জগদীশ ভগবতী 'বনাম' অমর্ত্য সেন বিতর্ক, নাকি মিডিয়ার বানানো 'ঝগড়া'?
এ পর্যন্ত পড়ে গপ্পের ল্যাজামুড়ো নিয়ে যাঁদের বিভ্রান্তি যাচ্ছে না তাঁদের জন্যে উপলক্ষটা খোলসা করে বলি৷ বহুল প্রচারিত আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক 'দ্য ইকনমিস্ট' পত্রিকায় জঁ্য দ্রেজ ও অমর্ত্য সেন রচিত সম্প্রতি প্রকাশিত ভারত-বিষয়ক বই 'অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি'র আলোচনা বেরোয়৷ সেখানে জগদীশ ভগবতী ও অরবিন্দ পানাগরিয়া প্রণীত আর একটি ভারত-বিষয়ক সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ের প্রসঙ্গ আনেন আলোচক৷ তিনি মন্তব্য করেন, ভগবতী ও পানাগরিয়া শ্রম ও জমির বাজারে দ্রুত সংস্কার এনে আর্থনীতিক বৃদ্ধিকে আরও ঠেলে তোলার পক্ষে সওয়াল করেছেন, কারণ তাঁরা মনে করেন আর্থনীতিক বৃদ্ধির হার বাড়িয়েই দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং জীবনযাত্রা মান বাড়ানোর কথা ভাবতে হবে৷ এ প্রসঙ্গে আলোচক লেখেন, দ্রেজ এবং সেন 'আরও এগিয়ে ভাবতে চান'৷
এই 'আরও এগিয়ে' শব্দবন্ধই সম্ভবত ভগবতীকে উত্তেজিত করে৷ খুঁচিয়ে ঘা করার মতো৷ ভগবতী ও সেন দু'জনেই প্রায় সমবয়সী৷ দু'জনেই খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, এক সময়ে দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স-এ সহকর্মীও ছিলেন৷ ভগবতী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, বর্তমানে রয়েছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ আর অমর্ত্য সেন হার্ভার্ডে৷ দু'টিই যাকে বলে 'আইভি লিগ' বিশ্ববিদ্যালয়৷ অর্থাত্ সব মিলিয়ে দু'জনেই সমান ওজনদার৷ ফলে 'দ্য ইকনমিস্ট' পত্রিকায় পর পর এক সপ্তাহের ব্যবধানে এঁদের দু'টি পত্র প্রকাশিত হয় যখন, তত্ক্ষণাত্ খবর হয়ে যায়৷
কী ছিল পত্র দু'টিতে? ভগবতী লেখেন, 'সেন এবং দ্রেজ 'আরও এগিয়ে ভাবতে চান' এই মন্তব্যে আমি বিভ্রান্ত৷ সেন কখনওই আর্থনীতিক বৃদ্ধির সপক্ষে কোনও নীতির জন্যে সওয়াল করেননি৷ অতি সম্প্রতি অবশ্য বৃদ্ধির প্রতি 'আলগোছে উদাসীন ফুল ছঁুড়তে শিখেছেন' ('বিলেটেডলি লান্র্ট টু গিভ লিপ সার্ভিস টু গ্রোথ')৷' এর পর অমর্ত্য সেন আর নিশ্চুপ থাকতে পারেননি৷ ভগবতী দীর্ঘকাল ধরেই যে কোনও উপলক্ষে অমর্ত্য সেনকে এক হাত নিয়ে থাকেন৷ স্বাধীন ভারতের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯৭-এ 'টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্ট'-এর এক বিশেষ সংখ্যা বেরোয়৷ ভগবতী সেখানে স্বাধীনতা-উত্তর পরিকল্পিত অর্থনীতিকে বর্ণনা করেছেন 'এক পেছু হটার যন্ত্র' বলে৷ আর এমন আশ্চর্য যন্ত্রের পেছু হটার দক্ষতার জন্য তিনি পুরোপুরি দায়ী করেছেন অমর্ত্য সেন সহ অন্য ভারতীয় অর্থনীতিবিদদের, যাঁরা কোনও-না-কোনও ভাবে এই যন্ত্রে জ্বালানি জুগিয়ে গিয়েছেন বলে তিনি মনে করেন৷ বছর তিনেক পরে দেখছি পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন ভাষণে আবার অমর্ত্য সেনকে তুলোধোনা করেছেন৷ সমাবর্তন ভাষণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে ব্যক্তিবিশেষের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা শুধু অভূতপূর্বই নয়, অদ্ভুত৷ মজার ব্যাপার, ভগবতীর এই ধারাবাহিক আক্রমণ- হ্যাঁ আক্রমণই বলা যায় একে- এত কাল প্রায় এক তরফাই হয়ে এসেছে৷ এই প্রথম অমর্ত্য সেন প্রত্যুত্তর দিলেন ('সম্ভবত এই শেষ', সাক্ষাত্কারে বলেছেন তিনি)৷ বৃদ্ধির প্রতি ইদানীং 'লিপ সার্ভিস' দিতে শিখেছেন- কথাটি যথেষ্ট উস্কানিমূলক৷ ১৯৬০-এ তাঁর 'চয়েস অফ টেকনিক্স' থেকে ১৯৭০-এ তাঁর সম্পাদিত 'গ্রোথ ইকনমিকস'- এই গোটা সময়টা অমর্ত্য সরাসরি আর্থনীতিক বৃদ্ধি নিয়েই তত্ত্বালোচনায় রত ছিলেন৷ পরবর্তী কালেও তিনি কখনওই বলেননি যে মানবকল্যাণে আর্থনীতিক বৃদ্ধি অপ্রয়োজনীয়৷
অতএব, একজন বলছেন তুমি বৃদ্ধিকে কখনওই গুরুত্ব দাওনি, আর একজন বলছেন 'দিয়েছি'৷ এ ভাবে আর কতক্ষণ তর্ক চলতে পারে? অতএব, মোকদ্দমাটা তখনকার মতো হয়তো মিটেও যেত৷ কিন্ত্ত দু'দিন পরেই টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে অমর্ত্য সেনকে জিজ্ঞেস করা হয় নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আপনি কী বলেন৷ সেন স্পষ্টই জানিয়ে দেন তথাকথিত 'গুজরাট মডেল' নিয়ে তিনি উত্সাহিত নন৷ এবং নরেন্দ্র মোদীকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও চান না৷ ওদিকে জানুয়ারিতে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে ভগবতী নরেন্দ্র মোদী এবং গুজরাটের উন্নয়নের প্রভূত প্রশংসা করেছিলেন৷ ব্যস, দু'য়ে দু'য়ে চার হয়ে গেল৷ ভগবতী-বিজেপি, সেন-কংগ্রেস এমন নানা অদ্ভুত সমীকরণ আছড়ে পড়তে লাগল মিডিয়ার আঙিনায়৷ রাজনীতির ডামাডোলে পাণ্ডিত্যের সূক্ষ্ম যুক্তি খাবি খেতে থাকে৷ অমর্ত্য সেনের ভারতরত্ন কেড়ে নেওয়া উচিত এমন হুমকিও শোনা যায়৷
অমর্ত্য সেন এবং তাঁর সহযোগী জ্যঁ দ্রেজ যে ধরনের নীতির পক্ষে বার বার বলে থাকেন তার কিছু কিছু ইউ পি এ জমানায় যে করার চেষ্টা হয়েছে তা যেমন সত্যি, আবার যতটা করা উচিত ছিল তা হয়নি, দারিদ্র্য হ্রাস হয়েছে মন্থর গতিতে- এই সব নিয়ে কঠোর সমালোচনাও রয়েছে তাঁদের সাম্প্রতিক বইয়ে৷ নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা করছেন মানেই অমর্ত্য সেন রাহুলের সমর্থক- এমন যুক্তি উদ্ভট৷ আবার নরেন্দ্র মোদীর আমলে গুজরাটের আর্থনীতিক প্রগতির প্রশংসা করছেন বলেই ভগবতী মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান, এমন সিদ্ধান্তও সমান উদ্ভট৷ সংস্কার-উত্তর ভারতবর্ষে মনমোহন সিংহের নেতৃত্বেরও ভগবতী প্রশংসা করতেন এবং নিজেকে সহযোগী বলে মনে করতেন৷ দলীয় রাজনীতি এবং ২০১৪-র নির্বাচন এ সবের সঙ্গে সেন-ভগবতী বিতর্ককে জোর করে ঘেঁটে দিলে দু'জনের প্রতিই অবিচার করা হয়৷
রাজনীতির অনাবশ্যক মশলার ছিটে সরিয়ে নিলে বিতর্কের যে নির্যাসটুকু পড়ে থাকে তার গুরুত্ব কতটুকু? এখানে সে বিষয়ে কিঞ্চিত্ আলোচনা করা যাক৷
জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি উন্নয়নের ন্যূনতম শর্ত৷ এ বিষয়ে সেন ও ভগবতীর ভিন্ন মত থাকতে পারে না৷ তা হলে তর্কটা কোথায়? উন্নয়ন বলতে যদি দারিদ্র্য দূরীকরণ, নাগালের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এসব বোঝায়, তা হলেও জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি আবশ্যিক৷ জাতীয় উত্পাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকারের আয়ও বাড়ে, আর এই বর্ধিত আয় থেকে সরকার জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অন্যান্য অবশ্যপ্রয়োজনীয় বিষয়ে খরচা করতে পারে৷ 'করতে পারে' মানে যে 'করবেই' এমনটা অবশ্য বলা যায় না৷ এখানেই সম্ভবত তাঁরা ভিন্নমত৷ ভগবতী বলেন, আর্থনীতিক বৃদ্ধির সঙ্গে যা যা সুফল দেখতে পাওয়ার কথা সংস্কার-পরবর্তী ভারতবর্ষে, তা হয়েছে৷ দারিদ্র্য কমেছে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় উন্নতি হয়েছে৷ যতটা উন্নতি হওয়ার কথা তা যদি না হয়ে থাকে তার কারণ সংস্কারের রথ তেমন ছুটছে না৷ আরও উন্নতি চাইলে আরও সংস্কার চাই৷ সেন বলেন, বৃদ্ধি তো হল অনেক- প্রায় আড়াই দশক ধরে ছয়-সাত শতাংশ হারে৷ তবু মানুষের ন্যূনতম চাহিদাটুকু মিটল কই? দেশবাসীর অর্ধেকের জন্যে শৌচালয়ই নেই৷ স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় মোট জাতীয় উত্পাদনের দুই শতাংশেরও কম৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এর থেকে বেশি৷ সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়বৃদ্ধির পক্ষে সওয়ালকেই ভগবতী খানিক মুচড়িয়ে তাঁর আক্রমণ শানান৷ বলেন, অমর্ত্য সেন ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিতে চান৷ আগে বৃদ্ধি না আগে সরকারি ব্যয়বৃদ্ধি?
বৃদ্ধির লক্ষ্য আর পুনর্বণ্টনের মধ্যে যে সর্বদা বিরোধের সম্পর্কই দেখা যায় তা কিন্ত্ত নয়৷ ভূমিসংস্কার করে জমির পুনর্বণ্টন হলে যে মোট কৃষি উত্পাদন বেড়ে যেতে পারে তা অনেক দিন আগে থেকেই জানা আছে৷ গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে গবেষণায় দেখা গিয়েছে ছোটো জোতের উত্পাদনশীলতা বড়ো জোতের থেকে বেশি৷ পরবর্তী কালে শিক্ষা বা মানবপুঁজি নিয়ে গবেষণায়ও দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির বৃদ্ধির হারকে অনেকটাই মানবপুঁজি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে৷ অর্থাত্ সরকার যদি শিক্ষাপ্রসারে ব্যয় করে, তার ফলে আর্থনীতিক বৃদ্ধির হার বাড়তে পারে৷ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির অভিজ্ঞতায় এর প্রমাণ রয়েছে৷ ভগবতীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা যায় যে তিনি এ দিকটায় একেবারেই গুরুত্ব দিতে চান না৷
অর্থনীতির আলোচনায় ব্যক্তিবিশেষের বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়ার যে সংস্কৃতি আমাদের সমাজে চালু আছে তা যতটুকু হলে স্বাস্থ্যকর বলা যায় তা থেকে যেন বেশিই ছাড়িয়ে গিয়েছে৷ জ্ঞানচর্চায় আপ্তবাক্যের স্থান নেই৷ ভগবতী কিংবা সেন যখন তাঁদের গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তা কিন্ত্ত একটি সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়৷ তাঁদের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ সেমিনার-কনফারেন্সে সহকর্মীদের ফেলা সার্চলাইটের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ সামাজিক চেহারা পায়৷ তাঁদের বক্তব্য যখন গণপরিসরে এসে পড়ে তখনও তেমনই সামাজিক প্রক্রিয়া আমরা আশা করতে পারি৷ যা জাজমেন্টাল নয়, অ্যানালিটিকাল৷
লেখক ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, কলকাতা-র অধিকর্তা
এ পর্যন্ত পড়ে গপ্পের ল্যাজামুড়ো নিয়ে যাঁদের বিভ্রান্তি যাচ্ছে না তাঁদের জন্যে উপলক্ষটা খোলসা করে বলি৷ বহুল প্রচারিত আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক 'দ্য ইকনমিস্ট' পত্রিকায় জঁ্য দ্রেজ ও অমর্ত্য সেন রচিত সম্প্রতি প্রকাশিত ভারত-বিষয়ক বই 'অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি'র আলোচনা বেরোয়৷ সেখানে জগদীশ ভগবতী ও অরবিন্দ পানাগরিয়া প্রণীত আর একটি ভারত-বিষয়ক সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ের প্রসঙ্গ আনেন আলোচক৷ তিনি মন্তব্য করেন, ভগবতী ও পানাগরিয়া শ্রম ও জমির বাজারে দ্রুত সংস্কার এনে আর্থনীতিক বৃদ্ধিকে আরও ঠেলে তোলার পক্ষে সওয়াল করেছেন, কারণ তাঁরা মনে করেন আর্থনীতিক বৃদ্ধির হার বাড়িয়েই দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং জীবনযাত্রা মান বাড়ানোর কথা ভাবতে হবে৷ এ প্রসঙ্গে আলোচক লেখেন, দ্রেজ এবং সেন 'আরও এগিয়ে ভাবতে চান'৷
এই 'আরও এগিয়ে' শব্দবন্ধই সম্ভবত ভগবতীকে উত্তেজিত করে৷ খুঁচিয়ে ঘা করার মতো৷ ভগবতী ও সেন দু'জনেই প্রায় সমবয়সী৷ দু'জনেই খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, এক সময়ে দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স-এ সহকর্মীও ছিলেন৷ ভগবতী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, বর্তমানে রয়েছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ আর অমর্ত্য সেন হার্ভার্ডে৷ দু'টিই যাকে বলে 'আইভি লিগ' বিশ্ববিদ্যালয়৷ অর্থাত্ সব মিলিয়ে দু'জনেই সমান ওজনদার৷ ফলে 'দ্য ইকনমিস্ট' পত্রিকায় পর পর এক সপ্তাহের ব্যবধানে এঁদের দু'টি পত্র প্রকাশিত হয় যখন, তত্ক্ষণাত্ খবর হয়ে যায়৷
কী ছিল পত্র দু'টিতে? ভগবতী লেখেন, 'সেন এবং দ্রেজ 'আরও এগিয়ে ভাবতে চান' এই মন্তব্যে আমি বিভ্রান্ত৷ সেন কখনওই আর্থনীতিক বৃদ্ধির সপক্ষে কোনও নীতির জন্যে সওয়াল করেননি৷ অতি সম্প্রতি অবশ্য বৃদ্ধির প্রতি 'আলগোছে উদাসীন ফুল ছঁুড়তে শিখেছেন' ('বিলেটেডলি লান্র্ট টু গিভ লিপ সার্ভিস টু গ্রোথ')৷' এর পর অমর্ত্য সেন আর নিশ্চুপ থাকতে পারেননি৷ ভগবতী দীর্ঘকাল ধরেই যে কোনও উপলক্ষে অমর্ত্য সেনকে এক হাত নিয়ে থাকেন৷ স্বাধীন ভারতের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯৭-এ 'টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্ট'-এর এক বিশেষ সংখ্যা বেরোয়৷ ভগবতী সেখানে স্বাধীনতা-উত্তর পরিকল্পিত অর্থনীতিকে বর্ণনা করেছেন 'এক পেছু হটার যন্ত্র' বলে৷ আর এমন আশ্চর্য যন্ত্রের পেছু হটার দক্ষতার জন্য তিনি পুরোপুরি দায়ী করেছেন অমর্ত্য সেন সহ অন্য ভারতীয় অর্থনীতিবিদদের, যাঁরা কোনও-না-কোনও ভাবে এই যন্ত্রে জ্বালানি জুগিয়ে গিয়েছেন বলে তিনি মনে করেন৷ বছর তিনেক পরে দেখছি পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন ভাষণে আবার অমর্ত্য সেনকে তুলোধোনা করেছেন৷ সমাবর্তন ভাষণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে ব্যক্তিবিশেষের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা শুধু অভূতপূর্বই নয়, অদ্ভুত৷ মজার ব্যাপার, ভগবতীর এই ধারাবাহিক আক্রমণ- হ্যাঁ আক্রমণই বলা যায় একে- এত কাল প্রায় এক তরফাই হয়ে এসেছে৷ এই প্রথম অমর্ত্য সেন প্রত্যুত্তর দিলেন ('সম্ভবত এই শেষ', সাক্ষাত্কারে বলেছেন তিনি)৷ বৃদ্ধির প্রতি ইদানীং 'লিপ সার্ভিস' দিতে শিখেছেন- কথাটি যথেষ্ট উস্কানিমূলক৷ ১৯৬০-এ তাঁর 'চয়েস অফ টেকনিক্স' থেকে ১৯৭০-এ তাঁর সম্পাদিত 'গ্রোথ ইকনমিকস'- এই গোটা সময়টা অমর্ত্য সরাসরি আর্থনীতিক বৃদ্ধি নিয়েই তত্ত্বালোচনায় রত ছিলেন৷ পরবর্তী কালেও তিনি কখনওই বলেননি যে মানবকল্যাণে আর্থনীতিক বৃদ্ধি অপ্রয়োজনীয়৷
অতএব, একজন বলছেন তুমি বৃদ্ধিকে কখনওই গুরুত্ব দাওনি, আর একজন বলছেন 'দিয়েছি'৷ এ ভাবে আর কতক্ষণ তর্ক চলতে পারে? অতএব, মোকদ্দমাটা তখনকার মতো হয়তো মিটেও যেত৷ কিন্ত্ত দু'দিন পরেই টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে অমর্ত্য সেনকে জিজ্ঞেস করা হয় নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আপনি কী বলেন৷ সেন স্পষ্টই জানিয়ে দেন তথাকথিত 'গুজরাট মডেল' নিয়ে তিনি উত্সাহিত নন৷ এবং নরেন্দ্র মোদীকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও চান না৷ ওদিকে জানুয়ারিতে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে ভগবতী নরেন্দ্র মোদী এবং গুজরাটের উন্নয়নের প্রভূত প্রশংসা করেছিলেন৷ ব্যস, দু'য়ে দু'য়ে চার হয়ে গেল৷ ভগবতী-বিজেপি, সেন-কংগ্রেস এমন নানা অদ্ভুত সমীকরণ আছড়ে পড়তে লাগল মিডিয়ার আঙিনায়৷ রাজনীতির ডামাডোলে পাণ্ডিত্যের সূক্ষ্ম যুক্তি খাবি খেতে থাকে৷ অমর্ত্য সেনের ভারতরত্ন কেড়ে নেওয়া উচিত এমন হুমকিও শোনা যায়৷
অমর্ত্য সেন এবং তাঁর সহযোগী জ্যঁ দ্রেজ যে ধরনের নীতির পক্ষে বার বার বলে থাকেন তার কিছু কিছু ইউ পি এ জমানায় যে করার চেষ্টা হয়েছে তা যেমন সত্যি, আবার যতটা করা উচিত ছিল তা হয়নি, দারিদ্র্য হ্রাস হয়েছে মন্থর গতিতে- এই সব নিয়ে কঠোর সমালোচনাও রয়েছে তাঁদের সাম্প্রতিক বইয়ে৷ নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা করছেন মানেই অমর্ত্য সেন রাহুলের সমর্থক- এমন যুক্তি উদ্ভট৷ আবার নরেন্দ্র মোদীর আমলে গুজরাটের আর্থনীতিক প্রগতির প্রশংসা করছেন বলেই ভগবতী মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান, এমন সিদ্ধান্তও সমান উদ্ভট৷ সংস্কার-উত্তর ভারতবর্ষে মনমোহন সিংহের নেতৃত্বেরও ভগবতী প্রশংসা করতেন এবং নিজেকে সহযোগী বলে মনে করতেন৷ দলীয় রাজনীতি এবং ২০১৪-র নির্বাচন এ সবের সঙ্গে সেন-ভগবতী বিতর্ককে জোর করে ঘেঁটে দিলে দু'জনের প্রতিই অবিচার করা হয়৷
রাজনীতির অনাবশ্যক মশলার ছিটে সরিয়ে নিলে বিতর্কের যে নির্যাসটুকু পড়ে থাকে তার গুরুত্ব কতটুকু? এখানে সে বিষয়ে কিঞ্চিত্ আলোচনা করা যাক৷
জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি উন্নয়নের ন্যূনতম শর্ত৷ এ বিষয়ে সেন ও ভগবতীর ভিন্ন মত থাকতে পারে না৷ তা হলে তর্কটা কোথায়? উন্নয়ন বলতে যদি দারিদ্র্য দূরীকরণ, নাগালের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এসব বোঝায়, তা হলেও জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি আবশ্যিক৷ জাতীয় উত্পাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকারের আয়ও বাড়ে, আর এই বর্ধিত আয় থেকে সরকার জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অন্যান্য অবশ্যপ্রয়োজনীয় বিষয়ে খরচা করতে পারে৷ 'করতে পারে' মানে যে 'করবেই' এমনটা অবশ্য বলা যায় না৷ এখানেই সম্ভবত তাঁরা ভিন্নমত৷ ভগবতী বলেন, আর্থনীতিক বৃদ্ধির সঙ্গে যা যা সুফল দেখতে পাওয়ার কথা সংস্কার-পরবর্তী ভারতবর্ষে, তা হয়েছে৷ দারিদ্র্য কমেছে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় উন্নতি হয়েছে৷ যতটা উন্নতি হওয়ার কথা তা যদি না হয়ে থাকে তার কারণ সংস্কারের রথ তেমন ছুটছে না৷ আরও উন্নতি চাইলে আরও সংস্কার চাই৷ সেন বলেন, বৃদ্ধি তো হল অনেক- প্রায় আড়াই দশক ধরে ছয়-সাত শতাংশ হারে৷ তবু মানুষের ন্যূনতম চাহিদাটুকু মিটল কই? দেশবাসীর অর্ধেকের জন্যে শৌচালয়ই নেই৷ স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় মোট জাতীয় উত্পাদনের দুই শতাংশেরও কম৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এর থেকে বেশি৷ সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়বৃদ্ধির পক্ষে সওয়ালকেই ভগবতী খানিক মুচড়িয়ে তাঁর আক্রমণ শানান৷ বলেন, অমর্ত্য সেন ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিতে চান৷ আগে বৃদ্ধি না আগে সরকারি ব্যয়বৃদ্ধি?
বৃদ্ধির লক্ষ্য আর পুনর্বণ্টনের মধ্যে যে সর্বদা বিরোধের সম্পর্কই দেখা যায় তা কিন্ত্ত নয়৷ ভূমিসংস্কার করে জমির পুনর্বণ্টন হলে যে মোট কৃষি উত্পাদন বেড়ে যেতে পারে তা অনেক দিন আগে থেকেই জানা আছে৷ গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে গবেষণায় দেখা গিয়েছে ছোটো জোতের উত্পাদনশীলতা বড়ো জোতের থেকে বেশি৷ পরবর্তী কালে শিক্ষা বা মানবপুঁজি নিয়ে গবেষণায়ও দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির বৃদ্ধির হারকে অনেকটাই মানবপুঁজি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে৷ অর্থাত্ সরকার যদি শিক্ষাপ্রসারে ব্যয় করে, তার ফলে আর্থনীতিক বৃদ্ধির হার বাড়তে পারে৷ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির অভিজ্ঞতায় এর প্রমাণ রয়েছে৷ ভগবতীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা যায় যে তিনি এ দিকটায় একেবারেই গুরুত্ব দিতে চান না৷
অর্থনীতির আলোচনায় ব্যক্তিবিশেষের বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়ার যে সংস্কৃতি আমাদের সমাজে চালু আছে তা যতটুকু হলে স্বাস্থ্যকর বলা যায় তা থেকে যেন বেশিই ছাড়িয়ে গিয়েছে৷ জ্ঞানচর্চায় আপ্তবাক্যের স্থান নেই৷ ভগবতী কিংবা সেন যখন তাঁদের গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তা কিন্ত্ত একটি সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়৷ তাঁদের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ সেমিনার-কনফারেন্সে সহকর্মীদের ফেলা সার্চলাইটের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ সামাজিক চেহারা পায়৷ তাঁদের বক্তব্য যখন গণপরিসরে এসে পড়ে তখনও তেমনই সামাজিক প্রক্রিয়া আমরা আশা করতে পারি৷ যা জাজমেন্টাল নয়, অ্যানালিটিকাল৷
লেখক ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, কলকাতা-র অধিকর্তা
No comments:
Post a Comment