষাটের দশকে কলেজে পড়ার সময় থেকেই লেখালিখির শুরু বাসুদেবের৷ তবে তা ছাপা হয়নি কোথাও৷ গ্রামের মাস্টারমশাই লালচাঁদ মুর্মুকে লেখাটেখা পড়াতেন৷ তিনিই 'সারিধরম' ছদ্মনাম দেন বাসুদেবকে৷ সেই থেকে এ নাম তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী৷ প্রেরণা বললে অবশ্য দু'জনের নাম করেন সারিধরম- সাধু রামচাঁদ মুর্মুসত্তরের দশকের শেষ দিকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে কাজ নেন বেলপাহাড়ি বিডিও অফিসে৷ কিন্ত্ত সে কাজ ভালো লাগত না৷ মন পড়ে থাকত খাতাকলমের জগতে৷ লেখালিখি চলত, কিন্ত্ত পেশার তাগিদে সময় মিলত কম৷ তাই ১৯৮৪ সালে ঝাড়গ্রামের আদিবাসী লোকরঞ্জন শাখায় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে যোগ দেন৷ গানের একটা চর্চা ছিলই পরিবারে৷ বাবা পদান হাঁসদা দিনমজুরি করেও গান গাইতেন৷ সারিধরম নিজে গান লেখেনও৷ সেই সূত্রেই সরকারি চাকরি৷ '৮৭-তে বিয়ে করেন ভাগাবাঁধ প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা কাজলকে৷ জীবনভর স্বামীর কাজে যোগ্য সহধর্মিণীর মতো সঙ্গত করে গিয়েছেন তিনি৷ ২০০৩ সালে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ঝাড়গ্রাম শহরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের নুননুনগেড়িয়ায় বাড়ি করেন সারিধরম৷ যদিও শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে মন টেঁকেনা তাঁর৷ বার বার বলেন, 'শহুরে মানুষ আধুনিকতার দৌলতে টিভি-রেডিও-কম্পিউটারে অনেক কিছু দেখে, সে কথা ঠিক৷ কিন্ত্ত সোঁদা মাটির গন্ধ তো পায় না! কলম ধরলেই সেই রূপ-রস-গন্ধ আমার কাছে জলীয় বাষ্পের মতো ভেসে ভেসে আসে৷ সুবিধের জন্য গ্রাম ছেড়েছি৷ কিন্ত্ত শিকড় আমার ওখানেই৷
ইতিমধ্যেই সাতটি কবিতার বই ৩৫টি গল্পের সংকলন এবং পাঁচটি যাত্রার বই প্রকাশিত হয়েছে৷ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লেখা তাঁর নাটক 'ডাইনি' আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত হয়েছিল সেই সত্তরের দশকে৷ আগে লিখতেন বাংলা ও দেবনাগরি লিপিতে সাঁওতালি ভাষায়৷ নব্বইয়ের দশক থেকে অলচিকি লিপির প্রচলন শুরু হওয়ায় সেটাই ব্যবহার করেন৷ ১৯৮৬-তে 'সারজম মহল' নামে পত্রিকা প্রকাশ৷ ২০০৯-এ 'অল ইন্ডিয়া সাঁওতাল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন'-এর পুরস্কার, ২০১২-তে মার্শাল গাঁওতার 'সাম্মানিক পদক' দিয়ে যে বৃত্তের সূচনা হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ হল সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে এসে৷ উচ্ছ্বসিত হতে পারেন না সারিধরম৷ ২০১২-তে স্ত্রীবিয়োগ অনেকটাই শূন্য করে দিয়েছে তাঁকে৷ তবু কলম সঙ্গ ছাড়েনি৷ পুরস্কারের খবর শুনে বললেন, 'কাজলের অভাব পূরণ হওয়ার নয়৷ ছাত্রজীবন থেকে আজও লেখনী নিয়ে যে সংগ্রাম করছি, তাতে ও থিল আমার সঙ্গী৷ ওর অনুপস্থিতিতে এই পুরস্কার শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষদের উত্সর্গ করলাম৷'
ঝাড়গ্রাম: 'খোকার মনের ঠিক মাঝখান ঘেঁষে, যে পথ গিয়েছে সৃষ্টিশেষে..' সে পথের সন্ধান মিলে গিয়েছিল আচমকাই৷ 'সকল উদ্দেশ হারা, সকল ভূগোল-ছাড়া..' সে রাস্তা আর ছাড়েননি ঝাড়গ্রামের সারিধরম হাঁসদা৷ সে পথে তাঁর অক্লান্ত চলা এই ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত৷ জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রামে বসে সাঁওতালি ভাষায় রচনা করে গিয়েছেন একের পর শিশু সাহিত্য৷ ছোট্ট মনের কল্পনা, চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্খার কথা ফুটিয়ে তুলেছেন কাগজ-কলমে৷ শুধু গল্প উপন্যাস নয়, নাটক, যাত্রাপালা, প্রবন্ধও লিখেছেন শিশুদের সমস্যা সংক্রান্ত নানা বিষয়ে৷ তবে কবি হিসেবেই তাঁর খ্যাতি৷ সত্তরের দশক থেকে আজ পর্যন্ত লেখনী থামেনি একবারও৷ তারই স্বীকৃতি এসেছে এত দিনে৷ তাঁর 'ডোঁবে বাহা' (বাংলা অর্থ - ফুলের কুঁড়ি) কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য অকাদেমি তাঁকে ভূষিত করছে ২০১৩ সালের শিশু সাহিত্য পুরস্কারে৷ গত ২৩ অগস্ট দিল্লির অকাদেমি কার্যালয় থেকে ফোনে তাঁকে এ খবর জানানো হয়৷ ২৮ অগস্ট ডাকে চিঠি পান৷ পুরস্কার নিতে নভেম্বর মাসে গোয়া যাবেন সারিধরম৷ ঝাড়গ্রাম মহকুমার তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিক কুশল চক্রবর্তী বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন সারিধরমবাবু৷ ওঁকে সহকর্মী হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত৷'
সারিধরম নামটি অবশ্য তাঁর পিতৃদত্ত নয়৷ ১৯৫৫ সালে জন্মের সময় বাপ-মা নাম রেখেছিলেন বাসুদেব৷ বাড়ি ছিল বিনপুরের শিলদায়৷ ষাটের দশকে কলেজে পড়ার সময় থেকেই লেখালিখির শুরু বাসুদেবের৷ তবে তা ছাপা হয়নি কোথাও৷ গ্রামের মাস্টারমশাই লালচাঁদ মুর্মুকে লেখাটেখা পড়াতেন৷ তিনিই 'সারিধরম' ছদ্মনাম দেন বাসুদেবকে৷ সেই থেকে এ নাম তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী৷ প্রেরণা বললে অবশ্য দু'জনের নাম করেন সারিধরম- সাধু রামচাঁদ মুর্মুসত্তরের দশকের শেষ দিকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে কাজ নেন বেলপাহাড়ি বিডিও অফিসে৷ কিন্ত্ত সে কাজ ভালো লাগত না৷ মন পড়ে থাকত খাতাকলমের জগতে৷ লেখালিখি চলত, কিন্ত্ত পেশার তাগিদে সময় মিলত কম৷ তাই ১৯৮৪ সালে ঝাড়গ্রামের আদিবাসী লোকরঞ্জন শাখায় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে যোগ দেন৷ গানের একটা চর্চা ছিলই পরিবারে৷ বাবা পদান হাঁসদা দিনমজুরি করেও গান গাইতেন৷ সারিধরম নিজে গান লেখেনও৷ সেই সূত্রেই সরকারি চাকরি৷ '৮৭-তে বিয়ে করেন ভাগাবাঁধ প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা কাজলকে৷ জীবনভর স্বামীর কাজে যোগ্য সহধর্মিণীর মতো সঙ্গত করে গিয়েছেন তিনি৷ ২০০৩ সালে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ঝাড়গ্রাম শহরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের নুননুনগেড়িয়ায় বাড়ি করেন সারিধরম৷ যদিও শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে মন টেঁকেনা তাঁর৷ বার বার বলেন, 'শহুরে মানুষ আধুনিকতার দৌলতে টিভি-রেডিও-কম্পিউটারে অনেক কিছু দেখে, সে কথা ঠিক৷ কিন্ত্ত সোঁদা মাটির গন্ধ তো পায় না! কলম ধরলেই সেই রূপ-রস-গন্ধ আমার কাছে জলীয় বাষ্পের মতো ভেসে ভেসে আসে৷ সুবিধের জন্য গ্রাম ছেড়েছি৷ কিন্ত্ত শিকড় আমার ওখানেই৷
ইতিমধ্যেই সাতটি কবিতার বই ৩৫টি গল্পের সংকলন এবং পাঁচটি যাত্রার বই প্রকাশিত হয়েছে৷ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লেখা তাঁর নাটক 'ডাইনি' আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত হয়েছিল সেই সত্তরের দশকে৷ আগে লিখতেন বাংলা ও দেবনাগরি লিপিতে সাঁওতালি ভাষায়৷ নব্বইয়ের দশক থেকে অলচিকি লিপির প্রচলন শুরু হওয়ায় সেটাই ব্যবহার করেন৷ ১৯৮৬-তে 'সারজম মহল' নামে পত্রিকা প্রকাশ৷ ২০০৯-এ 'অল ইন্ডিয়া সাঁওতাল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন'-এর পুরস্কার, ২০১২-তে মার্শাল গাঁওতার 'সাম্মানিক পদক' দিয়ে যে বৃত্তের সূচনা হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ হল সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে এসে৷ উচ্ছ্বসিত হতে পারেন না সারিধরম৷ ২০১২-তে স্ত্রীবিয়োগ অনেকটাই শূন্য করে দিয়েছে তাঁকে৷ তবু কলম সঙ্গ ছাড়েনি৷ পুরস্কারের খবর শুনে বললেন, 'কাজলের অভাব পূরণ হওয়ার নয়৷ ছাত্রজীবন থেকে আজও লেখনী নিয়ে যে সংগ্রাম করছি, তাতে ও থিল আমার সঙ্গী৷ ওর অনুপস্থিতিতে এই পুরস্কার শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষদের উত্সর্গ করলাম৷'
No comments:
Post a Comment