রবীন্দ্র-প্রযোজনার বিবর্তনের ইতিবৃত্ত
আবারভিন্নপাঠেশান্তিদেবঘোষেরএইসাক্ষাত্কারশান্তিনিকেতনেরচরিত্রবদলেরকারণকেওপরোক্ষভাবেসূচিতকরে৷লিখছেনবৈজয়ন্তচক্রবর্তী
শান্তিদেব ঘোষের জন্ম হয়েছিল ১৯১০ সালে৷ অর্থাত্, হিসেবমতো রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষ ও দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মশতবর্ষের ঠিক এক বছর আগে তাঁর জন্মের শতবর্ষ৷ প্রায় নীরবেই চলে গিয়েছে সেই ক্ষণটি৷ ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনও উদ্যাপন হয়েছে কিনা জানা নেই, কিন্ত্ত জনপরিসরে শান্তিদেবকে স্মরণ করার ছিটেফোঁটা উদ্যোগও চোখে পড়েনি৷ অথচ রবীন্দ্রনাথের শেষ ও মধ্যজীবনের সঙ্গীত, নাট্য ও নৃত্যভাবনার অপরিহার্য রূপকার হিসেবে শান্তিদেব ঘোষ রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে অনিবার্য৷ মনে হয় মুশকিল বেধেছে দু'টি জায়গায়৷ প্রথমত, শান্তিদেব ঘোষ দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র বা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ঐশ্বরিক 'পারফর্মার' ছিলেন না৷ তিনি মূলত শিক্ষক ও চিন্তক৷ নেপথ্যের মানুষদের স্মরণ করতে জনগণমন চিরকালই অনুত্সুক৷ কিছুটা প্রক্ষিপ্ত হলেও একটি কথা বলা দরকার৷ রবীন্দ্রনাথের গানের একটি বিশেষ 'পেলব' ভঙ্গি থেকে বলিষ্ঠতায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য গণনাট্য সঙ্ঘে দেবব্রত বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রদের ছকভাঙা ভাবনার কথা সুপরিজ্ঞাত৷ কিন্ত্ত শান্তিদেব ঘোষ খাস শান্তিনিকেতনেই গায়নরীতিতে যে দার্ঢ্য নিয়ে এসেছিলেন, তা কিছুটা অনালোচিতই থেকে যায়৷ দ্বিতীয়ত, ইদানীং 'রবীন্দ্রপূজা' নিয়ে ছদ্ম-র্যাডিকাল বাঙালি খড়গহস্ত হয়ে উঠেছে৷ কাজেই যিনি বা যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে 'জীবনের ধ্রুবতারা' বলে ঘোষণা করতে দ্বিধাবোধ করেননি, এবং যাঁদের ললাটে বিতর্কের তকমা জোটেনি, তাঁদের নিয়ে হয়তো সংস্কৃতিবান বাঙালি একটু দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন৷ ড্রেসিং টেবিলের তলার খাপের শর্টকাট ঠাকুরঘরে ফুলবেলপাতা চড়ানোটা যেমন পূজা, বহু দুর্গম পথ অতিক্রম করে উত্তুঙ্গ হিমালয়ের প্রথম দর্শনে অস্তিত্বের-মূল-নাড়িয়ে-দেওয়া বিস্ময়ে প্রণিপাত হওয়াটাও পূজা- এই দুইয়ের তফাত্ আদতে আইকনপ্রিয় বাঙালি কতটা মনে রেখেছে বলা কঠিন৷ এই স্বেচ্ছা-বিস্মৃতির প্রেক্ষিতে 'স্মৃতি ও সঞ্চয়' একটি তাত্পর্যপূর্ণ ব্যতিক্রম৷ বইটি মূলত শান্তিদেব ঘোষের একটি দীর্ঘ সাক্ষাত্কার৷ সাক্ষাত্কার নিয়েছেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শমীক ঘোষ এবং তাঁর স্ত্রী অনুত্তমা৷ সংযোজন হিসেবে আছে শান্তিদেবকৃত রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি, কিছু আলোকচিত্র, পাণ্ডুলিপি ও চিঠিপত্র৷ বইটি সম্পাদনা করেছেন শান্তিদেব ঘোষের ছাত্রী আলপনা রায়৷ সাক্ষাত্কারটির প্রাথমিক তাত্পর্য রবীন্দ্রনাথের নাট্যপ্রযোজনা ও অনুষ্ঠান পরিকল্পনার বিবর্তনের প্রেক্ষিতে৷ বিশেষত এই কারণে যে, রবীন্দ্রকৃতির উপস্থাপনা নিয়ে আলোচনায় অনেক সময়ই উহ্য থেকে যায় তাঁর সহযোগীদের ভূমিকার কথা৷ শান্তিদেব খুব স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন যে নন্দলাল বসুর মতো যোগ্য দোহার না পেলে পরবর্তীকালে সদর্থে 'রাবীন্দ্রিক' বলে যা কিছু সূচিত হয়েছে, তার অনেকটাই অধরা থেকে যেত৷ পশ্চিমি ধাঁচের বাস্তবানুগ মঞ্চসজ্জার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ খুব স্পষ্ট ভাবে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন৷ যেমন, তাঁর 'রঙ্গমঞ্চ' প্রবন্ধে: 'বিলাতের নকলে আমরা যে থিয়েটার করিয়াছি তাহা ভারাক্রান্ত একটা স্ফীত পদার্থ৷... তাহাতে কবি ও গুণীর প্রতিভার চেয়ে ধনীর মূলধন ঢের বেশি থাকা চাই৷ বাগানকে যে অবিকল বাগান আঁকিয়াই খাড়া করিতে হইবে এবং স্ত্রীচরিত্র অকৃত্রিম স্ত্রীলোককে দিয়াই অভিনয় করাইতে হইবে, এইরূপ অত্যন্ত স্থূল বিলাতি বর্বরতা পরিহার করিবার সময় আসিয়াছে৷' কিন্ত্ত এই ভাবনা কাগজে-কলমেই আটকা থেকে যেত যদি না রবীন্দ্রনাথ পেতেন নন্দলালকে৷ শান্তিদেব এই সাক্ষাত্কারে বলছেন: 'গুরুদেব যে রিয়ালিস্টিক স্টেজ পছন্দ করেন না, সে রকম উল্লেখ ওঁর শান্তিনিকেতনের প্রথমদিকের প্রবন্ধে কিছু পাওয়া যায়, কিন্ত্ত জোড়াসাঁকোতে বা শান্তিনিকেতনে নিজে কিছু ক'রে উঠতে পারেননি৷ নন্দবাবু যে পরিবর্তন আনলেন সেটাই শান্তিনিকেতনে পরবর্তী যুগে থেকে গেল'৷
শুধু নাটক বা নৃত্যনাট্য প্রযোজনার ক্ষেত্রেই নয়, আশ্রমিক জীবনচর্যার প্রাত্যহিকতাতেও নন্দলাল এক ধরনের সৌন্দর্যবোধ নিয়ে আসেন৷ শান্তিদেব সখেদে বলেন যে নন্দলালের ছাত্ররা অনেকেই পরবর্তী সময়ে বরেণ্য শিল্পী হয়েছেন, কিন্ত্ত কেউই নিজস্ব গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে সর্বকর্মে ব্যাপ্ত হতে চাননি৷ শান্তিনিকেতন নামক প্রতিষ্ঠানটির আরও চারটি কেজো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো হয়ে ওঠার অন্যতম সূত্রটি স্পষ্ট ভাবে বলা না হলেও তার প্রচ্ছন্ন আকারটি এই সাক্ষাত্কারের মধ্যে দিয়ে পাঠকের কাছে ধরা দেয়৷ বোঝা যায় নন্দলালের উত্তরসূরীরা অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় একটা সেট প্যাটার্ন অনুসরণ করে চলেন মাত্র৷ কাজেই সমসাময়িকতাকে উপেক্ষা করে একটা সময়ে শান্তিনিকেতনী প্রযোজনা হয়ে দাঁড়ায় এক ধরনের আনুষ্ঠানিকতা, যার পালেপার্বনে পর্যটক-মূল্য থাকলেও, সমসময়ের শিল্পজগতের দোলাচলের সম্পূর্ণ বাইরে থাকা এক ধরনের আর্কাইভ মেটিরিয়াল৷ আর এই সেট প্যাটার্ন মেনে চলা এক ধরনের পান-থেকে-চুন-খসলেই-সব-গেল মনোভাবের জন্ম দেয়, যা নন্দলালের উদারপন্থী ভাবধারার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে৷ যে উদারপন্থী ভাবধারা রামকিঙ্করের মতো অফঁ তেরিব্ল্-কে, তাঁর নতুন কিছু করার প্রবল ইচ্ছাকে সযত্নে লালন করে৷ প্রায় একই রকম অচলায়তনিক মনোবৃত্তি কি রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য প্রযোজনাকেও পরে গ্রাস করে না, যে প্রযোজনার প্রাথমিক রূপকার ছিলেন শান্তিদেব স্বয়ং?
এই সাক্ষাত্কার থেকেই জানতে পারি, সাম্প্রতিক সময়ের 'ফিউশন' নামক বালখিল্য হুজুগের বহু আগে শান্তিদেব কী ভাবে ভারত, এমন কী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নৃত্যশৈলীকে রবীন্দ্র-প্রযোজনায় অঙ্গীভূত করতে চাইছেন৷ যার মধ্যে ব্যালে থেকে কত্থক, জারিনাচ থেকে কথাকলি- সব ধারা মিশে যাচ্ছে৷ তৈরি হচ্ছে এক 'একলেক্টিক্' নৃত্যভাবনা৷ কিন্ত্ত তার বিরুদ্ধে শান্তিনিকেতনের মধ্য থেকেই বাধা ও আপত্তি উঠে আসছে৷ রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের গানের কাণ্ডারী স্বয়ং শান্তিদেবের বিরুদ্ধে শান্তিনিকেতনে ঘোঁট' পাকানো হচ্ছে, আগে-যে-রকম-হত-সে-রকম-হচ্ছে-না-কেন বলে প্রতিমা দেবী মারফত্ অনুযোগ করা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের কাছে৷ তখন রবীন্দ্রনাথই প্রতিমা দেবীকে বোঝাচ্ছেন, 'দ্যাখো বৌমা, যখন এ-নাচ প্রথম হয়েছিল, তারপরে এত বছর কেটে গেছে৷ এখন কলকাতার লোকদেরও নাচের দৃষ্টি অনেক বদলে গেছে, ওরা অনেক দেখছে, লিখছে, নাচছে- ওরা অনেকখানি এগিয়ে গেছে'৷ অর্থাত্, রবীন্দ্রনাথের জীবত্কালেই অচলায়তনের দুরারোগ্য ভাইরাসটি আশ্রমদেহে অনুপ্রবিষ্ট৷ রবীন্দ্রনাথ নামক বনস্পতি বিভিন্ন টানাপোড়েন, আপস-সমঝোতার মধ্য দিয়ে তাঁর প্রার্থিত চলিষ্ণুতাকে বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন৷ কাজেই বাহ্যত না হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে সাক্ষাত্কারটি 'মা কী ছিলেন, কী হইলেন এবং কেন হইলেন'-এর এক অন্তঃসলিলা ইতিবৃত্ত৷ অন্তত সাক্ষাত্কারটির একটি পাঠ এই রকমও হতে পারে৷
তবে বইটি আরও সুখপাঠ্য হত যদি মুদ্রণের ক্ষেত্রে আরও একটু যত্নের পরিচয় পাওয়া যেত৷ সম্পাদক 'উল্লেখ পরিচয়' অংশে যে ভাবে সংক্ষিপ্ত টীকা সংযোজন করেছেন, তা প্রশংসনীয়৷ কিন্ত্ত কিছু মুদ্রণ প্রমাদ বড়োই দৃষ্টিকটু৷ যেমন আলোকচিত্রের পরিচয় জানাতে গিয়ে 'পাণ্ডুলিপি' হয়েছে 'পীন্ডুলিপি', 'অভিনীত' হয়েছে 'সভিনীত' আর 'ইন্দ্র' হয়েছে 'ইন্দ'৷ আলোকচিত্রের সঙ্গে চিত্রগ্রাহকের নাম উল্লেখ না করার বদভ্যাসটি বর্জন করলেই বোধ হয় ভালো হত| রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির অংশ মুদ্রিত করা হয়েছে, কিন্ত্ত সাক্ষাত্কারের প্রেক্ষিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে কিছু লেখা থাকলে সংযোজিত অংশগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ হত৷
শান্তিদেব ঘোষের জন্ম হয়েছিল ১৯১০ সালে৷ অর্থাত্, হিসেবমতো রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষ ও দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মশতবর্ষের ঠিক এক বছর আগে তাঁর জন্মের শতবর্ষ৷ প্রায় নীরবেই চলে গিয়েছে সেই ক্ষণটি৷ ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনও উদ্যাপন হয়েছে কিনা জানা নেই, কিন্ত্ত জনপরিসরে শান্তিদেবকে স্মরণ করার ছিটেফোঁটা উদ্যোগও চোখে পড়েনি৷ অথচ রবীন্দ্রনাথের শেষ ও মধ্যজীবনের সঙ্গীত, নাট্য ও নৃত্যভাবনার অপরিহার্য রূপকার হিসেবে শান্তিদেব ঘোষ রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে অনিবার্য৷ মনে হয় মুশকিল বেধেছে দু'টি জায়গায়৷ প্রথমত, শান্তিদেব ঘোষ দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র বা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ঐশ্বরিক 'পারফর্মার' ছিলেন না৷ তিনি মূলত শিক্ষক ও চিন্তক৷ নেপথ্যের মানুষদের স্মরণ করতে জনগণমন চিরকালই অনুত্সুক৷ কিছুটা প্রক্ষিপ্ত হলেও একটি কথা বলা দরকার৷ রবীন্দ্রনাথের গানের একটি বিশেষ 'পেলব' ভঙ্গি থেকে বলিষ্ঠতায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য গণনাট্য সঙ্ঘে দেবব্রত বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রদের ছকভাঙা ভাবনার কথা সুপরিজ্ঞাত৷ কিন্ত্ত শান্তিদেব ঘোষ খাস শান্তিনিকেতনেই গায়নরীতিতে যে দার্ঢ্য নিয়ে এসেছিলেন, তা কিছুটা অনালোচিতই থেকে যায়৷ দ্বিতীয়ত, ইদানীং 'রবীন্দ্রপূজা' নিয়ে ছদ্ম-র্যাডিকাল বাঙালি খড়গহস্ত হয়ে উঠেছে৷ কাজেই যিনি বা যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে 'জীবনের ধ্রুবতারা' বলে ঘোষণা করতে দ্বিধাবোধ করেননি, এবং যাঁদের ললাটে বিতর্কের তকমা জোটেনি, তাঁদের নিয়ে হয়তো সংস্কৃতিবান বাঙালি একটু দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন৷ ড্রেসিং টেবিলের তলার খাপের শর্টকাট ঠাকুরঘরে ফুলবেলপাতা চড়ানোটা যেমন পূজা, বহু দুর্গম পথ অতিক্রম করে উত্তুঙ্গ হিমালয়ের প্রথম দর্শনে অস্তিত্বের-মূল-নাড়িয়ে-দেওয়া বিস্ময়ে প্রণিপাত হওয়াটাও পূজা- এই দুইয়ের তফাত্ আদতে আইকনপ্রিয় বাঙালি কতটা মনে রেখেছে বলা কঠিন৷ এই স্বেচ্ছা-বিস্মৃতির প্রেক্ষিতে 'স্মৃতি ও সঞ্চয়' একটি তাত্পর্যপূর্ণ ব্যতিক্রম৷ বইটি মূলত শান্তিদেব ঘোষের একটি দীর্ঘ সাক্ষাত্কার৷ সাক্ষাত্কার নিয়েছেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শমীক ঘোষ এবং তাঁর স্ত্রী অনুত্তমা৷ সংযোজন হিসেবে আছে শান্তিদেবকৃত রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি, কিছু আলোকচিত্র, পাণ্ডুলিপি ও চিঠিপত্র৷ বইটি সম্পাদনা করেছেন শান্তিদেব ঘোষের ছাত্রী আলপনা রায়৷ সাক্ষাত্কারটির প্রাথমিক তাত্পর্য রবীন্দ্রনাথের নাট্যপ্রযোজনা ও অনুষ্ঠান পরিকল্পনার বিবর্তনের প্রেক্ষিতে৷ বিশেষত এই কারণে যে, রবীন্দ্রকৃতির উপস্থাপনা নিয়ে আলোচনায় অনেক সময়ই উহ্য থেকে যায় তাঁর সহযোগীদের ভূমিকার কথা৷ শান্তিদেব খুব স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন যে নন্দলাল বসুর মতো যোগ্য দোহার না পেলে পরবর্তীকালে সদর্থে 'রাবীন্দ্রিক' বলে যা কিছু সূচিত হয়েছে, তার অনেকটাই অধরা থেকে যেত৷ পশ্চিমি ধাঁচের বাস্তবানুগ মঞ্চসজ্জার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ খুব স্পষ্ট ভাবে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন৷ যেমন, তাঁর 'রঙ্গমঞ্চ' প্রবন্ধে: 'বিলাতের নকলে আমরা যে থিয়েটার করিয়াছি তাহা ভারাক্রান্ত একটা স্ফীত পদার্থ৷... তাহাতে কবি ও গুণীর প্রতিভার চেয়ে ধনীর মূলধন ঢের বেশি থাকা চাই৷ বাগানকে যে অবিকল বাগান আঁকিয়াই খাড়া করিতে হইবে এবং স্ত্রীচরিত্র অকৃত্রিম স্ত্রীলোককে দিয়াই অভিনয় করাইতে হইবে, এইরূপ অত্যন্ত স্থূল বিলাতি বর্বরতা পরিহার করিবার সময় আসিয়াছে৷' কিন্ত্ত এই ভাবনা কাগজে-কলমেই আটকা থেকে যেত যদি না রবীন্দ্রনাথ পেতেন নন্দলালকে৷ শান্তিদেব এই সাক্ষাত্কারে বলছেন: 'গুরুদেব যে রিয়ালিস্টিক স্টেজ পছন্দ করেন না, সে রকম উল্লেখ ওঁর শান্তিনিকেতনের প্রথমদিকের প্রবন্ধে কিছু পাওয়া যায়, কিন্ত্ত জোড়াসাঁকোতে বা শান্তিনিকেতনে নিজে কিছু ক'রে উঠতে পারেননি৷ নন্দবাবু যে পরিবর্তন আনলেন সেটাই শান্তিনিকেতনে পরবর্তী যুগে থেকে গেল'৷
শুধু নাটক বা নৃত্যনাট্য প্রযোজনার ক্ষেত্রেই নয়, আশ্রমিক জীবনচর্যার প্রাত্যহিকতাতেও নন্দলাল এক ধরনের সৌন্দর্যবোধ নিয়ে আসেন৷ শান্তিদেব সখেদে বলেন যে নন্দলালের ছাত্ররা অনেকেই পরবর্তী সময়ে বরেণ্য শিল্পী হয়েছেন, কিন্ত্ত কেউই নিজস্ব গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে সর্বকর্মে ব্যাপ্ত হতে চাননি৷ শান্তিনিকেতন নামক প্রতিষ্ঠানটির আরও চারটি কেজো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো হয়ে ওঠার অন্যতম সূত্রটি স্পষ্ট ভাবে বলা না হলেও তার প্রচ্ছন্ন আকারটি এই সাক্ষাত্কারের মধ্যে দিয়ে পাঠকের কাছে ধরা দেয়৷ বোঝা যায় নন্দলালের উত্তরসূরীরা অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় একটা সেট প্যাটার্ন অনুসরণ করে চলেন মাত্র৷ কাজেই সমসাময়িকতাকে উপেক্ষা করে একটা সময়ে শান্তিনিকেতনী প্রযোজনা হয়ে দাঁড়ায় এক ধরনের আনুষ্ঠানিকতা, যার পালেপার্বনে পর্যটক-মূল্য থাকলেও, সমসময়ের শিল্পজগতের দোলাচলের সম্পূর্ণ বাইরে থাকা এক ধরনের আর্কাইভ মেটিরিয়াল৷ আর এই সেট প্যাটার্ন মেনে চলা এক ধরনের পান-থেকে-চুন-খসলেই-সব-গেল মনোভাবের জন্ম দেয়, যা নন্দলালের উদারপন্থী ভাবধারার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে৷ যে উদারপন্থী ভাবধারা রামকিঙ্করের মতো অফঁ তেরিব্ল্-কে, তাঁর নতুন কিছু করার প্রবল ইচ্ছাকে সযত্নে লালন করে৷ প্রায় একই রকম অচলায়তনিক মনোবৃত্তি কি রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য প্রযোজনাকেও পরে গ্রাস করে না, যে প্রযোজনার প্রাথমিক রূপকার ছিলেন শান্তিদেব স্বয়ং?
এই সাক্ষাত্কার থেকেই জানতে পারি, সাম্প্রতিক সময়ের 'ফিউশন' নামক বালখিল্য হুজুগের বহু আগে শান্তিদেব কী ভাবে ভারত, এমন কী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নৃত্যশৈলীকে রবীন্দ্র-প্রযোজনায় অঙ্গীভূত করতে চাইছেন৷ যার মধ্যে ব্যালে থেকে কত্থক, জারিনাচ থেকে কথাকলি- সব ধারা মিশে যাচ্ছে৷ তৈরি হচ্ছে এক 'একলেক্টিক্' নৃত্যভাবনা৷ কিন্ত্ত তার বিরুদ্ধে শান্তিনিকেতনের মধ্য থেকেই বাধা ও আপত্তি উঠে আসছে৷ রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের গানের কাণ্ডারী স্বয়ং শান্তিদেবের বিরুদ্ধে শান্তিনিকেতনে ঘোঁট' পাকানো হচ্ছে, আগে-যে-রকম-হত-সে-রকম-হচ্ছে-না-কেন বলে প্রতিমা দেবী মারফত্ অনুযোগ করা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের কাছে৷ তখন রবীন্দ্রনাথই প্রতিমা দেবীকে বোঝাচ্ছেন, 'দ্যাখো বৌমা, যখন এ-নাচ প্রথম হয়েছিল, তারপরে এত বছর কেটে গেছে৷ এখন কলকাতার লোকদেরও নাচের দৃষ্টি অনেক বদলে গেছে, ওরা অনেক দেখছে, লিখছে, নাচছে- ওরা অনেকখানি এগিয়ে গেছে'৷ অর্থাত্, রবীন্দ্রনাথের জীবত্কালেই অচলায়তনের দুরারোগ্য ভাইরাসটি আশ্রমদেহে অনুপ্রবিষ্ট৷ রবীন্দ্রনাথ নামক বনস্পতি বিভিন্ন টানাপোড়েন, আপস-সমঝোতার মধ্য দিয়ে তাঁর প্রার্থিত চলিষ্ণুতাকে বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন৷ কাজেই বাহ্যত না হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে সাক্ষাত্কারটি 'মা কী ছিলেন, কী হইলেন এবং কেন হইলেন'-এর এক অন্তঃসলিলা ইতিবৃত্ত৷ অন্তত সাক্ষাত্কারটির একটি পাঠ এই রকমও হতে পারে৷
তবে বইটি আরও সুখপাঠ্য হত যদি মুদ্রণের ক্ষেত্রে আরও একটু যত্নের পরিচয় পাওয়া যেত৷ সম্পাদক 'উল্লেখ পরিচয়' অংশে যে ভাবে সংক্ষিপ্ত টীকা সংযোজন করেছেন, তা প্রশংসনীয়৷ কিন্ত্ত কিছু মুদ্রণ প্রমাদ বড়োই দৃষ্টিকটু৷ যেমন আলোকচিত্রের পরিচয় জানাতে গিয়ে 'পাণ্ডুলিপি' হয়েছে 'পীন্ডুলিপি', 'অভিনীত' হয়েছে 'সভিনীত' আর 'ইন্দ্র' হয়েছে 'ইন্দ'৷ আলোকচিত্রের সঙ্গে চিত্রগ্রাহকের নাম উল্লেখ না করার বদভ্যাসটি বর্জন করলেই বোধ হয় ভালো হত| রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির অংশ মুদ্রিত করা হয়েছে, কিন্ত্ত সাক্ষাত্কারের প্রেক্ষিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে কিছু লেখা থাকলে সংযোজিত অংশগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ হত৷
No comments:
Post a Comment